(১) বিদআত কুফরের ডাকঘর। বিদআতীদের বহু ফির্কা তাদের বিদআতের মাধ্যমে কুফরে পৌছে কাফের হয়ে গেছে; যদিও বা তারা নিজেদের পরিচয় মুসলিম বলেই দিয়ে থাকে। যেমন ‘কামেল পীর বা দরবেশদের উপর থেকে শরয়ী বন্ধন তুলে নেওয়া, তাদেরকে আল্লাহর কিছু বৈশিষ্ট্যে (যেমন, গায়েব জানা, মসীবত দুর করা, সন্তান দান করা প্রভৃতির ব্যাপারে) শরীক করা, তাদের কবর সিজদা করা, বা তওয়াফ করা। কাবীরাহ গোনাহকারী মুসলিমকে কাফের জ্ঞান করা ইত্যাদি। যারা কিছু আমল ও ইবাদত তো করে কিন্তু ঐরূপ বিদআতের পাশে কোনই মূল্য নেই। আল্লাহ পাক বলেন,

وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَعْمَالُهُمْ كَسَرَابٍ بِقِيعَةٍ يَحْسَبُهُ الظَّمْآنُ مَاءً حَتَّىٰ إِذَا جَاءَهُ لَمْ يَجِدْهُ شَيْئًا

অর্থাৎ, যারা কুফরী করে (সত্য প্রত্যাখ্যান করে) তাদের কর্ম মরুভূমির মরীচিকার ন্যায়, পিপাসার্থ যাকে পানি মনে করে; কিন্তু সে ওর নিকট উপস্থিত হলে দেখে তা কিছুই নয়। (সূরা নুর ৩৯ আয়াত)

(২) বিদআতীরা আল্লাহর উপর বিনা ইলমে অনুমান-প্রসূত কথা বলে। সাধারণতঃ বাতেনী দাবীদাররা এই রোগের রোগী। যারা কলবে জ্ঞানার্জন করে থাকে, কুরআন হাদীস ও তফসীরের ইলমে কোন প্রকারের অনুরাগ প্রকাশ করে না, সলফের পথ জানার কোন ইচ্ছা রাখে না। বরং মনগড়া বাতেনী ইলম দ্বারা স্বপ্ন ও পরিকল্পিত কাশফ দ্বারা এবং ত্রিশ এর অধিক পারা কুরআন (?) দ্বারা ভক্তদের মনোরঞ্জন করে থাকে। শরীয়তের উর্ধ্বে থেকে মারেফতীর দাবী করে সবকাজে ফুর্তি মারে। আর এ সবের মাধ্যমে প্রকৃত ইলম ছাড়াই আল্লাহ ও তদীয় রসূলের উপর হলাহল মিথ্যা বলে। যা বান্দার জন্য কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। (সূরা আ'রাফ ৩৩ আয়াত)। মহান আল্লাহ নিজ নবীর জন্য বলেন,

وَلَوْ تَقَوَّلَ عَلَيْنَا بَعْضَ الْأَقَاوِيلِ (44) لَأَخَذْنَا مِنْهُ بِالْيَمِينِ (45) ثُمَّ لَقَطَعْنَا مِنْهُ الْوَتِينَ (46) فَمَا مِنكُم مِّنْ أَحَدٍ عَنْهُ حَاجِزِينَ (47) وَإِنَّهُ لَتَذْكِرَةٌ لِّلْمُتَّقِينَ (48) وَإِنَّا لَنَعْلَمُ أَنَّ مِنكُم مُّكَذِّبِينَ (49)

অর্থাৎ, সে যদি কিছু রচনা করে আমার নামে চালাতে চেষ্টা করত, তবে আমি তাকে কঠোর হস্তে দমন করতাম এবং তার কণ্ঠশিরা কেটে দিতাম, তখন। তোমাদের কেউই তাকে রক্ষা করতে পারত না। (সূরা হাক্কাহ ৪৪-৪৯ আয়াত)।

আল্লাহর রসুল (ﷺ) বলেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকত আমার উপর মিথ্যা বলে, সে যেন। নিজের ঠিকানা জাহান্নাম বানিয়ে নেয়।” (বুখারী ও মুসলিম)। অনুরূপভাবে শির্ক ও কুফরীর মূলও আল্লাহর নামে মিথ্যা রচনা। যেহেতু মুশরিক অজ্ঞভাবেই মনে করে যে, সে যার পুজা করে সেই মা'বুদ তাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করবে, তাঁর সামীপ্য দান করবে, তাঁর নিকট সুপারিশ করবে এবং অসীলা বা মাধ্যম হয়ে তাঁর নিকট থেকে তার প্রয়োজন মিটাবে। এ সব অমূলক ধারণা তার কল্পনাপ্রসূত। তাই প্রত্যেক মুশরিক আল্লাহর উপর মিথ্যা ধারণা ও রচনা করে থাকে। আর এইরূপ ধারণা ও অনুমানই বিদআতীকে বিদআতে উৎসাহিত করে। (মাদারেজুস সালেকীন)।

আর “যে ব্যক্তি আল্লাহ সম্বন্ধে মিথ্যা রচনা করে কিংবা তাঁর নিদর্শনসমূহকে প্রত্যাখ্যান করে তার অপেক্ষা বড় অত্যাচারী আর কে?” (সূরা আ'রাফ ৩৭ আয়াত)।

(২) বিদআতীরা সুন্নাহ ও আহলে সুন্নাহর প্রতি নিতান্ত বিদ্বেষ ও ঘৃণা পোষণ করে। উল্টোভাবে নিজেদেরকে আহলে সুন্নাহ’ এবং প্রকৃত আহলে সুন্নাহকে ‘কাফের’, ‘ওয়াহাবী ইত্যাদি বলে। অন্ধকার বলে, আলো তুমি নহ ভালো!” বিদআতীরা আহলে সুন্নাহকে বিভিন্নভাবে অপবাদ দিয়ে মন্দ নামে অভিহিত করেছে। যেমন মক্কার মুশরেকীনরা প্রিয় নবী (সা.)-কে বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে কেউ বলেছিল, 'যাদুকর’, কেউ বলেছিল, গণক, কেউ বলেছিল, ‘কবি’, কেউ বলেছিল ‘পাগল’, কেউ বলেছিল ‘বিকার গ্রস্ত’, আবার কেউ বলেছিল, 'মিথ্যারচনাকারী মিথ্যক’ ইত্যাদি। অথচ তিনি এ সব অপবাদ থেকে পবিত্র ছিলেন। আল্লাহ বলেছিলেন,

انظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوا لَكَ الْأَمْثَالَ فَضَلُّوا فَلَا يَسْتَطِيعُونَ سَبِيلًا

অর্থাৎ, দেখ ওরা তোমার জন্য কি উপমা দেয় ফলে ওরা পথ ভ্রষ্ট হয়ে গেছে এবং ওব্রা পথ পাবে না। (সূরা ইসরা ৪৮ আয়াত)

তদনুরূপ আহলে সুন্নাহ বা সালাফীগণও যাবতীয় অপবাদ থেকে পবিত্র। যেহেতু তারা উজ্জ্বল সুন্নাহ, সন্তোষজন চরিত্র, সরল পথ এবং শক্ত, চুড়ান্ত ও অকাট্য দলীলের ধারক ও বাহক। আল্লাহ আয্যা অজাল্ল যাদেরকে তাঁর কিতাব ও অহীবাণীর অনুসরণ এবং তাঁর রসুলের চরিতাদর্শের অনুকরণ করার তওফীক ও প্রেরণা দান করেছেন। যারা তাঁর অনুকরণে মানুষকে সৎকথা ও কাজের নির্দেশ এবং অসৎ কথা ও কাজে বাধা দান করে থাকে এবং জীবনের প্রতি মুহূর্তে তাঁরই চরিত ও সুন্নাহর অনুসারী থাকে। যাদের বক্ষ তাঁর প্রেমে এবং তাঁর শরীয়তের ইমামগণ ও তাঁর উম্মতের উলামাগণের মহব্বতে সদা প্রশস্ত। আর যারা যে জাতিকে ভালোবাসে তারা কিয়ামতে তাদেরই সঙ্গী হবে। (ই’তিকাদু আহলিল হাদীস)।

(৪) পুর্বেই আলোচিত হয়েছে যে, বিআতীদের আমল রহিত, যেহেতু দ্বীন পুর্ণাঙ্গ এবং যে কাজে কিতাব বা সুন্নাহর কোন নির্দেশ নেই তা করা ভ্রষ্টতা এবং এর পরিণাম জাহান্নাম। বিদআতীদের নিরর্থক মেহনত এবং বেকার কর্মকান্ডের কোন পারিশ্রমিক, প্রতিদান ও সুফল নেই। আল্লাহ জাল্লা শানুহ বলেন,

قُلْ هَلْ نُنَبِّئُكُم بِالْأَخْسَرِينَ أَعْمَالًا (103) الَّذِينَ ضَلَّ سَعْيُهُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَهُمْ يَحْسَبُونَ أَنَّهُمْ يُحْسِنُونَ صُنْعًا

অর্থাৎ, বল আমি কি তোমাদেরকে তাদের সংবাদ দেব, যারা কর্মে (আমলে)। বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত? ওরাই তারা, পার্থিব জীবনে যাদের প্রচেষ্টা পন্ড হয়, যদিও তারা মনে করে যে, তারা সৎকর্ম করছে। (সূরা কাহফ ১০৩-১০৪ আয়াত)

(৫) বিদআতীদের সমঝ বিপরীত মুখী হয়ে যায়। জলাতঙ্ক রোগের মত কুপ্রবৃত্তি তাদের শিরা-উপশিরায় স্থানাধিকার করে বসে। ফলে ভালোকে মন্দ এবং মন্দকে ভালো রূপে দেখে থাকে। বিদআতকে সুন্নাত এবং সুন্নাতকে বিদআত জ্ঞান করে থাকে। বিদআতীকে ওলী এবং সুন্নীকে কাফের’ ভেবে থাকে। বাউলিয়াকে আওলিয়া এবং মুত্তাকীন আওলিয়াকে (ইলমের) দেউলিয়া মনে করে। যাদের নিকট কোন হুজ্জত ও দলীল ফলপ্রসু হয় না। নবীর আদেশ মানতে এবং প্রকৃত আওলিয়াদের ও দলীল পথ অনুসরণ করতে বললে বলে, তোমাদের নবী ও আওলিয়াদের পথ অনুসরণ করতে বললে বলে, তোমাদের নবী ও আওলিয়াদের প্রতি কোন আদব ও মহব্বতর্ক নেই। হাদীস ও আয়াত দ্বারা কুরআনের তফসীর করতে গেলে বলে, তোমরা কুরআন বুঝ না, কুরআন মান না। প্রায় সব ব্যাপারেই উল্টা বুঝিল রাম।

(৬) যে বিদআত করলে মানুষ কাফের হয়ে যায় সেই বিদআতের বিদআতী এবং তার প্রতি আহবানকারী বিদআতীর রেওয়ায়াত (হাদীসের বর্ণনা) গ্রহণ যোগ্য নয়। যেমন, তার সাক্ষিও অগ্রহণযোগ্য।

(৭) অধিকাংশ ফিতনার পশ্চাতে কোন না কোন বিদআতীর হাত থাকে এবং বিদআতীরাই বেশীরভাগ ফিতনায় আপতিত হয়ে থাকে। তাদের কারণে ভয়াবহ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। এমন ফিতনার সৃষ্টি হয় যাতে বহু মানুষ সন্ধ্যায় মুমিন থাকে, সকালে কাফের হয়ে যায় এবং সকালে মুমিন থাকলে, সন্ধ্যায় কাফের হয়ে যায়। সামান্য পার্থিব স্বার্থের বিনিময়ে এরা দ্বীনকে বিক্রয় করে দেয়। বিদআতই দ্বীন ও সমাজের বড় ফিতনা। ইবনে মাসউদ ৩৯ বলেন, “তোমাদের তখন কি অবস্থা হবে, যখন ফিতনা তোমাদেরকে আচ্ছাদিত করে নেবে? যাতে বড় বৃদ্ধ হবে এবং ছোট প্রতিপালিত (হয়ে বড়) হবে। মানুষ যাকে সুন্নাহ মনে করবে। যখন তা (ফিতনা বা বিদআত) অপসারিত করা হবে তখন লোকেরা বলবে, ‘সুন্নাত অপসারিত হল। একজন জিজ্ঞাসা করল, 'হে আবু আব্দুর রহমান! এরূপ কখন। হবে? তিনি বললেন, 'যখন তোমাদের কৃারীর সংখ্যা অধিক হবে এবং ফকীহ (অভিজ্ঞ আলেমদের) সংখ্যা কম হবে, তোমাদের নেতার সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং আমানতদারের সংখ্যা কমে যাবে ও আখেরাতের কর্ম দ্বারা দুনিয়ার সম্পদ অন্বেষণ করা হবে।” (দারেমী ১/৬৪ নং)

ইমাম মালোকের নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল, হে আবু আব্দুল্লাহ! কোত্থেকে ইহরাম বাঁধব? তিনি বললেন, ‘যুলহুলাইফা থেকে; যেখান থেকে রসুলুল্লাহ এ ইহরাম বেঁধে ছিলেন। লোকটি বলল, আমি মসজিদে নববী) থেকে ইহরাম বাঁধতে ইচ্ছা করছি। তিনি বললেন, 'এমনটি করো না। লোকটি বলল, 'আমি ইচ্ছা করছি যে, মসজিদে কবরের নিকট থেকে এহরাম বাঁধব।” তিনি বললেন, এমনটি করো না, কারণ আমি তোমার উপর ফিতনার ভয় করি। লোকটি বলল, ‘এটা আবার কোন ফিতনা? এতো কয়েকটা মাইল মাত্র বেশী করব!’ তিনি বললেন, ‘কোন ফিতনা এর চেয়ে অধিক বড় যে, তুমি মনে কর, তুমি এমন। ফযীলতের প্রতি অগ্রগামী হয়েছ, যা হতে রসূল ধ্ৰু পিছে থেকে গেছেন? আমি শুনেছি আল্লাহ বলেছেন যে,

فَلْيَحْذَرِ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَن تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

অর্থাৎ, সুতরাং যারা তার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় (ফিতনা) অথবা কঠিন শাস্তি (আযাব) তাদেরকে গ্রাস করবে। (সূরা নুর ৬৩)।

বলাই বাহুল্য যে, বিদআতীদের এটাই হচ্ছে মূল বুনিয়াদ। ভাল জিনিস তো। বাড়তি করলে ক্ষতি কি? তাদের আকেলে অনুরূপ অতিরঞ্জনে কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু ইমাম মালেক (রঃ) বলেন, ঐটাই ফিতনা। (৮) বিদআতীর নিকট হক ও বাতিলের মাঝে তালগোল খেয়ে যায়। কখনো বা মস্তবড় গর্হিত কর্ম দেখে চুপ থেকে মৌনসম্মতি জানায়। আবার কখনো ছোট বিষয়ে কোমর বেঁধে লড়ে। কখনো সামান্য বিষয়কে বড় এবং বড় বিষয়কে তুচ্ছ জ্ঞান করে। তাই কখনো মুসলিমদের জান ও মালকে হালাল মনে করে তাদেরকে হত্যা করে। এবং কখনো মশা মারাও হারাম ভাবে। বিভিন্ন কুসংস্কারদিকে দ্বীন ভাবে। যাদু ও শয়তানী কর্মকান্ডকে কারামত জ্ঞান করে। ফলে তাদের অবস্থা ঠিক বানী ইস্রাঈলদের মত হয়; যাদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

وَلَا تَلْبِسُوا الْحَقَّ بِالْبَاطِلِ وَتَكْتُمُوا الْحَقَّ وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, তোমরা সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশ্রিত করো না এবং জেনে-শুনে সত্য গোপন করো না। (সূরা বাকারাহ ৪২ আয়াত)

(৯) বিদআতী অভিশাপ যোগ্য। তদনুরূপ যে ব্যক্তি কোন বিদআতীর সহায়তা ও পৃষ্ঠপোষকতা করে তার উপরেও আল্লাহ ফিরিশ্যামন্ডলী এবং সকল মানুষের অভিশাপ। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “মদীনায় ঈর থেকে সওর পর্যন্ত হারাম। যে ব্যক্তি তার মধ্যে কোন অপকর্ম করবে বা দুর্ঘটনা ঘটাবে বা নবরচিত কর্ম (বিদআত) করবে অথবা এমন অপকর্মকারী বা বিদআতীকে স্থান বা প্রশ্রয় দেবে বা সাহায্য করবে তার উপর আল্লাহ, ফিরিশ্যামন্ডলী এবং সমগ্র মানবমন্ডলীর অভিশাপ। আল্লাহ কিয়ামতের দিন। তার নিকট হতে ফরয ও নফল কোন কিছুই গ্রহণ করবেন না।” (বুখারী, মুসলিম ১৩৬৬নং)।

তিনি আরো বলেন, “আল্লাহর অভিসম্পাত সেই ব্যক্তির উপর যে গায়রুল্লাহর উদ্দেশ্যে যবেহ করে, আল্লাহর অভিসম্পাত সেই ব্যক্তির উপর যে নিজ পিতামাতাকে অভিসম্পাত করে, আল্লাহর অভিসম্পাত সেই ব্যক্তির উপর যে কোন দুষ্কৃতকারী বা বিদআতীকে আশ্রয় দেয় এবং আল্লাহর অভিসম্পাত সেই ব্যক্তির উপর যে ভূমির (জমি-জায়গার) সীমা-চিহ্ন পরিবর্তন করে।” (মুসলিম ১৯৭৮) (১০)

বিদআতী আল্লাহর যিকর হতে মুখ ফিরিয়ে থাকে। আবার যিকর করলেও মনগড়া রচিত যিকর মুখে আওড়ে থাকে। ইল-ইল, হু-হু, হাই-হাই’ প্রভৃতি অর্থহীন শব্দ দ্বারা উচ্চস্বরে আজব যিকর টেনে থাকে। বরং এখানেই শেষ নয়; যিকরের সময় তথাকথিত তন্ময়তা ও ভাবাবেগে তারা নিজেদের দেহ আন্দোলিত করে। কাওয়ালীর স্বরে ও ডুগডুগির তালে নাচতে থাকে। বরং নারী -পুরুষ একই কক্ষে এই যিক হেঁকে থাকে। কখনো বা হুযুরের তরফ থেকে এই প্রত্যাদেশ হয়, ‘মনের আলো বড় আলো বাইরের আলো নিভাও রে, মনের পর্দা বড় পর্দা বাইরের পর্দা উঠাও রে!’

অতঃপর ঐ কামেলের মজলিসে অন্ধকারে বেপর্দায় যা ঘটে, তা বলাই বাহুল্য! অবশ্য এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কারণ, ঐ কামেলদের উপর শরীয়তের কোন বাঁধনই অবশিষ্ট থাকে না! পক্ষান্তরে অনেক বিদআতীর নিকট তাদের মনগড়া যিকর আওড়ানো কুরআন অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। কুরআন ও সুন্নাহতে বর্ণিত যিকর তো জানেই না। বলতে গেলে ব্যঙ্গ হাসে অথবা মুখ টেরা করে নেয়। যেহেতু ওদের নিকট কিতাবী’ যিকর অপেক্ষা ‘কলবী’ যিকরে ফযীলত বেশী। তাই কুরআন পঠিত হলে কর্ণপাত করে না অথচ ঐ ধরণের যিকর অথবা কাওয়ালী যিকরের ক্ষেত্রে মন দিয়ে কান লাগিয়ে মাথা হিলিয়ে শোনে ও আওড়ায়। মহান আল্লাহ অবিশ্বাসীদের সম্বন্ধে বলেন,

وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ ۖ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ

অর্থাৎ, যারা পরকালে বিশ্বাস রাখে না (তাদের সামনে) যখন একক আল্লাহর কথা উল্লেখ করা হয়, তখন তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কারো (তাদের উপাস্যদের) উল্লেখ করা হলে তারা আনন্দে উল্লাসিত হয়।” (সূরা যুমার ৪৫ আয়াত)

এরা তো সেই বিদআতী যারা কুরআন ও সুন্নাহর নাম শুনলে স্থান ত্যাগ করার চেষ্টা করে। কুরআন-হাদীস শুনতে এদের মন টক হয়ে যায়। কুরআন ও সুন্নাহর মজলিস ও জলসায় উপস্থিত হয় না। হলেও তাদের প্রবৃত্তির প্রতিকূল কথা শুনে মজলিস ছেড়ে পলায়ন করতে চায়। মহান আল্লাহ ঐ শ্রেণীর মানুষের জন্য বলেন,

فَمَا لَهُمْ عَنِ التَّذْكِرَةِ مُعْرِضِينَ * كَأَنَّهُمْ حُمُرٌ مُّسْتَنفِرَةٌ * فَرَّتْ مِن قَسْوَرَةٍ

অর্থাৎ, ওদের কি হয়েছে যে, ব্রা উপদেশ হতে দুরে সরে পড়ে? ওরা যেন ভীতএস্ত গর্দভদল, যা সিংহের সম্মুখ হতে পলায়ন-পর। (সূরা মুদ্দাসসির ৪৯-৫১ আয়াত)

পরন্তু এমন অনেক বিদআতী আছে, যারা উচ্চ ও সমস্বরে কখনো বা লাউড স্পিকারে যিকর হাঁকে। এরা একই সঙ্গে বিদআত করে, রিয়া করে, প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয় এবং আল্লাহর যিকরের প্রতি মানুষের মনকে বীতরাগ করে তোলে। আবার তাদের মধ্যে অনেকেই ইসলামকে কেবল যিকর ও খানকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় এবং অন্যান্য ময়দান ও পরিবেশে তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না!

(১১) বিদআতীদের প্রধান চরিত্রসমূহের অন্যতম চরিত্র সত্য গোপন করা। আপন ভক্তদের নিকট কত ন্যায় ও সত্যের অপলাপ ঘটায়, যা প্রকাশ করলে তাদের ভেদ ফাঁস হয়ে যায়। কোন স্বার্থের খাতিরে জানা বিষয়কে না জানার ভান। করে অথবা শব্দার্থ গোপন করে অথবা কূটাই বা দূর ব্যাখ্যা করে অথবা মনগড়া অর্থ করে আসল সত্য গোপন করে। আর এই কাজে তারা এ কাফেরদের দলে শামিল। হয়ে যায়, যাদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,

الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ ۖ وَإِنَّ فَرِيقًا مِّنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি তারা তাকে (মুহাম্মাদ)কেও তেমনি চেনে, যেমন তারা তাদের পুত্রদেরকে চেনে। কিন্তু তাদের একদল জেনেশুনে সত্য গোপন করে থাকে।” (সূরা বাক্বারাহ ১৪৬ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

أَفَتَطْمَعُونَ أَن يُؤْمِنُوا لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِّنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلَامَ اللَّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ مِن بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

অর্থাৎ, তোমরা কি আশা কর যে, ওরা তোমাদের মত ঈমান আনবে? অথচ ওদের মধ্যে একদল আল্লাহর বাণী শ্রবণ করত এবং বুঝার পর জেনে শুনে তা বিকৃত করত।” (সূরা বাক্বারাহ ৭৫ আয়াত)

অন্যত্র তিনি বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَىٰ مِن بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ ۙ أُولَٰئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ

অর্থাৎ, আমি যে সব স্পষ্ট নিদর্শন ও পথনির্দেশ অবতীর্ণ করেছি, মানুষের জন্য খোলাখুলিভাবে আমি কিতাবে ব্যক্ত করার পরও যারা ঐ সকল গোপন রাখে, আল্লাহ তাদেরকে অভিশাপ করেন এবং অভিশাপকারীরাও তাদেরকে অভিশাপ দেয়।” (সূরা বাকারাহ ১৫৯ আয়াত) আর প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি কোন জানা ইম প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসিত হয় এবং তা গোপন করে, আল্লাহ কিয়ামতে তার মুখে আগুনের লাগাম দেবেন।” (ইবনে মাজাহ)। বলাই বাহুল্য যে, কোন ইলম গোপন করা মুসলিমের জন্য হারাম এবং তার শাস্তি ভয়ানক। অতএব কোন মুত্তাকী ওলী কি করে কি সাহসে কোন ইলম গুপ্ত রাখতে পারেন? যাতে এ কথাই প্রতয়মান হয় যে, কোনও ইলম -যার মাধ্যমে ইহপরকালে মঙ্গলের আশা করা যায়-তা গুপ্ত নেই। সব ইমই আল-আমীন নবী ঐক্ত, তাঁর পর তাঁর আমানতদার সাহাবায়ে কেরাম , তাঁদের পর তাবেয়ীনবৃন্দ (রঃ) এবং তাঁদেরই অনুগামী আউলিয়া ও ইমামগণ প্রকাশ ও প্রচার করে গেছেন। বাতেনী ইলম বলে কিছু নেই; যা আছে তা ভন্ডামি ও ভ্রষ্টতা। বাতেনীর নাম নিয়ে বোকা মানুষদেরকে ধােকায় ফেলে ওরা নিজেদের বুযুর্গী জাহির করে থাকে মাত্র।

(১২) বিদআতের অন্যতম প্রভাব এই যে, বিদআতী তার দ্বারা দ্বীনের সৌন্দর্য বিনষ্ট করে এবং তার অনাবিল রূপে আবিলতা আনে। বিদআতীদের বহুবিধ কুসংস্কার ও কু-আচরণ দেখে ইসলামের শত্রুরা দ্বীনের প্রতি কটাক্ষের সহিত বিদ্রুপ হানে। দরবেশীরূপ, বৈরাগী হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি, নযর-নিয়ামের নামে অসদুপায়ে ভক্তদের অর্থহরণ, গাঁজা ইত্যাদি মাদকদ্রব্য সেবন প্রভৃতি দেখে সকলের মনে। ইসলামের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে। ফলে দ্বীনের আসলরূপ চাপা পড়ে যায় এবং ইসলাম গ্রহণ করা হতে অনেক মানুষ দুরে সরে যায়। বরং বহু অজ্ঞ মুসলিমের মনেও ইসলামের প্রতি বিরাগ জন্মে। ফলে বিদআতীরা মানুষের হেদায়াতের পথে। বাধা হয়ে দাড়ায়।

(১৩) বিদআত মুসলিম জাতির সংহতি ও ঐক্য ধ্বংস করে। সুসংবদ্ধ সমাজের অভ্যন্তরে বিছিন্নতা সৃষ্টি করে, এক এক ধরনের অভিনব বিশ্বাস কর্ম বা কর্মপদ্ধতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জামাআত বা দল গঠিত হয়। মতানৈক্যের কারণে এক দল অপর দলের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব রাখে। এক দল অপর দলকে ভ্রষ্ট, কাফের বা বিদআতী ভাবে। প্রতি দলের অনুসারী নিজের দলীয় নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং বিপক্ষের নীতির প্রতিবাদ করে। ভাবে তার দলই শ্রেষ্ঠ উম্মত, যাদেরকে আল্লাহ মানুষের জন্য নির্বাচিত করেছেন। অন্ধ পক্ষপাতিত্বের পরিণাম শেষে এই দাঁড়ায় যে, একদল অপর দলের জান মাল হালাল মনে করে! এই অবকাশে কোন। ইসলাম দুশমন সুবর্ণ-সুযোগ পায়। অগম্য ইসলাম দুর্গের উদ্দেশ্যে এই ছিদ্রপথ ব্যবহার করে এবং ইসলামের অপরাজেয় শক্তিকে ভিতর থেকে মুসলিমদের সাহায্যেই নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে কৃতার্থ হয়ে যায়। যখন অনল্প অর্থ ও শক্তি থাকা সত্ত্বেও মুসলিমরা পরাভূত হয়ে পড়ে।

আল্লাহর রসূল ঐ সত্যই বলেছেন, “অনতি দূরে বিজাতিসমূহ তোমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে, যেমন ভোজনকারীগণ (একই) ভোজপাত্রের উপর একত্রিত হয়।” একজন বলল, 'আমরা কি তখন সংখ্যায় কম থাকব? হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন,“বরং তখন তোমরা সংখ্যায় অনেক থাকবে। কিন্তু তোমরা হবে তরঙ্গতারিত আবর্জনার ন্যায়। আল্লাহ তোমাদের শত্রুর বক্ষ হতে (তোমাদের প্রতি) ভীতি ছিনিয়ে নেবেন এবং তোমাদের হৃদয়ে দুর্বলতা প্রক্ষিপ্ত করবেন।” একজন বলল, 'হে আল্লাহর রসূল! সে দুর্বলতা কি? তিনি বললেন, “দুনিয়াকে ভালবাসা এবং মরতে না চাওয়া।” (আবু দাউদ)।

সংখ্যায় বেশী থাকলেও অনৈক্যের ফলে দুর্বল রয়ে যাবে। ঘনঘটা মেঘের কোথাও কোথাও বিজলী এবং গর্জন থাকলেও কোন বর্ষণ থাকবে না।

‘ভিতরে দিতে যত মরিয়াছি বাহিরের দিকেও তত,

গুনতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি গরু-ছাগলের মত।

অথচ বিধানকর্তা এ জাতিকে সতর্ক করে বলেছেন,

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا

অর্থাৎ, তোমরা সকলে আল্লাহর রশি (কুরআন ও দ্বীন)কে শক্ত করে ধারণ কর এবং পরস্পর বিছিন্ন হয়ো না। (সূরা আলে ইমরান ১০৩ আয়াত) তিনি অন্যত্র বলেন,

أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ

অর্থাৎ, তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওতে (মতভেদ করে) বিছিন্ন হয়ো না।” (সূরা শুরা ১৩ আয়াত) তিনি আরো বলেন,

وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ ۚ وَأُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ

অর্থাৎ, “তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর (বিভিন্ন দলে) বিভক্ত হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (সূরা আলে ইমরান ১০৫ আয়াত) মহান আল্লাহ আরো বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ ۚ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُم بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ

অর্থাৎ, অবশ্যই যারা দ্বীন সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে (হে নবী) তুমি কোন কিছুতে তাদের অন্তর্ভুক্ত নও (এবং তারাও তোমার দলভুক্ত নয়)। তাদের বিষয় আল্লাহর উপর ন্যস্ত, আল্লাহ তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে তাদেরকে অবহিত করবেন।” (সূরা আনআম ১৫৯ আয়াত)।

আল্লাহর রসুল ও উম্মতকে সাবধান করে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, “ইয়াহুদ একাত্তর দলে এবং নাসারা বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে এবং আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। যার একটি মাত্র দল ছাড়া সবগুলিই জাহান্নামী হবে।”

সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, সেই একটি দল কোনটি, হে আল্লাহর রসুল?” তিনি। বললেন, “যে দল আজ আমি ও আমার সাহাবাগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত আছি, তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী) কিন্তু মুখতা ও যুলুম সকল মন্দের মূল। এই উভয় হতেই শুরু হয় ভুল বুঝাবুঝি। ফলে অনেকে নিজেকে ত্রুটিহীন মনে করে অথবা নিজের মান্যবরকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভুলমুক্ত জ্ঞানী মনে করে প্রকৃত হক ও সত্য চিনতে ভুল করে বসে এবং শুরু হয়। দ্বন্দ্ব ও বিছিন্নতা।

(১৪) সমাজকে সাবধান ও সতর্ক করার উদ্দেশ্যে বিদআতীর গীবত করা বৈধ; যেমন ফাসেক ও প্রকাশ্যে পাপে লিপ্ত ব্যক্তির সমালোচনা ও চর্চা করা হারাম নয়। বরং প্রয়োজন ক্ষেত্রে তা ওয়াজেব হয়ে পড়ে। যেমন যদি কেউ বিদআতী বা দুষ্কৃতীর সহিত অজান্তে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়তে, তার প্রতিবেশ গ্রহণ, ব্যবসা বা অন্য কোন ব্যবহারিক জীবনে অংশী হতে কারো নিকট পরামর্শ বা খোঁজ-খবর নেয়, তবে জানা থাকলে নসীহতের নিয়তে তার নিকট ঐ ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা খুলে বর্ণনা করা ওয়াজেব হবে।

অনুরূপভাবে কোন তালেবে ইলমকে যদি কেউ কোন বিদআতীর নিকট বসতে বা ইলম শিক্ষা করতে দেখে তবে (হিংসা করে নয় বরং) নসীহতের নিয়তে ঐ তালেবকে সতর্ক করা তার জন্য ওয়াজেব। বিদআতীর প্রকাশ্য গীবত করা এবং জনসাধারণকে হুশিয়ার করা কেবল ইনসাফের সাথে তার বিদআতের উল্লেখ করতে হবে। অন্য কারণ না থাকলে তার অন্যান্য দোষ-ত্রুটি বয়ান করা বৈধ্য হবে না। যেমন ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটাবার উদ্দেশ্যে বা ঈর্ষায় কাতর হয়ে অথবা কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে অথবা ব্যক্তিগত কোন। প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে ঐ সুযোগের অপব্যবহার করা আদৌ বৈধ হবে না।

(১৫) বিদআতীদের সাধারণ স্বভাব এই যে, তারা পথ ও মত পরিবর্তনের সময় বিদআত থেকে অধিক নিকষ্টতর বিদআতের প্রতি ধাবমান হয়। আল্লাহ তাআলা তাদের বক্রতার প্রতিদান দেন। যেহেতু কৃতকর্মের প্রকাররানুরূপ প্রতিফলই স্বাভাবিক। মহান আল্লাহ বলেন,

فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ

অর্থাৎ, অতঃপর যখন ওরা বক্রপথ অবলম্বন করল, তখন আল্লাহ ওদের হৃদয়কে বক্র করে দিলেন। (সূরা সাফফ ৫ আয়াত)।

ইয়াহয়্যাবিন আবী উমার শাইবানী বলেন, 'বলা হত যে, বিদআতীদের তওবা আল্লাহ অগ্রাহ্য করেন এবং বিদআতী অধিকতর মন্দ বিদআতের দিকে স্থানান্তরিত হয়।

এ প্রসঙ্গেই আওয়াম বিন হাওশাব তাঁর পুত্রের উদ্দেশ্যে বলতেন, হে (বৎস) ঈসা! তুমি তোমার চিত্ত বিশুদ্ধ কর ও ধন অল্প কর। আল্লাহর কসম! ঈসাকে বিরুদ্ধাচারী (বিদআতী)দের দলে বসতে দেখার চাইতে তাকে গানবাদ্য ও মদের মজলিসে বসতে দেখা আমার নিকট (তুলনামূলকভাবে) অধিকতর পছন্দনীয়।”

কারণ বিদআতী তার বিদআতকে দ্বীন মনে করে এবং দ্বীনকে ধারণ ও মান্য করার মতই বিদআতকে ধারণ ও মান্য করে চলে। আবার কোন কারণবশতঃ ঐ বিদআত থেকে বহির্গত হলে অন্য কোন বড় বিদআতে প্রবেশ করে। কিন্তু মহাপাপী যারা; যেমন গান-বাদ্যকারী ও শ্রবণকারী মদ্যপায়ী ইত্যাদি তারা নিজ কামবশীভূত। তারা জানে যে, তারা যা করে তা মহাপাপ। কিন্তু তাদের কামপ্রবৃত্তি এবং মন্দকর্মপ্রবণ আত্মার বশবর্তী হয়ে তা বর্জন করতে সহজে সক্ষম হয় না। সম্ভবতঃ তাদের অবৈধতা-জ্ঞানের ফলে কখনো তা পরিহার করতেও পারে। যেহেতু গোনাহগার মানুষের ক্ষেত্রে তওবা, অনুশোচনা এবং সমূলে মন্দ কাজ বর্জন করার অধিক সম্ভাবনা ও আশা থাকে; যতটা বিদআতকে ধর্ম জ্ঞানকারী বিদআতীর ক্ষেত্রে থাকে না।

সেই বিদআতীর তওবার কোন আশা থাকে না, যার হৃদয়ে বিদআত বদ্ধমূল হয়ে অন্তস্তলে বড় জায়গা জুড়ে স্থান গ্রহণ করেছে। যার জন্য বিদআতকেই প্রকৃত দ্বীন মনে করে এবং তার প্রতিকূল সব কিছুকে পার্শ্বে বর্জন করে। বিদআতে বিজ্ঞ হয়ে অন্ধভাবে তাই পছন্দ করে। যে তা পছন্দ ও গ্রহণ করে তাকে ভালোবাসে এবং যে অপছন্দ ও অগ্রহণযোগ্য মনে করে তাকে মন্দ বাসে ও ঘূণা করে। বরং অনেক ক্ষেত্রে শত্রু মনে করে। তা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং তার বিরোধীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বেপরোয়া লড়াই লড়ে। যেমন প্রাচীন খাওয়ারেজ বিদআতীরা; যারা বিশ্বাস রাখে যে, যে ব্যক্তি কাবীরাহ গোনাহ করবে সে কাফের হয়ে চিরস্থায়ী জাহান্নামবাসী হবে। যারা কখনো এই বিশ্বাস ও ধারণা হতে বিচ্যুত হয়নি। (অবশ্য কিছু মানুষ সঠিক পথে ফিরে এসেছিল।) অথচ তাদের ঐ ধারণার প্রতিকূলে কুরআনী আয়াতে এবং সহীহ হাদীসে স্পষ্ট দলীল রয়েছে। কিন্তু তারা তা পৃষ্ঠপিছে বর্জন করে শরীয়তের বিরোধিতায় অটল থেকেছে। পরন্তু মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সহিত শির্কের অপরাধ ক্ষমা করেন না, এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। (সূরা নিসা ৪৮ আয়াত)

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি তাওহীদের উপর মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; যদিও সে ব্যভিচার ও চুরি করে থাকে।” তিনি এইরূপ তিনবার পুনঃ পুনঃ বলেছেন।

অনুরূপ আরো বহু দলীলাদির উপর ভিত্তি করে আহলে সুন্নাহ বলে, মহাপাপী আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে, যদি তিনি চান তবে তাকে মার্জনা করবেন, নচেৎ তার পাপ অনুযায়ী পরিমাণ মত শাস্তি প্রদান করবেন এবং (তওহীদের গুণে) তার প্রত্যাবর্তন স্থান হবে জান্নাত। আল্লাহ পাক বলেন,

قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَىٰ إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَٰهُكُمْ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ

অর্থাৎ, বল, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য--। (সূরা কাহাফ ১১০ আয়াত) অন্যত্র তিনি বলেন,

قُل لَّا يَعْلَمُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ

অর্থাৎ, বল, আল্লাহ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই গায়ব (অদৃশ্য) বিষয়ের জ্ঞান রাখে না। (সূরা নামল ৬৫ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

قُل لَّا أَقُولُ لَكُمْ عِندِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ

অর্থাৎ, (হে মুহাম্মাদ!) বল, আমি তোমাদেরকে এ কথা বলি নি যে, আমার নিকট আল্লাহর ধনভান্ডার আছে। আর গায়ব (অদৃশ্য) সম্বন্ধেও আমি অবগত নই--। (সূরা আনআম ৫০ আয়াত)।

এই আয়াতসমূহ এবং আরো অন্যান্য আয়াত ও হাদীস শরীফের উপর ভিত্তি করে আহলে সুন্নাহ বলে যে, আল্লাহর নবী মানুষ ছিলেন এবং তিনি গায়ব জানতেন না, গায়বী খবর তিনি ওহীর মাধ্যমে জানতেন ও জানাতেন। কিন্তু বিদআতীরা ঐ সমস্ত দলীলকে পশ্চাতে ফেলে ভুক্তির আতিশয্যে প্রিয় নবী ধ্রু-কে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ (সৃষ্টির সেরা জীব) হতে বহিস্কৃত করে এবং তাঁর জন্য গায়বীর দাবী করে আল্লাহর আসনে তাঁকে বসাতে দ্বিধা করে না। কেউ বা তাঁর শরীয়তকে পদদলিত করে ফুর্তি মেরে মারেফতী’র দাবী করে অলী সেজে বসে। অথচ অলি হয়ে যে পরিমল আহরণ করে তার সবটাই গরল। হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম করে ব্যবহার করে! এবং তারই মাধ্যমে অজ্ঞ সাদা মানুষদের মন ও হৃদয় লুটে ফায়দা উঠায়। মরণকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে নয়, যেখানে আল্লাহর রসুল (সা.) তাঁর নিজের জন্য দুআ ও দরূদ পড়তে বলেছেন, সেখানে মওতাদের জন্য দুআর উদ্দেশ্যে নয়, পরকালকে স্মরণ করে হৃদয়ে ভয় আনার উদ্দেশ্যে নয়, বরং মৃত্যের কাছে জীবন চাইতে নিঃস্বের কাছে সম্পদ চাইতে এবং পরকালের দুয়ারে ইহকাল চাইতে কবর যিয়ারত (পূজা) সিজদা, চুম্বন, তওয়াফ, তাবারুক, উরস। ইত্যাদি দ্বারা নতুন শরীয়ত রচিত করে।

ওরা মহব্বতে রসুলের নামে সেই কাজ করে যাতে ওদের খুশীর ভরপুর সমাগম ঘটে। ভিন্ন জাতির অনুকরণে দ্বীনকে কেবল নিজেদের স্বার্থ, আনন্দ ও সুস্বাদ আস্বাদনের উদ্দেশ্যে আংশিক ধারণ করে থাকে। আর নিরানন্দে একটু স্বার্থ ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারে ওরা আদৌ মহব্বতের পরিচয় দেয় না। আর ভাবে ঐ অনুষ্ঠানগত মহব্বতই জরুরী ও যথেষ্ট। বাকী তাঁর আদর্শে চরিত্র গড়া, তাঁর নির্দেশ পালন করা, তিনি যা পছন্দ করেছেন তা পছন্দ করা ইত্যাদিকে অজরুরী ও ফালতু ভাবে। পক্ষান্তরে, পার্থিব জীবনে প্রেমের কোন নির্দিষ্ট ধারা নেই, নিয়ন্ত্রিত গতি নেই। হাবীব তার মাহবুবকে যে কোন প্রকারে যে কোন উপায়ে এবং যে কোন মাধ্যমে তার মহব্বত জানাতে পারে। তাতে কোন বাধা নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই এবং সুশৃঙ্খলতা নেই।

কিন্তু বান্দার জন্য আল্লাহ এবং উম্মতের জন্য রসুল এমন মাহবুব, যিনি কেবল নিয়ন্ত্রিত প্রেমই পছন্দ করেন। কপট, হীন উচ্ছঙ্খল বা স্বার্থের প্রেম আদৌ পছন্দ করেন না। নিয়ন্ত্রণ ও পরিমাণের বাইরে কোন প্রেমের অতিরঞ্জন তাঁর নিকট প্রীত নয়। যেহেতু পার্থিব প্রেমে প্রায়শঃ ক্ষেত্রে হাবীব-মাহবুব উভয়ের মান-মর্যাদা অথবা কোন না কোন দিক সমপরিমাণ থাকে; যাতে উভয়ের মনের উচ্ছ্বাস গতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে একে অপরকে ইচ্ছামত বলে এবং ইচ্ছামত উপহার দেয়। কিন্তু সেই মাহবুব যিনি সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, জীবনদাতা, প্রতিটি জীব যাঁর দয়ার মুক্ষাপেক্ষী; তিনি একমাত্র মাবুদ এবং সেই মাহবুব যিনি অনুসৃত, যাঁর আদেশ কেউ অমান্য করলে, যাঁর নির্দেশ কেউ লংঘন করলে জাহান্নামের মহাগ্নি তার উপযুক্ত শাস্তি হয়, যে মাহবুব তাকে ভালোবাসার উপায় শিক্ষা দিয়েছেন, প্রেমের ধরন বলে

দিয়েছেন, যাতে ভালোবাসতে গিয়ে কেউ বেআদবী করে না বসে। এমন মাহবুবের জন্য হাবীবের হৃদয়ে সদা ভয় থাকে; যাতে প্রেম নিয়ন্ত্রণ-হারা, নিয়ম-ছাড়া, বন্ধনহারা ও বেয়াড়া না হয়ে যায়। পার্থিব প্রেমে অতিরঞ্জন চলে, কখনো বা উপহাসছলে। বেআদবী চলে কিন্তু আল্লাহ ও রসুলের প্রেমে নিছক আদব, তা'যীম ও আনুগত্য থাকে। তাইতো ওযুর অঙ্গ তিন বারের পরিবর্তে চার অথবা তার অধিক বার ধৌত করা বৈধ নয়। যদিও অধিকবার ধৌত করায় অধিক অপবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা লাভ হয়। তাইতো আল্লাহর প্রেমে তন্ময় হয়ে ফজরে দুয়ের স্থানে চার রাকআত ফরয। পড়া প্রেমিক বান্দার জন্য বৈধ নয়। যেহেতু তাঁর প্রেমের পথ নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত। এই নির্দিষ্ট সীমা দ্বারাই তাঁর প্রকৃত প্রেমের অগ্নিপরীক্ষা হয়। তাই নির্দেশিত সরল পথ ব্যতীত অন্যান্য বঙ্কিম পথে তাঁর মহব্বত হাসিল হয় না।

পক্ষান্তরে প্রেমিকা কেবল শাড়ীর আবেদন জানালে তার সঙ্গে বাড়তি ব্লাউজ ও চুড়ি নিবেদন করলে সে নারাজ হয় না বরং আরো অধিক খুশী হয় এবং প্রেমের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। ভূত্য সারা দিনের কর্তব্য পালন করেও যদি রাত্রে প্রভুর গা-পা দাবায় তবে প্রভু খুশী হয়ে তার বেতন বৃদ্ধি করে; নারাজ হয় না।।

হাঁ ব্লাউজ ও চুড়ি যদি প্রেমিকার দেহাঙ্গের মাপ ও তার পছন্দমত হয় এবং ভূতের ঐ বাড়তি খিদমত যদি প্রভুর সময় ও প্রয়োজন মত হয় তবেই তা সম্ভব। নচেৎ ভালোবাসার ঝুলিতে ভৎসনাই স্থান পাবে। আবার শাড়ী ব্যতীত অন্য কিছু বাড়তি আনলে এবং কাজ ছেড়ে প্রভুর পা দাবালে কি হবে তা বলাই বাহুল্য।

অনুরূপভাবে শরীয়তের পছন্দমত যে সব নফল (বাড়তি) কাজের নির্দেশ আছে। তা করলে তো আল্লাহ খুশীই হন। কিন্তু তাঁর নির্দেশ ও পছন্দের বাইরে নিজের মনগড়া কিছু করতে চাইলে অবশ্যই বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা ছাড়া কিছুই লাভ হয় না। আবার তাঁর নির্দেশ অমান্য করে অতিরিক্ত অন্য কিছু করে মহব্বত প্রকাশ করতে চাইলে জাহেল হাবীব এটাই বুঝে যে, সে তার মাহবুব ও শরীয়ত অপেক্ষা অনেক বেশী বুঝে। আবার এতটা বলতে দুঃসাহস করে যে, শরীয়ত তো একটা পিয়াজের মত যার সবটাই খোসা (ছাল)! অর্থাৎ যার সার ও আসল কিছুই নেই !! শরীয়তের আলেম ও অনুগামীরা তো কেবল পানারী পাতার মত; যা পানির গভীরতার উপরেই ভেসে বেড়ায় ইত্যাদি!!! এ ধরনের ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা মহব্বতের দাবীদারদের অবস্থা যে কি হবে, তা জ্ঞানীদের নিকট সহজেই প্রতীয়মান। বিদআতীদের এমন অনেক মানুষ আছে যারা বিদআতকে অন্তর্মুলে স্থান দেয় না, তবে তা ভালো জেনে এবং তাতে আল্লাহ খুশী হবেন এই মনে করে লোকের দেখাদেখি সাধারণভাবে তা করে থাকে। কিন্তু তার বিপরীত কোন দলীল বা নীতিকথা শুনলে উদার মনে তা পরিত্যাগ করে প্রকৃত দ্বীনকে হীন সেবকরূপে ধরার চেষ্টা করে এবং বিদআত হতে তওবা করে। অবশ্যই তারা পথপ্রাপ্ত এবং তাদের জন্যই মুক্তি।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে