আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا
‘‘এ সব লোক যাদেরকে ডাকে তারা নিজেরাই তাদের রবের নৈকট্য লাভের আশায় উসীলা অনুসন্ধান করে, তাদের মধ্য হতে কে সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী? তারা তার রহমতের আশা করে এবং তার শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তার শাস্তি ভয়াবহ’’। (সূরা ইসরাঃ ৫৭)
ব্যাখ্যাঃ কালেমা তায়্যেবার অর্থই হচ্ছে তাওহীদ বা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা। এই অধ্যায়ে বর্ণিত আয়াত ও হাদীছগুলো থেকেই এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে ইনশা-আল্লাহ্। কেননা এগুলোতে রয়েছে তাওহীদের বিশদ বর্ণনা ও খোলাখুলি আলোচনা। যেসব মূর্খ লোক ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর অর্থ বুঝতে গিয়ে ভুল করেছে, এতে তাদের উপর হুজ্জত কায়েম করা হয়েছে।
এসব লোক যাদেরকে ডাকে তারা নিজেরাই তাদের রবের নৈকট্য লাভের আশায় উসীলা অনুসন্ধান করে যে, তাদের কে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তীঃ অর্থাৎ মুশরিকরা যে সমস্ত ফেরেশতা, নবী-রাসূল এবং অলী-আওলীয়াদেরকে আহবান করে, তারা তাদের অকল্যাণ ও বিপদাপদ দূর করার কোনো ক্ষমতা রাখেনা। যেমন তারা ঈসা, তাঁর মা মারইয়াম এবং উযাইরকে আহবান করে থাকে। অথচ এদের সকলের দ্বীন ছিল তাওহীদ। যারা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে তাদেরকে আহবান করে তাদের দ্বীন তাওহীদের বিপরীত। আল্লাহ্ তাআলা তাদের ব্যাপারে বলেনঃ
يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ
‘‘তারা নিজেরাই তাদের রবের নৈকট্য লাভের আশায় উসীলা অনুসন্ধান করে। তাদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী’’।[1] অর্থাৎ যাদেরকে মুশরিকরা আহবান করছে, তারা নিজেরাই তো ইখলাসের সাথে আমল করা, আল্লাহর আদেশ সমূহ মেনে চলা এবং নিষেধসমূহ বর্জন করার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় অন্বেষণ করে।
আল্লাহ্ তাআলা যে তাওহীদসহ নবী-রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন, যার প্রতি আমল করা ফরয করেছেন এবং যার দিকে আহবান করা আবশ্যক করেছেন, সেই তাওহীদ বাস্তবায়ন করাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। এ তাওহীদই তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করবে অর্থাৎ তাঁর ক্ষমা ও সন্তুষ্টির নিকটবর্তী করে দিবে। আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে বলেনঃ
وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ
‘‘তারা তার রহমতের আশা করে এবং তার শাস্তিকে ভয় করে’’। সুতরাং তারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারও কাছে আশা করেনা এবং তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করেনা। এটিই হচ্ছে তাওহীদ। এ তাওহীদ ও ঈমান তাদেরকে শির্ক থেকে বাঁচাবে এবং তাদের মনে আল্লাহর রহমত পাওয়ার আকাঙ্খা জাগাবে ও তাদের অন্তরে তাঁর শাস্তির ভয় প্রবিষ্ট করবে। কিন্তু এ ব্যাপারটি এখন উল্টা হয়ে গেছে। আল্লাহ্ তাআলাকে বাদ দিয়ে তারা যে সমস্ত নবী-রাসূল ও অলী-আওলীয়াদেরকে আহবান করছে এবং তাদের কাছে তারা ঐ সমস্ত জিনিষ প্রার্থনা করছে, যা করতে আল্লাহ্ তাআলা নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ পূর্বযুগের মুশরিকরা দুআর মধ্যে আল্লাহ্ তাআলা ব্যতীত অন্যান্য যাদেরকে আহবান করত, নবী-রাসূলগণ তার প্রতিবাদ করতেন। এর মধ্যেই আল্লাহ্ তাআলার নিম্নের বাণীর অর্থ রয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ ‘‘কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শির্ক অস্বীকার করবে’’। (সূরা ফাতিরঃ ১৪) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوا لَهُمْ أَعْدَاء وَكَانُوا بِعِبَادَتِهِمْ كَافِرِينَ
‘‘যখন মানুষকে হাশরে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রু হবে এবং তাদের এবাদত অস্বীকার করবে’’। (সূরা আহকাফঃ ৬)
এতে ঐ সব লোকের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা দাবী করে, শুধু মূর্তিপূজাকেই শির্ক বলা হয়। অর্থাৎ শুধু মূর্তিপূজার মাধ্যমেই শির্ক হয়ে থাকে। এই আয়াতের মাধ্যমে সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, আল্লাহ্ তাআলা ঐ সমস্ত লোকের প্রতিবাদ করেছেন, যারা আল্লাহর সাথে নবী-রাসূল, অলী-আওলীয়া, ফেরেশতা এবং অন্যান্যদেরকে আহবান করে। অথচ কল্যাণ অর্জন কিংবা অকল্যাণ দূর করার জন্য মৃত এবং অলীদের আহবান করা বড় শির্কের অন্তর্ভূক্ত, যা আল্লাহ্ তাআলা ক্ষমা করেন না।[2] এ রকম করা কালেমা তায়্যেবার মর্মার্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
প্রিয় পাঠক! আপনি উপরে বর্ণিত মহান আয়াতটি নিয়ে চিন্তা করুন। তাহলেই আপনার কাছে তাওহীদ এবং তার বিপরীত বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। কেননা এই আয়াতটি ঐ সমস্ত লোকের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যারা ফেরেশতা, ঈসা (আঃ), তাঁর মা মারইয়াম এবং উযাইরের এবাদত করত। আল্লাহ্ তাআলার নিম্নের বাণীতে এরাই উদ্দেশ্য। আল্লাহ্ তাআলা সূরা ইসরার ৫৬ নং আয়াতে বলেনঃ
قُلِ ادْعُواْ الَّذِينَ زَعَمْتُم مِّن دُونِهِ فَلاَ يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّ عَنكُمْ وَلاَ تَحْوِيلاً
‘‘বলোঃ আল্লাহ্ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা উপাস্য মনে কর, তারা তো তোমাদের কষ্ট দূর করার ক্ষমতা রাখেনা এবং তা পরিবর্তনও করতে পারেনা’’। এসব মুশরিক যাদেরকে আহবান করছে, তারা তাদের দ্বীনের বিপরীত কাজ করছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
أُولَـئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ
‘‘যাদেরকে তারা আহবান করে, তারা নিজেরাই তো তাদের পালনকর্তার নৈকট্য লাভের জন্য মধ্যস্থতা তালাশ করে যে, তাদের মধ্যে কে অধিক নৈকট্যশীল’’। (সূরা ইসরাঃ ৫৭) অর্থাৎ তারা যাদেরকে আহবান করছে, তারা শুধু তাদের রবের নৈকট্য হাসিল করার জন্যই উসীলা তালাশ করে, অন্যের নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করেনা। আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্ববৃহৎ মাধ্যম হচ্ছে আল্লাহর তাওহীদ। এই তাওহীদ দিয়েই আল্লাহ্ তাআলা নবী ও রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন এবং এর জন্যই জিন ও ইনসান সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম উসীলা হচ্ছে আল্লাহর অতিসুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করা। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَلِلّهِ الأَسْمَاء الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا
‘‘আর আল্লাহ্র জন্য রয়েছে অতিসুন্দর নামসমূহ। কাজেই সে নামগুলো ধরেই তাঁকে ডাকো’’। (সূরা আরাফঃ ১৮০) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত দুআগুলোর মধ্যে আল্লাহ্ তাআলার অতিসুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর উসীলা দিয়ে দুআ করার কথা বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দুআয় বলেছেনঃ
«اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ بِأَنَّ لَكَ الْحَمْدَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ الْمَنَّانُ بَدِيعُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالإِكْرَامِ»
‘‘হে আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে এ উসীলায় প্রার্থনা করছি যে, তোমার জন্যই সমস্ত প্রশংসা। তুমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই। তুমি অত্যন্ত দয়াশীল। তুমি পূর্বের কোনো নমুনা ছাড়াই আসমান ও যমীনের সৃষ্টা। হে মহা সম্মানিত এবং সম্মান ও ইজ্জত দানকারী! তুমি আমার প্রার্থনা শ্রবণ করো।[3] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুআয় আরো বলতেনঃ
«اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ بِأَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ الأَحَدُ الصَّمَدُ الَّذِى لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ»
‘‘হে আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে এ উসীলায় প্রার্থনা করছি যে, তুমিই আল্লাহ্। তুমি ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই। তুমি একক, অমূখাপেক্ষী, তুমি কাউকে জন্ম দাও নি। তুমি কারো জাত নও এবং তোমার সমকক্ষ কেউ নেই’’।[4] এ ছাড়া অন্যান্য সৎ আমলের উসীলা দিয়েও আল্লাহ্ তাআলার কাছে চাওয়া ও প্রার্থনা করা জায়েয আছে। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলার পছন্দনীয় ও সস্ত্তষজনক আমল দ্বারা উসীলা দিতে হবে, অপছন্দনীয় আমল দ্বারা নয়। এমনিভাবে যে শির্ক থেকে তিনি নিজেকে পবিত্র বলে ঘোষণা করেছেন, তা দিয়েও উসীলা দেয়া জায়েয নয়। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ ‘‘তারা যাকে শরীক করে, আল্লাহ্ তা থেকে পবিত্র’’। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃوَسُبْحَانَ اللّهِ وَمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘‘আল্লাহ্ পবিত্র। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’’। (সূরা ইউসুফঃ ১০৮) যারা নিজেদের জন্য সুপারিশকারী নির্ধারণ করেছে, আল্লাহ্ তাআলা তাদের প্রতিবাদে বলেনঃ
قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللّهَ بِمَا لاَ يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلاَ فِي الأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘তুমি বলোঃ তোমরা কি আল্লাহ্কে এমন বিষয়ে অবহিত করছ, যা তিনি অবহিত নন আসমান ও যমীনে? তিনি পবিত্র ও মহান সে সমস্ত বস্ত্ত থেকে, যেগুলোকে তারা শরীক করছে’’। (সূরা ইউনূসঃ ১৮) কুরআনুল কারীমে এই ধরণের আয়াত আরো অনেক রয়েছে। এগুলো ইখলাসের সাথে আল্লাহর এবাদতের আহবান জানায় এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের এবাদত করতে নিষেধ করে এবং শির্কে লিপ্ত ব্যক্তিদের ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা দেয়। যেমন আল্লাহ্ তাআলা রাসূলদেরকে, তাদের আনিত তাওহীদের দাওয়াতকে এবং শির্ক থেকে নিষেধের ঘোষণাকে মিথ্যায়ন করার কারণে অতীতের জাতিসমূহকে শাস্তি দিয়েছেন। কেননা তারা নবী-রাসূলদের দাওয়াত কবুল করেনি। এ জন্য আল্লাহ্ তাআলা তাদেরকে শাস্তি দিয়েছেন। নূহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় আদ জাতি, ছামুদ জাতি এবং অন্যান্য জাতির লোকেরা রাসূলদের দাওয়াতের বিরোধীতা করার কারণে এবং আল্লাহর সাথে শির্ক করার কারণে ধ্বংস হয়েছে। ‘নূহ’ (আঃ)এর জাতির লোকেরা বলেছিল,
وَمَا نَرَاكَ اتَّبَعَكَ إِلاَّ الَّذِينَ هُمْ أَرَاذِلُنَا بَادِيَ الرَّأْيِ
‘‘আর আমাদের মধ্যে যারা ইতর ও স্থুল-বুদ্ধিসম্পন্ন তারা ব্যতীত কাউকে তোমার আনুগত্য করতে দেখছিনা’’। (সূরা হুদঃ ২৭) হুদ আলাইহিস সালামের জাতির লোকেরা বলেছিল,
يَا هُودُ مَا جِئْتَنَا بِبَيِّنَةٍ وَمَا نَحْنُ بِتَارِكِي آلِهَتِنَا عَن قَوْلِكَ وَمَا نَحْنُ لَكَ بِمُؤْمِنِينَ
‘‘হে হুদ! তুমি আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নিয়ে আস নাই, আমরা তোমার কথায় আমাদের দেব-দেবীদের বর্জন করতে পারিনা। আর আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনয়নকারীও নই’’। (সূরা হুদঃ ৫৩) শুআইব আলাইহিস সালামের জাতির লোকেরা বলেছিল,
يَا شُعَيْبُ أَصَلاتُكَ تَأْمُرُكَ أَنْ نَتْرُكَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا
‘‘হে শুয়ায়েব! তোমার নামায কি তোমাকে এ শিক্ষা দেয় যে, আমরা ঐ সব উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করবো, যাদের উপাসনা করত আমাদের বাপ-দাদারা? (সূরা হুদঃ ৮৭)
সুতরাং হে পাঠক! নবী-রাসূলগণ যে বিষয়ের দাওয়াত দিয়েছেন, আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় কিতাবে তার বিবরণ দিয়েছেন এবং যারা নবী-রাসূলদের দাওয়াতের বিরোধীতা করেছে, তাদের শাস্তিরও বিবরণ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক মুশরিকের উপর দলীল কায়েম করেছেন।
বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে উক্ত আয়াতের তাফসীর বর্ণিত হয়েছে যে, একদল মানুষ জিনদের এবাদত করত। অতঃপর জিনেরা ইসলাম গ্রহণ করল। কিন্তু মানুষেরা জিনদের এবাদত করতেই থাকল। অর্থাৎ শির্ক ও কুফরের উপর অটল থাকল।
ব্যাখ্যাকার বলেনঃ আমি বলছি, পূর্বোক্ত ব্যাখ্যা এবং এই ব্যাখ্যার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অলী-আওলীয়া বা অন্য কাউকে আহবান করবে, তার বিরুদ্ধে এই আয়াতটি দলীল হয়ে থাকবে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত প্রত্যেকটি কথাই সত্য। কেননা যাদের মাবুদ হবে আল্লাহর কোনো বান্দা তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই আয়াতটি প্রযোজ্য। চাই সে মাবুদ ফেরেশতাদের অন্তর্ভূক্ত হোক কিংবা কোনো জিন হোক অথবা বনী আদমের অন্য কেউ হোক।
আল্লাহ্ তাআলার বাণীঃ
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاء مِّمَّا تَعْبُدُونَ إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِهِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
‘‘স্মরণ করো সে সময়ের কথা, যখন ইবরাহীম তাঁর পিতা ও গোত্রের লোকদেরকে বলেছিলেন, তোমরা যার এবাদত কর তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার সম্পর্ক কেবল তাঁরই সাথেই, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। এ কালেমাটিকে তিনি অক্ষয় বাণীরূপে তার সন্তানদের মধ্যে রেখে গেছেন, যাতে তারা এ দিকেই ফিরে আসে’’। (সূরা যুখরুফঃ ২৬-২৮)
ব্যাখ্যাঃ আলেমদের ঐক্যমতে এখানে কালেমা বলতে কালেমায়ে তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ উদ্দেশ্য।[5] কালেমাটি দ্বারা যা উদ্দেশ্যে করা হয়েছে ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম এখানে তাই তুলে ধরেছেন।
إِنَّنِي بَرَاء مِّمَّا تَعْبُدُونَ ‘‘তোমরা যার এবাদত করো তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই’’-এর দ্বারা কালেমার প্রথমাংশ উদ্দেশ্য। আর إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي ‘‘আর আমার সম্পর্ক কেবল মাত্র তাঁর সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন’’- এর দ্বারা কালেমার দ্বিতীয় অংশ ‘ইল্লাল্লাহ্’ উদ্দেশ্য। মোট কথা তিনি এবাদতকে শুধু আল্লাহর জন্যই খাস করেছেন, আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য বস্ত্তর এবাদতকে অস্বীকার করেছেন এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য বস্ত্তর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এটি কালেমা তায়্যেবার কতই না সুন্দর ব্যাখ্যা!
আর উসীলার সাধারণ অর্থ হচ্ছে এমন সৎ আমল, যা দ্বারা আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করা যায়। সেই সাথে উসীলা জান্নাতের এমন একটি স্তরের নাম, যা আল্লাহর বান্দাদের থেকে কেবল একজনই অর্জন করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশা পোষণ করেছেন যে, আল্লাহর ইচ্ছায় কিয়ামতের দিন এটি তাঁর জন্য হবে। আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করি, তিনি যেন তাঁকে উহা দান করেন।
[2] - আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ করা যে শির্ক এবং আল্লাহ ব্যতীত যাদের কাছে দুআ করা হয় তারা যে দুআকারীর কোন উপকার করার ক্ষমতা রাখেনা, এব্যাপারে কুরআন ও হাদীছে অনেক দলীল রয়েছে। নিম্নে কতিপয় আয়াত উল্লেখ করা হল।
১) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لَا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوا لَهُمْ أَعْدَاءً وَكَانُوا بِعِبَادَتِهِمْ كَافِرِينَ
‘‘তার চেয়ে অধিক ভ্রান্ত আর কে হতে পারে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ছাড়া এমন কাউকে ডাকে, যে কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিতে পারবে না। তারা তো তাদের দুআ সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর। যখন মানুষকে হাশরে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রুতে পরিণত হবে এবং তাদের এবাদত অস্বীকার করবে ’’। (সূরা আহকাফঃ ৫-৬)
২) আল্লাহ তাআলা সূরা রা'দের ১৪ নং আয়াতে বলেনঃ
وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ لَا يَسْتَجِيبُونَ لَهُمْ بِشَيْءٍ إِلَّا كَبَاسِطِ كَفَّيْهِ إِلَى الْمَاءِ لِيَبْلُغَ فَاهُ وَمَا هُوَ بِبَالِغِهِ وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ
‘‘এবং তাকে ছাড়া যাদেরকে ডাকে, তারা তাদের কোন কাজে আসে না। ওদের দৃষ্টান্ত সেরূপ, যেমন কেউ দু’হাত পানির দিকে প্রসারিত করে যাতে পানি তার মুখে পৌছে যায়। অথচ পানি কোন সময় পৌঁছাবেনা। কাফেরদের সব আহবানই পথভ্রষ্টতা’’।
(৩) আল্লাহ তাআলা সূরা যুমারের ৩৮ নং আয়াতে আরো বলেনঃ
قُلْ أَفَرَأَيْتُم مَّا تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ ۚ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ
‘‘হে নবী! এদেরকে বলোঃ আচ্ছা তোমরা আমাকে সংবাদ দাও তো, আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে আহবান করছো, আল্লাহ যদি আমার ক্ষতি করতে চান তাহলে তারা কি তাঁর ক্ষতির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারবে? কিংবা আল্লাহ যদি আমাকে রহমত দান করতে চান তাহলে এরা কি তাঁর রহমত ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? তাদের বলে দাও, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট৷ ভরসাকারীরা তারই উপর ভরসা করে’’৷
৪) আল্লাহ তাআলা সূরা আনআমের ১৭ নং আয়াতে বলেনঃ
وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
‘‘আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোন কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী কেউ নাই। পক্ষান্তরে যদি তোমার মঙ্গল করেন, তবে তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’’। এই অর্থে আরো অনেক আয়াত রয়েছে।
[3] - তিরমিজী, অধ্যায়ঃ দুআ। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুনঃ সহীহুত তিরমিযী, হাদীছ নং- ২৮০৯।
[4] - আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ দুআ। ইমাম আলবানী (রঃ) এই হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুনঃ সহীহ ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং- ৩১১১।
[5] - এটিই ছিল সকল নবী-রাসূলের রেসালাত। কতিপয় আলেম বলেনঃ ইবরাহীম (আঃ)এর পর যত নবী আগমণ করেছেন, ঈসা (আঃ) ব্যতীত বাকীদের সকলেই ছিলেন তাঁর বংশধর থেকে। ইহা জানা কথা যে, ঈসা (আঃ) পিতা ছাড়াই জন্ম গ্রহণ করেছেন। তাতে কিছু যায় আসেনা। সকল নবী-রাসূলই কালেমা তায়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ নিয়ে এসেছেন।
হাফেয ইবনে কাছীর (রঃ) وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِهِ ‘‘এ কালেমাটিকে তিনি অমর বাণীরূপে তার সন্তানদের মাঝে রেখে গেছেন’’,- এর ব্যাখ্যায় বলেনঃ এটি হচ্ছে কালেমায়ে তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’। এর অর্থ হচ্ছে, এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা, তাঁর কোনো শরীক নেই এবং মূর্তিপূজা বর্জন করা। পবিত্র কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’কে ইবরাহীম (আঃ) স্বীয় বংশধরের মধ্যে চালু করেছেন। তাঁর বংশ থেকে যাদেরকে আল্লাহ্ তাআলা হেদায়াত দান করবেন, তারা এই কালেমার দিকে ফিরে আসবে এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল করবে।
ইকরিমা, মুজাহিদ, যাহ্হাক, সুদ্দী এবং অন্যান্য মুফাসসিরগণ وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِهِ -এর ব্যাখ্যায় বলেনঃ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’। ইবরাহীম আলাইহিস সালামের বংশধরদের মধ্যে সবসময় এমন লোক থাকবে, যারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ পাঠ করবে এবং এর দাবি অনুযায়ী আমল করবে।
আল্লাহ তাআলা অন্য আয়াতে বলেনঃ
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ
‘‘তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের আলেম ও দরবেশ লোকদেরকে নিজেদের রব বানিয়ে নিয়েছে’’। (সূরা তাওবাঃ ৩১)
ব্যাখ্যাঃ এখানে আহবার দ্বারা আলেম উদ্দেশ্য এবং রুহবান দ্বারা এবাদতকারী উদ্দেশ্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদী বিন হাতিমের জন্য এ আয়াতের ব্যাখ্যা করেছেন। আদি বিন হাতিম যখন মুসলিম হয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আগমণ করলেন, তখন তিনি আদীকে কুরআনের এই আয়াতটি পাঠ করে শুনালেন। আদী বিন হাতিম রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! তারা তো তাদের এবাদত করেনা। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ, তারা তাদের এবাদতই করে। কেননা আহলে কিতাবদের আলেমরা যখন তাদের জন্য কোনো হালাল বস্ত্তকে হারাম করে এবং হারামকে হালাল করে, তখন তারা তাতে আলেমদের অনুসরণ করে। আর এটিই হচ্ছে তাদের এবাদত।[6]
ইমাম সুদ্দী (রঃ) বলেনঃ আল্লাহর কিতাবকে পিছনে ফেলে দিয়ে তারা মানুষদের কাছ থেকে নসীহত অনুসন্ধান করেছিল। এ জন্যই আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُواْ إِلاَّ لِيَعْبُدُواْ إِلَـهاً وَاحِداً لاَّ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘তারা আল্লাহকে পরিহার করে তাদের পন্ডিত ও পুরোহিতদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে। এবং মারইয়ামের পুত্র মসীহকেও। অথচ তাদেরকে শুধু এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তোমরা শুধু এক মাবুদের এবাদত করবে। তিনি ছাড়া আর কোনো সত্য মাবুদ নেই। তিনি তাদের অংশী স্থির করা থেকে পবিত্র’’। (সূরা তাওবাঃ ৩১) সুতরাং বৈরাগীদের অনুসরণ করা তাদের এবাদতে পরিণত হয়েছে। আর তারাই আল্লাহ্ ব্যতীত অনুসারীদের মাবুদে পরিণত হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَلاَ يَأْمُرَكُمْ أَن تَتَّخِذُواْ الْمَلاَئِكَةَ وَالنِّبِيِّيْنَ أَرْبَاباً أَيَأْمُرُكُم بِالْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنتُم مُّسْلِمُونَ
‘‘তা ছাড়া তোমাদেরকে এ কথা বলাও সম্ভব নয় যে, তোমরা ফেরেশতা ও নবীগণকে নিজেদের প্রতিপালক সাব্যস্ত করে নাও। তোমাদের মুসলিম হবার পর তারা কি তোমাদেরকে কুফরীর আদেশ করবে? (সূরা আল-ইমরানঃ ৮০) তারা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে ঈসা ইবনে মারইয়ামকেও মাবুদ হিসাবে গ্রহণ করেছিল এবং আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে তাঁর এবাদত করেছিল। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَإِذْ قَالَ اللَّهُ يَا عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ أَأَنْتَ قُلْتَ لِلنَّاسِ اتَّخِذُونِي وَأُمِّيَ إِلَهَيْنِ مِنْ دُونِ اللَّهِ قَالَ سُبْحَانَكَ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أَقُولَ مَا لَيْسَ لِي بِحَقٍّ إِنْ كُنْتُ قُلْتُهُ فَقَدْ عَلِمْتَهُ تَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِي وَلَا أَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِكَ إِنَّكَ أَنْتَ عَلَّامُ الْغُيُوبِ (116) مَا قُلْتُ لَهُمْ إِلَّا مَا أَمَرْتَنِي بِهِ أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ رَبِّي وَرَبَّكُمْ وَكُنْتُ عَلَيْهِمْ شَهِيدًا مَا دُمْتُ فِيهِمْ فَلَمَّا تَوَفَّيْتَنِي كُنْتَ أَنْتَ الرَّقِيبَ عَلَيْهِمْ وَأَنْتَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ شَهِيدٌ
‘‘যখন আল্লাহ্ বলবেনঃ হে ঈসা ইবনে মারইয়াম! তুমি কি লোকদেরকে বলেছিলে, আল্লাহ্কে ছেড়ে আমাকে ও আমার মাকে উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করো? ঈসা বলবেনঃ আপনি পবিত্র। আমার জন্য শোভা পায়না যে, আমি এমন কথা বলি, যা বলার কোনো অধিকার আমার নেই। আমি যদিবলে থাকি, তবে তুমি অবশ্যই অবগত আছো; তুমি তো আমার নফ্সের কথাও জান এবং আমি জানিনা যা তোমার নফ্সের মধ্যে রয়েছে। নিশ্চয়ই তুমি অদৃশ্য বিষয়ে জ্ঞাত। যা তুমি বলতে আদেশ করেছিলে আমি তো তাদেরকে সে কথা ছাড়া আর কিছুই বলিনি। তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করো, যিনি আমার ও তোমাদের প্রতিপালক। আমি তাদের সম্পর্কে অবগত ছিলাম যতদিন তাদের মধ্যে ছিলাম। অতঃপর তুমি যখন আমাকে লোকান্তরিত করলে, তখন থেকে তুমিই তাদের সম্পর্কে অবগত রয়েছো। তুমি সর্ববিষয়ে পূর্ণ পরিজ্ঞাত। (সূরা মায়িদাঃ ১১৬-১১৭)
সুতরাং যে ব্যক্তি এই আয়াতগুলো নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করবে, সে অবশ্যই ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর অর্থ বুঝতে সক্ষম হবে এবং আল্লাহর তাওহীদ তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে, যা উম্মতের পরবর্তী যামানার ইল্মের দাবীদার অধিকাংশ লোক কবুল করে নিতে অস্বীকার করেছে। সম্মানিত তিন যুগের পর কালেমায়ে তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। যখন আহলে বাইত এবং অন্যান্যদের কবরগুলো নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু হল, এগুলোর উপর মসজিদ নির্মিত হল, মাজার নির্মিত হল, তখন বিষয়টি আরও ব্যাপকতা লাভ করল। মৃতদেরকে নিয়ে যখন বাড়াবাড়ি শুরু হল এবং তাদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন যখন এবাদত পর্যন্ত নিয়ে গেল, তখনই শির্কের ফিতনা ভয়াবহ আকার ধারণ করল। এ শির্ক ও কুসংস্কারের মধ্যে অধিকাংশ লোক লিপ্ত হওয়ার কারণে তাওহীদ শির্কে এবং শির্ক তাওহীদে পরিণত হয়েছে। সুন্নাত বিদআতে এবং বিদআত সুন্নাতে পরিণত হয়েছে। এ অবস্থার উপরই ছোটরা বড় হয়েছে এবং যুবকরা বৃদ্ধ হয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
«بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ الَّذِينَ يُصْلِحُونَ إِذَا فَسَدَ النَّاسُ»
‘‘অপরিচিত অবস্থায় অল্প কয়েকজন লোকের মাধ্যমে ইসলামের সূচনা হয়েছে। অচিরেই পুনরায় অপরিচিত অবস্থায় ফেরত যাবে। সুতরাং এই অপরিচিত অল্প সংখ্যক লোকের জন্যই সুসংবাদ। লোকেরা যখন খারাপ পথে চলবে, তখন তারা কল্যাণের পথে চলবে। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, মানুষেরা যা নষ্ট করবে, তারা তা সংশোধন করবে।[7]
আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ
‘‘মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে আল্লাহর সমতুল্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাদেরকে এমন ভালবাসে যেমন আল্লাহকে ভালবাসা উচিৎ’’। (সূরা বাকারাঃ ১৬৫)
ব্যাখ্যাঃ হাফেয ইবনে কাছীর (রঃ) এবং অন্যান্য মুফাস্সিরগণ أنداد এর ব্যাখ্যায় বলেনঃ কিছু লোক আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য বস্ত্তকে আল্লাহর অনুরূপ ও সমকক্ষ বানায়। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও কাছে কিছু আশা করল এবং তাকে ভয় করে তার জন্য কোনো প্রকার এবাদত পেশ করল, সে তাকে আল্লাহর শরীক বানিয়ে নিল। কেননা সে আল্লাহর সাথে তাঁর এবাদতে এমন কিছুকে শরীক করে, যারা এবাদতের হকদার নয়।
আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রঃ) বলেনঃ আল্লাহর প্রতি প্রকৃত ভালবাসা পোষণকারীর তাওহীদ হচ্ছে, সে একাধিক ব্যক্তি ও বস্ত্তকে স্বীয় মাহবুব বা প্রিয় বানাবেনা। অর্থাৎ আল্লাহর সাথে অন্যের এবাদত করে আল্লাহর সাথে অন্যান্য বস্ত্তকে নিজের বন্ধু বানাবেনা। একমাত্র আল্লাহ্কে ভালাবাসার অর্থ হচ্ছে ভক্তের অন্তরে আল্লাহর ভালোবাসা ছাড়া অন্যের জন্য সামান্য ভালবাসাও অবশিষ্ট থাকবেনা, যা সে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের জন্য ব্যয় করতে পারে। এই ভালবাসাকে ইশক[8] (প্রেম-প্রীতি) হিসাবে নামকরণ করা হলেও এতেই রয়েছে বান্দার কল্যাণ, নেয়ামত এবং তার চোখের শীতলতা। বান্দার অন্তরের পরিশুদ্ধি ও কল্যাণ ইহাই যে, তার অন্তরে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসাই অন্যান্য সকল বস্ত্ত হতে অধিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকবে এবং আল্লাহর ভালবাসার মধ্যে অন্য কারো বিন্দু মাত্র অংশও থাকবেনা। সে শুধু আল্লাহ্কেই ভালবাসবে। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হয়েছে,
ثَلاثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ حَلاوَةَ الإِيمَانِ: أَنْ يَكُونَ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا، وَأَنْ يُحِبَّ الْمَرْءَ لا يُحِبُّهُ إِلا لِلَّهِ، وَأَنْ يَكْرَهَ أَنْ يَعُودَ فِي الْكُفْرِ كَمَا يَكْرَهُ أَنْ يُقْذَفَ فِي النَّارِ
‘‘তিনটি গুণ যার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে সে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ অনুভব করতে পারবে। (১) যার মধ্যে আল্লাহ এবং রাসূলের ভালবাসা অন্যান্য সকল বস্ত্ত হতে অধিক পরিমাণে বিদ্যমান থাকবে। (২) যে ব্যক্তি কোন মানুষকে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ভালবাসে। (৩) যে ব্যক্তি ঈমান গ্রহণের পর কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে তেমনই অপছন্দ করে, যেমন অপছন্দ করে অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে।[9] রাসূলের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করা মূলতঃ আল্লাহ্ তাআলার ভালোবাসারই অংশ। কোনো মানুষ যখন আল্লাহর জন্য কাউকে ভালবাসে, তখন তার সে ভালোবাসা আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা পোষণের প্রমাণ। আর যে লোক আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশ্যে কাউকে ভালোবাসে, তার সে ভালবাসা আল্লাহর প্রতি তার ভালবাসাকে কমিয়ে দেয় এবং তাকে দুর্বল করে ফেলে। আল্লাহর প্রতি বান্দার ভালবাসার সত্যতা প্রমাণিত হবে তখনই, যখন সে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক অপছন্দনীয় বস্ত্ত তথা কুফরীকে সে রকমই অপছন্দ করবে, যেমন অপছন্দ করে অগ্নিতে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে কিংবা তার চেয়ে অধিক অপছন্দ করে। কোন সন্দেহ নেই যে, এটি একটি বিরাট ভালবাসা। কেননা মানুষ সাধারণত নিজের নফসের ভালোবাসার উপর অন্য বস্ত্তকে প্রাধান্য দেয়না। তাই যখন সে ঈমানের ভালোবাসাকে নিজের নফ্সের উপর প্রাধান্য দিবে, এমন কি কুফরীতে লিপ্ত হওয়া অথবা আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়া- এ দু’টির যে কোন একটিতে পতিত হওয়ার উপর তাকে বাধ্য করা হলে কুফুরীর বদলে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকেই অগ্রাধিকার দিবে, তখন নিশ্চিত জানা যাবে যে, আল্লাহর পবিত্র সত্তা তার কাছে নিজের জানের চেয়েও অধিক প্রিয়।
আশেক-মাশুকের মধ্যে যে পারস্পরিক ভালবাসা ও প্রেম-প্রীতি তৈরী হয়, তার চেয়ে আল্লাহর সাথে বান্দার ভালবাসার স্তর অনেক উর্ধ্বে। এক কথায় এ ভালবাসার কোন নযীর নেই এবং এর কোন তুলনা হয়না। এই ভালবাসার দাবী হল মাহবুবকে (আল্লাহ্কে) নিজের নফ্স, মাল এবং সন্তানদের উপর প্রাধান্য দিবে এবং আল্লাহর জন্য সম্পূর্ণরূপে অবনত হবে, তাঁর সামনে বিনয়ী হবে, আল্লাহ্কে পূর্ণ সম্মান প্রদর্শন করবে এবং প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে আল্লাহর আনুগত্য ও এবাদত করবে। মানুষের পারস্পরিক ভালবাসার মধ্যে এর কোন নযীর খুঁজে পাওয়া যাবেনা। সে মানুষ যত বড়ই হোক না কেন। এ জন্যই যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য খাস ভালবাসার মধ্যে আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে অংশীদার করবে, তার সে কাজ শির্কে পরিণত হবে, যা আল্লাহ্ তাআলা ক্ষমা করবেন না। আল্লাহ্ তাআলা সূরা বাকারার ১৬৫ নং আয়াতে বলেনঃ
وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ
‘‘মানুষের মধ্যে এমন লোকও আছে যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যদেরকে আল্লাহর সমতুল্য হিসেবে গ্রহণ করে এবং তাদেরকে এমন ভালবাসে যেমন আল্লাহকে ভালবাসা উচিৎ। কিন্তু যারা আল্লাহ্র প্রতি ঈমান এনেছে তাদের ভালবাসা ওদের তুলনায় বহুগুণ বেশী’’। এই আয়াতের সঠিক অর্থ হচ্ছে, মুশরিকরা তাদের মাবুদদেরকে যেমন ভালবাসে, ঈমানদারগণ আল্লাহ্ তাআলাকে তাদের চেয়ে অধিক ভালবাসে। একটু পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, মুমিনগণ আল্লাহর প্রতি যে ভালবাসা পোষণ করেন, মানুষের পারস্পরিক ভালবাসা তদ্রুপ হতে পারেনা। তাদের নিকট আল্লাহর মত অন্য কেউ হতেই পারে না। প্রত্যেক ঐ কষ্ট, যা আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের প্রতি ভালবাসা পোষণ করতে গিয়ে বরদাশত করতে হয়, আল্লাহ্কে ভালবাসতে গিয়ে সে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করলে তা নেয়ামতে পরিণত হয় এবং প্রত্যেক ঐ নির্যাতন, যা আল্লাহ্ ছাড়া অন্যকে ভালবাসতে গিয়ে সহ্য করা হয়, আল্লাহ্কে ভালবাসতে গিয়ে সে নির্যাতন সহ্য করলে তা ভালবাসা পোষণকারীর চোখের শীতলতায় পরিণত হয়। ইমাম মুজাহিদ থেকে এ কথা বর্ণিত হয়েছে।
আল্লামা ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রঃ) তাঁর অন্যতম কিতাব ‘আলকাফীয়ায়’ বলেনঃ দু’টি জিনিষের মধ্যে বান্দার অন্তরের জীবন। যাকে এ দু’টি জিনিষ প্রদান করা হয়েছে, সে দীর্ঘকাল পর্যন্ত জীবিত থাকবে। আল্লাহ তাআলার সাথে কোন কিছুকে শরীক করা ব্যতীত তাঁর স্মরণ করা এবং তাঁকে ভালবাসা। ডানাহীন পাখীর পক্ষে যেমন উড়াল দেয়া সম্ভব নয়, তেমনি যারা আল্লাহর সিফাতকে অস্বীকার করে, তারা এ দু’টি নেয়ামত থেকে মাহরুম হবে।
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ)এর এক উক্তির মূল তাৎপর্য হল, যে ব্যক্তি কোনো প্রয়োজন পূরণ করার জন্য কিংবা বিপদ দূর করার জন্য আল্লাহর স্মরণাপন্ন হবে, তার উপর আবশ্যক হচ্ছে সে আল্লাহকে ভালবাসবে। এ ক্ষেত্রে আল্লাহর ভালবাসাই হচ্ছে মূল বুনিয়াদ।
ভাষ্যকার বলেনঃ আমি বলছিঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর ভালবাসায় অন্যকে শরীক করল, সে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যে শির্ককে অস্বীকার করেছে, তা অস্বীকার করেনি এবং উহা যে তাওহীদকে সাব্যস্ত করেছে, সে তা সাব্যস্ত করেনি। বরং আল্লাহর উলুহীয়াতে অন্যকে শরীক সাব্যস্ত করেছে। এটি জানা কথা যে, উলুহীয়াতই হচ্ছে আল্লাহর এবাদত। সুতরাং আল্লাহ ব্যতীত অন্যদের থেকে উলুহীয়াতকে অস্বীকার করা এবং সকল প্রকার এবাদত কেবল আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করাই হচ্ছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’এর সঠিক অর্থ। পূর্বেও এ বিষয়টির বিবরণ অতিক্রান্ত হয়েছে।
সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
«مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَكَفَرَ بِمَا يُعْبَدُ مِنْ دُونِ اللَّهِ حَرُمَ مَالُهُ وَدَمُهُ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ»
‘‘যে ব্যক্তি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে আর আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য যেসব বস্ত্তর এবাদত করা হয় তাকে অস্বীকার করবে, তার জান-মাল মুসলিমদের নিকট সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে এবং তার অন্তরে লুকায়িত বিষয়ের হিসাব আললাহর উপরই ন্যস্ত হবে’’।[10]
ব্যাখ্যাঃ ‘‘যে ব্যক্তি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে এবং আল্লাহ ব্যতীত যারই এবাদত করা হয় তাকে অস্বীকার করবে, তার জান-মাল হারাম’’ - এ হাদীছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান-মালের নিরাপত্তার জন্য দু’টি শর্তারোপ করেছেন। প্রথম শর্তটি হচ্ছে, ইল্ম ও ইয়াকীনের সাথে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ পাঠ করা। ইল্ম ও ইয়াকীনের সাথে বাক্যটি পাঠ করার কথা একাধিক হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয় শর্তটি হচ্ছে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য যেসব বস্ত্তর এবাদত করা হয়, তা অস্বীকার করা। এখানন كَفَرَ শব্দটিকে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর তাকিদ স্বরূপ ব্যবহার করা হয়েছে। কেননা তাওহীদ সাব্যস্ত করা এবং শির্ক অস্বীকার করার জন্য বক্তব্যকে শক্তিশালী করার প্রয়োজন রয়েছে।
হাদীছের এ অংশের মধ্যে দলীল রয়েছে যে, যে ব্যক্তি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ পাঠ করবে এবং সেই সঙ্গে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য যেসব বস্ত্তর এবাদত করা হয়, সেগুলোর এবাদতকে অস্বীকার করবে, তার জান ও মাল মুসলিমদের নিকট নিরাপদ হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইহা পাঠ করবে, কিন্তু আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য মাবুদের এবাদত অস্বীকার করবেনা, তার জান ও মাল নিরাপদ হবেনা।[11] কেননা সে শির্ক প্রত্যাখ্যান করেনি এবং ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ যা অস্বীকার করেছে, তা অস্বীকার করেনি। প্রিয় পাঠক! আপনি এ বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করুন।
আর তার অন্তরে লুকায়িত বিষয়ের হিসাব আল্লাহর উপরই ন্যস্তঃ অর্থাৎ অন্তরের হিসাব-নিকাশ আল্লাহ্ তাআলাই নিবেন। সে যদি সত্যবাদী হয়ে থাকে, তাহলে বদলা স্বরূপ আল্লাহ্ তাআলা তাকে জান্নাতুন নাঈম প্রদান করবেন। আর যদি মুনাফেক হয়ে থাকে, তাহলে আল্লাহ্ তাআলা তাকে কঠিন শাস্তি দিবেন। তবে দুনিয়াতে তার প্রকাশ্য অবস্থার উপর ভিত্তি করেই বিধান প্রয়োগ হবে।
পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে এ অধ্যায়ের শিরোনামের ব্যাখ্যা আসছে। এ অধ্যায়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আর তা হচ্ছে তাওহীদ এবং শাহাদাতের ব্যাখ্যা। কয়েকটি সুস্পষ্ট বিষয়ের মাধ্যমে এর বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
(ক) তাতে রয়েছে সূরা বানী ইসরাঈলের আয়াত। এতে সেসব মুশরিকদের সমুচিত জবাব দেয়া হয়েছে যারা নেক বান্দাদেরকে ডাকে। আর এটা যে ‘শির্কে আকবার’ এ কথার বর্ণনাও এখানে রয়েছে।
(খ) তাতে রয়েছে সূরা তাওবার ঐ আয়াত যাতে বলা হয়েছে যে, ইহুদী-খৃষ্টানরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের আলেম ও দরবেশদেরকে রব হিসেবে গ্রহণ করেছে। আরো বর্ণনা করা হয়েছে যে, এক আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো এবাদত করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়নি। এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, অন্যায় কাজে আলেম ও আবেদদের আনুগত্য করা যাবেনা এবং বিপদে পড়ে তাদের কাছে সাহায্য চাওয়া যাবেনা।
(গ) কাফেরদেরকে লক্ষ্য করে ইবরাহীম খলীল (আঃ) বলেছেনঃ
إِنَّنِي بَرَاءٌ مِمَّا تَعْبُدُونَ (26) إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ
‘‘তোমরা যার এবাদত করো তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আর আমার সম্পর্ক হচ্ছে কেবল তাঁরই সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি আমাকে অচিরেই সৎপথ দেখাবেন। এর দ্বারা তিনি তাঁর রবকে যাবতীয় বাতিল মাবুদ থেকে আলাদা করেছেন।[12] আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আঃ)এর জবানীতে বর্ণনা করেছেন যে বাতিল মাবুদ থেকে পবিত্র থাকা আর প্রকৃত মাবুদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করাই হচ্ছে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র ব্যাখ্যা। তাই আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেনঃ
وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِهِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
‘‘আর ইবরাহীম এ কথাটি পরবর্তীতে তাঁর সন্তানের মধ্যে অমর বাণী হিসাবে রেখে গেছেন, যেন তারা এদিকেই ফিরে আসে’’।
(ঘ) সূরা বাকারায় আল্লাহ তাআলা কাফেরদের সম্পর্কে বলেছেন, وَمَا هُمْ بِخَارِجِينَ مِنَ النَّارِ ‘‘তারা কখনো জাহান্নাম থেকে বের হতে পারবেনা’’। আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেছেন যে, মুশরিকরা তাদের শরীকদেরকে আল্লাহকে ভালবাসার মতই ভালবাসে। এর দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা আল্লাহকে ভালবাসে, কিন্তু এ ভালবাসা তাদেরকে ইসলামে দাখিল করেনি। তাহলে যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য শরীক সাব্যস্ত করে তাকে আল্লাহর চেয়েও বেশী ভালবাসে সে কিভাবে মুসলিম হতে পারে? আর যে ব্যক্তি শুধুমাত্র শরীককেই ভালবাসে এবং আল্লাহর প্রতি যার কোনো ভালবাসা নেই, তার অবস্থা কেমন হবে?
(ঙ) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএর বাণীঃ
«مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَكَفَرَ بِمَا يُعْبَدُ مِنْ دُونِ اللَّهِ حَرُمَ مَالُهُ وَدَمُهُ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ»
‘‘যে ব্যক্তি ‘লা-ইলাহ ইল্লাল্লাহ’ বলবে আর আল্লাহ ব্যতীত যার এবাদত করা হয়, তাকে অস্বীকার করবে, তার জান-মাল হারাম’’। অর্থাৎ তার জান ও মাল মুসলমানের কাছে নিরাপদ। এ বাণী হচ্ছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যা। কারণ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহর মৌখিক উচ্চারণ, এর অর্থ জানা এবং এর স্বীকৃতি প্রদান করাই যথেষ্ট নয়। এমনকি আল্লাহকে ডাকলেও জান-মালের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পাওয়া যাবেনা। যতক্ষণ পর্যন্ত উক্ত কালেমা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র সাথে গাইরুল্লাহর এবাদতকে অস্বীকার করার বিষয়টি যুক্ত না করবে। এতে যদি কোনো প্রকার সন্দেহ, সংশয় কিংবা দ্বিধা-সংকোচ পরিলক্ষিত হয়, তাহলে জান-মালের নিরাপত্তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কতইনা বিরাট এই মাসআলাটি! কতইনা সুস্পষ্ট বর্ণনা এটি! ইহা প্রতিপক্ষের দলীলকে সম্পূর্ণরূপে কেটে দিয়েছে।[13]
ব্যাখ্যাঃ লেখক সামনের অধ্যায়গুলোতে তাওহীদ এবং তাওহীদের বিপরীত বিষয়ের বর্ণনাও করেছেন। একই সাথে যেসব বিষয় মানুষকে শির্কের নিকটবর্তী করে দেয় এবং যে সমস্ত বিষয় শির্কের মাধ্যম তাও বর্ণনা করেছেন। একই সঙ্গে এবাদতের মধ্যে শির্ক থেকে সালফে সালেহীনের দূরে থাকার কথা, শির্কের কঠোর প্রতিবাদ করা এবং এই পথে তাদের জিহাদ করার কথাও বর্ণনা করেছেন।
এই কিতাবটি তথা কিতাবুত তাওহীদ যদিও একটি সংক্ষিপ্ত কিতাব, কিন্তু তাতে তাওহীদের এমন বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে, যে সম্পর্কে কারো অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। আগ্রহের সাথে এ বিষয়গুলোর জ্ঞান অর্জন করা জরুরী। অনুরূপভাবে সকল বিদআতী ও প্রবৃত্তির অনুসারীদের প্রতিবাদ করাও জরুরী। এ কিতাবটি যে মুখস্ত করবে এবং স্মরণ রাখবে সে তাওহীদের বিরোধী এবং বিদআতীদের প্রতিবাদ করতে সক্ষম হবে। প্রত্যেক বিদআতীর জবাব দেয়ার জন্য এ কিতাবটিই তার জন্য যথেষ্ট হবে।
প্রিয় পাঠক! গভীর মনোযোগ দিয়ে কিতাবটি পাঠ করুন। তাতে তাওহীদের মাসআলাগুলো দিবালোকের মত সুস্পষ্ট হিসাবে দেখতে পাবেন। ইনশা-আল্লাহ! আগামী অধ্যায়গুলোতে এ ব্যাপারে আলোচনা হবে।
[7] - দেখুনঃ ইমাম আজুররী রচিত আলগুরাবা, ১/২। হাদীছের সনদ সহীহ, দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ১২৭৩।
[8] - ইশক্ শব্দটি আল্লাহ তাআলা ও আল্লাহর রাসূলের ক্ষেত্রে মানায়না। কেননা তাতে এক ধরণের উন্মাদনা থাকে, যা ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং এই পরিভাষাটি পরিহার করা দরকার। আল্লাহ তাআলা কুরআনে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্র সুন্নাতে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যকার এই সম্পর্ককে ভালবাসা নাম দিয়েছেন। আমরা এটিকে ভালবাসাই বলবো। এটিই উত্তম।
[9] - বুখারী, অধ্যায়ঃ ঈমানের স্বাদ।
[10] - মুসলিম, অধ্যায়ঃ লা-ইলাহা পাঠ না করা পর্যন্ত লোকদের সাথে জিহাদ করার আদেশ।
[11] - এই কথার পক্ষে কুরআন থেকে প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহর বাণীঃ
فَمَن يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِن بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَىٰ لَا انفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
‘‘যে কেউ তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর উপর ঈমান আনে, সে এমন একটি মজবুত রশিকে আঁকড়ে ধরে, যা কখনো ছিন্ন হয় না৷ আললাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’। (সূরা বাকারাঃ ২৫৬) আল্লাহ তাআলা আরও বলেনঃ
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহর এবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’।
[12] - লেখক এখানে যা উল্লেখ করেছেন, তাকে খোলাসা করার জন্য বলা যেতে পারে যে, ইবরাহীম (আঃ)এর জাতির লোকেরা আল্লাহর এবাদত করতো এবং তাঁর সাথে অন্যান্য মাবুদেরও এবাদত করতো। যেমন অন্যান্য মুশরেকরা করে থাকে। তাই আল্লাহর সাথে যেসব মাবুদের এবাদত করা হয় ইবরাহীম সেইসব মাবুদের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেছেন। শুধু সেই আল্লাহর এবাদতের উপর তিনি অটল রয়েছেন, যিনি তাঁকে সৃষ্টি করেছেন।
[13] - এখানে একটি বিষয় খোলাসা করা দরকার। তা হলো, কালেমা পাঠকারী মুসলিমদের থেকে যতক্ষণ পর্যন্ত কালেমার দাবী বিরোধী কোন সুস্পষ্ট কথা ও কর্ম বের না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত দুনিয়ার হুকুমে তাদের জান-মালের উপর আক্রমণ করা যাবেনা। উসামা বিন যায়েদ (রাঃ)এর হাদীছ এ কথারই প্রমাণ বহন করে। তিনি যখন কালেমা পাঠকারী একজন মুসলিমকে হত্যা করলেন, তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছিলেনঃ أَقَتَلْتَهُ بَعْدَ مَا قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ‘‘তুমি কি তাকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পরও হত্যা করেছো? উসামা বলছিলঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ! সে তো জান বাঁচানোর জন্য ইহা পাঠ করেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একই কথা বলছিলেনঃ তুমি কি তাকে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলার পরও হত্যা করেছো?’’ এ রকম হাদীছ আরো অনেক রয়েছে। মোট কথা বাহ্যিকভাবে জবান দিয়ে লা-ইলাহা পাঠ করে আখেরাতে উপকৃত না হলেও দুনিয়াতে জান-মালের হেফাযত হবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুনাফেকদেরকে হত্যা করেন নি।
এখানে আরেকটি কথা বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, কালেমা পাঠকারী কোন মুসলিমের পক্ষ হতে কালেমা বিরোধী কোন কথা বা কর্ম বের হলেও তাকে শারীরিক শাস্তি দেয়া বা শরীয়তের দন্ডবিধি তার উপর কার্যকর করা সাধারণ মুসলিমদের দায়িত্ব নয়। ইসলামী রাষ্ট্রের শাসক বা তার যথাযথ প্রতিনিধিই কেবল শরীয়তের দন্ডবিধি প্রয়োগের অধিকার রাখে।