তাওহীদের ফযীলত এবং তাওহীদ যে সমস্ত গুনাহ্ মিটিয়ে দেয় - ১

ব্যাখ্যাঃ باب তথা অধ্যায় অর্থ হচ্ছে কোনো বিষয়ে বা স্থানে প্রবেশ করার রাস্তা। লেখক বলেনঃ وما يكفره من الذنوب এখানে ما শব্দটি মাসদারীয়া তথা ক্রিয়ামূলের অর্থ প্রদান করেছে। অর্থাৎ তাওহীদ কর্তৃক গুনাহসমূহ মোচন করা সম্পর্কে। ما শব্দটি মাউসূলার অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। তখন অর্থ হবে والذي يكفره من الذنوب তাওহীদের ফযীলত এবং তাওহীদ যে সমস্ত গুনাহ মোচন করে দেয়। এখানে তাওহীদ দ্বারা ‘তাওহীদুল ইবাদাহ্’ উদ্দেশ্য। দুআ, কুরবানী এবং মানতসহ সকল প্রকার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য এবাদত কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট করার নামই হচ্ছে ‘তাওহীদুল ইবাদাহ্’। সূরা গাফেরের ১৪ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَادْعُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ

‘‘অতএব, তোমরা আল্লাহ্কে ডাক দ্বীনকে তাঁর জন্য একনিষ্ঠ করে। যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে’’। সূরা আরাফের ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃوَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ ‘‘তাঁকে ডাক, দ্বীনকে তাঁর জন্য খালেস করে’’।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ

‘‘যারা ঈমান এনেছে এবং ঈমানকে যুলুমের সাথে মিশ্রিত করেনি, তাদের জন্যই রয়েছে শান্তি ও নিরাপত্তা এবং তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত’’। (সূরা আনআমঃ ৮২)

.............................................................

ব্যাখ্যাঃ এখানে যুলুম দ্বারা বড় শির্ক উদ্দেশ্য। মারফু সূত্রে আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ এবং অন্যান্য সাহাবীদের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, উপরোক্ত আয়াতটি নাযিল হলে সাহাবীগণ বলতে লাগলেনঃ আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে নিজের নফসের উপর জুলুম করেনি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ তোমরা এ আয়াতে যুলুম দ্বারা যা বুঝেছ, তা সঠিক নয়। এখানে যুলুম দ্বারা শির্ক উদ্দেশ্য। তোমরা কি আল্লাহর প্রিয় বান্দা লুকমান (আঃ)এর কথা শুন নি? তিনি তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেনঃ يَا بُنَيَّ لا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ ‘‘হে প্রিয় বৎস! আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করোনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করা মহা যুলুম’’। (সূরা লুকমানঃ ১৩) সুতরাং এই অধ্যায়ে উল্লেখিত আয়াত থেকে জানা গেল, যে ব্যক্তি শির্ক থেকে মুক্ত থাকবেনা, তার জন্য নিরাপত্তা ও হেদায়াত অর্জন করা কোন ক্রমেই সম্ভব হবেনা। অপর পক্ষে যে ব্যক্তি শির্ক থেকে বেঁচে থাকবে, ঈমান ও ইসলামের উপর টিকে থাকা অনুপাতে তার জন্য নিরাপত্তা ও হেদায়াত অর্জিত হবে। যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে যে, সে জীবিত অবস্থায় সর্বদা কবীরা গুনাহ্ করেনি, পূর্ণ নিরাপত্তা ও হেদায়াত কেবল তার জন্যই অর্জিত হবে। আর যেই তাওহীদপন্থী গুনাহ করে তাওবা না করেই আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সে তাওহীদ অনুপাতে নিরাপত্তা ও হেদায়াত প্রাপ্ত হবে এবং গুনাহর অনুপাতে নিরাপত্তা ও হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হবে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِينَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ وَمِنْهُم مُّقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللَّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَضْلُ الْكَبِيرُ

‘‘অতঃপর আমার নির্বাচিত বান্দাদেরকেই কিতাবের অধিকারী করেছি। তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্‌র নির্দেশক্রমে কল্যাণের পথে এগিয়ে রয়েছে। এটাই মহা অনুগ্রহ’’।[1] (সূরা ফাতিরঃ ৩২) সুতরাং যালেম হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে সৎ ও অসৎ আমলের মিশ্রণ ঘটানোর মাধ্যমে নিজের উপর যুলুম করেছে। তার ব্যাপারটি আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ্ তাআলা ইচ্ছা করলে তাঁকে ক্ষমা করবেন। আর ইচ্ছা করলে গুনাহ্র কারণে তাঁকে শাস্তি দিবেন। কিন্তু তাওহীদের কারণে তাকে চিরকাল জাহান্নামে রাখবেন না; বরং তাকে জাহান্নাম থেকে বের করবেন। মধ্যমপন্থী হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে শুধু ওয়াজিবগুলো পালন করে এবং হারাম কাজ থেকে বিরত থাকে। এটিই আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের অবস্থা। কল্যাণের পথে ও সৎকর্মে অগ্রগামী হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে ইলম ও আমলের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্যে সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করে পরিপূর্ণ ঈমান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।[2] শেষ দুই শ্রেণীর মানুষের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে পূর্ণ নিরাপত্তা ও পূর্ণ হেদায়াত অর্জিত হবে। সুতরাং জানা গেল পূর্ণ ঈমানদারের জন্য রয়েছে পূর্ণ নিরাপত্তা। আর ত্রুটিপূর্ণ ঈমানদারের জন্য রয়েছে আংশিক বা অসম্পূর্ণ নিরাপত্তা। কেননা পূর্ণ ঈমান মুমিন বান্দাকে দুনিয়াতে পাপ কাজ ও আখেরাতে শাস্তি হতে রক্ষা করবে। সে আল্লাহর সাথে এমন পাপ নিয়ে মিলিত হবেনা, যার কারণে তাকে শাস্তি দেয়া হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

مَا يَفْعَلُ اللَّهُ بِعَذَابِكُمْ إِنْ شَكَرْتُمْ وَآمَنْتُمْ وَكَانَ اللَّهُ شَاكِرًا عَلِيمًا

‘‘তোমাদের আযাব দিয়ে আল্লাহ্ কি করবেন যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক। আর আল্লাহ্ হচ্ছেন সমুচিত মূল্যদানকারী, সর্বজ্ঞাত’’। (সূরা নিসাঃ ১৪৭) উপরোক্ত আয়াতের অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে আমি যা উল্লেখ করলাম, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রঃ) আয়াতের ব্যাখ্যায় তাই বলেছেন। কুরআন এ কথারই প্রমাণ বহন করে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বক্তব্যও তাই। খারেজী, মুতাযেলা এবং অন্যান্য বিদআতী দলের কথা এর বিপরীত।[3]

সাহাবী উবাদা ইবনে সামেত রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

مَنْ شَهِدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ ، وَأَنَّ عِيسَى عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ ، وَرُوحٌ مِنْهُ وَالْجَنَّةُ حَقٌّ وَالنَّارُ حَقٌّ أَدْخَلَهُ اللَّهُ الْجَنَّةَ عَلَى مَا كَانَ مِنَ الْعَمَلِ

‘‘যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দান করল যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, তিনি তাঁর এমন এক কালিমা যা তিনি মরিয়াম (আঃ) এর প্রতি প্রেরণ করেছেন এবং তিনি তাঁরই পক্ষ থেকে প্রেরিত রুহ বা আত্মা। জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, তাকে আল্লাহ তাআলা জান্নাত দান করবেন। তার আমল যাই হোক না কেন’’।[4]

.............................................................

ব্যাখ্যাঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীঃ যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দিল যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, সাক্ষ্য তখনই গ্রহণযোগ্য হওয়ার উপযুক্ত হয়, যখন তার ভিত্তি হবে ইল্ম, ইয়াকীন এবং সত্যের উপর। অজ্ঞতা এবং সন্দেহের উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। অজ্ঞতা সন্দেহের উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত সাক্ষ্য দেয়াতে কোন উপকারও নেই। অজ্ঞতা ও সন্দেহের উপর ভিত্তি করে সাক্ষ্য দিলে সাক্ষ্যদাতা মিথ্যুক হিসাবে গণ্য হবে। কেননা সে যে বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে, সে ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এই পবিত্র বাক্যটি অর্থাৎ কালেমায়ে তায়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাহ্-এর সাক্ষ্যটি না বাচক এবং হাঁ বাচক বক্তব্যকে শামিল করেছে। لاإله-এর মাধ্যমে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য সকল বস্ত্ত হতে ইলাহীয়াতকে নাকোচ করা হয়েছে এবং إلا الله-এর মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহর জন্য ইলাহীয়াত সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

شَهِدَ اللّهُ أَنَّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ وَالْمَلاَئِكَةُ وَأُوْلُواْ الْعِلْمِ قَآئِمَاً بِالْقِسْطِ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘‘আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। ফেরেশতাগণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ্ নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৮) অনেক লোকই কালেমা তায়্যেবার সঠিক অর্থ না জানার কারণে পথভ্রষ্ট হয়েছে। আর এই শ্রেণীর লোকের সংখ্যাই অধিক। তারা মূল অর্থকে পালটিয়ে দিয়েছে। তারা সৃষ্টির মধ্য হতে কবরবাসী, মাজারের খাদেম, তাগুত, বৃক্ষরাজি, পাথর, জিন এবং অন্যান্য সৃষ্ট বস্ত্তর জন্য উলুহীয়াত সাব্যস্ত করেছে। অথচ কালেমায়ে তায়্যেবার মধ্যে এগুলো থেকে উলুহীয়াতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে। তারা এগুলোর উপাসনা করাকে দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং এগুলোকে চাকচিক্যময় ও সুসজ্জিত করে প্রকাশের মাধ্যমে তাওহীদকে বিদআতে রূপান্তরিত করেছে। তারা ঐ সমস্ত তাওহীদপন্থীদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে, যারা নির্ভেজাল তাওহীদের দিকে মানুষকে আহবান করে। এই সমস্ত কবর পূজারীদের অবস্থা এই পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে যে, জাহেলী যামানার কুরাইশদের অজ্ঞ কাফেররা কালেমায়ে তায়্যেবার যতটুকু অর্থ বুঝত, এই সমস্ত নামধারী মুসলিমরা এই পবিত্র বাক্যটির অর্থ ততটুকুও বুঝতে সক্ষম নয়। জাহেলী যামানার কাফেররা কালেমায়ে তাওহীদের অর্থ খুব ভাল করেই বুঝত। কিন্তু কালেমায়ে তায়্যেবা যেই ইখলাস তথা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার প্রতি আহবান করে, তারা কেবল তাকেই অস্বীকার করেছিল। যেমন আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ

‘‘তাদের যখন বলা হত, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই, তখন তারা অহঙ্কার করত এবং বলত, আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করব? (সূরা আস্ সাফ্ফাতঃ ৩৫-৩৬)

এই উম্মতের বর্তমান মুসলিম নামধারী মুশরিকরা পূর্বকালের মুশরিকদের মতই আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যের এবাদত বর্জন করার দাওয়াতকে অস্বীকার করছে। বর্তমানে এই উম্মতের মুসলিম নামধারী মুশরিকরা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে মাজার, গম্বুজ, তাগুত এবং অন্যান্য বস্ত্তর পূজা শুরু করে দিয়েছে। মক্কার মুশরিকরা কালেমায়ে তায়্যেবা এবং এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার তাৎপর্য বুঝে-শুনেই মানতে অস্বীকার করেছিল। আর এই যামানার মুসলিমগণ কালেমার অর্থ না বুঝার কারণে তার দাবী বাস্তবায়ন করতে অস্বীকার করছে। এ জন্যই আপনি দেখবেন যে, সে لاإله إلا الله বলছে। আর সেই সাথে সে আল্লাহর সাথে অন্যেরও এবাদত করছে!

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ মাবুদ তিনিই হতে পারেন, লোকেরা অন্তরের একনিষ্ঠতার সাথে যার এবাদত করে, তাকে ভালবেসে, ভয়ের সাথে তাঁরই বড়ত্ব প্রকাশ করে, তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করে, তাঁকেই সম্মান করে, তাঁর সামনেই নতি স্বীকার করে, তাঁর সামনেই বিনয়ী হয়, তাঁকেই ভয় করে, তাঁর কাছেই আশা করে এবং তাঁর উপরই ভরসা করে।

উযীর আবুল মুযাফ্ফার (রঃ) তার ‘ইফসাহ’ নামক গ্রন্থে বলেনঃ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর সাক্ষ্য দেয়ার দাবী হচ্ছে, সাক্ষ্যদাতা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান রাখবে যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ্ নেই। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَاعْلَمْ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ

‘‘জেনে রেখো, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই। অতঃপর ক্ষমা প্রার্থনা করো, তোমার নিজের গুনাহর জন্য এবং মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্য’’। (সূরা মুহাম্মাদঃ ১৯) এখানে إلا -এর পরে الله মারফু হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহই হচ্ছেন এবাদতের একমাত্র হকদার। আল্লাহর যাতে পাক ব্যতীত অন্য কেউ এবাদতের হকদার নন। কালেমায়ে তায়্যেবা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, এই পবিত্র বাক্যটি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের সাথে সাথে প্রত্যেক তাগুতকে অস্বীকার করার দাবী জানায়। সুতরাং আপনি যখন আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য সকল বস্ত্ত হতে উলুহীয়াতকে অস্বীকার করবেন এবং শুধু আল্লাহর জন্যই তা সাব্যস্ত করবেন, তখন আপনি সমস্ত তাগুতকে অস্বীকারকারী এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের অন্তর্ভূক্ত হবেন।

ইমাম ইবনে রজব[5] (রঃ) বলেনঃ ইলাহ্ হচ্ছেন সেই সত্তা, যার আনুগত্য করা হয় এবং যার নাফরমানী করা হয়না। যাকে সম্মান করা হয়, যার বড়ত্ব প্রকাশ করা হয়, যাকে ভালোবাসা হয়, যাকে ভয় করা হয়, যার কাছে আশা করা হয়, যার উপর ভরসা করা হয়, যার কাছে চাওয়া হয় এবং যার কাছে দুআ করা হয়। এসব বস্ত্ত মহান আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করা শোভনীয় নয়। যে ব্যক্তি উলুহীয়াতের এ সমস্ত বৈশিষ্ট্যে কোন মাখলুককে আল্লাহর সাথে শরীক করল, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বলার ক্ষেত্রে তার ইখলাস ত্রুটিপূর্ণ হবে এবং তার মধ্যে সেই ত্রুটি অনুযায়ী মাখলুকের উবুদীয়াত পাওয়া যাবে।

ইমাম বিকাঈ (রঃ) বলেনঃ لاإله إلا الله -এই পবিত্র বাক্যটি মহান বাদশাহ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন সত্য মাবুদ থাকার কথাকে দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করেছে। এই বিশ্বাসই কিয়ামতের ভয়াবহ আযাব থেকে নাজাতের সর্বোত্তম মাধ্যম। কালেমার এই জ্ঞানটি তখনই প্রকৃত জ্ঞান বলে বিবেচিত হবে, যখন তা উপকারী হবে। আর তা উপকারী তখনই হবে, যখন তা অন্তর থেকে পাঠ করা হবে এবং তার দাবী অনুযায়ী আমল করা হবে। অন্যথায় তা নিছক মূর্খতা বলেই গণ্য হবে।

ভাষ্যকার বলেনঃ আমি বলছি যে, এই উম্মতের পরবর্তী যামানার লোকেরা لاإله إلا الله -এর অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ। এর সঠিক অর্থকে রুবুবীয়াতের অর্থের মাধ্যমে বদল করে ফেলেছে। অর্থাৎ তারা আল্লাহর জন্য শুধু সৃষ্টি করা ও প্রতিপালন করার ক্ষমতা সাব্যস্ত করছে। এর মাধ্যমে তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ যেই শির্ক থেকে নিষেধ করেছে, তারা আল্লাহর জন্য তাই সাব্যস্ত করেছে। তারা মূর্খতা বশতঃ কালেমা তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’& আল্লাহর জন্য যেই এবাদতকে খালেস করতে বলেছে, তা করতে অস্বীকার করেছে। সূরা যুমারের ২ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃفَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّينَ ‘‘তুমি আল্লাহর এবাদত কর, দ্বীনকে তাঁর জন্য খালেস করে’’।

ইমাম নববী (রঃ) বলেনঃ দীর্ঘ দিন যাবৎ আমর বিল মারুফ এবং নাহী আনিল মুনকার তথা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের দরজা বন্ধ রয়েছে। বর্তমান সময়ে খুব সীমিত আকারে কেবল এর নামটি বিদ্যমান রয়েছে। অথচ এটি ইসলামের বিরাট একটি স্তম্ভ। এর মাধ্যমেই কল্যাণের পথ প্রসারিত এবং স্থায়ী হয়। আর এর অবর্তমানে অন্যায় ও অকল্যাণের পথ প্রশস্ত হয়। পৃথিবীতে যখন পাপকাজ ছড়িয়ে পড়ে তখন আল্লাহর শাস্তি ভাল ও খারাপ সকল শ্রেণীর লোককেই পাকড়াও করে। কেউ এ থেকে রেহাই পায়না। ইমাম নববী (রঃ) বর্তমান সময় বলতে হিজরী পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শতক উদ্দেশ্য করেছেন। পঞ্চম ও ষষ্ঠ হিজরী সালের অবস্থা যদি এই হয়, তাহলে দশম ও তার পরবর্তী শতকের অবস্থা কেমন ভয়াবহ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ইসলামের দুর্বলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে তথা সঠিক ইসলাম একেবারেই অপরিচিত হয়ে গেছে। আমাদের শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রঃ) গুরবাতুল ইসলামের এক সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মত সুন্দর ও অভিনব ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে অন্য কেউ প্রদান করেনি। শাইখের ব্যাখ্যাটি পাঠ করা অত্যন্ত জরুরী। কেননা এই ব্যাখ্যাটি জানার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।[6]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীঃ وحده لا شريك له ‘‘তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই’’-এই বাক্যটি لاإله إلا الله এর অর্থকে শক্তিশালী করছে এবং এর প্রকৃত তাৎপর্যকেই ব্যাখ্যা করছে। মূলতঃ এটিও তাওহীদের প্রমাণ বহন করে। সুতরাং لاإله কথাটি এবাদতের মধ্যে সামান্যতম শির্ক করাকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। لاشريك له কথাটি সেই অর্থকেই সুস্পষ্ট ও ব্যাখ্যা করেছে। অর্থাৎ এবাদতে আল্লাহর কোন শরীক নেই। وحده এর মধ্যে إلا الله এর অর্থ বিদ্যমান। সুতরাং আল্লাহই একমাত্র সত্য ইলাহ। তিনি ব্যতীত আসমান-যমীনের কেউ কোন প্রকার এবাদতের হকদার নয়। কুরআনের মুহকাম আয়াতগুলো এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুতাওয়াতের হাদীছগুলো এ কথারই প্রমাণ বহন করে। আপনি যখন এই ব্যাখ্যাকে মনোযোগ দিয়ে পড়বেন, তখন আপনার কাছে ঐ সমস্ত লোকদের কথা বাতিল বলে প্রমাণিত হবে, যারা বলে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ করা জায়েয। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবীকে বলেনঃ

فَلَا تَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَهاً آخَرَ فَتَكُونَ مِنَ الْمُعَذَّبِينَ

‘‘অতএব, তুমি আল্লাহ্‌র সাথে অন্য উপাস্যকে আহবান করবেনা। করলে শাস্তিতে পতিত হবে’’। (সূরা শুআরাঃ ২১৩) এ রকম আরো অনেক আয়াত রয়েছে। অচিরেই এর বিস্তারিত আলোচনা আসবে, ইনশা-আল্লাহ্ । সুতরাং وحده لا شريك له এর মধ্যে وحده শব্দটি হাঁ বাচক বিষয়কে জোরদার করছে আর لا شريك له বাক্যটি না বাচক বিষয়কে জোরদার করছে।

হাদীছের অংশ وأن محمدا عبده ورسوله -এর অর্থ হচ্ছে অন্তর থেকে বিশ্বাস ও সত্যায়ন করবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। এ কথার দাবী হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা হবে, তাঁর আদেশ ও নিষেধের প্রতি সম্মান করা হবে এবং তাঁর সুন্নাতের উপর আমল করা হবে। কোন মানুষের কথা দ্বারা তাঁর সুন্নাতের বিরোধীতা করা যাবেনা। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো কথা ভুলের উর্ধ্বে নয়। আল্লাহ্ তাআলা তাঁকে ভুল থেকে হেফাজত করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে তাঁর আনুগত্য করার এবং তাঁকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন। নিম্নের আয়াতে তাঁর আনুগত্য বর্জনকারীদের শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجاً مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيماً

‘‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে পর্যন্ত তারা ঈমানদার হবেনা, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মেনে নেয়। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজেদের মনে কোন সংকীর্ণতা পাবেনা এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নেবে’’। (সূরা নিসাঃ ৬৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

‘‘অতএব, যারা তাঁর নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিত্না তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে।’’ (সূরা নূরঃ ৬৩) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) বলেনঃ আমি ঐ সমস্ত লোকের জন্য আশ্চর্যবোধ করি, যারা হাদীছের সনদ ও তার সত্যতা জানার পরও সুফীয়ানের রায় গ্রহণ করে। অথচ আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

‘‘অতএব, যারা তাঁর নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিত্না তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে’’। তুমি কি জান ফিতনা[7] কাকে বলে? ফিতনাহ্ হচ্ছে শির্ক। কোন মানুষ যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন কথা প্রত্যাখ্যান করবে, তখন এমন আশঙ্কা রয়েছে যে, তার অন্তরে বক্রতা প্রবেশ করবে। পরিণামে সে ধ্বংস হবে। বর্তমানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ত্রুটি করা হচ্ছে। তা বর্জনও করা হচ্ছে। তাঁর সুন্নাত ও কথার উপর ঐ সমস্ত লোকদের কথাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, যাদের কথার মধ্যে ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে আলেমরা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ বিষয়টি বর্তমানে সকলের নিকট সুস্পষ্ট।

ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূলঃ এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার মধ্যে ঐ মহা সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে, যা বিশ্বাস করা ফরয। কুরআনের মুহকাম আয়াতসমূহ দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত। তাতে কাফের খৃষ্টানদের প্রতিবাদও রয়েছে। এরা তিনটি দলে বিভক্ত। এক দলের কথা হচ্ছে, ঈসা (আঃ)-ই আল্লাহ্। অন্য দল বলছে, তিনি আল্লাহর পুত্র। আরেক দলের মত হচ্ছে, আল্লাহ্ তিনজনের একজন। অর্থাৎ ঈসা, তাঁর মা মারইয়াম এবং তৃতীয় হচ্ছেন আল্লাহ।

আল্লাহ্ তাআলা কুরআন মজীদে এ বিষয়ে মূল সত্যটি বর্ণনা করেছেন এবং বাতিলের প্রতিবাদ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لاَ تَغْلُواْ فِي دِينِكُمْ وَلاَ تَقُولُواْ عَلَى اللّهِ إِلاَّ الْحَقِّ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِّنْهُ فَآمِنُواْ بِاللّهِ وَرُسُلِهِ وَلاَ تَقُولُواْ ثَلاَثَةٌ انتَهُواْ خَيْراً لَّكُمْ إِنَّمَا اللّهُ إِلَـهٌ وَاحِدٌ سُبْحَانَهُ أَن يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَات وَمَا فِي الأَرْضِ وَكَفَى بِاللّهِ وَكِيلاً لَنْ يَسْتَنْكِفَ الْمَسِيحُ أَنْ يَكُونَ عَبْدًا لِلَّهِ وَلا الْمَلائِكَةُ الْمُقَرَّبُونَ وَمَنْ يَسْتَنْكِفْ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيَسْتَكْبِرْ فَسَيَحْشُرُهُمْ إِلَيْهِ جَمِيعًا

‘‘হে আহলে-কিতাবগণ! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করোনা এবং আল্লাহ্‌র শানে নিতান্ত সঙ্গত বিষয় ছাড়া কোন কথা বলোনা। নিঃসন্দেহে মরিয়ম পুত্র মসীহ ঈসা আল্লাহ্‌র রাসূল এবং তার বাণী, যা তিনি প্রেরণ করেছেন মরিয়মের নিকট এবং তারই কাছ থেকে আগত একটি রূহ। অতএব, তোমরা আল্লাহ্কে এবং তার রাসূলগণকে মান্য করো। আর এ কথা বলোনা যে, আল্লাহ্ তিনের এক, এ কথা পরিহার করো; তোমাদের মঙ্গল হবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ একক উপাস্য। সন্তান-সন্ততি হওয়া তাঁর যোগ্য বিষয় নয়। যা কিছু আসমানসমূহ ও যমীনে রয়েছে সবই তাঁর। আর কর্ম সম্পাদনে আল্লাহ্ই যথেষ্ট। মসীহ্ আল্লাহ্‌র বান্দা হবেন, তাতে তার কোন লজ্জাবোধ নেই এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাদেরও না। বস্ত্ততঃ যারা আল্লাহ্‌র এবাদত করতে লজ্জাবোধ করবে এবং অহংকার করবে, তিনি তাদের সবাইকে নিজের কাছে সমবেত করবেন’’। (সূরা নিসাঃ ১৭১-১৭২) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

لَقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ قُلْ فَمَنْ يَمْلِكُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ أَنْ يُهْلِكَ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُ وَمَنْ فِي الأرْضِ جَمِيعًا وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا يخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

‘‘নিশ্চয়ই তারা কাফের, যারা বলে মসীহ্ ইবনে মরিয়মই আল্লাহ্। তুমি জিজ্ঞাসা করো, তবে আল্লাহ্ যদি মসীহ্ ইবনে মারইয়াম, তার মা এবং ভূমন্ডলে যারা আছে অচিরেই তাদের সবাইকে ধ্বংস করতে চান, তাহলে এমন কারো সাধ্য আছে কি যে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে তাদেরকে বিন্দুমাত্রও বাঁচাতে পারে? নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে, সবকিছুর উপর আল্লাহ্‌রই আধিপত্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। আল্লাহ্ সবকিছুর উপর শক্তিমান’’। (সূরা মায়িদাঃ ১৭)[8] সূরা মায়িদার একাধিক স্থানে এ বিষয়ে বিশদ বর্ণনা এসেছে। এ সমস্ত স্থানে আল্লাহ্ তাআলা ঐ কথা বলে দিয়েছেন, যা ঈসা (আঃ) জন্মের পর মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় ব্যক্ত করেছিলেন। সূরা মারইয়ামের ২৭ থেকে ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَأَتَتْ بِهِ قَوْمَهَا تَحْمِلُهُ قَالُوا يَا مَرْيَمُ لَقَدْ جِئْتِ شَيْئاً فَرِيّاً يَا أُخْتَ هَارُونَ مَا كَانَ أَبُوكِ امْرَأَ سَوْءٍ وَمَا كَانَتْ أُمُّكِ بَغِيّاً فَأَشَارَتْ إِلَيْهِ قَالُوا كَيْفَ نُكَلِّمُ مَن كَانَ فِي الْمَهْدِ صَبِيّاً قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيّاً وَجَعَلَنِي مُبَارَكاً أَيْنَ مَا كُنتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيّاً وَبَرّاً بِوَالِدَتِي وَلَمْ يَجْعَلْنِي جَبَّاراً شَقِيّاً وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدتُّ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيّاً ذَلِكَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ قَوْلَ الْحَقِّ الَّذِي فِيهِ يَمْتَرُونَ مَا كَانَ لِلَّهِ أَن يَتَّخِذَ مِن وَلَدٍ سُبْحَانَهُ إِذَا قَضَى أَمْراً فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُن فَيَكُونُ وَإِنَّ اللَّهَ رَبِّي وَرَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ هَذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِيمٌ

‘‘অতঃপর তিনি সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হলেন। তারা বললঃ হে মারইয়াম, তুমি একটি অঘটন ঘটিয়ে বসেছ। হে হারুনের বোন! তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মাতাও ব্যভিচারিনী ছিলেন না। অতঃপর তিনি হাত দ্বারা সন্তানের দিকে ইঙ্গিত করলেন। তারা বললঃ কোলের শিশুর সাথে আমরা কেমন করে কথা বলবো? সন্তান বললঃ আমি তো আল্লাহ্‌র বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি ততদিন নামায ও যাকাত আদায় করতে। আর আমি জননীর অনুগত হবো। আমাকে তিনি অহংকারী ও হতভাগ্য করেন নি। আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন মৃত্যুবরণ করবো এবং যেদিন আমাকে জীবিত করে উঠানো হবে। ইনি হচ্ছেন মারইয়ামের পুত্র ঈসা এবং এ হচ্ছে তার সম্পর্কে সত্য কথা, যে সম্পর্কে লোকেরা সন্দেহ করছে। কাউকে সন্তান হিসাবে গ্রহণ করা আল্লাহর জন্য শোভনীয় নয়, তিনি পবিত্র সত্তা। তিনি যখন কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন এ কথাই বলেনঃ হয়ে যাও, অমনি তা হয়ে যায়। আর ঈসা বলেছিলঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমার প্রতিপালক তোমাদের প্রতিপালক। অতএব, তোমরা তাঁর এবাদত করো। এটাই সরল পথ’’। এখানে আল্লাহ্ তাআলা ঐ সঠিক পথের আলোচনা করেছেন, যে পথের অনুসারীরা নাজাতের হকদার হবে। আর যে ব্যক্তি ঐ পথের বাইরে চলবে, সে ধ্বংস হবে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা আল-ইমরানের ৫৯-৬০ নং আয়াতে বলেনঃ

إِنَّ مَثَلَ عِيسَى عِندَ اللّهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِن تُرَابٍ ثِمَّ قَالَ لَهُ كُن فَيَكُونُ الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلاَ تَكُن مِّن الْمُمْتَرِينَ

‘‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্‌র নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মত। তাকে মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন তারপর তাকে বলেছিলেনঃ হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল। যা তোমার প্রতিপালক বলেন তাই যথার্থ সত্য। কাজেই তোমরা সংশয়বাদী হয়োনা’’। আল্লাহ্ তাআলা সীরাতুল মুস্তাকীমকে সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণরূপে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর তাওহীদের দলীল-প্রমাণসমূহ বর্ণনা করেছেন। মুশরিকদের অপছন্দ সত্ত্বেও তিনি সত্যকে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং মিথ্যাকে বাতিল করেছেন।

ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর এমন এক কালিমা, যা তিনি মরিয়ামের প্রতি প্রেরণ করেছেনঃ এখানে কালিমার অর্থ হচ্ছে তাঁর বাণী كُنْ হয়ে যাও। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলা ঈসা (আঃ)কে তাঁর কালিমা كُنْ দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এর দ্বারা আরো প্রমাণিত হল যে, আল্লাহ্ তাআলা কথা বলেন, কথা বলা তাঁর অন্যতম একটি সিফাত। কিন্তু জাহমীয়ারা এতে বিশ্বাস করেনা।

ঈসা (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রূহঃ এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হচ্ছে, তিনি ঐ সমস্ত রূহের অন্তর্ভূক্ত, যাদেরকে আল্লাহ্ তাআলা আদম (আঃ)এর পৃষ্ঠদেশ থেকে নির্গত করেছেন এবং তাদের থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, আল্লাহ্ তাআলাই হচ্ছেন তাদের প্রভু ও মাবুদ। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِن بَنِي آدَمَ مِن ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُواْ بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ

‘‘আর যখন তোমার প্রতিপালক বনী আদমের পৃষ্টদেশ থেকে বের করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করালেন, আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি। আবার না কিয়ামতের দিন বলতে শুরু কর যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিলনা’’। (সূরা আরাফঃ ১৭২) সুতরাং ঈসা (আঃ)এর রূহ ঐ সমস্ত রূহের অন্তর্ভূক্ত, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন।

ইবনে জারীর[9] (রঃ) সূরা মারইয়ামের ২২ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ[10] (রঃ)এর বরাত দিয়ে বলেনঃ জিবরীল মারিয়ামের কোর্তার পকেটে ফুঁ দিলেন। ফুঁ-এর প্রভাব মারইয়ামের জরায়ু পর্যন্ত পৌঁছে গেল। এতে তিনি গর্ভবতী হয়ে গেলেন। ইমাম সুদ্দী (রঃ) বলেনঃ ফুৎকারের প্রভাব মারইয়ামের বক্ষদেশে প্রবেশ করল। এতেই তিনি ঈসা (আঃ)কে পেটে ধারণ করলেন। ইবনে জুরাইয (রঃ) বলেনঃ বলা হয় যে, জিবরীল (আঃ) মারইয়ামের কোর্তার গলদ্বারে ও আস্তীনে ফুঁ দিয়েছেন।

সার কথা হচ্ছে, জিবরীল ফুঁ দিয়েছেন আর আল্লাহ্ তাআলা তাঁর كٌنْ বাক্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ঈসা (আঃ) সৃষ্টি হয়ে গেছেন। আল্লাহ্ তাআলা সূরা হিজ্রে আদম (আঃ)-এর ব্যাপারে বলেনঃ

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ فَسَجَدَ الْمَلائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ إِلا إِبْلِيسَ أَبَى أَنْ يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِيْنَ

‘‘আর তোমার প্রভু যখন ফেরেশতাদেরকে বললেনঃ আমি পচা কর্দম থেকে তৈরি বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্ট একটি মানব জাতির পত্তন করব। অতঃপর যখন তাকে ঠিকঠাক করে নেব এবং তাতে আমার রূহ থেকে ফুঁ দেব, তখন তোমরা তার সামনে সেজদায় পরে যেয়ো। তখন ফেরেশতারা সবাই মিলে সেজদা করল। কিন্তু ইবলীস ব্যতীত। সে সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানালো। (সূরা হিজরঃ ২৮-৩১) সেই সত্তা অতি পবিত্র, যিনি ব্যতীত অন্য কোন সৃষ্টি কর্তা নেই। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এবাদতের যোগ্যও নয়।

কতিপয় খৃষ্টান মুসলমানদের কতক আলেমের সাথে আল্লাহর বাণীঃ وَرُوحٌ مِّنْهُ অর্থাৎ ঈসা (আঃ) আল্লাহর রূহ, -এ কথার মাধ্যমে দলীল পেশ করে তর্ক শুরু করল। তারা বলতে চাইল যে, ঈসা (আঃ) আল্লাহর রূহ তথা আল্লাহর অংশ বা তিনিই আল্লাহ্। তখন মুসলিম আলেমগণ তাদের উত্তরে বললেনঃ এটি শুধু ঈসা (আঃ)এর জন্য খাস নয়; বরং ঈসা (আঃ) এর মতই সকল সৃষ্টি আল্লাহর এবং আল্লাহর পক্ষ হতে। যেমন আল্লাহ্ তাআলা সূরা জাসিয়ার ১৩ নং আয়াতে বলেনঃ

وَسَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَوَاتِ وَمَا فِي الأرْضِ جَمِيعًا مِنْهُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

‘‘এবং তিনি আসমান ও যমীনের সমস্ত জিনিষকেই তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন। সবকিছুই তাঁর পক্ষ থেকে। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে’’। (সূরা জাসিয়াঃ ১৩) অর্থাৎ আসমান-যমীনের সব কিছুর সৃষ্টি কর্তা একমাত্র তিনি। তার মধ্যে ঈসা (আঃ)ও শামিল। অন্যান্য সকল বস্ত্তর ন্যায় তিনি ঈসাকেও সৃষ্টি করেছেন’’।

[1] - এই আয়াতে মানুষকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। (১) যালেমঃ যালেম হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে সৎ আমল করার সাথে সাথে খারাপ আমলও করে। কখনো ভাল আমল করে আবার কখনো হারাম কাজে লিপ্ত হয়। এর মাধ্যমে সে নফসের উপর যুলুম করছে। এই শ্রেণীর মানুষের জন্য দুনিয়াতে ও আখেরাতে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। তারা পরিপূর্ণ নিরাপদ ও পরিপূর্ণ হেদায়াতপ্রাপ্ত নয়। দুনিয়াতে তারা পূর্ণ ঈমান ও হেদায়াতের উপর নেই। আর আখেরাতেও তারা আল্লাহর শাস্তি ও পাকড়াও হতে পূর্ণ নিরাপদ নয়। মৃত্যুর পর তাদের বিষয়টি সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছাধীন। ইচ্ছা করলে দয়াময় আল্লাহ্ তাআলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। আর ইচ্ছা করলে তিনি তাদেরকে জাহান্নামে শাস্তি দিবেন। তবে শাস্তি দিলেও তিনি তাদেরকে চিরকাল জাহান্নামে রাখবেন না। তাওহীদের কারণে তিনি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে আশ্রয় দিবেন।

(২) মুকতাসিদঃ মুক্তাসিদ হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহর সকল হারাম কাজ থেকে বিরত থাকে। সেই সাথে সকল প্রকার ফরয ও ওয়াজিব আমল সম্পাদন করে। কিন্তু নফল এবাদতের প্রতি তাদের রয়েছে প্রচুর অনাগ্রহ। (৩) সাবিকুন বিল খায়রাতঃ এরা হচ্ছে ঐ শ্রেণীর লোক, যারা সকল প্রকার হারাম কাজ থেকে বিরত থাকে এবং সকল প্রকার ওয়াজিব ও ফরয আমলগুলো সম্পাদন করে। সেই সাথে তারা নফল ও সুন্নাতী আমলের দিকে প্রতিযোগীতামূলকভাবে অগ্রসর হয়। শেষ দুই শ্রেণীর মানুষের জন্যই রয়েছে দুনিয়াতে হেদায়াত এবং আখেরাতে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা।

[2] - তারীকুল হিজরাতাইন, পৃষ্ঠা নং- ৩১৪-৩৩৫।

[3] - مقالات الخوارج والمعتزلة – الفَرْق بين الفِرَق ص (73 ،117)

[4]- বুখারী, অধ্যায়ঃ আল্লাহর বানী, হে আহলে কিতাব! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না।

[5] - তিনি হচ্ছেন হাফেয আব্দুর রাহমান বিন আহমাদ বিন রজব আলবাগদাদী আদ্ দিমাশকী আলহাম্বালী। দ্বীনের খেদমতে তার অনেক লেখনী রয়েছে। তার মধ্যে লাতাইফুল মাআরিফ, যাইলু তাবাকাতিল হানাবেলা এবং জামেউল উলুম ওয়াল হিকাম অন্যতম। তিনি ৭৯৫ হিজরী সালে ইন্তেকাল করেন।

[6]- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

بَدَأَ الإِسْلامُ غَرِيبًا ، وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا ، فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ

‘‘ইসলাম অপ্রসিদ্ধ অবস্থায় এসেছে। অচিরেই তা গরীব অবস্থায় ফিরে যাবে। সুতরাং গরীবদের জন্য সুখবর’’। ইমাম মুসলিম এই হাদীছটি আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। শাইখ সিন্দী রাহিমাহুল্লাহ ইবনে মাজার হাশীয়াতে বলেনঃ গরীব শব্দের অর্থ হল, ইসলামের সূচনার সময় এর অনুসারী ছিল খুবই কম। মূলতঃ জন্মভূমি থেকে দূরে অবস্থানকারী লোককেও গরীব বলা হয়। অচিরেই ইসলাম আগের মতই গরীব হয়ে যাবে। এর অর্থ হচ্ছে পূর্বে যেমন এর অনুসারী ছিল খুবই কম, আখেরী যামানায়ও অবস্থা সে রকম হবে। সে সময় অল্প সংখ্যক লোকই সঠিক ইসলামকে মেনে চলবে এবং ইসলামের সাহায্য করবে। যদিও সে সময় মুসলমানদের সংখ্যা প্রচুর হয়। সুতরাং ইসলামের এই অল্প সংখ্যক ধারক ও বাহক লোকদের জন্য রয়েছে সুখবর (তুবা)। তুবা শব্দটিকে একাধিক অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কেউ বলেছেনঃ তুবা হচ্ছে একটি বেহেশতের নাম। আবার কেউ বলেছেনঃ এটি হচ্ছে বেহেশতের একটি বিরাট গাছ।

এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, সত্যিকার ইসলামের সাহায্য করতে চাইলে এবং দৃঢ়ভাবে ইসলামকে ধারণ করতে চাইলে স্বদেশ ত্যাগ করা এবং এ জন্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। ইসলামের প্রথম যুগের অবস্থা এ রকমই ছিল। ইমাম নববী (রঃ) হাদীছের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কাযী ইয়াযের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেনঃ ইসলাম অল্প কয়েকজন মানুষের দ্বারা শুরু হয়েছে। তারপর এর প্রসার ও বিস্তার ঘটেছে। অতঃপর এতে ত্রুটি চলে আসবে এবং শেষ যামানায় অল্প কয়েকজন লোকের মধ্যেই এর অনুসরণ ও অনুশীলন সীমিত হয়ে যাবে। যেমনটি ছিল প্রথম অবস্থায়।

সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের ফতোয়া ও গবেষণা বিভাগের স্থায়ী কমিটির ফতোয়ায় এসেছে, হাদীছের অর্থ হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন লোকদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন, তখন মাত্র অল্প কিছু লোক এই দাওয়াত গ্রহণ করল। সুতরাং তখন এর অনুসারী অল্প হওয়ার কারণে এবং ইসলামের অনুসারীগণ দুর্বল হওয়ার কারণে এটি অপরিচিত ছিল। অপর পক্ষে ইসলামের বিরোধীদের সংখ্যা ছিল প্রচুর, তাদের শক্তি ছিল প্রবল এবং মুসলিমদের উপর তাদের যুলুম ও সীমালংঘন ছিল মাত্রাতিরিক্ত। ফলে মুসলিমদের অনেকেই দ্বীন ও জীবনকে ফিতনা থেকে বাঁচানোর জন্য আবিসিনিয়ায় হিজরত করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষে কঠোর নির্যাতন ভোগ করার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও মদীনায় হিজরত করলেন। এই আশায় যে, হয়ত আল্লাহ্ তাআলা তাঁর দাওয়াতের এমন সমর্থক তৈরী করবেন, যারা তাঁর সাথে যোগ দিয়ে ইসলামের সাহায্য করবেন। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর আশা বাস্তবায়ন করলেন, তাঁর সৈনিকদেরকে সাহায্য করলেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করলেন, ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি পেল এবং পৃথিবীর সর্বত্র ইসলাম ছড়িয়ে পড়ল। আল্লাহ্ তাআলা কুফরের পতন ঘটালেন এবং তাওহীদের কালেমাকে বুলন্দ করলেন। আল্লাহ্ তাআলা মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। বস্ত্ততঃ আল্লাহ্, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদের জন্যই প্রকৃত সম্মান। দীর্ঘ দিন মুসলিমগণ পৃথিবীতে শক্তিশালী ও সম্মানিত ছিল। অতঃপর তাদের মধ্যে দলাদলি শুরু হয়, তাদের মধ্যে দুর্বলতা অনুপ্রবেশ করে। ধীরে ধীরে তারা পশ্চাৎমুখী হতে থাকে। এক পর্যায়ে ইসলাম পূর্বের ন্যায় অসহায় অবস্থায় ফিরে যায়। এবারের এই দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব কিন্তু মুসলিমদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে নয়। দ্বীনকে আঁকড়িয়ে না ধরার কারণে, আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে ধারণ না করার কারণে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হেদায়াতকে বর্জন করার কারণে বর্তমানে মুসলিমগণ দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং মুসলিমদের মাঝেই সঠিক ইসলামের গুরবত প্রকট আকার ধারণ করেছে। অল্প সংখ্যক মুসলিম ব্যতীত বেশীর ভাগ লোকই দুনিয়ার সম্পদ ও সামগ্রী নিয়েই সন্তুষ্ট ও ব্যস্ত রয়েছে। পূর্ববর্তী জাতির ন্যায়ই তারা দুনিয়া অর্জনে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত রয়েছে এবং দুনিয়ার সম্পদ ও নেতৃত্ব দখলের মোহে পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত রয়েছে। এতে ইসলামের শত্রুরা সুযোগ পেয়েছে। তারা মুসলিম দেশগুলোতে অনুপ্রবেশ করেছে এবং তাদেরকে অপমানিত-অপদস্ত করেছে ও তাদের উপর কঠিন জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে। এটিই হচ্ছে ইসলামের গুরবত, যে অবস্থায় ইসলামের সূচনা হয়েছিল।

শাইখ মুহাম্মাদ রশীদ রেযাসহ এক দল আলেম মনে করেন, অত্র হাদীছে দ্বিতীয়বার ইসলামের দুর্বলতার পর ইসলামের বিজয়ের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীঃ وسيعود غريباً كما بدأঅচিরেই সূচনার ন্যায় অবহেলিত অবস্থায় ফেরত যাবে। সুতরাং প্রথমবারের দুর্বলতার পর যেমন ইসলামের বিজয় অর্জিত হয়েছে এবং ইসলামের প্রসার ঘটেছে, তেমনি দ্বিতীয়বার দুর্বলতার পর পুনরায় ইসলামের বিজয় ও প্রসার ঘটবে। এই মতটিই অধিক প্রসিদ্ধ। আখেরী যামানায় ইমাম মাহদী এবং ঈসা (আঃ)এর অবতরণের হাদীছসমূহে এ বিষয়টির সমর্থন পাওয়া যায়। সে সময় ইসলাম ছড়িয়ে পড়বে এবং মুসলিমগণ শক্তিশালী ও বিজয়ী থাকবে। কুফর ও কাফের সম্প্রদায় পরাস্ত ও পদদলিত হবে।

[7] - ফিতনা শব্দের মূল অর্থ হচ্ছে বিরত রাখা, ফিরে যাওয়া, পরিবর্তিত হওয়া ইত্যাদি। এই অর্থেই আল্লাহর এই বাণীতে ফিতনা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

فَإِنَّكُمْ وَمَا تَعْبُدُونَ (161) مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ بِفَاتِنِينَ (162) إِلَّا مَنْ هُوَ صَالِ الْجَحِيمِ

‘‘কাজেই তোমরা ও তোমাদের এ উপাস্যরা কাউকে আল্লাহ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না, সে ব্যক্তিকে ছাড়া যে জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত আগুনে প্রবেশকারী হবে’’। (সূরা সাফফাতঃ ১৬১-১৬২) এখানে বলা হয়েছে, হে মুশরেকের দল! তোমরা এবংতোমাদের ঐসব মাবুদ, যাদেরকে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আহবান করে থাকো, তারা কোন মুমিনকেই ঈমান থেকে ফিরিয়ে কুফরীর দিকে নিতে পারবেনা। তবে যাকে আল্লাহ হতভাগ্য বলে জানেন এবং যে ব্যক্তি জাহান্নামী হবে, তার কথা ভিন্ন।

সুতরাং যে ব্যক্তি মুমিন ছিল, সে যদি কাফের হয়ে যায়, তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয় فلان فتن অর্থাৎ অমুক ব্যক্তি ফিতনায় পড়েছে। অর্থাৎ সে ঈমানদার মুসলিম ছিল অতঃপর সে ফিতনায় পড়েছে এবং কল্যাণের পথ ছেড়ে অকল্যাণের পথ ধরেছে ও ঈমানের পথ ছেড়ে কুফুরীর পথে চলেছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ ফিতনা হত্যার চেয়েও অধিক ভয়াবহ। অর্থাৎ মানুষকে ঈমান থেকে ফিরিয়ে কুফুরীর দিকে নিয়ে যাওয়া তাদেরকে হত্যা করার চেয়েও অধিক ক্ষতিকর।

সুতরাং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ)এর কথার অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি রাসূলের হাদীছ প্রত্যাখ্যান করে এবং মানুষের কথার দিকে যায়, তার ব্যাপারে আশঙ্কা আছে যে, তাকে মানুষের কথা একটু একটু ফিতনার (কুফুরীর) দিকে নিয়ে যেতে পারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ প্রত্যাখ্যানের শাস্তি স্বরূপই তাকে সেদিকে নিয়ে যাওয়া হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ثُمَّ انصَرَفُوا صَرَفَ اللَّهُ قُلُوبَهُم بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَّا يَفْقَهُونَ ‘‘অতঃপর তারা চুপে চুপে সরে পড়ল৷ আল্লাহও তাদের মন বিমুখ করে দিয়েছেন কারণ তারা এমন একদল লোক যাদের বোধশক্তি নেই’’। (সূরা বাকারাঃ ১২৭) যেমন আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃفَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ ۚ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ ‘‘অতঃপর যখন তারা বাঁকা পথ ধরলো তখনই আল্লাহও তাদের দিল বাঁকা করে দিলেন৷ আল্লাহ ফাসেকদের হেদায়াত করেন না’’। (সূরা সাফঃ ৫)

[8] - আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ ثَالِثُ ثَلَاثَةٍ ۘ وَمَا مِنْ إِلَٰهٍ إِلَّا إِلَٰهٌ وَاحِدٌ ۚ وَإِن لَّمْ يَنتَهُوا عَمَّا يَقُولُونَ لَيَمَسَّنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

‘‘নিঃসন্দেহে তারা কুফরী করেছে যারা বলেছে, আল্লাহ তিনের মধ্যে এক৷ অথচ এক ইলাহ্ ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ নেই। যদি তারা নিজেদের এসব কথা থেকে বিরত না হয়, তাহলে তাদের মধ্য থেকে যারা কুফরী করেছে তাদেরকে যন্ত্রণা দায়ক শাস্তি দেয়া হবে’’। (সূরা মায়িদাঃ ৭৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ۖ ذَٰلِكَ قَوْلُهُم بِأَفْوَاهِهِمْ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن قَبْلُ ۚ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ ۚ أَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ

‘‘ইহুদীরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং খৃস্টানরা বলে, মসীহ আল্লাহর পুত্র৷এগুলো একেবারেই আজগুবী ও উদ্ভট কথাবার্তা৷ তাদের পূর্বে যারা কুফরিতে লিপ্ত হয়েছিল তাদের দেখাদেখি তারা এগুলো নিজেদের মুখে উচ্চারণ করে থাকে। আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক তাদের উপর, তারা কোথা থেকে ধোকা খাচ্ছে! তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের উলামা ও দরবেশদেরকে নিজেদের রব বানিয়ে নিয়েছে এবং এভাবে মারইয়াম পুত্র মাসীহকেও৷ অথচ তাদেরকে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর এবাদত করার হুকুম দেয়া হয়নি। তিনি ছাড়া এবাদতের যোগ্যতা সম্পন্ন আর কোন সত্য ইলাহ নেই৷ তারা যেসব মুশরিকী কথা বলে তা থেকে তিনি পাক পবিত্র’’। (সূরা তাওবাঃ ৩০-৩১)

সুতরাং যেসব খৃষ্টান বলে মসীহ ইবনে মারইয়ামই আল্লাহ, যারা বলে আল্লাহ তিন মাবুদের এক মাবুদ এবং যারা বলেঃ ঈসা ইবনে মারইয়াম আল্লাহর পুত্র- এই তিন দলের সকলেই কাফের।

[9] - তিনি হচ্ছেন, বিখ্যাত মুফাস্সির এবং প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবু জাফর মুহাম্মাদ বিন জারীর তাবারী। তিনি ৩১০ হিজরী সালে ইন্তেকাল করেন। বিস্তারিত দেখুনঃ তাবাকাতুস শাফেঈয়া (৩/১২০), ওফীয়াতুল আয়ান (১/৩৩২), শাযরাতুয্ যাহাব (২/২৬০)।

[10] - তিনি হচ্ছেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক আল্লামা ইমাম ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ বিন কামিল আল ইয়ামানী। তিনি কিচ্ছা ও ঘটনাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধতা অর্জন করেন। মুহাদ্দিছগণ তাঁর সমালোচনা করেছেন। অর্থাৎ হাদীছ বর্ণনায় তিনি মুহাদ্দিছদের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। তিনি ১১৪ হিজরী সালে ইন্তেকাল করেন। বিস্তারিত দেখুনঃ সিয়ারু আলামিন্ নুবলা (৪/৫৪৪) , আল ইবার (১/১০৯-১১৩), শাযারাতুয্ যাহাব (১/১৫০)।
তাওহীদের ফযীলত এবং তাওহীদ যে সমস্ত গুনাহ্ মিটিয়ে দেয় - ২

উপরে বর্ণিত হাদীছে আল্লাহ্ এবং নবী-রাসূলদের শত্রু ইহুদীদেরও প্রতিবাদ করা হয়েছে। ইহুদী-খৃষ্টান, -এই উভয় দলই ঈসা (আঃ)এর ব্যাপারে পরস্পর বিরোধী কথা বলে। আল্লাহর দুশমন ইহুদীরা বলেঃ ঈসা (আঃ) জারজ সন্তান। আল্লাহ্ এদেরকে ধ্বংস করুন। আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় কিতাবে তাদের কথাকে মিথ্যায়ন করেছেন, তাদেরকে মিথ্যুক বলেছেন এবং তাদের ধারণাকে বাতিল করে দিয়েছেন। এমনি উপরোক্ত এবং অন্যান্য আয়াতে ঈসা (আঃ)কে নিয়ে খৃষ্টানদের বাড়াবাড়িরও প্রতিবাদ করেছেন। সুতরাং খৃষ্টানরা ঈসা (আঃ)এর বিষয়ে সীমালঙ্ঘন, বাড়াবাড়ি, কুফরী ও গোমরাহীতে লিপ্ত রয়েছে। অপর পক্ষে ইহুদীরা তাঁর সাথে মারাত্মক দুর্ব্যবহার করেছে। উভয় দলই প্রকাশ্য গোমরাহীর মধ্যে রয়েছে। কুরআনের অনেক স্থানেই আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই গোমরাহীর বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এ ব্যাপারে মূল সত্যটি পরিস্কারভাবে বর্ণনা করার মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর শানকে উন্নীত করেছেন এবং তাঁকে পাঁচজন উলুল আযম রাসূলদের কাতারে শামিল করেছেন। সূরা আহযাব ও শুরায় তাদের বর্ণনা একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা আহযাবের ৭ নং আয়াতে বলেনঃ

وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا

‘‘যখন আমি নবীগণের কাছ থেকে, তোমার কাছ থেকে এবং নূহ, ইব্রাহীম, মূসা ও মারইয়ামের পুত্র ঈসার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম এবং অঙ্গীকার নিলাম তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার। আর সূরা শুরার ১৩ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ

‘‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারণ করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি তোমার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করোনা। তুমি মুশরিকদেরকে যে বিষয়ের প্রতি আমন্ত্রণ জানাও, তা তাদের কাছে দুঃসাধ্য বলে মনে হয়। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন এবং যে তাঁর অভিমূখী হয়, তাকে পথ প্রদর্শন করেন’’। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উলুল আযম রাসূলদের ন্যায় সবর করার আদেশ দিয়েছেন। সূরা আহকাফের ৩৫ নং আয়াতে তিনি বলেনঃ

فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُوْلُوا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِلْ لَهُمْ

‘‘অতএব, তুমি সবর করো, যেমন সুদৃঢ় মনোবলের অধিকারী রাসূলগণ সবর করেছেন এবং ওদের বিষয়ে তড়িঘড়ি করবে না’’।

উপরোক্ত ব্যাখ্যা থেকে জানা গেল, সমস্ত নবী-রাসূলের মধ্যে উলুল আযম রাসূলগণ তথা নূহ, ইবরাহীম, মুসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বাধিক উত্তম। এদের মধ্যে এবং অন্যান্য সকল নবী-রাসূলদের মধ্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বোত্তম। তাঁর উপর এবং সকল নবী-রাসূলের উপর এবং কিয়মাত পর্যন্ত উত্তমভাবে তাদের অনুসরণকারীদের উপর আল্লাহর দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক।

জান্নাত সত্যঃ এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হল এই বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ্ তাআলা মুমিন বান্দাদের জন্য জান্নাত তৈরী করে রেখেছেন। কিয়ামতের দিন তারা এতে প্রবেশ করবে। এটি চিরকাল থাকবে। এতে রয়েছে সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ, ফলফলাদি, চিরস্থায়ী নেয়ামত এবং আল্লাহর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকার স্বাদসহ অফুরন্ত নেয়ামত। আল্লাহ্ তাআলা সূরা হুদের ১০৮ নং আয়াতে বলেনঃ

وَأَمَّا الَّذِينَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ عَطَاءً غَيْرَ مَجْذُوذٍ

‘‘আর যারা সৌভাগ্যবান তারা অবস্থান করবে বেহেশতের মাঝে, সেখানেই চিরদিন থাকবে, যতদিন আসমান ও যমীন বর্তমান থাকবে। তবে তোমার প্রতিপালক অন্য কিছু ইচ্ছা করলে ভিন্ন কথা। এ দানের ধারাবাহিকতা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়’’। আল্লাহ্ তাআলা সূরা সিজদার ১৭ নং আয়াতে বলেনঃ

فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاء بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

‘‘কেউ জানেনা তাদের কৃতকর্মের জন্য নয়ন শীতলকারী কী প্রতিদান লুকায়িত আছে’’।

জাহান্নাম সত্যঃ এই সাক্ষ্য দানের তাৎপর্য হল, মুমিনগণ এই বিশ্বাস করবে যে, জাহান্নাম হচ্ছে আযাবের স্থান। যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করবে, তাঁর এবাদত, প্রভুত্ব ও মালিকানায় শির্ক করবে এবং তাঁর নাম ও গুণাবলীতে পরিবর্তন করবে, তিনি তাদের জন্য এটি প্রস্ত্তত রেখেছেন। কিয়ামতের দিন তারা তাতে প্রবেশ করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি ঈমান আনবেনা সে কুরআন এবং রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন, তার প্রতি কুফরী করল। কেননা আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে জান্নাত ও জান্নাতের চিরস্থায়ী নেয়ামতের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি আরো বর্ণনা করেছেন যে, জান্নাত হচ্ছে আল্লাহ্ ভীরুদের বাসস্থান। আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে জাহান্নামের বর্ণনাও দিয়েছেন এবং তাতে যে শাস্তি রয়েছে, তারও বিবরণ দিয়েছেন। আর এটিকে তিনি কাফের-মুশরিকদের জন্য তৈরী করে রেখেছেন।

তাকে আল্লাহ তাআলা জান্নাত দান করবেন, তার আমল যাই হোক না কেনঃ অর্থাৎ যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দিল যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরিক নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, তিনি তাঁর এমন এক কালিমা, যা তিনি মারইয়াম (আঃ) এর প্রতি প্রেরণ করেছেন এবং তিনি তাঁরই পক্ষ থেকে প্রেরিত একটি রুহ। জান্নাত সত্য জাহান্নাম সত্য, আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত দান করবেন। তার আমল যাই হোক না কেন। অর্থাৎ তাঁর ইখলাস তথা একনিষ্ঠতার সাথে উপরোক্ত বিষয়গুলোর ঘোষণা দেয়ার কারণে, সত্য বিষয়গুলোর সত্যায়ন করার কারণে, নবী-রাসূলদের প্রতি এবং তাদেরকে যেই নবুওয়াত ও রেসালাত দেয়া হয়েছে, তার প্রতি ঈমান আনয়নের কারণে, খৃষ্টান ও ইহুদীরা ঈসা (আঃ)এর ব্যাপারে যেই বাড়াবাড়ি ও দুর্ব্যবহার করেছে তার প্রতিবাদ ও বিরোধীতা করার কারণে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সে ঈসা (আঃ)এর ব্যাপারে আরও দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেছে যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতিও ঈমান আনয়ন করেছে। যার আমল ও অবস্থা এই রকম হবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যদিও সৎকর্ম সম্পাদনে তার ত্রুটি রয়েছে এবং তাঁর বেশ কিছু গুনাহ্ও রয়েছে। এ সৎআমলটি অর্থাৎ নির্ভেজাল তাওহীদের ঘোষণা অন্যান্য সকল গুনাহ্-এর তুলনায় ভারী হয়ে যাবে। হে পাঠক! আপনি এই গুরুত্বপূর্ণ হাদীছটি ভাল করে বুঝে নিন।

ইমাম বুখারী ও মুসলিম সাহাবী ইতবান রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

«فَإِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ يَبْتَغِى بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ»

‘‘আল্লাহ তাআলা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে’’।[11]

............................................................

ব্যাখ্যাঃ এটি বুখারী ও মুসলিম শরীফের একটি দীর্ঘ হাদীছের অংশ। লেখক তা থেকে শুধু ঐ টুকুই বর্ণনা করেছেন, যা এ অধ্যায়ের জন্য প্রযোজ্য। কালেমায়ে তায়্যেবার এটিই প্রকৃত অর্থ। এ পবিত্র বাক্যটি এবাদতের মধ্যে ইখলাসের দাবী জানায় এবং শির্ককে সম্পূর্ণরূপে নাকোচ করে। সিদ্ক এবং ইখলাস এই দু’টি বিষয় এমন, যার একটি অন্যটির সাথে জড়িত। এ দু’টির একটিকে অন্যটি ছাড়া কল্পনাও করা যায়না। বান্দা যদি এবাদতের মধ্যে একনিষ্ঠ না হয়, তাহলে সে মুশরিক হিসাবে গণ্য হবে। আর যদি সত্যবাদী না হয়, তাহলে মুনাফেক হিসাবে গণ্য হবে। মুখলিস হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে কালেমায়ে তাওহীদ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’কে জবান দিয়ে পাঠ করার সাথে সাথে খালেসভাবে কেবল আল্লাহর এবাদত করে। এর নামই তাওহীদ। এটিই ইসলামের মূল কথা। ইবরাহীম (আঃ) এই বিষয়ে বলেছেনঃ

رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

‘‘হে আমাদের রব! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ করো এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি করো, আমাদের হজ্জের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা করো। নিশ্চয়ই তুমি তাওবা কবুলকারী, দয়ালু’’। (সূরা বাকারাঃ ১২৮) ইয়ামানের সাবা শহরের রাণী বিলকীস বলেছিলঃ

رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي وَأَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

‘‘হে আমার প্রতিপালক, আমি তো নিজের প্রতি যুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক আল্লাহ্‌র কাছে আত্মসমর্পন করলাম’’। (সূরা নামলঃ ৪৪) ইবরাহীম খলীল (আঃ) বলেছিলেনঃ

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيفاً وَمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘‘আমি একনিষ্ঠ হয়ে স্বীয় চেহারা ঐ সত্তার দিকে ফিরাচ্ছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই’’। (সূরা আনআমঃ ৭৯) হানীফ ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে সম্পূর্ণরূপে শির্ক বর্জন করে, শির্কের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল আমল ও এবাদত কেবল আল্লাহ্ তাআলার জন্যই সম্পাদন করে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা লুকমানের ২২ নং আয়াতে বলেনঃ

وَمَن يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى

‘‘যে ব্যক্তি সৎকর্মপরায়ণ হয়ে স্বীয় মুখমণ্ডলকে আল্লাহ্ অভিমুখী করে, সে এক মজবুত হাতল ধারণ করে’’। মুখমণ্ডলকে আল্লাহ্ অভিমুখী করার অর্থ হচ্ছে, বান্দা তাঁর এবাদতকে একমাত্র আললাহর জন্য এমনভাবে খালেস করবে যে, তাতে যেন কোন প্রকার শির্ক বা নিফাক স্থান না পায়। আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে এটিই হচ্ছে এ আয়াত এবং অন্যান্য আয়াতের অর্থ। যার অবস্থা এ রকম হবে, কালেমায়ে তাইয়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ কেবল তারই উপকার করবে। এ জন্যই আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى ‘‘সে এক মজবুত হাতল ধারণ করল’’।[12] কিন্তু যে ব্যক্তি কালেমায়ে তাওহীদ পাঠ করার সাথে সাথে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যকে আহবান করবে, জীবিত কিংবা মৃত এমন অলীর কাছে সাহায্য চাইবে, যে উপকার কিংবা ক্ষতির মালিক নয় তার কালেমা পাঠ কোন উপকার করবেনা। অধিকাংশ বনী আদমের অবস্থা বর্তমানে এ রকমই। তারা জবানের মাধ্যমে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করলেও তাদের কাজ তাদের কথার বিপরীত। কালেমায়ে তাওহীদ তখনই পাঠকের উপকারে আসবে যখন সে নেতিবাচক ও ইতিবাচকের সাথে এর অর্থ ভালভাবে উপলদ্ধি ও বিশ্বাস করার পরই তা পাঠ করবে। কালেমাটির অর্থ সম্পর্কে যে ব্যক্তি অজ্ঞ, কালেমাটি তাঁর কোন উপকার করবেনা।[13] কেননা আরবী ভাষায় যে অর্থে এই পবিত্র বাক্যটি তৈরী করা হয়েছে তা সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আর তা হচ্ছে শির্ককে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা। এমনিভাবে যে ব্যক্তি এর অর্থ জানবে ও বুঝবে, কিন্তু অন্তর দিয়ে তা বিশ্বাস করবেনা, কালেমাটি তারও কোন উপকার করবেনা। কেননা যখন কোন বিষয়ে কারো ইয়াকীন চলে যাবে, তখন ঐ বিষয়ে তার অন্তরে সন্দেহ প্রবেশ করবে। এ জন্যই মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায়غَيْرَ شَاكٍ কথাটি এসেছে। অর্থাৎ কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করার সময় আল্লাহ্ তাআলার ওয়াহ্দানিয়াত সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করলে কোন উপকার হবেনা। সুতরাং ইলম ও ইয়াকীন ব্যতীত কালেমাটি পাঠ করলে পাঠকের কোন উপকার হবেনা। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ صِدْقًا مِنْ قَلْبِهِ خَالِصاً مِنْ قَلْبِهِ অর্থাৎ পূর্ণ বিশ্বাস এবং একনিষ্ঠতার সাথে কালেমাটি পাঠ করলেই উপকার হবে। এমনি যে ব্যক্তি সত্যবাদী এবং একনিষ্ঠ না হয়ে কালেমাটির স্বীকারোক্তি প্রদান করবে, ঐ ব্যক্তির জন্য কালেমাটি উপকারী হবেনা। কেননা তাঁর অন্তর মুখের স্বীকারোক্তির বিরোধী। মুনাফিকদের অবস্থা এ রকমই। তারা মুখে এমন কথা বলে, যা তাদের অন্তরে নেই। এমনি অবস্থা মুশরিকদেরও। মুশরিকদের থেকেও এই কালেমাটি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা র্শিক এবাদতের ক্ষেত্রে ইখলাস ও কালেমায়ে তাওহীদের তাৎপর্যের পরিপন্থী। কালেমায়ে তাওহীদ যেমন আল্লাহর কোন শরীক হওয়াকে অস্বীকার করে, তেমনি শির্কের সাথে সম্পর্কচ্ছেদেরও ঘোষণা দেয় এবং একমাত্র আল্লাহর জন্য পরিপূর্ণ ইখলাসেরও প্রমাণ বহন করে। সুতরাং যার স্বীকারোক্তি এই মর্মার্থ হতে মুক্ত হবে, তার এ কালেমার স্বীকারোক্তি কোন কাজে আসবেনা। এটিই হচ্ছে মাজার পূজারীদের অবস্থা। তারা মুখে বলে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’। কিন্তু তারা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, তারা তাওহীদপন্থীদের সাথে শত্রুতাও পোষণ করে এবং শির্ক ও মুশরিকদের সাহায্যও করে। ইবরাহীম খলীল (আঃ) তাঁর পিতা ও স্বগোত্রীয় লোকদেরকে বলেছিলেনঃ

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاء مِّمَّا تَعْبُدُونَ إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِهِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

‘‘আর যখন ইবরাহীম তার পিতা এবং তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা যাদের পূজা কর, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তবে আমার সম্পর্ক তাঁর সাথে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব, তিনিই আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করবেন। এ কথাটিকে তিনি অক্ষয় বাণী স্বরূপ তার সন্তানদের মধ্যে রেখে গেছেন, যাতে তারা আল্লাহ্‌র দিকেই ফিরে আসে’’। (সূরা যুখরুফঃ ২৬-২৮) এটিই হচ্ছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর সঠিক অর্থ। ইবরাহীম খলীল (আঃ) তাঁর জবানের মাধ্যমে এই অর্থটিকেই প্রকাশ করেছেন। এই অর্থটির জন্যই কালেমাটি গঠন করা হয়েছে এবং তা এই অর্থই প্রকাশ করে। সেটি হচ্ছে শির্ক থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহর এবাদত করা, এতে তার কোন শরীক নেই। ইতিপূর্বে এর বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। এমনিভাবে যে ব্যক্তি কালেমাটি পাঠ করবে, কিন্তু এটি যেই ইখলাসের প্রমাণ বহন করে, তা কবুল করেনি, সে এই বাক্যটি পাঠে মিথ্যুক হিসাবে গণ্য হবে। শুধু তাই নয়; বরং এই কালেমাটির অর্থ পরিবর্তনকারী হিসাবে গণ্য হবে, কালেমায়ে তায়্যেবা যেই শির্ককে অস্বীকার করেছে, সেটিকেই সাব্যস্ত করবে এবং এটি যেই ইখলাসকে সাব্যস্ত করে তা অস্বীকারকারী হিসাবে গণ্য হবে।

ইসলামের প্রথম তিন যুগের পর উম্মতে মুহাম্মাদীর অধিকাংশ লোকের অবস্থা এ রকমই। এর কারণ হচ্ছে, কালেমায়ে তাওহীদের অর্থ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করা। এই মূর্খতা ও প্রবৃত্তির অনুসরণই মানুষকে সত্য গ্রহণ এবং আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য যেই দ্বীন ও তাওহীদসহ নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন তা কবুল করতে বাধা দেয়।

প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি এরশাদ করেছেন, মূসা (আঃ) বললেনঃ হে আমার রব! আমাকে এমন জিনিস শিক্ষা দিন যা দ্বারা আমি আপনাকে স্মরণ করব এবং আপনাকে ডাকব। আল্লাহ বললেন, ‘হে মূসা! তুমি لا إله إلا الله বল। মূসা বললেনঃ তোমার সব বান্দাই তো এটা বলে। তিনি বললেনঃ হে মূসা! আমি ব্যতীত সপ্তাকাশে যা কিছু আছে তা আর সাত তবক যমীন যদি এক পাল্লায় থাকে এবং আরেক পাল্লায় যদি শুধু لا إله إلا الله থাকে তাহলেلا إله إلا الله -এর পাল্লাই বেশী ভারী হবে’’।[14]

..............................................................

ব্যাখ্যাঃ لا إله إلا الله-এর মধ্যে ব্যবহৃত لا অক্ষরটি লায়ে নফী জিন্স। এই প্রকার لا এর পরে যে বিষয়টি আসে, লা-এর মাধ্যমে উক্ত বিষয়ের সকল প্রকারকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে শুধু إلا-এর পরে উল্লেখিত বিষয়টির জন্য তা সাব্যস্ত করা হয়। সুতরাং এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। এখানে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর তা হচ্ছে لا- এর খবর উহ্য রয়েছে। মূলতঃ বাক্যটি এরূপ لاإله حق إلا الله অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই।[15] সূরা হজ্জের ৬২ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ

‘‘এটা এ কারণে যে, আল্লাহ্ই সত্য; তার পরিবর্তে তারা যাকে ডাকে, তা অসত্য এবং আল্লাহ্ই সবার উচ্চে’’। সুতরাং আল্লাহই সত্য ইলাহ্। তিনিই এবাদতের একমাত্র হকদার। তিনি ব্যতীত যত ইলাহ আছে, তার সবই বাতিল। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে এই আয়াতে এবং অন্যান্য আয়াতসমূহে।

সুতরাং এটিই অর্থাৎ لا إله إلا الله হচ্ছে মহান কালেমা, এটিই মজবুত হাতল, এটিই কালিমাতুত তাকওয়া এবং এটিই কালিমাতুল ইখলাস। এর উপরই আসমান-যমীনের ভিত্তি, এর পূর্ণতার জন্যই ফরয ও সুন্নাতসমূহকে শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে, পৃথিবীতে এর শিক্ষা ও দাবীকে বাস্তবায়নের জন্যই তলোয়ার কোষমুক্ত করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমেই আল্লাহর বান্দাদের মধ্য হতে অনুগত ও নাফরমান বান্দাদের মধ্যে পার্থক্য হয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি সত্যায়ন, ইখলাস, মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নিয়ে, মুহাববত এবং বিনয়ের সাথে এই বাক্যটি পাঠ করবে এবং এর উপর আমল করবে, আল্লাহ্ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তার আমল যাই হোক না কেন।

সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

أَفْضَلُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ وَأَفْضَلُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّونَ مِنْ قَبْلِى لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهْوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ

‘‘সর্বোত্তম দুআ হচ্ছে আরাফা দিবসের দুআ। আমি এবং আমার পূর্বের নবীগণ যা বলেছেন, তার মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছেঃ

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهْوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ

আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি একক। তাঁর কোনো শরীক নেই। মালিকানা তাঁরই। সমুদয় প্রশংসা তাঁরই জন্য। তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান’’।[16]

আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে মারফু সূত্রে বর্ণিত হাদীছে এসেছে, কিয়ামতের দিন সমস্ত সৃষ্টির সামনে আমার উম্মতের একজন লোকের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকা হবে এবং তার সামনে ৯৯টি রেজিষ্টার বই খোলা হবে। চোখের দৃষ্টি যত দূর যায়, ততদূর লম্বা হবে এক একটি রেজিষ্টার। অতঃপর তাকে বলা হবে, তুমি কি এ সমস্ত আমল থেকে কোনো কিছু অস্বীকার করতে পারবে? সে বলবেঃ হে আমার প্রতিপালক! না। কোন কিছুই অস্বীকার করতে পারবনা। তাকে বলা হবেঃ তোমার কোন ওজর (অযুহাত) আছে কি? অথবা তোমার কোন নেকী আছে কি? তখন লোকটি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলতে থাকবেঃ না, আমার কোন নেক আমল নেই। অতঃপর বলা হবেঃ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমাদের কাছে তোমার একটি নেকী রয়েছে। তোমার উপর কোন প্রকার যুলুম করা হবেনা। অতঃপর তার জন্য একটি কার্ড বের করা হবে। তাতে লেখা থাকবেঃ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোনো সত্য উপাস্য নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল। লোকটি তখন বলবেঃ হে আমার প্রতিপালক! এত বিশাল বিশাল বইগুলোর সামনে এই কার্ডটির কোন মূল্য আছে কি? তখন তাকে বলা হবেঃ তোমার উপর কোন রকম যুলুম করা হবেনা। এ কথা বলার পর রেজিষ্টারগুলো রাখা হবে এক পাল্লায় এবং কার্ডটি রাখা হবে আরেক পাল্লায়। এতে বইগুলোর পাল্লা হালকা হয়ে যাবে এবং কার্ডটির পাল্লা ভারী হয়ে যাবে।[17]

আমি ব্যতীত সপ্তাকাশে যা কিছু আছে তা, আর সাত যমীন যদি এক পাল্লায় রাখা হয়ঃ এখানে আসমান ও যমীনে যা আছে, তার সবই উদ্দেশ্য। আর আমি ব্যতীত এ কথার মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় সত্তাকে আসমানবাসী থেকে আলাদা করেছেন। কেননা তার পবিত্র সত্তা সব কিছুর উর্ধ্বে। আল্লাহ্ তাআলা সুরা বাকারার ২৫৫ নং এবং সূরা শুরার ৪ নং আয়াতে বলেনঃ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ ‘‘তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান’’। অর্থাৎ তার ক্ষমতা সর্বোচ্চ, তার মর্যাদা সর্বোচ্চ এবং তার সত্তা সকলের উর্ধ্বে। ক্ষমতা, মর্যাদা এবং উঁচু হওয়া- এই তিনটির প্রত্যেকটিই আল্লাহর সিফাত। এগুলো আললাহ্ তাআলার কামালিয়াতের প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى

‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা তোহাঃ ৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ الرَّحْمَانُ

‘‘অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন। তিনি পরম দয়াময়’’। (সূরা ফুরকানঃ ৫৯) এভাবে কুরআনের সাতটি আয়াতে আল্লাহ্ তাআলার আরশে সমুন্নত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ

‘‘তাঁর কাছে শুধু পবিত্র কথাই উপরের দিকে আরোহণ করে এবং তিনি সৎকর্ম উন্নীত করেন’’। (সূরা ফাতিরঃ ১০) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

يَخَافُونَ رَبَّهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ

‘‘তারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, যিনি তাদের উপরে’’। (সূরা নাহ্লঃ ৫০) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

تَعْرُجُ الْمَلاَئِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ

‘‘ফেরেশতা এবং রূহ (জিবরীল) তাঁর দিকে উর্ধ্বগামী হয় এমন একদিনে যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর।’’। (সূরা মাআরেজঃ ৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

إِذْ قَالَ اللَّهُ يَاعِيسَى إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ

‘‘আল্লাহ যখন বললেনঃ হে ঈসা! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে মৃত্যু দান করবো[18] এবং তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নেব’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৫৫) এ রকম আরো অনেক আয়াত রয়েছে যা প্রমাণ করে আল্লাহ্ তাআলা উপরে সমুন্নত। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তাআলা মাখলুকের উপরে থাকার গুণটি অস্বীকার করল, সে কুরআন ও সুন্নাহ্র সুস্পষ্ট দলীলের বিরোধীতা করল এবং আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে পরিবর্তন ও বিকৃতি করল। উপরোক্ত হাদীছাংশে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য সকল বস্ত্তর উলুহীয়াত ও উবুদীয়াতকে অস্বীকার করা হয়েছে। উপরোক্ত হাদীছে আরো প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আসমানের ন্যায় যমীনও সাতটি।

এই বিশাল বিশাল সৃষ্টির মুকাবেলায় কেবল ঐ ব্যক্তির ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’র পাল্লা ভারী হবে যে কুরআন ও সুন্নাহ্য় বর্ণিত শর্তসহ এই মহান বাক্যটি পাঠ করবে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সূরা তাওবা এবং অন্যান্য সূরায় এমন অনেক লোকের আলোচনা করেছেন, যারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলে, কিন্তু এই পবিত্র বাক্যটি তাদের কোন উপকারে আসবেনা। ইহুদী, খৃষ্টান ও মুনাফেকদের অবস্থা এমনই। এদের সংখ্যা প্রচুর। এদের নিফাকীও বহুরূপী। তাদের স্বীকারোক্তি কোন কাজে আসেনি। কেননা তারা শর্তগুলো পালন সাপেক্ষ এই কালেমাটি পাঠ করেনি। তাদের কেউ কালেমার মর্ম না জেনেই তা পাঠ করেছে। অর্থাৎ যে অর্থে কালেমাটি তৈরী করা হয়েছে, তা না জেনেই পাঠ করছে। এই কালেমাটির মাকসুদ হচ্ছে শির্ক প্রত্যাখ্যান করা এবং তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া। সেই সাথে সত্যকে মনেপ্রাণে কবুল করা এবং ইখলাসের সাথে আল্লাহর এবাদত করাই এই কালেমার মাকসুদ। এ ছাড়া যে ব্যক্তি এই কালেমার অন্য কোন অর্থ বুঝার এবং তার উপর আমল করার আহবান জানায়, তার কথা গ্রহণ করা যাবেনা। এই কালেমার দাবী অনুযায়ী আনুগত্য বর্জন করা কালেমার মাকসুদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অতীত ও বর্তমানের অধিকাংশ লোকের অবস্থা এ রকমই। তারা কালেমা পাঠ করলেও এর অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল করতেও তারা প্রস্ত্তত নয়। পরবর্তী কালের অধিকাংশ লোকের অবস্থা এ রকমই।

কতক লোক এমন আছে, যাদের অন্তরে অহংকার, কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ এবং অন্যান্য দোষ-ত্রুটি থাকার কারণে কালেমার প্রতি ভালবাসা পোষণ করতে এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সূরা তাওবার ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ

‘‘বলোঃ তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা, যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যাকে তোমরা পছন্দ কর, এসব কিছু আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ্‌র বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ্ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না’’।

সুতরাং খাঁটি ঈমানদারগণ যখন জবান দিয়ে এই কালেমাটি পাঠ করে, তখন অন্তর দিয়ে অনুধাবন করেই পাঠ করে এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল করে। তারা কালেমার শর্তগুলোও বাস্তবায়ন করে।[19] শর্তগুলো হচ্ছে, কালেমার অর্থ জানা, তা নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করা, সত্যায়ন করা, একনিষ্ঠতা, এর মর্মার্থকে ভালবাসা, কবুল করে নেওয়া এবং অনুগত হওয়া। সেই সঙ্গে তারা কেবল আল্লাহর জন্যই কারও সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং আল্লাহর জন্যই কাউকে বন্ধু বানায়। কাউকে ভালবাসা বা ঘৃণা করার ক্ষেত্রেও কথা একই। সত্যিকার মুমিনদের অবস্থা আল্লাহ্ তাআলা সুরা তাওবায় এবং কুরআনের অন্যান্য স্থানে আলোচনা করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা তাদের প্রশংসা করেছেন, তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেছেন, তাদের জন্য জান্নাত তৈরী করেছেন এবং জাহান্নাম থেকে তাদেরকে পরিত্রাণ দেয়ার ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاَةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللّهَ وَرَسُولَهُ أُوْلَـئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللّهُ إِنَّ اللّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

‘‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে। অচিরেই এদের উপর আল্লাহ্ দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান’’। (সূরা তাওবাঃ ৭১) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَالسَّابِقُونَ الأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللّهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَداً ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

‘‘আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনসারদের মাঝে অগ্রগামী এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ্ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন বেহেশত, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হল মহান সফলতা’’। (সূরা তাওবাঃ ১০০) এ রকম আরো অনেক আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা খাঁটি ঈমানদারদের প্রশংসা এবং পরকালে তাদের জন্য প্রস্ত্ততকৃত নেয়ামতের আলোচনা করেছেন। এ সমস্ত সাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসারীগণই হচ্ছেন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর প্রকৃত অনুসারী।

যে ব্যক্তি কুরআন নিয়ে গবেষণা করবে, সে আল্লাহ্কে ভালবাসার ক্ষেত্রে, তার তাওহীদের ক্ষেত্রে, তার আনুগত্যের ক্ষেত্রে, তার নাফরমানী থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে, আগ্রহ ও আমলসহ আল্লাহর প্রিয় বস্ত্তকে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে এবং ভয়-ভীতিসহ আল্লাহর অপছন্দনীয় বস্ত্ত বর্জন করার ক্ষেত্রে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখতে পাবে। এমনি সে ব্যক্তি মানুষের অবস্থা, কথা-বার্তা, কর্ম, নিয়ত-উদ্দেশ্য এবং তাদের মধ্যে অন্যান্য বিষয়ে বিরাট পার্থক্য দেখতে পাবে এবং তার কাছে অহংকারী ও দাম্ভিক লোকদের বিভ্রান্তি সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। সহীহ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে,

«الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ»

‘‘প্রকৃত জ্ঞানী হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে নিজের নফ্সের হিসাব নিল এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য আমল করল। অক্ষম হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে স্বীয় ন্ফসের চাহিদা পূরণে প্রবৃত্তির অনুসরণ করল এবং আমল ছেড়ে দিয়ে নিজের আশা-আকাঙ্খা পূরণে আল্লাহর উপর ভরসা করে বসে থাকল।[20]

আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেনঃ আল্লাহ্ তাআলা হাদীছে কুদছীতে বলেছেনঃ

«يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِى بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِى لاَ تُشْرِكُ بِى شَيْئًا لأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً»

‘‘হে বনী আদম! তুমি যদি যমীন পরিপূর্ণ গুনাহ্ নিয়ে আমার কাছে আগমণ কর এবং আমার সাথে অন্য কিছুকে শরীক না করে মিলিত হও, তাহলে যমীন পরিপূর্ণ ক্ষমাসহ আমি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবো।[21]

.........................................................

ব্যাখ্যাঃ এই হাদীছে এমন কথা বর্ণিত হয়েছে, যা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর অর্থকে খোলাসা করেছে। এ জন্যই এটি সমস্ত মাখলুক এবং সকল পাপের মুকাবেলায় ভারী হয়ে যাবে। আর সেই কথাটি হচ্ছে এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার সাথে সাথে ছোট-বড়, কম-বেশী সকল শির্ক বর্জন করা। এটিই হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ তাওহীদের দাবী। যে তাওহীদ বাস্তবায়ন এবং কালেমায়ে ইখলাসের দাবী পূরণ করতে পারবেনা, সে কখনই শির্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারবেনা। কালেমায় ইখলাসের দাবী ও শর্তগুলো পূর্বে আলোচিত হয়েছে। আর তা হচ্ছে কালেমার অর্থ জানা, তা নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করা, সত্যায়ন করা, একনিষ্ঠতা, এর মর্মার্থকে ভালবাসা, কবুল করে নেওয়া, অনুগত হওয়া ইত্যাদি আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ

‘‘সে দিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন উপকারে আসবেনা; কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে আসবে’’। (সূরা শুআরাঃ ৮৮-৮৯)

[11] - বুখারী, অধ্যায়ঃ বাড়িঘরে নামাযের স্থান নির্ধারণ করা, মুসলিম, অধ্যায়ঃ জামাআতের সাথে নামায পড়া হতে বিরত থাকার অনুমতি।

[12] - العروة الوثقى উরওয়াতুল উছকা হচ্ছে মজবুত হাতল বা রশি। এই রশিকে যে আঁকড়ে ধরবে, রশিটি কখনো ছিড়বেনা এবং সে রশি থেকে বিচ্ছিন্নও হবেনা। এটি তাকে সরাসরি জান্নাতে নিয়ে যাবে। এখানে একটি হাদীছ উল্লেখ করার প্রয়োজন অনুভব করছি। আশা করি এর মাধ্যমে এই রশির অর্থ পরিস্কার হবে। সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন সালামের ফযীলতে ইমাম বুখারী (রঃ) কাইস বিন আববাদের সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। কাইস বলেনঃ আমি একদা মদীনার মসজিদে বসা ছিলাম। তখন একজন লোক মসজিদে প্রবেশ করল। তার চেহারায় ছিল বিনয় ও একাগ্রোতার ছাপ। লোকেরা বললঃ এই লোকটি জান্নাতের অধিবাসী। লোকটি খুব সংক্ষেপে দুই রাকআত নামায আদায় করল। অতঃপর সে মসজিদ হতে বের হয়ে গেল। আমিও তার পিছনে বের হলাম। আমি লোকটিকে বললামঃ তুমি যখন মসজিদে প্রবেশ করেছিলে, তখন লোকেরা বলেছেঃ এই লোকটি আহলে জান্নাতের অন্তর্ভূক্ত। লোকটি বললঃ আল্লাহর কসম! কারো জন্য এমন কথা বলা উচিৎ নয়, যা সে জানেনা। অচিরেই আমি তোমাকে এর কারণ খুলে বলবো।

আসল ব্যাপার এই যে, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় একটি স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নটি আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বর্ণনা করলাম। আমি স্বপ্নে দেখি আমি যেন একটি বাগানের মধ্যে আছি। এ কথা বলে তিনি বাগানের প্রশস্ততা ও তার সবুজ শ্যামল শোভার কথা উল্লেখ করলেন। তারপর বললেনঃ বাগানের মধ্যভাগে ছিল লোহার একটি খুঁটি। খুঁটির নীচের ভাগ ছিল মাটির মধ্যে এবং তার উপরের অংশ ছিল আকাশে। তার উপরের প্রান্তে রয়েছে একটু রশি। আমাকে বলা হলঃ এতে আরোহণ কর। আমি বললামঃ আমি তো পারছি না। এমন সময় আমার কাছে একজন খাদেম এসে পেছন দিক থেকে আমার কাপড় উঁচু করে ধরল। তখন আমি আরোহণ করতে লাগলাম। অবশেষে স্তম্ভটির উপরের প্রান্তে পৌঁছে রশিটা ধরে ফেললাম। তখন আমাকে বলা হল, দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরো। তারপর আমি ঐ রশিটা আমার হাতে ধরা অবস্থায় জেগে উঠলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আমার স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলে তিনি বললেনঃ ঐ বাগানটি হল ইসলাম। ঐ স্তম্ভটা হল ইসলামের মূল স্তম্ভ। আর ঐ রশিটা হল ইসলামের সুদৃঢ় রশি। কাজেই মৃত্যু পর্যন্ত তুমি ইসলামের উপরই থাকবে।

[13] - কালেমার অর্থ ও তাৎপর্য না জেনে কেউ যদি তা পাঠ করে, তাহলে এই কালেমা তার উপকারে আসবে কিনা- এ বিষয়টি মতভেদপূর্ণ। তবে অনেক দলীল প্রমাণ করে যে, অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবে। এ বিষয়ে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইনশা-আল্লাহ।

[14] - ইবনে হিববান ও হাকিম। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুনঃ সহীহুত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব, হাদীছ নং- ৯২৩। তবে এই কালেমার শক্তি আসমান-যমীন অপেক্ষা বেশী’’। একাধিক বিশুদ্ধ হাদীছ রয়েছে।

[15] - বাংলা ভাষায় অধিকাংশ ইসলামী বই-পুস্তকগুলোতে ‘আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই’,-এভাবেই لا إله إلا الله-এর অনুবাদ করা হয়েছে। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর অনুবাদ এভাবে করা ঠিক নয়। কারণ বাক্যটির আসল রূপ হচ্ছে لا إله حق إلا الله। যদি অনুবাদ করা হয় যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তাহলে حق(হক) শব্দটির অনুবাদ ছুটে যায়। আর আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই- এ কথাটিও অবাস্তব। কারণ আমরা এই পৃথিবীতে অসংখ্য মাবুদ দেখতে পাচ্ছি। মূলতঃ যার এবাদত ও উপাসনা করা হয়, তাই মাবুদ। সে হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায় যে সমস্ত দেব-দেবীর পূজা ও উপাসনা করে, সেগুলো তাদের মাবুদ। মক্কার মুশরিকরা যে সমস্ত মূর্তির উপাসনা করত, সেগুলো ছিল তাদের মাবুদ। যে সমস্ত মুসলিম কবরে সিজদাহ্ করছে, অলী-আওলীয়া ও কবরবাসীর কাছে সাহায্য চাচ্ছে, তারাও এগুলোকে মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে। সুতরাং পৃথিবীতে বহু মাবুদ আছে এবং মানুষ সেগুলোর পূজা করছে। তবে এগুলো সত্য ও সঠিক মাবুদ নয়। এ কথাটিই ব্যক্ত হয়েছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর মধ্যে। সুতরাং لا إله إلا الله -এর সঠিক অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্ ছাড়া সত্য-সঠিক কোন উপাস্য নেই। (অনুবাদক)

[16] - ইমাম মালেক (রঃ) মুআত্তায় তালহা বিন উবাইদুল্লাহ (রাঃ) হতে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আলবানী (রঃ) বলেনঃ সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, হাদীছটির শাওয়াহেদ থাকার কারণে তথা অন্যান্য সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে সহীহ। দেখুনঃ সিলসিলা সহীহা, হাদীছ নং- ১৫০৩।

[17] - তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ। ইমাম তিরমিজী হাদীছটি বর্ণনা করার পর সহীহ বলেছেন। ইমাম আলবানী (রঃ)ও হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ১৩৫।

হাদীছে বর্ণিত আল্লাহর রহমত কেবল তার বেলায় প্রযোজ্য হবে যার প্রতি আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ করবেন। এটা একান্তই আল্লাহর অনুগ্রহ। কাজেই উল্লেখিত রহমতের আশায় এবাদত-বন্দেগী না করে বসে থাকা মোটেই উচিত নয়।

[18] - এখানে মৃত্যু বলতে নিদ্রা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আমি তোমাকে নিদ্রার মাধ্যমে উপরে উঠিয়ে নিবো। কেননা ঈসা (আঃ) মৃত্যু বরণ করেন নি। কিয়ামতের আগে তিনি পুনরায় দুনিয়াতে আগমণ করবেন।

[19] - কালেমার শর্তসমূহঃ

(১) ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভাবে অর্থ জানা, যা অজ্ঞতার পরিপন্থী। নেতিবাচক হলো আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য এবাদাত সাব্যস্ত না করা। আর ইতিবাচক হলো তা (এবাদাত) এককভাবে তাঁর জন্য সাব্যস্ত করা। তাঁর কোন অংশীদার নেই তিনিই একমাত্র এবাদাতের মালিক ও হক্বদার।

(২) এই কালেমার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখা, যা সন্দেহের পরিপন্থী। অর্থাৎ এই কালেমার দাবীর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রেখে আন্তরিকভাবে নিশ্চিত হয়ে মুখে উচ্চারণ করা।

(৩) এই কালেমাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করা, যা প্রত্যাখ্যাণের পরিপন্থী। আর তা হলো এই কালেমার সকল দাবী-চাহিদা ও তার বক্তব্য গ্রহণ করা। সংবাদ সমূহের প্রতি বিশ্বাস রাখা, আদেশ সমূহ পালন করা। নিষেধ সমূহ হতে বিরত থাকা। কুরআন ও হাদীসের দলীল পরিত্যাগ ও অপব্যাখ্যা না করা।

(৪) অনুগত হওয়া, যা অগ্রায্য করার পরিপন্থী। আর তা হলো এই কালেমা যে সকল বিধানের নির্দেশ দিয়েছে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ভাবে তার প্রতি অনুগত থাকা।

(৫) এই কালেমাকে সত্য জানা, যা মিথ্যার পরিপন্থী। আর তা হলো বান্দা এই কালেমাকে সত্য জেনে অন্তর হতে উচ্চারণ করবে। এই কালেমা পাঠকারীর অন্তর তার কথা মোতাবেক হবে এবং তার বাহ্যিক অবস্থা অভ্যন্তরীণ অবস্থার অনুরূপ হবে। অতঃপর যে ব্যক্তি এই কালেমা মুখে উচ্চারণ করেছে আর তার দাবীকে অস্বীকার করেছে নিশ্চয়ই তার এই উচ্চারণ কোন কাজে আসবেনা, যেমন মুনাফেকদের অবস্থা ছিল। তারা এই কালেমা মুখে উচ্চারণ করতো অন্তরে অস্বীকার করত।

(৬) পূর্ণ একনিষ্ঠতা থাকা, যা শির্কের পরিপন্থী। আর তা হল বান্দা আমলকে নেক নিয়তের দ্বারা শির্কের সকল প্রকার প্রাদুর্ভাব হতে মুক্ত রাখবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَতারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে এবাদাত করার। (সূরা আল-বায়্যিনাঃ ৫)

(৭) এই কালেমার সাথে ভালবাসা রাখা, যা ঘৃণা ও অপছন্দের পরিপন্থী। আর ইহা বাস্তবায়িত হবে কালেমাকে, তার দাবীকে, তার নির্দেশিত বিধানকে এবং যারা এই কালেমার শর্ত মোতাবেক চলে তাদেরকে ভালবাসার মাধ্যমে। আর উল্লেখিত কথাগুলোর বিপরীত কথার সাথে বিদ্বেষ রাখার মাধ্যমে। এর নিদর্শন হলঃ আল্লাহর প্রিয় বস্ত্তকে প্রাধান্য দেয়া, যদিও তা প্রবৃত্তির বিরোধী হয়। আর আল্লাহর যা অপছন্দ তা অপছন্দ করা, যদিও প্রবৃত্তি তার দিকে ধাবিত হয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যাদের বন্ধুত্ব রয়েছে তাঁদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যাদের শত্রুতা রয়েছে তাদের সাথে শত্রুতা রাখা। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

فَقَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ

‘‘তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার এবাদাত কর তার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই। আমরা তোমাদেরকে মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে শুরু হল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য, যতক্ষন না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন কর। (সূরা মুমতাহিনাঃ ৪) তিনি আরও বলেনঃ

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ

‘‘মানুষের মধ্যে এমন লোক রয়েছে, যে আল্লাহ ছাড়া অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভাল বাসার ন্যায় তাদেরকে ভালবাসে, কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসা দৃঢ়তর’’। (সূরা বাকারাঃ ১৬৫) আর যে ব্যক্তি ইখলাস ও ইয়াকীনের সাথে (لا إله إلا الله) লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ‘‘আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মাবুদ নেই’’ এ কথা বলবে এবং সকল পাপাচার, বিদআত, ছোট শির্ক ও বড় শির্ক হতে মুক্ত থাকবে, সে দুনিয়াতে পথভ্রষ্ঠতা হতে হেদায়াত পাবে। আর আখেরাতে শাস্তি হতে নিরাপত্তা পাবে। তার উপর জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে। এই শর্তগুলো পূর্ণ করা বান্দার উপর আবশ্যক। আর এই শর্তগুলো পূর্ণ করার অর্থ হল যে, এই শর্তগুলো একজন বান্দার জীবনে সমাবেশ ঘটা এবং তা জানা অত্যাবশ্যক হওয়া। তবে ইহা মুখস্থ করা জরুরী নয়। আর এই মহান কালেমা (لا إله إلا الله) হল তাওহীদুল উলুহীয়্যাহ, যা তাওহীদের প্রকারসমূহের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক প্রকার তাওহীদ, এ বিষয়েই নাবীগণ ও তাঁদের সম্প্রদায়ের মাঝে মতানৈক্য সংঘটিত হয়েছিল। আর এরই বাস্তবায়নের জন্যে রাসূলগণকে প্রেরণ করা হয়েছিল।

[20] - তিরমিজী। ইমাম আলবানী হাদীছটিকে দুর্বল বলেছেন। দেখুনঃ শাইখের তাহকীকসহ মিশকাত, হাদীছ নং- ৫২৮৯।

[21] - তিরমিজী, অধ্যায়ঃ গুনাহ্ করার পর বান্দার জন্য আল্লাহর ক্ষমা। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ১২৭।

[22] - যে ব্যক্তি লা-ইলাহা পাঠ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে,- অনেক লোকই এই হাদীছটি বুঝতে ভুল করেছে। তারা মনে করে শুধু জবান দিয়ে এই বাক্যটি উচ্চারণ করাই জান্নাতে যাওয়ার জন্য এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। মূলতঃ বিষয়টি এরূপ নয়। যারা এরূপ মনে করে, তারা বিভ্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত। তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর সঠিক মর্মার্থ বুঝতে পারে নি। না বুঝার কারণ হল, তারা এ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেনি। এই পবিত্র বাক্যটির সঠিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ্ ব্যতীত সকল মাবুদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং সকল প্রকার এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই খাস (নির্ধারণ) করা। এবাদতগুলো এমন পদ্ধতিতে করা, যাতে আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হন। এটিই লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর হক। যে ব্যক্তি এই হক আদায় করবেনা, কিংবা এর কিছু অংশ আদায় করবে, অতঃপর আল্লাহর সাথে অন্যান্য অলী-আওলীয়া ও সৎ লোকদের কাছে দুআ করবে এবং তাদের জন্য নযর পেশ করবে, সে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’এর শর্ত ভঙ্গকারী হিসাবে গণ্য হবে। সে এটি পাঠ করার দাবী করলেও তাতে কোন লাভ হবে না।
তাওহীদের ফযীলত এবং তাওহীদ যে সমস্ত গুনাহ্ মিটিয়ে দেয় - ৩

এ অধ্যায় থেকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) আল্লাহ্ তাআলার অসীম করুণা।

২) আল্লাহর নিকট তাওহীদের অপরিসীম ছাওয়াব।

৩) অপরিসীম ছাওয়াব দেয়ার সাথে সাথে তাওহীদ দ্বারা পাপসমূহও মোচন হয়ে যায়।

৪) সূরা আনআমের ৮২ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল। অর্থাৎ সেখানে যে যুলুমের বর্ণনা এসেছে, তা দ্বারা সাধারণ যুলুম উদ্দেশ্য নয়; বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে শির্ক।

৫) উবাদা বিন সামেতের হাদীছে বর্ণিত পাঁচটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়া জরুরী।

৬) উবাদা বিন সামেত এবং ইতবানের হাদীছকে একত্র করলে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং ধোঁকায় নিপতিত লোকদের ভুল সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে।[22]

৭) ইতবান রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীছে উল্লেখিত শর্তের ব্যাপারে সতর্কীকরণ। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কালেমাটি পাঠ করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এটি পাঠ করবে, সে অবশ্যই আমল করবে এবং তা কেবল আল্লাহর জন্যই করবে।

৮) ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র ফযীলতের ব্যাপারে নবীগণকেও সতর্ক করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

৯) সমগ্র সৃষ্টির তুলনায় এ কালেমার পাল্লা ভারী হওয়ার ব্যাপারে অবগতকরণ। যদিও ইখলাসের সাথে পাঠ না করার কারণে এ কালেমার অনেক পাঠকের পাল্লা হালকা হয়ে যাবে।

১০) সপ্তাকাশের মত সপ্ত যমীন বিদ্যমান থাকার প্রমাণ পাওয়া গেল।

১১) যমীনের মত আকাশেও বসবাসকারী রয়েছে।

১২) আল্লাহর সিফাতসমূহকে সাব্যস্ত করা জরুরী। আশআরী সম্প্রদায়ের লোকেরা এগুলোকে অস্বীকার বা এগুলোর অপব্যাখ্যা করে থাকে।

১৩) আপনি যখন সাহাবী আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসটি বুঝতে সক্ষম হবেন তখন জানতে পারবেন যে, ইতবান রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীঃ

فَإِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ يَبْتَغِى بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ

‘‘আল্লাহ তাআলা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে’। এর মর্মার্থ হচ্ছে শির্ক বর্জন করা। শুধু মুখে বলা এর উদ্দেশ্য নয়।

১৪) আল্লাহর নবী ঈসা (আঃ) এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয়ই আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল হওয়ার বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করা।

১৫) কালিমাতুল্লাহ বলে ঈসা (আঃ) কে খাস করার বিষয়টি জানা গেল। এ দ্বারা বিশেষ মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

১৬) ঈসা (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে রূহ হওয়া সম্পর্কে অবগত হওয়া গেল।

১৭) জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি ঈমান আনার মর্যাদা।

১৮) তাওহীদপন্থী লোকেরা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমল যাই হোক না কেন।

১৯) এ কথা জানা গেল যে, কিয়ামতের দিন দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। দাঁড়িপাল্লার দুটি পাল্লাও থাকবে।

২০) আরও জানা গেল যে, আল্লাহর অনেক সিফাত রয়েছে। তার মধ্যে আল্লাহর চেহারা তার অন্যতম একটি সিফাত।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ৩ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে