আলেমগণের মধ্যে মতভেদ কারণ এবং আমাদের অবস্থান মতভেদের কারণসমূহ শাইখ মুহাম্মাদ ইবন সালেহ আল-উসাইমীন রহ. ১ টি
কারণ ৭: আলেম যঈফ হাদীছকে [দলীল হিসাবে] গ্রহণ করেন অথবা [দলীল শক্তিশালী, কিন্তু] তাঁর দলীলের বুঝ্ বা উপলব্ধিটা দুর্বল।

আর এমন ঘটনা বহু ঘটে থাকে। যঈফ হাদীছ দ্বারা দলীল পেশের অন্যতম একটা উদাহরণ হচ্ছে, কোন কোন আলেম ‘ছালাতুত্‌ তাসবীহ’-কে উত্তম বলেন। ‘ছালাতুত্‌ তাসবীহ’ হচ্ছে, দুই রাক‘আত নামায আদায়- যাতে দণ্ডায়মান অবস্থায় সূরা ফাতিহা এবং ১৫ বার তাসবীহ পাঠ করা হয়। অনুরূপভাবে রূকূ ও সিজদাহ সহ নামাযের শেষ পর্যন্ত সব জায়গায় তাসবীহ পাঠ করা হয়। আসলে ঐ নামাযের নিয়ম-কানুন আমি ভালভাবে রপ্ত করিনি। কারণ শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে আমি সেটাকে ঠিক মনে করি না। আবার কেউ কেউ বলেন, ‘ছালাতুত্‌ তাসবীহ’ জঘন্য বিদআত এবং এ মর্মের হাদীছ ছহীহ নয়। ইমাম আহমাদ রহেমাহুল্লাহ এ মতের পক্ষে। তিনি বলেন, রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম থেকে উহা সাব্যস্ত নয়। শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ রহেমাহুল্লাহ বলেন, ‘ছালাতুত্‌ তাসবীহ’ সংক্রান্ত হাদীছ হলো রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর উপর মিথ্যা রটনা। আর বাস্তবেই যিনি এ সম্পর্কে গবেষণা করবেন, তিনি দেখবেন যে, এমনকি শরী‘আতের দৃষ্টিকোণ থেকেও ইহা অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রম একটা বিধান।

কেননা ইবাদত হয় অন্তরের জন্য উপকারী হবে নতুবা উপকারী হবে না। আর উপকারী হলে সব সময় এবং সব জায়গায় তা শরীআতসম্মত হবে। পক্ষান্তরে উপকারী না হলে শরীআতসম্মত হবে না। আর যে হাদীছে এই নামায সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, মানুষ প্রত্যেক দিন, অথবা সপ্তাহে একদিন অথবা মাসে একদিন বা জীবনে অন্ততঃ একদিন আদায় করবে। ইসলামী শরী‘আতে এরকম আর কোন ইবাদত নেই। সেজন্য এ সংক্রান্ত হাদীছ সনদ এবং মতন উভয় দিক থেকেই ব্যতিক্রম এবং শায়খুল ইসলামের মত যিনি সেগুলোকে মিথ্যা বলেছেন, তাঁর বক্তব্যই সঠিক। আর সেকারণেই শায়খুল ইসলাম বলেন, কোন আলেমই এই নামাযকে উত্তম বলেন নি। নারী-পুরুষ কর্তৃক ব্যাপকভাবে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় বলে আমি এই উদাহরণটা পেশ করেছি। এই বিদ‘আতী আমল শরীআতসম্মত গণ্য করা হবে মর্মে আমি ভয় পেয়েছি। কিছু কিছু মানুষের কাছে ভারী মনে হতে পারে ভেবেও আমি উহাকে বিদ‘আতই বলছি। কেননা কুরআন ও হাদীছে নেই এমন যা কিছু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা হয়, তা-ই বিদআত।

দলীল শক্তিশালী কিন্তু দলীলের বুঝ বা উপলদ্ধিটা দুর্বল হওয়ার উদাহরণঃ হাদীছে এসেছে, ‘গর্ভস্থ বাচ্চার মাকে যবেহ করাই হল গর্ভস্থ বাচ্চাকে যবেহ করা’।[1] আলেম সমাজের নিকট এই হাদীছের প্রসিদ্ধ অর্থ হল, যদি গর্ভস্থ বাচ্চার মাকে যবেহ করা হয়, তাহলে সেই যবেহ গর্ভস্থ বাচ্চার জন্যও যবেহ হিসাবে গণ্য হবে। অর্থাৎ মাকে যবেহ করার পর যখন বাচ্চাকে পেট থেকে বের করা হবে, তখন তাকে আর যবেহ করার প্রয়োজন পড়বে না। কেননা বাচ্চা ইতিমধ্যে মারা গেছে। আর মারা যাওয়ার পর যবেহ করায় কোন লাভ নেই।

আবার কেউ কেউ হাদীছটার অর্থ এরূপ বুঝেছেন যে, গর্ভস্থ বাচ্চাকে তার মায়ের মত করেই যবেহ করতে হবে। ঘাড়ের দুই রগ কেটে দিতে হবে এবং রক্ত প্রবাহিত করতে হবে। কিন্তু এটা অবাস্তব। কারণ মৃত্যুর পর রক্ত প্রবাহিত করা সম্ভব নয়। রাসূল ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘যার রক্ত প্রবাহিত করা হয় এবং আল্লাহর নামে যবেহ করা হয়, তা খাও’।[2] আর একথা স্পষ্ট যে, মৃত্যুর পরে রক্ত প্রবাহিত করা সম্ভব নয়।

কিনারা বিহীন সাগরের মত অসংখ্য কারণের মধ্যে উক্ত কারণগুলোর কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া আমি ভাল মনে করেছি। কিন্তু এত কিছুর পরে আমাদের ভূমিকা কি হবে?

আমি আলোচনার শুরুতেই বলেছি, শ্রবণযোগ্য, পঠনযোগ্য, দর্শনযোগ্য ইত্যাকার নানা প্রচার মাধ্যম এবং এই প্রচার মাধ্যমগুলোতে আলেম ও বক্তাগণের মতানৈক্যের কারণে সাধারণ মানুষ সন্দীহান হয়ে পড়ছে আর বলছে, আমরা কার অনুসরণ করব? [কবি বলেন,]

تكاثرت الظباء على خراش

فما يدري خراش ما يصيد

অর্থাৎ: ‘শিকারী কুকুরের নিকট হরিণ এতই বেশী হয়ে গেছে যে, সে কোন্‌টা ছেড়ে কোন্‌টা শিকার করবে তা বুঝতেই পারছে না’।

>
[1]. আবু দাঊদ, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, হা/২৮২৮; তিরমিযী, ‘শিকার’ অধ্যায়, হা/১৪৭৬, তিনি হাদীছটাকে ‘ছহীহ’ বলেছেন; ইবনু মাজাহ, ‘যবেহ’ অধ্যায়, হা/৩১৯৯।

[2] . বুখারী, ‘যবেহ’ অধ্যায়, হা/৫৪৯৮; মুসলিম, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, হা/১৯৬৮; আবু দাঊদ, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, হা/২৮২৭; নাসাঈ, ‘কুরবানী’ অধ্যায়, হা/৪৪০৩-৪৪০৪; ইবনু মাজাহ, ‘যবেহ’ অধ্যায়, হা/৩১৭৮।