মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ
অর্থাৎ, হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে ভয় কর এবং তোমরা আত্মসমর্পণকারী (মুসলিম) না হয়ে মরো না। (সূরা আলে ইমরান ১০২ আয়াত)
“হে মানব! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তা থেকে তার সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যিনি তাদের দুজন থেকে বহু নর-নারী বিস্তার করেছেন এবং আল্লাহকে ভয় কর যার নামে তোমরা একে অপরের নিকট যাচঞ্চা কর এবং অজ্ঞাতি-বন্ধন ছিন্ন করাকে ভয় কর, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের উপর তীক্ষ দৃষ্টি রাখেন। (সুরা নিসা ১ আয়াত)।
হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক কথা বল; তাহলে তিনি তোমাদের কর্মসমূহকে ত্রুটিমুক্ত করবেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করবেন। যারা আল্লাহ ও তদীয় রসুলের আনুগত্য করে তারা অবশ্যই মহা সাফল্য অর্জন করবে।” (সুরা আহযাব ৭০-৭১ আয়াত)। আল্লাহ জাল্লা শানুহু তাঁর বান্দাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হতে আদেশ করেছেন এবং অনৈক্য ও আপোস-বিরোধিতা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,
وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ۚ وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللَّهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُم بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنتُمْ عَلَىٰ شَفَا حُفْرَةٍ مِّنَ النَّارِ فَأَنقَذَكُم مِّنْهَا ۗ كَذَٰلِكَ يُبَيِّنُ اللَّهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ
অর্থাৎ, তোমরা সকলে আল্লাহর রশি (দ্বীন ও কুরআন)কে শক্ত করে ধর এবং পরস্পর বিছিন্ন হয়ো না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর, তোমরা পরস্পর শত্রু ছিলে, তিনি তোমাদের হৃদয়ে প্রীতির সঞ্চার করেন। ফলে তোমরা তাঁর অনুগ্রহে পরস্পর ভাই-ভাই হয়ে গেলে। তোমরা অগ্নিকুন্ডের (জাহান্নামের) প্রান্তে ছিলে, অতঃপর তিনি তা থেকে তোমাদেরকে উদ্ধার করেছেন। এরূপে আল্লাহ তোমাদের জন্য নিদর্শন স্পষ্টভাবে বিবৃত করেন, যাতে তোমরা সৎপথ পেতে পার। (সূরা আলে ইমরান ১০৩ আয়াত)
এই ঐক্য রক্ষার জন্য, আল্লাহর রজুকে সুদৃঢ়ভাবে ধারণ করার জন্য এবং বিছিন্নতা থেকে রেহাই পাবার জন্য তিনি বান্দাদেরকে রসুলের উপর নাযেলকৃত অনুশাসনের অনুসরণ করতে আদেশ করেছেন। তিনি বলেন,
كِتَابٌ أُنزِلَ إِلَيْكَ فَلَا يَكُن فِي صَدْرِكَ حَرَجٌ مِّنْهُ لِتُنذِرَ بِهِ وَذِكْرَىٰ لِلْمُؤْمِنِينَ * اتَّبِعُوا مَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِن دُونِهِ أَوْلِيَاءَ ۗ قَلِيلًا مَّا تَذَكَّرُونَ
অর্থাৎ, এই কিতাব তোমার প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে। অতএব তোমার মনে যেন এর সম্পর্কে কোন দ্বিধা না থাকে। যাতে এর দ্বারা তুমি (মানুষকে) সতর্ক কর এবং এটা মুমিনদের জন্য উপদেশ। তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে তোমরা তার অনুসরণ কর এবং তাঁকে ছেড়ে অন্যান্য অভিভাবকদের অনুসরণ করো না। তোমরা খুব অল্পই উপদেশ গ্রহণ করে থাক। (সুরা আরাফ ২-৩ আয়াত)
যেমন, তিনি বাপ-দাদা (অনুরূপ বুযুর্গ, আউলিয়া ও বিদআতীদের) সে সব বিষয়ে অনুসরণ করতে নিষেধ করেন যে বিষয় কিতাব ও সুন্নাহর অনুশাসনের বিপরীত। তিনি বলেন,
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا ۗ أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ
অর্থাৎ, আর যখন তাদেরকে বলা হয় যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার তোমরা অনুসরণ কর; তখন তারা বলে, (না-না) বরং আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদের যাতে (যে মতামত ও ধর্মাদর্শে) পেয়েছি তারই অনুসরণ করব।” যদিও তাদের পিতৃপুরুষগণ কিছুই বুঝত না এবং তারা সৎপথেও ছিল না। (সুরা বাক্বারাহ ১৭০ আয়াত)
তিনি আরো বলেন,
وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا ۚ أَوَلَوْ كَانَ الشَّيْطَانُ يَدْعُوهُمْ إِلَىٰ عَذَابِ السَّعِيرِ
অর্থাৎ, আর যখন বলা হয় যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তোমরা সে বস্তুর অনুসরণ কর; তখন তারা বলে আমাদের বাপ-দাদাদেরকে যাতে পেয়েছি আমরা
তো তাই মেনে চলব; যদিও শয়তান তাদেরকে দোযখ যন্ত্রণার দিকে আহবান করে (তথাপি কি তারা বাপ-দাদারই অনুসরণ করবে)? (সুরা লুকমান ২১ আয়াত)
সুতরাং কিতাব ও সুন্নাহর মতামত ছাড়া অন্য কোন মতবাদের দিকে আহবানকারী প্রবৃত্তি, দোযখের দিকে আহবানকারী মানুষ শয়তানের অনুসরণ করতে মুসলিমকে নিষেধ করা হয়েছে। যেমন কিতাব ও সুন্নাহরই অনুসরণ করতে, কেবল ঐ দুটিকেই জীবন-সংবিধানরূপে গ্রহণ ও ধারণ করতে সে আদিষ্ট হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, মানুষের পরিত্রাণ ও সফলতা কেবল ঐ দুয়ের অনুসরণেই আছে। আল্লাহর রসূল ঐ বলেন, “তোমাদের মাঝে দুটি জিনিস ছেড়ে যাচ্ছি, তা যদি তোমরা শক্তভাবে ধারণ কর, তবে কোন দিন পথভ্রষ্ট হবে না; আল্লাহর কিতাব ও আমার সুন্নাহ।” (মুআত্তা মালেক ইত্যাদি)। এই বাণীতে নবী করীম (সা.) কিতাব ও সুন্নাহর অনুসারীর জন্য সুপথ প্রাপ্তি এবং দুনিয়া ও আখেরাতের সর্বনাশী পথভ্রষ্টতা হতে রক্ষার যামানত নিয়েছেন। যেমন অন্য দিকে আল্লাহর দ্বীনে বিদআত রচনা করতে কঠোরভাবে নিষেধ ও সতর্ক করেছেন এবং সারা উম্মতকে স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন যে, আল্লাহর দ্বীনে যে কোন বিদআত পথভ্রষ্টতার কারণ।
সাহাবী ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) বলেন, (একদা) আল্লাহর রসুল ঐ আমাদেরকে এমন উচ্চাঙ্গের উপদেশ দান করলেন যাতে আমাদের চিত্ত কম্পিত এবং চক্ষু অশ্রু বহমান হল। আমরা বল্লাম, হে আল্লাহর রসুল! এটা যেন বিদায়ী উপদেশ, অতএব আমাদেরকে কিছু অসিয়ত (অতিরিক্ত নির্দেশ দান করুন। তিনি বললেন, “তোমাদেরকে আল্লাহ-ভীতি এবং (পাপ ছাড়া অন্য বিষয়ে) আমীর (বা নেতা) এর আনুগত্য স্বীকার করার অসিয়ত করছি। যদিও বা তোমাদের আমীর এক জন ক্রীতদাস হয়। আর অবশ্যই তোমাদের মধ্যে যারা আমার বিদায়ের পর জীবিত থাকবে তারা অনেক রকমের মতভেদ দেখতে পাবে। অতএব তোমরা আমার এবং আমার সুপথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ অবলম্বন করো, তা দন্ত দ্বারা দৃঢ়তার সহিত ধারণ করো। (তাতে যা পাও মান্য কর এবং অন্য কোনও মতের দিকে আকৃষ্ট হয়ো না।) এবং (দ্বীনে) নবরচিত কর্মসমূহ হতে সাবধান! কারণ, নিশ্চয়ই প্রত্যেক বিদআহ (নতুন আমল) ভ্রষ্টতা।” (আবু দাউদ ৪৪৪৩, তিরমিযী ২৮১৫, ইবনে নাজাহ ৪২ নং)
উল্লেখিত হাদীস শরীফটি উম্মাহর মাঝে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা করতে, ফিতনা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী মতভেদ ও অনৈক্য নির্মূল করতে উদ্বুদ্ধ করে। সুন্নাহর অনুসরণ করে, জামাআত (সাহাবা)র অনুগমন করে, দাওয়াত পদ্ধতি, কর্ম, কথা ও বিশ্বাসে প্রত্যেক নব রচিত কর্মসমূহ বা বিদআত হতে সুদুরে থাকতে আদেশ করে; যা বিভ্রাট ও বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী বিতর্ক ও কলহের প্রতি উম্মাহকে টেনে নিয়ে যায়। আল্লাহ তাআলার প্রত্যাদেশ ও শরীয়ত উম্মাহর কাছে পৌছে না দেওয়া ও যথাযথভাবে তা বিবৃত না করার পূর্বে তাঁর প্রিয় রসুল প্লঃ ইহকাল ত্যাগ করেন নি। তিনি উম্মাহকে সে সকল কিছু কর্তব্যাকর্তব্য বর্ণনা করে গেছেন যাতে তাদের পার্থিব ও দ্বীনী কল্যাণ ও ইষ্ট নিহিত ছিল। তিনি উম্মাহকে এমন সমুজ্জ্বল পথে রেখে গেছেন যার রজনীও দিবসের ন্যায় দীপ্তিমান; যে পথ হতে একমাত্র ধ্বংসগামী ব্যতীত অন্য কেউ বক্রতা অবলম্বন করে না।
আর আল্লাহ জাল্লা শানুহ তাঁর প্রিয় নবীর জন্য দ্বীনকে পরিপূর্ণ ও তাঁর সম্পদকে সম্পূর্ণ করেছেন। আর সমগ্র মানব ও দানব জাতির জন্য ইসলামকেই একমাত্র ধর্ম বলে মনোনীত ও নির্বাচিত করেছেন। তিনি বলেন,
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا
অর্থাৎ, আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করলাম ও তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ (নেয়ামত) সম্পূর্ণ করলাম এবং ইসলামকে তোমাদের ধর্মরূপে মনোনীত করলাম। (সূরা মায়েদাহ ৩ আয়াত) তিনি অন্যত্র বলেন,
وَمَن يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَن يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
অর্থাৎ, কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম চাইলে তা কখনো তার নিকট হতে গ্রহণ করা হবে না এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের দলভুক্ত হবে। (সূরা আলে ইমরান ৮৫ আয়াত)।
সুতরাং এখান হতে প্রতীয়মান হয় যে, দ্বীন অসম্পূর্ণ নয়, বরং সম্পূর্ণ। আর রসূল ঐ তা স্পষ্টভাবে প্রচারও করে গেছেন। যেমন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি ধারণা করে যে, মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর অবতীর্ণ প্রত্যাদেশের কিছুও গুপ্ত করেছেন, তবে সে নিশ্চয় আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেন,
يَا أَيُّهَا الرَّسُولُ بَلِّغْ مَا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ ۖ وَإِن لَّمْ تَفْعَلْ فَمَا بَلَّغْتَ رِسَالَتَهُ
অর্থাৎ, হে আল্লাহর রসূল! তোমার প্রতিপালকের নিকট হতে তোমার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে তা প্রচার কর। যদি তা না কর তবে তুমি তাঁর বার্তা প্রচার করলে না। (সূরা মায়েদাহ ৬৭ আয়াত)।
অনুরূপভাবে বিদায়ী হজ্জের ভাষণে রসুল (সা.) বিভিন্ন অনুদেশ, বৈধাবৈধ এবং পরস্পরের মান-ইজ্জত হারাম হওয়ার প্রসঙ্গ বিবৃত করার পর বলেছিলেন, “শোন! আমি কি (আল্লাহর প্রত্যাদেশ তোমাদের নিকট যথাযথভাবে) পৌছে দিলাম?” সাহাবাবৃন্দ বলেছিলেন, 'হ্যাঁ, অবশ্যই। তখন তিনি আকাশের প্রতি হস্তোত্তলন করে বলেছিলেন, “হে আল্লাহ! সাক্ষী থাকুন। আল্লাহ! সাক্ষী থাকুন।”
অতএব এর পরেও যদি কোন ব্যক্তি দ্বীনে নতুন কিছু আবিষ্কার করে; যার নির্দেশ না কিতাবে আছে সুন্নাহতে এবং না খুলাফায়ে রাশেদীন বা কোনও সাহাবার আদর্শে, তা আকীদা হোক বা আমল, কথা হোক বা ইসলামের প্রতি দাওয়াতী পদ্ধতি তবে ঐ ব্যক্তি যেন বলে যে, দ্বীন অসম্পূর্ণ, পুর্ণাঙ্গ নয়। আর সে এই অসম্পূর্ণতাকে নতুন কিছু (বিদআত) রচনার মাধ্যমে পূর্ণতা দান করার দুঃসাহসিকতা করে থাকে। অথচ মহান আল্লাহ বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম।” অথবা ঐ ব্যক্তি যেন এই বলে বা ধারণা করে যে, দ্বীন তো পূর্ণাঙ্গ। কিন্তু এমন কিছু বিষয় আছে যা নবী ঐ প্রচার করে যাননি! অথচ হযরত আয়েশার হাদীস তা ভীষণভাবে খন্ডন করে।
অনুরূপভাবে বিদায়ী হজ্জের ভাষণে তাঁর তবলীগ ও প্রচার প্রসঙ্গে গুরুত্ব আরোপ করে এ বিষয়ে আল্লাহকে সাক্ষী রাখেন এবং সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, “তোমাদের উপস্থিত ব্যক্তি অনুপস্থিত ব্যক্তিকে পেীছে দেবে। সম্ভবতঃ যার নিকট (ইলম) পৌছে দেওয়া হবে সে শ্রোতা অপেক্ষা অধিক স্মৃতিমান হতে পারে।” অতএব বিদআতীর রসনা অথবা অবস্থা যেন বলে যে, শরীয়ত পূর্ণাঙ্গ নয়। এমন কিছু বিষয় আছে যা তাতে সংযোজন ও পরিবর্ধন করা ওয়াজেব অথবা মুস্তাহাব। যেহেতু তার বিশ্বাস যদি এই থাকত যে, শরীয়ত সর্বতোভাবে পূর্ণতাপ্রাপ্ত, তাহলে নিশ্চয় তাতে আধুনিক কিছু উদ্ভাবন করে তাকে শরীয়ত’ নাম দেবার অপচেষ্টা ও দুঃসাহসিকতা আদৌ করত না। আর এরূপ আকীদা ও বিশ্বাসের মানুষ অবশ্যই পথভ্রষ্ট, সত্য ও সঠিক পথ হতে বহু দুরে।।
ইবনে মাজেশুন বলেন, আমি ইমাম মালেক (রঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, যে ব্যক্তি ইসলামে কোন বিদআত রচনা করে এবং তা পুণ্যের কাজ মনে করে, সে ব্যক্তি ধারণা করে যে, মুহাম্মাদ প্রঃ রিসালতের খিয়ানত (আল্লাহর প্রত্যাদেশ প্রচারে বিশ্বাসঘাতকতা) করেছেন। যেহেতু আল্লাহ তাআলা বলেন, “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম।” অতএব সেদিন যা দ্বীন ছিল না আজও (নতুনভাবে) তা দ্বীন নয়। (আল ইতিসাম ১/৪৯)
ইমাম শাত্ববী তাঁর মূল্যবান গ্রন্থ আল-ই'তিসামে বলেনঃ
১। বিদআতী শরীয়তের বিরোধী ও দ্বীনের পরিপন্থী। কারণ, আল্লাহ আযযা অজাল্ল বান্দাদের জন্য তাঁর ইবাদতের নির্দিষ্ট পথ ও পদ্ধতি নির্ধারিত করেছেন এবং তারই উপরে সৃষ্টিকে তাঁরই আদেশ ও নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে তিরস্কার ও পুরস্কারের অঙ্গীকারের সহিত সীমাবদ্ধ করেছেন। আর এও জানিয়েছেন যে, কেবলমাত্র তাতেই মঙ্গল নিহিত আছে এবং এর সীমালঙ্ঘনে অমঙ্গল ও বিপদ আছে। যেহেতু আল্লাহ (কিসে ভাল অথবা মন্দ আছে তা) জানেন এবং আমরা কিছুও জানি না। আর বিদিত যে, তিনি তাঁর রসূল (সা.)-কে জগদ্বাসীর জন্য করুণা স্বরূপ প্রেরণ করেছেন।
কিন্তু বিদআতী এসব কিছুকে অমান্য ও অস্বীকার করে। সে মনে করে যে, (আল্লাহর নির্ধারিত ও সীমিত পথ ব্যতীত) আরো অন্যান্য পথও আছে (যাতে তাঁর সামিপ্য ও সন্তুষ্টি লাভ হয়) তিনি যা নির্দিষ্ট করেছেন তাতেই সীমাবদ্ধ নয় এবং যা নির্ধারিত করেছেন সেটাই চূড়ান্ত ও শেষ পথ নয়! যেন সে বলে আল্লাহ জানেন আমরাও জানি। বরং আল্লাহর শরীয়তে সংযোজন ও পরিবর্ধন করে সে ভাবে যে, আল্লাহ যা জানতেন না তা সে জেনে ফেলেছে! (নাউযু বিল্লাহ মিন যালিক।) বিদআতীর এমন কর্ম ও ধারণা যদি স্বেচ্ছাকৃত হয়, তবে নিশ্চয় তা কুফর এবং যদি তা অনিচ্ছাকৃত হয়, তবে তা ভ্রষ্টতা।
২। বিদআতী তার এই কাজে নিজেকে আল্লাহ তাআলার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। কারণ আল্লাহ পাক শরীয়ত প্রণয়ন করেছেন এবং মানুষকে তাঁর সেই বিধান অনুযায়ী বাধ্য-বাধকতার সহিত চলতে আদেশ করেছেন। আর তিনিই এ কাজে একক ও অদ্বিতীয়। কারণ বান্দারা যাতে মতভেদ করে থাকে সে বিষয়ে মীমাংসা তিনিই দান করে থাকেন।
তাই শরীয়ত কোন জ্ঞানলব্ধ বস্তু নয় মানুষের বিবেক-বুদ্ধি দ্বারা রচিত বিধান নয়; যা যে কেউ ইচ্ছা করলে নিজের তরফ হতে রচনা বা সংযোজন করতে পারে। যদি ব্যাপারটা তাই হত, তাহলে আর জগদ্বাসীর জন্য কোন নবী বা রসুল প্রেরণ করার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু বিদআতী বিদআত রচনা করে যেন সে নিজেকে শরীয়ত রচয়িতার প্রতিদ্বন্দ্বী ও সমকক্ষ মনে করে। তাই সে তার মত শরীয়তবিধান উদ্ভাবন করতে সাহস পায় এবং এর দ্বারা মতান্তর ও বিচ্ছিন্নতার দ্বার উদ্ঘাটন করতে প্রয়াসী হয়।
৩। আবার বিদআতী তার এই কাজে নিজের কামনা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ করে থাকে। অথচ আল্লাহ পাক বলেন,
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنِ اتَّبَعَ هَوَاهُ بِغَيْرِ هُدًى مِّنَ اللَّهِ
অর্থাৎ, আল্লাহর পথ-নির্দেশ ব্যতিরেকে যে ব্যক্তি নিজের খেয়াল খুশীর অনুসরণ করে তার অপেক্ষা অধিক বিভ্রান্ত আর কে? (সুরা কাসাস ৫০ আয়াত) অতএব যে ব্যক্তি তার আত্মার প্রবৃত্তিকে আল্লাহর পথ-নির্দেশের অনুসারী করে না তার চেয়ে বেশী পথভ্রষ্ট আর কেউ নেই।