যে ব্যক্তি কুরআন অথবা রাসূল কিংবা এমন কোনো বিষয় নিয়ে উপহাস করল, যাতে আল্লাহর যিকির রয়েছে

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ لَيَقُولُنَّ إِنَّمَا كُنَّا نَخُوضُ وَنَلْعَبُ قُلْ أَبِاللَّهِ وَآَيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ (65) لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ إِنْ نَعْفُ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْكُمْ نُعَذِّبْ طَائِفَةً بِأَنَّهُمْ كَانُوا مُجْرِمِينَ

‘‘তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা করো, তোমরা কি কথা বলছিলে? উত্তরে তারা অবশ্যই বলবে, আমরা কেবল হাসি-তামাসা উপহাস-পরিহাস করছিলাম। বলোঃ তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াতসমূহ এবং তাঁর রাসূলকে নিয়ে উপহাস করছিলে? তোমরা এখন অযুহাত পেশ করোনা। তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফুরী করেছ। তোমাদের মধ্যে কোনো কোনো লোককে যদি আমি ক্ষমা করে দেই, তবে অবশ্য কিছু লোককে আযাবও দিবো। কারণ তারা ছিল অপরাধী’’। (সূরা তাওবাঃ ৬৫-৬৬)

ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ যে ব্যক্তি কুরআন অথবা রাসূল কিংবা এমন কোনো বিষয় নিয়ে উপহাস করল, যাতে আল্লাহর যিকির রয়েছে, সে কুফুরী করল।

উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ আবু মাশার আলমাদানী মুহাম্মাদ বিন কা’ব আলকুরাযী এবং অন্যান্য আলেম থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তাবুক যুদ্ধের সফরে মুনাফেকদের এক লোক বললঃ আমাদের এই কারীদের চেয়ে অধিক পেটুক, অধিক মিথ্যুক এবং শত্রুদের মুকাবেলায় অধিক ভীত আর কাউকে দেখতে পাইনি।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে সেই মুনাফেকের উক্ত কথা পৌঁছে গেল। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটনীর উপর আরোহন করে যাত্রা শুরু করে দিয়েছিলেন। মুনাফেক তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে বলতে লাগলঃ হে আল্লাহর রাসূল! হে আল্লাহর রাসূল আমরা তো অর্থহীন গল্প বলছিলাম। সফর অবস্থায় কাফেলার লোকেরা পথ চলার ক্লান্তি দূর করার জন্য যে ধরণের কথা বলে থাকে আমাদের কথা তার বাইরে ছিলনা। মূলত সে কসম করে মূলঘটনা অস্বীকার করতে লাগল। তখন নাযিল হল, হে নবী! তুমি বলঃ তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াতসমূহ এবং তাঁর রাসূলকে নিয়ে উপহাস করছিলে? তোমরা এখন অযুহাত পেশ করোনা। তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফুরী করেছ’’। ঐ সময় লোকটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর উটনীর হাওদাজের (পালকীর) রশিতে এত শক্ত করে ধরেছিল যে, উটনী চলা অবস্থায় লোকটি রশির সাথে ঝুলছিল এবং তার পা দু’টিকে পাথরের উপর দিয়ে হিঁচড়ে নিচ্ছিল। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দিকে একদম তাকাচ্ছিলেন না এবং তার কথায় মোটেই কর্ণপাত করছিলেন না।

আল্লাহর বাণীঃ لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُم তোমরা এখন অযুহাত পেশ করোনা। তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফরী করেছঃ অর্থাৎ যেই কথার মাধ্যমে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছে, তার কারণে তোমরা কুফুরীতে লিপ্ত হয়েছ।

إِنْ نَعْفُ عَنْ طَائِفَةٍ مِنْكُمْ نُعَذِّبْ طَائِفَةً بِأَنَّهُمْ كَانُوا مُجْرِمِينَ তোমাদের মধ্যে কোনো কোনো লোককে যদি আমি ক্ষমা করে দেইও, তবে অবশ্য কিছু লোককে শাস্তি দেব। কারণ তারা ছিল অপরাধীঃ অর্থাৎ তোমাদের সকলকে ক্ষমা করা হবেনা। অবশ্যই তোমাদের কতক লোককে আযাব দেয়া হবে। কেননা তারা এই অন্যায় ও নিকৃষ্ট কথার মাধ্যমে গুরতর অপরাধী হয়ে গিয়েছে। ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ)এর বক্তব্য এখানেই শেষ।

শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীকে এ কথা বলার আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা ঈমান আনয়ন করার পর কাফের হয়ে গেছ। যারা বলে তারা জবানের মাধ্যমে ঈমান আনয়নের পর কাফের হয়ে গেছে অথচ অন্তরের মাধ্যমে প্রথমেই তারা কাফের ছিল, তাদের কথা ঠিক নয়। কেননা অন্তরে কুফুরী রেখে জবান দিয়ে ঈমান আনয়ন করা কুফরীর নামান্তর। বিষয়টি এমন হলে এ কথা বলা ঠিক হবেনা যে,قد كفرتم بعد إيمانكم অর্থাৎ তোমরা ঈমান আনয়ন করার পর কুফুরী করেছ। কারণ তারা কুফুরীতে আছে বলেই তখন ঈমান আনার পর কুফুরী করার কথা বলা হবে অর্থহীন।

আর এখানে যদি এটি উদ্দেশ্য হয় যে, তোমরা ঈমান প্রকাশের পর কুফুরী প্রকাশ করেছ, তাও ঠিক নয়। কারণ তারা তো সকলের সামনে কুফরী প্রকাশ করেনাই; বরং তা প্রকাশ করেছিল তাদের বিশেষ কয়েকজন লোকের সামনে। সব সময়ই মুনাফেকরা তাদের বিশেষ লোকজনের নিকট কুফরী প্রকাশ করত। সুতরাং এমতাবস্থায় বাক্যটি প্রমাণ করেনা যে, তারা এখনো মুনাফেক রয়ে গেছে। বরং সঠিক কথা হচ্ছে এখন তারা কাফের-মুরতাদ হিসাবে গণ্য হবে।

উপরোক্ত ঘটনায় প্রমাণ মিলে যে, মানুষ কখনো মাত্র একটি শব্দ বলার কারণে কিংবা সামান্য একটি আমলের মাধ্যমেই কাফের হয়ে যায়। তবে অন্তরের ইচ্ছা এ ক্ষেত্রে সর্বাধিক ভয়ঙ্কর ও বিপদজনক। কেননা অন্তর হচ্ছে ঐ সমুদ্রের ন্যায় যার কোন কুলকিনারা নেই। এমনি ইলম্ ও আলেম-উলামাদের সাথে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করা এবং ইলমের খাতিরে আলেমদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করাও কুফুরীর অন্তর্ভূক্ত।

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার, মুহাম্মদ বিন কা’ব, যায়েদ বিন আসলাম এবং কাতাদাহ রাযিয়াল্লাহু আনহুম থেকে বর্ণিত আছে যে, তাবুক যুদ্ধে একজন লোক বললঃ এসব কারীর চেয়ে অধিক পেটুক, কথায় এদের চেয়ে অধিক মিথ্যুক এবং যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর সাক্ষাতে এত অধিক ভীরু আর কোনো লোক দেখিনি। লোকটি তার কথা দ্বারা মুহাম্মদ সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম এবং তাঁর কারী সাহাবায়ে কেরামের দিকে ইঙ্গিত করছিল। আওফ বিন মালেক লোকটিকে বললেনঃ তুমি মিথ্যা বলেছ এবং তুমি একজন পাক্কা মুনাফিক। আমি অবশ্যই রাসূল সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­ামকে এ খবর জানাবো। আওফ তখন এ খবর জানানোর জন্য রাসূল সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­ামের কাছে চলে গেলেন। গিয়ে দেখলেন কুরআন তাঁর চেয়েও অগ্রগামী অর্থাৎ আওফ পৌছার পূর্বেই অহীর মাধ্যমে রাসূল সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম ব্যাপারটি জেনে ফেলেছেন। এরই মধ্যে মুনাফিক রাসূল সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­ামের কাছে চলে আসল। লোকটি এমন সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে উপস্থিত হল, যখন তিনি সফরের উদ্দেশ্যে উটনীর উপর আরোহন করে রওয়ানা দিচ্ছিলেন। তারপর সে বললঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমরা হাসি-তামাশা করছিলাম এবং চলার পথে আরোহীদের মতই পরস্পর উপহাস করছিলাম। যাতে করে আমাদের পথ চলার কষ্ট লাঘব হয়।

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি যেন তার দিকে তাকিয়ে দেখছি, যখন সে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উটনীর গদির রশির সাথে ঝুলন্ত ছিল এবং কিভাবে সে তাঁর সাথে কথা বলছিল। লোকটি ঝুলন্ত থাকার কারণে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নিয়ে উটনী যাত্রা শুরু করার কারণে তার পা দু’টি পাথরের উপর দিয়ে হিঁচড়ে যাচ্ছিল। আর সে বলছিল, ‘আমরা হাসি ঠাট্টা ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করছিলাম। রাসূল সাল্ল­াল্ল­াহু আলাইহি ওয়াসাল্ল­াম তখন তাকে উদ্দেশ্য করে বলছিলেনঃ

أَبِاللَّهِ وَآَيَاتِهِ وَرَسُولِهِ كُنْتُمْ تَسْتَهْزِئُونَ (65) لَا تَعْتَذِرُوا قَدْ كَفَرْتُمْ بَعْدَ إِيمَانِكُمْ

‘‘তোমরা কি আল্লাহ, তাঁর আয়াতসমূহ এবং তাঁর রাসূলকে নিয়ে উপহাস করছিলে? তোমরা এখন মিথ্যা অযুহাত পেশ করোনা। তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফুরী করেছ’’। (সূরা তাওবাঃ ৬৫-৬৬) তিনি তার দিকে তাকিয়ে দেখেননি এবং উক্ত আয়াতের বাইরে অতিরিক্ত কোনো কথাও বলেননি।[1] এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত মাসআলাগুলো জানা যায়ঃ

১) এই অধ্যায়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা হচ্ছে, যারা আল্লাহ, কুরআন ও রাসূলের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে তারা কাফের।

২) এ ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট আয়াতের তাফসীর ঐ ব্যক্তির জন্য, যে এ ধরনের কাজ করে অর্থাৎ আল্লাহ, কুরআন ও রাসূলের সাথে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। সে যেই হোক না কেন।

৩) চোগলখোরী এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উদ্দেশ্যে নসীহতের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ আওফ বিন মালেক রাযিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মুনাফেকের কথা জানিয়ে দেয়া চোগলখোরীর আওতায় পড়েনা।

৪) যে পরিমাণ ক্ষমা করাকে আল্লাহ ভালোবাসেন তার মাঝে এবং আল্লাহর দুশমনদের উপর কঠোরতা প্রদর্শনের মাঝে পার্থক্য রয়েছে।

৫) কিছু কিছু অযুহাত এমন রয়েছে যা গ্রহণ করা উচিৎ নয়।

[1] - ঘটনাটি সহীহ। দেখুনঃ তাফসীরে ইবনে কাছীর, (৪/১৭১)।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে