ব্যখ্যাঃ শাফআত মূলত দুই প্রকারঃ (১) এমন শাফাআত, কুরআন যাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। কুরআন বলেছে যে, কাফের ও মুশরিকদের জন্য শাফআত অগ্রহণীয় বলেছে। আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারার ২৫৪ নং আয়াতে বলেনঃ
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا أَنْفِقُوا مِمَّا رَزَقْنَاكُمْ مِنْ قَبْلِ أَنْ يَأْتِيَ يَوْمٌ لَا بَيْعٌ فِيهِ وَلَا خُلَّةٌ وَلَا شَفَاعَةٌ وَالْكَافِرُونَ هُمُ الظَّالِمُونَ
‘‘হে ঈমানদারগণ! আমি তোমাদেরকে যে রুজি দিয়েছি, সেদিন আসার পূর্বেই তোমরা তা থেকে ব্যয় করো, যাতে না আছে বেচা-কেনা, না আছে সুপারিশ কিংবা বন্ধুত্ব। আর কাফেররাই হলো প্রকৃত যালেম। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
فَمَا تَنْفَعُهُمْ شَفَاعَةُ الشَّافِعِينَ
‘‘অতএব সুপারিশকারীদের সুপারিশ তাদের কোনো উপকারে আসবেনা’’। (সূরা মুদ্দাছছিরঃ ৪৮) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
وَاتَّقُوا يَوْمًا لَا تَجْزِي نَفْسٌ عَنْ نَفْسٍ شَيْئًا وَلَا يُقْبَلُ مِنْهَا شَفَاعَةٌ وَلَا يُؤْخَذُ مِنْهَا عَدْلٌ وَلَا هُمْ يُنْصَرُونَ
‘‘আর সে দিনের ভয় করো, যখন কেউ কারও সামান্য উপকারে আসবেনা এবং তার পক্ষে কোনো সুপারিশও কবুল হবেনা; কারও কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও নেয়া হবেনা এবং তারা কোনো রকম সাহায্যও পাবেনা’’। (সূরা বাকারাঃ ৪৮) এ আয়াতগুলোতে কাফেরদের জন্য কিয়ামতের দিন কোনো শাফাআত ও শাফাআতকারী থাকার কথাকে অস্বীকার করা হয়েছে। এ রকম আরও অনেক আয়াত রয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘আর তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যাদের এবাদত করছে, তারা তাদের ক্ষতিও করতে পারেনা, উপকারও করতে পারেনা। তারা বলে, এরা তো আল্লাহ্র কাছে আমাদের সুপারিশকারী। তুমি তাদেরকে বলে দাওঃ তোমরা কি আল্লাহ্কে এমন বিষয়ে অবহিত করছ, যা তিনি অবহিত নন আসমান ও যমীনে? তাদের শির্ক থেকে তিনি পবিত্র এবং তার অনেক উর্ধে’’। (সূরা ইউনুসঃ ১৮) এখানে আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিচ্ছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা মাবুদগুলোকে আল্লাহর নিকট সুপারিশকারী বানিয়ে নিয়েছে, আল্লাহর নিকট তাদের সুপারিশের কোনো খবর নেই। অথচ আল্লাহ তাআলা জানেন না, পৃথিবীতে এমন কোনো বিষয়ের অস্তিত্বই নেই। সুতরাং আল্লাহ তাআলা বলেছেন যে, মুশরিকদের জন্য কোনো সুপারিশ নেই। মুশরিকরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে সুপারিশকারী মনে করছে, তাদের ধারণা শির্কী ধারণার অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ তাআলা তাদের শির্কের অনেক উর্ধ্বে। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ
‘‘যারা আল্লাহ্ ব্যতীত অপরকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে এবং বলে যে, আমরা তাদের এবাদত এ জন্যই করি, যেন তারা আমাদেরকে আল্লাহ্র নিকটবর্তী করে দেয়। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাদের পারস্পরিক বিরোধপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা করে দিবেন। আল্লাহ্ মিথ্যাবাদী কাফেরকে সৎপথে পরিচালিত করেন না’’। (সূরা যুমারঃ ৩)
এ আয়াত এমন ব্যক্তির শাফাআতকে বাতিল ঘোষণা করেছে, যার ব্যাপারে ধারণা করা হয় যে, সে বান্দাকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দিবে। বরং প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, সে বান্দাকে আল্লাহ থেকে, আল্লাহর রহমত থেকে এবং তাঁর ক্ষমা থেকে দূরে সরিয়ে দিবে। কেননা সে আল্লাহর জন্য শরীক সাব্যস্ত করেছে। সেই শরীকের কাছে কল্যাণ কামনা করছে, তার কাছে আশা-ভরসা করছে এবং আল্লাহর ভালবাসার মতই তাকে ভালবাসছে অথবা এর চেয়ে অধিক ভালবাসছে।
(২) দ্বিতীয় প্রকার শাফাআত হচ্ছে এমন শাফাআত, যাকে কুরআন স্বীকৃতি প্রদান করেছে। আর এটি হবে শুধু একনিষ্ঠ মুমিন বান্দা এবং তাওহীদপন্থীদের জন্য। আল্লাহ তাআলা এর জন্য দু’টি শর্তারোপ করেছেন।
(১) শাফাআতকারীর জন্য শাফাআতের অনুমতি প্রদানঃ আল্লাহ তাআলা সূরা বাকারার ২৫৫ নং আয়াতে বলেনঃ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ‘‘কে আছে সুপারিশ করবে তাঁর কাছে তার অনুমতি ছাড়া? গুনাহগার বান্দার উপর আল্লাহ তাআলার রহমত না হলে তার জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে সুপারিশের অনুমতি হবেনা। সুতরাং তিনি যখন তার উপর রহমত নাযিল করবেন, তখন শাফাআতকারীকে তার জন্য শাফাআত করার অনুমতি দিবেন।
দ্বিতীয় শর্ত হচ্ছে, যার জন্য সুপারিশ করা হবে, তার প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ
‘‘তারা শুধু তাদের জন্যই সুপারিশ করে, যাদের প্রতি আল্লাহ্ সন্তুষ্ট এবং তারা তার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত’’। (সূরা আম্বীয়াঃ ২৮) সুতরাং এ আয়াত থেকে জানা গেল যে, আল্লাহ তাআলা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েই শাফাআত করার অনুমতি দিবেন। আর তিনি তাওহীদপন্থী ছাড়া অন্য কারও প্রতি সন্তুষ্ট নন।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَأَنْذِرْ بِهِ الَّذِينَ يَخَافُونَ أَنْ يُحْشَرُوا إِلَى رَبِّهِمْ لَيْسَ لَهُمْ مِنْ دُونِهِ وَلِيٌّ وَلَا شَفِيعٌ لَعَلَّهُمْ يَتَّقُونَ
‘‘তুমি কুরআনের মাধ্যমে সেসব লোকদের সতর্ক করো, যারা তাদের রবের সামনে উপস্থিত হওয়াকে ভয় করে। সেদিন তাদের অবস্থা এমন হবে যে, আল্লাহ ছাড়া তাদের কোনো সাহায্যকারী বন্ধু এবং কোন শাফাআতকারী থাকবেনা, যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করে’’। (সূরা আনআমঃ ৫১)
ব্যাখ্যাঃ الإنذار অর্থ হচ্ছে শরীয়ত বিরোধী কাজগুলো সম্পর্কে জানিয়ে দেয়া এবং তা হতে সাবধান করা। যারা তাদের রবের সামনে উপস্থিত হওয়াকে ভয় করে, তারা হচ্ছেন একনিষ্ঠ বান্দা। তারা আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সুপারিশকারী হিসাবে গ্রহণ করেন না। তারা তাদের চাওয়া, আশা-ভরসা এবং অন্যান্য আমল ইখলাসের সাথে কেবল আল্লাহ তাআলার জন্য সম্পন্ন করে থাকেন। তারা কল্যাণ কামনা করার ক্ষেত্রে এবং ক্ষতিকর বস্ত্ত থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি মুখাপেক্ষী হন না। ফুযাইল বিন ইয়ায (রঃ) বলেন। আল্লাহ তাআলা সকল সৃষ্টিকে ভৎর্সনা করেন নি। তিনি কেবল তাদেরকেই ভৎর্সনা করেছেন, যাদের বিবেক রয়েছে।
আল্লাহ তাআলার বাণীঃ যাতে তারা তাকওয়া অবলম্বন করেঃ অর্থাৎ যাতে তারা এই পার্থিব জগতে এমন আমল করে, যার মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে কিয়ামত দিবসের আযাব থেকে বাঁচাবেন। সেই সঙ্গে তারা সুপারিশকারী এবং অন্যদেরকেও বর্জন করবে। কারণ আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে শাফাআত চাওয়া ইখলাসের পরিপন্থী, যা ব্যতীত আল্লাহ তাআলা কারও কোনো আমল কবুল করবেন না। আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সুপারিশ কামনা করা অন্যের কাছে কিছু প্রার্থনা করার অন্তর্ভূক্ত।
আল্লাহ তাআলা সূরা যুমারের ৪৪ নং আয়াতে বলেন, قُلْ لِلَّهِ الشَّــفَاعَةُ جَمــِيعًا ‘‘বলো, সমস্ত শাফাআত কেবল আল্লাহরই মালিকানাধীন’’।
ব্যাখ্যাঃ এ আয়াত প্রমাণ করছে যে, শাফাআত একমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য। কেননা আল্লাহর অনুমতিক্রমে কেবল তাওহীদপন্থীদের জন্যই শাফাআত হবে। পূর্বের আয়াতে আল্লাহ তাআলা এ কথাই বলেছেন। আল্লাহ তাআলা সূরা ইউনূসের ৩ নং আয়াতে বলেনঃ
يُدَبِّرُ الْأَمْرَ مَا مِنْ شَفِيعٍ إِلَّا مِنْ بَعْدِ إِذْنِهِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ
‘‘তিনি কার্য পরিচালনা করেন। তার অনুমতি ব্যতীত কেউ সুপারিশ করতে পারবেনা। তিনিই আল্লাহ্ তোমাদের প্রতিপালক। অতএব, তোমরা তারই এবাদত করো। তোমরা কি উপদেশ গ্রহণ করবেনা? সুতরাং জানা গেল, শাফাআত কেবল আল্লাহর অধিকার। কারণ আল্লাহ যাকে শাফাআত করার অনুমতি দিবেন, সে ব্যতীত অন্য কেউ শাফাআত করতে পারবেনা। সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত অন্যদেরকে সুপারিশকারী বানানোর ব্যাপারে এ আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা করা উচিত। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
‘‘নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতোদুভয়ের মধ্যে যা আছে, সবকিছুর উপরই আল্লাহ্র আধিপত্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। আল্লাহ্ সবকিছুর উপর শক্তিমান’’। (সূরা মায়েদাঃ ১৭) এ আয়াত আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে কিছু প্রার্থনা করাকে বাতিল করে দিয়েছে। কেননা তিনি একাই সবকিছুর মালিক। তাঁর রাজত্বে কারো একটি সরিষা দানা পরিমাণ অধিকার নেই।
ইসলাম অর্থ হচ্ছে বান্দা তার অন্তর ও কপালকে পূর্ণরূপে কেবল আল্লাহর জন্য অবনত করবে। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল বাহায বিন হাকীম থেকে, তিনি তার পিতা থেকে, তার পিতা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলেছিলেনঃ সেই আল্লাহর শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহকারে প্রেরণ করেছেন, আপনাকে আল্লাহ তাআলা কী কী জিনিষ দিয়ে প্রেরণ করেছেন? তিনি বললেনঃ ইসলাম। অর্থাৎ আল্লাহ আমাকে ইসলাম দিয়ে প্রেরণ করেছেন। তিনি আবার প্রশ্ন করলেনঃ ইসলাম কাকে বলে? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ ইসলাম হচ্ছে তুমি তোমার চেহারাকে এবং অন্তরকে আল্লাহর জন্য সোপর্দ করবে, ফরয নামায পড়বে এবং ফরয যাকাত আদায় করবে।[1]
ইখলাসের ব্যাখ্যায় অনেক আয়াত রয়েছে। ইখলাসের অর্থ হচ্ছে বান্দা সমস্ত আমল সম্পাদন করার সময় তার অন্তর ও চেহারাকে কেবল আল্লাহর দিকেই ফিরাবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
فَادْعُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
‘‘অতএব, তোমরা আল্লাহ্কে ডাকো দ্বীনকে তাঁর জন্য একনিষ্ঠ করে। যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে’’। (সূরা গাফেরঃ ১৪)
এখানে আল্লাহ তাআলা পরিপূর্ণ ইখলাসের সাথে তাঁকে আহবান করার হুকুম করেছেন এবং সংবাদ দিয়েছেন যে, ইখলাসই হচ্ছে সেই দ্বীন, যা ব্যতীত কোনো আমলই সঠিক ও কবুল হয়না।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ ইখলাস হচ্ছে আল্লাহর ভালবাসা এবং তাঁর ছাওয়াবের নিয়ত করা।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেনঃ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ‘‘তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট কে শাফাআত করতে পারে?’’ (সূরা বাকারাঃ ২৫৫)
ব্যাখ্যাঃ এই আয়াতের ব্যাখ্যা পূর্বে অতিক্রম করেছে।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى
‘‘আকাশ মন্ডলে এমন অনেক ফেরেস্তা রয়েছে, যাদের শাফাআত কোনো কাজেই আসবেনা, তবে আল্লাহ নিজ ইচ্ছায় যাকে খুশী তার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দিলে সে কথা ভিন্ন। (সূরা নাজমঃ ২৬)
ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ তাআলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন যে, ফেরেশতাগণ তাঁর সম্মানিত অনুগত বান্দা এবং তারা তাঁর নৈকট্যশীল হওয়ার বিষয়টি সুনিশ্চিত। তা সত্ত্বেও তাদের অবস্থা যদি এমন হয় অর্থাৎ তারাই যদি আল্লাহর বিনা অনুমতিতে তাঁর নিকট সুপারিশ করতে অক্ষম হন, তাহলে অন্যদের অক্ষম হওয়ার বিষয়টি আরো অধিক সুস্পষ্ট। আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদের কিছু গুণাবলী বর্ণনা করে সূরা আম্বীয়ার ২৬-২৯ নং আয়াতে বলেনঃ
بَلْ عِبَادٌ مُكْرَمُونَ (26) لَا يَسْبِقُونَهُ بِالْقَوْلِ وَهُمْ بِأَمْرِهِ يَعْمَلُونَ (27) يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى وَهُمْ مِنْ خَشْيَتِهِ مُشْفِقُونَ (28) وَمَنْ يَقُلْ مِنْهُمْ إِنِّي إِلَهٌ مِنْ دُونِهِ فَذَلِكَ نَجْزِيهِ جَهَنَّمَ كَذَلِكَ نَجْزِي الظَّالِمِينَ
‘‘বরং তারা তো তাঁর সম্মানিত বান্দা। তারা আগে বেড়ে কথা বলতে পারেনা এবং তারা তাঁর আদেশেই কাজ করে। তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যা আছে, তা তিনি জানেন। তারা শুধু তাদের জন্য সুপারিশ করে, যাদের প্রতি আল্লাহ্ সন্তুষ্ট এবং তারা তাঁর ভয়ে ভীত। তাদের মধ্যে যে বলবেঃ আল্লাহ ব্যতীত আমিই উপাস্য, তাকে আমি জাহান্নামের শাস্তি দেবো। আমি যালেমদেরকে এভাবেই প্রতিফল দিয়ে থাকি’’।
এ মুহকাম আয়াতগুলোতে কুরআনে বর্ণিত বৈধ সুপারিশের স্বরূপ সুস্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়েছে। আর এটি আল্লাহর মালিকানাধীন। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এর মালিক নয়। দুই শর্তে তা অর্জন করা সম্ভব। যেমন বর্ণিত হয়েছে উপরের আয়াত এবং অন্যান্য আয়াতে। শর্ত দু’টি হচ্ছে, (১) শাফাআতকারীর জন্য শাফাআত করার অনুমতি থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ مَنْ ذَا الَّذِي يَشْفَعُ عِنْدَهُ إِلَّا بِإِذْنِهِ ‘‘তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট কে শাফাআত করতে পারে?’’ (সূরা বাকারাঃ ২৫৫) (২) যে গুনাহগার তাওহীদপন্থীর প্রতি আল্লাহ তাআলা সন্তুষ্ট থাকবেন, শাফাআত কেবল তার জন্যই হবে।
সুতরাং জানা গেল যে, শাফাআত শুধু তাওহীদপন্থী মুমিনদের জন্যই নির্দিষ্ট। আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্যকে সুপারিশকারী বানানো মুশরিকদের দ্বীনের অন্তর্ভূক্ত। পূর্বে উল্লেখিত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের শাফাআতকারী গ্রহণ করার প্রতিবাদ করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ
‘‘হে মুহাম্মদ! মুশরিকদেরকে বলো, তোমরা তোমাদের সেসব মাবুদদেরকে ডাকো, যাদেরকে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত নিজেদের মাবুদ মনে করে নিয়েছো, তারা না আকাশের, না যমীনের এক অনু পরিমাণ জিনিষের মালিক’’। (সূরা সাবাঃ ২২)
আবুল আব্বাস ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ (রঃ) বলেনঃ মুশরিকরা আল্লাহ ছাড়া যাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছে, তার সবই আল্লাহ তাআলা অস্বীকার করেছেন। আল্লাহ ছাড়া অন্যের জন্য রাজত্ব অথবা আল্লাহর ক্ষমতায় গাইরুল্লাহর অংশীদারিত্ব অথবা আল্লাহর জন্য কোনো সাহায্যকারী হওয়াকে তিনি অস্বীকার করেছেন। বাকী থাকল শুধু শাফাআতের বিষয়টি। এ ব্যাপারে কথা হলো, আল্লাহ তাআলা যাকে শাফাআত করার অনুমতি দিবেন, তার শাফাআত ছাড়া অন্য কারো শাফাআত কোনো কাজে আসবেনা। আল্লাহ তাআলা বলেছেন,وَلَا يَشْفَعُونَ إِلَّا لِمَنِ ارْتَضَى ‘‘তিনি যার ব্যাপারে সন্তুষ্ট হবেন, কেবল তার পক্ষেই তারা শাফাআত করবে’’। (সূরা আম্বিয়াঃ ২৮)
মুশরিকরা যে শাফাআতের আশা করে, কিয়ামতের দিন উহার কোন অস্তিত্বই থাকবেনা। কুরআনে কারীম এ ধরনের শাফাআতকে অস্বীকার করেছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জানিয়েছেন, তিনি আল্লাহর নিকট উপস্থিত হবেন। অতঃপর তাঁর রবের উদ্দেশ্যে তিনি সেজদায় লুটিয়ে পড়বেন এবং আল্লাহর প্রশংসায় মগ্ন হবেন। প্রথমেই তিনি শাফাআত শুরু করবেন না। অতঃপর তাঁকে বলা হবে, হে মুহাম্মদ! তোমার মাথা উঠাও। তুমি তোমার কথা বলতে থাক, তোমার কথা শ্রবণ করা হবে। তুমি চাইতে থাক, তোমাকে দেয়া হবে। তুমি সুপারিশ করতে থাক, তোমার সুপারিশ গ্রহণ করা হবে’’।[2]
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন আপনার শাফাআত লাভে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কে? তিনি বললেন, যে ব্যক্তি খাস দিলে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলবে, সে আমার শাফাআত পাওয়ার সর্বাধিক হকদার হবে।
এ হাদীছে বর্ণিত শাফাআত আল্লাহ তাআলার অনুমতিপ্রাপ্ত এবং নেককার মুখলিস বান্দাদের জন্য নির্দিষ্ট। আল্লাহর সাথে যে ব্যক্তি কাউকে শরিক করবে, তার ভাগ্যে এ শাফাআত জুটবেনা।
এ আলোচনার তাৎপর্য হলো, আল্লাহ তাআলা মুখলিস বান্দাগণের প্রতি অনুগ্রহ করবেন এবং শাফাআতের জন্য অনুমতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের প্রার্থনায় তাদেরকে ক্ষমা করবেন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে, শাফাআতকারীকে সম্মানিত করা এবং তাঁকে মাকামে মাহমূদ তথা প্রশংসিত স্থান দান করা।
কুরআনে কারীম যে শাফাআতকে অস্বীকার করেছে, তাতে শির্ক বিদ্যমান রয়েছে। এ জন্যই আল্লাহ তাআলার অনুমতি সাপেক্ষে শাফাআতের স্বীকৃতির কথা কুরআনে বিভিন্ন জায়গায় এসেছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন যে, শাফাআত একমাত্র তাওহীদবাদী নিষ্ঠাবান মুমিনদের জন্যই নির্দিষ্ট।
ব্যাখ্যাঃ উল্লেখিত বর্ণনায় শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়াহ (রঃ) শাফাআতের হাকীকত বর্ণনা করেছেন এবং তাতে দলীল-প্রমাণ একত্রিত করেছেন। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয় গুলো জানা যায়ঃ
১) এই অধ্যায়ে বর্ণিত আয়াতসমূহের তাফসীর জানা গেল।
২) কুরআনে যে শাফাআতকে অস্বীকার করা হয়েছে তার স্বরূপ জানা গেল।
৩) আর যে প্রকার শাফাআতকে কুরআন স্বীকৃতি দিয়েছে তার গুণাগুণ জানা গেল।
৪) সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ শাফাআতের উল্লেখ। আর তা হচ্ছে মাকামে মাহমুদ।
৫) কিয়ামতের দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা করবেন তার বর্ণনা। অর্থাৎ তিনি প্রথমেই শাফাআত করবেন না; বরং তিনি সেজদায় পড়ে যাবেন। তাঁকে অনুমতি প্রদান করা হলেই তিনি শাফাআত করতে পারবেন।
৬) শাফাআতের মাধ্যমে সবচেয়ে সৌভাগ্যবান ব্যক্তি কে, তাও জানা গেল।
৭) আল্লাহর সাথে শির্ককারীর জন্য কোনো শাফাআত গৃহীত হবে না।
৮) শাফাআতের স্বরূপ জানা গেল।
[2] - বুখারী, অধ্যায়ঃ জান্নাত ও জাহান্নামের গুণাগুণ।