মরণের পর মানুষের আমল বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষণে সকল ফসল বোনার সময় শেষ, এবারে বোনা ফসল কাটার সময়। যারা বোনার সময় গড়িমসি করে কাটিয়েছে তারা এখানে এসে দেখবে, তাদের জমিতে ফসল নেই। রয়েছে। জমিভরা আগাছা অথবা আগছা মিশ্রিত ফসল। তাদের জন্য রয়েছে বড় আক্ষেপ, কবরের ফিতনা ও আযাব।
আগুনের মাঝে অথবা বন্যা স্রোতের মাঝে পড়ে যেমন কোন মানুষ বাঁচার জন্য আকুল ফরিয়াদ করে, তেমনি কবরে গিয়ে পাপী মানুষও যেন সাহায্যের আশায় চেয়ে থাকে। জীবিত আত্মীয়-স্বজনরা তাদের যথার্থ সাহায্য সামগ্রী নিয়ে তাকে সহায়তা করতে পারে।
অবশ্য সেই সাহায্য পাঠাতে হবে সরকারী ডাকে এবং সরকারী নিয়মে। নচেৎ বেসরকারী ডাক ও নিয়মে সাহায্য পাঠালে তা সঠিক ঠিকানায় না পৌছে ‘মেহনত বরবাদ ও গোনাহ লাযেম’ হয়ে যাবে। আবার যেখানে দই’ এর প্রয়োজন সেখানে ‘খই’ অথবা চুন’ পাঠালে সাহায্যপ্রার্থী কোন উপকার পাবে না।
মৃত ব্যক্তি যে সব আমল দ্বারা উপকৃত হয়ে থাকে তা নিম্নরূপঃ
১। মুসলিম তার সেই মধ্যজগৎ হতে আত্মীয়-স্বজন ও মুসলিম ভায়ের দুআয় উপকৃত হয়ে থাকে। দুআ কবুলের সমস্ত শর্ত পূর্ণ থাকলে নিশ্চয় সে দুআ তার কাজে দেবে। কুরআন মাজীদে মৃতের জন্য দুআর কথা উল্লেখ হয়েছে; আল্লাহ তা'আলা বলেন,
وَالَّذِينَ جَاءُوا مِن بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِّلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ
অর্থাৎ,---যারা ওদের পরে এসেছে তারা বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে এবং ঈমানে অগ্রণী (বিগত) আমাদের ভাইদেরকে ক্ষমা কর। আর ঈমানদারদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন হিংসা-বিদ্বেষ রেখো না। হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু। (সুরা হাশর ১০ আয়াত)
প্রিয় নবী (ﷺ)-ও মৃতব্যক্তির জন্য দুআ করেছেন। যেমন, জানাযার নামায ও কবর যিয়ারতের বিভিন্ন দুআ এ কথার সাক্ষী। যার প্রায় সবটাই মাইয়্যেতের জন্য দুআ ও ক্ষমা প্রার্থনায় পূর্ণ। পরন্তু মহানবী (ﷺ) এ কথাও বলেছেন, “মুসলিম ব্যক্তির কোন ভায়ের জন্য তার অদৃশ্যে থেকে দুআ কবুল হয়। দুআকারীর মাথার উপর এক ফিরিশ্তা নিয়োজিত থাকেন। যখনই দুআকারী তার (অদৃশ্য বা অনুপস্থিত) ভায়ের জন্য দুআ করে, তখনই উক্ত ফিরিশ্তা বলেন, 'আমীন। আর তোমার জন্যও অনুরূপ।” (মুসলিম ২৭৩৩, আবু দাউদ ১৫৩৪নং প্রমুখ।
২। মাইয়্যেতের নযর-মানা রোযা যদি তার অভিভাবক কাযা রেখে দেয়, তবে তার সওয়াব তার উপকারে আসবে।
প্রিয় রসূল (ﷺ) বলেন, “ব্যক্তি রোযা কাযা রেখে মারা যায় সে ব্যক্তির তরফ থেকে তার অভিভাবক (বা ওয়ারেস) রোযা রাখবে।” (বুখারী ১৯৫২, মুসলিম ১১৪৭নং, প্রমুখ)।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, 'এক মহিলা সমুদ্র-সফরে বের হলে সে নযর মানল যে, যদি আল্লাহ তাবারাকা অতাআলা তাকে সমুদ্র থেকে পরিত্রাণ দান করেন, তাহলে সে একমাস রোযা রাখবে। অতঃপর সে সমুদ্র থেকে পরিত্রাণ পেয়ে ফিরে এল। কিন্তু রোযা না রেখেই সে মারা গেল। তার এক কন্যা নবী (ﷺ) এর নিকট এসে সে ঘটনার উল্লেখ করলে তিনি বললেন, “মনে কর, তার যদি কোন ঋণ বাকী থাকত, তাহলে তা তুমি পরিশোধ করতে কি না?” বলল, ‘হ্যা। তিনি বললেন, “তাহলে আল্লাহর ঋণ অধিকরূপে পরিশোধযোগ্য। সুতরাং তুমি তোমার মায়ের তরফ থেকে রোযা কাযা করে দাও।” (আবু দাউদ ৩৩০৮নং, আহমাদ ২/২১৬ প্রমুখ।
তদনুরূপ রমযানের রোযা কাযা করে মারা গেলে তার বিনিময়ে তার অভিভাবক ফিদয়্যাহ (প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে একটি মিসকীনকে একদিনের খাদ্য অথবা ১ কিলো ২৫০ গ্রাম করে চাল) দিলে তার সওয়াবও মাইয়্যেতের জন্য উপকারী।
আমরাহর মা রমযানের রোযা বাকী রেখে ইন্তিকাল করলে তিনি মা আয়েশা (রাঃ)-কে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি আমার মায়ের তরফ থেকে কাযা করে দেব কি?’ আয়েশা (রাঃ) বললেন, 'না। বরং তার তরফ থেকে প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে এক একটি মিসকীনকে অর্ধ সা’ (প্রায় ১কিলো ২৫০ গ্রাম খাদ্য) সদকাহ করে দাও।' (ত্বাহাবী ৩/ ১৪২, মুহাল্লা ৭/৪, আহকামুল জানাইয, টীকা ১৭০পৃঃ)
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, কোন ব্যক্তি রমযান মাসে অসুস্থ হয়ে পড়লে এবং তারপর রোযা না রাখা অবস্থায় মারা গেলে তার তরফ থেকে মিসকীন খাওয়াতে হবে, তার কাযা নেই। পক্ষান্তরে নযরের রোযা বাকী রেখে গেলে তার তরফ থেকে তার অভিভাবক (বা ওয়ারেস) রোযা রাখবে।” (আবু দাউদ ২৪০ ১নং প্রমুখ)
৩। মাইয়্যেতের তরফ থেকে আত্মীয় বা যে কেউ তার ছেড়ে যাওয়া ঋণ পরিশোধ করলে সে কবরে উপকৃত হয়। এ ব্যাপারে পুস্তিকার শুরুর দিকে আলোকপাত করা হয়েছে।
৪। মাইয়্যেত হজ্জ করার নযর মেনে মারা গেলে, অথবা হজ্জ ফরয হওয়ার পর কোন ওযরে না করে মারা গেলে যদি তার ওয়ারেসীনদের কেউ (যে নিজের ফরয হজ্জ আগে পালন করে থাকবে) তার তরফ থেকে তা পালন করে তবে এর সওয়াবেও সে লাভবান হবে।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি নবী (ﷺ) এর নিকট এসে বলল, 'আমার বোন হজ্জ করার নযর মেনে মারা গেছে। (এখন কি করা যায়?) নবী (ﷺ) বললেন, “তার ঋণ বাকী থাকলে কি তুমি পরিশোধ করতে? লোকটি বলল, ‘হ্যাঁ। তিনি বললেন, “তাহলে আল্লাহর ঋণ পরিশোধ করে দাও। কারণ, তা অধিক পরিশোধযোগ্য।” (বুখারী ৬৬৯৯নং)
অনুরূপ এক মহিলা বলল, হে আল্লাহর রসূল! আমার আব্বা বড় বৃদ্ধ। তার ফরয হজ্জ বাকী আছে। এখন সওয়ারীতে বসে থাকতেও সে অক্ষম। আমি কি তার তরফ থেকে হজ্জ করে দেব?’ নবী (ﷺ) বললেন, “হ্যাঁ।' করে দাও।” (মুসলিম ১৩৩৪-১৩৩৫নং প্রমুখ।
ইমাম নববী (রহঃ) বলেন, এই হাদীস বার্ধক্য, চিররোগ অথবা মৃত্যুর কারণে ফরয হজ্জ পালনে অসমর্থ ব্যক্তির তরফ থেকে হজ্জ পালন করার বৈধতা নির্দেশ করে। (শরহে নওবী ৫/৮৩)
অবশ্য ফরয হওয়া সত্ত্বেও যে বিনা ওজরে সময়ের অবহেলা করে হজ্জ না করে মারা গেছে তার তরফ থেকে হজ্জ আদায় কোন কাজে দেবে না। (আহকামুল জানাইয ১৭১পৃঃ, টীকা)
৫। মাইয়্যেতের ছেড়ে যাওয়া নেক সন্তান যে নেক আমল করে তার সওয়াবের অনুরূপ সওয়াব লাভ হয় তার পিতা-মাতারও। এতে সন্তানের সওয়াবও মোটেই কম হয় না। কারণ, সন্তান হল পিতা-মাতার আমলকৃত ও উপার্জিত ধনের ন্যায়। আর আল্লাহ তাআলা বলেন,
وَأَن لَّيْسَ لِلْإِنسَانِ إِلَّا مَا سَعَىٰ
অর্থাৎ, এবং মানুষ তাই পায়; যা সে করে। (সুরা নাজম ৩৯ আয়াত)
আল্লাহ রসূল (ﷺ) বলেন, “মানুষ সবচেয়ে হালাল বস্তু যেটা ভক্ষণ করে তা হল তার নিজ উপার্জিত খাদ্য। আর তার সন্তান হল তার নিজ উপার্জিত ধন। স্বরূপ।” (আবু দাউদ ৩৫২৮, তিরমিযী ১৩৫৮, নাসাঈ ৪৪৬৪, ইবনে মাজাহ ২১৩৭নং প্রমুখ)।
তাই সন্তান যদি তার পিতা-মাতার নামে দান করে অথবা ক্রীতদাস মুক্ত করে অথবা হজ্জ করে, তাহলে এসবের সওয়াবে তারা উপকৃত হবে।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, সা’দ বিন উবাদাহর মা যখন ইন্তেকাল করেন। তখন তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। পরে তিনি আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমার অনুপস্থিত থাকা কালে আমার আম্মা মারা গেছেন। এখন যদি তাঁর তরফ থেকে কিছু দান করি তাহলে তিনি উপকৃত হবেন কি?’ নবী (ﷺ) বললেন, “হাঁ হবে।” সা’দ বললেন, তাহলে আমি আপনাকে সাক্ষ্য রেখে বলছি যে, আমার মিখরাফের বাগান তার নামে সদকাহ করলাম।” (বুখারী ২৭৫৬নং প্রমুখ।)
আব্দুল্লাহ বিন আমর বলেন, আস বিন ওয়াইল সাহমী তার তরফ হতে ১০০টি ক্রীতদাস মুক্ত করার অসিয়ত করে মারা যায়। সুতরাং তার ছোট ছেলে হিশাম ৫০টি দাস মুক্ত করে। অতঃপর তার বড় ছেলে আর বাকী ৫০টি দাস মুক্ত করার ইচ্ছা করলে বললেন, ‘(বাপ তো কাফের অবস্থায় মারা গেছে।) তাই আমি এ কাজ আল্লাহর রসূল (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা না করে করব না।” সুতরাং তিনি নবী (ﷺ)-এর নিকট এসে ঘটনা খুলে বলে জিজ্ঞাসা করলেন, “আমি কি বাকী ৫০টি দাস তার তরফ থেকে মুক্ত করব? উত্তরে আল্লাহর রসূল (ﷺ) বললেন, “সে যদি মুসলিম হতো এবং তোমরা তার তরফ থেকে দাস মুক্ত করতে, অথবা সদকাহ করতে অথবা হজ্জ করতে তাহলে তার সওয়াব তার নিকট পৌঁছত।” (আবু দাউদ ২৮৮৩নং, বাইহাকী ৬/২৭৯ আহমাদ ৬৭০৪নং)
৬। মাইয়্যেতের ছেড়ে যাওয়া স্বকৃত প্রবাহমান ইষ্টাপূর্ত কীর্তিকর্ম (সাদকায়ে জারিয়াহ); যেমন, মসজিদ-মাদ্রাসা নির্মাণ, কল-কুঁয়া প্রভৃতি তৈরী, উপকারী গ্রন্থ প্রণয়ন প্রভৃতি যে সব কীর্তির উপকারিতা দীর্ঘস্থায়ী বহমান থাকে সে ধরনের নিজের কর্মফল মৃত মধ্যজগতেও ভোগ করবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
إِنَّا نَحْنُ نُحْيِي الْمَوْتَىٰ وَنَكْتُبُ مَا قَدَّمُوا وَآثَارَهُمْ ۚ وَكُلَّ شَيْءٍ أَحْصَيْنَاهُ فِي إِمَامٍ مُّبِينٍ
অর্থাৎ, আমিই মৃতদেরকে জীবিত করি এবং লিখে রাখি ওদের কৃতকর্ম আর যে কীর্তিসমূহ পশ্চাতে রেখে যায়। আমি প্রত্যেক জিনিস স্পষ্ট গ্রন্থে সংরক্ষিত রেখেছি। (সুরা ইয়াসীন ১২ আয়াত)
প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন, “মানুষ মারা গেলে তিনটি জিনিস ছাড়া তার আমল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়; সদকাহ জারিয়াহ, ফলপ্রসূ ইলম (শিক্ষা) এবং নেক সন্তান; যে তার জন্য দুআ করে।” (মুসলিম ১৬৩১ আবু দাউদ ২৮৮০, নাসাঈ ৩৬৫৩নং প্রমুখ)।
তিনি আরো বলেন, “মরণের পরেও মুমিনের যে আমল ও নেকী তার সাথে মিলিত হয় তা হল; এমন ইলম যা সে শিক্ষা করেছে এবং প্রচার করেছে, তার ছেড়ে যাওয়া নেক সন্তানও মুসহাফ (কুঅরান শরীফ), তার নির্মিত মসজিদ ও মুসাফির খানা, তার খননকৃত নালা বা ক্যানেল এবং তার মালের সদকাহ যা সে তার সুস্থ ও জীবিত থাকা অবস্থায় দান করে গেছে।” (ইবনে মাজাহ ২৪২নং) এ কথা স্পষ্ট যে, নিজের হাতে করে যাওয়া নেকীতেই লাভের আশা করা যায়। তাছাড়া অপরে যে ঠিকমত ঈসালে সওয়াব করবে তার ভরসা কোথায়?
পক্ষান্তরে অন্যান্য আমল বা পদ্ধতি দ্বারা ঈসালে সওয়াব করলে তা বেসকারী ডাকে ইরসাল হবে যা সঠিক ঠিকানায় পৌছবে না। সুতরাং মাইয়্যেতের তরফ থেকে তওবা করা, নামায পড়া, নিজের অথবা ভাড়াটে ক্বারীদের কুরআনখানী, ফাতিহাখানী, কুলখানী, শবীনা পাঠ, চালশে, চাহারম, নিয়মিত বাৎসরিক দুআ মজলিস ইত্যাদি কোন মতেই ঈসাল বা রিসিভড় হবে না। (আহকামুল জানাইয, মু'জামুল বিদা’ ১৩৫পৃঃ)
উল্লেখ্য যে, ঈসালে সওয়াবের জন্য দান খয়রাত বা দুআর জন্য কোন নির্দিষ্ট দিন, ক্ষণ বা মজলিস নেই। নির্দিষ্ট দিনে অথবা জুমআহ, ঈদ বা তথাকথিত শবেবরাতের দিন বা রাতে বিশেষ করে সাদাকা বা দুআ করা অথবা এর জন্য লোক জমায়েত করে মজলিস করা বিদআত।
অনুরূপভাবে মাইয়্যেত জীবিতকালে যে জিনিস খেতে অধিক পছন্দ করত সেই জিনিসই বিশেষ করে সদকা করা বিদআত।
অনেকে ফাতেহাখানী, কুরআনখানী প্রভৃতি করে তার সওয়াব তাদের জন্য (যেমন আম্বিয়াদের নামে) বখশে দেয় -যাঁরা সওয়াবের মুখাপেক্ষী নন। সুতরাং এমন কাজ বিদআত ও ফালতু বৈ কি?