তাওহীদ পন্থীদের নয়নমণি ৫৯তম অধ্যায় - তাকদীর অস্বীকারকারীদের সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে (باب ماجاء في منكري القدر) শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রহঃ) ২ টি
তাকদীর অস্বীকারকারীদের সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে - ১

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ

«وَالَّذِى نفس ابن عمر بيده لَوْ أَنَّ لأَحَدِهِمْ مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا ثُمَّ أَنْفَقَهُ في سبيل الله مَا قَبِلَه اللَّهُ مِنْهُ حَتَّى يُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ»

‘‘সেই সত্তার কসম, যার হাতে ইবনে উমারের জীবন, তাকদীরের প্রতি অবিশ্বাসীদের কারো কাছে যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও থাকে, অতঃপর তা আল্লাহর রাস্তায় দান করে, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা উহা কবুল করবেন না, যতক্ষণ না সে তাকদীরের প্রতি ঈমান আনে’’। অতঃপর তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই বাণী দ্বারা নিজ বক্তব্যের পক্ষে দলীল পেশ করেনঃ

«الإِيْمَانُ أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ»

‘‘ঈমান হচ্ছে, তুমি আল্লাহ তাআলার প্রতি, তাঁর ফেরেশতাদের প্রতি, তাঁর যাবতীয় কিতাবের প্রতি, তাঁর সমস্ত রাসূলের প্রতি এবং আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে। সাথে সাথে তাকদীর এবং এর ভাল-মন্দের প্রতিও ঈমান আনয়ন করবে’’। ইমাম মুসলিম এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[1]

ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীছগুলোতে তাকদীর অস্বীকার কারীদের সম্পর্কে ভয়াবহ শাস্তির বর্ণনা এসেছে।

قال ابن عمر وَالَّذِى نفس ابن عمر بيده ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ সেই সত্তার কসম, যার হাতে ইবনে উমারের জীবনঃ আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর এই হাদীছটি ইমাম মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী এবং ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) ইয়াহইয়া বিন ইয়ামুর হতে বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারী বলেনঃ ইরাকের বসরা শহরে সর্বপ্রথম মাবাদ আলজুহানী কাযা ও কাদ্র সম্পর্কে কথা বলেছিল। অর্থাৎ তাকদীর অস্বীকার করার ফিতনা প্রকাশ করেছিল। ইয়াহইয়া বলেনঃ আমি এবং হুমায়েদ বিন আব্দুর রাহমান আল-হিময়ারী হজ্জ অথবা উমরার জন্য বের হলাম। আমরা বললামঃ যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোনো একজন সাহাবীর সাক্ষাত পাই, তাহলে তাকদীর সম্পর্কে এরা যা বলছে, সে ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞাসা করবো। আল্লাহ তাআলার তাওফীকে আমরা মসজিদে প্রবেশ করেই আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুকে পেয়ে গেলাম। আমি এবং আমার সাথী তাঁকে ঘিরে ধরলাম। আমাদের একজন ছিল তাঁর ডানে আরেকজন ছিল বামে। আমার ধারণা ছিল, আমার সাথী আমাকেই কথা বলার সুযোগ করে দিবে। তাই আমি প্রশ্ন করলামঃ হে আবু আব্দুর রাহমান! (ইবনে উমারের কুনিয়ত) আমাদের এলাকায় এমন কিছু লোকের আবির্ভাব হয়েছে, যারা কুরআন পড়ে এবং ইলম অর্জনের জন্য সর্বোচ্চ শ্রম ব্যয় করে। তবে তারা ধারণা করে, তাকদীর বলতে কিছু নেই এবং বলে থাকে সকল কাজ নতুন করেই শুরু হয়, পূর্ব হতে নির্ধারিত নয় এবং বান্দা থেকে কাজ সংঘটিত হওয়ার পূর্বে আল্লাহ তাআলা বান্দার কাজ সম্পর্কে কোনো খবর রাখেন না। কাজটি যখন সংঘটিত হয় আল্লাহ তাআলা কেবল তখনই জানতে পারেন।[2]

ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন বললেনঃ যখন তোমরা তাদের সাথে সাক্ষাত করবে, তখন বলবে যে, তাদের থেকে আমি সম্পূর্ণ মুক্ত এবং তারাও আমার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। অর্থাৎ তাদের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। সেই সত্তার কসম, যার নামে আব্দুল্লাহ ইবনে উমার কসম করে থাকেন, তাকদীর অস্বীকার কারীদের কারো কাছে যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও থাকে, অতঃপর তা আল্লাহর রাস্তায় দান করে দেয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা উক্ত দান কবুল করবেন না, যতক্ষণ না সে তাকদীরের প্রতি ঈমান আনে’’। অতঃপর ইবনে উমার আমাদেরকে এই হাদীছ শুনালেন। উমার ইবনুল খাত্তাব বলেনঃ

«بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ذَاتَ يَوْمٍ إِذْ طَلَعَ عَلَيْنَا رَجُلٌ شَدِيدُ بَيَاضِ الثِّيَابِ شَدِيدُ سَوَادِ الشَّعَرِ لاَ يُرَى عَلَيْهِ أَثَرُ السَّفَرِ وَلاَ يَعْرِفُهُ مِنَّا أَحَدٌ حَتَّى جَلَسَ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَأَسْنَدَ رُكْبَتَيْهِ إِلَى رُكْبَتَيْهِ وَوَضَعَ كَفَّيْهِ عَلَى فَخِذَيْهِ وَقَالَ يَا مُحَمَّدُ أَخْبِرْنِى عَنِ الإِسْلاَمِ. فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم « الإِسْلاَمُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَتُقِيمَ الصَّلاَةَ وَتُؤْتِىَ الزَّكَاةَ وَتَصُومَ رَمَضَانَ وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إِنِ اسْتَطَعْتَ إِلَيْهِ سَبِيلاً. قَالَ صَدَقْتَ. قَالَ فَعَجِبْنَا لَهُ يَسْأَلُهُ وَيُصَدِّقُهُ. قَالَ فَأَخْبِرْنِى عَنِ الإِيمَانِ قَالَ « أَنْ تُؤْمِنَ بِاللَّهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ ». قَالَ صَدَقْتَ. قَالَ فَأَخْبِرْنِى عَنِ الإِحْسَانِ. قَالَ « أَنْ تَعْبُدَ اللَّهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ ». قَالَ فَأَخْبِرْنِى عَنِ السَّاعَةِ. قَالَ « مَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ ». قَالَ فَأَخْبِرْنِى عَنْ أَمَارَتِهَا. قَالَ « أَنْ تَلِدَ الأَمَةُ رَبَّتَهَا وَأَنْ تَرَى الْحُفَاةَ الْعُرَاةَ الْعَالَةَ رِعَاءَ الشَّاءِ يَتَطَاوَلُونَ فِى الْبُنْيَانِ» قَالَ ثُمَّ انْطَلَقَ فَلَبِثْتُ مَلِيًّا ثُمَّ قَالَ لِى « يَا عُمَرُ أَتَدْرِى مَنِ السَّائِلُ ». قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ « فَإِنَّهُ جِبْرِيلُ أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ»

‘‘একদা আমরা রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নিকট বসা ছিলাম। এমন সময় আমাদের সামনে এক ব্যক্তি উপস্থিত হলেন, তাঁর পোষাক ছিল ধব্ধবে সাদা। মাথার চুল ছিল কুচকুচে কালো। তাঁর মধ্যে দূর দেশ হতে ভ্রমণ করে আসার কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছিলনা। আর তিনি আমাদের কারো নিকট পরিচিতও ছিলেন না। তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকটবর্তী হলেন। তাঁর দুই হাঁটু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুই হাঁটুর সাথে লাগালেন এবং তার দুই হাত নিজ উরুর উপর রেখে বসে পড়লেন।[3] অতঃপর বললেনঃ হে মুহাম্মদ! আমাকে বলুনঃ ইসলাম কাকে বলে? উত্তরে তিনি বললেনঃ ‘‘ইসলাম হচ্ছে (১) এই সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর রাসূল। (২) সালাত কায়েম করা। (৩) যাকাত আদায় করা। (৪) রামাযানের রোযা রাখা। (৫) সামর্থ থাকলে আল্লাহর ঘরের হজ্জ আদায় করা’’। উত্তর শুনে তিনি বললেনঃ আপনি সত্য বলেছেন। উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমরা তার কথা শুনে অবাক হলাম। তিনি প্রশ্ন করেছেন, আবার উত্তরকে সত্য বলেছেন!

তিনি আবার বললেনঃ আমাকে ঈমান সম্পর্কে সংবাদ দিন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ ‘‘উহা হল, বিশ্বাস স্থাপন করা (১) আল্লাহর উপর (২) তাঁর ফেরেশতাদের উপর (৩) তাঁর কিতাবসমূহের উপর (৪) তাঁর রাসুলদের উপর (৫) আখেরাত দিবসের উপর এবং (৬) তাকদীরের ভাল-মন্দের উপর’’। উত্তর পেয়ে তিনি বললেনঃ আপনি সত্য বলছেন।

তিনি আবার প্রশ্ন করলেনঃ আমাকে ইহসান সম্পর্কে সংবাদ দিন। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ ‘‘ইহসান হল, তুমি এমনভাবে আল্লাহর এবাদত করবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তাঁকে দেখতে না পাও তবে বিশ্বাস করবে যে তিনি তোমাকে অবশ্যই দেখছেন।

অতঃপর তিনি বললেনঃ আমাকে কিয়ামত সম্পর্কে অবহিত করুন। উত্তরে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ ‘‘প্রশ্নকারীর চাইতে প্রশ্নকৃত ব্যক্তি এ সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত নন। তিনি বললেনঃ তবে তার নিদর্শন বা আলামত সম্পর্কে আমাকে সংবাদ দিন। তিনি বললেনঃ ‘‘তুমি দেখবে যে, দাসী তার মনিবকে প্রসব করছে। দেখবে নগ্নপদ, পোষাকহীন, অভাবী এবং রাখালরা উঁচু উঁচু দালান নির্মাণে পরস্পর গর্ব প্রদর্শন করছে’’। এরপর আগন্তুক চলে গেলেন।

[1] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ ইসলাম, ঈমান এবং তাকদীর সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। হাদীছ নং- ১০২।

[2] - এটিই হচ্ছে কাদরীয়া সম্প্রদায়ের আকীদাহ। তারা তাকদীরকে অস্বীকার করে এবং বলে বান্দা থেকে কাজ সম্পাদিত হওয়ার পূর্বে আল্লাহ তাআলা বান্দার কর্ম সম্পর্কে জানেন না। তাদের আরো বিভ্রান্তি রয়েছে। তবে কাদরীয়া সম্প্রদায়ের সকল লোকই যে এই আকীদাহ পোষণ করে, তা নয়। এটি কাদরীয়াদের মধ্যে সর্বাধিক বিভ্রান্তদের বিশ্বাস। এই মতের প্রবর্তক মিথ্যুক ও গোমরাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এবং সকল মুসলিমকে তাদের বিভ্রান্তি থেকে হেফাজত করুন। আমীন

[3] - তিনি তার দুই হাত কার উরুতে রেখেছিলেন, সে সম্পর্কে আলেমদের থেকে দু’টি কথা পাওয়া যায়। ইমাম নববী (রঃ) বলেনঃ ছাত্র যেমন উস্তাদের সামনে নিজ হাত দ্বয় স্বীয় উরুতে রেখে আদবের সাথে বসে, আগন্তুক ঠিক সেভাবেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে স্বীয় হাত দ্বয় তার উরুর উপর রেখেই বসেছিলেন।

আবু দাউদের শরাহ ‘আউনুল মাবুদ’এ শামসুল হক আযীমাবাদী (রঃ) বলেনঃ আগন্তুক তার দুই হাত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুই উরুর উপর রেখেই বসেছিলেন।
তাকদীর অস্বীকারকারীদের সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে - ২

উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমরা কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তা করতে থাকলাম। এরই মধ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে প্রশ্ন করলেনঃ হে উমার! তুমি কি জান প্রশ্নকারী কে? আমি বললামঃ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই এ ব্যাপারে অধিক জ্ঞাত আছেন। তিনি বললেনঃ তিনি হলেন জিবরীল (আঃ)। তিনি এসেছিলেন তোমাদেরকে দ্বীন শিক্ষা দিতে।[4]

উবাদা বিন সামেত রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি একদা তার ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বললেনঃ

«يَا بُنَىَّ إِنَّكَ لَنْ تَجِدَ طَعْمَ حَقِيقَةِ الإِيمَانِ حَتَّى تَعْلَمَ أَنَّ مَا أَصَابَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَكَ وَمَا أَخْطَأَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيبَكَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ « إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فَقَالَ لَهُ اكْتُبْ. قَالَ رَبِّ وَمَاذَا أَكْتُبُ قَالَ اكْتُبْ مَقَادِيرَ كُلِّ شَىْءٍ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ ». يَا بُنَىَّ إِنِّى سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ « مَنْ مَاتَ عَلَى غَيْرِ هَذَا فَلَيْسَ مِنِّى»

‘‘হে বৎস, তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানের স্বাদ অনুভব করতে পারবে না, যতক্ষণ না তুমি এ কথা বিশ্বাস করবে যে, তোমার জীবনে যা ঘটেছে তা ঘটারই ছিল। আর যা ঘটেনি তা কোনো দিন ঘটার ছিলনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি এ কথা বলতে শুনেছি, সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা যা সৃষ্টি করলেন তা হচ্ছে কলম।[5] সৃষ্টির পরই তিনি কলমকে বললেন, লিখো। কলম বললঃ হে আমার রব, আমি কী লিখবো? তিনি বললেন, কিয়ামত পর্যন্ত সব জিনিষের তাকদীর লিপিবদ্ধ করো। হে বৎস! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আমি বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি তাকদীরের উপর বিশ্বাস করা ব্যতীত মৃত্যু বরণ করলো, সে আমার উম্মতের মধ্যে গণ্য নয়’’।[6]

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) হতে অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে আল্লাহ তাআলা সর্ব প্রথম যা সৃষ্টি করেছেন তা হচ্ছে কলম। এরপরই তিনি কলমকে বললেন, লিখো। কলম তখন কিয়ামত পর্যন্ত যা সংঘটিত হবে, সব লিখে শেষ করেছে।

ইবনে ওয়াহাবের একটি বর্ণনা মতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি তাকদীর এবং তাকদীরের ভাল-মন্দে বিশ্বাস করেনা, তাকে আল্লাহ তাআলা জাহান্নামের আগুনে জ্বালাবেন’’।

ব্যাখ্যাঃ উবাদাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত এই হাদীছটি ইমাম আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন। আর ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল উবাদাহ বিন ওয়ালীদ উবাদাহ হতে পূর্ণ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেনঃ আমার পিতা ওয়ালীদ আমার কাছে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেনঃ আমি আমার পিতার নিকট প্রবেশ করলাম। তিনি তখন অসুস্থ ছিলেন। বাহ্যিকভাবে আমার দৃষ্টিতে তাঁর মৃত্যু ছিল অতি নিকটে। ওয়ালীদ বলেনঃ আমি বললামঃ হে আমার পিতা! আমাকে উপদেশ দিন এবং আমার জন্য খাসভাবে ওয়াসীয়ত করুন।

উবাদাহ বিন সামিত রাযিয়াল্লাহু আনহু তখন বললেনঃ আমাকে তোমরা বসাও। অতঃপর উবাদাহ রাযিয়াল্লাহু আনহু বললেনঃ হে বৎস! তুমি ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানের স্বাদ পাবেনা এবং ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত ইলম অর্জন করতে পারবেনা, যতক্ষণ না তাকদীদের প্রতি এবং তার ভাল-মন্দের প্রতি ঈমান আনয়ন করবে।

ওয়ালীদ বলেনঃ আমি বললামঃ হে আমার পিতা! আমি কিভাবে তাকদীরের ভালো এবং তাকদীরের মন্দ সম্পর্কে জানতে পারবো? তিনি তখন বললেনঃ তুমি এ কথা জেনে রাখো, যে কষ্ট ও মসীবতে তুমি পতিত হওনি, তা তোমার কাছে পৌঁছার ছিলনা। আর যে কষ্টে তুমি পতিত হয়েছ, তা তোমার জীবনে না ঘটার ছিলনা। হে আমার পুত্র! আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এ কথা বলতে শুনেছি, সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা যা সৃষ্টি করলেন তা হচ্ছে কলম। সৃষ্টির পরই তিনি কলমকে বললেন, লিখো। কলম তখন কিয়ামত পর্যন্ত যা কিছু হবে সব জিনিষের তাকদীর লিপিবদ্ধ করে ফেলেছে। হে বৎস! তুমি যদি এর উপর ঈমান না রেখে মৃত্যু বরণ করো, তাহলে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। ইমাম তিরমিযী মুত্তাসিল সনদে আতা বিন আবু রাবাহ থেকে বর্ণনা করেছেন।

এই হাদীছ প্রমাণ করে যে, সকল বস্ত্তই আল্লাহর ইলমের আওতায় রয়েছে। এই পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে এবং আগামীতে যা হবে, তাও তিনি জ্ঞানের মাধ্যমে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ وَمِنَ الأرْضِ مِثْلَهُنَّ يَتَنزلُ الأمْرُ بَيْنَهُنَّ لِتَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ وَأَنَّ اللَّهَ قَدْ أَحَاطَ بِكُلِّ شَيْءٍ عِلْمًا

‘‘আল্লাহ্ সেই সত্তা, যিনি সাত আসমান সৃষ্টি করেছেন এবং যমীনও সেই পরিমাণে বানিয়েছেন, এ সবের মধ্যে তাঁর আদেশ অবতীর্ণ হয়, যাতে তোমরা জানতে পার যে, আল্লাহ্ তাআলা প্রত্যেক জিনিষের উপর ক্ষমতাবান এবং আল্লাহর জ্ঞান সবকিছুকে বেষ্টন করে আছে’’। (সূরা তালাকঃ ১২) তাকদীরের উপর ঈমান আনয়ন আবশ্যক হওয়ার আরো অনেক দলীল রয়েছে।

আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা ও ইল্মের ব্যাপকতার মাধ্যমেও আলেমগণ কাযা ও কাদর তথা আল্লাহর ফয়সালা ও তাকদীর নির্ধারণের উপর দলীল গ্রহণ করেছেন। যেমন পূর্বোল্লেখিত আয়াতে অতিক্রান্ত হয়েছে। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) বলেনঃ তাকদীর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীর। আল্লাহ তাআলাই সব কিছু সৃষ্টি ও নির্ধারণ করেছেন।

কোন কোন ইমাম তাকদীরকে অস্বীকার কারীদের ব্যাপারে বলেনঃ আল্লাহ তাআলার অন্যতম সিফাত ‘ইলম’ - এ বিষয়ে তাদের সাথে বিতর্ক করো। তারা যদি আল্লাহর ইলমকে স্বীকার করে নেয়, তবে তারা পরাজিত হবে। আর যদি অস্বীকার করে, তাহলে তারা কুফরীতে লিপ্ত হয়েছে বলে গণ্য হবে।

মুসনাদে আহমাদ এবং সুনানে আবু দাউদে ইবনুদ্ দাইলামী থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ আমি উবাই ইবনে কা’বএর কাছে আসলাম। অতঃপর বললাম, তাকদীরের ব্যাপারে আমার মনে কিছু সন্দেহ উদয় হয়েছে। আপনি আমাকে তাকদীর সম্পর্কে কিছু বলুন। এর ফলে হয়তো আল্লাহ তাআলা আমার অন্তর হতে তা দূর করে দিবেন। তখন তিনি বললেনঃ

«لَوْ أنفقت مِثْلَ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا قَبِلَه اللَّهُ مِنْك حَتَّى تُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ»

‘‘তুমি যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় দান করো, আল্লাহ তোমার এ দান ততক্ষণ পর্যন্ত কবুল করবেন না, যতক্ষণ না তুমি তাকদীরের প্রতি বিশ্বাস করবে’’। আর এ কথা জেনে রাখো, তোমার জীবনে যা ঘটেছে তা না ঘটার ছিলনা। আর তোমার জীবনে যা ঘটেনি, তা ঘটার ছিলনা। এ বিশ্বাস না করে তুমি যদি মৃত্যু বরণ করো, তা হলে অবশ্যই জাহান্নামী হবে।

ইবনুদ দাইলামী বলেনঃ অতঃপর আমি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ, হুযায়ফা বিন ইয়ামান এবং যায়েদ বিন ছাবিত রাযিয়াল্লাহু আনহুর নিকট গেলাম। তাদের প্রত্যেকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ রকমই বর্ণনা করেছেন’’। ইমাম আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকিম এই হাদীছ তার সহীহ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন এবং সহীহ বলেছেন।

ব্যাখ্যাঃ ইমাম ইবনুদ্ দাইলামীর সংক্ষিপ্ত পরিচয় হচ্ছে, তিনি আবু বিশর অথবা আবু বুসর আব্দুল্লাহ বিন আবু ফাইরুয।

আবু দাউদের বর্ণনায় উপরোক্ত হাদীছের শব্দগুলো নিম্নরূপ। উবাই ইবনে কা’ব রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ

«لَوْ أَنَّ اللَّهَ عَذَّبَ أَهْلَ سَمَوَاتِهِ وَأَهْلَ أَرْضِهِ لَعَذَّبَهُمْ وَهُوَ غَيْرُ ظَالِمٍ لَهُمْ وَلَوْ رَحِمَهُمْ لَكَانَتْ رَحْمَتُهُ خَيْرًا لَهُمْ مِنْ أَعْمَالِهِمْ وَلَوْ أنفقت مِثْلُ جَبَلِ أُحُدٍ ذَهَبًا مَا قبِلَه الله مِنْكَ حَتَّى تُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ وتَعْلَمَ أَنَّ مَا أَصَابَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُخْطِئَكَ وَأَنَّ مَا أَخْطَأَكَ لَمْ يَكُنْ لِيُصِيبَكَ ولو مُتَّ عَلَى غَيْرِ هَذَا لَكُنْتَ منْ أهلِ النَّارَ فَأَتَيْتُ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ مَسْعُودٍ فقال مِثْلَ ذلك ثم أَتَيْتُ حُذَيْفَةَ بن اليمان فَقَالَ مِثْلَ ذلك قَال ثم أتيت زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ فَاسْأَلْهُ فَأَتَيْتُ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ فحدثني عن النبي صلى الله عليه وسلم مثل ذلك»

‘‘আল্লাহ তাআলা যদি আসমান ও যমীনের সকল অধিবাসীকে শাস্তি দেন, তাতেও তিনি যালেম হবেন না। আর যদি আসমান ও যমীনের সকলের উপর রহম করেন, তাহলে আললাহর রহমত তাদের আমলের তুলনায় উত্তম হবে। তাকদীরের উপর ঈমান আনয়ন করা ব্যতীত তুমি যদি উহুদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও আল্লাহর রাস্তায় খরচ করো, তাহলেও আল্লাহ তোমার পক্ষ হতে উহা কবুল করবেন না। আর এ কথাও জেনে রাখো, তোমার জীবনে যা ঘটেছে, তা না ঘটার ছিলনা। আর তোমার জীবনে যা ঘটেনি, তা ঘটার ছিলনা। এ বিশ্বাস না করে যদি মৃত্যু বরণ করো, তা হলে তুমি অবশ্যই জাহান্নামীদের অন্তর্ভূক্ত হবে।

ইবনুদ দাইলামী (রঃ) বলেনঃ এই হাদীছ শুনে আমি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদের কাছে গেলাম। তিনিও আমাকে অনুরূপ বললেন। অতঃপর আমি হুযায়ফা বিন ইয়ামানের কাছে গেলাম। তিনিও অনুরূপ বললেন। অতঃপর আমি যায়েদ বিন ছাবেতের কাছে গেলাম। তিনিও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আমাকে অনুরূপ হাদীছ শুনালেন। ইমাম ইবনে মাজাহ (রঃ) এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[7]

এই হাদীছগুলো এবং অনুরূপ অর্থে যে সমস্ত হাদীছ বর্ণিত হয়েছে, সেগুলো তাকদীরকে অস্বীকারকারী মুতাযেলা সম্প্রদায় ও তাদের অনুরূপ অন্যান্য বাতিল ফির্কার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট দলীল। তাদের যে সমস্ত বাতিল আকীদাহ রয়েছে, তার মধ্যে গুনাহগার মুমিন চিরস্থায়ী জাহান্নামী হওয়ার বিষয়টি অন্যতম। তাদের এই বিশ্বাসই সর্বাধিক নিকৃষ্ট এবং সবচেয়ে বড় বিদআত। তাদের অনেকেই আবার আল্লাহ তাআলার সিফাতগুলোকে অস্বীকার করার ক্ষেত্রে জাহমীয়াদের অনুসরণ করেছে। আল্লাহ তাআলা তাদের বাতিল বিশ্বাসের অনেক উর্ধ্বে। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয় গুলো জানা যায়

১) তাকদীরের প্রতি ঈমান আনয়ন করা ফরয।

২) তাকদীরের প্রতি কিভাবে ঈমান আনতে হবে, তাও বর্ণনা করা হয়েছে।

৩) তাকদীরের প্রতি যার ঈমান নেই তার আমল বাতিল।

৪) যে ব্যক্তি তাকদীরের প্রতি ঈমান আনেনা সে ঈমানের স্বাদ থেকে মাহরূম হবে।

৫) আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যা সৃষ্টি করেছেন- এখানে তা উল্লেখ করা হয়েছে।

৬) কিয়ামত পর্যন্ত যা সৃষ্টি হবে, হুকুমে ইলাহী পেয়েই কলম তা লিখে শেষ করেছে।

৭) যে ব্যক্তি তাকদীর বিশ্বাস করেনা তার সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম সম্পূর্ণ দায়মুক্ত বলে ঘোষণা দিয়েছেন। অর্থাৎ তার সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কোন সম্পর্ক নেই।

৮) সালাফে সালেহীনের রীতি ছিল, কোনো বিষয়ের সংশয় নিরসনের জন্য তারা জ্ঞানী ও বিজ্ঞজনকে প্রশ্ন করতেন।

৯) উলামায়ে কেরাম এমনভাবে প্রশ্নকারীকে জবাব দিতেন যা দ্বারা সন্দেহ দূর হয়ে যেতো। তাদের জবাবের নিয়ম এই ছিল যে, তাঁরা নিজেদের কথাকে শুধুমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম এর দিকে সম্বোধিত করতেন।

[4] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ ইসলাম, ঈমান এবং তাকদীর সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা। হাদীছ নং- ১০২।

[5] - ইসলাম যে কোন আমলের পূর্বে সঠিক আকীদাহ গ্রহণ করার উপর বিশেষ গুরত্ব প্রদান করেছে। তাই আকীদার বিষয়টি সবচেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আকীদাহ সঠিক না হলে কারো কোন আমল আল্লাহর দরবারে গৃহিত হবে না। এই জন্যই ইসলাম আকীদাহ সংশোধনের উপর সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব প্রদান করেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে অনেক মুসলিমদের আকীদায় যথেষ্ট ভুল রয়েছে। মুসলিমদের বিরাট একটি অংশ বিশ্বাস করে যে, তিনি আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি, তিনি নূরের তৈরী, তিনি গায়েব জানতেন ইত্যাদি কুরআন ও সহীহ হাদীছ বিরোধী আরো অনেক আকীদাহ ও বিশ্বাস। আমরা এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে একটি ভুল আকীদাহ সংশোধনের চেষ্টা করব।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রথম সৃষ্টি হওয়ার ব্যাপারে বর্ণিত হাদীছটির প্রকৃত অবস্থাঃ

আমাদের দেশের বহু সংখ্যক মানুষের মাঝে এই কথাটি প্রচলিত আছে যে, আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম মুহাম্মাদ (সাঃ)এর নূর সৃষ্টি করেছেন। এ ধরণের বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়ার কারণ হল আমাদের দেশের বেশ কিছু বক্তা ও আলেম এ ব্যাপারে একটি মাওযু তথা বানোয়াট হাদীছ দিয়ে দলীল গ্রহণ করে থাকেন এবং সুমধুর কণ্ঠে ওয়াজ করে মানুষকে বুঝিয়ে থাকেন। অনেক বক্তার ওয়াজের একমাত্র পূঁজিই হচ্ছে এ জাতীয় কয়েকটি বানোয়াট বিষয়। অবস্থা দেখে মনে হয়, কুরআন ও হাদীছের জ্ঞান তাদের কাছে খুবই নগণ্য। হাদীছটি মানুষের মুখে মুখে শুনা যায়, কিন্তু গ্রহণযোগ্য কোন হাদীছের কিতাবে তা পাওয়া যায় না। হাদীছটি হল নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«أول ما خلق الله تعالى نوري»

অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। অন্য শব্দে এসেছে,

«أول ما خلق الله نور نبيك يا جابر»

হে জাবের! সর্বপ্রথম আল্লাহ তোমার নবীর নূর সৃষ্টি করেছেন। একই অর্থে এবং বিভিন্ন শব্দে সুফীদের কিতাবসমূহে সনদ বিহীন এই বানোয়াট হাদীছটি উল্লেখিত হয়েছে। মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাকে হাদীছটি থাকলেও লেখক কোন নির্ভরযোগ্য সনদ উল্লেখ করেননি। এই মর্মে যত হাদীছ বর্ণিত হয়েছে তার সবই বাতিল। মুহাদ্দিছগণ এই হাদীছকে মাওযু বলেছেন। ইমাম সুয়ুতী (রঃ) বলেনঃ এই হাদীছের কোন নির্ভরযোগ্য সনদ নেই। সুতরাং হাদীছটি মুনকার ও বানোয়াট। হাদীছের কোন কিতাবে এর ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। (দেখুনঃ আলহাভী ১/৩২৫) ইমাম সাগানীও হাদীছটিকে মাওযু বলেছেন। দেখুনঃ للصغاني الموضوعات ইমাম আলবানী (রঃ) বলেনঃ এটি মানুষের মুখে মুখে প্রসিদ্ধ একটি বাতিল হাদীছ। (দেখুনঃ সিলসিলা সাহীহা, হাদীছ নং- ৪৫৮)। সুফীদের অন্যতম গুরু ওয়াহদাতুল উজুদের প্রবক্তা ইবনে আরাবী এই আকীদাই পোষেণ করতেন। আশ্চর্যের বিষয় হল আমাদের দেশের বহু সুন্নী মুসলমানের আকীদাও তাই।

সর্বপ্রথম সৃষ্টি কোনটি?

সহীহ হাদীছের ভাষ্য থেকে জানা যায় যে, আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বপ্রথম সৃষ্টি ছিলেন না এবং তিনি নূরের তৈরীও ছিলেন না। সর্বপ্রথম সৃষ্টির ব্যাপারে আলেমগণ থেকে একাধিক কথা বর্ণিত হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেনঃ কলমই প্রথম সৃষ্টি। প্রখ্যাত আলেম ইবনে জারীর, মালেকী মাজহাবের প্রখ্যাত আলেম ইবনুল আরাবী এমতেরই সমর্থক ছিলেন। পরবর্তীদের মধ্যে ইমাম আলবানী (রঃ) এ মতকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। তারা নিম্নের সহীহ হাদীছগুলো দিয়ে দলীল গ্রহণ করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«إن أول شيء خلقه الله تعالى القلم ، وأمره أن يكتب كل شيء يكون»

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম যে জিনিষটি সৃষ্টি করেছেন, তা হচ্ছে কলম। তারপর কলমকে কিয়ামত পর্যন্ত যা হবে তা লিখতে বললেন’’। {(আবু ইয়ালা (১/১২৬) আল-আসমা ওয়াস সিফাত লিল-বায়হাকী ২৭১), সিলসিলায়ে সাহীহা, হাদীছ নং- ১৩৩)} তিনি আরো বলেনঃ

«إِنَّ أَوَّلَ مَا خَلَقَ اللَّهُ الْقَلَمَ فَقَالَ: لَهُ اكْتُبْ قَالَ: رَبِّ وَمَاذَا أَكْتُبُ قَالَ: اكْتُبْ مَقَادِيرَ كُلِّ شَيْءٍ حَتَّى تَقُومَ السَّاعَةُ»

‘‘আল্লাহ তাআলা সর্বপ্রথম কলম সৃষ্টি করে তাকে বললেনঃ লিখ। কলম বললঃ হে আমার প্রতিপালক! কী লিখব? আল্লাহ বললেনঃ কিয়ামত পর্যন্ত আগমণকারী প্রতিটি বস্ত্তর তাকদীর লিখ’’। (দেখুনঃ আবু দাউদ, তিরমিজী, বায়হাকী এবং অন্যান্য) মালেকী মাজহাবের বিখ্যাত আলেম ইবনুল আরাবী বলেনঃ

«قبل القلم لم يكن شيء إلا هو سبحانه»

কলমের পূর্বে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। (দেখুন আরেযাতুল আহওয়াযী) অপর পক্ষে আরেক দল আলেমের মতে সর্বপ্রথম সৃষ্টি হচ্ছে আরশ। আল্লামা ইবনে তাইমীয়া এবং অন্যান্য আলেম থেকে এধরণের মত পাওয়া যায়। তাদের দলীল হচ্ছে, ইমরান বিন হুসাইন থেকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«كَانَ اللَّهُ وَلَمْ يَكُنْ شَىْءٌ غَيْرُهُ وَكَانَ عَرْشُهُ عَلَى الْمَاءِ ، وَكَتَبَ فِى الذِّكْرِ كُلَّ شَىْءٍ وَخَلَقَ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ»

আদিতে একমাত্র আল্লাহ-ই ছিলেন। তিনি ছাড়া আর কিছুই ছিলনা। তাঁর আরশ ছিল পানির উপর। তারপর তিনি প্রত্যেক জিনিষ লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ করলেন এবং তিনি আসমান ও যমিন সৃষ্টি করলেন। (বুখারী, হাদীছ নং- ৩১৯১) উপরের হাদীছ থেকেই দলীল গ্রহণ করে আবার কেউ কেউ পানি সর্বপ্রথম সৃষ্টি বলে মত প্রকাশ করেছেন।

প্রথম পর্যায়ের কতিপয় মাখলুক বা সৃষ্টিঃ এ কথা সত্য যে, আরশ, কুরসী, লাওহে মাহফুয, পানি, আসমান, ফেরেশতা, জিন ইত্যাদি প্রথম পর্যায়ের সৃষ্টির অন্তর্ভূক্ত। মানুষ কোন ক্রমেই উপরোক্ত সৃষ্টিসমূহের পূর্বে সৃষ্টি হয় নি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও নন। কলমও প্রথম পর্যায়ের সৃষ্টি। তবে আমরা যে কলম দিয়ে লেখি সেই কলম সর্বপ্রথম সৃষ্টি নয়; বরং যে কলম দিয়ে লাওহে মাহফুয লেখা হয়েছে সেটিই সর্বপ্রথম সৃষ্টি। সুতরাং সর্বপ্রথম সৃষ্টি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হওয়ার ব্যাপারে কোন সহীহ দলীল না থাকায় তা মুসলিমের আকীদাহ হতে পারে না। তাই উপরোক্ত হাদীছগুলো এবং অন্যান্য সহীহ হাদীছের শিক্ষা গ্রহণ করা জরুরী। ইমাম মালেক (রঃ) বলেনঃ

«ما منا من أحد إلا يؤخذ من قوله أو يرد عليه إلا صاحب هذا القبر ويشير إلى قبر النبي صلى الله عليه وسلم»

‘‘আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যার সকল কথাই গ্রহণ করা হবে অর্থাৎ আমাদের কারো কথা গ্রহণ করা যেতে পারে আবার প্রত্যাখ্যানও করা যেতে পারে। তবে এই কবরের অধিবাসী ব্যতীত। এই কথা বলে তিনি নবী (সাঃ)এর কবরের দিকে ইঙ্গিত করে দেখালেন।

উপসংহারঃ الختام

উপরোক্ত আলোচনার আলোকে সহীহ হাদীছ দ্বারা সুস্পষ্ট রূপে প্রমাণিত হল যে, নবী (সাঃ) সর্বপ্রথম সৃষ্টি নন। সুতরাং সহীহ হাদীছ দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পর কোন মুসলিমের আকীদাহ এটি হতে পারে না যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর প্রথম সৃষ্টি। আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের সকল সঠিক আকীদাহ গ্রহণ করার তাওফীক দিন। আমীন

[6] - আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ তাকদীর সম্পর্কে। হাদীছ নং- ৪৭০২।

[7] - ইবনে মাজাহ, অধ্যায়ঃ তাকদীর। হাদীছ নং- ৮১।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে