ঈসায়ী প্রচারকগণ বলেন: ইঞ্জিল অর্থ সুসংবাদ। ঈসা মাসীহ মানবকুলের জন্য সুসংবাদ প্রচার করেছেন। আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু আরবদের ভয় প্রদর্শনকারী! তিনি মক্কা ও পার্শবর্তী এলাকার জন্য এবং যাদের পিতৃপুরুষগণকে সতর্ক করা হয় নি তাদের সতর্ক করতে প্রেরিত। (নাউযূ বিল্লাহ!) মিথ্যাচারগুলি লক্ষ্য করুন:

(১) নবীগণের দায়িত্ব সুসংবাদ দেওয়া ও ভয় প্রদর্শন। কাজেই কেউ যদি শুধু সুসংবাদ প্রচার করেন তবে তিনি নুবুওয়াতের অর্ধেক দায়িত্ব পালন করেছেন। যে স্কুলে ছাত্রদেরকে শুধুই পাস করার সুসংবাদ শোনানো হয়, ফেল করার ভয় প্রদর্শন করা না হয় সে স্কুলে কেউ সন্তান ভর্তি করবেন না। যে দেশ বা সমাজে আইনের শাসনের ভয় না দেখিয়ে সবাইকে শুধু সর্বপ্রকার শাস্তি থকে পরিত্রানের সুসংবাদ শোনানো হয় সে দেশে কোনো মানুষ বাস করতে পারেন না।

(২) ভয়প্রদর্শনও সুসংবাদ। এজন্য ইঞ্জিলেও মাসীহ ভয় প্রদর্শন করেছেন। কোনো ধনী ব্যক্তি জান্নাতে ঢুকবে না, পরনারীর দিকে তাকালে চক্ষু তুলতে হবে ইত্যাদিও বলেছেন। তবে তাঁর সুসংবাদ ও ভয় প্রদর্শন সবই ইস্রায়েলীয়দের জন্য।

(৩) আল্লাহ বলেছেন: “আমি এ কল্যাণময় কিতাব নাযিল করেছি যা তার আগের সব কিতাবের সমর্থক এবং যা দ্বারা আপনি মক্কা ও তার চারপাশের মানুষদেরকে সতর্ক করেন।” (৬-আন‘আম ৯২। ৪২-শূরা: ৭)। আল্লাহ আরো বলেন: “যেন আপনি সতর্ক করেন সেসব সম্প্রদায়কে যাদের কাছে আপনার আগে কোন সতর্ককারী আসেনি” (২৮-কাসাস: ৪৬; ৩২-সাজদা: ৩। ৩৬-ইয়াসীন: ৬)। ঈসায়ী প্রচারকগণ বলেন, এতে প্রমাণিত হয় যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশ্বনবী ছিলেন না। অথচ শুধু এ কথাগুলিই প্রমাণ করে যে, তিনি অসাম্প্রদায়িক বিশ্বনবী ছিলেন।

(৪) আমরা দেখেছি যে, মাসীহ বলেছেন: তিনি ইসরায়েল বংশের সন্তানগণ ছাড়া কারো জন্যই প্রেরিত হন নি, অন্যান্য বংশের ও জাতির মানুষেরা শূকর ও কুকুর; কাজেই তাদেরকে তাঁর দীন প্রদান করা যাবে না; দো‘আও করা যাবে না। মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথম এ সাম্প্রদায়িকতার ইতি টানলেন। সম্প্রদায় বা বংশের কারণে কাউকে শূকর-কুকুর বলা তো দূরের কথা আল্লাহ একথাও বলেন নি যে, তুমি ‘ঈসমাঈল বংশ’ বা ‘আরব’ ছাড়া কাউকে দীক্ষা দিবে না। বরং বললেন, কোনোরূপ গোত্র, বংশ বা সম্প্রদায় বিবেচনা না করে যারাই “সতর্ককারী” বা সত্য নবীর সঠিক দীন থেকে বঞ্চিত সকলকেই জান্নাতের পথ দেখাবে। মক্কা ও তৎপার্শবর্তী অঞ্চলের সকল ধর্মের, বর্ণের, বংশের ও গোত্রের মানুষকে জান্নাতের পথের দাওয়াত দিবে।’

(৫) মক্কা ও তৎপার্শবর্তী এলাকা থেকে বিশ্বধর্ম শুরু করার কারণ বিশ্বের একমাত্র এ অঞ্চলেই সকল ধর্ম, রক্ত ও বর্ণের মানুষ বাস করতেন। তৎকালীন সময়ে চীন, ভারত, আফ্রিকা, ইউরোপ ও অন্যান্য দেশে মূলত একই বংশ বা বর্ণের মানুষ বাস করত। কোনো সর্বজনীন দাওয়াতও এ সকল দেশে শুরু করলে তা সাম্প্রদায়িক বা আঞ্চলিক হওয়ার ভয় ছিল। পাঠক মানচিত্রে দৃষ্টি দিলে দেখবেন যে, মক্কা পৃথিবীর কেন্দ্র। একমাত্র এখান থেকেই পৃথিবীর স্থলভাগের সকল অংশ প্রায় সমান। উপরন্তু সে সময়েই মক্কা ও তৎপার্শ্ববর্তী সিরিয়া, ইয়ামান, পারস্য, রোম, মিসর ইত্যাদি দেশে সকল বংশের, বর্ণের ও ধর্মের মানুষ বসবাস করত। এজন্য ইসলামকে সত্যিকার বিশ্বজনীন করার জন্য আল্লাহ এ বিশ্বজনীন দাওয়াতকে মক্কা থেকে শুরু করেন।

(৬) এ বিশ্বজনীনতা বারংবার নিশ্চিত করা হয়েছে কুরআনে। আল্লাহ বলেন: “আমি তো আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদ প্রদানকারী ও ভয়প্রদর্শনকারী হিসাবে প্রেরণ করেছি” (৩৪-সাবা: ২৮); “বল: হে মানবজাতি, নিশ্চয় আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রাসূল” (৭-আ’রাফ: ১৫৮); “তিনিই মহিমাময় যিনি তাঁর বান্দার উপরে ফুরকান নাযিল করেছেন, যেন তিনি সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য ভয় প্রদর্শনকারী হন” (২৫- ফুরকান: ১); “নিশ্চয় আমি আপনাকে সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত-স্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (২১-আম্বিয়া: ১০৭)। কিতাবুল মোকাদ্দসে মানবজাতিকে দুভাগে ভাগ করা হয়েছিল: (১) ইসরায়েল বংশ এবং (২) অন্যান্য বংশ বা ‘পরজাতি’ ও উম্মী। বিভক্তির দেওয়াল যে ভাঙ্গা হলো তা বুঝাতে মাঝে মাঝে দু অংশের জন্যই যে ইসলামী বিধান এক আল্লাহ তা স্পষ্ট করেছেন। একস্থানে আল্লাহ বলেন: “যাদেরকে কিতাব দেয়া হয়েছে তাদেরকে ও ‘উম্মী’গণকে বলুন, ‘তোমরাও কি আত্মসমর্পণ করেছ?’...” (৩-আল-ইমরান ২০)।

(৭) সর্বোপরি একমাত্র মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মধ্যেই সকল মানুষের জীবন্ত আদর্শ বিদ্যমান এবং তাঁর আদর্শ সংরক্ষিত। ব্যক্তিগত, দাম্পত্য, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, বাণিজ্যিক সকল প্রকারের সমস্যায় ও অবস্থায় বিশ্বের যে কোনো মানুষ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবনে প্রায়োগিক আদর্শ দেখতে পান। কিন্তু ঈসা মাসীহের আদর্শ সংরক্ষিত হয় নি। তাঁর সাধারণ কিছু শিক্ষা বিদ্যমান; কিন্তু প্রায়োগিক কোনো আদর্শ সংরক্ষিত নয়। খৃস্টান প্রচারকগণ তাকে ত্যাগের আদর্শ বলে প্রচার করেন। তাঁরা দাবি করেন যে, তিনি মানবতার মুক্তির জন্য জীবন দিয়েছেন। কিন্তু ইঞ্জিল শরীফে তার জীবনদানের যে বিবরণ লেখা হয়েছে তাকে কোনোভাবেই ‘আদর্শ আত্মত্যাগ’ বলে বিবেচনা করা যায় না। জীবন দানের ভয়ে হাউমাউ করে মাথা ঠুকে ক্রন্দন, মৃত্যুর পূর্বে সমবেত মানুষদেরকে মুক্তির পথ এবং অলৌকিক চিহ্ন না দেখিয়ে নীরব থাকা, ক্রুশের উপর চিৎকার করে আল্লাহকে দোষারোপ করা ইত্যাদি কর্ম যদি কোনো মানুষ করেন তবে আমরা তাকে আদর্শ আত্মত্যাগী বলতে পারি না।

অনুরূপভাবে অবিবাহিত জীবন যাপন করা, বিবাহকে নিরুৎসাহিত করা, পিতামাতা-স্ত্রীপুত্র পরিত্যাগ করতে উৎসাহ দেওয়া, কথাবার্তায় গালিগালাজ করা, অভিশাপ দেওয়া, নিজের মা-কে ‘ওহে মহিলা’ বলা, মাকে ‘কে আমার মা?’ বলা, তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে অস্বীকার করা, বেশ্যা মহিলাদেরকে চুমু খাওয়ার সুযোগ দেওয়া ইত্যাদিকে কোনোভাবেই আদর্শ বলে বিবেচনা করা যায় না। অন্য কোনো মানুষ যদি এরূপ করেন তবে কেউ তাকে আদর্শস্থানীয় বলে বিবেচনা করবেন না।

(৮) আমরা মুসলিমরা বিশ্বাস করি, ঈসা (আঃ) এসকল কর্ম করেন নি। তবে প্রচলিত ইঞ্জিলে এরকমই রয়েছে। এজন্য আমরা বিশ্বাস করি, তাঁর আদর্শ সংরক্ষিত হয় নি। তিনি বিশ্বনবী ছিলেন না, শুধু ইস্রায়েল বংশের মানুষদেরকে সত্যের দিশা দিতে আগমন করেছিলেন। তাঁর অনুসারীরা তাঁর আদর্শ সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়। বিশ্বের সকল মানুষই ‘সতর্ককারী’র বা সত্যনবীর সত্য আদর্শ থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। এজন্য আল্লাহ সকলের জন্য মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণ করেন।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে