ব্যাখ্যাঃ ভাষ্যকার বলেনঃ গ্রন্থকার ‘বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ দ্বারা কিতাবুত্ তাওহীদ লিখা শুরু করেছেন। তিনি আরো বলেনঃ কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল মাজীদে’ আমি বিস্মিল্লাহ্-এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছি। বিসমিল্লাহ্-এর মাধ্যমে সকল কাজ-কর্ম শুরু করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত। সুন্নাতের অনুসরণ করেই ইমাম বুখারী এবং অন্যান্য আলেমগণ বিসমিল্লাহ্ দ্বারা তাদের কিতাব লিখা শুরু করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে চিঠি লেখার সময় বিসমিল্লাহ লিখতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি প্রসিদ্ধ হাদীছে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করার আদেশ দিয়েছেন। ইমাম ইবনে মাজাহ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।[1]
গ্রন্থকার এখানে ‘তাওহীদ’ দ্বারা ‘তাওহীদুল ইবাদাহ’ তথা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করাকে বুঝিয়েছেন।[2] প্রত্যেক রাসূলই এ প্রকার তাওহীদের মাধ্যমে নিজ নিজ গোত্রের লোকদের সামনে দাওয়াতের সূচনা করেছেন। সূরা আরাফের ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ
‘‘নিশ্চয়ই আমি নুহকে তার সম্প্রদায়ের প্রতি পাঠিয়েছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই। তা না করলে আমি তোমাদের উপর একটি মহা দিবসের শাস্তির আশঙ্কা করছি। একই সূরার ৬৫ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ أَفَلَا تَتَّقُونَ
‘‘আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই হুদকে। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَإِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ قَدْ جَاءَتْكُمْ بَيِّنَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ هَذِهِ نَاقَةُ اللَّهِ لَكُمْ آَيَةً فَذَرُوهَا تَأْكُلْ فِي أَرْضِ اللَّهِ وَلَا تَمَسُّوهَا بِسُوءٍ فَيَأْخُذَكُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ
‘‘আর সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই সালেহকে। তিনি বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো সত্য মাবুদ নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একটি প্রমাণ এসে গেছে। এটি আল্লাহ্র উষ্ট্রী। তোমাদের জন্য এটি একটি নিদর্শন স্বরূপ। অতএব একে ছেড়ে দাও, আল্লাহ্র ভূমিতে এটি চরে বেড়াবে। একে অসৎ নিয়তে স্পর্শ করবেনা। অন্যথায় তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পাকড়াও করবে। (সূরা আরাফঃ ৭৩) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ قَدْ جَاءَتْكُمْ بَيِّنَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ فَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ
‘‘আমি মাদায়েনের প্রতি তাদের ভাই শুআইবকে প্রেরণ করেছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রমাণ এসে গেছে। অতএব তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ কর এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দিয়োনা এবং ভূপৃষ্ঠের সংস্কার সাধন করার পর তাতে ফাসাদ সৃষ্টি করোনা। এটিই হল তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’’। (সূরা আরাফঃ ৮৫) সূরা হুদের আরো কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন যে, নবীগণ সর্বপ্রথম তাওহীদ দিয়েই তাদের দাওয়াতের কাজ শুরু করেছেন।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ‘‘আমি জিন এবং মানুষকে একমাত্র আমার এবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।’’ (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)।
..................................................................
ব্যাখ্যাঃ এ আয়াতটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তাআলা একটি মহান উদ্দেশ্যে জিন ও মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আর সেটি হচ্ছে আল্লাহ্ তাআলা তাদের উপর যা ওয়াজিব করেছেন, তারা তা বাস্তবায়ন করবে, তাঁরই এবাদত করবে, তাঁর এবাদত ব্যতীত অন্যান্য বস্ত্তর এবাদত বর্জন করবে। সুতরাং এই আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা দু’টি কাজের উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে আল্লাহর কাজ। তথা আল্লাহ্ তাআলা জিন-ইনসান সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং জিন-ইনসান সৃষ্টি করা আল্লাহর কাজ। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বান্দার কাজ। তা হচ্ছে বান্দাগণ এককভাবে আল্লাহর এবাদত করবে। শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ
العبادة اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأقوال والأعمال الظاهرة والباطنة
আল্লাহ্ তাআলা বান্দার যে সমস্ত প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজকে ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন, তার নামই এবাদত।
শাইখুল ইসলাম আরো বলেনঃ এবাদত হচ্ছে এমন একটি নাম, যা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ও সর্বোচ্চ ভালোবাসার অর্থ বহন করে এবং তাঁর সামনে পূর্ণ ও সর্বোচ্চ নতি স্বীকার করার কথা ঘোষণা করে। নতি স্বীকার করা ব্যতীত শুধু ভালোবাসা কিংবা ভালোবাসাহীন শুধু নতি স্বীকার কখনই এবাদত হতে পারে না। এবাদত ঐ বস্ত্তকে বলা হয়, যাতে উপরোক্ত দু’টি বিষয় পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকে।
শাইখুল ইসলাম আরো বলেনঃ বান্দাগণ আল্লাহ্ তাআলাকে ভালোবাসবে এবং তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জন করবে, এ জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং যারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য তাঁরই এবাদত করবে এবং তাঁকেই ভালোবাসবে ও ভয় করবে তাদের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তাআলার সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন হবে, যাকে দ্বীনি ইচ্ছা বা ইরাদায়ে শরঈয়া বলা হয়।[3] আর এটিই আল্লাহ্ তাআলা উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ
‘‘আমি জিন এবং মানব জাতিকে একমাত্র আমার এবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি’’। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)।
আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করো এবং তাগুত থেকে দূরে থাকো’’। (সূরা নাহলঃ ৩৬)
......................................................
ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ্ তাআলা এখানে সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি প্রত্যেক যামানায় এবং প্রত্যেক জাতির কাছেই রাসূল পাঠিয়েছেন। যাতে করে প্রেরিত রাসূল একমাত্র আল্লাহর এবাদত করার আদেশ দেন এবং ঐ সমস্ত বস্ত্তর এবাদত করা হতে নিষেধ করেন, যা শয়তান মানুষের সামনে খুব চাকচিক্যময় করে প্রকাশ করেছে এবং আল্লাহর এবাদত বাদ দিয়ে তাদেরকে ঐ সমস্ত বাতিল মাবুদের এবাদতে লিপ্ত করেছে। অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা তাদের কাউকে হেদায়াত করেছেন। তাই তারা এককভাবে আল্লাহ্ তাআলার এবাদত করেছে এবং তাঁর রাসূলদের আনুগত্য করেছে। আর বনী আদমের কতক লোক পথহারা হয়ে আল্লাহর এবাদতে অন্যান্য বস্ত্তকে শরীক করেছে। রাসূলগণ যেই হেদায়াত নিয়ে আগমণ করেছেন, তারা তা গ্রহণ করেনি। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ
‘‘তোমার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রদান করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই এবাদত করো’’। (সূরা আম্বীয়াঃ ২৫) এই তাওহীদের জন্যই তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্যই তাদেরকে আহবান করা হয়েছে। এটিই হচ্ছে তাওহীদুল উলুহীয়াহ। একে توحيد القصد والطلب তাওহীদুল কাস্দ ওয়াত্ তালাবও বলা হয়।
আর তাওহীদে রুবুবীয়া, তাওহীদুল আসমা ওয়াস্ সিফাত এবং তাওহীদুল আফআল কিংবা ‘তাওহীদুল ইল্ম ওয়াল ইতিকাদ’ তথা জ্ঞান ও বিশ্বাসগত তাওহীদ বলা হয়। মানব জাতির অধিকাংশ লোকই আল্লাহ তাআলার এই তাওহীদকে স্বীকার করেছে।[4] তবে অধিকাংশ লোকই তাওহীদুল উলুহীয়াকে অস্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী হুদ (আঃ)এর গোত্রের লোকদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। তিনি যখন তাঁর জাতির লোকদেরকে বললেনঃ
يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ
‘‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো সত্য উপাস্য নেই’’। (সূরা আরাফঃ ৬৫) তখন তারা বললঃ তুমি কি আমাদের কাছে এ জন্য এসেছ যে, আমরা এক আল্লাহ্র এবাদত করি এবং আমাদের বাপ-দাদারা যাদের পূজা করত, তাদেরকে ছেড়ে দেই? (সূরা আরাফঃ ৭০) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কার মুশরিকদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন, তখন তারাও বলেছিলঃ
أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهاً وَاحِداً إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ
‘‘সে কি বহু মাবুদকে এক মাবুদে পরিণত করে দিয়েছে? নিশ্চয়ই এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার! (সূরা সোয়াদঃ ৫) আল্লাহ্ তাআলার বাণীঃ
وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ
‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর এবাদত করো আর তাগুতকে বর্জন করো’’-এ আয়াতটি তার পূর্বের এবং পরের অন্যান্য আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা করছে। আরো ব্যাখ্যা করছে যে, যেই এবাদতের জন্য বান্দাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তা হচ্ছে এমন খাঁটি ও নির্ভেজাল এবাদত, যার সাথে শির্ক এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য বস্ত্তর এবাদতের মিশ্রন নেই। সেই অন্য বস্ত্ত যেই হোক না কেন। সুতরাং জানা গেল যে, আমল ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক হবেনা, যতক্ষণ না তা আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য সমস্ত বাতিল মাবুদের এবাদত হতে মুক্ত হবে।[5] আল্লাহ্ তাআলার এবাদত করার জন্যই জিন-ইনসান সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের কেউ তাঁর এবাদত করছে। আবার কেউ তাঁর এবাদতে অন্যকে শরীক করছে এবং কুফুরী করছে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা নাহলের ৩৬ নং আয়াতে বলেনঃ
فَمِنْهُم مَّنْ هَدَى اللّهُ وَمِنْهُم مَّنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلالَةُ
‘‘অতঃপর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোককে আল্লাহ্ হেদায়াত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্যে গোমরাহী অবধারিত হয়ে গেছে’’। (সূরা নাহলঃ ৩৬) আল্লাহ্ তাআলা সূরা নিসার ৬৪ নং আয়াতে বলেনঃ
وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ
‘‘বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহ্র নির্দেশ অনুযায়ী তাদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়’’।
উপরের আয়াতগুলোর মাধ্যমে পরিস্কার বুঝা গেল যে, জিন-ইনসান সৃষ্টির ক্ষেত্রে দয়াময় আল্লাহ্ তাআলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদেরকে যে জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যে বিষয়ের আহবান করার জন্য রাসূলদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে, তারা তাই করবে। এ জন্যই যারা এককভাবে তাঁর এবাদত করেনি এবং তাঁর রাসূলগণের দাওয়াত গ্রহণ করেনি, তিনি তাদেরকে ধ্বংস করেছেন। তিনি নবী-রাসূলগণ এবং তাদের সাথীদের জন্য তাওহীদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বৈধ করেছেন। তাদের কেউ কেউ নবী-রাসূলদের আনুগত্য করেছে। এদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। আবার তাদের মধ্য হতে অন্যরা নবী-রাসূলদের তাওহীদের দাওয়াতের বিরোধিতা করেছে। তাদের সংখ্যাই ছিল অধিক।
এই তাওহীদের নামই হচ্ছে ইসলাম। এই ইসলাম ছাড়া আল্লাহ্ তাআলা অন্য কোন দ্বীন কবুল করবেন না। সূরা ইউসুফের ৪০ নং আয়াতে ইউসুফ (আঃ)এর উক্তি নকল করে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآَبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
‘‘তোমরা আল্লাহ্কে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের এবাদত করে থাকো, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছে। আল্লাহ্ এদের কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেন নি। আল্লাহ্ ছাড়া কারও হুকুম করার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারো এবাদত করোনা। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না’’।
এককভাবে আল্লাহর এবাদত করাই হলো সেই সত্য দ্বীন, যা দিয়ে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর সকল রাসূল প্রেরণ করেছেন, এই শিক্ষাই সকল আসমানী কিতাবে নাযিল করেছেন এবং এটি বাস্তবায়ন করার জন্যই রাসূলদেরকে আদেশ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحاً وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ
‘‘তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি তোমার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করোনা’’। (সূরা শুরাঃ ১৩) আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
قُلْ إِنَّمَا أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللّهَ وَلا أُشْرِكَ بِهِ إِلَيْهِ أَدْعُو وَإِلَيْهِ مَآبِ
‘‘হে নবী তুমি লোকদেরকে বলোঃ আমাকে আদেশ করা হয়েছে, আমি যেন একমাত্র আল্লাহ্র এবাদত করি এবং তার সাথে অংশীদার না করি। আমি তাঁর দিকেই দাওয়াত দেই এবং তাঁর কাছেই আমার প্রত্যাবর্তন’’। (সূরা রা’দঃ ৩৬) এখানে দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবীকে একমাত্র তাঁরই এবাদত করার আদেশ দিয়েছেন এবং উম্মতকে এদিকেই আহবান করার নির্দেশ দিয়েছেন। সমস্ত কুরআনই এ তাওহীদ এবং তাওহীদের ব্যাখ্যায় ভরপুর। এতে রয়েছে তাওহীদপন্থীদের পুরস্কার ও তাওহীদ অস্বীকারকারীদের তিরস্কার। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيراً مِّمَّا كُنتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ قَدْ جَاءكُم مِّنَ اللّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ، يَهْدِي بِهِ اللّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلاَمِ وَيُخْرِجُهُم مِّنِ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ
‘‘হে আহ্লে কিতাবগণ! তোমাদের কাছে আমার রাসূল আগমণ করেছেন। কিতাবের যেসব বিষয় তোমরা গোপন করতে, তিনি তার মধ্য থেকে অনেক বিষয় প্রকাশ করেন এবং অনেক বিষয় মার্জনা করেন। তোমাদের কাছে একটি উজ্জ্বল জ্যোতি এসেছে এবং এসেছে একটি সমুজ্জ্বল গ্রন্থ। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে এর দ্বারা তিনি তাদেরকে নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে আনয়ন করেন এবং সরল পথে পরিচালিত করেন’’। (সূরা মায়েদাঃ ১৫-১৬)
আবু দাউদ ও তিরমিজীতে বর্ণিত মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছে এসেছে, মুআয বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন কিছু আমল দেখিয়ে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ তুমি একটি বিরাট বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছ। তবে আল্লাহ্ তাআলা যার উপর সেই আমলটি সহজ করে দিয়েছেন, তার জন্য তা খুবই সহজ। আমলটি হচ্ছে, তুমি আল্লাহর এবাদত করবে, তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করবেনা। নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং রামাযানের রোযা রাখবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জের কথাও বলেছেন। অতঃপর তিনি বলেনঃ আমি কি তোমাকে দ্বীনের মূল বিষয়, স্তম্ভ এবং এর সর্বোচ্চ চূড়া সম্পর্কে বলবোনা? মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! হ্যাঁ, বলুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ দ্বীনের মূল হচ্ছে ইসলাম। এর স্তম্ভ হচ্ছে নামায এবং দ্বীনের সর্বোচ্চ চূড়া হচ্ছে জিহাদ।[6]
এই হাদীছ থেকে বুঝা যাচ্ছে ইসলাম হচ্ছে তাওহীদের অন্য একটি নাম। আর অন্যান্য হুকুম-আহকাম ও ফরয-ওয়াজিবগুলো হচ্ছে তাওহীদের হকসমূহের অন্তর্গত। সকল আলেম এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, তাওহীদ হচ্ছে নামায এবং অন্যান্য আমল সঠিক হওয়ার শর্ত। কালেমায়ে শাহাদাত لا إله إلا الله و أن محمداً رسول الله এর তাৎপর্য ও দাবী এটিই। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হচ্ছে, এটি একদিকে যেমন শির্ককে প্রত্যাখ্যান করে এবং শির্ক ও মুশরিকদের থেকে সম্পর্কচ্ছেদ ঘোষণা করে অন্যদিকে একমাত্র আল্লাহর জন্য এবাদতকে সাব্যস্ত করে, রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান আনয়ন আবশ্যক হওয়া এবং তাঁর আনুগত্য করা জরুরী হওয়ার প্রমাণও বহন করে।
[2] - আলেমগণ কুরআন ও হাদীছের আলোকে তাওহীদকে তিনভাবে বিভক্ত করেছেনঃ
ক) তাওহীদে রুবুবীয়াহঃ
তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ হল দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তাআলা সব কিছুর প্রতিপালক, তিনিই সব কিছুর মালিক, সৃষ্টি কর্তা, ব্যবস্থাপক ও পরিচালক। তার রাজত্বে কোন অংশীদার নেই। তিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যে কারণে তাঁর কোন সাহায্যকারীর প্রয়োজন হতে পারে। তাঁর ফয়সালাকে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না, তার আদেশ প্রত্যাখ্যান করার মত কেউ নেই, তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তাঁর অনুরূপ আর কেউ নেই, নেই তাঁর কোন সমতুল্য। তাঁর প্রতিপালনাধীন কোন বিষয়ের বিরোধী কেউ নেই এবং তাঁর নাম ও গুণাবলীতেও কোন শরীক নেই। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ قُلْ اللَّهُ قُلْ أَفَاتَّخَذْتُمْ مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ لاَ يَمْلِكُونَ لأَنفُسِهِمْ نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّورُ أَمْ جَعَلُوا لِلَّهِ شُرَكَاءَ خَلَقُوا كَخَلْقِهِ فَتَشَابَهَ الْخَلْقُ عَلَيْهِمْ قُل اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ
‘‘বলো! কে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক? বলোঃ আল্লাহ। বলোঃ তবে কি তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করেছো, যারা নিজেদের লাভ ও ক্ষতি সাধনে সক্ষম নয়? তুমি বলোঃ অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান? অথবা অন্ধকার ও আলো কি সমান? তবে কি তারা আল্লাহর এমন শরীক স্থাপন করেছে যারা তাঁর সৃষ্টির মত সৃষ্টি করেছে যে কারণে সৃষ্টি তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ঘটিয়েছে? বলোঃ আল্লাহ সকল বস্ত্তর স্রষ্টা; তিনি একক ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা রা’দঃ ১৬)
আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمْ الْخَالِقُونَ * أَمْ خَلَقُوا السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بَل لاَ يُوقِنُونَ
‘‘তারা কি কোন কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? না কি তারা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করেনা’’। (সূরা তুরঃ ৩৫-৩৬)
সর্বকালের অধিকাংশ বনী আদমই এই প্রকার তাওহীদ তথা তাওহীদে রুবুবীয়ার প্রতি বিশ্বাস করেছে এবং তা মেনে নিয়েছে। জাহেলী যুগের মক্কার মুশরিকরাও তা মেনে নিয়েছিল। কুরআন মজীদে এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ
‘‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো- কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তবে অবশ্যই তারা বলবেঃ আল্লাহ্। (সূরা লুকমানঃ ২৫) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنْ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنْ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنْ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ
‘‘তুমি জিজ্ঞেস করো, কে রিযিক দান করে তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তা ছাড়া কে জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ্! তখন তুমি বলো, তারপরও কি ভয় করবেনা? (সূরা ইউনুসঃ ৩১)
মুসলিম হিসাবে গণ্য হওয়ার জন্য শুধু তাওহীদে রুবুবীয়াতে বিশ্বাস যথেষ্ট নয়। তাওহীদে উলুহীয়াতে বিশ্বাস না করা পর্যন্ত কাউকে মুমিন হিসাবে গণ্য করা হবেনা। কারণ মক্কাবাসীরা তাওহীদে রুবুবীয়াতে বিশ্বাস করত। কিন্তু আল্লাহর এবাদতে তারা শরীক স্থাপন করত। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ
‘‘আর অধিকাংশ মানুষই আল্লাহ্র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শির্কেও লিপ্ত হয়’’। (সূরা ইউসুফঃ ১০৬) এখানে ঈমান বলতে তাওহীদে রুবুবীয়া উদ্দেশ্য। শুধু তাওহীদে রুবুবীয়াতের প্রতি ঈমান আনয়ন করাকে মুসলিম হওয়ার জন্য যথেষ্ট গণ্য করা হয়নি। এ জন্যই মক্কাবাসীরা এতে ঈমান আনয়ন করা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে বদর, উহুদ ও খন্দকসহ বহু যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। মুসলিম হওয়ার জন্য যদি শুধু আল্লাহ্ তাআলা রুবুবীয়াতের প্রতি ঈমান আনয়ন করাই যথেষ্ট হত, তাহলে তিনি কখনই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন না এবং তাদের জান ও মালকে হালাল মনে করতেন না।
তাওহীদুল উলুহীয়াহঃ
প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল কথা ও কাজ তথা সকল প্রকার এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোন বস্ত্তর এবাদতকে অস্বীকার করার নাম তাওহীদে উলূহিয়্যাহ। যেমন আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُوا إِلاَّ إِيَّاهُ
‘‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া তোমরা অন্য কারো এবাদত করবে না’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلاَ تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ‘‘তোমরা আল্লাহর এবাদত করো এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করোনা’’। (সূরা নিসাঃ ৩৬) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
نَّنِي أَنَا اللَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمْ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي
‘‘আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই। অতএব আমার এবাদত করো এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম করো’’। (সূরা তোহাঃ ১৪) এটিই (لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ)এর সরল ও সঠিক ব্যাখ্যা।
সুতরাং নামায আদায় করা, প্রার্থনা করা, যবেহ্ করা, নযর বা মানত করা, সাহায্য চাওয়া, বিপদে আশ্রয় প্রার্থনা করা, ইত্যাদি সকল প্রকার এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই করতে হবে। তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করা যাবেনা। এই প্রকার তাওহীদকেই কাফেরগণ অমান্য করেছিল এবং নূহ (আঃ) থেকে শুরু করে আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল ও তাঁদের উম্মতের মাঝে মূল বিরোধ ছিল এই তাওহীদকে কেন্দ্র করেই।
তাওহীদুল আসমা ওয়াস্ সিফাতঃ
তাওহীদুল্ আসমা ওয়াস্ সিফাতের অর্থ হলো, আল্লাহ নিজেকে যে সমস্ত নামে নামকরণ করেছেন এবং তাঁর কিতাবে নিজেকে যে সমস্ত সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করেছেন ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে যে সমস্ত অতি সুন্দর নামে এবং সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করেছেন, তাতে বিশ্বাস স্থাপন করা। তার ধরণ বর্ণনা করা ব্যতীত যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই আল্লাহ তাআলার জন্য তা সাব্যস্ত করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের অনেক স্থানে কোন প্রকার ধরণ বর্ণনা করা ব্যতীত স্বীয় সুউচ্চ গুণাবলী উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلاَ يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا
‘‘তাদের সম্মুখের ও পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেন। কিন্তু তারা জ্ঞান দ্বারা তাঁকে আয়ত্ত করতে পারেনা’’। (সূরা তোহাঃ ১১০) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ
‘‘ তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’’ (সূরা শুরাঃ ১১)
তিরমিযী শরীফে উবাই বিন কাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললঃ আমাদের সামনে আপনার রবের বংশ পরিচয় বর্ণনা করুন। তখন আল্লাহ তাআলা এই সূরাটি নাযিল করেনঃ
قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ
‘‘হে রাসূল তুমি বলোঃ তিনি আল্লাহ্ একক। আল্লাহ্ অমূখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং তাঁকে জন্ম দেয়া হয়নি এবং তাঁর সমতুল্য অন্য কেউ নেই’’। ‘সামাদ’ হচ্ছে যিনি কাউকে জন্ম দেন নি বা যাকে কেউ জন্ম দেয়নি। কারণ জন্মগ্রহণকারী সকলেই মরণশীল। আর মরণশীল প্রতিটি বস্ত্তই উত্তরাধিকারী রেখে যায়। আর আল্লাহ তাআলা মরণশীল নন, তিনি কারো উত্তরাধিকারী নির্ধারণকারী নন। ‘আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই’ অর্থাৎ কেউ তাঁর সমকক্ষ, সম মর্যাদা সম্পন্ন এবং তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই।
আল্লাহ্ তাআলার অনেকগুলো অতি সুন্দর নাম এবং সুউচ্চ গুণাবলী রয়েছে যা তাঁর পরিপূর্ণতা এবং মহত্ত্বের প্রমাণ বহন করে, এ কথার প্রতি ঠিক সেভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা যেভাবে পবিত্র কুরআন এবং হাদীছে উল্লেখ হয়েছে। কোন প্রকার বিকৃতি, অস্বীকৃতি, ধরণ-গঠন বা সাদৃশ্য আরোপ না করেই। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ
‘‘তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’’ এই আয়াতে কোন বস্ত্ত তাঁর অনুরূপ না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা- এই দু’টি সিফাত তাঁর জন্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। এটাই হলো সালাফে সালেহীন তথা সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীগণের মূলনীতি। তারা সকলেই আল্লাহর অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর শিখানো মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলা নিজের জন্য যে অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী পছন্দ করেছেন বা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নাম ও গুণাবলী তাঁর হাদীছে উল্লেখ করেছেন উহা ব্যতীত অন্য কোন নাম বা গুণাবলী আল্লাহ্ তাআলার জন্য নির্দিষ্ট করা যাবেনা। কেননা আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ অধিক অবগত নয়। আল্লাহ্র পর তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া আল্লাহ্ সম্পর্কে অধিক অবগত আর কেউ নেই।
[3] - শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এখানে বুঝাতে চেয়েছেন যে, কুরআন ও হাদীছে আল্লাহর যে ইরাদাহ বা ইচ্ছার কথা উল্লেখিত হয়েছে তা দুই প্রকার। যথাঃ
(১) ইরাদাহ কাওনীয়া কাদ্রীয়া (সৃষ্টি ও নির্ধারণ করার ইচ্ছা)। এটি আল্লাহর এমন ইচ্ছা, যা তাঁর ভালোবাসা এবং পছন্দকে আবশ্যক করেনা। কুফরী, ঈমান, আনুগত্য, পাপাচার, সন্তুষ্টি, ভালবাসা, পছন্দনীয় এবং অপছন্দনীয় সবই এ প্রকার ইচ্ছার অন্তর্ভূক্ত। কোন ব্যক্তিই আল্লাহর এ প্রকার ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে পারে না এবং তা হতে পালানোর কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
فَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يَهدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلإسْلاَمِ وَمَنْ يُرِدْ أَنْ يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا
‘‘অতএব আল্লাহ্ যাকে হিদায়াত করতে চান, ইসলামের জন্যে তার অন্তকরণ খুলে দেন। আর যাকে পথভ্রষ্ট করার ইচ্ছা করেন, তার অন্তকরণ খুব সংকুচিত করে দেন’’। (সূরা আন-আমঃ ১২৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ فِتْنَتَهُ فَلَنْ تَمْلِكَ لَهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا أُولَئِكَ الَّذِينَ لَمْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يُطَهِّرَ قُلُوبَهُمْ
‘‘আল্লাহ্ যাকে ফিতনায় ফেলতে চান, তার জন্য আল্লাহর কাছে কিছুই করার নেই। ওরা হল সেই লোক, যাদের অন্তরসমূহকে আল্লাহ্ পবিত্র করার ইচ্ছা পোষণ করেন নি’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৪১) এছাড়াও আরো আয়াত রয়েছে।
(২) ইরাদা শারঈয়া ও দ্বীনিয়া (শরীয়তগত ইচ্ছা)। আল্লাহর যে ইচ্ছা সন্তুষ্টি ও ভালবাসার সাথে সম্পৃক্ত, তাকে ইরাদাহ শরঈয়া বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা কোন জিনিষকে ভালবেসে যে ইচ্ছা পোষণ করেন তাকে ইরাদাহ শরঈয়া বলা হয়। এ ইচ্ছার কারণেই আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদেরকে আদেশ ও নিষেধ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ
‘‘আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ করার ইচ্ছা করেন, তোমাদের পক্ষে যা কঠিন, তা তিনি চান না’’। (সূরা বাকারাঃ ১৮৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
يُرِيدُ اللَّهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمْ وَيَهْدِيَكُمْ سُنَنَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَيَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ
‘‘আল্লাহ্ তোমাদের জন্যে বর্ণনা করতে, তোমাদেরকে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের আদর্শসমূহ প্রদর্শন করতে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে ইচ্ছা করেন। আল্লাহ্ মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান’’। (সূরা নিসাঃ ২৬) এ ছাড়া আরো আয়াত রয়েছে। আল্লাহ তাআলার এ প্রকার ইচ্ছা তথা শরীয়ত গত ইচ্ছা শুধু তার ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হবে, যার ক্ষেত্রে সৃষ্টিগত ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছে। আনুগত্যকারী মুমিনের মধ্যে ইরাদাহ কাওনীয়া ও শরঈয়া উভয়ই একত্রিত হয়ে থাকে। আর কাফেরের ক্ষেত্রে শুধু আল্লাহর সৃষ্টিগত ইচ্ছাই বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর সকল বান্দাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের আহবান জানিয়েছেন। তাদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা তাকেই আহবানে সাড়া দেয়ার পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَى دَارِ السَّلاَمِ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ
‘‘আর আল্লাহ্ তোমাদেরকে শান্তির আবাসস্থল তথা জান্নাতের দিকে আহবান করেন এবং যাকে ইচ্ছা সরল পথে চলার ক্ষমতা দান করেন’’। (সূরা ইউনুসঃ ২৫) সুতরাং তিনি সকলকে আহবান জানিয়েছেন, কিন্তু যাকে ইচ্ছা কেবল তাকেই হেদায়াত নসীব করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ اهْتَدَى
‘‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথের উপর রয়েছে’’। (সূরা নাজ্ম ৩০)
আল্লাহ তাআলার ইরাদাহ তথা ইচ্ছার বিষয়টি ভালভাবে বুঝার জন্য আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। আল্লাহর আদেশ, ফয়সালা এবং তাঁর ইচ্ছার মধ্যে এমন কিছু ইচ্ছা ও আদেশ রয়েছে, যা শরীয়তের হুকুম-আহকামের সাথে সংশ্লিষ্ট। আরেক প্রকার আদেশ, ইচ্ছা ও ফয়সালা রয়েছে, যা সৃষ্টি ও নির্ধারণের সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহ তাআলার যেই আদেশ সৃষ্টি ও নির্ধারনের সাথে সম্পৃক্ত, তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যা সৃষ্টি এবং নির্ধারণ করার ইচ্ছা করেন, তার সাথে সম্পৃক্ত আদেশ হুবহু বাস্তবায়িত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ
‘‘আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি করার নিয়ম এই যে, যখন তিনি কোন কিছুর ইচ্ছা করেন তখন তিনি কেবল তাকে এতটুকু বলেন যে, হয়ে যাও। অতঃপর তা হয়ে যায়’’। (সূরা ইয়াসীনঃ ৮২) আললাহ তাআলা আরো বলেনঃ وَاللَّهُ غَالِبٌ عَلَىٰ أَمْرِهِ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পন্ন করেই থাকেন, কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানেনা’’। (সূরা ইউসুফঃ ২১) অর্থাৎ আল্লাহর বিধানগত আদেশ অবশ্যই বাস্তবায়িত হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই। যেমন আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেনঃ
وَقَضَيْنَا إِلَيْهِ ذَٰلِكَ الْأَمْرَ أَنَّ دَابِرَ هَٰؤُلَاءِ مَقْطُوعٌ مُّصْبِحِينَ
‘‘আর তাকে আমি এ ফায়সালা পৌঁছিয়ে দিলাম যে, সকাল হতে হতেই এদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হবে’’। (সূরা হিজরঃ ৬৬) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
وَقَضَيْنَا إِلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ فِي الْكِتَابِ لَتُفْسِدُنَّ فِي الْأَرْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَّ عُلُوًّا كَبِيرًا
‘‘তারপর আমি নিজের কিতাবে বনী ইসরাঈলকে এ মর্মে ফয়সালা দিয়েছিলাম যে, তোমরা দুবার পৃথিবীতে বিরাট বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং ভীষণ বাড়াবাড়ি করবে’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৪) সুতরাং আল্লাহর ফয়সালা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে শরীয়তগত ফয়সালা বান্দাদের মানা না মানার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তাআলার বাণীঃ وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ‘‘তোমার রব এ ফয়সালা দিয়েছেন যে তাঁকে ছাড়া তোমরা আর কারো এবাদত করোনা। আর মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৩) এটি আল্লাহর শরীয়তের ফয়সালার (আদেশের) অন্তর্ভূক্ত। তাই আপনি দেখবেন যে, অনেক মানুষ আল্লাহর সাথে শির্কও করে এবং কেউ কেউ তার পিতা-মাতার অবাধ্যও হয়।
আর আল্লাহ তাআলার বাণীঃ ﴾أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴿ ‘‘আল্লাহ আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁর এবাদত ব্যতীত অন্য কারোর এবাদত করবেনা৷ এটিই সরল সঠিক দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানেনা’’। (সূরা ইউসুফঃ ৪০) এটি হচ্ছে শরীয়ত ও দ্বীনি আদেশ। কিছু লোক এই আদেশের বিরোধীতাও করে। তাই আপনি দেখবেন যে, এক শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর সাথে এমন কিছুকে শরীক করে, যার পক্ষে আল্লাহ কোন দলীল প্রমাণ নাযিল করেন নি।
[4]- যেসব জাতি আল্লাহ তাআলার রুবুবীয়াতকে অস্বীকার করেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে ইবরাহীম (আঃ)এর সাথে বিতর্ককারী (নমরুদ) অন্যতম। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَاجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ آتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللَّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ
‘‘তুমি কি সেই ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে জাননা, যে ইবরাহীমের সাথে তর্ক করেছিল? তর্ক করেছিল এই কথা নিয়ে যে, ইবরাহীমের রব কে? এবং তর্ক এ জন্য করেছিল যে, আল্লাহ তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছিলেন৷ যখন ইবরাহীম (আঃ) বললেনঃ যার হাতে জীবন ও মৃত্যু তিনিই আমার রব৷ জবাবে সে বললোঃ আমিও তো জীবন ও মৃত্যু দিতে পারি৷ ইবরাহীম (আঃ) বললেনঃ তাই যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে, আল্লাহ তো পূর্ব দিক থেকে সূর্য উঠান। তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উঠাও তো দেখি৷ একথা শুনে সেই কাফের হতবুদ্ধি হয়ে গেলো কিন্তু আল্লাহ জালেমদের সঠিক পথ দেখান না’’। (সূরা বাকারাঃ ২৫৮)
আল্লাহ তাআলা যখন মূসা (আঃ)কে ফেরাউনের কাছে পাঠালেন তখন তিনি নিজেকে রাববুল আলামীনের রাসূল হিসেবে পেশ করলেন। ফেরাউন তখন বলেছিলঃ وَمَا رَبُّ الْعَالَمِينَ রাববুল আলামীন আবার কে? ফেরাউন আরো বলেছিল, أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَىٰ আমি তোমাদের সবচেয়ে বড় রব (সূরা নাযিআতঃ ২৪) সে আরো বলেছিল,
يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرِي فَأَوْقِدْ لِي يَا هَامَانُ عَلَى الطِّينِ فَاجْعَل لِّي صَرْحًا لَّعَلِّي أَطَّلِعُ إِلَىٰ إِلَٰهِ مُوسَىٰ وَإِنِّي لَأَظُنُّهُ مِنَ الْكَاذِبِينَ
‘‘হে সভাসদবর্গ! আমি তো নিজেকে ছাড়া তোমাদের আর কোন প্রভু আছে বলে জানি না৷ ওহে হামান! আমার জন্য ইঁট পুড়িয়ে একটি উঁচু প্রাসাদ তৈরি করো, হয়তো তাতে উঠে আমি মূসার প্রভুকে দেখতে পাবো, আমিতো তাকে মিথ্যুক মনে করি’’ (সূরা কাসাসঃ ৩৮)
এখন প্রশ্ন হলো সে কি আসমান ও যমীনের রবের উপর বিশ্বাস করতো এবং তা গোপন রেখেছিল? না কি সে মোটেই বিশ্বাস করতো না? আল্লাহর নবী মুসা (আঃ)এর কথা থেকে বুঝা যায় ফেরাউন আল্লাহর উপর ঈমান রাখতো। আল্লাহ তাআলা মুসা (আঃ)এর উক্তি উদ্বৃত করে বলেনঃ
قَالَ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنزَلَ هَٰؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ وَإِنِّي لَأَظُنُّكَ يَا فِرْعَوْنُ مَثْبُورًا
‘‘তুমি খুব ভাল করেই জান এ প্রজ্ঞাময় নিদর্শনগুলো আকাশ ও পৃথিবীর রব ছাড়া আর কেউ নাযিল করেন নি। হে ফেরাউন! আমার মনে হয় তুমি নিশ্চয়ই একজন হতভাগ্য ব্যক্তি’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ১০২) অর্থাৎ হে ফেরাউন তুমি ভাল করেই জান যে, এই নিদর্শন ও মুজিযাগুলো যিনি নাযিল করেছেন, তিনি হলেন আসমান ও যমীনের প্রভু আল্লাহ তাআলা। কিন্তু তুমি অযথা ঝগড়া করছো এবং বিতর্ক করছো। ফেরাউনের গোত্রের লোকেরা ফেরাউনকে বলেছিলঃ
وَقَالَ الْمَلَأُ مِن قَوْمِ فِرْعَوْنَ أَتَذَرُ مُوسَىٰ وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ قَالَ سَنُقَتِّلُ أَبْنَاءَهُمْ وَنَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ وَإِنَّا فَوْقَهُمْ قَاهِرُونَ
‘‘ফেরাউনকে তার জাতির প্রধানরা বললঃ ‘‘তুমি কি মূসা ও তার জাতিকে এমনিই ছেড়ে দেবে যে, তারা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়াবে এবং তোমার ও তোমার মাবুদের এবাদত পরিত্যাগ করবে? ’’ফেরাউন জবাব দিলঃ ‘‘আমি তাদের পুত্রদের হত্যা করবো এবং তাদের কন্যাদের জীবিত রাখবো৷ আমরা তাদের উপর প্রবল কর্তৃত্বের অধিকারী’’। (সূরা আরাফঃ ১২৭) ফেরাউনের রাজ দরবারের উচ্চ পদস্থ লোকদের এই কথা থেকে বুঝা যায় যে, ফেরাউনের একজন মাবুদ ছিল। সে গোপনে এই মাবুদের এবাদত করতো।
কেউ কেউ আবার তাদের কথার ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, এখানে তাদের কথার অর্থ হলো, মুসা তোমাকে পরিত্যাগ করবে এবং তোমার জন্য তার এবাদতকেও পরিত্যাগ করবে। (আল্লাহই অধিক জানেন)
তবে কিছু কিছু কাফের আল্লাহর রুবুবীয়াতকেও অস্বীকার করে থাকে। তার প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার বাণীঃ
وَيُرْسِلُ الصَّوَاعِقَ فَيُصِيبُ بِهَا مَن يَشَاءُ وَهُمْ يُجَادِلُونَ فِي اللَّهِ وَهُوَ شَدِيدُ الْمِحَالِ
‘‘তিনি বজ্র প্রেরণ করেন। অতঃপর যার উপর ইচ্ছা উহা নিক্ষেপ করেন৷ তারা আল্লাহর ব্যাপারে বাদানুবাদ করছে। আসলে তাঁর কৌশল বড়ই কঠোর। (সূরা রা’দঃ ১৩)
কোন কোন আলেমের নিকট হাসান সনদে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আনাস (রাঃ) থেকে ইমাম বাযযার (রঃ) কাশফুল আসতারে (৩/৫৪) হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। আনাস (রাঃ) বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার জন্য একজন সাহাবীকে জাহেলী যামানার কাফেরদের জনৈক নেতার নিকট পাঠালেন। সেই কাফের বললঃ তুমি যেই রবের দিকে আমাকে ডাকছ, সে কিসের তৈরী? সেকি লোহার তৈরী? না কি পিতলের? রৌপ্যের? না কি স্বর্ণের?
সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ফেরত এসে ঘটনা জানালেন। তিনি তাঁকে দ্বিতীয়বার পাঠালেন। সেই কাফের একই কথা বলল। তাঁকে তৃতীয়বার পাঠানো হলে সে একই কথা বলল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ আল্লাহ তাআলা একটি বজ্র প্রেরণ করে তোমার সেই সাথীকে জ্বালিয়ে দিয়েছেন। তখন উপরোক্ত আয়াত নাযিল করেন।
উপরোক্ত আলোচনার সারসংক্ষেপ এই যে, (১) কোন কোন কাফের সৃষ্টিজগতের রবকে অস্বীকার করে এবং সৃষ্টির জন্য কোন ইলাহ (মাবুদ) থাকার কথাকেও অস্বীকার করে। (২) কোন কোন কাফের স্বীকার করে যে, আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা, তিনিই একমাত্র রিযিক দাতা ও সৃষ্টিজগতের সকল বিষয়ের তদবীরকারী। তবে আল্লাহ তাআলার সাথে তারা অন্যান্য মাবুদের এবাদত করে এবং আল্লাহর সাথে এমন বস্ত্তকে শরীক করে, যার পক্ষে আল্লাহ তাআলা কোন দলীল-প্রমাণ নাযিল করেন নি। কতিপয় কাফের-মুশরেক যে আল্লাহর রুবুবীয়াতকে স্বীকার করতো, তার দলীল হচ্ছে, যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ
‘‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ্। (সূরা লুকমানঃ ২৫)
(৩) কোন কোন কাফের আল্লাহতে বিশ্বাস করে, কিন্তু তারা দাবী করে যে, আল্লাহর পুত্র সন্তান রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদের জবাবে বলেনঃ
وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ۖ ذَٰلِكَ قَوْلُهُم بِأَفْوَاهِهِمْ ۖ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن قَبْلُ ۚ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ ۚ أَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ
‘‘ইহুদীরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং খৃষ্টানরা বলে, মসীহ আল্লাহর পুত্র৷এগুলো একেবারেই আজগুবী ও উদ্ভট কথাবার্তা৷ তাদের পূর্বে যারা কুফরিতে লিপ্ত হয়েছিল তাদের দেখাদেখি তারা এগুলো নিজেদের মুখে উচ্চারণ করে থাকে৷ আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক তাদের উপর, তারা কোথা থেকে ধোকা খাচ্ছে! (সূরা তাওবাঃ ৩০) আল্লাহ তাআলা সূরা মায়েদার ১৮ নং আয়াতে আরো বলেনঃ
وَقَالَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَىٰ نَحْنُ أَبْنَاءُ اللَّهِ وَأَحِبَّاؤُهُ قُلْ فَلِمَ يُعَذِّبُكُم بِذُنُوبِكُم ۖ بَلْ أَنتُم بَشَرٌ مِّمَّنْ خَلَقَ ۚ يَغْفِرُ لِمَن يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَاءُ ۚ وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا ۖ وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ
‘‘ইহুদী ও খৃষ্টানরা বলে, আমরা আল্লাহর সন্তান এবং তাঁর প্রিয়পাত্র৷ তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, তাহলে তোমাদের গুনাহের জন্য তিনি তোমাদের শাস্তি দেন কেন? আসলে তোমরাও ঠিক তেমনি মানুষ যেমন আল্লাহ অন্যান্য মানুষ সৃষ্টি করেছেন৷ তিনি যাকে চান মাফ করে দেন এবং যাকে চান শাস্তি দেন৷ পৃথিবী ও আকাশসমূহ এবং এ দুয়ের মধ্যকার যাবতীয় সৃষ্টি আল্লাহর মালিকানাধীন এবং তাঁরই দিকে সবাইকে ফিরে যেতে হবে’’।
(৪) কিছু মানুষ রয়েছে, যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁকে এমন বিশেষণে বিশেষিত করে, যা তাঁর পবিত্র সত্তার জন্য অশোভনীয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَقَالَتْ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ
‘‘আর ইহুদীরা বলেঃ আল্লাহর হাত বাঁধা রয়েছে। তাদের হাতই বাঁধা হয়ে গেছে। এ কথা বলার কারণে তাদের প্রতি অভিসম্পাত; বরং তাঁর উভয় হস্ত সদা উন্মুক্ত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা ব্যয় করেন’’। (সূরা মায়িদাঃ ৬৪) আল্লাহ তাআলা ইহুদীদের প্রতিবাদ করে বলেনঃ
لَقَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ سَنَكْتُبُ مَا قَالُوا وَقَتْلَهُمْ الْأَنْبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَنَقُولُ ذُوقُوا عَذَابَ الْحَرِيقِ
‘‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের কথা শুনেছেন, যারা বলেছে, আল্লাহ হচ্ছেন অভাবগ্রস্ত আর আমরা বিত্তবান। এখন আমি তাদের কথা এবং যেসব নবীকে তারা অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে, তা লিখে রাখবো, অতঃপর বলবোঃ ‘আস্বাদন করো জ্বলন্ত আগুনের আযাব’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৮১)
(৫) আল্লাহ তাআলার উপর বিশ্বাসী কিছু মানুষ আল্লাহর অনেক সিফাতকে অস্বীকার করে। মুতাযেলা ও জাহমীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা এদের অন্তুর্ভূক্ত। আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীদের সাথে কথা বলেছেন, তিনি কথা বলেন, কিয়ামতের দিন মানুষের সাথে কথা বলবেন, আল্লাহ তাআলার হাত ও চক্ষু রয়েছে। তিনি দৃশ্য-অদৃশ্য ইত্যাদি সকল বিষয়ের খবর রাখেন। কোন কোন ফির্কা আল্লাহ তাআলার এসব সিফাত (বিশেষণ) অস্বীকার করে থাকে। এমনি আরো অসংখ্য গোমরাহ দল রয়েছে, যা বলে শেষ করা যাবেনা। আমরা এগুলো থেকে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি।
অপর পক্ষে তাওহীদ ও সঠিক পথের অনুসারী মুসলিমগণ সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তারা আল্লাহ তাআলাকে এমনসব সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করে, যদ্বারা আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের সত্তাকে গুণান্বিত করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্র সুন্নাতে আল্লাহ তাআলার যেসব গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, তারা কোন প্রকার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ছাড়া তাতেও বিশ্বাস করে। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। যথাস্থানে তা আলোচনা করা হবে ইনশা-আল্লাহ।
[5] - এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, মুসলিমগণ মুশরেকদের বাতিল মাবুদ ও শির্ক থেকে মুক্ত থাকার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে এবং তারা সর্বদা এমন আমল করবে, যা তাদেরকে শির্ক থেকে দূরে রাখে। এরই অংশ হিসাবে আমরা ফজরের সুন্নত দুই রাকআত নামাযের মাধ্যমে দিবসের আমল শুরু করি এবং বিতর নামাযের মাধ্যমে রাতের আমলের পরিসমাপ্তি ঘটাই। শির্ক ও মুশরেকদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন ঘোষণা করার জন্যই উপরোক্ত নামায দু’টিতে এমন দু’টি সূরা পাঠ করি, যাতে রয়েছে শির্কের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও আপোসহীনতার জোরালো ঘোষণা। সুতরাং এই আমলটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া বাঞ্চনীয়।
[6] - হাদীছটি ইমাম তিরমিজী, নং- ২৬১৯ এবং ইবনে মাজাহ, নং-৪০৪৪-এ বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ এই হাদীছটি হাসান সহীহ। দেখুনঃ ইরওয়াউল গালীল, হাদীছ নং- ৪১৩।
আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেনঃ
وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا
‘‘তোমার রব এ ফয়সালা দিয়েছেন যে তাঁকে ছাড়া তোমরা আর কারো এবাদত করোনা। আর মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৩)
......................................................
ব্যাখ্যাঃ এখানে قضى (ফয়সালা প্রদান করেছেন) শব্দটি আদেশ দিয়েছেন অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহর বাণীঃ أن لاتعبدوا -এর মধ্যে রয়েছে لاإله -এর অর্থ। আর إلاإياه -এর মধ্যে রয়েছে إلا الله এর অর্থ। কালেমায়ে ইখলাস (لاإله إلاالله )-এর অর্থ এটিই। সুবহানাল্লাহ্! সুতরাং এই বিষয়টির (তাওহীদের) বিশদ বর্ণনা ও ব্যাখ্যা আসার পরও উম্মতের পরবর্তী যুগের লোকদের কাছে কিভাবে তা অস্পষ্ট থাকতে পারে?[7]
সূরা নিসার ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا
‘‘তোমরা আল্লাহর এবাদত করো। আর তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরিক করো না’’।
.............................................................
ব্যাখ্যাঃ এই আয়াতে ঐ এবাদতের কথাই বর্ণনা করা হয়েছে, যার জন্য জিন ও মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে বান্দাদের উপর ফরযকৃত এবাদতের আদেশ দেয়ার সাথে সাথে এবাদতের মধ্যে শির্ক করা থেকে নিষেধ করেছেন। যেই শির্ককে তিনি হারাম করেছেন, তা হচ্ছে ঐ শির্ক, যা এবাদতের মধ্যে হয়ে থাকে। সুতরাং আয়াতটি প্রমাণ করে যে, শির্ক থেকে দূরে থাকাই বান্দার এবাদত সঠিক হওয়ার প্রধান ও মূল শর্ত। শির্ক থেকে দূরে না থাকলে এবাদত সঠিক হবে না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ
‘‘তারা যদি শির্ক করত, তাহলে তাদের আমলসমূহ বরবাদ হয়ে যেত’’। (সূরা আনআমঃ ৮৮) আল্লাহ্ তাআলা আরে বলেনঃ
وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ، بَلِ اللَّهَ فَاعْبُدْ وَكُن مِّنْ الشَّاكِرِينَ
‘‘তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্বের নবীদের প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে, যদি আল্লাহ্র শরীক স্থির করো, তাহলে তোমার কর্ম নিস্ফল হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। বরং আল্লাহ্রই এবাদত করো এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত থাকো’’। (সূরা যুমারঃ ৬৫-৬৬) এ আয়াতদ্বয়ে مفعول মাফউলকে فاعبد শব্দের পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবী ব্যাকরণের একটি সাধারণ নিয়ম হচ্ছে প্রথম فعل (ক্রিয়া) অতঃপর فاعل (কর্তা), তারপর مفعول তথা ক্রিয়া পতিত হওয়ার স্থলকে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমে প্রথমেই যদি মাফউল উল্লেখ করা হয়, তখন ফেল বা ক্রিয়াকে মাফউলের উপর সীমিত করা হয়। অর্থাৎ কেবল আল্লাহরই এবাদত কর, অন্যের নয়। যেমন আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ
‘‘আমরা একমাত্র তোমারই এবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি’’। (সূরা ফাতিহাঃ ৫) আল্লাহ্ তাআলা এই তাওহীদকেই সূরা যুমারের ১১ নং আয়াতে জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّينَ
‘‘বলোঃ আমি একমাত্র আল্লাহ্র এবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি, দ্বীনকে তাঁর জন্য নিবেদিত করে’’। মূলতঃ দ্বীন ও এবাদত একই বিষয়। যে সমস্ত কাজ করার আদেশ দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা এবং যে সকল বিষয় হতে নিষেধ করা হয়েছে, তা বর্জন করার নামই হচ্ছে এবাদত। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রঃ) বলেনঃ
والأمر والنهي الذي هو دينه + وجزاؤه يوم المعاد الثاني
আদেশ ও নিষেধই হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। আর এগুলো পালন করার পুরস্কার পাওয়া যাবে কিয়ামতের দিন। ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, দ্বীনের মূল বুনিয়াদ হচ্ছে তাওহীদুল ইবাদাহ তথা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা। সুতরাং এ কথাটি সবসময় মনে রাখা জরুরী।
সূরা আনআমের ১৫১ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ
‘‘তুমি বলোঃ এসো! আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শুনাই, যেগুলো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। তা এই যে, আল্লাহ্র সাথে অন্য কিছুকে অংশীদার করোনা, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্রে্যর কারণে হত্যা করোনা আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার দেই। অশ্লীলতার কাছেও যেয়োনা, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য, যাকে হত্যা করা আল্লাহ্ হারাম করেছেন, তাকে হত্যা করোনা; তবে ন্যায়ভাবে হত্যা করার কথা ভিন্ন। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা বুঝ’’। (সূরা আনআমঃ ১৫১)
.............................................................
ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলা তোমাদের উপর শির্ক হারাম করেছেন এবং আল্লাহ্ তাআলার বাণীঃ তোমরা তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবেনা এর মাধ্যমে তিনি শির্ক থেকে নিষেধও করেছেন।
সুতরাং জানা যাচ্ছে যে, বান্দা ছোট-বড় যত গুনাহ্-এর মাধ্যমে আল্লাহর নাফরমানী করে থাকে, তার মধ্যে শির্কই হচ্ছে সর্বাধিক বড় ও ভয়াবহ।
এই উম্মতের পরবর্তী যামানার অধিকাংশ লোক জাহেলিয়াতের লোকদের মতই এই সর্বাধিক ভয়াবহ হারাম কাজটিতে তথা শির্কে লিপ্ত হয়েছে। এরা কবর, গম্বুজ, বৃক্ষ, পাথর, শয়তান, জিন এবং মানুষের এবাদত করছে। যেমন জাহেলিয়াতের লোকেরা লাত, মানাত, উজ্জা, হুবল এবং অন্যান্য দেব-দেবীর পূজা করত। এই শির্ককেই দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করেছিল। তাদেরকে যখন তাওহীদের দিকে আহবান করা হল, তখন তারা ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করল এবং তাদের কল্পিত মাবুদগুলোর পক্ষ অবলম্বন করে মুসলিমদের প্রতি ক্রোধান্বিত হল। আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই অবস্থা বর্ণনা করেছেনঃ
وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ
‘‘যখন এককভাবে আল্লাহ্র নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন পরকালে অবিশ্বাসীদের অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়, আর যখন আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্যদের নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তারা আনন্দে উল্লাসিত হয়ে উঠে’’। (সূরা যুমারঃ ৪৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَإِذَا ذَكَرْتَ رَبَّكَ فِي الْقُرْآنِ وَحْدَهُ وَلَّوْاْ عَلَى أَدْبَارِهِمْ نُفُوراً
‘‘আর যখন তুমি কুরআনে একমাত্র তোমার পালনকর্তার কথা উল্লেখ করো, তখন অনীহা বশতঃ ওরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলে যায়’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৪৬) আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ
إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ
‘‘তাদের যখন বলা হতো, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই, তখন তারা দাম্ভিকতা প্রদর্শন করতো এবং বলতোঃ আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করব? (সূরা আস্ সাফ্ফাতঃ ৩৫-৩৬)
মক্কার মুশরিকরা ভাল করেই জানত যে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলার অর্থই হচ্ছে, তাদের ঐ শির্ককে প্রত্যাখ্যান করা, যাতে তারা লিপ্ত হয়েছিল এবং তারা ঐ তাওহীদকেই গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল, যার প্রতি কালেমায়ে তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ প্রমাণ বহন করে।
সুতরাং ঐ যামানার মুশরিকরাই এই উম্মতের বর্তমান সময়ের অধিকাংশ মুসলিমের চেয়ে কালেমায়ে তায়্যেবার অর্থ সম্পর্কে অধিক অবগত ছিল। বিশেষ করে মক্কার মুশরিকরা এই উম্মতের ঐ সমস্ত আলেমদের চেয়ে কালেমা তায়্যেবার অর্থ অধিক অবগত ছিল, যাদের কাছে শরীয়তের কতক বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান রয়েছে এবং তর্ক শাস্ত্রেও রয়েছে তাদের যথেষ্ট পান্ডিত্য। কিন্তু ‘তাওহীদুল ইবাদাহ্’-এর বিষয়ে জ্ঞান না থাকার কারণে তারা শির্কে লিপ্ত হয়েছে, যা তাওহীদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আর ‘তাওহীদুল আসমা ওয়াস্ সিফাত’ সম্পর্কেও তাদের কোন জ্ঞান না থাকার কারণে তারা তা অস্বীকার করেছিল। শুধু তাই নয়; বরং নিজেদের মতের সমর্থনে এবং তা প্রচারে তারা কিতাবও রচনা করেছে। তাদের ধারণা ছিল, তাদের মতই সঠিক। অথচ তাদের সে ধারণা প্রসূত মতটিই সম্পূর্ণ বাতিল। দুঃখ জনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে সঠিক ইসলাম লোকদের কাছে এমনই অপরিচিত হয়ে গেছে যে, ভাল বিষয় মন্দে পরিণত হয়েছে আর মন্দ বিষয় ভাল রূপ ধারণ করেছে। এ অবস্থাতেই পরবর্তী প্রজন্মের ছোটরা বড় হয়েছে এবং যুবকরা বৃদ্ধ হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
«بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا فَطُوبَى لِلْغُرَبَاء»
‘‘অপরিচিত অবস্থায় তথা অল্প সংখ্যক লোকের মাধ্যমে সঠিক ইসলামের সূচনা হয়েছে। অচিরেই তা সূচনার অবস্থায় ফেরত যাবে। সুতরাং এই গরীব তথা অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য সুখবর।[8] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেনঃ
«افْتَرَقَتِ الْيَهُودُ عَلَى إِحْدَى أَوْ ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً وَتَفَرَّقَتِ النَّصَارَى عَلَى إِحْدَى أَوْ ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِى عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً كُلُّهَا فِى النَّارِ إِلاَّ وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِىَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِى»
‘‘ইহুদীরা বিভক্ত হয়েছিল ৭১ দলে। খৃষ্টানরা বিভক্ত হয়েছিল ৭২ দলে। আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। মাত্র একটি দল ব্যতীত বাকীদের সকলেই জাহান্নামে যাবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, সেটি কোন্ দল? তিনি বললেন, আমি এবং আমার সাহাবীগণ যেই পথে আছি, সেই পথে যারা থাকবে, তারাই হবে নাজাতপ্রাপ্ত দল’’।[9]
এই উম্মতের সম্মানিত তিন যুগ চলে যাওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যৎ বাণী বাস্তবে পরিণত হয়েছে। দ্বীন ইসলামের মূল ভিত্তি তাওহীদ সম্পর্কে অজ্ঞতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তাওহীদের মূল শিক্ষা হচ্ছে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো এবাদত করা যাবেনা। সেই সঙ্গে আল্লাহ্ তাআলা ও তাঁর রাসূল যে সমস্ত এবাদত ইসলামী শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত করেছেন এবং যে পদ্ধতিতে করার আদেশ দিয়েছেন তা ব্যতীত অন্য কোন পদ্ধদিতে আল্লাহর এবাদত করা যাবেনা। এ বিষয়টি বর্তমানে অবহেলিত। অধিকাংশ মুসলিমের এবাদতে শির্ক-বিদআতের মিশ্রণ ঘটেছে। তারপরও আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে পৃথিবী এমন লোক থেকে খালী হয়নি, যারা দলীল-প্রমাণসহ তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে তাওহীদের দিকে আহবান করছে। আল্লাহ্ তাআলা নবী-রাসূলদের মাধ্যমে মানুষের কাছে হেদায়াতের এমন দলীল নাযিল করেছেন, যাতে তাওহীদের মূলমর্ম পরিত্যাগ না হয়। এ বিরাট অনুগ্রহের জন্য আল্লাহ্ তাআলার যথাযোগ্য প্রশংসা করা ও শুকরিয়া আদায় করা জরুরী।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ
«من أراد ان ينظر إلى وصية محمد صلى الله عليه وسلم التى عليها خاتمه فليقرأ قوله تعالى قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا..... وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيْمًا»
‘‘যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মোহরাঙ্কিত অসিয়ত দেখতে চায়, সে যেন আল্লাহ তাআলার এ বাণী পড়ে নেয়, হে মুহাম্মদ বলঃ এসো! তোমাদের রব তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তা পড়ে শুনাই। আর তা হলো, তোমরা তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না . . . . আর এটাই হচ্ছে আমার সরল-সোজা পথ’’।[10] (সূরা আনআমঃ ৫২-৫৩)
.............................................................
ব্যাখ্যাঃ এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উপদেশকে সেই অসীয়তের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যা লিখে মোহর লাগানো হয়েছে। তা আর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়নি। উদ্দেশ্য হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত পাওয়া থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত উম্মতকে একটি বিষয়েরই (তাওহীদের) দাওয়াত দিয়েছেন। এতে তিনি কোন পরিবর্তন সাধন করেন নি। তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর পক্ষ হতে অফুরন্ত দুরূদ ও সালাম। বনী শায়বান গোত্রের নেতা মাফরুক যখন দেখল যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদ, মেলা ও হজ্জের মৌসুমে আরব গোত্রসমূহকে তাওহীদের দাওয়াত দিচ্ছেন, তখন সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললঃ হে কুরাইশী লোক! তুমি আর কিসের দাওয়াত দিচ্ছ? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত করলেনঃ
قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ (১৫১) وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى وَبِعَهْدِ اللَّهِ أَوْفُوا ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ (১৫২) وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ
‘‘তুমি বলোঃ এসো, আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শুনাই, যেগুলো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। তা এই যে, আল্লাহ্র সাথে অন্য কিছুকে অংশীদার করোনা, পিতা-মাতার সাথে সদয় ব্যবহার করো, স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্রে্যর কারণে হত্যা করোনা আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার দেই। অশ্লীলতার কাছেও যেয়োনা, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য, যাকে হত্যা করা আল্লাহ্ হারাম করেছেন তাকে হত্যা করোনা; কিন্তু ন্যায়ভাবে হলে ভিন্ন কথা। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা বুঝ। এতিমদের ধন-সম্পদের কাছেও যেয়োনা; কিন্তু উত্তম পন্থায়- যে পর্যন্ত সে বয়ঃপ্রাপ্ত না হয়। ওজন ও মাপ পূর্ণ কর ন্যায় সহকারে। আমি কারো উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেইনা। যখন তোমরা কথা বল, তখন সুবিচার কর। যদিও তা নিকটাত্মীয়ের বিরুদ্ধে হয়। আল্লাহ্র অঙ্গীকার পূর্ণ কর। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলোনা। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা সংযত হও’’। (সূরা আনআমঃ ১৫১-১৫৩) এই মুহকাম আয়াতগুলোতে একটি আদেশ এবং একটি নিষেধ রয়েছে। এ রকমই আল্লাহ্ তাআলা ইবরাহীম খলীল (আঃ) এর ব্যাপারে সূরা বাকারার ১৩১-১৩২ নং আয়াতে বলেনঃ
إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ (১৩১) وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
‘‘স্মরণ করো, যখন তাকে তার প্রতিপালক বললেনঃ অনুগত হও। সে বললঃ আমি বিশ্বপালকের অনুগত হলাম। এরই অসিয়ত করেছে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে। ইয়াকুবও একই অসীয়ত করেছে তার সন্তানদেরকে। সে বলেছিলঃ হে আমার সন্তানগণ! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের জন্য এ দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলিম না হয়ে কখনো মৃত্যুবরণ করো না’’।
সাহাবী মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পিছনে একটি গাধার পিঠে বসে ছিলাম। তিনি তখন আমাকে ডাক দিয়ে বললেনঃ
«يَا مُعَاذُ هَلْ تَدْرِى حَقَّ اللَّهِ عَلَى عِبَادِهِ وَمَا حَقُّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ فَإِنَّ حَقَّ اللَّهِ عَلَى الْعِبَادِ أَنْ يَعْبُدُوهُ وَلاَ يُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَحَقَّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ أَنْ لاَ يُعَذِّبَ مَنْ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ أُبَشِّرُ بِهِ النَّاسَ قَالَ لاَ تُبَشِّرْهُمْ فَيَتَّكِلُوا»
‘‘হে মুআয! তুমি কি জানো, বান্দার উপর আল্লাহর কি হক রয়েছে? আর আল্লাহর উপর বান্দার কি হক আছে? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জানেন। তিনি বললেন, বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে তারা তাঁরই এবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হলো যারা তার সাথে কাউকে শরিক করবে না, তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন না। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি কি এ সুসংবাদ লোকদেরকে জানিয়ে দেব না? তিনি বললেন, তুমি তাদেরকে এ সুসংবাদ দিওনা। তাহলে তারা এবাদত ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে’’।[11]
.............................................................
ব্যাখ্যাঃ পূর্বের আয়াতগুলোর অর্থ বহন করার কারণেই শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রঃ) আয়াতগুলোর পর পরই এ হাদীছটি উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জবানের বাণীঃ বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে তারা তাঁরই এবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আল্লামা ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রঃ) বলেনঃ বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে, তারা আল্লাহর শরীয়ত মোতাবেক তাঁর এবাদত করবে, নিজের মন যেভাবে চায় সেভাবে নয়। কারণ নিজের মন মত এবাদত করলে তা শয়তানের এবাদতে পরিণত হয়। আর আল্লাহর এবাদতে অন্য কিছুকে শরীক করবেনা। এই দু’টি অর্থাৎ আল্লাহর এবাদত করা এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত শরীয়ত অনুযায়ী এবাদত করাই নাজাতের একমাত্র মাধ্যম। কতই না সুন্দর এ দু’টি মাধ্যম। আল্লাহর ক্রোধ ও তাঁর জাহান্নাম থেকে কেবল সেই রক্ষা পাবে, যে এই দু’টি বিষয়ের উপর আমল করবে। কিন্তু পরবর্তী যুগের কেউ পথভ্রষ্ট হয়ে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করেছে। আবার কেউ বিদআতের পথ বেছে নিয়েছে আবার কেউ উভয়টিতেই লিপ্ত হয়েছে।
সুতরাং যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর হক তথা এবাদতের কোন অংশ যেমন দুআ করা, সাহায্য চাওয়া ইত্যাদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে প্রদান করল, যে সেই এবাদতের হকদার নয় সে তাগুতের প্রতি ঈমান আনয়ন করল, আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করল এবং কুফরী করল।
حَقَّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ أَنْ لاَ يُعَذِّبَ مَنْ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হচ্ছে যারা তার সাথে কাউকে শরীক করবে না, তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন নাঃ এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, বিবেক দ্বারা আল্লাহর উপর কোন অত্যাবশ্যকীয় ওয়াজিব বা হক নির্ধারণ করা যাবেনা। যেমন ধারণা করে থাকে মুতাযেলা সম্প্রদায়। তাদের ধারণা সৎ লোককে জান্নাতে স্থান দেয়া এবং পাপীকে জাহান্নামে পাঠানো আল্লাহর উপর ওয়াজিব। মূলতঃ আল্লাহ্ তাআলার উপর কোন ওয়াজিব নেই। কিন্তু আল্লাহ্ তাআলার একনিষ্ঠ ও তাওহীদপন্থী বান্দারা যেহেতু তাদের ইচ্ছায়, এবাদতে, আশা-আকাঙ্খায় ও ভয়-ভীতির সময় আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো দারস্থ হয়না এবং তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে তথা সকল প্রকার এবাদতের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও নৈকট্য ও সন্তুষ্টি কামনা করেনা, তাই তাদেরকে শাস্তি না দেয়ার বিষয়টি আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে তাঁর নিজের উপর আবশ্যক করে নিয়েছেন। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ
১) জিন ও মানব জাতি সৃষ্টির রহস্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা গেল। আর তা হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর এবাদত করা এবং তাঁর এবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করা।
২) এককভাবে আল্লাহর এবাদতই হচ্ছে তাওহীদ। কারণ এটা নিয়েই বিবাদ।
৩) যার তাওহীদ ঠিক নেই, তার এবাদতও ঠিক নেই। আল্লাহ্ তাআলার বাণীঃ وَلا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ এর অর্থও তাই।
৪) রাসূল পাঠানোর হিকমত ও রহস্য জানা গেল।
৫) সকল উম্মতই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের আওতাধীন।
৬) সকল নবী-রাসূলের দ্বীন ছিল এক ও অভিন্ন। আর তা হচ্ছে ইসলাম।[12]
৭) সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তাগুতকে অস্বীকার করা ব্যতীত আল্লাহ্ তাআলার এবাদতের কল্পনাও করা যায়না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ
‘‘যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহ্র উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল, যা বিচ্ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ্ সবই শুনেন ও জানেন’’। (সূরা বাকারাঃ ২৫৬)[13]
৮) আল্লাহর এবাদত ব্যতীত অন্যান্য যেসব বস্ত্তর এবাদত করা হয়, সেগুলোই তাগুত হিসেবে গণ্য।
৯) সালাফে-সালেহীনের কাছে সূরা আনআমের উল্লেখিত তিনটি মুহকাম আয়াতের বিরাট মর্যাদার কথা জানা যায়। এতে দশটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এর প্রথমটিই হচ্ছে; শির্কের প্রতিবাদ ও তা নিষিদ্ধতার ব্যাপারে।
১০) সূরা ইস্রায় কতগুলো মুহকাম আয়াত রয়েছে এবং তাতে আঠারোটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ বিষয়গুলোর সূচনা করেছেন তাঁর এই বাণী দ্বারাঃ
لَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ فَتَقْعُدَ مَذْمُومًا مَخْذُولَا
‘‘স্থির করোনা আল্লাহ্র সাথে অন্য কোন উপাস্য। তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে’’। (সূরা ইসরাঃ ২২) আর এই প্রসঙ্গের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন তাঁর উক্ত বাণী দ্বারাঃ
وَلاَ تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ فَتُلْقَى فِي جَهَنَّمَ مَلُومًا مَدْحُورًا
‘‘আর আল্লাহ্র সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির করোনা। তাহলে নিন্দিত ও আল্লাহ্র অনুগ্রহ থেকে বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’’। (সূরা ইসরাঃ ৩৯) আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা তাঁর এই বাণীঃ ﴾ذَلِكَ مِمَّا أَوْحَى إِلَيْكَ رَبُّكَ مِنَ الْحِكْمَةِ﴿ ‘‘এটা ঐ হিকমতের অন্তর্ভুক্ত, যা তোমার প্রতিপালক তোমাকে অহী মারফত দান করেছেন’’ দ্বারা এ বিষয়গুলোর সুমহান মর্যাদাকে উপলব্ধি করার প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন।
১১( এ অধ্যায়ে সূরা নিসার ঐ আয়াতটি জানা গেল, যাতে দশটি হক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যার সূচনা হয়েছে আল্লাহ তাআলার এই বাণী দ্বারাঃ وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ‘‘তোমরা আল্লাহর এবাদত করো; তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করোনা আর পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো’’।
১২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তিম অসিয়তের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা। আর তা হচ্ছে উম্মতকে শির্ক থেকে সতর্ক করা এবং তাতে লিপ্ত হওয়া থেকে নিষেধ করার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
১৩) আমাদের উপর আল্লাহ তাআলার হক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা জরুরী।
১৪) বান্দা যখন আল্লাহর হক আদায় করবে তখন আল্লাহ তাআলার উপর বান্দার হক কী? তা জানা গেল।
১৫) অধিকাংশ সাহাবীই এ বিষয়টি জানতেন না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে মানুষের কাছে মাসআলাটি গোপন রাখার আদেশ দিয়েছিলেন। কারণ তা মানুষকে বলে দিলে তারা আল্লাহর সীমাহীন দয়া ও অনুগ্রহের উপর ভরসা করে আমল ছেড়ে দিতে পারে। তাই মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু মৃত্যুর সময়ই কেবল ইল্ম গোপন করার অপরাধে অপরাধী হওয়ার ভয়ে তা বলে দিয়েছেন। সুতরাং মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু জীবিত থাকা অবস্থায় এ বিষয়টি সম্পর্কে অধিকাংশ সাহাবীরই জ্ঞান ছিল না।
১৬) কোন বিশেষ স্বার্থে ইল্ম গোপন রাখার বৈধতা রয়েছে।
১৭) আনন্দ দায়ক বিষয়ে কোন মুসলিমকে সুখবর দেয়া মুস্তাহাব।
১৮) আল্লাহর অপরিসীম রহমতের উপর ভরসা করে আমল বাদ দেয়ার ভয়।
১৯) অজানা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির এই কথা বলা উচিৎ যে, الله ورسوله أعلم অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সবচেয়ে ভাল জানেন।[14]
২০) কাউকে বাদ রেখে অন্য কাউকে কোনো বিষয়ে জ্ঞান দান করার বৈধতা সম্পর্কে জানা গেল।
২১) গাধার পিঠে আরোহন করার মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিনয়-নম্রতার প্রমাণ মিলে। সেই সঙ্গে তাঁর পিছনে মুআযকে বসার সুযোগ দেয়ার মধ্যে তাঁর বিনয়ী হওয়ার বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট।
২২) একই পশুর পিঠে একজনের পিছনে অন্য ব্যক্তি আরোহনের বৈধতা জানা গেল।
২৩) মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুর মর্যাদা প্রমাণিত হল।
২৪) তাওহীদের মর্যাদা ও গুরুত্ব জানা গেল।
১) সেকালের মুশরিকরা শুধু সুখ-শান্তি ও আমোদ-প্রমোদে থাকার সময়ই আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করত। আর তাদের উপর বিপদাপদ ও মসীবত আপতিত হলে তারা তাদের বাতিল মাবুদগুলোকে ভুলে যেত এবং খালেসভাবে আল্লাহকেই উদ্ধারের জন্য আহবান করত। আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই অবস্থার বিবরণ কুরআনেই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ
فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوْا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ
‘‘তারা যখন জলযানে আরোহণ করে, তখন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্কেই ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে’’। (সূরা আনকাবুতঃ ৬৫)
কিন্তু আপনি যদি বর্তমান কালের এক শ্রেণীর কবর ও মাজার পূজারী মুসলিমদের দিকে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, তারা সুখে-দুঃখে তথা সকল অবস্থাতেই আল্লাহর সাথে শরীক করে থাকে। বিপদে পড়েও তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের কল্পিত অলী-আওলীয়াকেই উদ্ধারের জন্য আহবান করে। অথচ মক্কার মুশরিকরা কখনই এ ধরণের কাজ করত না। এমন কি তারা বিশ্বাসও করত না যে, বিপদ হতে উদ্ধারের ক্ষমতা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো আছে। শুধু তাই নয়, তারা একমাত্র আল্লাহকেই সৃষ্টি করা, রিযিক দেয়া বৃষ্টি বর্ষণ করা এবং জীবন-মরণের মালিক মনে করত। সুতরাং যেই মুশরিক শুধু সুখের সময় আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করে আর যেই নামধারী মুসলিম সুখে-দুঃখে তথা সকল অবস্থায় আল্লাহর সাথে শরীক করে, তাদের উভয়ের মধ্যে নামধারী মুসলিমের শির্কটিই অধিক ভয়াবহ। সুতরাং বিষয়টি ভালভাবে বুঝা উচিৎ।
২) মক্কার কুরাইশরা শুধু আল্লাহর প্রিয় ও নৈকট্যপ্রাপ্ত লোকদেরকেই আল্লাহর সাথে শরীক করত। যেমন লাত, মানাত, উজ্জা এবং অন্যান্য অলী-আওলীয়াকে আল্লাহর সাথে শরীক করত। আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেনঃ
وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا
‘‘তারা বলছে: তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে ত্যাগ করো না এবং ত্যাগ করো না ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নসরকে’’। (সূরা নূহঃ ২৩) বুখারী ও মুসলিম শরীফে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেনঃ এগুলো হচ্ছে নূহ (আঃ)এর জাতির সৎ লোকদের নাম। তারা যখন মারা গেল তখন শয়তান নূহ (আঃ)-এর কাওমের জীবিত লোকদের নিকট আগমণ করে বললঃ তোমরা তাদের মজলিসে তথা বসার স্থানে তাদের ছবি স্থাপন কর। তাদের নামেই এগুলোর নামকরণ কর। কারণ তাদের ছবি দেখলে তোমরা আল্লাহর এবাদতের আগ্রহ পাবে। তারা শয়তানের প্রস্তাবকে সুন্দর মনে করে তাই করল। কিন্তু তখনই তারা এগুলোর এবাদত শুরু করেনি। ঐ যুগের লোকেরা যখন মারা গেল এবং তাদের স্থলে নতুন এক প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটল, তখন শয়তান এই নতুন যুগের নতুন প্রজন্মের নিকট আগমণ করল। উল্লেখ্য যে, এই নতুন লোকেরা ঐ সমস্ত অলী-আওলীয়ার আসল ইতিহাস ভুলে গিয়েছিল এবং তাওহীদের শিক্ষা হতে বিচ্যুত হয়েছিল। তাই শয়তান দ্বিতীয়বার আগমণ করে যখন তাদেরকে এগুলোর এবাদতের বা এগুলোর উসীলা দিয়ে আল্লাহর এবাদতের আহবান জানাল, তখন ইলম না থাকার কারণে তারা শয়তানের সেই আহবানে সাড়া দিল এবং এদের এবাদত শুরু হয়ে গেল। এখান থেকেই শির্কের সূচনা হয় এবং বনী আদমের মধ্যে শির্ক প্রবেশ করে।
মোট কথা পূর্ব যামানার লোকেরা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত সৎ লোক, নিষ্পাপ ফেরেশতা, আল্লাহর অনুগত গাছপালা, পাথর ইত্যাদি মাসুম (নিষ্পাপ) বস্ত্তকে আল্লাহর সাথে শরীক করত। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, বর্তমান কালের নামধারী অসংখ্য মুসলিম আল্লাহর সাথে আল্লাহর এমন মাখলুককে শরীক করে, যারা সর্বাধিক নিকৃষ্ট ও পাপিষ্ঠ। তাদের পাপাচার ও অশ্লীলতা জনগণের কাছে সুপ্রকাশিত। তা সত্ত্বেও লোকেরা তাদেরকে আহবান করছে, তাদের কাছে দুআ করছে, সিজদাহ করছে এবং তাদের কাছে সাহায্য চাচ্ছে। সুতরাং যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দাকে আল্লাহর শরীক সাব্যস্থ করে আর যারা আল্লাহর নিকৃষ্ট বান্দাকে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তারা উভয়েই কি সমান। নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় দলের শির্ক প্রথম দলের শির্কের চেয়ে অধিক ভয়াবহ। সুতরাং বিষয়টি ভাল করে ভেবে দেখা উচিৎ।
৩) মক্কার মুশরিকদের শির্ক ছিল শুধু তাওহীদে উলুহীয়ার ক্ষেত্রেই। তাওহীদে রুবুবীয়াকে তারা মেনে চলত। তারা যে আল্লাহকে আসমান-জমিনসহ সকল বস্ত্তর একমাত্র সৃষ্টিকারী, রিযিক দাতা, জীবন-মরণের মালিক এবং পৃথিবীর পরিচালক ও ব্যবস্থাপক মনে করত, কুরআনই তার সাক্ষ্য দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴾وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ﴿ ‘‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো- কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তবে অবশ্যই তারা বলবে আল্লাহ্’’। (সূরা লুকমানঃ ২৫) কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে এমন লোকও মুসলিম হওয়ার দাবী করছে, যারা আল্লাহর রুবুবীয়াতেও অলী-আওলীয়াকে শরীক করছে। নিম্নের উদাহরণগুলো মন দিয়ে পড়লে ও গভীরভাবে উপলদ্ধি করলেই বিষয়টি সহজভাবে অনুধাবন করা যাবে।
১) ভেদে মারেফত বা ইয়াদে খোদা নামক বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় মৃতকে জীবিত করার যে গল্পটা আছে তা নিম্নরুপঃ
শামসুদ্দীন তাব্রীজী নামের এক লোক ছিলেন। লোকেরা তাকে পীর সাহেব কেবলা বলত। এবার আসি মূল গল্পে। একদা হযরত পীর সাহেব কিবলা রোম শহরের দিকে রওয়ানা হইলেন। পথিমধ্যে ঝুপড়ির ভেতর এক অন্ধ বৃদ্ধকে লাশ সামনে নিয়া কাদঁতে দেখিলেন। হুজুর বৃদ্ধকে প্রশ্ন করিলে বৃদ্ধ উত্তর করিলেন, ‘‘হুজুর এই পৃথিবীতে আমার খোঁজ-খবর করিবার আর কেউ নাই, একটি পুত্র ছিল সে আমার যথেষ্ট খেদমত করিত, তাহার ইন্তেকালের পর সে একটি নাতি রাখিয়া যায়। সেই ১২ বছরের নাতি একটা গাভী পালিয়া আমাকে দুগ্ধ খাওয়াইত এবং আমার খেদমত করিত, তার লাশ আমার সম্মুখে দেখিতেছেন। এখন উপায় না দেখিয়া কাঁদিতেছি’’। হুজুর বলিলেন এ ঘটনা কি সত্য? বৃদ্ধ উত্তর করিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। তখন হুজুর বলিলেনঃ "হে ছেলে আমার হুকুমে দাঁড়াও"। ছেলেটি উঠে দাঁড়াল এবং দাদুকে জড়াইয়া ধরিল, বৃদ্ধ তাকে জিজ্ঞেস করিল ‘‘তুমি কিরুপে জিন্দা হইলে’’। ছেলে জবাব দিল, ‘‘আল্লাহর অলী আমাকে জিন্দা করেছেন’’। (নাউযুবিল্লাহ) তারপর ঐ অঞ্চলের বাদশাহ হুজুরের এই খবর পেয়ে উনাকে তলব করিলেন। উনাকে পরে জিজ্ঞেস করিলেন "আপনি কি বলিয়া ছেলেটিকে জিন্দা করিয়াছেন"। হুজুর বলিলেন আমি বলেছি ‘‘হে ছেলে আমার আদেশে জিন্দা হইয়া যাও’’। অতঃপর বাদশাহ বলিলেন, ‘‘যদি আপনি বলিতেন আল্লাহর আদেশে’’। হুজুর বলিলেন "মাবুদ! মাবুদের কাছে আবার কি জিজ্ঞেস করিব। তাহার আন্দাজ নাই (নাউ-যুবিল্লাহ)। এই বৃদ্ধের একটি মাত্র পুত্র ছিল তাহাও নিয়াছে, বাকী ছিল এই নাতিটি যে গাভী পালন করিয়া কোনরুপ জিন্দেগী গোজরান করিত, তাহাকেও নিয়া গেল। তাই আমি আল্লাহ পাকের দরবার থেকে জোরপূর্বক রুহ নিয়া আসিয়াছি’’। (নাউ-যুবিল্লাহ)।
এরপর বাদশাহ বলিলেন আপনি শরীয়াত মানেন কিনা? হুজুর বলিলেন ‘‘নিশ্চয়ই! শরীয়াত না মানিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শাফায়াত পাইব না’’। বাদশাহ বলিলেন, ‘‘আপনি শির্ক করিয়াছেন, সেই অপরাধে আপনার শরীরের সমস্ত চামড়া তুলে নেওয়া হইবে’’। এই কথা শুনিয়া আল্লাহর কুতুব নিজের হাতের অঙ্গুলি দ্বারা নিজের পায়ের তলা হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত শরীরের চামড়া ছাড়াইয়া তা বাদশাহর কাছে ফেলিয়া জঙ্গলে চলিয়া গেলেন। পরদিন ভোরবেলা যখন সূর্য উঠিল তার চর্মহীন গায়ে তাপ লাগিল। তাই তিনি সূর্যকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন ‘‘হে সূর্য, আমি শরীয়াত মানিয়াছি, আমাকে কষ্ট দিওনা’’। তখন ওই দেশের জন্য সূর্য অন্ধকার হইয়া গেল। দেশের মধ্যে শোরগোল পড়িয়া গেল। এই অবস্থা দেখিয়া বাদশাহ হুজুরকে খুঁজিতে লাগিলেন। জঙ্গলে গিয়া হুজুরের কাছে বলিলেনঃ শরীয়াত জারি করিতে গিয়া আমরা কি অন্যায় করিলাম, যাহার জন্য আমাদের উপর এমন মুসিবত আনিয়া দিলেন। তখন হুজুর সূর্য কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ আমি তোমাকে বলিয়াছি আমাকে কষ্ট দিওনা, কিন্তু দেশবাসীকে কষ্ট দাও কেন? সূর্যকে বশ করা কি কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব? ইহা বলা মাত্র সূর্য আলোকিত হইয়া গেল। আল্লাহ্ পাক তাহার ওলীর শরীর ভাল করিয়া দিলেন।
প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! উপরোক্ত বানোয়াট কাহিনীতে গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে এতে একাধিক শির্ক বিদ্যমান। যেমনঃ
ক) কুরআন বলছে, জীবিতকে মৃত্যু দেয়া এবং মৃতকে জীবিত করা একমাত্র আল্লাহর কাজ। কোন নবী বা অলী মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা রাখে না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمْ مَنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ
‘‘হে নবী! তুমি জিজ্ঞেস করো, তোমাদেরকে আসমান থেকে ও যমীন থেকে কে রুযী দান করেন? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ! তখন তুমি বলো, তারপরেও তোমরা ভয় করছনা?’’ (সূরা ইউনুসঃ ৩১)
এই আয়াত থেকে বুঝা যায় মক্কার মুশরিকরাও এ কথা বিশ্বাস করতনা যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ মৃতকে জীবিত বা জীবিতকে মৃত্যু দান করার ক্ষমতা রাখে। অথচ মুসলিম নামধারী পীর ও মুরীদগণ তা বিশ্বাস করে থাকে।
এমনি আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ মৃতকে জীবিত করতে পারে না। এটি একমাত্র আল্লাহর বৈশিষ্ট। এমন কি আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য মুজেযা থাকা সত্ত্বেও মৃতকে জীবিত করার মুজেযা তাঁকে দেয়া হয় নি। এটি ছিল একমাত্র ঈসা (আঃ)এর মুজেযা।
এ ব্যাপারে তাদের দাপট দেখে মনে হয় তাদের কল্পিত অলীরা মৃতকে জীবিত করার ক্ষেত্রে ঈসা (আঃ) এর চেয়েও বেশী ক্ষমতা সম্পন্ন। কারণ ঈসা (আঃ) মৃতকে জীবিত করতেন قُمْ بِإِذْنِ اللَّهِ বলে অর্থাৎ তুমি আল্লাহর আদেশে জীবিত হও। যেমন আল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ)কে লক্ষ্য করে বলেনঃ (وَإِذْ تُخْرِجُ الْمَوتَى بِإِذْنِي) ‘‘এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদেরকে বের করে দাড় করিয়ে দিতে’’। (সূরা মায়িদাঃ ১১০)
আর পীর ও মুরীদদের বিশ্বাস হচেছ, তাদের অলীগণ قُمْ بِإِذْني অর্থাৎ আমার আদেশে উঠে দাঁড়াও এ কথা বলে মৃতকে জীবিত করে থাকেন।
সুতরাং কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, কোন পীর বা অলী মৃতকে জীবিত করতে পারে, তাহলে সে মুশরিক হিসেবে গণ্য হবে।
খ) চন্দ্র-সূর্য, নদ-নদী, দিবা-রাত্রি ইত্যাদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো হুকুমে চলে না। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لِأَجَلٍ مُسَمًّى يُدَبِّرُ الْأَمْرَ يُفَصِّلُ الْآَيَاتِ لَعَلَّكُمْ بِلِقَاءِ رَبِّكُمْ تُوقِنُونَ وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ جَعَلَ فِيهَا زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ
‘‘আল্লাহ্, যিনি উধর্বদেশে স্থাপন করেছেন আকাশমন্ডলীকে স্তম্ভ ব্যতীত। তোমরা সেগুলো দেখ। অতঃপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন। এবং সূর্য ও চন্দ্রকে কর্মে নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট সময় মোতাবেক আবর্তন করে। তিনি সকল বিষয় পরিচালনা করেন, নিদর্শন সমূহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা স্বীয় পালনকর্তার সাথে সাক্ষাত সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। তিনিই ভূমন্ডলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী স্থাপন করেছেন এবং প্রত্যেক ফলের মধ্যে দুই প্রকার (জোড়ায় জোড়ায়) সৃষ্টি করেছেন। তিনি দিনকে রাত্রি দ্বারা আবৃত করেন। এতে তাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা চিন্তা করে।’’ (সূরা রাদঃ ২-৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ
وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ
‘‘যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছে, চন্দ্র ও সূর্যকে কর্মে নিয়োজিত করেছে? তবে তারা অবশ্যই বলবে ‘আল্লাহ্’। তাহলে তারা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? (সূরা আনকাবুতঃ ৬১)
২) বর্তমান সময়ের সুফীরা বিশ্বাস করে যে, পৃথিবীতে কতিপয় আবদাল, কুতুব এবং আওলীয়া আছেন, যাদের হাতে আল্লাহ তাআলা পৃথিবী পরিচালনার কিছু কিছু দায়িত্ব সোপর্দ করে দিয়েছেন। সুতরাং তারা তাদের ইচ্ছামত পৃথিবীর কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন।
ফাযায়েলে আমাল বইয়ে এই ধরণের একটি ঘটনা উল্লেখ আছে। ঘটনার বিবরণ এই যে, হজরত শাইখুল হাদীছ বলেছেনঃ আমি আমার আববাজানের নিকট প্রায়ই একটা ঘটনা শুনতাম। উহা এই যে, জনৈক ব্যক্তি বিশেষ কোন প্রয়োজনে পানি পথে যাইতেছিল। পথিমধ্যে যমুনা নদী পড়িল, তাহার অবস্থা তখন এত ভয়ঙ্কর ছিল যে, নৌকা চলাও মুশকিল ছিল, লোকটি পেরেশান হইয়া গেল। লোকজন তাহাকে বলিল অমুক জঙ্গলে একজন কামেল লোক থাকেন, তাহার নিকট গিয়া স্বীয় প্রয়োজন পেশ কর। তিনি নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা করিবেন। তবে তিনি প্রথমে রাগ করিবেন। তাহাতে তুমি নিরাশ হইও না। লোকটি তাহাদের কথায় জঙ্গলের মধ্যে গিয়া দেখিলেন সেই দরবেশ তাহার বিবি বাচ্চাসহ একটি ঝুপড়ির মধ্যে বাস করিতেছে। সেই ব্যক্তি স্বীয় প্রয়োজন ও যমুনার অবস্থা বর্ণনা করিল, দরবেশ প্রথমে অভ্যাস মোতাবেক রাগ করিয়া বলিল, আমার হাতে কী আছে? আমি কী করিতে পারি? লোকটি কান্নাকাটি করিয়া আপন সমস্যার কথা বলিল, তখন দরবেশ বলিলঃ যাও, যমুনার কাছে গিয়া বলঃ আমাকে ঐ ব্যক্তি পাঠাইয়াছে, যে জীবনে কখনো কিছু খায় নাই এবং বিবির সহিত সহবাস করে নাই। লোকটি যমুনায় গিয়া দরবেশের কথা জানাইল। যমুনা তাহার কথা মত শান্ত হইয়া গেল। সেই লোকটি পার হইয়া যাওয়ার পর যমুনা আবার ভীষণ আকার ধারণ করিল। (দেখুনঃ ফাযায়েলে আমাল, দ্বিতীয় খন্ড, ১৬২ পৃষ্ঠা)
প্রিয় পাঠক বৃন্দ লক্ষ্য করুন, এটি এমন একটি বিশ্বাস যা মক্কার মুশরিকরাও পোষণ করতো না। তারা যখন সাগর পথে ভ্রমণ করার সময় বিপদে আক্রান্ত হত, তখন তারা সকল দেব-দেবীর কথা ভুলে গিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য এক মাত্র আল্লাহকেই ডাকতো। আল্লাহ তাআলা মক্কার মুশরিকদের সেই কথা কুরআনে উল্লেখ করে বলেনঃ
فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوْا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ
‘‘তারা যখন জলযানে আরোহণ করে তখন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্কে ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে।’’ (সূরা আনকাবুতঃ ৬৫) অথচ বর্তমান সময়ের অসংখ্য মুসলিমকে দেখা যায় তারা চরম বিপদের সময়ও আল্লাহকে বাদ দিয়ে কল্পিত অলী-আওলীয়াদেরকে আহবান করে থাকে, যা মক্কার মুশরিকদের শির্ককেও হার মানিয়েছে। কেননা মক্কার লোকেরা শুধু সুখের সময়ই আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করতো, কিন্তু বিপদের সময় তারা সেগুলোকে ভুলে গিয়ে এক মাত্র আল্লাহকেই ডাকতো। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম উভয় অবস্থাতেই আল্লাহর সাথে শির্ক করছে। এদিক থেকে মূল্যায়ন করলে দেখা যায় বর্তমানের মাজার পূজারী মুসলিমের শির্কের চেয়ে মক্কার আবু জাহেল ও আবু লাহাবদের শির্ক অধিক হালকা ছিল।
এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, غوث অর্থ হচ্ছে ত্রাণকর্তা। এটি আল্লাহর গুণ। কোন মানুষ গাউছ হতে পারে না। ঢাকা শহরের মহাখালীতে মাসজিদে গাউছুল আযম নামে বিশাল একটি মসজিদ রয়েছে। আমরা সকলেই জানি এখানে গাউছুল আযম দ্বারা আব্দুল কাদের জিলানীকে বুঝানো হয়েছে। আল-গাউছুল আল-আযাম অর্থ হচ্ছে মহান ত্রাণকর্তা। যারা আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) কে মহা ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন হলো, তারা কি এ ধরণের কথার মাধ্যমে আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) কে আল্লাহর সমান করে দেন নি? শুধু তাই নয় সুফীদের একটি দল বিশ্বাস করে যে, আব্দুল কাদের জিলানী নিজ হাতে লাওহে মাহফুযে নতুন করে বৃদ্ধি করতে বা তা থেকে কিছু কমানোরও অধিকার রাখেন। (নাউযুবিল্লাহ)
৩) বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম নামধারী লোক বিশ্বাস করে যে, তাদের মাশায়েখ ও অলীগণ বিপদ হতে উদ্ধার করতে সক্ষম। তাই বিপদে তারা তাদের অলীদেরকে আহবান করে থাকে। তারা বলে থাকে মদদ ইয়া আব্দুল কাদের জিলানী, হে উমুক, হে উমুক ইত্যাদি। এভাবে বিপদাপদে পড়ে আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আহবান করা প্রকাশ্য শির্কের অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
তুমি বলে দাও, আমি আমার নিজের কল্যাণ এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ্ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম। ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতোনা। আমি তো শুধু একজন ভীতিপ্রদর্শক ও সুসংবাদ দাতা ঈমানদারদের জন্য। (সূরা আ’রাফঃ ১৮৮)
এমনি আরো অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যা প্রমাণ করে বতর্মান কালের মাজারপন্থী ও পীরতন্ত্রের অনুসারী মুসলিমরা তাওহীদে রুবুবীয়াতেও শির্ক করছে। যা থেকে মক্কার মূর্তিপূজক মুশরিকরাও বেঁচে থাকত। সুতরাং এ কথা সহজেই বোধগম্য যে, যেই মুসলিম ইসলামের দাবী করে, কিন্তু তাওহীদে উলুহীয়াতে তথা আল্লাহর এবাদতে অন্য কিছুকে শরীক করার সাথে সাথে রুবুবীয়াতেও আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার চেয়ে যে মুশরিক শুধু তাওহীদে উলুহীয়াতে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার শির্ক ঐ নামধারী মুসলিমের শির্কের চেয়ে অধিকতর হালকা। সুতরাং দলীল-প্রমাণসহ উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত হল যে, বর্তমান কালের মুসলিমদের শির্ক মক্কার মুশরিকদের শির্কের চেয়েও অধিক ভয়াবহ। সত্যিই চিন্তার বিষয়!
এখানে বিশেষভাবে একটি কথা উল্লেখ করা দরকার যে, বিদআতীরা উপরোক্ত ঘটনাগুলোকে অলীদের কারামত বলে প্রচার করে থাকে। আমরা বলবো যে, কারামতে আওলীয়া সত্য। পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মধ্যে এবং এই উম্মতের মধ্যে অনেক কারামত প্রকাশিত হয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্যতম আকীদাহ হচ্ছে অলীদের কারামতে বিশ্বাস করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীনকে শক্তিশালী করা, তাঁর অলীদেরকে সাহায্য করা এবং তাঁর বান্দাদের মাধ্যমে স্বীয় কুদরত প্রকাশ করার জন্য অলীদের মাধ্যমে কারামত প্রকাশ করেন। চাই তা কুদরত সম্পর্কিত হোক বা কাশফ সম্পর্কিত হোক। তবে এগুলো বর্ণনা করার সময় এমন বাক্য পরিহার করতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে, অলীরা নিজের ক্ষমতা বলেই কারামত প্রকাশ করে থাকে এবং যখন ইচ্ছা তখনই তারা তা প্রকাশ করতে পারে। এ জাতিয় বাক্য সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা আবশ্যক; বরং এগুলো মানুষের সামনে প্রকাশ করার প্রয়োজন হলে এভাবে প্রকাশ করতে হবে, যাতে কেবল আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা ও বড়ত্বের বিষয়টি ফুটে উঠে; অলীদের নয়। সাহাবী ও তাবেয়ীদের মধ্যে এ রকম অনেক কারামত প্রকাশিত হয়েছে। সাহাবী ও তাবেয়ীদের পরে যেহেতু প্রচুর মিথ্যা ঘটনা তৈরী করা হয়েছে, তাই পরবর্তীকালের অলীদের কারামত বর্ণনায় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের অন্যতম কিতাব আলামুস্ সুন্নাহ, শরহুল আকীদাহ আলওয়াসেতীয়া এবং শরহুল আকীদাহ আত তাহাবীয়ায় কারামতে আওলীয়ার মূলনীতি এবং উহার বেশ কিছু উদাহরণ বর্ণনা করা হয়েছে। বিস্তারিত জানার জন্য কিতাবগুলো পড়ার অনুরোধ রইল।
[8] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ অপরিচিত অবস্থায় ইসলামের সূচনা হয়েছে-এ কথার বর্ণনা। সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ১৪৬, সহীহু সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং- ৩২৩৬, সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ১২৭৩।
[9] -ইবনু আবী আসেম কিতাবুস সুন্নাতে বর্ণনা করেছেন, হাদীছ নং- ৬৩, ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুন সহীহা, হাদীছ নং- ১৪৯২, সহীহু সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং- ৪০৬৩। ইমাম ইবনে কাছীর এবং অন্যান্য হাফেযগণ বলেনঃ এই হাদীছটি বিভিন্ন সনদে সহীহ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। হাদীছটি সুনান এবং অন্যান্য গ্রন্থেও রয়েছে। মুহাম্মাদ বিন নযরও কিতাবুল ইতেসামে হাদীছটি উল্লেখ করেছেন।
[10] - হাদীছের সনদ দুর্বল। দেখুনঃ যঈফু সুনানে তিরমিজী, হাদীছ নং- ৫৯৩।
[11] - বুখারী, অধ্যায়ঃ ঘোড়া ও গাধার নাম রাখা।
[12] - ইসলামই ছিল সকল নবী-রাসূলের দ্বীন। কুরআনে এই কথার অনেক প্রমাণ রয়েছে। নূহ (আঃ) বলেনঃ
فَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَمَا سَأَلْتُكُم مِّنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ
‘‘তোমরা যদি আমার নসীহত থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, তা হলে জেনে রাখো যে, আমি তো তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাইনি৷ আমার প্রতিদান তো আল্লাহর কাছেই৷ আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে আমি যেন মুসলিম হিসেবে থাকি’’। (সূরা ইউনূসঃ ৭২) আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আঃ)এর ব্যাপারে বলেনঃ
مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَٰكِن كَانَ حَنِيفًا مُّسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ
‘‘ইবরাহীম ইহুদী ছিল না, খৃস্টানও ছিল না বরং সে তো ছিল একজন একনিষ্ঠ মুসলিম এবং সে কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না ৷ ইবরাহীমের যারা অনুসরণ করেছে তারাই তার সাথে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক রাখার অধিকারী’’। (সূরা আল ইমরানঃ ৬৭) ইবরাহীম খলীল (আঃ) এবং তাঁর পুত্র ইসমাঈল একসাথে সুর মিলিয়ে বলেছেনঃ
رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا ِنَّكَ أَنتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
‘‘হে আমাদের রব! আমাদের দু’জনকে তোমার মুসলিম (অনুগত) বানিয়ে দাও৷ আমাদের বংশ থেকে এমন একটি জাতির সৃষ্টি করো যে হবে তোমার মুসলিম৷ তোমার এবাদাতের পদ্ধতি আমাদের বলে দাও এবং আমাদের ভুল-ত্রুটি মাফ করে দাও৷ তুমি বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী’’। (সূরা বাকারাঃ ১২৮) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ (وَوَصَّىٰ بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَىٰ لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ) ‘‘ঐ একই মিল্লাতের পথে চলার জন্য তিনি তার সন্তানদের উপদেশ দিয়েছিলেন এবং এরই উপদেশ দিয়েছিলেন ইয়াকুবও তার সন্তানদেরকে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার সন্তানেরা! আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দ্বীনটিই পছন্দ করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ করোনা’’। (সূরা বাকারঃ ১৩২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ (وَقَالَ مُوسَىٰ يَا قَوْمِ إِن كُنتُمْ آمَنتُم بِاللَّهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوا إِن كُنتُم مُّسْلِمِينَ) ‘‘মুসা তার কওমকে বলল, হে লোকেরা! যদি তোমরা সত্যিই আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে থাকো তাহলে কেবল তার উপর ভরসা করো, যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাকো’’। (সূরা ইউনুসঃ ৮৪) সাবার রাণী বলেছিলেনঃ (رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي وَأَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِين) ‘‘হে আমার রব! আমি নিজের উপর বড়ই জুলুম করেছি এবং এখন আমি সুলাইমানের সাথে আল্লাহ রাববুল আলামীনের আনুগত্য কবুল করে নিয়েছি’’। (নামালঃ ৪৪)
[13] - মোটকথা তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কারো ইসলাম পরিশুদ্ধ হবেনা। কালেমায়ে তায়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহএর মর্মার্থ এটিই। সুতরাং لاإله এই কথার মাধ্যমে প্রত্যেক ঐ তাগুতকে অস্বীকার করা হয়েছে, আল্লাহর পরিবর্তে যার এবাদত করা হয়। আর إلا الله কালেমার এই অংশের মাধ্যমে কেবল আল্লাহর একত্ববাদ সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ) ‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর এবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’। সুতরাং আল্লাহর এবাদতকে একটি বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তাগুতের এবাদতকে অন্য একটি বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং একজন মানুষ কেবল তখনই মুসলিম বলে গণ্য হবে, যখন সে আল্লাহর এবাদত করবে এবং একই সাথে তাগুত থেকে দূরে থাকবে।
আর طاغوت শব্দের উৎপত্তি হয়েছে الطغيان থেকে। তাগুত বলা হয় এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে, যে অন্যায় ও বিদ্রোহে সীমা লংঘন করে। আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে বলেছেনঃ ﴾اذْهَبْ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى﴿ ‘‘এখন তুমি যাও ফেরাউনের কাছে। কেননা সে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে’’। (সূরা তোহাঃ ২৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ (إِنَّا لَمَّا طَغَى الْمَاءُ حَمَلْنَاكُمْ فِي الْجَارِيَةِ) ‘‘যে সময় পানির তুফান সীমা অতিক্রম করলো তখন আমি তোমাদেরকে জাহাজে আরোহন করিয়েছিলাম’’। (সূরা আলহাক্কাহঃ ১১) অর্থাৎ পানি যখন অত্যন্ত বেড়ে গেল। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ﴾ فَأَمَّا ثَمُودُ فَأُهْلِكُوا بِالطَّاغِيَةِ ﴿ ‘‘তাই সামূদ জাতিকে একটি সীমাহীন বিপদ দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে’’। (সূরা আলহাক্কাহঃ ৫) অর্থাৎ বিকট ও ভয়াবহ একটি চিৎকারের মাধ্যমে। সুতরাং যে ব্যক্তি বা বিষয় সীমা অতিক্রম করে, তাকেই তাগুত বলা হয়। শয়তানকে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার কারণে এবং সীমালংঘন করার কারণে তাগুত বলা হয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্য যে মাবুদের এবাদত করা হয়, সেই মাবুদ যদি উক্ত এবাদতের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে তাকে তাগুত বলা হয়। যাদুকর এবং গণক উভয়ই তাগুত। এমনি আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য প্রত্যেক মাবুদই তাগুত।
[14] - আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই অধিক জানেন, -এই কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় বলা বৈধ ছিল। এখন শুধু আমরা বলবোঃ আল্লাহই ভাল জানেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর সালাফদেরকে এই কথা বলতে শুনা যেতনা যে, الله ورسوله أعلم (আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)।