মানসূখ সংক্রান্ত বর্ণনা : হাদীছ জাল করার এক অভিনব কৌশল

মানসূখ সংক্রান্ত বর্ণনা : হাদীছ জাল করার এক অভিনব কৌশল

অবশেষে যখন রাফ‘উল ইয়াদায়েনকে প্রতিরোধ করার আর কোন পথ পাওয়া যায়নি তখন বলা হয়েছে যে, রাফ‘উল ইয়াদায়েনের হাদীছগুলো মানসূখ বা হুকুম রহিত হয়ে গেছে। অথচ উক্ত দাবীর পক্ষে যে সমস্ত বর্ণনা পেশ করা হয় তা ডাহা মিথ্যা, বানোয়াট ও কাল্পনিক।

(১৮) أَنَّ عَبْدَ اللهِ بْنِ الزُّبَيْرِ رَاىَ رَجُلًا يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِى الصَّلَاةِ عِنْدَ الرُّكُوْعِ وَعِنْدَ رَفْعِ رَأْسِهِ مِنَ الرُّكُوْعِ فَقَالَ لَا تَفْعَلْ فَإنَّ هَذَا شَيْىٌ فَعَلَهُ رَسُوْلُ اللهِ ثُمَّ تَرَكَهُ.

(১৮) একদা আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রাঃ) এক ব্যক্তিকে দেখলেন, ছালাতে রুকূতে যাওয়ার সময় ও রুকূ হতে উঠার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করছে। তিনি তখন বললেন, তুমি এটা কর না। কারণ এগুলো সবই রাসূল (ছাঃ) করেছেন, তবে পরবর্তীতে বাদ দিয়েছেন।[1]

তাহক্বীক্ব : উক্ত বর্ণনা মিথ্যা ও বাতিল। রাফ‘উল ইয়াদায়েনের প্রসিদ্ধ আমলকে প্রতিরোধ করার জন্য উক্ত মিথ্যা বর্ণনা রচনা করা হয়েছে। কারণ উক্ত বর্ণনা কোন হাদীছ গ্রন্থে পাওয়া যায় না। যেমন মুওয়াত্ত্বা মুহাম্মাদের ভাষ্যকার বলেন,

لَكِنَّ هَذَا الْأَثَرَ لَمْ يَجِدْهُ الْمُخَرِّجُوْنَ الْمُحَدِّثُوْنَ مُسْنَدًا فِىْ كُتُبِ الْحَدِيْثِ مَعَ أَنَّهُ أَخْرَجَ الْبُخَارِىٌّ فِىْ رِسَالَةِ رَفْعِ الْيَدَيْنِ عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ الزُّبَيْرِ أَنَّهُ كاَنَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ عِنْدَ الْخَفْضِ وَالرَّفْعِ.

‘কিন্তু এই আছারের সন্ধান কোন মুহাদ্দিছ কোন হাদীছ গ্রন্থে পাননি। বরং ইমাম বুখারী তার ‘জুযউ রাফ‘উল ইয়াদায়েন’ গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর (রাঃ) রুকূতে যাওয়া ও রুকূ থেকে উঠার সময় রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন।[2]

অথচ ‘হেদায়া’ কিতাবে বলা হয়েছে, وَاَلَّذِىْ يُرْوَى مِنْ الرَّفْعِ مَحْمُوْلٌ عَلَى الِابْتِدَاءِ كَذَا نُقِلَ عَنِ ابْنِ الزُّبَيْرِ ‘রাফ‘উল ইয়াদায়েন সম্পর্কে যা বর্ণিত হয়েছে, তা মূলতঃ ইসলামের প্রথম যুগের বিষয়। যেমন ইবনু যুবাইর (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে’।[3] সেই সাথে হেদায়ার টীকাকার হাশিয়ার মধ্যে ইবনু যুবাইরের বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।[4] তাছাড়া বাংলায় অনুবাদ করতে গিয়ে অনুবাদকমন্ডলী টীকায় উক্ত বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।[5] অথচ তার যে কোন ভিত্তি নেই সে বিষয়টি লক্ষ্য করেননি। এই মিথ্যাচার সম্পর্কে অনুবাদকমন্ডলীকে জিজ্ঞেস করলে তারা কী জবাব দিবেন?

আরো আফসোসের বিষয় হল, ইমাম বুখারী ছহীহ বুখারীতে রাফ‘উল ইয়াদায়েনের পাঁচটি হাদীছ পেশ করেছেন। সেই হাদীছগুলোকে রদ করার জন্য তার টীকায় ভাষ্যকার আহমাদ আলী সাহারাণপুরী উক্ত মিথ্যা বর্ণনা উল্লেখ করেছেন।[6] অনুরূপভাবে আধুনিক প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত সহীহ আল-বুখারীতে রাফঊল ইয়াদায়েনের হাদীছগুলোকে যবাই করার জন্য উক্ত বানোয়াট বর্ণনা পেশ করা হয়েছে এবং এই অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাতকে বাতিল আখ্যা দেয়া হয়েছে।[7] অনুবাদকমন্ডলী এবং প্রকাশক বিচারের মাঠে আল্লাহর সামনে কী জবাব দিবেন?

সুধী পাঠক! এটাই হল ফেক্বহী গ্রন্থের আসল চেহারা। মাযহাবকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য হাদীছের উপর এভাবেই আক্রমণ করা হয়েছে। অন্যদিকে আব্দুল্লাহ বিন যুবাইর (রাঃ)-এর উপর মিথ্যাচার করা হয়েছে। কারণ তিনি যে নিজেই রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন তার প্রমাণে ইমাম বুখারী ছহীহ হাদীছ বর্ণনা করেছেন।

عَنْ عَطَاءٍ قَالَ رَأَيْتُ أَبَا سَعِيْدٍ الْخُدْرِيَّ وَابْنَ عُمَرَ وَابْنَ عَبَّاسٍ وَابْنَ الزُّبَيْرِ يَرْفَعُوْنَ أَيْدِيَهُمْ.

আত্বা (রাঃ) বলেন, আমি আবু সাঈদ খুদরী, ইবনু ওমর, ইবনু আব্বাস ও ইবনু যুবাইর (রাঃ)-কে দেখেছি, তারা সকলেই ছালাতে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন।[8]

অতএব পাঠক সমাজকে ছহীহ দলীলের দিকে ফিরে আসতে হবে। বানোয়াট বর্ণনা ও প্রতারণা থেকে সাবধান থাকতে হবে। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন- আমীন!

(19) عَنِ ابْن عَبَّاس قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ يَرْفَعُ يَدَيْهِ كُلّمَا رَكَعَ وَكُلَّمَا رَفَعَ ثمَّ صَارَ إِلَى افْتِتَاح الصَّلَاة وَتَرَكَ مَا سِوَى ذَلِك.

(১৯) ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) যখন রুকূ করতেন এবং রুকূ থেকে উঠতেন, তখন দুই হাত উত্তোলন করতেন। পরে তিনি শুধু ছালাত শুরু করার সময় করতেন। আর অন্যান্য স্থানে ছেড়ে দিতেন।[9]

তাহক্বীক্ব : বর্ণনাটি জাল ও বানোয়াট। ইবনুল জাওযী বলেন, هَذَانَ الْحَدِيْثَانِ لاَ يَعْرِفَانِ أَصْلاً وَإِنَّمَا الْمَحْفُوْظُ عَنْهُمَا خِلاَفُ ذَلِكَ (ইবনু আব্বাস ও যুবাইর-এর নামে বর্ণিত) ‘এই দুই হাদীছের কোন ভিত্তি নেই। বরং তাদের থেকে এর বিরোধী যা বর্ণিত হয়েছে, তা-ই ছহীহ’। ড. তাক্বিউদ্দ্বীন বলেন, لَكِنَّهُ أَثَرٌ لَمْ يَثْبُتْهُ الْمُحَدِّثُوْنَ وَالثَّابِتُ عَنْدَهُمْ خِلاَفُهُ ‘বরং এটি এমন আছার, মুহাদ্দিছগণই যার সন্ধান পাননি। বরং তাঁদের নিকট থেকে এর বিরোধী বর্ণনাই প্রমাণিত’।[10]

সুধী পাঠক! রাসূল (ছাঃ) যদি পরবর্তীতে উক্ত আমল ছেড়ে দেন, তাহলে ইবনু আব্বাস (রাঃ) নিজে কেন রাফ‘উল ইয়াদায়েন করবেন? মূলতঃ উক্ত বর্ণনাটি পেশ করে তার নামে মিথ্যাচার করা হয়েছে। কারণ ছহীহ হাদীছে এসেছে,

عَنْ أَبِىْ حَمْزَةَ مَوْلَى بَنِىْ أَسَدٍ قَالَ رَأَيْتُ ابْنَ عَبَّاسٍ يَرْفَعُ يَدَيْهِ إِذَا افْتَتَحَ الصَّلاَةَ وَإِذَا رَكَعَ وَإِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ مِنَ الرُّكُوْعِ.

বনী আসাদের গোলাম আবু হামযাহ বলেন, আমি ইবনু আব্বাস (রাঃ)-কে দেখেছি, তিনি যখন ছালাত শুরু করতেন, যখন রুকূ করতেন এবং যখন রুকূ থেকে মাথা উঠাতেন তখন রাফ‘উল ইয়াদায়েন করতেন।[11]

(20) عَنِ ابْنِ مَسْعُوْدٍ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ أَنَّهُ قَالَ رَفَعَ رَسُوْلُ اللهِ فَرَفَعْنَا وَتَرَكَ فَتَرَكْنَا.

(২০) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) হাত উত্তোলন করতেন আমরাও করতাম। তিনি ছেড়ে দিয়েছেন আমরাও ছেড়ে দিয়েছি।[12]

তাহক্বীক্ব : উক্ত বর্ণনা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। আলাউদ্দ্বীন আল-কাসানী উক্ত বানোয়াট বর্ণনা পেশ করে রাফ‘উল ইয়াদায়েনের সুন্নাতকে মানসূখ সাব্যস্ত করতে চেয়েছেন।[13] একজন জলীলুল ক্বদও ছাহাবীর নামে উক্ত বর্ণনা পেশ করার পূর্বে যাচাই করার দরকার ছিল। এ সমস্ত মাযহাবী গোঁড়ামী অত্যন্ত দুঃখজনক।

জ্ঞাতব্য : রাফ‘উল ইয়াদায়েনের সুন্নাতকে রহিত করার জন্য আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর, আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কয়েকজন ছাহাবীর নামে উক্ত হাদীছগুলো জাল করা হয়েছে। যাতে করে সহজেই সাধারণ মানুষকে উক্ত প্রতারণার জালে আটকানো যায়। বাস্তবতাও তাই। অসংখ্য মুছল্লী এই ধোঁকায় পড়ে গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত থেকে বঞ্চিত হয়েছে। উক্ত সুন্নাত থেকে মুছল্লীদেরকে বিরত রাখার জন্য গভীর খাল খনন করেছেন ‘দলিলসহ নামাযের মাসায়েল’ বইয়ের লেখক আব্দুল মতিন। তার সামনে ছহীহ হাদীছগুলো প্রকাশিত হওয়ার পরও মানসূখ বলে বাতিল সাব্যস্ত করেছেন এবং জাল ও যঈফ বর্ণনা দ্বারা সুন্নাতের বিরোধিতা করেছেন।[14] এর পরিণাম যে কত ভয়াবহ তা হয়ত তিনি ভুলে গেছেন (সূরা নিসা ১১৫)।

[1]. ছহীহ বুখারী, ১/১০২ পৃঃ টীকা দ্রঃ।

[2]. মুওয়াত্ত্বা মুহাম্মাদ, তাহক্বীক্ব : ড. তাক্বিউদ্দীন নাদভী হা/১০৪-এর ব্যাখ্যা দ্রঃ।

[3]. হেদায়া ১/১১১ পৃঃ।

[4]. হেদায়াহ ১/১১১ পৃঃ, টীকা নং-৬; আল-ইনায়াহ শারহুল হেদায়াহ ২/৪ পৃঃ।

[5]. আল-হিদায়াহ ১ম খন্ড, পৃঃ ৮৬।

[6]. বুখারী (ভারতীয় ছাপা) ১/১০২ পৃঃ, টীকা দ্রঃ।

[7]. সহীহ আল-বুখারী ১ম খন্ড, পৃঃ ৩২১-৩২২।

[8]. মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/২৪৪৫; মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২৫২৫; সনদ ছহীহ, সিলসিলা যঈফাহ হা/৬০৪৪-এর আলোচনা দ্রঃ; বুখারী, রাফ‘উল ইয়াদায়েন হা/১৬ ও ৫৭।

[9]. নাছবুর রাইয়াহ ১/২৯২ পৃঃ; আল-বাদরুল মুনীর ৪/৪৮৪ পৃঃ।

[10]. তাহক্বীক্ব মুওয়াত্ত্বা, পৃঃ ১৭৯; নাছবুর রাইয়াহ ১/২৯২ পৃঃ।

[11]. মুছান্নাফ আব্দুর রাযযাক হা/২৫২৩; মুছান্নাফ ইবনে আবী শায়বাহ হা/২৪৪৬, সনদ ছহীহ, সিলসিলা যঈফাহ হা/৬০৪৪-এর আলোচনা দ্রঃ।

[12]. আলাউদ্দীন আল-কাসানী (মৃঃ ৫৮৭), বাদায়েউছ ছানায়ে‘ ফী তারতীবিশ শারাঈ (বৈরুত : দারুল কিতাব আল-আরাবী, ১৯৮২), ১/২০৮ পৃঃ।

[13]. বাদায়েউছ ছানায়ে‘ ১/২০৮ পৃঃ।

[14]. দলিলসহ নামাযের মাসায়েল, পৃঃ ৭১-৮২।