আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَفَأَمِنُوا مَكْرَ اللَّهِ فَلَا يَأْمَنُ مَكْرَ اللَّهِ إِلَّا الْقَوْمُ الْخَاسِرُونَ
‘‘তারা কি আল্লাহ্র পাকড়াও থেকে নিরাপদ হয়ে গেছে? ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদ্রায় ছাড়া আল্লাহ্র পাকড়াও থেকে অন্য কেউ নিজেদেরকে নিরাপদ ভাবতে পারেনা’’। (সূরা আরাফঃ ৯৯)
ব্যাখ্যাঃ লেখকের উদ্দেশ্য হচ্ছে, এ কথা প্রমাণ করা যে, আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে মুক্ত ও নিরাপদ মনে করা দুর্বল ঈমানের লক্ষণ। যে আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করে, সে ওয়াজিব কাজ ছেড়ে দেয় এবং হারামে লিপ্ত হওয়াতে কোনো প্রকার পরওয়া করেনা। কেননা সে যে সমস্ত হারাম কাজে লিপ্ত হয় কিংবা যে সমস্ত ওয়াজিব কাজ বর্জন করে, তাতে সে আল্লাহকে মোটেই ভয় করেনা। অন্তরে আল্লাহর ভয় না থাকা সবচেয়ে বড় গুনাহ এবং সকল প্রকার অপরাধের মূল।
আয়াতের সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা যখন রাসূলদের প্রতি অবিশ্বাসী জনপদবাসীর অবস্থা বর্ণনা করেছেন তখন এটিও বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করা এবং আল্লাহকে ভয় না করাই ছিল নবী-রাসূলদেরকে অবিশ্বাস করা এবং তাদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করার একমাত্র কারণ। আল্লাহ তাআলা যখন তাদেরকে বিভিন্ন প্রকার নেয়ামত ও সুখ-শান্তি দান করার মাধ্যমে তাদের রশি ঢিল দিলেন, তখন তারা আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেদেরকে নিরাপদ মনে করল। ঐ সমস্ত নেয়ামত ও ভোগের বিষয়গুলো যে আল্লাহর পক্ষ হতে পরীক্ষার বস্ত্ত- এ কথাকে তারা অসম্ভব মনে করেছিল।
হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ তাআলা যার রুযীতে বরকত দিয়েছেন, সে যদি মনে না করে যে, তাকে পরীক্ষায় ফেলা হচ্ছে, তাহলে সে বোকা বলে গণ্য হবে।
কাতাদাহ বলেনঃ আল্লাহর ফয়সালা এসে জনপদবাসীকে অতর্কিত পাকড়াও করে। অতীতে যে সমস্ত অপরাধীকে পাকড়াও করা হয়েছে, তাদেরকে কেবল আরাম-আয়েশ করার সময় এবং অমনোযোগী থাকা অবস্থায়ই পাকড়াও করা হয়েছে। সুতরাং তোমরা আল্লাহর তরফ থেকে নেয়ামত পেয়ে ধোঁকায় পতিত হয়োনা।
ইসমাঈল বিন রাফে বলেনঃ আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করার অন্যতম পদ্ধতি হচ্ছে, পাপ কাজে লিপ্ত থাকা এবং আল্লাহর মাগফিরাতের আশা করা। ইমাম ইবনে আবী হাতিম এই কথা বর্ণনা করেছেন।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, وَمَنْ يَقْنَطُ مِنْ رَحْمَةِ رَبِّهِ إِلَّا الضَّالُّونَ ‘‘একমাত্র পথভ্রষ্ট লোকেরা ব্যতীত স্বীয় রবের রহমত থেকে আর কে নিরাশ হতে পারে’’? (সূরা হিজরঃ ৫৬)
ব্যাখ্যাঃ এখানে قنوط অর্থ হচ্ছে বিপদে পড়ে দুঃখ-কষ্ট লাঘব হওয়াকে অসম্ভব মনে করা এবং আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া। এটি আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিরাপদ মনে করার বিপরীত। উভয়টিই বিরাট গুনাহএর অন্তর্ভূক্ত। কেননা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া আল্লাহ সম্পর্কে মন্দ ধারণার নামান্তর।
ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামকে কবীরা গুনাহ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছেন, কবীরা গুনাহ হচ্ছেঃ
(الْكَبَائِرُ الشِّرْكُ بِاللَّهِ وَالْيَأْسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ وَالْقَنُوطُ مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ وَالأَمْنُ مِنْ مَكْرِ اللَّهِ)
‘‘আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া এবং আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করা’’।
ব্যাখ্যাঃ ইমাম বায্যার ও ইবনে হাতিম শাবীব বিন বিশরের সূত্রে এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ইমাম ইয়াহইয়া বিন মাঈন বলেনঃ শাবীব বিন বিশর নির্ভরযোগ্য রাবী। ইবনে আবী হাতিম তাঁকে দুর্বল বলেছেন।
ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ উক্ত হাদীছের সনদে মতভেদ রয়েছে। তা মারফু না হয়ে মাওকুফ হওয়ার অধিক নিকটবর্তী।
আল্লাহর সাথে শির্ক করা যেহেতু সবচেয়ে বড় কবীরাহ গুনাহ, তাই প্রথমেই শির্কের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ আল্লাহর রুবুবীয়াতের বিরোধীতা করা, উলুহীয়াতে দোষ লাগানো এবং রাববুল আলামীনের প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করাই হচ্ছে শির্ক।
وَالْيَأْسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ ‘‘আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া’’ঃ অর্থাৎ ভয় ও আশার ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তাআলার উপর আশা-ভরসা না করা। এ রকম করা আল্লাহর প্রতি মন্দ ধারণার অন্তর্ভূক্ত। সেই সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে, তাঁর সীমাহীন রহমত সম্পর্কে এবং তার দয়া ও মাগফেরাতের প্রতি অজ্ঞতারও প্রমাণ।
وَالأَمْنُ مِنْ مَكْرِ اللَّهِ ‘‘আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিজেকে নিরাপদ মনে করা’’ঃ অর্থাৎ বান্দাকে বিভিন্ন প্রকার নেয়ামতের মধ্যে অবকাশ দিয়ে পুনরায় পাকড়াও করা এবং আল্লাহ তাআলা তাকে ঈমানের যে নূর দিয়েছেন, তা ছিনিয়ে নেওয়াকে অসম্ভব মনে করা শির্কের অন্তর্ভূক্ত। আমরা আল্লাহর কাছে তা থেকে আশ্রয় চাই। এ রকম মনে করা আল্লাহ ও তাঁর ক্ষমতা সম্পর্কে অজ্ঞতার প্রমাণ এবং নিজের নফসের উপর ভরসা করা ও অহংকারের পরিচয়। এ তিনটি বিষয় অর্থাৎ আল্লাহর সাথে শির্ক করা, তাঁর রহমত ও দয়া থেকে নিরাশ হওয়া এবং তাঁর গ্রেপ্তার থেকে নিজেকে নিরাপদ ও মুক্ত মনে করা সর্ববৃহৎ কবীরা গুনাহসমূহের অন্তর্ভূক্ত। মানুষের মধ্যে এগুলো প্রচুর দেখা যায়। আল্লাহর কাছে আমরা এগুলো থেকে নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি।
কবীরা গুনাহ সমূহ থেকে এখানে শুধু এ তিনটিকেই উল্লেখ করা হল। কারণ এ তিনটি সকল অন্যায়ের প্রতি উৎসাহ যোগায় এবং মানুষকে সকল প্রকার ভালো কাজ থেকে দূরে রাখে। অতীত ও বর্তমানের অনেক লোকই এতে লিপ্ত হয়েছে। আল্লাহ তাআলার কাছে আমরা দুনিয়া ও আখেরাতে এ থেকে রক্ষা চাই।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ
أَكْبَرُ الْكَبَائِرِ الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَالأَمْنُ لِمَكْرِ اللَّهِ وَالْقَنُوطُ مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ وَالْيَأْسُ مِنْ رَوْحِ اللَّهِ
‘‘সবচেয় বড় কবীরাহ গুনাহ হচ্ছে, আল্লাহর পাকড়াও হতে নিজেকে নিরাপদ মনে করা, আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হওয়া এবং আল্লাহর করুণা থেকে নিজেকে বঞ্চিত মনে করা’’। ইমাম আব্দুর রাজ্জাক স্বীয় মুসান্নাফে এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন।[1]
ব্যাখ্যাঃ আবুস সাআদাত বলেনঃ আল্লাহর রহমত থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাশ হওয়ার নাম হচ্ছে قُنُوْط। অন্তরের জন্য উত্তম হচ্ছে, তাতে আল্লাহর ভয় বেশী পরিমাণ থাকবে। কেননা সুখ-শান্তিতে থাকাবস্থায় আশার পাল্লা ভাড়ি হলে অন্তর নষ্ট হয়ে যায় এবং তা অন্যায়ের উৎসে পরিণত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنَّ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ كَبِيرٌ
‘‘নিশ্চয়ই যারা তাদের পালনকর্তাকে না দেখে ভয় করে, তাদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরষ্কার’’। (সূরা মুলকঃ ১২) আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ
يَخَافُونَ يَوْمًا تَتَقَلَّبُ فِيهِ الْقُلُوبُ وَالْأَبْصَارُ
‘‘তারা ভয় করে সেই দিনকে, যেদিন অন্তর ও দৃষ্টিসমূহ পরিবর্তন হয়ে যাবে’’। (সূরা নূরঃ ৩৭) এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) সূরা আ’রাফের ৯৯ নং আয়াতের তাফসীর।
২) সূরা হিজরের ৫৬ নং আয়াতের তাফসীর।
৩) আল্লাহর পাকড়াও থেকে ভয়হীন ব্যক্তির জন্য কঠোর শাস্তির ভয় প্রদর্শন।
৪) আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ ব্যক্তিদের জন্যও রয়েছে কঠোর আযাবের ধমকি।