জেনে-বুঝে তোমরা আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করো না

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেনঃ

فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ

‘‘অতএব জেনে-বুঝে তোমরা আল্লাহর সমকক্ষ নির্ধারণ করোনা’’। (সূরা বাকারাঃ ২২)

ব্যাখ্যাঃ أنداد শব্দটি نِدٌّএর বহুবচন। নিদ্দ অর্থ হচ্ছে অনুরূপ ও সমকক্ষ। মাখলুক থেকে কাউকে আল্লাহর শরীক ও সমকক্ষ নির্ধারণ করা। আল্লাহর জন্য শরীক নির্ধারণ করার স্বরূপ এই যে, এবাদতের সকল প্রকার অথবা তা থেকে কোনো প্রকার আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য পেশ করা। এটিই মূর্তি পূজকদের অবস্থা। তারা যাদেরকে ডাকে এবং যাদের কাছে তারা আশা-ভরসা করে তাদের ব্যাপারে ধারণা করে যে, এরা তাদের উপকার করে, তাদের থেকে বিপদাপদ দূর করে এবং তাদের জন্য সুপারিশও করবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘‘অতএব জেনে-বুঝে তোমরা আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক ও সমকক্ষ নির্ধারণ করোনা’’। (সূরা বাকারাঃ ২২)

আল্লামা ইমাদুদ্দীন হাফেয ইবনে কাছীর (রঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেনঃ আবুল আলীয়া বলেনঃ এই আয়াতে أنداد বলতে ঐসব লোক উদ্দেশ্য, যাদেরকে আল্লাহর সমকক্ষ ও শরীক নির্ধারণ করা হয়। রবী বিন আনাস, কাতাদাহ, সুদ্দী, আবু মালেক এবং ইসমাঈল বিন আবু খালেদ এ রকমই বলেছেন।

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ তোমরা আল্লাহর সাথে এমন বস্ত্তকে শরীক করোনা, যা তোমাদের উপকার করতে পারেনা এবং ক্ষতিও করতে পারেনা। অথচ তোমরা জান যে, আল্লাহই হচ্ছেন তোমাদের প্রভু, তিনি ব্যতীত অন্য কেউ তোমাদের রিযিকের ব্যবস্থা করেন না এবং তোমরা অবগত আছ যে, রাসূল যেই তাওহীদের দিকে আহবান করছেন, তাই সত্য। এতে কোনো সন্দেহ নেই।

মুজাহিদ বলেনঃ তোমরা অবগত আছ যে, তাওরাত এবং ইঞ্জিলেও বলা হয়েছে, আল্লাহই একক মাবুদ।

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ أنداد (আন্দাদ) হচ্ছে শির্ক। অন্ধকার রাত্রে নির্মল কালো পাথরের উপর পিপিলিকার চলাচলের চেয়েও অধিক গোপনে মানুষের মধ্যে শির্ক অনুপ্রবেশ করে। এর উদাহরণ হচ্ছে, তোমার এ কথা বলা, আল্লাহর কসম! হে অমুক! তোমার জীবনের কসম, আমার জীবনের কসম। অনুরূপ তোমার কথা যদি এই ছোট্ট কুকুরটি না থাকত, তাহলে অবশ্যই আমাদের ঘরে চোর প্রবেশ করত। হাঁসটি যদি ঘরে না থাকত, তাহলে অবশ্যই চোর আসত। অনুরূপ কোনো ব্যক্তি তার সাথীকে এ কথা বললঃ আল্লাহ তাআলা এবং তুমি যা ইচ্ছা করো। কারো এ কথা বলা যে, আল্লাহ এবং অমুক যদি না থাকতো, এ সবই শির্ক।[1] ইবনে আবি হাতেম ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহুর এই বক্তব্য উল্লেখ করেছেন।

ব্যাখ্যাঃ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত উপরোক্ত বক্তব্যের মধ্যে শির্কের সর্বাধিক ছোট প্রকার বর্ণনার মাধ্যমে বড় শির্ক হতে সতর্ক করা হয়েছে।

আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম এরশাদ করেছেনঃ مَنْ حَلَفَ بِغَيْرِ اللَّهِ فَقَدْ كَفَرَ أَوْ أَشْرَك‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করল, সে কুফরী করলো অথবা শির্ক করল’’। ইমাম তিরমিযী এই হাদীছ বর্ণনা করার পর হাসান বলেছেন এবং আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকেম এটিকে সহীহ বলেছেন।

ব্যাখ্যাঃ সম্ভবতঃ সন্দেহটি রাবীর পক্ষ হতে। এখানে এ সম্ভাবনাও রয়েছে যে, أو (অথবা) শব্দটি وَ (এবং) অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তখন অর্থ হবে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে শপথ করল সে কুফরী করল এবং শির্ক করল। তবে এটি كفر دون كفر তথা ছোট কুফরের অন্তর্ভূক্ত।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ

«لَأَنْ أَحْلِفَ بِاللهِ كَاذِبًا أحَبَّ إليَّ مِنْ أحْلِفَ بِغَيْرِهِ صَادِقًا»

‘‘আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করা আমার কাছে আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে সত্য কসম করার চেয়ে বেশী পছন্দনীয়।

ব্যাখ্যাঃ ইহা জানা কথা যে, আল্লাহর নামে মিথ্যা শপথ করা কবীরা গুনাহ। কিন্তু শির্ক করা সমস্ত কবীরা গুনাহএর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ কবীরা গুনাহ। যদিও তা শির্কে আসগার তথা ছোট শির্ক হয়। যেমন পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে।

হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্ল­াম এরশাদ করেছেনঃ

لا تقولوا: ماشاء الله وشاء فلان ولكن قولوا: ماشاء الله ثم شاء فلان»

‘‘তোমরা এ কথা বলোনা; আল্লাহ এবং অমুক ব্যক্তি যা চেয়েছেন; বরং তোমরা বলো, আল্লাহ যা চেয়েছেন অতঃপর অমুক ব্যক্তি যা চেয়েছে। ইমাম আবু দাউদ সহীহ সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।

ব্যাখ্যাঃ কেননা واو দ্বারা একটি বিষয়কে অন্য বিষয়ের উপর আতফ করলে তথা দু’টি শব্দের মাঝখানে واو আনয়ন করলে এর দ্বারা দু’টি বস্ত্তকে সমান করে দেয়া উদ্দেশ্য হয়। কেননা ভাষাবিদগণ দু’টি বস্ত্তকে সাধারণভাবে একসাথে একত্রিত করে দেয়ার জন্যই واو ব্যবহার করেছেন। তবে فا (ফা) এবং ثم (ছুম্মা) এর ব্যতিক্রম। অর্থাৎ দু’টি শব্দের মাঝখানে فا অথবা ثم ব্যবহার করলে তার পূর্বের ও পরের বস্ত্তর হুকুম একই রকম হয়না।[2] আর واوএর মাধ্যমে কোনো বিষয়ে স্রষ্টাকে সৃষ্টির সমান করে দেয়া শির্ক। তবে এটি ছোট শির্কের অন্তর্ভূক্ত।

ইবরাহীম নখয়ী থেকে এ কথা বর্নিত আছে যে, أعوذ بالله وبك ‘‘আমি আল্লাহ এবং আপনার কাছে আশ্রয় চাই’’- তিনি এ কথা বলা অপছন্দ করতেন। আর أعوذ بالله ثم بك ‘‘আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাই অতঃপর আপনার কাছে’’- এ কথা বলা তিনি জায়েয মনে করতেন। তিনি আরো বলেছেন, لولا الله ثم فلان ‘‘যদি আল্লাহ না থাকতেন অতঃপর অমুক না থাকত- একথা বলাও তিনি জায়েয মনে করতেন। কিন্তু لولا الله وفلان ‘‘যদি আল্লাহ না থাকতেন এবং অমুক না থাকত’’- এ কথা বলতে নিষেধ করেছেন।

ব্যাখ্যাঃ উপরোক্ত কথাগুলো হতে যেগুলো জায়েয আছে বলে মত দেয়া হয়েছে, তা হতে হবে ঐ ব্যক্তির ক্ষেত্রে, যে জীবিত, উপস্থিত ও সক্ষম। কিন্তু যে মৃত্যু বরণ করার কারণে কিংবা অনুপস্থিত থাকার কারণে কোনো কথা শুনতে সক্ষম নয় এবং কথার জবাবও দিতে পারেনা, তাকে জড়িয়ে উপরোক্ত বাক্যগুলোর কোনোটিই বলা জায়েয নেই। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) সূরা বাকারার ২২ নং আয়াতের মাধ্যমে আনদাদ তথা আল্লাহর সাথে শির্ক করার তাফসীর জানা গেল।

২) বড় শিরকের ব্যাপারে নাযিলকৃত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা সাহাবায়ে কেরাম এভাবে করেছেন যে, তাদের সেই ব্যাখ্যা ছোট শির্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

৩) গাইরুল্ল­াহর নামে কসম করা শির্ক।

৪) আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে সত্য কসম করা, আল্লাহর নামে মিথ্যা কসম করার চেয়েও ভয়াবহ গুনাহ।

৫) واو এবং ثم এর মধ্যকার পার্থক্য জানা গেল। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা এবং বান্দার মাঝে واو ব্যবহার করে কোনো বিষয় একত্রিত করা যাবেনা। বিষয়টি বুঝতে মূল কিতাবের বিশ্লেষণ এবং এ বিষয়ে প্রদত্ত টিকা ভালভাবে পড়ার অনুরোধ করা গেল।

[1] - (وَ-ওয়াও) দ্বারা দু’টি বিষয়কে এক সাথে মিলিত করলে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী বিষয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বুঝায় অর্থাৎ স্রষ্টা ও সৃষ্টি পরস্পর সমতুল্য হওয়া বুঝায়। সুতরাং যে ব্যক্তি বললঃ(ما شاء الله وشئت) যা আল্লাহ চান এবং আপনি চান, সে বান্দার ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে মিলিয়ে সমান করে দিল। তবে (ثم-ছুম্মা)এর মাধ্যমে দু’টি বস্ত্তকে একত্রিত করলে এ রকম কোন সম্ভাবনা থাকেনা। সুতরাং যে ব্যক্তি বললঃ (ما شاء الله ثم شئت) আল্লাহ্ যা চান অতঃপর আপনি যা চান, সে এ কথা স্বীকার করল যে, বান্দার ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার অনুগামী ও পরে হয়ে থাকে। তা কেবল আল্লাহর ইচ্ছার পরেই কার্যকরী হয়। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ وَمَا تَشَاءُونَ إِلَّا أَنْ يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ‘‘তোমরা আল্লাহ্ রাববুল আলামীনের ইচ্ছার বাইরে অন্য কিছুই ইচ্ছা করতে পারনা। (সূরা তাকভীরঃ ২৯)
[2] - বিষয়টি পরিস্কার করে বুঝানোর জন্য আরো বলা যেতে পারে যে, دخل خالد وأحمد في الغرفة অর্থাৎ খালেদ এবং আহমাদ রুমে প্রবেশ করেছে। এ কথা তখনই এভাবে বলা যথার্থ হবে, যখন জানা যাবে যে, তারা উভয়েই একই সময় একই সাথে রুমে প্রবেশ করেছে। কিন্তু যখন জানা যাবে যে উভয়ের প্রবেশের মধ্যে সময়ের ব্যবধান রয়েছে, তখন উপরোক্ত পদ্ধতিতে বলা ঠিক নয়। তখন খালেদ ও আহমাদের মাঝখানে فا অথবা ثم ব্যবহার করতে হবে। খালেদে প্রবেশ করার সামান্য পরেই যদি আহমাদ প্রবেশ করে, তাহলে বলতে হবে دخل خالد فأحمد। আর যদি ব্যবধান অনেক বেশী হয়, তাহলে বলতে হবে, دخل خالد ثم أحمد। এখানে অর্থ হবে খালেদ প্রবেশ করেছে। অতঃপর আহমাদ প্রবেশ করেছে।

এ রকমই যদি বলা হয় ماشاء الله وشئت অর্থাৎ আল্লাহ যা চেয়েছে এবং আপনি যা চেয়েছেন, তাহলে এখান থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহর চাওয়া এবং বান্দার চাওয়া সমান্তরালভাবে হয়েছে। এতে আল্লাহর ইচ্ছাকে বান্দার ইচ্ছার সমান করে দেয়া হয়, যা সঠিক নয়। কেননা বান্দার ইচ্ছা আল্লাহর ইচ্ছার অনুগামী এবং তা আল্লাহর ইচ্ছার পরেই হয়; একসাথে নয়। সুতরাং উপরোক্ত পদ্ধতি বর্জন করে যদি বলা হয় ماشاء الله ثم شئت অর্থাৎ আল্লাহ যা চেয়েছেন অতঃপর আপনি যা চেয়েছেন, তাহলে বুঝা যাবে যে, আল্লাহর ইচ্ছার পর বান্দার ইচ্ছা রয়েছে। এতে কোন অসুবিধা নেই। কেননা গঠণের দিক থেকে ثم শব্দটির মাধ্যমে দু’টি বিষয়কে একত্রিত করা উদ্দেশ্য হলেও তাতে সময়ের ব্যবধান থাকে। তা ছাড়া বান্দার ইচ্ছা আর আল্লাহর ইচ্ছা সমান হওয়া তো দূরের কথা; আল্লাহর ইচ্ছা ব্যতীত বান্দার ইচ্ছার কল্পনাও করা যায়না। সুতরাং বিষয়টি গভীরভাবে বুঝা উচিত।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে