আমরা দেখলাম, পলীয় খৃস্টধর্মে শরীয়ত, ইবাদত ইত্যাদির গুরুত্ব নেই। যাজকগণ ধর্মকর্মের সব কিছুতেই ছাড় দিতে প্রস্তুত। তবে একটি বিষয়ে তাঁরা বিন্দু মাত্র ছাড় দিতে রাজি হন নি; তা হলো ত্রিত্ববাদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাসের একটি শব্দ নিয়ে সামান্য দ্বিধা করলেই তাকে অভিশাপ দেওয়া থেকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে মারা! এ বিশ্বাসটি এত অযৌক্তিক ও উদ্ভট যে, খৃস্টান প্রচারকগণ নতুন খৃস্টানদেরকে তা খুলে বলেন না। এখানে আমি খৃস্টধর্মের মূল কালেমা, বিশ্বাসের সাক্ষ্য বা নাইসীন ক্রীড (Nicene creed) হুবহু্ উল্লেখ করছি:
We believe in one God, the Father Almighty, Maker of all thing, visible and invisible; and in one Lord Jesus Christ, the Son of God, the only begotten of the Father, that is, of the substance of the Father; God of God, light of light, true God of true God; begotten, not made, consubstantial with the Father, by whom all things were made, both in heaven and in earth; who for us men, and for our salvation, descended, was incarnate, and was made man, and suffered, and rose again the third day: he ascended into heaven, and shall come to judge the living and the dead; And in the Holy Spirit. But the holy catholic and apostolic Church of God anathematizes those who affirm that there was a time when the Son was not, or that he was not before he was begotten, or that he was made of things not existing: or who say, that the Son of God was of any other substance or essence, or created, or liable to change or conversion.
“আমরা বিশ্বাস করি এক ঈশ্বরে, সর্বশক্তিমান পিতা, সকল কিছুর স্রষ্টা, দৃশ্য ও অদৃশ্য; এবং একজন প্রভু যীশু খৃস্টে, ঈশ্বরের পুত্র & পিতার একমাত্র জন্ম-দেওয়া (ঔরসজাত) পুত্র (only begotten Son), অর্থাৎ পিতারই যাত বা সত্ত্বা থেকে, ঈশ্বর থেকে ঈশ্বর, আলো থেকে আলো, সত্য ঈশ্বর থেকে সত্য ঈশ্বর, জন্ম দেওয়া (begotten: ঔরসজাত), সৃস্ট নয়; পিতার সাথে মূলগত-সারবস্তুতে এক; যার দ্বারা সকল কিছু সৃষ্ট; আসমানে ও যমিনে, যিনি আমাদের মানুষদের জন্য এবং আমাদের পরিত্রানের জন্য অবতরণ করেন, দেহ ধারণ করেন, তাকে মানুষ বানানো হয়, তিনি দুঃখভোগ করেন, এবং তৃতীয় দিনে পুনরায় উত্থান করেন। তিনি স্বর্গে উঠেন, এবং জীবিত ও মৃতদের বিচার করতে আবার আগমন করবেন। এবং পবিত্র আত্মায়। কিন্তু পবিত্র মহাসম্মেলন ও শিষ্যদের অনুসারী মণ্ডলী অভিশাপ দিচ্ছে তাদেরকে যারা দাবি করে যে, পুত্র অনাদি নন- এক সময় ছিল যখন পুত্র বিদ্যমান ছিলেন না, অথবা তাঁকে জন্ম দেওযার আগে তাঁর অস্তিত্ব ছিল না, অথবা তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে অনাদি কোনো বস্তু দ্বারা; অথবা যারা বলে যে ঈশ্বরের পুত্র অন্য কোনো বস্তু বা সারবস্তুর; অথবা তিনি সৃষ্ট, অথবা তিনি পরিবর্তন বা রূপান্তর যোগ্য।" (A Historical View of the Council of Nice, p 44) পাঠক, প্রয়োজনে the creed লিখে ইন্টারনেটে সার্চ করুন।
সম্মানিত পাঠক, নিম্নের বিষয়গুলি লক্ষ্য করুন:
(ক) একটি ধর্মের মূলবিশ্বাস সে ধর্মের ধর্মগ্রন্থের কোথাও নেই! আমাদের ঈমানের কালিমা কুরআনে এবং হাদীসে শতশতবার বলা হয়েছে। আর খৃস্টধর্মের ঈমানের এ সুবৃহৎ কালিমাটির কোনো অস্তিত্ব ‘কিতাবুল মোকাদ্দসে’ নেই। পাপ, পুন্য ও শরীয়ত পালন সম্পর্কে মাসীহ কত কথা বলেছেন! শিষ্যগণ না বুঝলে আবার বুঝিয়েছেন। বর্তমান ঈসায়ী ধর্মে এসব কথা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়! বরং পাপ ও অভিশাপের উৎস! অথচ যে বিশ্বাসের উপর মুক্তি নির্ভর করছে তা তিনি বুঝালেন না!
(খ) এ বিশ্বাসের মূল বিষয় আল্লাহ বা পিতা নন; পুত্র বা যীশু। পিতার প্রতি ঈমানের বিষয়টি কয়েক শব্দে শেষ! বাকি সব কথা শুধু পুত্রকে নিয়ে! পুত্রকে জন্ম-দেওয়া (begotten) ও ‘পিতার যাত বা সত্ত্বা (substance of the Father) থেকে’ বলে বিশ্বাস করতেই হবে; না-হলে অভিশাপ থেকে আগুনে মৃত্যু! ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র, তবে জন্ম-দেওয়া (begotten) বা ‘যাত থেকে’ নয়; বরং ‘মাখলূক (made) পুত্র’ বলে বিশ্বাস করার কারণে ৩য়-৪র্থ শতকের প্রসিদ্ধ খৃস্টান ধর্মগুরু আরিয়ূস (Arius) এবং তাঁর অনুসারীগণ (Arians) কি ভয়ঙ্কর নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন তা জানতে পাঠক উপরের শব্দ দুটি দিয়ে ইন্টারনেটে সার্চ করতে পারেন।
(গ) আমরা দেখলাম যে, এ ঘৃণ্য শির্কী শব্দটি প্রচলিত ইঞ্জিল থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। খৃস্টান ধর্মগুরু ও বাইবেল বিশেষজ্ঞগণ বাইবেলের প্রাচীন পাণ্ডুলিপিতে এ ঘৃণ্য শব্দটির অস্তিত্ব না পেয়ে তা ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এ শব্দটির উচ্ছেদের সাথে সাথে ত্রিত্ববাদের উচ্ছেদ জরুরী ছিল; কিন্তু ধর্মগুরুগণ তা করেন নি। কারণ ইঞ্জিলে কি আছে বা নেই তা তাদের বিবেচ্য নয়; তাদের ত্রিত্ববাদী গুরুগণ কি বলেছেন, সেটিই বড় বিষয়। এজন্যই আল্লাহ বলেন: “বলুন, ‘হে কিতাবীগণ! তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না; এবং যে সম্প্রদায় ইতোপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে, অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে ও সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করো না।”’ (৫-মায়িদা: ৭৭)
ত্রিত্ববাদ বা (Trinity) অর্থ (the unity of Father, Son, and Holy Spirit as three persons in one Godhead): এক ঈশ্বরত্বের মধ্যে পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা এই তিন ব্যক্তির মিলন। এর ব্যাখ্যায় ঈসায়ী ধর্মগুরুগণ বলেন:
There is exactly one God. There are three really distinct Persons - Father, Son, and Holy Spirit. Each of the Persons is God. The Father is God. The Son is God. The Holy Spirit is God. The Father is not the Son. The Son is not the Holy Spirit. The Father is not the Holy Spirit
(http://www.bbc.co.uk/religion/religions/christianity/beliefs/trinity_1.shtml)
“একজন ঈশ্বর বিদ্যমান, সম্পূর্ণ পৃথক তিনজন ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি বিদ্যমান: পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্মা। তিনজনের প্রত্যেক ব্যক্তিই ঈশ্বর: পিতা ঈশ্বর, পুত্র ঈশ্বর, পবিত্রআত্মা ঈশ্বর। পিতা পুত্র নন, পুত্র পবিত্র আত্মা নন, পিতা পবিত্র আত্মা নন।”
কিভাবে সম্পূর্ণ তিনজন পৃথক ব্যক্তি একজন হলেন তা কখনোই ত্রিত্ববাদীরা বুঝতে বা বুঝাতে পারেন নি। হয়ত খৃস্টান প্রচারক আপনাকে বলবেন, যেমন মাংস, অস্থি ও রক্ত তিন বস্তু দিয়ে মানব দেহ; তেমনি পিতা-পুত্র-পবিত্রআত্মার সমন্বয়ে আল্লাহ! সম্ভবত তিনি জানেনও না যে, এ কথা বলার সাথে সাথে ত্রিত্ববাদী বিশ্বাস অনুসারে তিনি কাফির হয়ে গিয়েছেন! কারণ ত্রিত্ববাদে পিতা-পুত্র-পবিত্র আত্মা এক ঈশ্বরের তিন অঙ্গ বা অংশ নন; বরং প্রত্যেকে পৃথক ঈশ্বর! আচ্ছা বলুন তো মাংস, অস্থি ও রক্তকে কি বলা যায় প্রত্যেকেই পৃথক মানুষ! সম্পূর্ণ পৃথক সত্ত্বা?!
ত্রিত্ববাদ বিষয়ে বিবিসির খৃস্টধর্ম বিষয়ক ওয়েবসাইটের ভাষ্য:
The Trinity is a controversial doctrine; many Christians admit they don't understand it, while many more Christians don't understand it but think they do. .... The doctrine of the Trinity is one of the most difficult ideas in Christianity, but it's fundamental to Christians ... This idea that three persons add up to one individual seems like nonsense. And logically, it is. (www.bbc.co.uk/religion/religions/christianity/beliefs/trinity_1.shtml)
“ত্রিত্ববাদ একটি বিতর্কিত মতবাদ; অনেক খৃস্টানই স্বীকার করেন যে, তারা তা বুঝেন না। অন্যান্য অধিকাংশ খৃস্টান তা বুঝেন বলে ধারণা করেন, তবে প্রকৃতপক্ষে তারা তা বুঝেন না। .. ত্রিত্ববাদী বিশ্বাস খৃস্টধর্মের সবচেয়ে কঠিন বিশ্বাসগুলির অন্যতম; যদিও খৃস্টানদের জন্য এটি মূল বিষয়। তিনজন ব্যক্তি একত্রিত হয়ে একক ব্যক্তিত্ব তৈরি করেছেন-এরূপ ধারণা ননসেন্স বা নির্বোধ প্রলাপ বলেই প্রতীয়মান হয়। আর যুক্তির বিচারে তা নির্বোধ প্রলাপই বটে।”
আর এ ‘ননসেন্স’ নিয়েই বিগত দু হাজার বৎসর ধরে খৃস্টানদের যত দলাদলি ও খুনোখুনি। ‘অবতারবাদ’ বা মানুষরূপে ঈশ্বরের (God incarnate) বিশ্বাস হিন্দুধর্মেও রয়েছে। হিন্দুরা খুবই সহজভাবে কৃষ্ণকে ঈশ্বরের অবতার (God incarnate) বলে বিশ্বাস করেন। এর ব্যাখ্যা চাইলে তারা অতি সহজে বলবেন যে, ঈশ্বর মানুষ রূপে এসেছিলেন.... ইত্যাদি। খৃস্টানগণ যীশুকে ঈশ্বরের অবতার (God incarnate) বলে বিশ্বাস করেন। কিন্তু আল্লাহর একত্ব, ঈসা মাসীহের প্রেরিতত্ব (রাসূলত্ব) ও মনুষ্যত্ব বিষয়ক কিতাবুল মোকাদ্দসের এবং ঈসা মাসীহের অগণিত সুস্পষ্ট বক্তব্য বাতিল করে ‘ত্রিত্ববাদ’ প্রমাণ করতে যেয়ে তারা গলদঘর্ম হয়ে পড়েন।
‘তিনে এক’-এর ‘ননসেন্স’ ছাড়াও আরো সমস্যা আছে। পলীয় ধর্মে যে নতুন দুজন ঈশ্বর আবিষ্কার করা হলো তাদের প্রকৃতি নিয়ে তাঁদের সমস্যার অন্ত নেই। পুত্র ঈশ্বরের প্রকৃতি: মানুষ যীশুর সাথে পুত্র ঈশ্বরের সমন্বয় কিভাবে? মানুষ যীশু কিভাবে এবং কখন থেকে ঈশ্বর ও ঈশ্বরের পুত্র? জন্ম থেকে না পরবর্তী কোনো সময়ে? তাঁর মধ্যে কয়টি সত্ত্বা বিদ্যমান ছিল? একটি? না দুটি? তৃতীয় ঈশ্বর ‘পবিত্র আত্মা’র উৎস কী? প্রথম ঈশ্বর না প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় ঈশ্বর? প্রকৃতপক্ষে কেউ এর ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। ফলে একজনের ব্যাখ্যার সাথে অন্যজনের ব্যাখ্যা মিলে না। খৃস্টধর্মের অগণিত দল উপদল ও যুদ্ধ বিগ্রহ মূলত এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই। আগ্রহী পাঠক যে কোনো এনসাইক্লোপিডিয়া বা ইন্টারনেটে নিম্নের বিষয়গুলি দেখুন:
Chalcedon, Council of; Syrian Orthodox Patriarchate of Antioch, Nestorius; Nestorian, Monarchianism; Paul Of Samosata, Trinitarian heresies, Modalism, Tritheism, Partialism, Adoptionism, Arianism, The Filioque fracas, Schism...
কোনোভাবে এ সকল ‘ননসেন্স আকীদা’ বুঝাতে না পেরে তারা এখন বলেন: (the Trinity of Persons being conceived as an irrational truth found in revelation) তিন ব্যক্তির ঐক্য আল্লাহর কিতাবে বিদ্যমান একটি অযৌক্তিক সত্য। অর্থাৎ বিষয়টি অযৌক্তিক, তবে যেহেতু আল্লাহর কিতাবে বিদ্যমান তাই বিশ্বাস করি।
তাদের এ কথাটি অসত্য। খৃস্টানগণ একবাক্যে স্বীকার করেন যে, ত্রিত্ববাদের কথা বাইবেলে কোথাও বলা হয় নি। (Trinity) শব্দটিতো দূরের কথা, এ আকীদায় যা বলা হয় সে বিষয়ে কিতাবুল মোকাদ্দসে, ইঞ্জিল শরীফে, শিষ্যদের পত্রে কোথাও পরিষ্কার কিছু নেই। নিজেরাই বলছেন, এ বিষয়ে কিতাবুল মোকাদ্দসে স্পষ্ট কিছুই নেই। আবার বলছেন, কিতাবে আছে বলে বাধ্য হয়ে বিশ্বাস করি!
তাঁরা বলেন, এ বিষয়ক কিছু ইঙ্গিত বাইবেলে বিদ্যমান। আমরা আগেই বলেছি যে, বুদ্ধিমান-নির্বোধ সকল মানুষের জন্য বিশ্বাসের বিষয়টি পরিষ্কার করতেই নবী-রাসূলগণ আগমন করেন। কাজেই যে বিশ্বাসের উপর মুক্তি নির্ভর করে সে বিশ্বাস কখনো ইঙ্গিত হতে পারে না। সর্বোপরি, কিতাবুল মোকাদ্দসের সুস্পষ্ট ও ব্যাখ্যাতীত বক্তব্যের বিপরীতে ইঙ্গিত নামের অপব্যাখ্যাকে কিতাবের শিক্ষা বলা যায় না।
এ বিশ্বাসের লাভ কী? এ বিষয়ে বিবিসির খৃস্টধর্ম বিষয়ক ওয়েবসাইটের ভাষ্য:
Absolutely nothing worthwhile for the practical life can be made out of the doctrine of the Trinity taken literally. (Immanuel Kant, Der Streit der Fakultätencite) ...the doctrine of the Trinity so easily appears to be an intellectual puzzle with no relevance to the faith of most Christians. Karen Kilby. Until quite recently, many theologians thought that the doctrine of the Trinity was pretty pointless. And the churches themselves disagree about the content of the doctrine... And yet somehow it remains at the heart of the Christian faith ..... (www.bbc.co.uk/religion/religions/christianity/beliefs/trinity_1.shtml)
“ইম্মানুলে কান্ট বলেন: ‘বাস্তব জীবনের কল্যাণকর সামান্য কোনো কিছুই ত্রিত্ববাদী আকীদা থেকে অর্জন করা যায় না।’ কারেন কিলবি বলেন: ‘খুব সহজেই বুঝা যায় যে, ত্রিত্ববাদী আকীদাটি একটি বুদ্ধির গোলকধাঁধা, অধিকাংশ খৃস্টানের বাস্তব জীবনে এর কোনো কার্যকরিতা নেই।’ একেবারে বর্তমান সময় পর্যন্ত অনেক খৃস্টান ধর্মতত্ত্ববিদ বিশ্বাস করেন যে, ত্রিত্ববাদী আকীদা একেবারে অন্তসারশূণ্য। আর খৃস্টান চার্চগুলিও এ বিশ্বাসের বিষয়বস্তুগুলির বিষয়ে একমত নয়।... এরপরও এ আকীদাটিই খৃস্টধর্মের মূল বিষয়।”