ইমাম বারকানী তাঁর সহীহ হাদীছ গ্রন্থে উপরোক্ত হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। তবে উক্ত বর্ণনায় নিম্নোক্ত কথাগুলো অতিরিক্ত এসেছে,
«وَإِنَّمَا أَخَافُ عَلَى أُمَّتِى الأَئِمَّةَ الْمُضِلِّينَ وَإِذَا وُقع السَّيْفُ عليهم لَمْ يُرْفَعْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَلاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يْلحَقَ حَيُّ مِنْ أُمَّتِى بِالْمُشْرِكِينَ وَحَتَّى تَعْبُدَ فِئام مِنْ أُمَّتِى الأَوْثَانَ وَإِنَّهُ سَيَكُونُ فِى أُمَّتِى كَذَّابُونَ ثَلاَثُونَ كُلُّهُمْ يَزْعُمُ أَنَّهُ نَبِىٌّ وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى وَلاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى عَلَى الْحَقِّ مَنْصُوْرَةً لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلََهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللَّهِ تبارك وتعالى»
‘‘আমার উম্মতের উপর বিভ্রান্তির ইমামদের ব্যাপারে বেশী আশঙ্কা বোধ করছি এবং তাদের উপর একবার তলোয়ার চালানো হলে কিয়ামত পর্যন্ত সে তলোয়ার উঠানো হবেনা। আর ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবেনা যতক্ষণ না আমার একদল উম্মত মুশরিকদের সাথে মিলিত হবে এবং যতক্ষণ না আমার উম্মতের এক শ্রেণী লোক মূর্তিপূজা করবে। আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যাবাদীর আগমণ ঘটবে। প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবী করবে। অথচ আমিই সর্বশেষ নবী। আমার পর আর কোনো নবী নাই। কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মতের মধ্যে এমন একটি সাহায্য প্রাপ্ত দল থাকবে, যারা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাআলার ফয়সালা আসার পূর্ব পর্যন্ত তারা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা।
ব্যাখ্যাঃ ইমাম বারকানী হলেন হাফেয কাবীর আবু বকর আহমাদ বিন মুহাম্মাদ বিন গালিব আল খাওয়ারেযমী আল-শাফেঈ। ৩৩৬ হিজরী সালে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। হিজরী ৪২৫ সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। খতীব বাগদাদী বলেনঃ তিনি ছিলেন খুব গ্রহণযোগ্য, নির্ভরশীল এবং পরহেজগার আলেম। আমাদের উস্তাদদের মধ্যে তাঁর চেয়ে অধিক নির্ভরযোগ্য আলেম আর কাউকে দেখিনি। তিনি ফিকাহ শাস্ত্রে খুব অভিজ্ঞ এবং অনেক গ্রন্থ রচনাকারী। তিনি এমন একটি মুসনাদ গ্রন্থ রচনা করেছেন, যাতে বুখারী ও মুসলিমের হাদীছগুলো একত্রিত করার সাথে সাথে ছাওরী, শুবা এবং আরো একদল মুহাদ্দিছের হাদীছ জমা করেছেন।
‘‘আমার উম্মতের উপর পথভ্রষ্টকারী ইমামদের ব্যাপারে বেশী আশঙ্কা বোধ করছিঃ এখানে ইমাম বলতে শাসক, আলেম এবং আবেদগণ উদ্দেশ্য। তারা বিনা ইলমে মানুষের মধ্যে ফয়সালা করবে এবং তাদেরকে গোমরাহ করবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَإِنَّ كَثِيرًا لَيُضِلُّونَ بِأَهْوَائِهِمْ بِغَيْرِ عِلْمٍ إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِالْمُعْتَدِينَ
‘‘অনেক লোক স্বীয় ভ্রান্ত প্রবৃত্তি দ্বারা বিনা ইলমে মানুষকে বিপথগামী করতে থাকে। আপনার প্রতিপালক সীমা লংঘনকারীদের সম্পর্কে পূর্ণ অবগত’’। (সূরা আনআমঃ ১১৯) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ وَلَقَدْ ضَلَّ قَبْلَهُمْ أَكْثَرُ الْأَوَّلِينَ ‘‘তাদের পূর্বেও অগ্রবর্তীদের অধিকাংশ লোক বিপথগামী হয়েছিল’’। (সূরা সাফ্ফাতঃ ৭১) কুরআনে এই ধরণের আয়াত আরও অনেক রয়েছে।
যিয়াদ বিন হুদাইর রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু আমাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ
«هَلْ تَعْرِفُ مَا يَهْدِمُ الإِسْلاَمَ؟ قَالَ قُلْتُ لاَ قَالَ يَهْدِمُهُ زَلَّةُ الْعَالِمِ وَجِدَالُ الْمُنَافِقِ بِالْكِتَابِ وَحُكْمُ الأَئِمَّةِ الْمُضِلِّينَ»
‘‘তুমি কি জান কোন্ জিনিষ ইসলামকে ধ্বংস করে দেয়? আমি বললামঃ না। অতঃপর তিনি বললেনঃ আলেমের পদস্খলন, কুরআন নিয়ে মুনাফিকের তর্ক-বিতর্ক এবং গোমরাহকারী শাসকদের শাসন’’।[7]
তাদের উপর একবার তলোয়ার চালানো হলে কিয়ামত পর্যন্ত সেই তলোয়ার উঠানো হবেনাঃ এই উম্মতের মধ্যে উহা চালানো হয়েছে এবং এখনও চালানো হচ্ছে। আমরা আল্লাহর কাছে ইহ-পরকালের সকল ফিতনা থেকে মুক্তি চাই।
মুশরিকদের বিরুদ্ধে মুসলিমদের যুদ্ধের ন্যায়ই এ যুদ্ধগুলোর মধ্যে কিছু যুদ্ধ ছিল সঠিক। মুসলিমগণ এ সব যুদ্ধে মুশরিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ করছেন, যাতে তারা শির্ক থেকে বিরত থাকে। আখেরী যামানায় আল্লাহ তাআলা ঐ সমস্ত লোকের উপর অনুগ্রহ করেছেন, যারা তাঁর তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছে। কিন্তু এই উম্মতের মুসলিম নামধারী মুশরিকরা তাওহীদের দিকে আহবানকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা করেছে। এতে আল্লাহ তাআলা মুশরিকদের উপর তাওহীদপন্থীদেরকে বিজয় দান করেছেন।
وَلاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يْلحَقَ حي مِنْ أُمَّتِى بِالْمُشْرِكِينَ ‘‘আর ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবেনা যতক্ষণ না আমার উম্মতের একদল লোক মুশরিকদের সাথে মিলিত হবে’’- এখানে حي শব্দটি এক বচন। বহুবচনে أحياء। এর অর্থ হচ্ছে গোত্রসমূহ। আবু দাউদের এক বর্ণনায় এসেছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ
«وَلاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى يَلْحَقَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِى بِالْمُشْرِكِينَ»
‘‘যতক্ষণ পর্যন্ত আমার উম্মতের বেশ কিছু গোত্র মুশরিকদের সাথে মিলিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবেনা। এ রকম বহু গোত্র অতীতে পাওয়া গিয়েছে।
وَحَتَّى تَعْبُدَ فِئام مِنْ أُمَّتِى الأَوْثَانَ এবং যতক্ষণ না আমার উম্মতের একটি শ্রেণী মূর্তি পূজা করবেঃ এখানে الفئام শব্দটির ‘ফা’ বর্ণের পরে হামজাহ দিয়ে পড়া হয়েছে। এ দ্বারা মানুষের অনেক জামাআত উদ্দেশ্য। আবুস সাআদাত বলেনঃ এখান থেকেই লেখক অধ্যায় রচনা করার দলীল গ্রহণ করেছেন।
এই উম্মতের মধ্যে মূর্তির বা কবর ও অলী-আওলীয়ার এবাদতের শির্ক এমনভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে যে, আখেরী যামানায় এমন কোনো লোকের সন্ধান পাওয়া যাবেনা, যে এগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলা শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রঃ)কে তাওফীক দিলেন। তিনি শির্কের প্রতিবাদ করলেন, তা থেকে মানুষকে নিষেধ করলেন এবং তাদেরকে শির্ক বর্জনের আহবান জানালেন। একই সাথে তিনি এককভাবে আল্লাহর এবাদতের আহবান জানালেন, তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁর রুবুবীয়াত, উলুহীয়াত এবং তাঁর আসমা ওয়াস সিফাতেও কোন অংশীদার নেই। এর ফলে সেই যামানার রাজা-বাদশাহ ও তাদের অনুসারীগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করল। আল্লাহ তাআলা দলীল-প্রমাণের মাধ্যমে তাঁকে বিজয়ী করলেন এবং তাঁর বিরোধীদের বিরুদ্ধে তাঁকে সাহায্য করলেন। পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তসমূহে তার দাওয়াত পৌঁছে গিয়েছে। লোকদের মধ্যে অনেকেই এই দাওয়াতকে চিনতে পেরে তা কবুল করে নিয়েছে এবং কতক লোক এটিকে বর্জন করেছে ও তার প্রতিবাদ করেছে। হেজাজ, নজদ এবং ওমানসহ আরও অনেক অঞ্চলের লোকেরা এই বরকতময় দাওয়াতের মাধ্যমে উপকৃত হয়েছে। এ বিরাট নেয়ামত পেয়ে আমরা আল্লাহর প্রশংসা করছি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে আপনার কৃতজ্ঞতা প্রকাশের তাওফীক দিন! আমীন
আমার উম্মতের মধ্যে ত্রিশজন মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব হবে। প্রত্যেকেই নিজেকে নবী বলে দাবী করবেঃ ইমাম কুরতুবী (রঃ) বলেনঃ হুযায়ফাঃ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হাদীছে নির্দিষ্টভাবে তাদের সংখ্যা বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মতের মধ্যে ২৭ জন মিথ্যুক দাজ্জাল আগমণ করবে। তাদের মধ্যে চারজন হবে মহিলা। আবু নুআইম এ হাদীছ বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন হাদীছটি দুর্বল। পূর্বে উল্লেখিত ছাওবানের হাদীছ এ হাদীছের চেয়ে অধিক বিশুদ্ধ।
কাযী ইয়ায (রঃ) বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর যামানা থেকে শুরু করে বর্তমানকাল পর্যন্ত নবুওয়াতের দাবীদারদের মধ্যে যারা প্রসিদ্ধি অর্জন করেছে এবং একদল মানুষ যাদের গোমরাহীর অনুসরণ করেছে, তাদের সংখ্যা গণনা করা হয়েছে। সুতরাং তাদের ক্ষেত্রে এ সংখ্যা হুবহু পাওয়া গেছে। যারা ইতিহাসের কিতাবগুলো পাঠ করবে, সে এর সত্যতা জানতে পারবে। এদের মধ্যে সর্বশেষ হবে সর্বাধিক বড় মিথ্যুক দাজ্জাল।
وَأَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّينَ لاَ نَبِىَّ بَعْدِى ‘‘আমিই সর্বশেষ নবী, আমার পর আর কোনো নবী নেই’’ঃ ইমাম হাসান বসরী (রঃ) বলেনঃ খাতাম ঐ জিনিষকে বলা হয়, যার মাধ্যমে মোহর লাগানো হয়। অর্থাৎ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেনঃ সর্বশেষ নবী। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَا أَحَدٍ مِنْ رِجَالِكُمْ وَلَكِنْ رَسُولَ اللَّهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّينَ وَكَانَ اللَّهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمًا
‘‘মুহাম্মদ তোমাদের কোনো পুরুষের পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহ্র রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ে পরিজ্ঞাত’’। (সূরা আহযাবঃ ৪০)
তবে এ কথা সঠিক যে, আল্লাহর নবী ঈসা (আঃ) আখেরী যামানায় পৃথিবীতে পুনরায় আগমণ করবেন। তিনি শরীয়তে মুহাম্মাদী অনুযায়ী ফয়সালা করবেন এবং মুসলিমদের কিবলার দিকে মুখ করে নামায আদায় করবেন। তিনি হবেন উম্মতে মুহাম্মাদীর সাধারণ একজন মানুষের মতই। সেই সঙ্গে তিনি হবেন উম্মতে মুহাম্মাদীর সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি।
وَلاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى عَلَى الْحَقِّ مَنْصُوْرَةً لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلََهُمْ ‘‘কিয়ামত পর্যন্ত আমার উম্মতের মধ্যে একটি সাহায্য প্রাপ্ত দল থাকবে। যারা তাদেরকে পরিত্যাগ করবে, আল্লাহ তাআলার ফয়সালা আসার পূর্ব পর্যন্ত তারা তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবেনা’’ঃ ইমাম নববী (রঃ) বলেনঃ মুমিনদের বিভিন্ন জামাআত এ সাহায্যপ্রাপ্ত গোষ্ঠির অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। বীর সাহসী, যুদ্ধ বিদ্যায় পারদর্শী, ফকীহ, উম্মতের মুহাদ্দিছ, মুফাস্সির, সৎ কাজের আদেশকারী ও অসৎ কাজের নিষেধকারী, আবেদ ইত্যাদি আরো অনেক শ্রেণীর লোক এ নাজী ফির্কার অন্তর্ভূক্ত হতে পারে। এটি আবশ্যক নয় যে, তারা একই দেশের বাসিন্দা হবে। তারা কোনো সময় পৃথিবীর এক স্থানে একত্রিত অবস্থায় থাকতে পারে। আবার কখনো পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়েও থাকতে পারে। আবার কখনো একটি দেশের এক স্থানে একত্রিত অবস্থায় থাকতে পারে আবার কখনো একই দেশের এক অংশে থাকতে পারে এবং সে দেশের অন্য অংশে তাদের অস্তিত্ব নাও থাকতে পারে। এও হতে পারে যে, এক এক করে পৃথিবীর সকল অংশ এ নাজাতপ্রাপ্ত দল থেকে খালি হয়ে যাবে। এভাবে খালি হতে হতে পৃথিবীর মাত্র একটি এলাকাতেই তাদের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যাবে। পরিশেষে যখন পৃথিবী থেকে এ দল একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যাবে, তখন কিয়ামত সংঘটিত হবে। ইমাম নববীর এ বক্তব্য ইবনে হাজার আসকালানী সংক্ষিপ্ত করে এবং তার নিজের পক্ষ হতে কিছু বাড়িয়ে ফতহুল বারীর ১৩ নং খন্ডের ২৯৫ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন।
সম্মানিত শাইখ বলেনঃ এ হাদীছে বিরাট একটি নিদর্শন রয়েছে। তা হলো, সেই নাজাতপ্রাপ্ত লোকদের সংখ্যা কম হওয়ার পরও যারা তাদেরকে বর্জন করবে এবং তাদের বিরোধীতা করবে, তারা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। এখানে আরও সুসংবাদ রয়েছে যে, হক কখনো একেবারে নিঃশেষ হয়ে যায়না।
حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللَّهِ تبارك وتعالى ‘‘যে পর্যন্ত না আল্লাহ তাআলার ফয়সালা আগমণ করে’’ঃ অর্থাৎ কিয়ামত পর্যন্ত তারা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। এ বাক্যের বাহ্যিক অর্থ হচ্ছে, সে সময় নরম ও পবিত্র একটি বাতাসের মাধ্যমে পৃথিবীতে বসবাসকারী অবশিষ্ট সমস্ত মুমিনের রূহ কবজ করে নেওয়া হবে এবং বড় বড় আলামতগুলো প্রকাশিত হবে। তারপর শুধু খারাপ লোকগুলোই বাকী থাকবে।
تبارك وتعالى এর ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ বরকত দুই প্রকার। (১) এমন বরকত, যা আল্লাহ তাআলা হতে প্রকাশিত হয়। البركة থেকে بارك (তিনি বরকত দান করেছেন) فعل বা ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। এ ফেলটি কখনো নিজে নিজেই বাক্যে ব্যবহৃত হয়। কখনো على হরফে জার আবার কখনো في হরফে জারের মাধ্যমে ব্যবহৃত হয়। এ থেকে اسم مفعول এর সীগাহ হয় مباركٌ। অর্থাৎ যার মধ্যে বরকত রাখা হয়। সুতরাং আল্লাহ তাআলা যাকে বরকতময় করেছেন, কেবল তাই বরকতময় হয়েছে।
(২) আল্লাহ তাআলার দিকে যেমন রহমত ও ইজ্জতের সম্বন্ধ করা হয়, তেমনি বরকতের সম্বন্ধও তাঁর দিকেই করা হয়। বরকত শব্দটি যখন এ অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন এ থেকে فعل (ক্রিয়া) হয় تَبَارَكَ । তাই আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য تبارك ক্রিয়াটি ব্যবহৃত হয়না এবং অন্য কারো জন্য এটি ব্যবহার করা সঠিকও নয়। সুতরাং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা متبارك তথা বরকতের অধিকারী ও বরকত দানকারী। তাঁর রাসূল এবং অনুগত বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম مبارك তথা বরকতময়। সুতরাং تبارك এর সিফাতটি তথা বরকত দান করা কেবল আল্লাহর সাথে খাস। আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের পবিত্র সত্তার জন্য এই সিফাতটি সাব্যস্ত করেছেন। তিনি সূরা আরাফের ৫৪ নং আয়াতে বলেনঃ تَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ ‘‘আললাহ বড়ই বরকতের অধিকারী। তিনি সমগ্র সৃষ্টিজগতের মালিক ও প্রতিপালক’’। আল্লাহ তাআলা সূরা মুলকের ১ নং আয়াতে বলেনঃ
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
‘‘অতি মহান তিনি, যার হাতে রয়েছে সবকিছুর রাজত্ব, তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’’।[8]
[8] - মূলতঃ আল্লাহ তাআলার জন্য এখানে تَبَارَكَ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর পূর্ণ অর্থ এক শব্দে তো দূরের কথা এক বাক্যে বর্ণনা করাও কঠিন। এর শব্দমূল রয়েছে ب - ر - ك অক্ষর। এ থেকে بَرَكَة ও بُرُوك দু'টি ধাতু নিষ্পন্ন হয়। بَرَكَة এর মধ্যে রয়েছে বৃদ্ধি, সমৃদ্ধি, বিপুলতা, প্রাচুর্যের অর্থ। আর بُرُوك এর মধ্যে স্থায়িত্ব, দৃঢ়তা, অটলতা ও অনিবার্যতার অর্থ রয়েছে। তারপর এ ধাতু থেকে যখন تَبَارَكَ ক্রিয়াপদ তৈরী করা হয় তখন تفاعل এর বৈশিষ্ট্য হিসেবে এর মধ্যে বৃদ্ধি পাওয়া ও পূর্ণতা প্রকাশের অর্থও শামিল হয়ে যায়। এ অবস্থায় এর অর্থ দাঁড়ায় সর্বোচ্চ, বর্ধমান প্রাচুর্য ও চূড়ান্ত পর্যায়ের স্থায়িত্ব। এ শব্দটি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রূপে কোন জিনিষের প্রাচুর্য বা তার দৃঢ়তা ও স্থায়িত্বের অবস্থা বর্ণনা করার জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন কখনো এর অর্থ হয় উচ্চতায় অনেক বেশী এগিয়ে যাওয়া। বলা হয়, تباركت النخلة অর্থাৎ অমুক খেজুর গাছটি অনেক উঁচু হয়ে গেছে। আসমায়ী বলেন, এক বন্ধু একটি উঁচু টিলায় উঠে নিজের সাথীদেরকে বলতে থাকে تَبَارَكْتُ عَلَيْكُمْ ‘‘আমি তোমাদের চেয়ে উঁচু হয়ে গেছি’’। কখনো মর্যাদায় ও শ্রেষ্ঠত্বে বেশী অগ্রণী হওয়ার অর্থে শব্দটি ব্যবহার হয়। কখনো একে ব্যবহার করা হয় দয়া ও সমৃদ্ধি পৌঁছানো এবং শুভ ও কল্যাণের ক্ষেত্রে অগ্রণী হওয়ার অর্থে। কখনো এ থেকে পবিত্রতার পূর্ণতা ও চূড়ান্ত বিশুদ্ধতার অর্থ গ্রহণ করা হয়। পূর্বাপর বক্তব্যই বলে দেয় কোথায় একে কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং উপরোক্ত আয়াতে ব্যবহৃত تبارك শব্দের যেসব ব্যাখ্যা করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,
এক) মহা অনুগ্রহকারী ও সর্বজ্ঞ। কারণঃ তিনি নিজের বান্দাকে ফুরকানের মহান নিয়ামত দান করে সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছেন।
দুই) বড়ই মর্যাদাশালী ও সম্মানীয়। কারণ, পৃথিবী ও আকাশে তাঁরই রাজত্ব চলছে।
তিন) বড়ই পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন। কারণ, তাঁর সত্তা সকল প্রকার শির্কের গন্ধমুক্ত। তাঁর সমজাতীয় কেউ নেই। ফলে আল্লাহর সত্তার সার্বভৌমত্বে তাঁর কোন নযির ও সমকক্ষ নেই। তাঁর কোন ধ্বংস ও পরিবর্তন নেই। কাজেই তাঁর স্থলাভিষিক্তের জন্য কোন পুত্রের প্রয়োজন নেই।
চার) বড়ই উন্নত ও শ্রেষ্ঠ। কারণ, সমগ্র রাজত্ব তাঁরই কতৃর্ত্বাধীন। তাঁর ক্ষমতায় অংশীদার হবার যোগ্যতা ও মর্যাদা কারো নেই।
পাঁচ) শক্তির পূর্ণতার দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ। কারণ, তিনি বিশ্ব-জাহানের প্রত্যেকটি জিনিষ সৃষ্টিকারী ও তার ক্ষমতা নির্ধারণকারী। {(বাগাবী, আলুসী এবং ইমাম ইবনুল কায়্যিম রচিত জালাউল আহকাম, (১/৩০৬)}