রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদ দূর করা অথবা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে আংটি, তাগা, সূতা ইত্যাদি পরিধান করা শির্ক - ১

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ

‘‘বলোঃ তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি আল্লাহ্ আমার অনিষ্ট করার ইচ্ছা করেন, তবে তোমরা আল্লাহ্ ব্যতীত যাদেরকে ডাকো, তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি রহমত করার ইচ্ছা করলে তারা কি সে রহমত প্রতিরোধ করতে পারবে? বলোঃ আমার জন্য আল্লাহ্ই যথেষ্ট। নির্ভরকারীরা তাঁরই উপর নির্ভর করে’’। (সূরা যুমারঃ ৩৮)

ব্যাখ্যাঃ বিপদাপদ আপতিত হয়ে গেলে তা দূর করার জন্য এবং আগমণকারী বিপদাপদ আসার পূর্বেই প্রতিহত করার জন্য উপরোক্ত জিনিষগুলো ব্যবহার করা শির্ক। অর্থাৎ উপরোক্ত জিনিষগুলো পরিধান করার উদ্দেশ্য যদি তাই হয় এবং তার অন্তরে যদি এ বিষয়টি বদ্ধমূল হয় যে, ঐ বিষয়গুলো আপতিত বিপদাপদ দূর করবে এবং যে সমস্ত বিপদাপদ আসবে তাও প্রতিহত করবে, তাহলে সহীহ হাদীছের সুস্পষ্ট ঘোষণা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ শির্ক।[1]

উপরোক্ত আয়াতের তাফসীরে ইমাম মুকাতিল (রঃ) বলেনঃ অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু তারা কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ থাকল। কেননা তারা তাদের বাতিল মাবুদের ব্যাপারে এ বিশ্বাস রাখতনা যে, তারা কোনো কিছু সৃষ্টি করতে পারে।[2]

আমি বলছি, আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে তারা যেসব মাবুদদের আহবান করছে, আল্লাহ্ তাআলা যদি তার বান্দার কোনো ক্ষতি করতে চান, তাহলে ঐসব মাবুদ সে ক্ষতি দূর করার ক্ষমতা রাখেনা অথবা আল্লাহ্ তাআলা যে রহমত তাঁর বান্দার উপর নাযিল করেছেন, তা প্রতিহত করার ক্ষমতাও রাখেনা। সুতরাং তাদের উপর আবশ্যক যে, একমাত্র আল্লাহই হবেন তাদের মাবুদ। আল্লাহ্ ব্যতীত তাদের অন্য কোনো মাবুদ থাকতেই পারেনা। যে ব্যক্তি ইবরাহীম (আঃ)এর সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়েছিল, তাকেও আল্লাহ্ তাআলা একই প্রশ্ন করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা সূরা হজ্জের ৩৭ নং আয়াতে বলেনঃ

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَاجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ آَتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللَّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

‘‘তুমি কি সে লোককে দেখনি, যে ইবরাহীমের সাথে তাঁর প্রভুর ব্যাপারে বাদানুবাদ করেছিল এ কারণে যে, আল্লাহ্ সে ব্যক্তিকে রাজ্য দান করেছিলেন? ইবরাহীম যখন বললেন, আমার প্রতিপালক হলেন তিনি, যিনি জীবন দান করেন এবং মৃত্যু ঘটান। সে বলল, আমিও জীবন দান করি এবং মৃত্যু ঘটিয়ে থাকি। ইবরাহীম বললেন, নিশ্চয়ই তিনি সূর্যকে উদিত করেন পূর্ব দিক থেকে। তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উদিত করো। তখন সে কাফের হতভম্ব হয়ে গেল। আর আল্লাহ্ সীমালংঘণকারী সম্প্রদায়কে সরল পথ প্রদর্শন করেন না’’।

আল্লাহ্ তাআলা এখানে দৃষ্টান্ত পেশ করে মুশরিকদের বিরুদ্ধে এমন দলীল-প্রমাণ কায়েম করেছেন, যা তাদের শির্ককে খন্ডন করে দেয় এবং এবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে অন্যান্য বস্ত্তকে সমান করে দেয়াকে বাতিল করে। এ ধরণের আয়াত কুরআনুল কারীমে অনেক রয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা হজ্জের ৩৭ নং আয়াতে বলেনঃ

يَا أَيُّهَا النَّاسُ ضُرِبَ مَثَلٌ فَاسْتَمِعُوا لَهُ إِنَّ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ لَن يَخْلُقُوا ذُبَاباً وَلَوِ اجْتَمَعُوا لَهُ وَإِن يَسْلُبْهُمُ الذُّبَابُ شَيْئاً لَّا يَسْتَنقِذُوهُ مِنْهُ ضَعُفَ الطَّالِبُ وَالْمَطْلُوبُ

‘‘হে লোক সকল! একটি উপমা পেশ করা হল, অতএব তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শোন; তোমরা আল্লাহ্‌র পরিবর্তে যাদেরকে আহবান করো, তারা কখনো একটি মাছি সৃষ্টি করতে পারবেনা, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের কাছ থেকে কোনো কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা মাছির কাছ থেকে তা উদ্ধার করতে পারবেনা। প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়েই অসহায়’’। আল্লাহ্ তাআলা সূরা আনকাবুতের ৪১ ও ৪২ নং আয়াতে বলেনঃ

مَثَلُ الَّذِينَ اتَّخَذُوا مِن دُونِ اللَّهِ أَوْلِيَاءَ كَمَثَلِ الْعَنكَبُوتِ اتَّخَذَتْ بَيْتاً وَإِنَّ أَوْهَنَ الْبُيُوتِ لَبَيْتُ الْعَنكَبُوتِ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ مِن شَيْءٍ وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ وَتِلْكَ الْأَمْثَالُ نَضْرِبُهَا لِلنَّاسِ وَمَا يَعْقِلُهَا إِلَّا الْعَالِمُونَ

‘‘যারা আললাহ্র পরিবর্তে অপরকে সাহায্যকারী বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তাদের উদাহরণ ঐ মাকড়সা, যে ঘর বানায়। আর সব ঘরের মধ্যে মাকড়সার ঘরই সর্বাধিক দুর্বল। আফসোস! যদি তারা জানতো। তারা আল্লাহ্‌র পরিবর্তে যা কিছুকে ডাকে, আল্লাহ্ তা জানেন। তিনি মহা পরাক্রশালী, প্রজ্ঞাময়। এ সকল উদাহরণ আমি মানুষের জন্য দেই; কিন্তু জ্ঞানীরাই তা বুঝে’’। আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ

وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِن دُونِ اللّهِ لاَ يَخْلُقُونَ شَيْئاً وَهُمْ يُخْلَقُونَ أَمْواتٌ غَيْرُ أَحْيَاء وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ

‘‘যারা আল্লাহ্কে ছেড়ে অন্যদের ডাকে, ওরা তো কোনো কিছুই সৃষ্টি করেনা; বরং ওরা নিজেরাই সৃজিত। তারা মৃত, প্রাণহীন এবং কবে পুনরুত্থিত হবে, তাও তারা জানে না’’। (সূরা নাহলঃ ২০-২১)

হাফেয ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস হতে ইবনে আবী হাতিমের সূত্রে বর্ণিত একটি মারফু হাদীছ বর্ণনা করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহুকে লক্ষ্য করে বলেনঃ তুমি আল্লাহর হকসমূহের হেফাযত করো। আল্লাহ্ও তোমাকে হেফাযত করবেন। তুমি আল্লাহর ফরয ও ওয়াজিব সমূহের হেফাযত করো, তাহলে তুমি আল্লাহ্কে তোমার সামনে পাবে। সুখ-শান্তির সময় আল্লাহ্কে স্মরণ করো, তাহলে দুঃখে ও বিপদাপদে আল্লাহ্কে কাছে পাবে। তুমি যখন কিছু চাইবে, তখন কেবল আল্লাহর কাছেই চাইবে। তুমি যখন সাহায্য চাইবে, তখন কেবল আল্লাহর কাছেই চাইবে। জেনে রাখো! দুনিয়ার সমস্ত লোকও যদি তোমার এমন কোনো ক্ষতি করার জন্য একত্রিত হয়, যা আল্লাহ্ তাআলা তোমার ভাগ্যে লিখেন নি, তাহলেও তারা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। আর তারা সকলে মিলে যদি তোমার এমন কোনো উপকার করতে চায়, যা তোমার ভাগ্যে আল্লাহ্ তাআলা লিখে দেননি, তাহলেও তারা তোমার উপকার করতে পারবেনা। সবকিছু লিখার পর কলমের কালি শুকিয়ে গেছে এবং কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমল করো এবং ঈমান ও ইয়াকীনকে সম্পদ মনে করে এর শুকরিয়া আদায় করো। জেনে রাখো! অপছন্দনীয় বস্ত্তর উপর শুকরিয়া আদায় করার মধ্যে রয়েছে অপরিমীত কল্যাণ। সবরের সাথেই আল্লাহর সাহায্য আগমণ করে। দুঃখ-কষ্টের পরই আগমণ করে শান্তি এবং কঠিনতার পরই আগমণ করে সহজতা।[3]

সাহাবী ইমরান বিন হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন,

«أن النبي صلى الله صلى الله عليه وسلم رَأَى رَجُلاً فِى يَدِهِ حَلْقَةٌ مِنْ صُفْرٍ فَقَالَ مَا هَذِهِ الْحَلْقَةُ قَالَ هَذِهِ مِنَ الْوَاهِنَةِ قَالَ انْزِعْهَا فَإِنَّهَا لاَ تَزِيدُكَ إِلاَّ وَهْنًا»

‘‘নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তির হাতে পিতলের একটি বালা দেখলেন। তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, এটা কী? লোকটি বলল, এটা দুর্বলতা দূর করার জন্য পরিধান করা হয়েছে। তিনি বললেনঃ এটা খুলে ফেল। কারণ এটা তোমার দুর্বলতাকে আরো বৃদ্ধি করবে। আর এটা তোমার সাথে থাকা অবস্থায় যদি তোমার মৃত্যু হয়, তাহলে তুমি কখনো সফলকাম হতে পারবেনা’’।[4]

ব্যাখ্যাঃ ইমারন বিন হুসাইন ইবনে উবাইদ বিন খালাফ আল-খুযাঈ ছিলেন সাহাবী। তাঁর পিতাও সাহাবী ছিলেন। খায়বার যুদ্ধের বছর তিনি ইসলাম কবুল করেন। ৫২ হিজরী সালে তিনি বসরায় ইন্তেকাল করেন।

হাকেমের অন্য এক বর্ণনায় এসেছে, ইমরান বিন হুসাইন বলেনঃ আমি একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট গেলাম। তখন আমার হাতে ছিল পিতলের একটি বালা। এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, উপরোক্ত হাদীছে যার নাম উল্লেখ করা হয়নি, তিনিই ছিলেন ইমরান বিন হুসাইন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেনঃ এটা কী? এই প্রশ্ন থেকেই বুঝা যাচ্ছে, তিনি এটিকে অপছন্দ করেছেন এবং তা পরিধান করার প্রতিবাদ করেছেন।

হাদীছে বর্ণিত الواهنة ( দূর্বলতা)এর ব্যাখ্যায় একাধিক উক্তি রয়েছে। আবুস সাআদাত বলেনঃ এটি একটি রোগের নাম, যা ঘাড়ে এবং হাতের সকল স্থানেই পরিলক্ষিত হয়। এতে ঝাড়-ফুঁক করা হয়ে থাকে। কেউ কেউ বলেনঃ এটি এমন একটি রোগের নাম, যা বাহুতে পরিলক্ষিত হয়। এতে শুধু পুরুষেরাই আক্রান্ত হয়।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদ দূর করার জন্য বালা পরিধান করতে নিষেধ করেছেন। কারণ এতে এই ধারণা হতে পারে যে, এটিই রোগ থেকে মুক্তি দিবে অথবা রোগ প্রতিহত করবে। এ জন্যই তিনি এটি নিক্ষেপ করার আদেশ করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, এটি অসুস্থতা আরো বাড়িয়ে দিবে। মুশরিকদেরকে আল্লাহ্ তাআলা তাদের আশার বিপরীত ফল দিয়ে থাকেন। কেননা সে তার অন্তরকে এমন জিনিষের সাথে সংযুক্ত করেছে, যা তার কোনো লাভ অথবা ক্ষতির মালিক নয়। সাধারণ একটি বালা পরিধান করলে যদি অবস্থা এমন হয়, তাহলে এর চেয়ে বড় অপরাধসমূহের ক্ষেত্রে অবস্থা কেমন হবে? যেমন কবর, মাজার, তাগুত এবং এ ধরণের অন্যান্য বস্ত্তর পূজারীদের অবস্থা কেমন হবে- তা সহজেই অনুমেয়। যার সামান্য পরিমাণ বিবেক রয়েছে, তার কাছেও শির্কের ভয়াবহতার বিষয়টি মোটেও গোপন নয়।

গ্রন্থকার বলেনঃ এতে সাহাবীদের ঐ কথার দলীল পাওয়া যায় যে, শির্কে আসগার কবীরাহ গুনাহ্ সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি সর্ববৃহৎ গুনাহ্। আর অজ্ঞতার কারণে শির্কে লিপ্ত হলেও শির্কে লিপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হবেনা।[5] কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, আর এটা তোমার সাথে থাকা অবস্থায় যদি তোমার মৃত্যু হয়, তবে তুমি কখনো সফলকাম হতে পারবেনা।

[1] - এ বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা হচ্ছে, কেউ যদি আল্লাহর উপর থেকে বিশ্বাস ও আস্থা উঠিয়ে নিয়ে অন্যসব বস্ত্তর উপর এমন ভরসা স্থাপন করে যে, এগুলোই আরোগ্য দানের জন্য যথেষ্ট, তবে তা হবে বড় শির্ক। পক্ষান্তরে যদি এই বিশ্বাস পোষণ করা হয় যে, এগুলো মাধ্যম মাত্র, মূল আরোগ্য দাতা মহান আল্লাহ, তবে তা হবে ছোট শির্ক।

[2] - মুকাতিল আয়াতে কারীমা থেকে ইহা বুঝেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ রকম কোন মারফু হাদীছ নেই।

[3] - মুসনাদে আহমাদ, তিরমিজী ও তাবরানী এই হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ইমাম আলবানী (রঃ) এই হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ যিলালুল জান্নাত, হাদীছ নং- ৩১৫।

[4] - মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ। ইমাম আলবানী (রঃ) এই হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে যঈফা, হাদীছ নং- ২১৯৫।

[5] - লেখকের এই কথাটি সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য নয়। তাই অজ্ঞতার কারণে কোন মুমিন যদি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র বিপরীত কোন কর্মে লিপ্ত হয়, সে ক্ষমা পাবে কি না, সামনের টিকায় এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা আসছে ইনশা-আল্লাহ।
রোগ-ব্যাধি ও বিপদাপদ দূর করা অথবা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে আংটি, তাগা, সূতা ইত্যাদি পরিধান করা শির্ক - ২

ইমাম আহমাদ বিন হাম্বালের পূর্ণ নাম হচ্ছে আবু আব্দুল্লাহ আহমাদ বিন হাম্বাল বিন মুহাম্মাদ বিন হিলাল বিন আসাদ আল শায়বানী আল মিরওয়াযী আল-বাগদাদী। তিনি ছিলেন তাঁর যুগের ইমাম এবং সমসাময়িক আলেমদের মধ্যে হাদীছ ও ফিকাহ শাস্ত্রে সর্বাধিক পারদর্শী। তিনি তাদের মধ্যে অত্যাধিক পরহেজগার এবং সুন্নাতের অনুসারী ছিলেন। কোনো কোনো আলেম তাঁর ব্যাপারে বলেছেনঃ তিনি ছিলেন দুনিয়ার ভোগবিলাস বর্জনকারী এবং সালফে সালেহীনদের পথের অনুসরণে আগ্রহী। দুনিয়ার সম্পদ ও পদমর্যাদা তাঁর করতলগত হয়েছিল, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর যামানায় দ্বীনের মধ্যে বিভিন্ন বাতিল আকীদাহ প্রবেশ করেছিল এবং সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু তিনি এগুলোর কড়া প্রতিবাদ করেছেন।

তিনি ইমাম শাফেয়ী, ইয়াযীদ বিন হারুন, আব্দুর রাহমান বিন মাহদী, ইয়াহইয়া আলকাত্তান, সুফিয়ান বিন উয়াইনা, আব্দুর রাজ্জাক এবং আরো অগণিত আলেম থেকে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। ২৪১ হিজরীতে ৭৭ বছর বয়সে উপনীত হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর উপর রহম করুন। আমীন

উকবা বিন আমের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি মারফু হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«مَنْ تَعَلَّقَ تَمِيمَةً فَلاَ أَتَمَّ اللَّهُ لَهُ وَمَنْ تَعَلَّقَ وَدَعَةً فَلاَ وَدَعَ اللَّهُ لَهُ»

‘‘যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলায় আল্লাহ যেন তার আশা পূরণ না করেন। যে ব্যক্তি কড়ি, শামুক ইত্যাদি পরিধান করে, আল্লাহ যেন তার রোগ ভাল না করেন (উদ্দেশ্য পূর্ণ না করেন)’’।[6] অপর একটি বর্ণনায় আছে, «مَنْ تَعَلَّقَ تَمِيمَةً فَقَدْ أَشْرَكَ»‘‘যে ব্যক্তি তাবিজ ঝুলাল সে শিরক করল’’।

ব্যাখ্যাঃ এই হাদীছ সুস্পষ্টভাবে বলে দিচ্ছে যে, তাবীজ লটকানো শির্ক। কেননা যে ব্যক্তি তাবীজ লটকায় সে এ উদ্দেশ্যেই লটকায় যে, এটি তার ক্ষতি দূর করবে অথবা তার জন্য কল্যাণ নিয়ে আসবে। আর এটি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর দাবি মোতাবেক ইখলাসের পরিপন্থী।[7] মুখলিস বান্দার অন্তর কল্যাণ অর্জন কিংবা বিপদাপদ দূর করার জন্য আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের প্রতি কখনই দৃষ্টিপাত করবেনা। আল্লাহ্ তাআলা সূরা নিসার ১২৫ নং আয়াতে বলেনঃ

وَمَنْ أَحْسَنُ دِينًا مِمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لِلَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ وَاتَّبَعَ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَاتَّخَذَ اللَّهُ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلًا

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র নির্দেশের সামনে মস্তক অবনত করে সৎকাজে নিয়োজিত থাকে এবং ইবরাহীম (আঃ)এর দ্বীনের অনুসরণ করে, যিনি ছিলেন একনিষ্ঠ, তার চেয়ে উত্তম দ্বীন পালনকারী আর কে হতে পারে? আল্লাহ্ ইবরাহীমকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করেছেন’’।

সুতরাং জানা গেল, শির্ক বর্জন না করলে কারও তাওহীদ পূর্ণ হবেনা। তাবীজ-কবজ লটকানো যদিও ছোট শির্কের অন্তর্ভূক্ত, তারপরও এটি বিরাট অপরাধ। ছোট শির্কের বিষয়টি যদি নবুওয়াতের যুগে কতক সাহাবীর নিকট অস্পষ্ট থাকে, তাহলে মুসলিম জাতির মধ্যে শির্ক-বিদআত ছড়িয়ে পড়ার পর এবং যারা ঈমান ও জ্ঞানে সাহাবীদের চেয়ে অনেক পিছনে, তাদের কাছে বিষয়টি অস্পষ্ট থাকা খুবই স্বাভাবিক। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে অনেক সহীহ হাদীছে। ইতিপূর্বে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

উপরোক্ত হাদীছেও ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর অর্থকে সুস্পষ্ট করা হয়েছে। কেননা এটি ছোট-বড় এবং কম-বেশী সকল শির্ককে প্রত্যাখ্যান করে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা আল-ইমরানের ১৮ নং আয়াতে বলেনঃ

شَهِدَ اللّهُ أَنَّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ وَالْمَلاَئِكَةُ وَأُوْلُواْ الْعِلْمِ قَآئِمَاً بِالْقِسْطِ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘‘আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য উপাস্য নেই। ফেরেশতাগণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য ইলাহ্ নেই। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান’’।

‘‘فلا أتم الله له আল্লাহ যেন তার আশা পূরণ না করেন’’- এটি হচ্ছে তার উপর বদ্ দুআ। এ রকমইفلا ودع الله আল্লাহ্ যেন তাকে রোগমুক্ত না করেন বা তার উদ্দেশ্য পূরণ না করেন।

ইবনে আবি হাতেম হুযাইফা থেকে বর্ণনা করেছেন, জ্বর নিরাময়ের জন্য হাতে সূতা বা তাগা পরিহিত অবস্থায় তিনি একজন লোককে দেখতে পেয়ে সেটি কেটে ফেললেন এবং কুরআনের এ আয়াতটি তিলাওয়াত করলেন,

وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ

‘‘আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনকারী অধিকাংশ মানুষই শির্ক করে থাকে’’। (সূরা ইউসুফঃ ১০৬)

ব্যাখ্যাঃ ইবনে আবী হাতিমের পূর্ণ নাম হচ্ছে হাফেয ইমাম আবু মুহাম্মাদ আব্দুর রাহমান বিন আবী হাতেম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আল মুরাদী আত্ তামিমী আলহানযালী। তিনি ছিলেন হাদীছ বর্ণনাকারীদের অবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞ, তাফসীর এবং অন্যান্য শাস্ত্রের বিশিষ্ট একজন আলেম। ৩২৭ হিজরী সালে তিনি ইন্তেকাল করেন।

হুযায়ফা রাযিয়াল্লাহু আনহুর পূর্ণ নাম হচ্ছে হুযায়ফা বিন ইয়ামান আনসারী। তিনি ছিলেন আনসার গোত্রের বন্ধু এবং একজন প্রসিদ্ধ মুহাজির সাহাবী। তাঁকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের গোপন ভান্ডার বলা হত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর নিকট বেশ কিছু গোপন কথা বলেছিলেন। আলী রাযিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতকালে ৩৬ হিজরী সালে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

এখানে দলীল পাওয়া যাচ্ছে যে, হাতে সূতা বা তাগা লাগানো শির্ক। বড় শির্কের ক্ষেত্রে নাযিলকৃত আয়াতগুলোর মাধ্যমে সাহাবীগণ ছোট শির্ক হারাম হওয়ার দলীল গ্রহণ করতেন। কেননা অনেক আয়াত ও হাদীছে বিনা পার্থক্যে শির্ক করতে নিষেধ করা হয়েছে। সে হিসাবে যেখানে শির্ক থেকে নিষেধ করা হয়েছে, সেখানে ছোট ও বড় উভয় প্রকার শির্কই উদ্দেশ্য। আর ইহা জানা কথা যে, ছোট শির্কও ইখলাসের পরিপন্থী। বিষয়টি যেহেতু এ রকমই, তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদের উপরও শির্কে আসগারের ভয় করেছেন। তিনি বলেনঃ

«إِنَّ أَخْوَفَ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمُ الشِّرْكُ الأَصْغَرُ»

‘‘আমি তোমাদের উপর ছোট শির্কের সর্বাধিক ভয় করছি। সম্মানিত যুগের মানুষদের উপর তিনি যদি ছোট শির্কের ভয় করেন, তাহলে পরবর্তী যামানার লোকদের ব্যাপারে কিভাবে এ কথা কল্পনা করা যায় যে, তারা বড় শির্কে লিপ্ত হবেনা? কিন্তু পরিতাপের বিষয় হল, মূর্খতার কারণে বর্তমান যামানার লোকদের মধ্যে আইয়্যামে জাহেলিয়াতের আরব ও অন্যান্য মুশরিকদের শির্কের চেয়েও অধিক ভয়াবহ শির্ক পাওয়া যাচ্ছে। পূর্বে এ বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। পরবর্তী যামানার অনেক নামধারী আলেম ঐ সমস্ত আলেমদের কঠোর প্রতিবাদ করছে, যারা শির্কে আকবার বর্জনের আহবান জানায়। এর মাধ্যমে বর্তমান কালের নামধারী আলেমগণ সাহাবীদের বিপরীতমুখী অবস্থান গ্রহণ করেছেন। সাহাবীগণ সামান্য শির্কেরও প্রতিবাদ করেছেন। আর বর্তমান কালের এক শ্রেণীর আলেম শির্কে আকবারের প্রতিবাদকারীদের প্রতিবাদ করে এবং শির্ক থেকে নিষেধ করাকেই বিদআত ও গোমরাহী বলে থাকে। নবী-রাসূলদেরকে যে তাওহীদ, একমাত্র আল্লাহর জন্য ইখলাসের সাথে এবাদত ও আল্লাহর সাথে শির্ক থেকে নিষেধসহ প্রেরণ করা হয়েছিল, তাতে নবী-রাসূলদের সাথে নিজ নিজ উম্মতের অবস্থা একই রকম ছিল।

পূর্বের নবী-রাসূলদের ন্যায় আখেরী যামানার নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও আল্লাহ্ তাআলা তাওহীদ, ইখলাসের সাথে আল্লাহর এবাদত এবং শির্কের নিষেধাজ্ঞাসহ প্রেরণ করেছেন। কিন্তু আরব ও অন্যান্য মুশরিকদেরকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে তাওহীদের দিকে দাওয়াত দিয়েছেন, পরবর্তীকালের এই মুসলমানেরা তা পাল্টিয়ে ফেলেছে। এই লোকেরা নিষিদ্ধ শির্কের পথে চলছে এবং এর সাহায্য করছে। যেই তাওহীদ দিয়ে আল্লাহ্ তাআলা নবী-রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন, তারা তাকেই কঠোরভাবে অস্বীকার করছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরাইশদেরকে লক্ষ্য করে যখন বললেনঃ

«أَيُّهَا النَّاسُ قُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ تُفْلِحُوا»

‘‘হে লোক সকল! তোমরা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলো। এতে তোমরা সফলকাম হবে। যে অর্থে এই কালেমাটি গঠন করা হয়েছে, তারা তা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল। তারা বলেছিলঃ

أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهاً وَاحِداً إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ

‘‘সে কি বহু মাবুদের পরিবর্তে এক মাবুদের এবাদত সাব্যস্ত করে দিয়েছে? নিশ্চয়ই এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার’’! (সূরা সোয়াদঃ ৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ

‘‘তাদের যখন বলা হত, আল্লাহ্ ব্যতীত কোনো সত্য উপাস্য নেই, তখন তারা অহঙ্কার করত এবং বলতঃ আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের মাবুদদেরকে পরিত্যাগ করব?’’ (সূরা আস্ সাফ্ফাতঃ ৩৫-৩৬) সহীহ বুখারী এবং অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে হিরাক্লিয়াস এবং আবু সুফিয়ানের মধ্যে কথোপকথনের মধ্যে একই কথা বর্ণিত হয়েছে। হিরাক্লিয়াস আবু সুফিয়ানকে প্রশ্ন করল, মুহাম্মাদ তোমাদেরকে কিসের আদেশ দেয়? আবু সুফিয়ান তখন বলেছিলেনঃ তিনি আমাদেরকে আদেশ দিচ্ছেন যে, তোমরা এক আল্লাহর এবাদত করো, তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করোনা এবং তোমাদের বাপদাদারা যা বলে, তা বর্জন করো। তিনি আমাদেরকে নামায আদায় করার, দান-সাদকাহ করার এবং পবিত্র জীবন-যাপন করার আদেশ দেন।[8] এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে আংটি, বালা ও সূতা ইত্যাদি পরিধান করার ব্যাপারে অত্যাধিক কঠোরতা।

২) সাহাবীও যদি এসব জিনিষ পরিহিত অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন, তাহলে তিনিও সফলকাম হতে পারবেন না। এতে এ কথারই প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ছোট শির্ক কবিরা গুনাহর চেয়েও অধিক মারাত্মক।

৩) শির্কে লিপ্ত ব্যক্তির অজ্ঞতার অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।[9]

৪) রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে রিং বা সূতা পরিধান করার মধ্যে কোন কল্যাণ নেই বরং তাতে অকল্যাণ আছে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর বাণীঃ لا تزيدك إلا وهنا ইহা তোমার দুর্বলতা ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করবেনা।

৫) যে ব্যক্তি উপরোক্ত কাজ করে তার কাজকে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে।

৬) এ কথা সুস্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি রোগ নিরাময়ের জন্য রিং বা সূতা শরীরে লটকাবে তাকে সেই বস্ত্তর দিকেই সোপর্দ করে দেয়া হবে। কেননা সে আললাহর রহমত ও করুণা হতে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সর্বাধিক দুর্বল এবং একেবারেই শক্তিহীন উপকরণের উপর ভরসা করেছে। এর মাধ্যমে সে আল্লাহর সাহায্য, দেখাশুনা ও পরিচর্যা লাভের অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে।

৭) এ কথাও সুস্পষ্ট যে, যে ব্যক্তি রোগ নিরাময়ের উদ্দেশ্যে তাবিজ ব্যবহার করলো সে মূলতঃ শির্ক করল।

৮) জ্বর নিরাময়ের জন্য সূতা পরিধান করাও শির্কের অন্তর্ভুক্ত।

৯) সাহাবী হুযাইফা কর্তৃক কুরআনের আয়াত তেলাওয়াত করা দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, সাহাবায়ে কেরাম শির্কে আসগারের দলীল হিসেবে ঐ আয়াতকেই পেশ করেছেন, যে আয়াতে শির্কে আকবারের কথা রয়েছে। যেমনটি ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু সূরা বাকারার আয়াতের ব্যাখ্যায় উল্লেখ করেছেন।

১০) বদনযর বা চোখ লাগা থেকে আরোগ্য লাভ করার জন্য শামুক, কড়ি, শঙ্খ ইত্যাদি পরিধান করাও শিরকের অন্তর্ভুক্ত।

১১) যে ব্যক্তি তাবিজ ব্যবহার করে, তার উপর বদ দুআ করা হয়েছে, আল্লাহ যেন তার আশা পূরণ না করেন। আর যে ব্যক্তি শামুক, কড়ি বা শঙ্খ লটকায় তাকে যেন আল্লাহ রক্ষা না করেন।

[6] - ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় বর্ণনার সনদ সহীহ। কিন্তু প্রথম বর্ণনাটিতে দুর্বলতা রয়েছে। দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ৪৯২।

[7] - যদি কেউ এই বিশ্বাস পোষণ করে যে, তাবীজ নিজ ক্ষমতায় ভাল-মন্দ সাধন করে তবে তা হবে বড় শির্ক, যার ফলে মানুষ ইসলামের গন্ডি থেকে বেরিয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে যদি এ কথা বিশ্বাস করে যে, মূল ক্ষমতা আল্লাহরই, তবে তাবীজ একটি মাধ্যমে মাত্র, তাহলে তাবীজ ঝুলানো ছোট শির্ক হবে, যা কবীরা গুনাহের পর্যায়ভূক্ত।

[8] - বুখারী, অধ্যায়ঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কর্তৃক ইসলামের দিকে আহবান।

[9] - অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবে কি না- এ ব্যাপারে আলেমদের মতভেদ রয়েছে। আমাদের সম্মানিত শাইখ আল্লামা মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব এবং অন্যান্য কতিপয় আলেমের মতে অজ্ঞতা বশত শির্ক করলে শাস্তি হবে। অন্যান্যদের কথা হচ্ছে অন্যান্য পাপ কাজের ন্যায় অজ্ঞতা বশতঃ শির্কে লিপ্ত হলেও অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবে এবং আল্লাহর শাস্তি থেকে রেহাই পাবে। এ বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে। আমরা সেখানে বলেছি যে, অজ্ঞতা বশতঃ শির্ক কারী যদি এমন সমাজে বসবাস করে, যেখানে আল্লাহর তাওহীদ সম্পর্কে জ্ঞানার্জন সম্ভব ছিল, তাহলে অবশ্যই তারা শাস্তিপ্রাপ্ত হবে, নচেৎ নয়। যারা বলেন অজ্ঞতা বশতঃ শির্ক করলেও অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবে, তারা তাদের মতের পক্ষে নিম্নের দলীলগুলো পেশ করে থাকেন।

১) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَمَا كُنَّا مُعَذِّبِينَ حَتَّى نَبْعَثَ رَسُولًا‘‘কোন রসূল না পাঠানো পর্যন্ত আমি কাউকেই শাস্তি দান করি না’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ১৫) (২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

ذَلِكَ أَنْ لَمْ يَكُنْ رَبُّكَ مُهْلِكَ الْقُرَى بِظُلْمٍ وَأَهْلُهَا غَافِلُونَ

‘‘এটা এ জন্যে যে, তোমার প্রতিপালক কোন জনপদের অধিবাসীদেরকে যুলুমের কারণে ধ্বংস করেন না এমতাবস্থায় যে, তথাকার অধিবাসীরা অজ্ঞ থাকে’’। (সূরা আনআমঃ ১৩১) (৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

رُسُلًا مُبَشِّرِينَ وَمُنْذِرِينَ لِئَلَّا يَكُونَ لِلنَّاسِ عَلَى اللَّهِ حُجَّةٌ بَعْدَ الرُّسُلِ وَكَانَ اللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمًا

‘‘সুসংবাদদাতা ও ভীতি-প্রদর্শনকারী রাসূলগণকে প্রেরণ করেছি, যাতে রাসূলগণের পরে আল্লাহ্‌র প্রতি অপবাদ আরোপ করার মত কোন অবকাশ মানুষের জন্য না থাকে। আল্লাহ্ প্রবল পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান’’। (সূরা নিসাঃ ১৬৫) (৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

كُلَّمَا أُلْقِيَ فِيهَا فَوْجٌ سَأَلَهُمْ خَزَنَتُهَا أَلَمْ يَأْتِكُمْ نَذِيرٌ (8) قَالُوا بَلَى قَدْ جَاءَنَا نَذِيرٌ فَكَذَّبْنَا وَقُلْنَا مَا نَزَّلَ اللَّهُ مِنْ شَيْءٍ

‘‘যখনই তাতে কোন সম্প্রদায় নিক্ষিপ্ত হবে তখন তাদেরকে তার সিপাহীরা জিজ্ঞাসা করবে, তোমাদের কাছে কি কোন সতর্ককারী আগমন করেনি? তারা বলবেঃ হাঁ আমাদের কাছে সতর্ককারী আগমন করেছিল, অতঃপর আমরা মিথ্যারোপ করেছিলাম এবং বলেছিলামঃ আল্লাহ্ কোনো কিছুই নাযিল করেননি’’। (সূরা মূলকঃ ৮-৯) (৫) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

وَجَاءَكُمُ النَّذِيرُ فَذُوقُوا فَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ نَصِيرٍ

‘‘উপরন্তু তোমাদের কাছে সতর্ককারীও আগমন করেছিল। অতএব আস্বাদন কর। জালেমদের জন্যে কোন সাহায্যকারী নেই’’। (সূরা ফাতিরঃ ৩৭) (৬) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

وَمَا كَانَ اللَّهُ لِيُضِلَّ قَوْمًا بَعْدَ إِذْ هَدَاهُمْ حَتَّى يُبَيِّنَ لَهُمْ مَا يَتَّقُونَ إِنَّ اللَّهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

‘‘আর আল্লাহ্ কোন জাতিকে হেদায়েত করার পর পথভ্রষ্ট করেন না- যতক্ষণ না তাদের জন্য পরিষ্কারভাবে বলে দেন সেসব বিষয় যা থেকে তাদের বেঁচে থাকা দরকার। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ সব বিষয়ে অবগত’’। (সূরা তাওবাঃ ১১৫) (৭) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

وَلَوْ أَنَّا أَهْلَكْنَاهُمْ بِعَذَابٍ مِنْ قَبْلِهِ لَقَالُوا رَبَّنَا لَوْلَا أَرْسَلْتَ إِلَيْنَا رَسُولًا فَنَتَّبِعَ آَيَاتِكَ مِنْ قَبْلِ أَنْ نَذِلَّ وَنَخْزَى

‘‘যদি আমি এদেরকে ইতঃপূর্বে কোন শাস্তি দ্বারা ধ্বংস করতাম, তবে এরা বলতঃ হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি আমাদের কাছে একজন রসূল প্রেরণ করলেন না কেন? তাহলে তো আমরা অপমানিত ও হেয় হওয়ার পূর্বেই আপনার নিদর্শনসমূহ মেনে চলতাম’’। (সূরা তোহাঃ ১৩৪) এ ব্যাপারে আরও বহু আয়াত রয়েছে। এগুলো প্রমাণ করে যে, দাওয়াত না পৌঁছিয়ে আল্লাহ তাআলা কাউকে শাস্তি দিবেন না।

এমনি অনেক সহীহ হাদীছও প্রমাণ করে যে, অজ্ঞতা বশত অন্যায় কাজে লিপ্ত হলে অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«إِنَّ رَجُلاً حَضَرَهُ الْمَوْتُ، فَلَمَّا يَئسَ مِنَ الْحَيَاةِ أَوْصَى أَهْلَهُ: إِذَا أَنَا مُتُّ فَاجْمَعُوا لِي حَطَبًا كَثِيرًا وَأَوْقِدُوا فِيهِ نَارًا حَتَّى إِذَا أَكَلَتْ لَحْمِي وَخَلَصَتْ إِلَى عَظْمِي فَامْتُحِشَتْ فَخُذُوهَا، فَاطْحَنُوهَا ثُمَّ انْظُرُوا يَوْمًا رَاحًا فَاذْرُوهُ فِي الْيَمِّ فَفَعَلُوا فَجَمَعَهُ اللَّهُ فَقَالَ لَهُ: لِمَ فَعَلْتَ ذَلِكَ؟ قَالَ مِنْ خَشْيَتِكَ، فَغَفَرَ اللَّهُ لَهُ»

‘‘তোমাদের পূর্ববর্তীদের ভিতরে একজন লোক ছিল। তার জান কবয করার জন্যে মালাকুল মাওত যখন উপস্থিত হলেন তখন তিনি দেখলেন বেঁচে থাকার আর কোন আশা নেই। তখন পরিবারের লোকদেরকে ডেকে বললঃ আমি যখন মৃত্যু বরণ করব তখন তোমরা বেশ কিছু কাঠ সংগ্রহ করে বিরাট একটি অগ্নি প্রজ্বলিত করে আমাকে তাতে নিক্ষেপ করবে। আমার শরীর আগুনে জ্বলে যখন ছাই হয়ে যাবে তখন ছাইগুলোকে ভাল করে পিষবে। অতঃপর তোমরা অপেক্ষা করতে থাকবে। সাগরের ভিতরে যে দিন ঝড় সৃষ্টি হবে এবং প্রচন্ড ঢেউ উঠবে তখন ছাইগুলোকে তাতে নিক্ষেপ করবে। তারা তাই করল। আল্লাহ রাববুল আলামীন তাকে একত্রিত করে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কেন এরকম করেছো? সে বললঃ হে আল্লাহ! আপনার শাস্তির ভয়ে আমি এরকম করেছি। অতঃপর আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিলেন। এই ব্যক্তি অজ্ঞতা বশতঃ ধারণা করেছিল যে, এরূপ করলে সে আল্লাহর শাস্তি হতে রেহাই পেতে পারে।

অজ্ঞতার অযুহাত যে কবুল করা হবে, তার প্রমাণ স্বরূপ এই অধ্যায়ে বর্ণিত হাদীছটিও পেশ করা যেতে পারে। সাহাবীগণ যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর কাছে যাতু আনওয়াত তথা বরকত ওয়ালা গাছএর স্বীকৃতি দিতে বললেন, তখন তিনি তাদেরকে মুরতাদ মনে করে পুনরায় কালেমা পাঠ করতে বলেন নি। বরং তিনি তাদেরকে অজ্ঞ মনে করেছেন এবং অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণ করেছেন বলেই সাহাবীদের তাওবার আদেশ দেন নি। (আল্লাহই অধিক অবগত রয়েছেন)
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে