আল্লাহর প্রতি ঈমান সম্পর্কে আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা বলেন

وَالْمُؤْمِنُونَ ۚ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ

“আর মুমিনরা প্রত্যেকেই আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখে।” (সূরা আল-বাকারা : ২৮৫)। আরও বলা হয়েছে

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا آمِنُوا بِاللَّهِ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রাখো।' (সূরা আন নিসা : ১৩৬)

সহীহ আল-বুখারী ও সহীহ মুসলিমে[১] আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। নবী করীম (সা.) বলেছেন

أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَقُولُوا: لاَ إِلٰهَ إِلاَّ الله. فَمَنْ قَالَ: لاَ إِلٰهَ إِلاَّ الله فَقَدْ عَصَمَ مِنِّي مَالَهُ وَنَفْسَهُ إِلاَّ بِحَقِّهِ، وَحِسَابُهُ عَلَى الله

“যতক্ষণ মানুষ এ সাক্ষ্য না দেবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই', ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আদিষ্ট হয়েছি। কাজেই যে ব্যক্তি স্বীকার করে নেবে যে, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই’ সে আমার থেকে তার জীবন ও সম্পদকে নিরাপদ করে নিল। তবে শরীআহসম্মত কোনো কারণ ঘটলে তা ভিন্ন কথা। আর তার (কৃতকর্মের) হিসাব-নিকাশ আল্লাহর কাছে।”

উসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস মুসলিম শরীফে সংকলন করা হয়েছে। তাতে নবী করীম (সা.) বলেছেন

مَن ماتَ وهو يَعْلَمُ أنَّه لا إلَهَ إلَّا اللَّهُ، دَخَلَ الجَنَّةَ

“যে ব্যক্তি এই বিশ্বাস নিয়ে মারা যাবে- আল্লাহ ছাড়া আর কোনো ইলাহ্ নেই, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।”[২]

[১].ইমাম বুখারী যাকাত অধ্যায়ে এবং ইমাম মুসলিম ঈমান অধ্যায়ে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।

[২]. সহীহু মুসলিম, 'যে ব্যক্তি তাওহীদের উপর ইন্তিকাল করবে সে জান্নাতী অনুচ্ছেদ, ঈমান অধ্যায়।
শাখা-২, ৩, ৪. রাসূলগণের প্রতি, ফেরেশতাদের প্রতি ও আল-কুরআনের উপর ঈমান

ঈমানের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অংশ বা শাখা হচ্ছে নবী-রাসূল, ফেরেশতা এবং আল্লাহ প্রদত্ত কিতাবসমূহের উপর ঈমান আনা। আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা ইরশাদ করেন

وَالْمُؤْمِنُونَ ۚ كُلٌّ آمَنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ

‘এবং সকল মুমিন— আল্লাহ্, ফেরেশতা, কিতাবসমূহ এবং নবীদের উপর ঈমান আনে।[১]

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস- যা হাদীসে জিবরীল নামে খ্যাত সেখানে জিবরীল (আঃ)-এর এক প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে

الْإِيمَانُ قَالَ أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ

“ঈমান হচ্ছে- আল্লাহ্, ফেরেশতা, কিতাবসমূহ ও রাসূলগণের উপর তোমার ঈমান আনয়ন।[২]

কিতাবসমূহের উপর ঈমান আনার সাথে সাথে আল-কুরআনের উপর ঈমান আনাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছেঃ

“হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি ঈমান আনো এবং সেই কিতাবের (কুরআনের) প্রতিও যা তাঁর রাসূলের উপর নাযিল করেছেন, সেই সাথে আগে যেসব কিতাব নাযিল হয়েছিল সেগুলোর প্রতিও।[৩]

[১]. সূরা আল-বাকারা : ২৮৫।

[২]. হাদীসটি সহীহ আল-বুখারীতে আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে এবং সহীহ মুসলিম উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে। পুরো হাদীসটি নিম্নরূপঃ

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেছেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ্ (সা.)-এর কাছে ছিলাম। একজন লোক এলেন। তার পরনের কাপড় ছিলো সাদা ধবধবে, মাথার চুলগুলো ছিলো কাল কুচকুচে। তিনি অনেক দূর থেকে সফর করে এসেছেন, দেখে এমন মনে হলো না, কিন্তু আমরা কেউ তাকে চিনলাম না। এসে নিজের হাঁটুদ্বয় নবী করীম (সা.)-এর হাঁটুদ্বয়ের সাথে লাগিয়ে বসে পড়লেন। দুহাত নবী করীম (সা.)-এর উরুর উপর রাখলেন। তারপর বললেনঃ হে মুহাম্মদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন- ইসলাম হলো তুমি এ কথার সাক্ষ্য দেবে যে, আল্লাহ্ ছাড়া আর কোনো ইলাহ্ নেই, মুহাম্মদ আল্লাহর রাসূল, সালাত কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে, রমযানের রোযা রাখবে এবং বাইতুল্লাহ পৌঁছার সামর্থ্য থাকলে হজ্জ করবে। আগন্তুক বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন।

তার কথা শুনে আমরা বিস্মিত হলাম, কী আশ্চর্য! প্রশ্নও করছেন আবার সত্যায়িতও করছেন। তারপর বললেনআমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ঈমান হচ্ছে- তুমি আল্লাহ্, ফেরেশতা, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, আখিরাত এবং তাকদীরের ভালোমন্দের ব্যাপারে ঈমান রাখবে। আগন্তুক বললেন- আপনি ঠিকই বলেছেন। তারপর বললেন- আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন। নবী করীম (সা.) বললেন, ইহসান হচ্ছে- তুমি আল্লাহকে দেখছে এই অনুভূতি নিয়ে ইবাদাত-বন্দেগী করবে। যদি তাকে নাও দেখ মনে করবে তিনি তো তোমাকে দেখছেন। এবার আগন্তুক বললেন, কিয়ামত সম্পর্কে কিছু বলুন। রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বললেন, এ বিষয়ে প্রশ্নকারীর চেয়ে যাকে প্রশ্ন করা হয়েছে তিনি (উত্তরদাতা) বেশী কিছু জানেন না।

তিনি বললেন, আমাকে এর কিছু নিদর্শন সম্পর্কে বলুন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন- দাসী তার মনিবকে প্রসব করবে। খালি পা উদাম গা এরূপ দরিদ্র মেষের রাখালদেরকে অট্টালিকা নির্মাণে পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত দেখতে পাবে। আগন্তুক প্রস্থান করলেন। আমিও বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন- উমার! তুমি কি জাননা প্রশ্নকারী কে? বললাম- আল্লাহ ও তার রাসূলই এ সম্পর্কে ভালো জানেন। নবী করীম (সা.) বললেন, তিনি জিবরীল, তোমাদেরকে তোমাদের দীন শেখাতে এসেছিলেন। (সহীহ মুসলিম)।

[৩]. সূরা আন-নিসা, আয়াত : ১৩৬।

ভালো হোক কিংবা মন্দ, সবকিছুই যে আল্লাহর পক্ষ থেকে পূর্ব নির্ধারিত এ কথার উপর ঈমান রাখা। আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা ইরশাদ করেন

قُلْ كُلٌّ مِّنْ عِندِ اللَّهِ

বলুন, সবকিছুই আল্লাহর পক্ষ থেকে।[১]

সহীহ আল-বুখারী ও সহীহ্ মুসলিমে আবু হুরাইরা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে- (নবী করীম সা. বলেছেন) একবার আদম (আঃ) ও মূসা (আঃ)-এর মধ্যে বিতর্ক হয়েছিলো। মূসা (আঃ) বললেন- হে আদম! আপনি আমাদের পিতা। আমাদেরকে বঞ্চিত করেছেন এবং জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছেন। আদম (আঃ) বললেন- আপনি তো মূসা! আল্লাহ্ তা'আলা আপনার সাথে কথা বলে আপনাকে সম্মানিত করেছেন। লিখিত কিতাব (তাওরাত) দিয়েছেন। আপনি কি এমন বিষয়ে আমাকে তিরস্কার করছেন যা আল্লাহ্ আমাকে সৃষ্টি করার চল্লিশ বছর আগে নির্ধারণ করে রেখেছিলেন? আদম (আঃ) মূসা (আঃ)-এর উপর বিতর্কে বিজয়ী হলেন।[২]

জুনাইদ ইবনু আহমদ আতাবারী থেকে বর্ণনা পরম্পরায় আবু বকর আল বাইহাকী নিম্নোক্ত কবিতাটি জানতে পেরেছেন।

নিয়তি নির্ধারিত বলে স্রষ্টার প্রতি

মানুষের কত না অভিযোগ,

সময়ের পরিবর্তনে সবকিছুই যাবে হারিয়ে

রবে না কোনোই সুযোগ।

ভালো মন্দ রিযিক দৌলত সবকিছু সে তো

মহান স্রষ্টারই হাত

তবু নিন্দুকেরা কেবল তারই নিন্দা করে।

চলছে দিন রাত।

[১]. সূরা আন-নিসা, আয়াত : ৭৮।

[২]. হাদীসটি সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে তাকদীর অধ্যায়ে ‘আদম ও মূসা-এর বিতর্ক শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে।

আখিরাত বা পরকালের ব্যাপারে বিশ্বাস রাখাও ঈমানের অংশ। এ সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন,

قَاتِلُوا الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَلَا بِالْيَوْمِ الْآخِرِ

‘তোমরা তাদের সাথে যুদ্ধ কর, যারা আল্লাহ ও পরকালকে বিশ্বাস করে না।”[১]

হুলাইমী[২] বলেন, অবশ্যই একদিন এই দুনিয়া শেষ হয়ে যাবে। একদিন একদিন করে মূলত পৃথিবী সেই দিনটির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যা হঠাৎ করে এসে হাজির হবে। সেই দিনটিকে পাশ কাটানোর কোনো উপায়ই নেই। সহীহ্ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (সা.) বলেছেন- যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ তার শপথ! কিয়ামত অবশ্যই সংঘটিত হবে। দোকানদার ও খরিদ্দার কাপড় দর দাম করে মূল্য পরিশোধের আগেই তা সংঘটিত হয়ে যাবে।'[৩]

[১]. সূরা আত তাওবা, আয়াত : ২৯।

[২]. পুরো নাম আল হসাইন ইবনু আল হাসান হুলাইমী (হি-৩৩৮-৪০৩)। শাফিঈ মাযহাবের অনুসারী। ইমাম বাইহাকীর শিক্ষক। তার অন্যতম গবেষণা হচ্ছে ‘আল মিনহাজ ফী শুআবুল ঈমান'। ইমাম বাইহাকী এই গ্রন্থটির অনুকরণেই শুআবুল ঈমান' গ্রন্থটি রচনা করেন। টীকা- ইমাম কাযভিনী।

[৩]. সহীহ্ আল বুখারী, সহীহ মুসলিম।

মৃত্যুর পর পুনরায় জীবিত করা হবে এ আস্থা রাখা। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা নিজেই বলেন,

زَعَمَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَن لَّن يُبْعَثُوا ۚ قُلْ بَلَىٰ وَرَبِّي لَتُبْعَثُنَّ

‘অবিশ্বাসীরা ভেবে নিয়েছে তাদেরকে আর কখনও জীবিত করে উঠানো হবে না। বলে দিন, হা, অবশ্যই আমার প্রতিপালক তোমাদেরকে পুনরায় জীবন দান করে উঠাবেন।[১]

অন্যত্র বলা হয়েছে

قُلِ اللَّهُ يُحْيِيكُمْ ثُمَّ يُمِيتُكُمْ ثُمَّ يَجْمَعُكُمْ إِلَىٰ يَوْمِ الْقِيَامَةِ لَا رَيْبَ فِيهِ

বলুন, আল্লাহই তোমাদেরকে জীবন দান করেন এবং মৃত্যু দেন। কিয়ামতের দিন পুনরায় তোমাদেরকে একত্রিত করবেন। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই।'[২]

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক সহীহ্ হাদীসে বলা হয়েছেঃ

الإيمان أن تؤمن بالله وملائكته وكتبه ورسله وبالبعث من بعد الموت وبالقدر كله

‘আল্লাহ্, ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, নবী-রাসূলগণ, মৃত্যুর পর পুনরুত্থান এবং তাকদীরের ভালো মন্দের প্রতি তোমার আস্থার নাম হচ্ছে ঈমান।

[১]. সূরা আত তাগাবুন, আয়াত ৭।

[২]. সূরা আল জাসিয়া, আয়াত : ২৬।

সকল মানুষকে একদিন কবর থেকে জীবিত করে একত্রিত করা হবে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় (যার নাম হাশরের ময়দান), এ কথার উপর বিশ্বাস রাখা হচ্ছে ঈমানের অংশ। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন,

أَلَا يَظُنُّ أُولَٰئِكَ أَنَّهُم مَّبْعُوثُونَ ٭ لِيَوْمٍ عَظِيمٍ ٭ يَوْمَ يَقُومُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ

তারা কি চিন্তা করে না যে, পুনরুত্থিত হবে। সেই মহাদিবসে। যেদিন মানুষ দাঁড়াবে বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে।[১]

আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে বলা হয়েছে,

يقوم الناس لرب العالمين حتى يغيب أحدهم في رشْحه

মানুষ বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে দাঁড়াবে। তখন তারা ঘামে ডুবে থাকবে।

[১]. সূরা আল মুতাফফিফীন, আয়াত : ৪, ৫, ৬।
শাখা-৯. মুমিনের আবাসস্থল জান্নাত আর কাফিরের আবাসস্থল জাহান্নাম

পরকালিন জীবনে মুমিন এবং কাফিরের আবাসস্থল হবে যথাক্রমে জান্নাত ও জাহান্নাম, এ বিষয়ে আস্থা রাখা। আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা বলেন

بَلَىٰ مَن كَسَبَ سَيِّئَةً وَأَحَاطَتْ بِهِ خَطِيئَتُهُ فَأُولَٰئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ * وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَٰئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ ۖ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ

“হাঁ, যে ব্যক্তি পাপ উপার্জন করেছে এবং পাপ তাকে ঘিরে নিয়েছে, তারা জাহান্নামের অধিবাসী। সেটি তাদের স্থায়ী আবাস। আর যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কাজ করেছে, তারা জান্নাতের অধিবাসী। তারা চিরদিন সেখানেই থাকবে।[১]

আবদুল্লাহ্ ইবনু উমার (রাঃ) থেকে সহীহ্ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বলা হয়েছে, নবী করীম (সা.) বলেছেন

ان أحدكم اذا مات عرض عليه مقعده بالغداة والعشى ان كان من أهل الجنة فمن أهل الجنة وان كان من أهل النار فمن أهل النار يقال هذا مقعدك حتى يبعثك الله تعالى الى يوم القيامة

“তোমাদের কারও মৃত্যু হলে সকাল সন্ধ্যায় তাকে তার আবাসস্থল দেখানো হয়। জান্নাতী হলে জান্নাত আর জাহান্নামী হলে জাহান্নাম। বলা হবে এটিই তোমার আবাসস্থল। এভাবে কিয়ামত পর্যন্ত চলতে থাকবে।[২]

[১]. সূরা আল বাকারা, আয়াত : ৮১।

[২]. সহীহ আল বুখারী, জানাযা অধ্যায়; সহীহ মুসলিম, জান্নাত, জান্নাতের নিয়ামত ও জান্নাতবাসীদের বিবরণ অধ্যায়।
শাখা-১০. আল্লাহর প্রতি গভীর ভালোবাসা

আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলার প্রতি গভীর ভালোবাসা ঈমানেরই অন্যতম অংশ। কালামে হাকীমে বলা হয়েছে,

وَمِنَ النَّاسِ مَن يَتَّخِذُ مِن دُونِ اللَّهِ أَندَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ ۖ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِّلَّهِ

‘মানুষের মধ্যে এমনও রয়েছে যারা অন্যকে আল্লাহর মত মনে করে এবং তাদেরকে সেই রকম ভালোবাসে যেমন ভালোবাসা হয় আল্লাহকে। অথচ যারা ঈমানদার তারা আল্লাহকেই সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে।[১]

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত সহীহ্ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমের এক হাদীসে বলা হয়েছে, নবী করীম (সা.) বলেছেন,

ثلاث من كن فيه وجد بهن حلاوة الإيمان من كان الله ورسوله أحب إليه مما سواهما وان يحب المرء لا يحبه إلا الله وان يكره أن يعود في الكفر بعد أن أنقذه الله منه كما يكره أن يقذف في النار

‘তিনটি জিনিস যার মধ্যে রয়েছে, সে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ অনুভব করতে পেরেছে। ১. যার কাছে আল্লাহ্ ও তার রাসূল (সা.) সবচেয়ে বেশী প্রিয়। ২. কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই অন্যকে ভালোবাসে। ৩. যাকে আল্লাহ্ কুফর থেকে মুক্তি দিয়েছেন, সে পুনরায় কুফরের দিকে ফিরে যাওয়াকে এমন অপছন্দ করে যেমন অপছন্দ করে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে।[২]

আল সারী আস সাকাতীকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, আপনি কেমন আছেন? উত্তরে তিনি নিচের চরণটি আবৃত্তি করেছিলেনঃ

যে জন বুঝে না ভালোবাসা কী

সে কি কখনো হয় রে ব্যাকুল,

সে তো জানেনা কী জ্বালা বিরহে

এ যে হৃদয়ে রণাঙ্গন॥

আবু দুজানা বলেছেন, রাবেয়া বসরী যখন আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন হতেন, তখন নিচের কবিতাটি আবৃত্তি করতেনঃ

তুমি ভান করবে আল্লাহকে ভালোবাসার

আর অমান্য করবে নির্দেশ তাঁর

এ যে ভালোবাসার নামে ভণ্ডামী

দু’জনের মাঝে অথৈ পারাবার

তুমি যদি ভালোই বাসো তাঁকে, তবে-

হওনা কেন অনুগত তাঁর,

প্রেমিকরা তো চিরকাল অনুরাগের বাঁধনে

বাধা থাকে দুজন দুজনার॥

[১]. সূরা আল বাকারা, আয়াত : ১৬৫।

[২]. সহীহ্ আল বুখারী, ঈমান অধ্যায়; যে গুণে গুণান্বিত হলে ঈমানের স্বাদ পাওয়া যায় শিরোনামে। সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায়; যেসব গুণে গুণান্বিত হলে ঈমানের স্বাদ পাওয়া যায়' শিরোনাম। অবশ্য সহীহ মুসলিমের হাদীসে দুয়েকটি শব্দের পার্থক্যও রয়েছে।
শাখা-১১. মনে সদা আল্লাহর ভয় জাগ্রত থাকা

মনে সর্বদা আল্লাহর ভয় জাগ্রত থাকাও ঈমানের আরেকটি অংশ। আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা ইরশাদ করেন

فَلَا تَخَافُوهُمْ وَخَافُونِ إِن كُنتُم مُّؤْمِنِينَ

‘তোমরা যদি মুমিন-ই হয়ে থাক, তাহলে তাদেরকে নয় আমাকেই ভয় কর।[১]

فَلَا تَخْشَوُا النَّاسَ وَاخْشَوْنِ

‘তোমরা মানুষকে ভয় করো না, আমাকে ভয় কর।[২]

وَإِيَّايَ فَارْهَبُونِ

‘আর ভয় কেবলমাত্র আমাকেই কর।[৩]

অন্য জায়গায় আল্লাহভীতিকে মুমিনের বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন,

وَهُم مِّنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ

‘তারা সর্বদা আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত।[৪]

وَيَدْعُونَنَا رَغَبًا وَرَهَبًا ۖ وَكَانُوا لَنَا خَاشِعِينَ

তারা ভয় ও আশা নিয়ে আমাকে ডাকতো এবং তারাই ছিলো আমার কাছে বিনয়ী।[৫]

যারা আক্ষরিক অর্থেই আল্লাহকে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে পুরস্কার। ইরশাদ হচ্ছে

وَلِمَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ جَنَّتَانِ

“যে ব্যক্তি আল্লাহর সামনে একদিন দাঁড়াতে হবে, এই ভয় রাখে, তার জন্য রয়েছে (জান্নাতে) দুটো বাগান।[৬]

ذَٰلِكَ لِمَنْ خَافَ مَقَامِي وَخَافَ وَعِيدِ

যারা আমাকে এবং আমার আযাবের ওয়াদাকে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে এ মর্যাদা।[৭]

সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আদী ইবনু হাতিম (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, নবী করীম (সা.) বলেছেন,

اتقوا النار ولو بشق تمرة

‘তোমরা এক টুকরা খেজুরের বিনিময়ে হলেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো।”[৮]

আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন

لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيلًا وَلَبَكَيْتُمْ كَثِيرًا

‘আমি যা জানি তা যদি তোমরা জানতে তাহলে কম হাসতে এবং বেশী কাঁদতে।”[৯]

একবার এক ব্যক্তি তার বন্ধুকে জোরে জোরে কাঁদতে দেখে ভর্ৎসনা করলেন, কিন্তু তিনি বিরত না হয়ে কেঁদেই চললেন। কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলেনঃ

‘আমি কাঁদি কারণ, আমার গুনাহ্ অনেক

যারা গুনাহগার তাদের প্রত্যেকেরই কাদা উচিত।

যদি আমি নিশ্চিত হতে পারতাম, দুঃশ্চিন্তা আমার

দূর করে দেবে ক্রন্দন

তাহলে কেঁদে কেঁদে চোখ দিয়ে ঝরাতাম রক্ত।

অন্য এক কবি বলেছেনঃ

কি করে মানুষ ঘুমায় নিশ্চিন্তে সে কি জানে না

ভয়াবহ এক সময় অপেক্ষমান সম্মুখে তার?

যে জানে সে তো অলক্ষে সবার

সিজদায় কাটায় প্রহর, ছেড়ে আরামের বিছানা।'

[১]. সূরা তাওবা, আয়াত : ১৭৫।

[২]. সূরা আল মায়িদা, আয়াত : ৪৪।

[৩]. সূরা আল বাকারা, আয়াত : ৪০।

[৪]. সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত : ২৮।

[৫]. সূরা আল আম্বিয়া, আয়াত : ৯০।

[৬]. সূরা আর রাহমান, আয়াত : ৪৬।

[৭]. সূরা ইবরাহীম, আয়াত : ১৪।

[৮]. সহীহ্ আল বুখারী, যাকাত অধ্যায়; সহীহ মুসলিম, যাকাত অধ্যায়।

[৯]. মুসনাদ আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনু মাজা।
শাখা-১২. আল্লাহর প্রতি সু-ধারণা রাখা

আল্লাহ্‌র প্রতি সু-ধারণা রাখা এবং তাঁর রহমতের প্রত্যাশী হওয়াও ঈমানের অন্যতম অংশ। মহান আল্লাহ বলেন,

يَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ

তারা আল্লাহর করুণা প্রত্যাশী আবার তার শাস্তির ভয়ে ভীত।[১]

আরও বলা হয়েছে,

إِنَّ رَحْمَتَ اللَّهِ قَرِيبٌ مِّنَ الْمُحْسِنِينَ

অবশ্যই আল্লাহর রহমত সচ্চরিত্র লোকদের কাছাকাছি রয়েছে।[২]

সূরা আয-যুমারে বলা হয়েছে

قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَىٰ أَنفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِن رَّحْمَةِ اللَّهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا ۚ إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ

‘আপনি বলে দিন, (মহান আল্লাহ্ বলেন) হে আমার বান্দাগণ! যারা নিজেদের সাথে বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে তারা আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহ থেকে নিরাশ হয়ো না। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল, দয়াবান।”[৩]

তবে শর্ত হচ্ছে আল্লাহর সত্তা ও গুণাবলীর মত আর কাউকে যেন অনুরূপ সত্তা ও গুণাবলীর অধিকারী মনে না করা হয়। ইরশাদ হচ্ছে-

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ

“আল্লাহ্ কেবল শিরকের গুনাহ মাফ করেন না, তাছাড়া যত গুনাহ্ আছে, চাইলে। তিনি মাফ করে দেবেন।[৪]

সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, নবী করীম (সা.) বলেছেনঃ

لَوْ يَعْلَمُ الْمُؤْمِنُ مَا عِنْدَ اللَّهِ مِنَ الْعُقُوبَةِ مَا طَمِعَ بِجَنَّتِهِ أَحَدٌ وَلَوْ يُعْلَمُ الْكَافِرُ مَا عِنْدَ اللَّهِ مِنَ الرَّحْمَةِ مَا قَنَطَ مِنْ جَنَّتِهِ أَحَدٌ

‘আল্লাহর কাছে কী ভয়াবহ শাস্তি রয়েছে তা যদি ঈমানদারগণ জানতো তাহলে কেউ আল্লাহর কাছে জান্নাতের প্রত্যাশা করতে সাহস পেতো না। আর আল্লাহ্ যে কী পরিমাণ দয়ার সাগর তা যদি কাফিররা জানতো, তাহলে কেউ তাঁর জান্নাতের ব্যাপারে নিরাশ হতো না।[৫]

সহীহ মুসলিমে জাবির (রাঃ) থেকে বর্ণিত আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, নবী করীম (সা.)-এর মৃত্যুর তিন দিন আগে আমি তাকে বলতে শুনেছি,

لاَ يَمُوتَنّ أَحَدُكُم إِلاَّ وَهُوَ يُحْسِنُ الظَّنَّ باللَّه

‘তোমাদের প্রত্যেকেই যেন মৃত্যুর সময় আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা রেখে মৃত্যু বরণ করে।'[৬]

সহীহ্ আল বুখারী ও সহীহ্ মুসলিমে বর্ণিত আবু হুরাইরা (রাঃ)-এর আরেক হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন,

يقول الله عز وجل أنا عند ظن عبدي بي وأنا معه حين يذكرني

আল্লাহ্ আয্‌যা ওয়া জাল্লা ইরশাদ করেন, বান্দা আমাকে যে রকম মনে করে, আমাকে সে সেইভাবেই পায়। আর যেখানেই সে আমাকে স্মরণ করে আমি তার সাথেই থাকি।[৭]

[১]. সূরা আলে ইমরান, আয়াত : ৫৭।

[২]. সূরা আল আ'রাফ, আয়াত : ৫৬।

[৩]. সূরা আয যুমার, আয়াত : ৫৩।

[৪]. সূরা আন নিসা, আয়াত : ৪৮।

[৫]. সহীহ আল বুখারী; সহীহ মুসলিম, তাওবা অধ্যায় (হাদীস-৬৭২৬)।

[৬]. সহীহ মুসলিম, হাদীস-৬৯৬০, অধ্যায় : জান্নাত, জান্নাতের নি'আমত ও অধিবাসীদের বর্ণনা।

[৭]. সহীহ আল বুখারী, তাওহীদ অধ্যায়; সহীহ মুসলিম, তাওবা অধ্যায় (হাদীস-৬৭০০)।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৭৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 7 8 পরের পাতা »