লোক দেখানো কাজ পরিহার করে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কাজ করাও ঈমানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা। আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা বলেন,
وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ
তাদেরকে এ নির্দেশ ছাড়া আর কোন নির্দেশই দেয়া হয়নি যে, নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং দীনকে কেবল তারই জন্য নির্দিষ্ট করে নেবে।[১]
সূরা আশ শূরায় বলা হয়েছে,
مَن كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ ۖ وَمَن كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِن نَّصِيبٍ
“যে ব্যক্তি পরকালিন ফসল চায়- তার ফসল আমরা বাড়িয়ে দেই আর যে দুনিয়ার ফসল পেতে চায়। তাকে দুনিয়াতেই দান করি। পরকালে সে কিছুই পাবে না।[২]
আরও বলা হয়েছে,
مَن كَانَ يُرِيدُ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَزِينَتَهَا نُوَفِّ إِلَيْهِمْ أَعْمَالَهُمْ فِيهَا وَهُمْ فِيهَا لَا يُبْخَسُونَ (15) أُولَٰئِكَ الَّذِينَ لَيْسَ لَهُمْ فِي الْآخِرَةِ إِلَّا النَّارُ ۖ وَحَبِطَ مَا صَنَعُوا فِيهَا وَبَاطِلٌ مَّا كَانُوا يَعْمَلُونَ
যারা কেবল পার্থিব জীবন এবং তার চাকচিক্যই প্রতাশা করে তাদের কাজকর্মের যাবতীয় ফল আমরা এখানেই তাদেরকে দান করি। এ ব্যাপারে কোনো কম করা হয় না। কিন্তু পরকালে আগুন ছাড়া তাদের জন্য আর কিছুই নেই। (তখন তারা বুঝতে পারবে) পৃথিবীতে যা কিছু বানিয়েছে এবং যা কিছু করেছে, তা সবই বিফল হয়ে গেছে।[৩]
সূরা আল কাহফে আরও সুস্পষ্ট বলে দেয়া হয়েছে, যারা আল্লাহ্ ও পরকালে বিশ্বাসী তাদের কী করা উচিত। বলা হয়েছে,
فَمَن كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلًا صَالِحًا وَلَا يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدًا
কাজেই যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের আশা রাখে, সে যেন আমলে সালেহ (সৎ কাজ) করে এবং প্রতিপালকের ইবাদাতের সাথে আর কাউকে শরীক না করে।[৪]
সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেনমহান আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লা বলেন, আমি অংশীদারমুক্ত। কাজেই কেউ যদি আমার জন্য আমল করে এবং তার সাথে অন্য কাউকে অংশীদার করে, শির্কযুক্ত সেই আমলের আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
আবু উমারকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল- ইখলাস (আন্তরিকতা) কী? তিনি বললেন- আল্লাহ্ ছাড়া আর কারও প্রশংসা না করা।
সাহল ইবনু সাদ (রাঃ) বলেছেন- মুখলেস ব্যক্তি ছাড়া রিয়া (লোক দেখানো ইবাদাত)-এর মর্ম আর কেউ বুঝে না, তেমনিভাবে নিফাকের (কপটতা) মর্ম কেবল একজন ঈমানদারই বুঝে। আর আলিম (জ্ঞানী) ছাড়া মূর্খতার মর্ম কে আর বুঝবে, যেমন গুনাহর মর্ম আল্লাহর একান্ত বাধ্যগত ব্যক্তি ছাড়া আর কেউই বুঝে না।[৫]
রবী ইবনু খুশাইম (রাঃ) বলেছেন- ‘কোনো কাজের পেছনে যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যই না থাকে তবে সেই কাজ অনর্থক।
জুনাইদ (র) বলেন- কোনো বান্দার ভেতর যদি আদম (আঃ)-এর মত মুখাপেক্ষিতা, ঈসা (আঃ)-এর মত সংসার বিমুখতা, আইউব (আঃ)-এর মত কষ্টক্লেশ ভোগ, ইয়াহইয়া (আঃ)-এর মত আনুগত্য, ইদরীস (আঃ)-এর মত দৃঢ়তা, ইবরাহীম (আঃ)-এর মত আন্তরিকতা এবং মুহাম্মদ (সা.)-এর মত চরিত্র থাকে। তারপরও যদি তার অন্তরে গাইরুল্লাহর প্রতি বিন্দু পরিমাণ আস্থা থাকে, তাহলে এসব গুণ আল্লাহ্র কোনো প্রয়োজন নেই।
সুফিয়ান সাওরী (র) বলেছেন- আল্লাহ ছাড়া যেহেতু সবকিছুই ধ্বংস হয়ে যাবে তাই আমি তাকে ছাড়া আর কিছুই চাই না। তিনি আরও বলেছেন, আল্লাহর নবী ঈসা (আঃ) বলতেনঃ ‘কেউ যদি রোযা রাখে সে যেন তার দাড়ি এবং ঠোটে কিছু তেল মাখিয়ে নেয়, যেন অন্যেরা বুঝতে না পারে যে, সে রোযা রেখেছে। কেউ কিছু দান করতে চাইলে সে যেন এমনভাবে দান করে যাতে তার বাম হাতও টের না পায়। আর যদি কেউ (নফল) নামায পড়তে চায় সে যেন তার ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। আল্লাহ্ যেভাবে রিযিক বণ্টন করে থাকেন তেমনিভাবে প্রশংসা এবং মর্যাদাও বণ্টন করেন।
যিনুন মিসরী বলেছেন- ‘অনেক উলামা বলেন, ইখলাস (আন্তরিকতা) বান্দাকে আল্লাহর ভালবাসার গভীরতম স্থানে পৌছে দেয় যা সে নিজেও বুঝে না।
ইমাম মালিক ইবনু আনাস (র) বলেছেন, একবার আমার শিক্ষক রবী'আ আর-রাঈ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, হে মালিক! বলতো সবচেয়ে নিকষ্ট ব্যক্তি কে? বললাম- যে ব্যক্তি তার দীনকে (বিক্রি করে) খায়। তখন আবার জিজ্ঞেস করলেন- এবার বলতো নিকৃষ্টদের মধ্যে নিকৃষ্ট কে? আমি বললাম- যে পার্থিব সুখ স্বাচ্ছন্দের জন্য তার দীনকে বিপর্যস্ত করে দেয়। তিনি বললেন- তুমি ঠিকই বলেছে।'
ইবনুল আরাবী (র) বলেছেন- সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত সেই ব্যক্তি, যে লোক দেখানো সৎ সাজে এবং মানুষকে দেখাবার জন্য কাজ করে। অথচ সে বুঝে না আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউই তার অত্যন্ত কাছে থাকে না। আলিমগণ বলেছেন- মুমিনরা আল্লাহকে ভয় করে আর মুনাফিকরা ভয় করে শাসককে এবং লোক দেখানোর জন্য কাজ করে।
[২]. সূরা আশ শূরা, আয়াত : ২০।
[৩]. সূরা হূদ, আয়াত : ১৫, ১৬।
[৪]. সূরা আল কাহফ, আয়াত : ১১০।
[৫]. ইমাম বাইহাকী।