আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا
‘‘এ সব লোক যাদেরকে ডাকে তারা নিজেরাই তাদের রবের নৈকট্য লাভের আশায় উসীলা অনুসন্ধান করে, তাদের মধ্য হতে কে সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী? তারা তার রহমতের আশা করে এবং তার শাস্তিকে ভয় করে। নিশ্চয়ই তোমার পালনকর্তার শাস্তি ভয়াবহ’’। (সূরা ইসরাঃ ৫৭)
ব্যাখ্যাঃ কালেমা তায়্যেবার অর্থই হচ্ছে তাওহীদ বা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা। এই অধ্যায়ে বর্ণিত আয়াত ও হাদীছগুলো থেকেই এ বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে ইনশা-আল্লাহ্। কেননা এগুলোতে রয়েছে তাওহীদের বিশদ বর্ণনা ও খোলাখুলি আলোচনা। যেসব মূর্খ লোক ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর অর্থ বুঝতে গিয়ে ভুল করেছে, এতে তাদের উপর হুজ্জত কায়েম করা হয়েছে।
এসব লোক যাদেরকে ডাকে তারা নিজেরাই তাদের রবের নৈকট্য লাভের আশায় উসীলা অনুসন্ধান করে যে, তাদের কে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তীঃ অর্থাৎ মুশরিকরা যে সমস্ত ফেরেশতা, নবী-রাসূল এবং অলী-আওলীয়াদেরকে আহবান করে, তারা তাদের অকল্যাণ ও বিপদাপদ দূর করার কোনো ক্ষমতা রাখেনা। যেমন তারা ঈসা, তাঁর মা মারইয়াম এবং উযাইরকে আহবান করে থাকে। অথচ এদের সকলের দ্বীন ছিল তাওহীদ। যারা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে তাদেরকে আহবান করে তাদের দ্বীন তাওহীদের বিপরীত। আল্লাহ্ তাআলা তাদের ব্যাপারে বলেনঃ
يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ
‘‘তারা নিজেরাই তাদের রবের নৈকট্য লাভের আশায় উসীলা অনুসন্ধান করে। তাদের মধ্যে কে সবচেয়ে বেশী নিকটবর্তী’’।[1] অর্থাৎ যাদেরকে মুশরিকরা আহবান করছে, তারা নিজেরাই তো ইখলাসের সাথে আমল করা, আল্লাহর আদেশ সমূহ মেনে চলা এবং নিষেধসমূহ বর্জন করার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য লাভের উপায় অন্বেষণ করে।
আল্লাহ্ তাআলা যে তাওহীদসহ নবী-রাসূলদেরকে পাঠিয়েছেন, যার প্রতি আমল করা ফরয করেছেন এবং যার দিকে আহবান করা আবশ্যক করেছেন, সেই তাওহীদ বাস্তবায়ন করাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। এ তাওহীদই তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করবে অর্থাৎ তাঁর ক্ষমা ও সন্তুষ্টির নিকটবর্তী করে দিবে। আল্লাহ তাআলা এ ব্যাপারে বলেনঃ
وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ
‘‘তারা তার রহমতের আশা করে এবং তার শাস্তিকে ভয় করে’’। সুতরাং তারা আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কারও কাছে আশা করেনা এবং তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে ভয় করেনা। এটিই হচ্ছে তাওহীদ। এ তাওহীদ ও ঈমান তাদেরকে শির্ক থেকে বাঁচাবে এবং তাদের মনে আল্লাহর রহমত পাওয়ার আকাঙ্খা জাগাবে ও তাদের অন্তরে তাঁর শাস্তির ভয় প্রবিষ্ট করবে। কিন্তু এ ব্যাপারটি এখন উল্টা হয়ে গেছে। আল্লাহ্ তাআলাকে বাদ দিয়ে তারা যে সমস্ত নবী-রাসূল ও অলী-আওলীয়াদেরকে আহবান করছে এবং তাদের কাছে তারা ঐ সমস্ত জিনিষ প্রার্থনা করছে, যা করতে আল্লাহ্ তাআলা নিষেধ করেছেন। অর্থাৎ পূর্বযুগের মুশরিকরা দুআর মধ্যে আল্লাহ্ তাআলা ব্যতীত অন্যান্য যাদেরকে আহবান করত, নবী-রাসূলগণ তার প্রতিবাদ করতেন। এর মধ্যেই আল্লাহ্ তাআলার নিম্নের বাণীর অর্থ রয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ وَيَوْمَ الْقِيَامَةِ يَكْفُرُونَ بِشِرْكِكُمْ ‘‘কিয়ামতের দিন তারা তোমাদের শির্ক অস্বীকার করবে’’। (সূরা ফাতিরঃ ১৪) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ
وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوا لَهُمْ أَعْدَاء وَكَانُوا بِعِبَادَتِهِمْ كَافِرِينَ
‘‘যখন মানুষকে হাশরে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রু হবে এবং তাদের এবাদত অস্বীকার করবে’’। (সূরা আহকাফঃ ৬)
এতে ঐ সব লোকের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা দাবী করে, শুধু মূর্তিপূজাকেই শির্ক বলা হয়। অর্থাৎ শুধু মূর্তিপূজার মাধ্যমেই শির্ক হয়ে থাকে। এই আয়াতের মাধ্যমে সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, আল্লাহ্ তাআলা ঐ সমস্ত লোকের প্রতিবাদ করেছেন, যারা আল্লাহর সাথে নবী-রাসূল, অলী-আওলীয়া, ফেরেশতা এবং অন্যান্যদেরকে আহবান করে। অথচ কল্যাণ অর্জন কিংবা অকল্যাণ দূর করার জন্য মৃত এবং অলীদের আহবান করা বড় শির্কের অন্তর্ভূক্ত, যা আল্লাহ্ তাআলা ক্ষমা করেন না।[2] এ রকম করা কালেমা তায়্যেবার মর্মার্থের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
প্রিয় পাঠক! আপনি উপরে বর্ণিত মহান আয়াতটি নিয়ে চিন্তা করুন। তাহলেই আপনার কাছে তাওহীদ এবং তার বিপরীত বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। কেননা এই আয়াতটি ঐ সমস্ত লোকের ব্যাপারে নাযিল হয়েছে, যারা ফেরেশতা, ঈসা (আঃ), তাঁর মা মারইয়াম এবং উযাইরের এবাদত করত। আল্লাহ্ তাআলার নিম্নের বাণীতে এরাই উদ্দেশ্য। আল্লাহ্ তাআলা সূরা ইসরার ৫৬ নং আয়াতে বলেনঃ
قُلِ ادْعُواْ الَّذِينَ زَعَمْتُم مِّن دُونِهِ فَلاَ يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّ عَنكُمْ وَلاَ تَحْوِيلاً
‘‘বলোঃ আল্লাহ্ ব্যতীত যাদেরকে তোমরা উপাস্য মনে কর, তারা তো তোমাদের কষ্ট দূর করার ক্ষমতা রাখেনা এবং তা পরিবর্তনও করতে পারেনা’’। এসব মুশরিক যাদেরকে আহবান করছে, তারা তাদের দ্বীনের বিপরীত কাজ করছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
أُولَـئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ
‘‘যাদেরকে তারা আহবান করে, তারা নিজেরাই তো তাদের পালনকর্তার নৈকট্য লাভের জন্য মধ্যস্থতা তালাশ করে যে, তাদের মধ্যে কে অধিক নৈকট্যশীল’’। (সূরা ইসরাঃ ৫৭) অর্থাৎ তারা যাদেরকে আহবান করছে, তারা শুধু তাদের রবের নৈকট্য হাসিল করার জন্যই উসীলা তালাশ করে, অন্যের নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করেনা। আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্ববৃহৎ মাধ্যম হচ্ছে আল্লাহর তাওহীদ। এই তাওহীদ দিয়েই আল্লাহ্ তাআলা নবী ও রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন এবং এর জন্যই জিন ও ইনসান সৃষ্টি করেছেন।
আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম উসীলা হচ্ছে আল্লাহর অতিসুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর উসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দুআ করা। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ
وَلِلّهِ الأَسْمَاء الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا
‘‘আর আল্লাহ্র জন্য রয়েছে অতিসুন্দর নামসমূহ। কাজেই সে নামগুলো ধরেই তাঁকে ডাকো’’। (সূরা আরাফঃ ১৮০) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে বর্ণিত দুআগুলোর মধ্যে আল্লাহ্ তাআলার অতিসুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর উসীলা দিয়ে দুআ করার কথা বর্ণিত হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর দুআয় বলেছেনঃ
«اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ بِأَنَّ لَكَ الْحَمْدَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ الْمَنَّانُ بَدِيعُ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ يَا ذَا الْجَلاَلِ وَالإِكْرَامِ»
‘‘হে আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে এ উসীলায় প্রার্থনা করছি যে, তোমার জন্যই সমস্ত প্রশংসা। তুমি ছাড়া অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই। তুমি অত্যন্ত দয়াশীল। তুমি পূর্বের কোনো নমুনা ছাড়াই আসমান ও যমীনের সৃষ্টা। হে মহা সম্মানিত এবং সম্মান ও ইজ্জত দানকারী! তুমি আমার প্রার্থনা শ্রবণ করো।[3] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুআয় আরো বলতেনঃ
«اللَّهُمَّ إِنِّى أَسْأَلُكَ بِأَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ الأَحَدُ الصَّمَدُ الَّذِى لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ»
‘‘হে আল্লাহ্! আমি তোমার কাছে এ উসীলায় প্রার্থনা করছি যে, তুমিই আল্লাহ্। তুমি ছাড়া কোনো সত্য মাবুদ নেই। তুমি একক, অমূখাপেক্ষী, তুমি কাউকে জন্ম দাও নি। তুমি কারো জাত নও এবং তোমার সমকক্ষ কেউ নেই’’।[4] এ ছাড়া অন্যান্য সৎ আমলের উসীলা দিয়েও আল্লাহ্ তাআলার কাছে চাওয়া ও প্রার্থনা করা জায়েয আছে। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলার পছন্দনীয় ও সস্ত্তষজনক আমল দ্বারা উসীলা দিতে হবে, অপছন্দনীয় আমল দ্বারা নয়। এমনিভাবে যে শির্ক থেকে তিনি নিজেকে পবিত্র বলে ঘোষণা করেছেন, তা দিয়েও উসীলা দেয়া জায়েয নয়। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ سُبْحَانَ اللَّهِ عَمَّا يُشْرِكُونَ ‘‘তারা যাকে শরীক করে, আল্লাহ্ তা থেকে পবিত্র’’। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃوَسُبْحَانَ اللّهِ وَمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘‘আল্লাহ্ পবিত্র। আর আমি মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত নই’’। (সূরা ইউসুফঃ ১০৮) যারা নিজেদের জন্য সুপারিশকারী নির্ধারণ করেছে, আল্লাহ্ তাআলা তাদের প্রতিবাদে বলেনঃ
قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللّهَ بِمَا لاَ يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلاَ فِي الأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ
‘‘তুমি বলোঃ তোমরা কি আল্লাহ্কে এমন বিষয়ে অবহিত করছ, যা তিনি অবহিত নন আসমান ও যমীনে? তিনি পবিত্র ও মহান সে সমস্ত বস্ত্ত থেকে, যেগুলোকে তারা শরীক করছে’’। (সূরা ইউনূসঃ ১৮) কুরআনুল কারীমে এই ধরণের আয়াত আরো অনেক রয়েছে। এগুলো ইখলাসের সাথে আল্লাহর এবাদতের আহবান জানায় এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের এবাদত করতে নিষেধ করে এবং শির্কে লিপ্ত ব্যক্তিদের ভয়াবহ শাস্তির ঘোষণা দেয়। যেমন আল্লাহ্ তাআলা রাসূলদেরকে, তাদের আনিত তাওহীদের দাওয়াতকে এবং শির্ক থেকে নিষেধের ঘোষণাকে মিথ্যায়ন করার কারণে অতীতের জাতিসমূহকে শাস্তি দিয়েছেন। কেননা তারা নবী-রাসূলদের দাওয়াত কবুল করেনি। এ জন্য আল্লাহ্ তাআলা তাদেরকে শাস্তি দিয়েছেন। নূহ আলাইহিস সালামের সম্প্রদায় আদ জাতি, ছামুদ জাতি এবং অন্যান্য জাতির লোকেরা রাসূলদের দাওয়াতের বিরোধীতা করার কারণে এবং আল্লাহর সাথে শির্ক করার কারণে ধ্বংস হয়েছে। ‘নূহ’ (আঃ)এর জাতির লোকেরা বলেছিল,
وَمَا نَرَاكَ اتَّبَعَكَ إِلاَّ الَّذِينَ هُمْ أَرَاذِلُنَا بَادِيَ الرَّأْيِ
‘‘আর আমাদের মধ্যে যারা ইতর ও স্থুল-বুদ্ধিসম্পন্ন তারা ব্যতীত কাউকে তোমার আনুগত্য করতে দেখছিনা’’। (সূরা হুদঃ ২৭) হুদ আলাইহিস সালামের জাতির লোকেরা বলেছিল,
يَا هُودُ مَا جِئْتَنَا بِبَيِّنَةٍ وَمَا نَحْنُ بِتَارِكِي آلِهَتِنَا عَن قَوْلِكَ وَمَا نَحْنُ لَكَ بِمُؤْمِنِينَ
‘‘হে হুদ! তুমি আমাদের কাছে কোনো প্রমাণ নিয়ে আস নাই, আমরা তোমার কথায় আমাদের দেব-দেবীদের বর্জন করতে পারিনা। আর আমরা তোমার প্রতি ঈমান আনয়নকারীও নই’’। (সূরা হুদঃ ৫৩) শুআইব আলাইহিস সালামের জাতির লোকেরা বলেছিল,
يَا شُعَيْبُ أَصَلاتُكَ تَأْمُرُكَ أَنْ نَتْرُكَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا
‘‘হে শুয়ায়েব! তোমার নামায কি তোমাকে এ শিক্ষা দেয় যে, আমরা ঐ সব উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করবো, যাদের উপাসনা করত আমাদের বাপ-দাদারা? (সূরা হুদঃ ৮৭)
সুতরাং হে পাঠক! নবী-রাসূলগণ যে বিষয়ের দাওয়াত দিয়েছেন, আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় কিতাবে তার বিবরণ দিয়েছেন এবং যারা নবী-রাসূলদের দাওয়াতের বিরোধীতা করেছে, তাদের শাস্তিরও বিবরণ দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি কিয়ামত পর্যন্ত প্রত্যেক মুশরিকের উপর দলীল কায়েম করেছেন।
বুখারী ও মুসলিমে আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে উক্ত আয়াতের তাফসীর বর্ণিত হয়েছে যে, একদল মানুষ জিনদের এবাদত করত। অতঃপর জিনেরা ইসলাম গ্রহণ করল। কিন্তু মানুষেরা জিনদের এবাদত করতেই থাকল। অর্থাৎ শির্ক ও কুফরের উপর অটল থাকল।
ব্যাখ্যাকার বলেনঃ আমি বলছি, পূর্বোক্ত ব্যাখ্যা এবং এই ব্যাখ্যার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অলী-আওলীয়া বা অন্য কাউকে আহবান করবে, তার বিরুদ্ধে এই আয়াতটি দলীল হয়ে থাকবে। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বর্ণিত প্রত্যেকটি কথাই সত্য। কেননা যাদের মাবুদ হবে আল্লাহর কোনো বান্দা তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই আয়াতটি প্রযোজ্য। চাই সে মাবুদ ফেরেশতাদের অন্তর্ভূক্ত হোক কিংবা কোনো জিন হোক অথবা বনী আদমের অন্য কেউ হোক।
আল্লাহ্ তাআলার বাণীঃ
وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاء مِّمَّا تَعْبُدُونَ إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِهِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ
‘‘স্মরণ করো সে সময়ের কথা, যখন ইবরাহীম তাঁর পিতা ও গোত্রের লোকদেরকে বলেছিলেন, তোমরা যার এবাদত কর তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমার সম্পর্ক কেবল তাঁরই সাথেই, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। এ কালেমাটিকে তিনি অক্ষয় বাণীরূপে তার সন্তানদের মধ্যে রেখে গেছেন, যাতে তারা এ দিকেই ফিরে আসে’’। (সূরা যুখরুফঃ ২৬-২৮)
ব্যাখ্যাঃ আলেমদের ঐক্যমতে এখানে কালেমা বলতে কালেমায়ে তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ উদ্দেশ্য।[5] কালেমাটি দ্বারা যা উদ্দেশ্যে করা হয়েছে ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম এখানে তাই তুলে ধরেছেন।
إِنَّنِي بَرَاء مِّمَّا تَعْبُدُونَ ‘‘তোমরা যার এবাদত করো তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই’’-এর দ্বারা কালেমার প্রথমাংশ উদ্দেশ্য। আর إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي ‘‘আর আমার সম্পর্ক কেবল মাত্র তাঁর সাথে যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন’’- এর দ্বারা কালেমার দ্বিতীয় অংশ ‘ইল্লাল্লাহ্’ উদ্দেশ্য। মোট কথা তিনি এবাদতকে শুধু আল্লাহর জন্যই খাস করেছেন, আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য বস্ত্তর এবাদতকে অস্বীকার করেছেন এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য বস্ত্তর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এটি কালেমা তায়্যেবার কতই না সুন্দর ব্যাখ্যা!
আর উসীলার সাধারণ অর্থ হচ্ছে এমন সৎ আমল, যা দ্বারা আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জন করা যায়। সেই সাথে উসীলা জান্নাতের এমন একটি স্তরের নাম, যা আল্লাহর বান্দাদের থেকে কেবল একজনই অর্জন করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আশা পোষণ করেছেন যে, আল্লাহর ইচ্ছায় কিয়ামতের দিন এটি তাঁর জন্য হবে। আমরা আল্লাহর কাছে দুআ করি, তিনি যেন তাঁকে উহা দান করেন।
[2] - আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ করা যে শির্ক এবং আল্লাহ ব্যতীত যাদের কাছে দুআ করা হয় তারা যে দুআকারীর কোন উপকার করার ক্ষমতা রাখেনা, এব্যাপারে কুরআন ও হাদীছে অনেক দলীল রয়েছে। নিম্নে কতিপয় আয়াত উল্লেখ করা হল।
১) আল্লাহ তাআলা বলেনঃ
وَمَنْ أَضَلُّ مِمَّنْ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ مَنْ لَا يَسْتَجِيبُ لَهُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَهُمْ عَنْ دُعَائِهِمْ غَافِلُونَ وَإِذَا حُشِرَ النَّاسُ كَانُوا لَهُمْ أَعْدَاءً وَكَانُوا بِعِبَادَتِهِمْ كَافِرِينَ
‘‘তার চেয়ে অধিক ভ্রান্ত আর কে হতে পারে, যে ব্যক্তি আল্লাহকে ছাড়া এমন কাউকে ডাকে, যে কিয়ামত পর্যন্ত তার ডাকে সাড়া দিতে পারবে না। তারা তো তাদের দুআ সম্পর্কে সম্পূর্ণ বেখবর। যখন মানুষকে হাশরে একত্রিত করা হবে, তখন তারা তাদের শত্রুতে পরিণত হবে এবং তাদের এবাদত অস্বীকার করবে ’’। (সূরা আহকাফঃ ৫-৬)
২) আল্লাহ তাআলা সূরা রা'দের ১৪ নং আয়াতে বলেনঃ
وَالَّذِينَ يَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ لَا يَسْتَجِيبُونَ لَهُمْ بِشَيْءٍ إِلَّا كَبَاسِطِ كَفَّيْهِ إِلَى الْمَاءِ لِيَبْلُغَ فَاهُ وَمَا هُوَ بِبَالِغِهِ وَمَا دُعَاءُ الْكَافِرِينَ إِلَّا فِي ضَلَالٍ
‘‘এবং তাকে ছাড়া যাদেরকে ডাকে, তারা তাদের কোন কাজে আসে না। ওদের দৃষ্টান্ত সেরূপ, যেমন কেউ দু’হাত পানির দিকে প্রসারিত করে যাতে পানি তার মুখে পৌছে যায়। অথচ পানি কোন সময় পৌঁছাবেনা। কাফেরদের সব আহবানই পথভ্রষ্টতা’’।
(৩) আল্লাহ তাআলা সূরা যুমারের ৩৮ নং আয়াতে আরো বলেনঃ
قُلْ أَفَرَأَيْتُم مَّا تَدْعُونَ مِن دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ ۚ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ
‘‘হে নবী! এদেরকে বলোঃ আচ্ছা তোমরা আমাকে সংবাদ দাও তো, আল্লাহকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদেরকে আহবান করছো, আল্লাহ যদি আমার ক্ষতি করতে চান তাহলে তারা কি তাঁর ক্ষতির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করতে পারবে? কিংবা আল্লাহ যদি আমাকে রহমত দান করতে চান তাহলে এরা কি তাঁর রহমত ঠেকিয়ে রাখতে পারবে? তাদের বলে দাও, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট৷ ভরসাকারীরা তারই উপর ভরসা করে’’৷
৪) আল্লাহ তাআলা সূরা আনআমের ১৭ নং আয়াতে বলেনঃ
وَإِنْ يَمْسَسْكَ اللَّهُ بِضُرٍّ فَلَا كَاشِفَ لَهُ إِلَّا هُوَ وَإِنْ يَمْسَسْكَ بِخَيْرٍ فَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
‘‘আর যদি আল্লাহ তোমাকে কোন কষ্ট দেন, তবে তিনি ব্যতীত তা অপসারণকারী কেউ নাই। পক্ষান্তরে যদি তোমার মঙ্গল করেন, তবে তিনি সবকিছুর উপর ক্ষমতাবান’’। এই অর্থে আরো অনেক আয়াত রয়েছে।
[3] - তিরমিজী, অধ্যায়ঃ দুআ। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুনঃ সহীহুত তিরমিযী, হাদীছ নং- ২৮০৯।
[4] - আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ দুআ। ইমাম আলবানী (রঃ) এই হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুনঃ সহীহ ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং- ৩১১১।
[5] - এটিই ছিল সকল নবী-রাসূলের রেসালাত। কতিপয় আলেম বলেনঃ ইবরাহীম (আঃ)এর পর যত নবী আগমণ করেছেন, ঈসা (আঃ) ব্যতীত বাকীদের সকলেই ছিলেন তাঁর বংশধর থেকে। ইহা জানা কথা যে, ঈসা (আঃ) পিতা ছাড়াই জন্ম গ্রহণ করেছেন। তাতে কিছু যায় আসেনা। সকল নবী-রাসূলই কালেমা তায়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ নিয়ে এসেছেন।