গোসল দেওয়ার জন্য স্থানটি পাঁচ দিকে ঘেরা হবে। (উপর দিকেও ছাদ অথবা পর্দা হতে হবে।)
* গোসল দাতা সহায়তার জন্য ২/১ জন ভালো লোক সঙ্গে নিতে পারে। বাকী ঐ পর্দা-সীমার ভিতরে যেন কেউ না থাকে ও গোসল না দেখে। অবশ্য গোনাহ অধিক করে এমন লোককেও সঙ্গে রাখা চলে। যাতে সে মুর্দার হাল দেখে উপদেশ গ্রহণ এবং তওবা করতে পারে। আর উপদেশের জন্য মৃত্যু যথেষ্ট।
* গোসলদাতা মুখে মুখাচ্ছাদন লাগাতে পারে অথবা কাপড় নাকে-মুখে বেঁধে নিতে পারে, যদি কোন রকম দুর্গন্ধ পাওয়ার আশঙ্কা থাকে তবে।
* এপ্প্রন বা সারক্ষণী কাপড় দেহের সম্মুখ ভাগে বেঁধে নিতে পারে যাতে কোন নাপাকী তার শরীর বা পোশাকে না লেগে যায়। উভয় হাতে রবারের দস্তানা বা হ্যান্ডকভার পরা উত্তম। যাতে হাতে ময়লা না লাগে এবং লাশের লজ্জাস্থানাদিতে সরাসরি স্পর্শ না হয়।
* উভয় পায়ে গাম-সু’ ব্যবহার করতে পারে একই উদ্দেশ্যে।
* গোসলদাতা মাইয়েতের দেহ অনু্যায়ী পরিমাণমত পানি প্রস্তুত রাখবে। ১ বালতি সাদা সাধারণ পানি, ১ বালতি কুলের পাতা মিশ্রিত পানি এবং অপর আর ১ বালতি কর্পূর মিশ্রিত পানি প্রস্তুত রাখবে। কুলপাতা পিষে পানিতে দিয়ে এমনভাবে ঘুটবে যাতে পানিতে ফেনা দেখা যায়। প্রতি লিটার পানিতে দুই টুকরা কর্পূর দিতে হবে। এর সঙ্গে প্রয়োজনে সাবান ও শ্যাম্পু ব্যবহারও উত্তম।
* লাশ তুলে একটি তক্তা বা পাটার উপর ধীরে রাখবে। এ তক্তা বা পাটার যেদিকে লাশের মাথা রাখা হবে সেদিকটা যেন একটু উঁচু হয়, যাতে মাথার দিকের পানি পায়ের দিকে গড়িয়ে নেমে যায়। এই পাটা কেবলামুখ হওয়া জরুরী নয়। উল্লেখ্য যে, লাশ তোলা-নামা করার সময় “লা ইলা-হা ইল্লাল্লাহ’র যিকর বিদআত।
* এরপর লাশের লজ্জাস্থানের উপর মাত্র একটি মোটা কাপড় রেখে দেহের পরিহিত সমস্ত কাপড় খুলে দেবে। নবী (ﷺ) এর যুগে এরূপই আমল ছিল। (আবু দাউদ, হাকেম ৩/৫৯-৬০, বাইহাকী ৩/৩৮৭, আহমাদ ৬/২৬৭)।
উল্লেখ্য যে, নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত লজ্জাস্থান দেখা সকলের জন্য হারাম। মহিলা গোসলদাত্রীও মহিলার ঐ স্থান দেখবে না।
* বরফে জমা লাশ হলে অথবা কোন কাপড় খুলতে অসুবিধা হলে কাপড় কেটে বের করে নেবে।
* নখ, গোঁফ ইত্যাদি কেটে ফেলার ব্যাপারে কোন নির্দেশ বর্ণিত হয়নি। অনেকে এসব কাটা বিদআত বলেছেন। (আহকামুল জানায়ে ১৪পৃঃ, মুজামুল বিদা ১২৯পৃঃ)।
* নাক ও মুখগহবরে ময়লা থাকলে আঙ্গুল প্রবেশ করিয়ে পরিষ্কার করবে। শ্লেষ্মাদি নিরবচ্ছিন্নভাবে বের হতেই থাকলে তুলা ইত্যাদি দ্বারা ছিদ্রপথ বন্ধ করে দেবে।
* মাইয়্যেতের দেহের কোন অংশে জমাট বাঁধা ময়লা থাকলে এবং কুলের পাতা দ্বারা দূর না হলে তা সাবান অথবা অন্য কোন পরিষ্কারক বস্তু দিয়ে পরিষ্কার করে দেবে।।
* বাম হাতে (কভারের উপরেই) একটি ন্যাকড়া জড়িয়ে নেবে। অতঃপর সহায়ক সাথীদের সাহায্যে লাশের মাথার দিক একটু তুলে অর্ধ বসার ন্যায় বসাবে এবং ধীরে ধীরে ২/৩ বার পেটের উপর চাপ দেবে, যাতে বাহির-মুখী কোন নাপাকী থেকে থাকলে বের হয়ে যাবে। ময়লা ন্যাকড়া হাত হতে খুলে দেবে। তারপর গোসলদাতা কভার বা ন্যাকড়া-জড়ানো বাম হাত পর্দার নিচে থেকে শরমগাহে ফিরিয়ে এবং উপর থেকে একজন পানি টেলে পরিষ্কার করে দেবে। তারপর কভার অথবা ময়লা ন্যাকড়াটি হাত থেকে খুলে ফেলবে।
* যদি নাপাকী একটানা অথবা বারবার বের হতে থাকে, তাহলে ২/৩ বার ধুয়ে দেখার পর ছিদ্রপথ তুলা বা বস্ত্রখন্ড দ্বারা বন্ধ করে দেবে। প্রয়োজন হলে এর উপর প্লাস্টার-পটি ব্যবহার করতে পারে। প্রকাশ যে, এ ছাড়া পৃথকভাবে ‘বার গোসল’ বলে আর কিছু নেই। মাটির ঢেলা ব্যবহার করার কথাও হাদীসে বর্ণিত হয় নি। সুতরাং ন্যাকড়া ব্যবহার করাই উচিত। অতঃপর গোসলদাতা গোসল দেবার নিয়ত করে মাইয়্যেতের উভয় হাত ‘বিসমিল্লাহ বলে কবজি পর্যন্ত ধুয়ে দেবে। (ভিজে পরিষ্কার ন্যাকড়ার সাহায্যে) তিনবার মুখের ভিতর দাঁত সহ মাসাহ করবে। তিনবার নাকের ভিতর মাসাহ করে দেবে। অতঃপর সাধারণ ওযুর ন্যায় মুখমণ্ডল, হাত ইত্যাদি যথা নিয়মে ধুইয়ে মাথা ও কান মাসাহ করে পাধুইয়ে ওযু সমাধা করবে।
অতঃপর কুলের পাতা মিশ্রিত পানি দ্বারা মাইয়্যেতের মাথা ও মুখমণ্ডল (দাড়ি সহ) উত্তমরূপে ধৌত করবে। মহিলার মাথায় চুটি গাঁথা থাকলে খুলে নিয়ে ভালোরূপে এবং প্রয়োজন হলে শ্যাম্পু দ্বারা ধৌত করবে।
অতঃপর মাইয়্যেতকে বামপার্শ্বে শয়ন করিয়ে ঐ পানি দ্বারা কাঁধ থেকে শুরু করে ডান পায়ের শেষাংশ পর্যন্ত ভালোভাবে রগড়ে দেবে। তারপর ডান কাতে শুইয়ে বাম পার্শ্ব অনুরূপ ধৌত করবে। পর্দার নিচে লজ্জাস্থানসমুহে কভার দেওয়া হাত ফিরিয়ে ধুয়ে দেবে।।
পুনঃ দ্বিতীয়বার ঐ একই পানি দ্বারা একই রূপে গোসল দেবে। অতঃপর কর্পূর মিশ্রিত পানি দ্বারা মাথা ও মুখমণ্ডল ধুয়ে দেওয়ার পর অনুরূপ একবার গোসল দেবে।
এরপরেও নাপাকী দেখা দিলে তিনের অধিক ৫ ও ৭ বা ততোধিকবার বেজোড় গোসল দেওয়া যায়। তবে শেষ বারে যেন কপূর মিশ্রিত পানি দ্বারা গোসল হয়। (বুখারী ১১৭৫ ক, মুসলিম ১৫৫৭ক প্রমুখ।
এরপর শুষ্ক কাপড় দ্বারা মাইয়্যেতের দেহ মাথা, বুক, মুখ, পেট, হাত, পা, মুছে দেবে। লজ্জাস্থানের উপর ভিজে কাপড়টিকে অন্য একটি শুষ্ক কাপড় দ্বারা পাল্টে দেবে। মাইয়্যেতের চুল আঁচড়ে দেবে। (বুখারী ১১৭৬, মুসলিম ১৫৫৮ক, ইবনে আবী শাইবাহ ১০৯৯ ১নং) মহিলার চুল আঁচড়ে চুটি গেঁথে কাফনানোর সময় লাশের পিছন দিকে ফেলে রাখবে। মাথার দুই সাইডে দুটি এবং সামনের দিকে চুল নিয়ে একটি মোট তিনটি বেণী হবে। (বুখারী, মুসলিম, আবু দাউদ, নাসাঈ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ আহমাদ ৫/৮৪-৮৫, ৬/৪০৭ ৪০৮) এ পর্যন্ত করলে লাশ কাফনানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে।। লাশের কোন অঙ্গ অগ্নিদগ্ধ বা কোন দুর্ঘটনায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে থাকলে কাপড় জড়িয়ে গোসলের পর ঐ অঙ্গে মাসাহ করে দেবে।। চারমাসের নিষ্মের গর্ভপাতজনিত ভ্রূণের গোসল, কাফন ও নামায নেই। একটি ছোট কবর খুঁড়ে তাকে দাফন করা হবে। চার মাসের উর্ধের ভ্রূণের কাফন-দাফন সাত বছরের নিম্মের বালক-বালিকার মতই। সুতরাং ঐ প্রাণের নাম রাখতে হবে এবং আকীকাও দিতে হবে। (আহকামুল জানাইয ৮১পৃঃ, আলবিজাযাহ ৭৫পৃঃ, আশ-শারহুল মুমতে’৫/৩৭৪, ৭/৫৩৯)।
সর্বদা মাইয়্যেতের সম্মানের খেয়াল রাখবে গোসলদাতা, যাতে গোসল দেওয়ার সময় বা অন্যান্য ক্ষেত্রে তার প্রতি ধস্তাধস্তি না হয় ও গোসলে শীতের সময় শীতল এবং গ্রীষ্মের সময় খুব গরম পানি ব্যবহার না করা হয়।
লাশের মুখে বাঁধানো সােনার দাঁত থাকলে যদি মুখ এঁটে বন্ধ থাকে, তাহলে বল প্রয়োগ করে খোলার চেষ্টা করবে না। খোলা থাকলে এবং দাঁত সহজে বের করা সম্ভব হলে বের করে নেবে, নচেৎ বলপূর্বক বের করবে না। (আলবিজাযাহ ৭৫পৃঃ)
হজ্জ করতে গিয়ে ইহরাম অবস্থায় মৃত মুহরিমের গোসলে কোন প্রকার সুগন্ধি বা কর্পূর ব্যবহার বৈধ নয়। যেহেতু পূর্বোক্ত ইহরাম বাঁধা অবস্থায় মৃত হাজীর জন্য নবী (ﷺ) বলেছিলেন, “ওকে কুলপাতা-মিশ্রিত পানি দ্বারা গোসল দাও, ওর দুই কাপড়ে কাফনাও এবং সুগন্ধি লাগিওনা--- ” জিহাদের ময়দানে হত শহীদের গোসল নেই, যদিও বা সে অপবিত্র অবস্থায় প্রাণ হারায়। তাঁকে তাঁর পোশাক ও খুন সহ দাফন করা হবে। নবী (ﷺ) উহুদের দিন এই নির্দেশই দিয়েছিলেন। (বুখারী ১২৬০তিরমিযী ৯৫৭ক, নাসাঈ ১৯২৯, প্রমুখ)।
আনাস (রাঃ) বলেন, উহুদ যুদ্ধের শহীদদের গোসল দেওয়া হয়নি; তাদেরকে তাদের খুন সহ দাফন করা হয়েছিল। (আবু দাউদ ২৭২৮-ক, তিরমিযী ৯৩৭ সহীহ আবু দাউদ ২৬+৮নং) ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, হামা বিন আবু মুত্তালিব ও হানযালা বিন রাহেব নাপাক অবস্থায় (উহুদ যুদ্ধে) শহীদ হন। নবী (ﷺ) বলেন, “আমি দেখেছি যে, ফিরিশ্তাগণ উভয়কে গোসল দিচ্ছে।” (তাবরানীর কাবীর, মাজমাউয যাওয়াইদ ৩/২৩, হাকেম ৩/১৯৫) সুতরাং নাপাকে থাকা অবস্থায় নিহত শহীদকে গোসল দেওয়া ওয়াজেব হলে ফিরিশ্তাদের গোসল দেওয়ায় ওয়াজেব পালন হত না। বরং নবী (ﷺ) তাদেরকে গোসল দিতে সাহাবীগণকে আদেশ করতেন। কারণ, মৃতকে গোসল দেওয়ার পশ্চাতে উদ্দেশ্য হল মুসলিমদের এক ইবাদত পালন। (আহকামুল জানাইয ৫৬পৃঃ টীকা)
গোসলদাতার জন্য (বিশেষ করে তার নিজ দেহে কোন নাপাকী লাগার সন্দেহ থাকলে) গোসল করা মুস্তাহাব। নবী (ﷺ) বলেন, যে ব্যক্তি মৃতের গোসল দেয় সে যেন গোসল করে এবং যে তা বহন করে সে যেন ওযু করে।” (আবু দাউদ ২৭৪৯ক, তিরমিযী ৯১৪ক, ইবনে মাজাহ ১৪৫৩ক, সহীহ আবু দাউদ ২৭০৭নং)
তার এই আদেশের নির্দেশ হল মুস্তাহাব। কারণ, তিনি আরো বলেন, “তোমরা যখন তোমাদের মুর্দাকে গোসল দাও তখন তোমাদের জন্য গোসল জরুরী নয়। কেননা, তোমাদের মুর্দা তো নাপাক নয়। সুতরাং কেবল হাত ধুয়ে নেওয়াই তোমাদের জন্য যথেষ্ট।” (হাকেম ১/৩৮৬, বাইহাকী ৩/৩৯৮)।
মাইয়্যেতের গোসল দেওয়ার সময় গোসলদাতা যদি তার কোন ত্রুটি বা অপ্রীতিকর কিছু দেখে থাকে – যেমন চেহারা কালি ও বিকৃত হয়ে যাওয়া, তার দেহ হতে দুর্গন্ধ বের হওয়া ইত্যাদি - তাহলে তা প্রচার করা বা কাউকে বলা বৈধ নয়। ভালো কিছু দেখলে; যেমন হাসি মুখ, দেহে ঔজ্জ্বল্য প্রভৃতি দেখলে বা সুগন্ধ পেলে তা প্রচার করতে পারে। (আল-মুমতে’৫/৩৭৬) গোসল দেওয়ার সময় কোন বাংলা মেয়েলী ছড়া বলা, প্রত্যেক অঙ্গে পানি ঢালার সময় নির্দিষ্ট দুআ বা কলেমার যিকর করা, গোসল দেওয়ার স্থানে কয়েকদিন ধরে বাতি জ্বালানো বা ধুপ ইত্যাদি দেওয়া বিদআত।
গোসল দেওয়ার সময় ব্যবহৃত ন্যাকড়াদি ফেলবার কোন নির্দিষ্ট জায়গা নির্বাচনের প্রয়োজন নেই। (মাটির) বাড়ির মধ্যেই যে কোন জায়গায় বা যেখানে। সুবিধা সেখানেই পুঁতে দেওয়া অথবা মিউনিসিপ্যালিটির ডিব্বায় ফেলে দেওয়া যায়। এ কাপড় বা ময়লা এমন কিছু নয় যে, এতে ভূত (?) জড়িয়ে থাকে- যেমন, অনেকের ধারণা। তাইতো এগুলো ঝুলতলায় (?) ফেলা হয় এবং ঝুলতলাকে সম্মাান অথবা ভয় করা হয়। আর ঐ ময়লা ফেলতে যাওয়ার সময় সঙ্গে লোহাও রাখা হয়। যা বিদআত ও শির্ক।
অনুরূপ একটি অলীক ধারণা এই যে, অনেকে মনে করে লোয়ানোর পানি ডিঙ্গাতে নেই এবং ডিঙ্গালে কোন অমঙ্গল হয়। তাই তো ঐ পানির জন্য (নিকাশ ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও) বিশেষ গর্ত খোড়া হয়।
অনেকের ধারণা, মওতার পদতলে দাঁড়াতে নেই। অথচ এসব নিছক মেয়েলী ব্যাপার।