দীনী ভাইদের সাথে আদব এবং আল্লাহর জন্য তাদেরকে ভালোবাসা ও ঘৃণা করা

আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমানের দাবি অনুযায়ী মুসলিম ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসবে শুধু আল্লাহর জন্য এবং কাউকে ঘৃণা করবে— তাও শুধু আল্লার জন্য; কারণ, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পছন্দই তার পছন্দ এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অপছন্দই তার অপছন্দ; সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালোবাসার কারণেই সে তাকে ভালোবাসবে এবং তার প্রতি তাঁদের ঘৃণার কারণেই সে তাকে ঘৃণা করবে; আর এ ব্যাপারে তার দলীল হলো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, তিনি বলেছেন:

« مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ ، وَأَبْغَضَ لِلَّهِ ، وَأَعْطَى لِلَّهِ ، وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الإِيمَانَ » . (رواه أبو داود ).

“যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কাউকে ভালোবাসল, আল্লাহর জন্য কাউকে ঘৃণা করল, আল্লাহর জন্য কাউকে দান করল এবং আল্লাহর জন্য কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকল, সে ব্যক্তি নিজ ঈমানকে পূর্ণতা দান করল।”[1] আর এর উপর ভিত্তি করে মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর সকল সৎবান্দাকে ভালোবাসবে এবং তাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করবে; আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ অমান্যকারী আল্লাহর সকল বান্দাকে ঘৃণা করবে এবং তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করবে; তাছাড়া এটা মুসলিম ব্যক্তিকে তার কোনো কোনো ভাইকে আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে বেশি মহব্বত ও আন্তরিকতার কারণে ভাই ও বন্ধু বলে গ্রহণ করতে কোনো মানা নেই; কেননা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ধরনের ভাই ও বন্ধু গ্রহণ করার ব্যাপারে উৎসাহ প্রদান করে বলেন:

« الْمُؤْمِنُ آلِفٌ مَأْلُوفٌ ، وَلَا خَيْرَ فِيمَنْ لَا يَأْلَفُ وَلَا يُؤْلَفُ » . (رواه أحمد و الطبراني و الحاكم ).

“মুমিন ঘনিষ্ঠ ও বন্ধত্বপূর্ণ ব্যক্তি; আর সে ব্যক্তির মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই, যে ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ নয়।”[2] তিনি আরও বলেন:

« إنّ حولَ العرشِ مَنابِرُ من نورٍ، عليها قومٌ لباسُهم نورٌ ووجوهُهم نورٌ، ليسوا بأنبياءَ ولا شهداءَ ، يَغْبِطُهُمْ الأنبياءُ والشهداءُ ، فقالوا: يا رسولَ اللّهِ صِفْهُمْ لنا ، فقال: هم المُتَحَابُّونَ في اللّهِ عزّ وجلّ ، والمُتَجالِسُونَ في اللّهِ تعالى ، والمُتَزَاوِرُونَ في اللّهِ تعالى» . (رواه النسائي ).

“আরশের চারিপাশে কতগুলো নূরের মিম্বার রয়েছে, যেগুলোর উপর একদল লোক অবস্থান করবে, যাদের পোশাকে নূর এবং চেহারাতেও নূর, তারা নবী নন এবং শহীদও নন, তাদের প্রতি ঈর্ষা করবে নবী ও শহীদগণ; সাহাবীগণ বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের জন্য তাদের একটা বর্ণনা পেশ করুন; তখন তিনি বললেন: তারা হলেন আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে একে অপরকে মহব্বতকারী, পরস্পর আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্য বন্ধুত্ব স্থাপনকারী এবং আল্লাহ তা‘আলার উদ্দেশ্যে একে অপরের সাথে সাক্ষাৎকারী।”[3] তিনি আরও বলেন:

« إِنَّ اللَّهَ عَزَّ وَجَلَّ يَقُولُ : قَدْ حَقَّتْ مَحَبَّتِي لِلَّذِينَ يَتَحَابُّونَ مِنْ أَجْلِي ، وَحَقَّتْ مَحَبَّتِي لِلَّذِينَ يَتَنَاصَرُونَ مِنْ أَجْلِي » . (رواه أحمد و الحاكم ).

“আল্লাহ তা‘আলা বলেন: তাদের জন্য আমার মহব্বত (ভালোবাসা) নিশ্চিত হয়ে যায়, যারা আমার জন্যই একে অপরকে ভালোবাসে; আবার তাদের জন্যও আমার মহব্বত নিশ্চিত হয়ে যায়, যারা আমার কারণেই একে অপরকে সাহায্য করে।”[4] তিনি আরও বলেন:

« سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ في ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إلاَّ ظِلُّهُ : إمَامٌ عَادِلٌ ، وَشَابٌّ نَشَأ في عِبَادَةِ الله عز وجل ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ بِالمَسْجِدِ إذَا خَرَجَ مِنْهُ حَتَّى يَعُوْدَ إلَيْهِ ، وَرَجُلاَنِ تَحَابّا في اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيهِ وتَفَرَّقَا عَلَيهِ ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ الله خَالِياً فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأةٌ ذَاتُ حَسَبٍ وَجَمَالٍ ، فَقَالَ : إنِّي أخَافُ الله ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ ، فَأخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ » . (متفق عليه ).

“এরূপ সাত ব্যক্তিকে সেদিন আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সুশীতল ছায়ায় স্থান দিবেন, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত আর কোনো ছায়া থাকবে না: ১. ন্যায় বিচারক ইমাম বা নেতা; ২. মহান আল্লাহর ইবাদতে মশগুল যুবক; ৩. মাসজিদের সাথে সম্পর্কযুক্ত হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তি— যখন সে মাসজিদ থেকে বের হয় আবার তাতে ফিরে আসা পর্যন্ত মন ব্যকুল থাকে; ৪. এমন দুই ব্যক্তি, যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই পরস্পর ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়; ৫. এমন ব্যক্তি, যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে দু’চোখের অশ্রু ঝরায়; ৬. এমন লোক, যাকে কোন সম্ভ্রান্ত সুন্দরী নারী ব্যভিচারের জন্য আহ্বান করেছে, আর তখন সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছে: আমি তো আল্লাহকে ভয় করি; ৭. যে ব্যক্তি এমন গোপনীয়তা রক্ষা করে দান-সাদকা করে যে, তার ডান হাত কী দান করল বাম হাতও তা জানতে পারে না।”[5] তিনি আরও বলেন:

« إن رجلاً زَارَ أخاً له في اللهِ فأرْصَدَ اللهُ لهُ ملكاً ، فقال : أين تُرِيدُ ؟ قَالَ : أرِيْدُ أن أزُوْرُ أخِيْ فُلَاناً ، فَقَالَ : لِحَاجَةٍ لكَ عندَهُ ؟ قَالَ : لَا ، قَالَ : لِقَرَابَةٍ بينكَ وبينهُ ؟ قال : لَا ، قَالَ : فَبِنِعْمَةٍ له عندَكَ ؟ قَالَ : لَا ، قَالَ : فَبِمَ ؟ قَالَ : أحِبُّهُ في اللهِ ، قَالَ : فإن اللهَ أرْسَلَنِيْ إليكَ أخْبِرُكَ بِأنَّهُ يُحِبُّكَ لِحُبِّكَ إيَّاهُ ، وقد أوْجَبَ لَكَ الجنةَ » . (رواه مسلم بلفظ أخصر من هذا ).

“এক ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে তার এক ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করবে, তখন আল্লাহ তা‘আলা তার জন্য একজন ফেরেশ্তাকে পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব দিলেন; তারপর সে (ফেরেশ্তা) বলল: তুমি কোথায় যাচ্ছ? সে বলল: আমি আমার অমুক ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ করতে চাই; তারপর সে জিজ্ঞাসা করল: তার কাছে কি তোমার কোনো প্রয়োজন আছে? সে বলল: না, সে আবার জিজ্ঞাসা করল: তোমার ও তার মাঝে কোনো আত্মীয়তার বন্ধনের কারণেই কি তুমি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছ? সে বলল: না, সে আবার জিজ্ঞাসা করল: তাহলে কি তোমার কাছে তার কোনো দান বা অনুগ্রহের ব্যাপার আছে যার কারণে তুমি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছ? সে বলল: না, তারপর সে আবার জিজ্ঞাসা করল: তাহলে কোন্ কারণে তুমি তার সাথে সাক্ষাৎ করবে? জবাবে সে বলল: আমি তাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালোবাসি; তখন ফেরেশ্তা বলল: আল্লাহ তা‘আলা আমাকে তোমার নিকট পাঠিয়েছেন তোমাকে এ সংবাদ দেয়ার জন্য যে, তার প্রতি তোমার ভালোবাসার কারণে তিনিও তোমাকে ভালোবাসেন এবং তিনি তোমার জন্য জান্নাত বরাদ্দ করে দিয়েছেন।”[6]

আর এ ভ্রতৃত্বের সম্পর্কের শর্ত হলো— তা একান্তই আল্লাহর উদ্দেশ্যে হতে হবে, যা দুনিয়ার যাবতীয় ভেজাল ও তার বস্তুগত সম্পর্ক থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হবে এবং তার একমাত্র কারণ বা উদ্দেশ্য হবে আল্লাহর প্রতি ঈমান, অন্য কিছূ নয়।

সুতরাং তাকে দীনী ভাই হিসেবে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত আদবসমূহ রক্ষা করে চলতে হবে:

১. তাকে বুদ্ধিমান হতে হবে; কারণ, নির্বোধের সাথে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক ও সাহচর্যের মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই; কেননা, অনেক সময় নির্বোধ মূর্খ ব্যক্তি উপকার করতে গিয়ে ক্ষতি করে বসে।

২. তাকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী হতে হবে; কেননা, দুশ্চিরিত্রবান ব্যক্তি বুদ্ধিমান হলেও অধিকাংশ সময় নিজের খেয়াল-খুশি মত চলে অথবা রাগ-বিরাগের বশবর্তী হয়ে কাজ করে, ফলে সে তার সাথীর সাথে মন্দ আচরণ করে।

৩. তাকে আল্লাহভীরু হতে হবে; কারণ, প্রতিপালকের আনুগত্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে যাওয়া ফাসিক ব্যক্তি থেকে বন্ধুও নিরাপদ নয়; কেননা, সে কখনও কখনও তার সাথীর বিরুদ্ধে এমন অন্যায়-অপরাধে জড়িয়ে পড়ে, যেখানে সে ভ্রাতৃত্ব বা বন্ধুত্ব বা অন্য কোনো সম্পর্কের তোয়াক্কা করে না; কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলাকে ভয় করে না, সে ব্যক্তি কোনো অবস্থাতেই অন্যকে ভয় করে না। ৪. তাকে কুসংস্কার ও বিদ‘আত থেকে দূরে থেকে কুরআন ও সুন্নাহ’র অনুসারী হতে হবে; কারণ, কখনও কখনও বিদ‘আতপন্থীর বিদ‘আতের পঙ্কিলতা তার বন্ধুকে পেয়ে বসতে পারে; কেননা, বিদ‘আতপন্থী ও আত্মপূজারীকে বর্জন করা ও তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা আবশ্যক; সুতরাং কিভাবে তাদের সাথে আন্তরিকতা ও বন্ধুত্ব স্থাপন করা সম্ভব হবে, অথচ কোনো এক সৎব্যক্তি বন্ধু বা সাথী নির্বাচনে সংক্ষেপে এ আদবগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন, তিনি তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেন: হে আমার আদরের ছেলে! যখন কোনো ব্যক্তিকে তোমার বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, তখন তুমি এমন ব্যক্তিকে বন্ধু বা সাথী হিসেবে গ্রহণ করবে— যখন তুমি তার খিদমত করবে, তখন সে তোমাকে রক্ষণাবেক্ষণ করবে; যদি তুমি তাকে সঙ্গ দাও, তবে সে তোমাকে সুন্দর করবে; যদি তোমার কোনো খাদ্যসংকট দেখা দেয়, তাহলে সে তোমাকে তা সরবরাহ করবে। তুমি তাকেই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে— যখন তুমি কোনো কল্যাণে তোমার হাত বাড়াবে, তখন সেও তার হাত বাড়াবে; আর যদি সে তোমার পক্ষ থেকে ভালো কিছু দেখে, তাহলে তা ভালো বলে গণ্য করে; আর মন্দ কিছু দেখলে তা থেকে বাধা প্রদান করে। আর তুমি তাকেই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে— যখন তুমি তার নিকট চাইবে, তখন সে তোমাকে দিবে; আর তুমি চুপ করে থাকলে, সে তোমার সাথে কথার সূচনা করবে; আর যদি তুমি কোনো দুর্ঘটনার শিকার হও, তাহলে সে তোমাকে সান্ত্বনা দিবে। আর তুমি তাকেই বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করবে— যখন তুমি তার সাথে কথা বলবে, তখন সে তোমার কথাকে সত্য বলে জানবে; আর তোমরা পরস্পর কোনো কাজের উদ্যোগ নিলে সে তোমাকে দায়িত্ব প্রদান করে; আর যদি তোমরা পরস্পর কোনো বিষয়ে মতবিরোধ কর, তাহলে সে তোমাকে অগ্রাধিকার দেয়।[7]

>
[1] আবূ দাউদ, হাদিস নং- ৪৬৮৩

[2] আহমাদ, ত্ববারনী ও হাকেম এবং তিনি হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।

[3] নাসায়ী, আস-সুনান আল-কুবরা এবং হাদিসটি সহীহ।

[4] আহমাদ ও হাকেম এবং তিনি হাদিসটিকে সহীহ বলেছেন।

[5] বুখারী, হাদিস নং- ৬৪২১; মুসলিম, হাদিস নং- ২৪২৭

[6] ইমাম মুসলিম রহ. হাদিসটি এর চেয়ে সংক্ষিপ্ত শব্দে বর্ণনা করেছেন (হাদিস নং- ৬৭১৪)। আর এখানে যেসব শব্দে বর্ণনাটি বিদ্যমান, তা ইমাম আল-গাযালী রহ. তাঁর ‘এহইয়াউ ‘উলুমিদ দীন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আর যাইনুল ‘ইরাকী বলেছেন: " رواه مسلم "(হাদিসটি মুসলিম রহ. বর্ণনা করেছেন) এবং তিনি এ কথার ঈঙ্গিত করেননি যে, “শব্দগুলো ইমাম মুসলিম রহ. এর শব্দ নয়, যা তিনি তাঁর ‘আস-সহীহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন”। আল-এহইয়াউ ( الإحياء ): ২ / ১৫৭, আল-হাবলী সংস্করণ, ১৩৫৮ হি.

[7] উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১৫৭

এ ধরনের ভাইদের অধিকারসমূহের কিছু দিক নিম্নে তুলে ধরা হলো:

১. অর্থ-সম্পদ দিয়ে সাহায্য সহযোগিতা করা; সুতরাং প্রয়োজনের সময় তাদের প্রত্যেকেই তার ভাইকে তার অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করবে, এমনিভাবে যে, মনে করবে তাদের উভয়ের দিনার ও দিরহাম এক ও অভিন্ন। যেমন আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তাঁর নিকট এক ব্যক্তি এসে বলল:

« إنى أريد أن أؤاخيك فى الله . قال : أتدرى ما حق الإخاء ؟ قال : عرِّفنى . قال : لا تكون أحق بدينارك ودرهمك منّى . قال : لم أبلغ هذه المنزلة بعد . قال : فاذهب عنى » .

“আমি তোমাকে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে দীনী ভাই হিসেবে গ্রহণ করতে চাই; তখন তিনি বললেন: তুমি কি জান ভ্রাতৃত্বের ‘হক’ কি? তখন সে বলল: আমাকে জানিয়ে দাও। তখন তিনি বললেন: তোমার দিনার ও দিরহামের উপর তোমার অধিকার আমার চেয়ে বেশি হতে পারবে না। তখন সে বলল: পরে আমি এ মানে পৌঁছতে পারলাম না। তখন তিনি বললেন: তাহলে তুমি আমার থেকে দূর হও।”[1]

২. তাদের প্রত্যেকেই প্রয়োজন পূরণের সময় একে অপরের সহযোগী হবে এবং নিজের উপর তার সাথীর প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিবে; তার প্রয়োজনকে নিজের প্রয়োজনের মত করে দেখবে, তার নিজের উপর এবং তার পরিবার ও সন্তানাদির উপর তাকে প্রাধান্য দিবে; প্রতি তিন দিন পর তার খোঁজ-খবর নিবে, তারপর সে অসুস্থ হলে তার সেবা করবে, কর্মে ব্যস্ত হলে তাকে সহযোগিতা করবে, কোনো কিছু ভুলে গেলে তাকে তা স্মরণ করিয়ে দিবে, কাছে আসলে তাকে অভিবাদন জানাবে, যখন সে বসবে তখন তার জন্য জায়গা প্রশস্ত করে দিবে এবং যখন সে কথা বলবে, তখন মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনবে।

৩. তার শুধু ভালো দিকগুলোই বলবে; সুতরাং তার উপস্থিতিতে অথবা অনুপস্থিতিতে তার কোনো দোষ নিয়ে আলোচনা করবে না এবং তার কোনো গোপন বিষয় জনসম্মুখে প্রকাশ করবে না; আর তার ব্যক্তিগত গোপন বিষয়সমূহের দিকে তাকানোর চেষ্টা করবে না; আর যখন সে পথিমধ্যে তাকে তার কোনো ব্যক্তিগত প্রয়োজনে দেখতে পাবে, তখন সে যেন তার সাথে প্রথমে সে প্রয়োজন সম্পর্কে কথা বলা শুরু না করে এবং তার উৎস বা উৎপত্তিস্থল সম্পর্কে জানার চেষ্টা না করে। তাকে ভালো কাজের আদেশ অথবা মন্দ কাজে নিষেধ করার ব্যাপারে সহৃদয়তার পরিচয় দিবে; কথা বলার সময় তার সাথে তর্ক করবে না এবং কোনো ‘হক’ বা ‘বাতিল’ বিষয় নিয়ে তার সাথে ঝগড়া করবে না। কোনো বিষয়ে তাকে তিরস্কার করবে না এবং অপর কোনো বিষয়ে তাকে নিন্দা করবে না।

৪. তার সাথে তার পছন্দসই ভাষায় কথা বলা; সুতরাং সে তাকে তার সবচেয়ে প্রিয় নামে ডাকবে এবং উপস্থিতিতে ও অনুপস্থিতিতে তার ভালো দিকগুলো আলোচনা করবে, তাকে করা জনগণের প্রশংসা তার নিকট আনন্দ চিত্তে ও খুশি মনে পৌঁছিয়ে দিবে। তাকে অনর্গল উপদেশ দিবে না; কারণ, তাতে সে বিরক্তবোধ করতে পারে; আর তাকে জনসম্মুখে উপদেশ দিবে না, ফলে তা তার সম্মান নষ্ট করবে; যেমনটি ইমাম শাফে‘য়ী রহ. বলেছেন:

« مَنْ وَعَظَ أَخَاهُ سِرًّا فَقَدْ نَصَحَهُ وَزَانَهُ ، وَمَنْ وَعَظَهُ عَلَانِيَةً فَقَدْ فَضَحَهُ وَشَانَهُ » .

“যে ব্যক্তি তার ভাইকে গোপনে উপদেশ দিল, সে ব্যক্তি সত্যিই তাকে উপদেশ দিল এবং তার সাথে সুন্দর ব্যবহার করল; আর যে ব্যক্তি তাকে প্রকাশ্যে উপদেশ দিল, সে ব্যক্তি তার সম্মান নষ্ট করল এবং তাকে অসম্মান করল।”[2]

৫. তার ভুলকে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখা, তার অপরাধসমূহ উপেক্ষা করা, তার দোষ-ত্রুটিগুলো গোপন করে রাখা এবং তার ব্যাপারে ভালো ধারণা পোষণ করা। আর যদি সে গোপনে বা প্রকাশ্যে কোনো অপরাধে জড়িয়ে যায়, তাহলে তার ভালোবাসাকে ছিন্ন করবে না এবং তার বন্ধুত্বকে অবহেলা করবে না, বরং তার তাওবা ও ক্ষমা প্রার্থনার অপেক্ষা করবে; আর যদি সে বারবার অপরাধ করতে থাকে, তাহলে তার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে অথবা বন্ধুত্ব বহাল রাখবে উপদেশ চালিয়ে যাওয়ার শর্তে এ আশায় যে, সে তাওবা করবে এবং আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন। আবূ দারদা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন:

« إذَا تَغَيَّرَ أَخُوك وحَالَ عمَّا كَانَ عَليهِ فَلَا تَدَعْهُ لأجلِ ذلكَ ، فَإِنَّ أَخَاك يَعْوَجُّ مَرَّةً وَيَسْتَقِيمُ أخرى » .

“যখন তোমার ভাই বিকৃত হয়ে যায় এবং যে সম্পর্কের উপর সে বিদ্যমান ছিল তা থেকে সরে যায়, তখন এ করণে তুমি তাকে ছেড়ে দিয়ো না; কারণ, তোমার ভাই একবার বাঁকা হবে এবং আরেক বার সোজা হবে।”[3]

৬. তার ভ্রাতৃত্বের হক পূরণ করা; সুতরাং সে ভ্রতৃত্বের সম্পর্ককে প্রতিষ্ঠিত রাখবে এবং বন্ধুত্বের সম্পর্ককে স্থায়ী করবে; কেননা, এ সম্পর্ক ছিন্ন করলে তার জন্য বরাদ্দকৃত প্রতিদান নষ্ট হয়ে যাবে। আর সে মারা গেলে ভ্রাতৃত্বের সংরক্ষণ ও বন্ধুত্বের দাবি পূরণার্থে ভালোবাসা ও আন্তরিকতা তার সন্তান ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বন্ধু-বান্ধগণের প্রতি স্থানান্তর হবে। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিকট আগত এক বৃদ্ধাকে সম্মান প্রদর্শন করলেন; তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন:

« إنَهَا كَانَتْ تَأتينَا أيّامَ خَدِيجَة ، وإنَّ كَرَمَ الْعَهدِ من الدينِ » . (رواه الحاكم).

“খাদিজা রা. জীবিত থাকাকালীন সময়ে সে আমাদের নিকট আসত; আর বন্ধুত্বের মর্যাদা দান করাটা দীনের অন্তর্ভুক্ত।”[4] আর বন্ধুত্বের দাবি পূরণের অন্যতম একটি দিক হলো তার বন্ধুর শত্রুকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ না করা; কেননা, ইমাম শাফে‘য়ী রহ. বলেন:

« إذا أطاع صديقك عدوك ، فقد اشتركا في عدواتك » .

“যখন তোমার বন্ধু তোমার শত্রুর অনুসরণ করে, তখন বুঝতে হবে তারা উভয়ে তোমার সাথে শত্রুতার ব্যাপারে একজোট।”[5]

৭. তার উপর কষ্টকর কিছু চাপিয়ে না দেওয়া এবং তার উপর এমন কোনো বোঝা চাপিয়ে না দেওয়া, যা পালনে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না; সুতরাং সে তার থেকে সম্মান বা সম্পদ আদায় করার চেষ্টা করবে না, অথবা কোনো কাজ বাস্তবায়নে তাকে বাধ্য করার চেষ্টা করবে না; কেননা, ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের মূল উদ্দেশ্যই ছিল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন; সুতরাং এ সম্পর্ককে দুনিয়ার কোনো ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবে না।

৮. তার জন্য ও তার সন্তানদের জন্য দো‘য়া করা; আর যে ব্যক্তি তার সাথে ভালো সম্পর্ক রাখবে, স্বাভাবিকভাবেই সে তার নিজের জন্য, তার সন্তানদের জন্য এবং যে ব্যক্তি তার সাথে সম্পর্ক করেছে তার জন্য দো‘য়া করবে; কেননা, যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে তারা আবদ্ধ হয়েছে, সে ভ্রাতৃত্বের প্রশ্নে তারা একজন অন্যজন থেকে আলাদা কেউ নন; সুতরাং সে তার জন্য দো‘য়া করবে জীবিত ও মৃত অবস্থায় এবং উপস্থিত ও অনুপস্থিত অবস্থায়; রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

« إذا دعا الرجُلُ لأَخِيهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ قال له المَلَكُ : ولك مثلُ ذَلِكَ » . (رواه مسلم و أبو داود).

“কোনো ব্যক্তি যখন তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে তার জন্য দো‘য়া করে, তখন তাকে উদ্দেশ্য করে ফেরেশ্তা বলে: তোমার জন্যও অনুরূপ।”[6] আর সৎব্যক্তিগণের মধ্য থেকে কোনো একজন বলেন: ভালো ভাইয়ের দৃষ্টান্ত কোথায়? নিশ্চিয়ই কোনো ব্যক্তি যখন মারা যায়, তখন তার পরিবারের লোকজন তার মিরাস বণ্টন করে এবং তার রেখে যাওয়া সম্পদ ভোগ করে, আর ভালো ভাইটি এককভাবে তার জন্য চিন্তা করে এই ভেবে যে, তার ভাই কী নিয়ে বিদায় নিয়েছেন এবং কোন্ পরিণতি লাভ করেছেন! ফলে সে তার জন্য রাতের অন্ধকারে দো‘য়া করে এবং তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, অথচ সে মাটির নীচের অধিবাসী।[7]

>
[1] আল-গাযালী, ‘এহইয়াউ ‘উলুমিদ দীন’ , ২য় খণ্ড, পৃ. ১৭৪

[2] আল-গাযালী, ‘এহইয়াউ ‘উলুমিদ দীন’ , ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮২

[3] আল-গাযালী, ‘এহইয়াউ ‘উলুমিদ দীন’ , ২য় খণ্ড, পৃ. ১৮৩

[4] হাদিসটি হাকেম রহ. বর্ণনা করেছেন এবং তিনি তাকে সহীহ বলেছেন।

[5] আল-গাযালী, ‘এহইয়াউ ‘উলুমিদ দীন’ , ৩য় খণ্ড, পৃ. ৮৫

[6] মুসলিম, হাদিস নং- ৭১০৩; আবূ দাউদ, হাদিস নং- ১৫৩৬

[7] উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১৫৯
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ২ পর্যন্ত, সর্বমোট ২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে