নির্দিষ্ট সংখ্যার মাধ্যমে সূরা ইখলাসের খতম প্রচলিত না থাকলেও সূরা ইখলাস তিনবার পড়ার মাধ্যমে কুরআন খতমের প্রচলন রয়েছে। তিনবার সূরা ইখলাস পাঠ করলে পূর্ণ এক খতম কুরআন তেলাওয়াতের ছওয়াব পাওয়া যায় বলে অনেকের ধারণা। তাই অনেক সময় কুরআন খতম করতে অপারগ হলে তিনবার এই সূরা পাঠ করা হয়। বলা হয় হাদীসে রয়েছে, তিনবার সূরা ইখলাস পাঠ করলে এক খতম কুরআনের ছওয়াব পাওয়া যায়। অথচ এমন কোনো কথা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয় নি। রাসূলের হাদীসের সাথে যুক্তির মিশ্রণ ঘটিয়ে এমন কথা বলা হয়। আর অনেক ক্ষেত্রে এভাবেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথার মর্ম পরিবর্তন হয়ে শরীয়তের বিকৃতি ঘটেছে।

কুরআন আল্লাহর পবিত্র কালাম। তার প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি আয়াত, প্রতিটি সূরা বরকতময় ও মর্যাদাপূর্ণ। আল্লাহর কালাম হিসেবে মর্যাদার দিক থেকে পুরো কুরআন এক সমান। তবে ভাব বা মর্মের দিক থেকে কোনো কোন আয়াত বা সূরার ফযিলত অন্যটির তুলনায় বেশি বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে জানিয়েছেন। এরকম মর্যাদাপূর্ণ একটি সূরা হচ্ছে সূরা ইখলাস। সুরাটিতে আল্লাহ তাঁর পরিচয় অত্যন্ত অল্প বাক্যের মাধ্যমে পরিপূর্ণভাবে তুলে ধরেছেন। এই সূরার ফযিলতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:

"والذي نفسي بيده إنها لتعدل ثلث القرآن". (صحيح البخاري، كتاب التفسير، باب فضل قل هو الله أحد، رقم:4726)

‘‘ঐ সত্তার কসম যার হাতে আমার প্রাণ নিশ্চয় এটি (ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের বরাবর।’’[1]

আরেকটি হাদীসে রয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন:

« أيعجز أحدكم أن يقرأ فى ليلة ثلث القرآن ». قالوا وكيف يقرأ ثلث القرآن قال « (قل هو الله أحد) يعدل ثلث القرآن». (صحيح مسلم، كتاب التفسير، باب فضل قراءة قل هو الله أحد، رقم:1922)

‘‘তোমাদের কেউ কি প্রতি রাতে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ পড়তে অক্ষম? সাহাবিরা বললেন, এক তৃতীয়াংশ কীভাবে পড়বে? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,

(قل هو الله أحد)

এক তৃতীয়াংশের সমান।’’[2]

এবার দেখুন, এই হাদীসের অর্থটিকে কীভাবে পরিবর্তন করে তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে সম্পৃক্ত করা হয়েছে, যার কোনো বিবরণ সহীহে হাদীসে নেই। এক তৃতীয়াংশের সমান হওয়া এবং তিনবার পড়লে পূর্ণ কুরআন পড়ার ছওয়াব পাওয়া কি এক? উলামায়ে কেরাম এই হাদীসের মর্ম বর্ণনা করেন যে, কুরআনের বিষয়বস্তু মূলত তিনটি: আহকাম বা জীবন বিধান, আখবার বা সংবাদসমূহ, তাওহীদ তথা আল্লাহর একত্ববাদের বিবরণ। সূরা ইখলাসে তাওহীদের আলোচনা বা আল্লাহর একত্ববাদকে সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একে এক তৃতীয়াংশ বলেছেন।[3]

একেই কেউ কেউ এভাবে বলেন যে, কুরআনের অর্থ তিন ভাগে বিভক্ত। ঘটনাবলী, আহকাম, আল্লাহর গুণাবলী। সূরা ইখলাসটি আল্লাহর গুণাবলীতে বিশেষিত।[4] এভাবেও বলা যায় যে, পুরো কুরআনের আলোচনা তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাত নিয়ে। যে কোনো বিষয় এ তিনটির কোনোটির সাথে সম্পৃক্ত। আর সূরা ইখলাসে তাওহীদের আলোচনা অত্যন্ত নিপুণভাবে করা হয়েছে, তাই এ সূরাকে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ বলা হয়েছে।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি হাদীস থেকেও এ অর্থেই এক তৃতীয়াংশ বলার কথাটি স্পষ্ট হয়ে যায়।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:

« إن الله جزأ القرآن ثلاثة أجزاء فجعل قل هو الله أحد جزءا من أجزاء القرآن ». ( صحيح مسلم، المرجع السابق، رقم: 1923)

‘‘আল্লাহ তা‘আলা কুরআনকে তিন অংশে বিভক্ত করেছেন। “قل هو الله أحد” (সূরা ইখলাস) কে কুরআনের তিন অংশের এক অংশ সাব্যস্ত করেছেন।’’[5]

এই হাদীস থেকে উপরোক্ত মর্মটি আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। তবে কেউ কেউ এক তৃতীয়াংশের সমতুল্য বলতে এক তৃতীয়াংশ পড়লে যে ছওয়াব হয় সূরা ইখলাস তেলাওয়াত করলে এই পরিমাণ ছওয়াব হয় বলে বলেছেন। কিন্তু এই মর্মটির কোনো দলীল নেই। বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল বারী’তে লিখেন:

" ومنهم من حمل المثلية على تحصيل الثواب فقال معنى كونها ثلث القرآن أن ثواب قراءتها يحصل للقارئ مثل ثواب من قرأ ثلث القرآن وقيل مثله بغير تضعيف وهي دعوى بغير دليل ". ( فتح الباري، كتاب التفسير، باب فضل قل هو الله أحد،9-60)

‘‘আলেমগণের মধ্যে কেউ সমতুল্য অর্থটি ছওয়াব অর্জনের ক্ষেত্রে নেন এবং বলেন, এক তৃতীয়াংশ হওয়ার অর্থ এই সুরাটি পড়ার ছওয়াব পাঠকের জন্য ঐ ব্যক্তির সমান হবে যে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়েছে। এটাও বলা হয়ে থাকে, অতিরিক্ত ছওয়াব ব্যতিরেকে[6]মূল ছওয়াবের এক তৃতীয়াংশের সমান। তবে এই দাবীর সপক্ষে কোনো দলীল নেই।’’[7]

এখানে লক্ষণীয় যে, একবার সূরা ইখলাস তেলাওয়াত করলে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ পড়ার ছওয়াব পাওয়ার ব্যাপারে কোনো সহীহ হাদীস নেই। একটি হাদীস থেকে এই মর্ম নেয়ার সামান্য সম্ভাবনা ছিল মাত্র, তবে মুসলিম শরীফের হাদীসের মাধ্যমে এই সম্ভাবনাটির অবকাশ দূর হয়ে গেছে। তথাপি দূরবর্তী সম্ভাবনা অনুযায়ী আমরা যদি মেনে নেই যে, একবার সূরা ইখলাস তেলাওয়াত করলে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ পরিমাণ পড়ার ছওয়াব পাওয়া যায় তবে একথা অত্যন্ত স্পষ্ট যে, তিনবার সুরাটি তেলাওয়াত করলে এক তৃতীয়াংশ তিনবার পড়ার ছওয়াব পাওয়া যাবে। পূরো কুরআন একবার পড়ার ছওয়াব পাওয়া যাবে বলে কোনো ইঙ্গিত হাদীসে নেই। বিষয়টি সহজে বোঝার জন্য মনে করুন, আপনার একটি কাজ আছে। যে কাজের তিনটি অংশ রয়েছে। এই কাজটি পূর্ণ করার উপর আপনার ১০০ টাকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রয়েছে। তবে একটি অংশ করলে ২০ টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। এখন কেউ যদি একটি অংশ তিনবার করে এবং এমনটি করার সুযোগ থাকে তবে আপনার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক সে ৬০ টাকা পাওয়ার কথা। এখন যদি সে দাবী করে যে, মোট অংশ তিনটি, আমি একটি অংশ তিনবার করেছি, সুতরাং আমি কাজটি পূর্ণ করেছি, তাই যুক্তির দাবী হলো আমাকে ১০০ টাকা দেওয়া হোক, এখানে আপনি তার এই যুক্তিকে কীভাবে দেখবেন? ঠিক তদ্রূপ একবার সূরা ইখলাস তেলাওয়াত করলে এক তৃতীয়াংশের ছওয়াব মেনে নিলেও একবার পড়লে এক খতম কুরআনের ছওয়াব পাওয়া যাবে এমন কথা যেমন নির্ভরযোগ্য হাদীস বহির্ভূত, তেমন যুক্তি বহির্ভূত। কোনো ইবাদত বা তার ছওয়াবের ক্ষেত্রে যুক্তি দিয়ে কিছু বলার সুযোগ নেই, তথাপি অনেক দূরবর্তী একটি যুক্তির আলোকে আমাদের মাঝে সূরা ইখলাস তিনবার পড়ে কুরআন খতমের ছওয়াব অর্জনের কথা ও আমল অত্যন্ত ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও প্রচলিত। এমনকি অনেকে পুরো কুরআন পড়ার পর তিনবার সূরা ইখলাস পড়েন যাতে করে ভুলভ্রান্তি কিছু হলে এর মাধ্যমে তার ঘাটতি পূর্ণ হয়ে যায়, তারাবীর সালাতে অনেকে এই সূরা তিনবার পড়ে ঘাটতি পূর্ণ করেন, অথচ শরীয়তে এ সবের কোনো ভিত্তি নেই। সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হলো, অন্যের জন্য খতম পড়তে গিয়ে ঘটনাক্রমে পড়া শেষ না হলে এই সূরা তিনবার পড়ে বেঁচে যাওয়ার বাহানা তালাশ করা হয়। খতমের আয়োজকের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার জন্য এই সূরা তিনবার পড়ে নিলেই কাম সারে। এভাবে বিভিন্ন সুন্নাহ বিরোধী কর্মের অনুপ্রবেশ ঘটে।

কেউ বলতে পারেন সূরা ইখলাসের বর্ণিত ফযিলতের ব্যাপারে হাদীস রয়েছে, যেমন একটি হাদীসে এসেছে:

"من قرأ ( قل هو الله أحد ( ثلاث مرات فكأنما قرأ القرآن أجمع".

‘‘যে ব্যক্তি قل هو الله أحد তিনবার পড়ল সে যেন পুরো কুরআন পাঠ করল।’’[8]এ হাদীসটি অনির্ভরযোগ্য। এর কোনো নির্ভরযোগ্য সনদ নেই।[9] এ হাদীস ছাড়াও উক্ত সূরা সংক্রান্ত নির্দিষ্ট সংখ্যা ও বিশাল ফযিলতের কথা সহ আরো কিছু হাদীস রয়েছে যার নির্ভরযোগ্য কোনো সনদ বা ভিত্তি নেই। হাদীসের সাথে যাদের গভীর সম্পর্ক রয়েছে তারা জানেন যে, অন্যের কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে নিসবত বা সম্পৃক্তের একটি দিক হচ্ছে, অনেক সময় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের বিভিন্ন মর্ম বা ব্যাখ্যা মানুষ তাদের জ্ঞান বা মেধা থেকে বর্ণনা করে থাকেন। পরবর্তীতে ব্যাখ্যাকারী নিজে অথবা অন্য কেউ উক্ত ব্যাখ্যা বা মর্মকেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে সম্পৃক্ত করে হাদীস বলে চালিয়ে দিয়েছেন। অনেক জাল হাদীসের অনুপ্রবেশ এভাবেই ঘটেছে। আল্লামা সুয়ুতী মনে করেন জাল হাদীসের এই প্রকারটি সর্বাধিক।[10] নির্ভরযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য কোনো সনদ না থাকায় বর্ণিত হাদীসটিও এই ধরণের বলে সহজেই অনুমেয়। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন এবং সহীহ সুন্নাহ মোতাবেক আমাদের জীবন পরিচালনার তওফীক দান করুন। আমীন।

[1] সহীহুল বুখারী, তাফসীর অধ্যায়, “قل هو الله أحد” এর ফযিলত পরিচ্ছেদ, নং: ৪৭২৬। উল্লেখ্য বুখারীর আরো একাধিক জায়গায় হাদীসটি রয়েছে।

[2] সহীহ মুসলিম, কুরআন ফযিলত সমূহ অধ্যায়, “قل هو الله أحد” পড়ার ফযিলত পরিচ্ছেদ, নং: ১৯২২,

সহীহুল বুখারী, তাফসীর অধ্যায়, “قل هو الله أحد” এর ফযিলত পরিচ্ছেদ, নং: ৪৭২৭। উল্লেখ্য বুখারীর বর্ণনাটি সামান্য ভিন্ন। বর্ণনাটি এইরূপ,

" أيعجز أحدكم أن يقرأ ثلث القرآن في ليلة فشق ذلك عليهم وقالوا أينا يطيق ذلك يا رسول الله ؟ فقال: الله الواحد الصمد ثلث القرآن ".

[3] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী, প্রাগুক্ত অধ্যায়, ৯/৫৯।

[4] ইমাম নাওয়াওয়ী, মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থ, প্রাগুক্ত অধ্যায়।

[5] সহীহ মুসলিম, প্রাগুক্ত, নং: ১৯২৩।

[6] একথার মর্ম হল: যে কোনো নেক আমলের একটি মূল নেকী রয়েছে, তবে আল্লাহ তা‘আলা তার দয়ায় এই নেকী কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেন বলে কুরআন ও হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি। এই হিসেবে পূর্ণ কুরআন একবার তেলাওয়াত করলে তার মূল এক ছওয়াব রয়েছে। তেলাওয়াতের মাঝে ইখলাস, গভীরতা ইত্যাদি অনুযায়ী ব্যক্তি বিশেষে আল্লাহ তা অনেকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারেন। একবার সূরা ইখলাস পড়লে এক তৃতীয়াংশের মূল ছওয়াব পাওয়া যাবে। অতিরিক্তটুকু নয়।

[7] ফাতহুল বারী, প্রাগুক্ত অধ্যায়, ৯/৬০।

[8] আল্লামা জালাল উদ্দীন সুয়ূতী, (৮৪৯-৯১১ হিজরী, ১৪৪৫-১৫০৫ ঈসায়ী) জাম‘উল জাওয়ামি‘‘য়, মিম হরফের হাদীস, নং ৬২০১, আলাউদ্দীন আলী ইবন হুসামুদ্দীন আল-মুত্তাক্বী, (৮৮৮-৯৭৫ হিজরী, ১৪৮৩-১৫৬৭ ঈসায়ী) কানযুল উম্মাল,১/৫৯৮।

[9] নুরুদ্দীন আলী ইবনু আবু বাকর আল-হাইসামী, মাজমা‘উয্যাওয়ায়িদ, সূরা “قل هو الله أحد” এবং এবিষয়ে যা বর্ণিত হয়েছে, নং:১১৫৪০, আলবানী, সিলসিলাতুল আহাদীসিদ্দা‘য়ীফাহ, ১০/১৩৬, নং: ৪৬৩৪।

[10] সুয়ূতী, তাদরীবুর-রাবী, জালিয়াতের প্রকার, ১/২৮৭।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে