শাখা-৩৯. হারাম খাদ্য ও পানীয় বর্জন করা

 খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের বেলায়ও বাছবিচার করতে হবে। এটি ঈমানের অন্যতম শাখা। আল্লাহ্ সুবহানাহু তা'আলা বলেছেন,

حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنزِيرِ وَمَا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ وَالْمُنْخَنِقَةُ وَالْمَوْقُوذَةُ وَالْمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيحَةُ وَمَا أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ

‘তোমাদের জন্য হারাম করে দেয়া হয়েছে- মৃত পশু, রক্ত, শূকরের মাংস এবং সেইসব পশু যা আল্লাহ ছাড়া আর কারও নামে যবাহ করা হয়েছে, যা গলায় ফাঁস লেগে, আঘাত পেয়ে বা উপর থেকে পড়ে গিয়ে বা অন্য পশুর শিঙের আঘাতে অথবা যা কোনো হিংস্র পশু ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে- তা জীবিত পেয়ে যবাহ করলে ভিন্ন কথা- যা কোনো আস্তানায় বলি দেয়া হয়েছে।[১]

সূরা আন'আমে বলা হয়েছে এভাবে-

قُل لَّا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَىٰ طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَن يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَّسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللَّهِ بِهِ

“হে নবী! আপনি বলে দিন, আমার কাছে যে ওহী আসে তাতে এমন কোনো জিনিস পাইনা যা খাওয়া কারও জন্য হারাম। তবে মৃত, প্রবাহিত রক্ত কিংবা শূকরের গোত হলে ভিন্ন কথা, কারণ তা অপবিত্র জিনিস। আর যদি ফিস্ক হয়, যা আল্লাহ্ ছাড়া আর কারও নামে যবাহ করা হয়ে থাকে- তাও।[২]

আল্লাহ সুবহানাহু তা'আলা আরও বলেন,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ

‘হে ঈমানদারগণ! মাদকদ্রব্য, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক তীর এসব শয়তানী কাজ। এসব থেকে বেঁচে থাক।[৩]

অন্যত্র বলা হয়েছে,

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ ۖ قُلْ فِيهِمَا إِثْمٌ كَبِيرٌ

‘তারা আপনাকে মাদকদ্রব্য ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, বলে দিন এগুলোর মধ্যে রয়েছে মহাপাপ।[৪]

আল্লাহ্ আরও বলেছেন,

قُلْ إِنَّمَا حَرَّمَ رَبِّيَ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَالْإِثْمَ وَالْبَغْيَ بِغَيْرِ الْحَقِّ

‘আপনি বলে দিন, আমার প্রতিপালক অশ্লীল বিষয়সমূহ হারাম করেছেন যা প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য, আরও হারাম করেছেন গুনাহ্ এবং অন্যায়-অত্যাচার।[৫]

সহীহ্ আল বুখারী ও সহীহ্ মুসলিমে আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন,

كُلُّ شَرَابٍ أَسْكَرَ فَهُوَ حَرَامٌ

‘নেশা সৃষ্টি করে এমন যে কোনো পানীয়ই হারাম।[৬]

সহীহ মুসলিমে ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

كُلُّ مُسْكِرٍ خَمْرٌ وَكُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ

‘যা নেশা সৃষ্টি করে তাই মাদকদ্রব্য, আর মাদকদ্রব্য মাত্রই হারাম।[৭]

ইবনু উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত অন্য হাদীসে বলা হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন,

مَنْ شَرِبَ الْخَمْرَ فِي الدُّنْيَا ثُمَّ لَمْ يَتُبْ مِنْهَا حُرِمَهَا فِي الآخِرَة

“যে ব্যক্তি পৃথিবীতে নেশাজাত দ্রব্য গ্রহণ করবে এবং তাওবা না করে মারা যাবে, আখিরাতে সে তা থেকে বঞ্চিত হবে।'[৮]

সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে,

أتى ليلة أسرى به بايلياء بقدحين من خمر ولبن فنظر اليهما فأخذ اللبن فقال له جبريل الحمد لله الذي هداك للفطرة لو أخذت الخمر غوت أمتك

‘মিরাজের রাতে বাইতুল মুকাদ্দাসে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে মদ ও দুধের দুটো গ্লাস হাজির করা হলে তিনি দুটোর দিকেই তাকালেন, তারপর দুধের গ্লাস তুলে নিয়ে পান করলেন। জিবরীল (আঃ) বললেন- সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্ যিনি আপনাকে স্বভাবসুলভ পথ গ্রহণে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। যদি আপনি মদ গ্রহণ করতেন তাহলে আপনার উম্মাত বিভ্রান্ত হয়ে যেত।[৯]

অন্য হাদীসে বলা হয়েছে,

ولا يشرب الخمر الشارب حين يشربها وهو مؤمن

‘কোনো মাদকদ্রব্য সেবনকারী যখন মাদকদ্রব্য সেবন করে তখন সে মুমিন থাকে না।[১০]

সহীহ মুসলিম সহ আরও কিছু গ্রন্থে আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত এক হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

يٰايُّها النَّاسُ إنَّ الله طَيِّبٌ لا يَقْبَلُ إلاَّ طيِّباً، وإنَّ الله تعالى أمرَ المُؤْمِنينَ بما أمرَ به المُرسَلين

‘হে লোক সকল! নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ পবিত্র এবং পবিত্র জিনিস ছাড়া তিনি গ্রহণ করেন না। মুমিনদেরকে তিনি সেই নির্দেশ দিয়েছেন, যে নির্দেশ নবী রাসূলদের দিয়েছিলেন। নির্দেশ ছিলো-

يَا أَيُّهَا الرُّسُلُ كُلُوا مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَاعْمَلُوا صَالِحًا ۖ إِنِّي بِمَا تَعْمَلُونَ عَلِيمٌ

“হে নবী রাসূলগণ! পবিত্র জিনিসসমূহ খাও এবং সৎ কাজ কর, তোমরা যা কিছু কর তা আমি খুব ভালো করেই জানি।' (সূরা আল মুমিনূন : ৫১)।

মানুষকে লক্ষ্য করে তিনি সরাসরি নির্দেশ দিয়েছেন,

يَا أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوا مِمَّا فِي الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا وَلَا تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ

‘হে মানুষ! জমিনে যেসব হালাল ও পবিত্র জিনিস রয়েছে সেগুলো খাও, আর শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না।' (সূরা আল বাকারা : ১৬৮)

তারপর বললেন- এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফর করে এলো, চুলগুলো এলোমেলো, কাপড় ধুলোমলিন, এমতাবস্থায় সে উপরের দিকে হাত উঠিয়ে দুআ করতে লাগলো- হে আমার প্রতিপালক! হে আমার রব! এইভাবে, অথচ তার খাদ্য হারাম, পানীয় হারাম এমনকি তার পরনের পোশাকটিও হারামের টাকায় কেনা, এমতাবস্থায় কীভাবে তার দু'আ কবুল হতে পারে?

সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে নুমান ইবনু বশীর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন,

إن الحلال بين والحرام بين وبين ذٰلك مشتبهات لا يعلمها كثير من الناس فمن اتقى الشبهات استبرأ لعرضه ودينه ومن وقع في الشبهات وقع في الحرام كالراعي يرعى حول الحمى يوشك أن يقع فيه ألا وإن لكل ملك حمى و حمى الله في الارض محارمه.

‘হালালসমূহ সুস্পষ্ট, হারামসমূহও সুস্পষ্ট, আর কিছু আছে সংশয়যুক্ত, অধিকাংশ মানুষ তা জানে না। যে সংশয়যুক্ত বিষয় এড়িয়ে চলবে সে নিজের সম্মান ও দীনকে নিরাপদ রাখতে পারবে। আর যে সংশয়যুক্ত বিষয়ে জড়িয়ে পড়বে সে প্রকারান্তরে হারামে লিপ্ত হবে। যেমন কোনো রাখাল যদি সংরক্ষিত চারণভূমির প্রান্তসীমায় তার পশু চড়ায় তাহলে যে কোনো মুহূর্তে তা সীমালংঘন করে। সাবধান! প্রত্যেক বাদশাহর যেমন একটি সংরক্ষিত চারণভূমি রয়েছে, তেমনি পৃথিবীতে আল্লাহর সংরক্ষিত চারণভূমি হচ্ছে তার নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ।[১১]

সহীহ আল বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন,

انى لانقلب إلى أهلي فأجد التمرة ساقطة على فراشي أو في بیتی فارفعها لأكلها أخشى أن تكون من الصدقة فألقيها

‘আমি একবার বাইরে থেকে বাড়ি ফিরে আমার বিছানায় বা ঘরে একটি খেজুর পেয়ে খেয়ে ফেললাম। পরক্ষণেই মনে হলো সেটি তো সাদকার খেজুরও হতে পারে। তখন আমি তা বমি করে ফেলে দিলাম।[১২]

সহীহ আল বুখারীতে আয়িশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে,

گان لأبي بكر غلام يخرج له الخراج وكان أبو بكر يأكل من خراجه فجاء يوما بشیء فأكل منه أبو بكر فقال له الغلام - أتدرى ماهذا ؟ فقال أبو بكر رضي الله عنه وما هو ؟ قال تكهنت لانسان في الجاهلية وما أحسن الكهانة الأ أني خدعته فلقيني أعطاني بذلك فهذا الذي أكلت منه . قالت قال أبو بكر يده فقاء كل شيء في بطنه .

আবু বকর (রাঃ)-এর এক ক্রীতদাস খারাজ[১৩] কালেকশানে নিয়োজিত ছিলো। একদিন সে কিছু খাদ্য নিয়ে এলো। আবু বকর (রাঃ) তা থেকে খেলেন। ক্রীতদাস বললো- আপনি কি জানেন এ খাদ্য আমি কোথেকে পেয়েছি। তিনি বললেন- কোত্থেকে? সে বললো- আমি জাহেলী যুগে লোকদের ভাগ্য গণনা করতাম, অথচ সেই বিদ্যা আমার জানা ছিল না। শুধু শুধু লোকদের ধোকা দিতাম। আজ তাদের একজনের সাথে সাক্ষাৎ হওয়ায় এগুলো আমাকে দিয়েছে, যা আপনি খেলেন। আয়িশা (রাঃ) বলেন- তখন আবু বকর (রাঃ) মুখের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে দিয়ে পেটে যা কিছু ছিল বমি করে ফেলে দিলেন।[১৪]

উমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) সম্পর্কে যায়িদ ইবনু আসলাম (রাঃ) বর্ণনা করেছেন,

شرب لبنا فأعجبه فقال للذي سقاه- من أين لك هذا اللبن؟ فأخبره أنه ورد على ماء قد سماه فاذا نعم من نعم الصدقة وهم يسقون فحلبوه من ألبانها فجعلته في سقائي وهو هذا- فادخل عمر يده فاستاءه

‘একবার উমার (রাঃ)-কে কিছু দুধ পান করানো হলো। যা তিনি পছন্দ করতেন। পরে যিনি দুধ পান করিয়েছেন তাকে জিজ্ঞেস করলেন- তুমি এ দুধ কিভাবে পেলে? তাকে বলা হলো তিনি পানি আনতে কূপের কাছে গিয়েছিলেন। দেখলেন বেশ কিছু সাদকার ছাগল সেখানে পানি পান করানোর জন্য আনা হয়েছে। অনেকে সেসব ছাগলের দুধ দোহন করে নিচ্ছে, তিনিও একটি ছাগলের দুধ দোহন করে এনেছেন। একথা শুনে উমার (রাঃ) গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে সবকিছু বমি করে ফেলে দিলেন।[১৫]

[১]. সূরা আল মায়িদা, আয়াত : ৩।

[২]. সূরা আনআম, আয়াত : ১৪৫।

[৩]. সূরা আল মায়িদা, আয়াত : ৯০।

[৪]. সূরা আল বাকারা, আয়াত : ২১৯।

[৫]. সূরা আল আ'রাফ, আয়াত : ৩৩।

[৬]. সহীহ আল বুখারী, পানীয় অধ্যায়; সহীহ মুসলিম, পানীয় অধ্যায় (হাদীস-৫০৪১)।

[৭]. ১৫০. সহীহ মুসলিম, পানীয় অধ্যায় (হাদীস-৫০৫১)।

[৮]. সহীহ আল বুখারী, পানীয় অধ্যায়; সহীহ মুসলিম, পানীয় অধ্যায়, (হাদীস-৫০৫৩)।

[৯]. সহীহ্ আল বুখারী, পানীয় অধ্যায়; সহীহ্ মুসলিম পানীয় অধ্যায় (হাদীস-৫০৭০)।

[১০]. সহীহ আল বুখারী, পানীয় অধ্যায়; সহীহ মুসলিম, ঈমান অধ্যায় (হাদীস-১০৮)।

[১১]. সহীহ আল বুখারী, ঈমান অধ্যায়; সহীহ মুসলিম, মুসাকাত অধ্যায়।

[১২]. সহীহ্ আল বুখারী, হারানো জিনিস প্রাপ্তি অধ্যায়; সহীহ মুসলিম, যাকাত অধ্যায়।

[১৩]. ভূমিকর যা অমুসলিমদের কাছ থেকে আদায় করা হতো।

[১৪]. সহীহ্ আল বুখারী।

[১৫]. ইমাম বাইহাকী তার নিজস্ব সনদে এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।