মূলতঃ সালাত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ রুকন যার মাহাত্ম্য কুরআন ও হাদীসে বিষদভাবে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা কুরআন মাজীদে সালাত প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে বার বার তাগিদ দিয়েছেন। এমনকি তিনি প্রতি বেলা সালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করার ব্যাপারেও পূর্ণ যত্নবান হতে নির্দেশ দিয়েছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿حَٰفِظُواْ عَلَى ٱلصَّلَوَٰتِ وَٱلصَّلَوٰةِ ٱلۡوُسۡطَىٰ وَقُومُواْ لِلَّهِ قَٰنِتِينَ ٢٣٨﴾ [البقرة: ٢٣٨]
“তোমরা সালাতের প্রতি যত্নবান হও বিশেষ করে আসরের সালাতের প্রতি এবং তোমরা কায়মনোবাক্যে আল্লাহ তা‘আলার জন্য দণ্ডায়মান হও”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৩৮]
উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা সালাতের প্রতি যত্নবান হতে আদেশ করেছেন। আর যে ব্যক্তি জামা‘আতের সাথে সালাত আদায় করে না সে সালাতের প্রতি কতটুকু যত্নবান তা সহজেই অনুধাবন করা যায়।
তেমনিভাবে তিনি সালাত আদায়ের প্রতি অবহেলা প্রদর্শনকে মুনাফিকী বলে আখ্যায়িত করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের চরিত্র বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:
﴿إِنَّ ٱلۡمُنَٰفِقِينَ يُخَٰدِعُونَ ٱللَّهَ وَهُوَ خَٰدِعُهُمۡ وَإِذَا قَامُوٓاْ إِلَى ٱلصَّلَوٰةِ قَامُواْ كُسَالَىٰ يُرَآءُونَ ٱلنَّاسَ وَلَا يَذۡكُرُونَ ٱللَّهَ إِلَّا قَلِيلٗا ١٤٢ مُّذَبۡذَبِينَ بَيۡنَ ذَٰلِكَ لَآ إِلَىٰ هَٰٓؤُلَآءِ وَلَآ إِلَىٰ هَٰٓؤُلَآءِۚ وَمَن يُضۡلِلِ ٱللَّهُ فَلَن تَجِدَ لَهُۥ سَبِيلٗا ١٤٣﴾ [النساء: ١٤٢، ١٤٣]
“মুনাফিকরা আল্লাহ তা‘আলাকে ধোকা দেয়। আল্লাহ তা‘আলা উহার প্রতিদান দিবেন। তারা অলস মনে সালাত আদায় করতে দাঁড়ায় লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে। তারা আল্লাহকে কমই স্মরণ করে। তারা সর্বদা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত থাকে। না এদিক না ওদিক। যাকে আল্লাহ তা‘আলা পথভ্রষ্ট করেন আপনি কখনো তাকে সুপথ দেখাতে পারেন না”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১৪২-১৪৩]
দৈনিক পাঁচ বেলা সালাত জামা‘আতে পড়া প্রতিটি সক্ষম ও সাবালক পুরুষের ওপরই ওয়াজিব। চাই সে সফরে থাকুক অথবা নিজ এলাকায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَأَقِيمُواْ ٱلصَّلَوٰةَ وَءَاتُواْ ٱلزَّكَوٰةَ وَٱرۡكَعُواْ مَعَ ٱلرَّٰكِعِينَ ٤٣ ﴾ [البقرة: ٤٣]
“তোমরা সালাত প্রতিষ্ঠা করো, যাকাত আদায় করো এবং রুকুকারীদের সাথে রুকু করো। অর্থাৎ সালাত আদায়কারীদের সাথে সালাত আদায় করো”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৪৩]
উক্ত আয়াত জামা‘আতে সালাত আদায় করা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট। কারণ, আয়াতের শেষাংশ থেকে সালাত প্রতিষ্ঠাই যদি উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তাহলে তা আয়াতের প্রথমাংশের সাথে প্রকাশ্য সামঞ্জস্যহীনই মনে হয়। কেননা, আয়াতের প্রথমাংশে সালাত প্রতিষ্ঠার আদেশ রয়েছে। তাই আয়াতের শেষাংশে তা পুনরুল্লেখের আর কোনো প্রয়োজন থাকে না। তাই বলতে হবে, আয়াতের শেষাংশে জামা‘আতে সালাত আদায়েরই আদেশ দেওয়া হয়েছে।
$ আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿ وَإِذَا كُنتَ فِيهِمۡ فَأَقَمۡتَ لَهُمُ ٱلصَّلَوٰةَ فَلۡتَقُمۡ طَآئِفَةٞ مِّنۡهُم مَّعَكَ وَلۡيَأۡخُذُوٓاْ أَسۡلِحَتَهُمۡۖ فَإِذَا سَجَدُواْ فَلۡيَكُونُواْ مِن وَرَآئِكُمۡ وَلۡتَأۡتِ طَآئِفَةٌ أُخۡرَىٰ لَمۡ يُصَلُّواْ فَلۡيُصَلُّواْ مَعَكَ وَلۡيَأۡخُذُواْ حِذۡرَهُمۡ وَأَسۡلِحَتَهُمۡۗ ﴾ [النساء: ١٠٢]
“যখন আপনি তাদেরকে নিয়ে সালাত আদায় করতে যান তখন তাদের এক দল যেন অস্ত্রসহ আপনার সাথে সালাত আদায় করতে দাঁড়ায়। অতঃপর তারা সাজদাহ সম্পন্ন করে যেন আপনার পেছনে চলে আসে। ইতোমধ্যে দ্বিতীয় দলটি যারা পূর্বে সালাত পড়ে নি আপনার সাথে যেন সালাত পড়ে নেয়। তবে তারা যেন সতর্কতা ও অস্ত্রধারণাবস্থায় থাকে”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ১০২]
উক্ত আয়াতে যুদ্ধাবস্থায় জামা‘আতে সালাত আদায়ের পদ্ধতি শেখানো হচ্ছে। যদি পরিবেশ শান্ত থাকাবস্থায় জামা‘আতে সালাত আদায়ের ব্যাপারে কোনো ছাড় থাকতো তথা তা সুন্নাত কিংবা মুস্তাহাব হতো তা হলে যুদ্ধাবস্থায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণকে জামা‘আতে সালাত আদায়ের পদ্ধতি শেখানোর কোনো প্রয়োজনই অনুভূত হতো না। বরং তারা উক্ত ছাড় পাওয়ার বেশি উপযুক্ত ছিলো। যখন তা হয় নি তখন আমাদেরকে বুঝতেই হবে, জামা‘আতে সালাত আদায় করা নিহায়েত গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব। তাই ওযর ছাড়া কারোর জন্য ঘরে সালাত পড়া জায়িয নয়।
তেমনিভাবে উক্ত আয়াতে উভয় দলকেই জামা‘আতে সালাত আদায় করতে আদেশ করা হয়েছে। যদি কেউ কেউ জামা‘আতে সালাত পড়লে অন্যদের পক্ষ থেকে উক্ত দায়িত্ব আদায় হয়ে যেতো তাহলে উভয় দলকেই এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে জামা‘আতে সালাত আদায় করতে আদেশ করা হতো না। তাই জামা‘আতে সালাত পড়া প্রতিটি ব্যক্তির ওপরই ওয়াজিব। চাই সে সফরে থাকুক অথবা নিজ এলাকায়।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:
﴿يَوۡمَ يُكۡشَفُ عَن سَاقٖ وَيُدۡعَوۡنَ إِلَى ٱلسُّجُودِ فَلَا يَسۡتَطِيعُونَ ٤٢ خَٰشِعَةً أَبۡصَٰرُهُمۡ تَرۡهَقُهُمۡ ذِلَّةٞۖ وَقَدۡ كَانُواْ يُدۡعَوۡنَ إِلَى ٱلسُّجُودِ وَهُمۡ سَٰلِمُونَ ٤٣﴾ [القلم: ٤٢، ٤٣]
“স্মরণ করো সে দিনের কথা যে দিন জঙ্ঘা (হাঁটুর নিম্নাংশ) উন্মোচিত করা হবে এবং তাদেরকে আহ্বান করা হবে সাজদাহ করার জন্য তখন তারা তা করতে সক্ষম হবে না। তাদের দৃষ্টি থাকবে তখন অবনত এবং লাঞ্ছনা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখবে অথচ যখন তারা নিরাপদ ছিলো তখন তাদেরকে সাজদাহ করার জন্য আহ্বান করা হয়েছিলো। (কিন্তু তারা তখন সে আহ্বানে সাড়া দেয় নি)”। [সূরা আল-ক্বালাম, আয়াত: ৪২-৪৩]
আল্লামা ইবরাহীম তাইমী রহ. উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেন: তাদেরকে আযান ও ইক্বামতের মাধ্যমে ফরয সালাতগুলো জামা‘আতে আদায়ের জন্য ডাকা হতো।
বিশিষ্ট তাবঈ আল্লামা সা‘য়ীদ ইবন মুসাইয়িব রহ. বলেন: তারা “হাইয়া ‘আলাস-সালাহ, হাইয়া ‘আলাল-ফালাহ” শুনতো অথচ তারা সুস্থ থাকা সত্ত্বেও মসজিদে গিয়ে জামা‘আতে সালাত আদায় করতো না।
কা‘ব আল-আহবার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: আল্লাহর কসম! উক্ত আয়াতটি জামা‘আতে সালাত না পড়া লোকদের সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে।
উক্ত আয়াতে আহ্বানে সাড়া দেওয়া মানে মুআয্যিনের আযানে সাড়া দিয়ে মসজিদে এসে জামা‘আতে সালাত পড়া। যা নিম্নোক্ত হাদীস থেকেই বুঝা যায়।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন:
«أَنَّ رَجُلاً أَعْمَى قَالَ: يَارَسُوْلَ اللهِ! لَيْسَ لِيْ قَائِدٌ يُلاَئِمُنِيْ إِلَى الْـمَسْجِدِ فَهَلْ لِيْ رُخْصَةٌ أَنْ أُصَلِّيَ فِيْ بَيْتِيْ؟ فَقَالَ لَـهُ النَّبِىُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: هَلْ تَسْمَعُ النِّدَاءَ بِالصَّلاَةِ؟ قَاْلَ: نَعَمْ، قَاْلَ: فَاَجِبْ».
“জনৈক অন্ধ সাহাবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বললেন: আমাকে মসজিদে নিয়ে আসার মতো কোনো লোক নেই। তাই আমাকে ঘরে সালাত আদায় করতে অনুমতি দিবেন কি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন: তুমি কি আযান শুনতে পাও? সে বললো: জি হাঁ! তিনি বললেন: তাহলে তোমাকে মুআয্যিনের ডাকে সাড়া দিয়ে মসজিদে এসে সালাত আদায় করতে হবে”।[1]
উক্ত হাদীসে মুআয্যিনের ডাকে সাড়া দেওয়া মানে যদি শুধু সালাত পড়াই হতো চাই তা যেখানেই পড়া হোক না কেন তা হলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত সাহাবীকে তার ঘরে সালাত আদায়ের অনুমতি চাওয়ার পর আর তাকে আযান শুনার প্রশ্ন ও মুআয্যিনের ডাকে সাড়া দেওয়ার আদেশই করতেন না। কারণ, সে তো ঘরে সালাত আদায়ের অনুমতিই চাচ্ছিলো।
এ ছাড়াও নিম্নোক্ত হাদীসটি আলোচ্য বিষয়ে আরো অত্যন্ত সুস্পষ্ট বক্তব্যই প্রদান করে।
আব্দুল্লাহ ইবন উম্মু মাকতুম রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন: হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো অন্ধ এবং আমার ঘরও মসজিদ থেকে অনেকখানি দূরে অবস্থিত। অন্য বর্ণনায় রয়েছে, মদীনা তো একটি সাপ-বিচ্চু ও হিংস্র প্রাণীর এলাকা। আবার অনেক সময় আমাকে মসজিদে নিয়ে আসার মতো কোনো লোকও পাওয়া যায় না। তাই কি আমি এমন পরিস্থিতিতে ঘরে সালাত আদায়ের অনুমতি পেতে পারি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তুমি কি আযান শুনতে পাও? অন্য বর্ণনায় রয়েছে, তুমি কি “হাইয়া ‘আলাস-সালাহ, হাইয়া ‘আলাল-ফালাহ” শুনতে পাও? তিনি বললেন: জি হাঁ! তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন:
«لاَ أَجِدُ لَكَ رُخْصَةً».
“আমি তোমার জন্য ঘরে সালাত আদায়ের কোনো অনুমতিই খুঁজে পাচ্ছি না”।[2]
যখন এক জন অন্ধ ব্যক্তি ঘরে সালাত আদায়ের অনুমতি পাচ্ছে না তাহলে এক জন চক্ষুষ্মান ব্যক্তি কীভাবে ঘরে সালাত আদায়ের অনুমতি পেতে পারে?! এতেই বুঝা গেলো, জামা‘আতে সালাত আদায় করা প্রতিটি ব্যক্তির ওপর নিহায়েত গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব। তাই ওযর ছাড়া কারোর জন্য ঘরে সালাত পড়া কোনোভাবেই সঠিক নয়।
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও কিন্তু জামা‘আতে সালাত আদায়ের ব্যাপারে কম তাগিদ দেন নি; বরং তিনি যারা জামা‘আতে উপস্থিত হচ্ছে না তাদের ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনিবলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لَقَدْ هَمَمْتُ أَنْ آمُرَ بِالصّلاَةِ فَتُقَامَ، ثُمَّ آمُرَرَجُلاً فَيُصَلِّيَ بِالنَّاسِ ثُمَّ أَنْطَلِقَ مَعِيْ بِرِجَالٍ مَعَهُمْ حُزَمٌ مِنْ حَطَبٍ إِلَىْ قَوْمٍ لاَيَشْهَدُوْنَ الصَّلاَةَ فَأُحَرِّقَ عَلَيْهِمْ بُيُوْتَهُمْ بِالنَّارِ».
“আমার ইচ্ছে হয় কাউকে সালাত পড়ানোর দায়িত্ব দিয়ে লাকড়ির বোঝাসহ কিছু সংখ্যক লোক নিয়ে তাদের পিছু নেই যারা জামা‘আতে উপস্থিত হয় না এবং তাদের ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দেই”।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামা‘আতে সালাত ত্যাগকারীদের ঘর-বাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো এতো বড়ো জঘন্য কাজ করার ইচ্ছা কখনোই পোষণ করতেন না যদি না জামা‘আতে সালাত পড়া একান্ত গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিব হতো। আর যদি কেউ কেউ জামা‘আতে সালাত পড়লে অন্যদের পক্ষ থেকে উক্ত দায়িত্ব আদায় হয়ে যেতো তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর কিছু সাহাবীগণ জামা‘আতে সালাত আদায় করলেই অন্যদের পক্ষ থেকে উক্ত দায়িত্ব আদায় হয়ে যেতো।
যে ব্যক্তি শরঈ অজুহাত ছাড়াই ঘরে সালাত পড়লো তার সালাত আদায় বা কবুল হবে না।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ سَمِعَ الـمُنَادِىَ بِالصَّلاَةِ فَلَمْ يَمْنَعْهُ مِنِ اتِّبَاعِهِ عُذْرٌ لَمْ تُقْبَلْ مِنْهُ الصَّلاَةُ الَّتِيْ صَلَّى، قِيْلَ: وَمَا الْعُذْرُ يَا رَسُوْلَ اللهِ؟ قَالَ: خَوْفٌ أَوْ مَرَضٌ».
“যে ব্যক্তি মুয়ায্যিনের আযান শুনেও মসজিদে না গিয়ে ঘরে সালাত পড়লো অথচ তার নিকট মসজিদে উপস্থিত না হওয়ার শরঈ কোনো ওযর নেই তাহলে তার আদায়কৃত সালাত আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। সাহাবারা বললেন: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি ওযর বলতে কী ধরণের ওযর বুঝাতে চাচ্ছেন? তিনি বললেন: ভয় অথবা রোগ”।[3]
উক্ত হাদীসটিতে কবুল ও ওযরের ব্যাখ্যা চাওয়া ছাড়া তার বাকী অংশটুকু শুদ্ধ।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ سَمِعَ النِّدَاءَ ثُمَّ لَمْ يُجِبْ مِنْ غَيْرِ عُذْرٍ فَلاَ صَلاَةَ لَهُ».
“যে ব্যক্তি আযান শুনেও মসজিদে উপস্থিত হয় নি অথচ তার কোনো ওযর নেই। তাহলে তার সালাতই হবে না”।[4]
উক্ত হাদীসদ্বয়ে জামা‘আতে সালাত না পড়লে সালাত কবুল বা শুদ্ধই হবে না বলতে কমপক্ষে জামা‘আতে সালাত পড়া ওয়াজিব হওয়াকেই বুঝানো হচ্ছে।
কোনো জায়গায় সালাতের সময় হলে এবং সেখানে তিন বা তিনের অধিক ব্যক্তি একত্রিত থাকলে তাদেরকে অবশ্যই উক্ত সালাত জামা‘আতে আদায় করতে হবে। এটিই হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একান্ত আদেশ। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদেশ সাধারণত ওয়াজিব হওয়াকেই বুঝায়।
আবু সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِذَا كَانُوْا ثَلاَثَةً فَلْيَؤُمُّهُمْ أَحَدُهُمْ، وَأَحَقُّهُمْ بِالْإِمَامَةِ أَقْرَؤُهُمْ».
“যখন তারা তিনজন কোথাও একত্রিত হয় তখন তাদের কোনো এক জন যেন সালাতের ইমামতি করে। তবে ইমামতির উপযুক্ত তাদের মধ্যে যে কুরআন সম্পর্কে বেশি জানে”।[5]
মালিক ইবন হুওয়াইরিস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা আমার বংশের আরো কিছু মানুষসহ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট উপস্থিত হলাম। আমরা তাঁর নিকট বিশ রাত্রি অবস্থান করলাম। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দয়ালু প্রকৃতির। যখন তিনি আমাদের মধ্যে বাড়ি ফেরার আকর্ষণ অনুভব করলেন তখন তিনি আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন:
«ارْجِعُوْا فَكُوْنُوْا فِيْهِمْ، وَعَلِّمُوْهُمْ، وَصَلُّوْا، فَإِذَا حَضَرَتِ الصَّلاَةُ فَلْيُؤَذِّنْ لَكُمْ أَحَدُكُمْ، وَلْيَؤُمُّكُمْ أَكْبَرُكُمْ».
“তোমরা বাড়ি ফিরে যাও। নিজ স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারবর্গের মাঝে অবস্থান করো। তাদেরকে শিক্ষা দাও এবং সালাত পড়ো। সালাতের সময় হলে তোমাদেরই কেউ আযান দিবে এবং তোমাদের মাঝে যে বয়স্ক সেই ইমামতি করবে”।[6]
কোনো এলাকায় তিন বা তিনের অধিক ব্যক্তি অবস্থান করা সত্ত্বেও তারা যদি আযান-ইক্বামত দিয়ে জামা‘আতে সালাত আদায় না করে তাহলে শয়তান তাদের ওপর ভালোভাবে জেঁকে বসবে।
আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেন:
«مَا مِنْ ثَلاَثَةٍ فِي قَرْيَةٍ لاَ يُؤَذَّنُ وَلاَ تُقَامُ فِيهِمُ الصَّلاَةُ إِلاَّ اسْتَحْوَذَ عَلَيْهِمُ الشَّيْطَانُ فَعَلَيْكَ بِالْجَمَاعَةِ فَإِنَّ الذِّئْبَ يَأْكُلُ الْقَاصِيَةَ».
“কোনো গ্রাম বা এলাকায় যদি তিনজন মানুষ থাকে অথচ সেখানে আযান-ইক্বামত দিয়ে ফরয সালাত আদায় করা হলো না তা হলে তাদের ওপর শয়তান জেঁকে বসবে। তাই তুমি জামা‘আতে সালাত পড়বে। কারণ, নেকড়ে বাঘ তো একমাত্র দলছুট ছাগলটিকেই খেয়ে ফেলে”।[7]
উক্ত হাদীসে জামা‘আতে সালাত আদায়ের আদেশ করা হয়েছে যা জামা‘আতে সালাত পড়া ওয়াজিব হওয়াই প্রমাণ করে।
কোনো মসজিদে অবস্থানরত অবস্থায় যে কোনো সালাতের আযান দেওয়া হলে তা জামা‘আতে আদায় না করে সেখান থেকে বের হয়ে যাওয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ বিরোধী।
আবুশ-শাসা রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমরা একদা আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু এর সাথে মসজিদে বসা ছিলাম। এমতাবস্থায় মুআয্যিন আযান দিলে জনৈক ব্যক্তি বসা থেকে দাঁড়িয়ে সোজা হাঁটতে শুরু করলো। আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন। ইতোঃমধ্যে সে মসজিদ থেকে একেবারেই বের হয়ে গেলো। তখন আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন:
«أَمَّا هَذَا فَقَدْ عَصَى أَبَا الْقَاسِمِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ».
“আরে! এ তো আবুল-ক্বাসিম তথা রাসূলসাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবাধ্য হলো”।[8]
উক্ত হাদীসে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু আযানের পর জামা‘আতে সালাত না পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়া ব্যক্তিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একান্ত অবাধ্য বলে আখ্যায়িত করেন। যদি সালাত জামা‘আতে পড়া না পড়ার ব্যাপারে লোকটির স্বেচ্ছাচারিতার কোনো সুযোগ থাকতো তাহলে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে জামা‘আতে সালাত না পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একান্ত অবাধ্য বলে আখ্যায়িত করতেন না। অতএব, বুঝা গেলো জামা‘আতে সালাত পড়া ওয়াজিব।
এমনকি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ জাতীয় মানুষকে মুনাফিক বলেও আখ্যায়িত করেছেন। আর শরী‘আতের দৃষ্টিতে সাধারণত কোনো সুন্নাত বা মুস্তাহাব কাজ ছাড়া কিংবা কোনো মাকরূহ কাজ করার দরুন কাউকে মুনাফিক বলা হয় না; বরং তা বলা হয় কোনো ফরয-ওয়াজিব ছাড়লে অথবা কোনো হারাম কাজ করলে। অতএব বুঝা গেলো জামা‘আতে সালাত পড়া ওয়াজিব।
উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ أَدْرَكَهُ الأَذَانُ فِيْ الْـمَسْجِدِ ثُمَّ خَرَجَ لَمْ يَخْرُجْ لِحَاجَةٍ وَهُوَ لاَ يُرِيدُ الرَّجْعَةَ فَهُوَ مُنَافِقٌ».
“কেউ মসজিদে অবস্থানরত অবস্থায় যদি কোনো সালাতের আযান হয়ে যায় অথচ সে কোনো প্রয়োজন ছাড়াই মসজিদ থেকে বের হয়ে গেলো এবং তার দ্বিতীবার মসজিদে ফিরে আসারও ইচ্ছে নেই তাহলে সে মুনাফিক”।[9]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো ওযর ছাড়া সালাত আদায়কারীদের সারির পেছনে একা দাঁড়িয়ে জামা‘আতে সালাত পড়ুয়া ব্যক্তির সালাত বাতিল বলে আখ্যায়িত করে তাকে উক্ত সালাতটুকু দ্বিতীয়বার পড়ার আদেশ করেন। তাহলে বিনা ওযরে ঘরে সালাত পড়ুয়া ব্যক্তির সালাতটুকু কীভাবে শুদ্ধ হতে পারে?! তা একেবারে অশুদ্ধ না হলেও কমপক্ষে জামা‘আতে সালাত পড়া তো ওয়াজিব বলতে হবে।
আলী ইবন শাইবান রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা জনৈক ব্যক্তিকে সালাত আদায়কারীদের সারির পেছনে একা সালাত আদায় করতে দেখে সেখানে দাঁড়িয়ে গেলেন। যখন লোকটি সালাতটুকু শেষ করলো তখন তিনি তাকে বললেন:
«اسْتَقْبِلْ صَلاَتَكَ فَلاَ صَلاَةَ لِرَجُلٍ فَرْدٍ خَلْفَ الصَّفِّ».
“তুমি তোমার সালাতটুকু আবার পড়ো। কারণ, সালাত আদায়কারীদের সারির পেছনে একা সালাত পড়ুয়ার সালাতটুকু শুদ্ধ হয় না”।[10]
>[2] আবু দাউদ, হাদীস নং ৫৫২।
[3]; আবু দাউদ, হাদীস নং ৫৫১; বায়হাকী, হাদীস নং ৫৪৩১।
[4] বায়হাকী, হাদীস নং ৪৭১৯, ৫৩৭৫।
[5] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৭২।
[6] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬২৮; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৭৪।
[7] আহমদ, হাদীস নং ২০৭১৯;; আবু দাউদ, হাদীস নং ৫৪৭; নাসাঈ, হাদীস নং ৮৪৭।
[8] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৬৫৫; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৭৪০।
[9] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৭৪১।
[10] আহমদ, হাদীস নং ১৫৭০৮, ১৬৩৪০।
যে ব্যক্তি শরঈ কোনো অজুহাত ছাড়াই ঘরে সালাত পড়লো সে মুনাফিক। আর শরী‘আতের দৃষ্টিতে সাধারণত কোনো সুন্নাত বা মুস্তাহাব কাজ ছাড়া কিংবা কোনো মাকরূহ কাজ করার দরুন কাউকে মুনাফিক বলা হয় না। বরং তা বলা হয় কোনো ফরয-ওয়াজিব ছাড়লে অথবা কোনো হারাম কাজ করলে। অতএব বুঝা গেলো জামা‘আতে সালাত পড়া ওয়াজিব।
আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«لَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا يَتَخَلَّفُ عَنِ الصَّلاَةُ إِلاَّ مُنَافِقٌ عُلِمَ نِفَاقُهُ أَوْ مَرِيْضٌ، إِنْ كَاْنَ الْـمَرِيْضُ لَيَمْشِىْ بَيْنَ رَجُلَيْنِ حَتَّى يَأْتِيَ الصَّلاَةَ، وَقَاْلَ: إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَّمَنَا سُنَنَ الْـهُدَى وَإِنَّ مِنْ سُنَنِ الْهُدَى الصَّلاَةُ فِي الْـمَسْجِدِ الَّذِيْ يُؤَذَّنُ فِيْهِ».
“আমাদের মধ্যে নিশ্চিত মুনাফিক ও রুগ্ন ব্যক্তি ছাড়া কেউই জামা‘আতে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকতো না। এমনকি আমরা দেখতাম রুগ্ন ব্যক্তি ও দু’ব্যক্তির কাঁধে ভর দিয়ে জামা‘আতে উপস্থিত হতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। আর জামা‘আতে সালাত আদায়ের নির্দেশ সঠিক পথের দিশা বৈ কি”?
আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু আরো বলেন:
«حُطُّ عَنْهُ بِهَا سَيِّئَةً، وَلَقَدْ رَأَيْتُنَا وَمَا يَتَخَلَّفُ عَنْهَا إِلاَّ مُنَافِقٌ مَعْلُوْمُ النِّفَاقِ، وَلَقَدْ كَاْنَ الرَّجُلُ يُؤْتَى بِهِ يُهَادَي بَيْنَ الرَّجُلَيْنِ حَتَّى يُقَامَ فِي الصَّفِّ».
“যার ইচ্ছে হয় পরকালে আল্লাহর সাথে মুসলিম রূপে সাক্ষাৎ দিতে সে যেন জামা‘আতে সালাত আদায় করতে সযত্ন হয়। আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সঠিক পথের দিশা দিয়েছেন। আর জামা‘আতে সালাত পড়া তারই অন্তর্ভুক্ত। তোমরা যদি ঘরে সালাত পড়ুয়া অলসের ন্যায় ঘরে সালাত পড়ো তা হলে নিশ্চিতভাবে তোমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামপ্রদর্শিত সঠিক পথ থেকে সরে পড়লে। আর তখনই তোমরা পথভ্রষ্ট হবে। যে কেউ সুন্দরভাবে পবিত্রতার্জন করে মসজিদগামী হয় আল্লাহ তা‘আলা তাকে প্রতি কদমের বদৌলতে একটি করে পুণ্য দিবেন ও একটি করে মর্যাদা উন্নীত করবেন এবং একটি করে গুনাহ মুছে দিবেন। তিনি বলেন: আমাদের মধ্যে নিশ্চিত মুনাফিক ছাড়া কেউ জামা‘আতে উপস্থিত হওয়া থেকে বিরত থাকতো না। এমনকি কেউ কেউ দু’জনের কাঁধে ভর দিয়েও জামা‘আতে উপস্থিত হতো”।[11]
উক্ত হাদীসে কেউ পরকালে আল্লাহ তা‘আলার সাথে মুসলিম রূপে সাক্ষাৎ দিতে হলে তাকে জামা‘আতে সালাত আদায়ের ব্যাপারে সযত্ন হতে বলা হয়েছে এবং তাতে ঘরে সালাত আদায়কারীকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদর্শ ও তাঁর আনীত শরী‘আত বিরোধী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। উক্ত আদর্শ বলতে এমন আদর্শকে বুঝানো হয় নি যা ইচ্ছে করলে ছাড়াও যায়; বরং এমন আদর্শকে বুঝানো হয়েছে যা ছাড়লে পথভ্রষ্ট ও মুনাফিক রূপে আখ্যায়িত হতে হয়। অতএব বুঝা গেলো জামা‘আতে সালাত পড়া প্রতিটি মুমিন ব্যক্তির ওপর ওয়াজিব ও ফরয।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামইরশাদ করেন:
«إِنَّ لِلْمُنَافِقِيْنَ عَلاَمَاتٍ يُعْرَفُوْنَ بِهَا، تَحِيَّتُهُمْ لَعْنَةٌ، وَطَعَامُهُمْ نُهْبَةٌ، وَغَنِيْمَتُهُمْ غُلُوْلٌ، وَلاَ يَقْرَبُوْنَ الْـمَسَاجِدَ إِلاَّ هَجْراً، وَلاَ يَأْتُوْنَ الصَّلاَةَ إِلاَّ دَبْــراً مُسْتَكْبِرِيْنَ، لاَ يَأْلَفُوْنَ وَلاَ يُؤْلَفُوْنَ، خُشُبٌ بِاللَّيْلِ، صُخُبٌ بِالنَّهَارِ ».
“মুনাফিকদের এমন কিছু আলামত রয়েছে যা দিয়ে তাদেরকে সহজেই চেনা যায়। সেগুলো হলো: তাদের সম্ভাষণই হচ্ছে অভিসম্পাত। তাদের খাবারই হচ্ছে কোথাও থেকে লুট করা বস্তু। তাদের যুদ্ধলব্ধ সম্পদই হচ্ছে তা বন্টনের পূবেই চুরি করা বস্তু। তারা মসজিদের ধারেকাছেও যায় না। সালাতে কখনো আসলেও তারা অহঙ্কারী ভাব নিয়ে দেরিতে আসে। তারা কারোর সাথে গভীরভাবে মিশতে চায় না এবং তাদের সাথেও গভীরভাবে মিশা যায় না। রাতে তারা কাষ্ঠখন্ড স্বরূপ নিঃসাড় নিঃশব্দ। দিনে সরব”।[12]
আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كُنَّا إِذَا فَقَدْنَا الرَّجُلَ فِيْ صَلاَةِ الْعِشَاءِ وَصَلاَةِ الْفَجْرِ أَسَأْنَا بِهِ الظَّنَّ».
“আমরা যখন কাউকে ইশা ও ফজরের সালাতে মসজিদে না দেখতাম তখন তার সম্পর্কে খারাপ ধারণা করতাম তথা তাকে মুনাফিক ভাবতাম”।[13]
এমনকি লাগাতার জামা‘আতে সালাত না পড়া ব্যক্তির অন্তরকে সীল-গালা করা তথা তার অন্তরের ওপর মোহর মেরে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। আর শরী‘আতে সাধারণত কোনো ফরয-ওয়াজিব ছাড়া ব্যতীত কাউকে এ ধরণের হুমকি দেওয়া হয় না।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস ও আব্দুল্লাহ ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত তারা বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা মিম্বারের উপর বসে বলেন:
«لَيَنْتَهِيَنَّ أَقْوَامٌ عَنْ وَدْعِهِمُ الْجَمَاعَاتِ أَوْ لَيَخْتِمَنَّ اللهُ عَلَى قُلُوْبِهِمْ ثُمَّ لَيَكُوْنَنَّ مِنَ الْغَافِلِيْنَ».
“কয়েকটি সম্প্রদায় যেন জামা‘আতে সালাত পরিত্যাগ করা থেকে অবশ্যই ফিরে আসে তা না হলে আল্লাহ তা‘আলা তাদের হৃদয়ের ওপর মোহর মেরে দিবেন। অতঃপর তারা নিশ্চিত গাফিল তথা ধর্ম বিমুখ হয়েই জীবন যাপন করতে বাধ্য হবে”।[14]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জামা‘আতে সালাত আদায়ের ব্যাপারে সাহাবাগণের খবরদারি করতেন। আর কোনো ব্যাপারে কারোর খবরদারি করা সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথা অবশ্য করণীয় ওয়াজিব হওয়াকেই বুঝায়।
উবাই ইবন কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে ফজরের সালাত আদায় করলেন। অতঃপর তিনি আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন: “অমুক উপস্থিত আছে কি? সাহাবীগণ বললেন: না। তিনি আবারো জিজ্ঞাসা করলেন: “অমুক উপস্থিত আছে কি? সাহাবীগণ বললেন: না। তখন তিনি বললেন:
«إِنَّ هَاتَيْنِ الصَّلَاتَيْنِ أَثْقَلُ الصَّلَوَاتِ عَلَى الْـمُنَافِقِينَ وَلَوْ تَعْلَمُونَ مَا فِيهِمَا لَأَتَيْتُمُوهُمَا وَلَوْ حَبْوًا عَلَى الرُّكَبِ وَإِنَّ الصَّفَّ الْأَوَّلَ عَلَى مِثْلِ صَفِّ الْـمَلَائِكَةِ وَلَوْ عَلِمْتُمْ مَا فَضِيْلَتُهُ لَابْتَدَرْتُمُوهُ وَإِنَّ صَلَاةَ الرَّجُلِ مَعَ الرَّجُلِ أَزْكَى مِنْ صَلَاتِهِ وَحْدَهُ وَصَلَاتُهُ مَعَ الرَّجُلَيْنِ أَزْكَى مِنْ صَلَاتِهِ مَعَ الرَّجُلِ وَمَا كَثُرَ فَهُوَ أَحَبُّ إِلَى اللَّهِ تَعَالَى».
“এ দু’টি সালাত তথা ইশা ও ফজরের সালাত জামা‘আতের সাথে আদায় করা সত্যিই মুনাফিকদের জন্য খুবই কষ্টকর। তোমরা যদি জানতে তা জামা‘আতের সাথে আদায়ে কী পরিমাণ সাওয়াব রয়েছে তাহলে তোমরা তা আদায়ের জন্য হামাগুড়ি দিয়ে হলেও মসজিদে উপস্থিত হতে। সালাত আদায়কারীদের প্রথম সারি ফিরিশতাগণের সারির ন্যায়। তোমরা যদি জানতে প্রথম সারিতে সালাত আদায়ের কি ফযীলত রয়েছে তা হলে তোমরা খুব দ্রুত সেখানে অবস্থান করতে। একা সালাত আদায়ের চাইতে দু’জন মিলে জামা‘আতে পড়া অনেক ভালো। আবার একজনকে নিয়ে জামা‘আতে সালাত আদায়ের চাইতে দু’জনকে নিয়ে জামা‘আতে সালাত আদায় করা আরো অনেক ভালো। জামা‘আতে সালাত আদায়কারীদের সংখ্যা যতোই বেশি হবে ততোই তা আল্লাহ তা‘আলার নিকট বেশি পছন্দনীয়”।[15]
জামা‘আতে সালাত আদায়ের ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামের ঐকমত্য রয়েছে যা নিম্নের বাণীগুলো থেকে বুঝা যায়।
আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বাণী যা উপরে উল্লিখিত হয়েছে।
আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে আরো বর্ণিত তিনি বলেন:
«مَنْ سَمِعَ الْـمُنَادِيَ فَلَمْ يُجِبْ مِنْ غَيْرِ عُذْرٍ فَلاَ صَلاَةَ لَهُ».
“যে ব্যক্তি মুআয্যিনের আযান শুনেও মসজিদে উপস্থিত হয় নি অথচ তার কোনো ওযরই ছিলো না তা হলে তার সালাতই হবে না”।[16]
আবু মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَنْ سَمِعَ الْـمُنَادِيَ فَلَمْ يُجِبْ بِغَيْرِ عُذْرٍ فَلاَ صَلاَةَ لَهُ».
“যে ব্যক্তি মুআয্যিনের আযান শুনেও মসজিদে উপস্থিত হয় নি অথচ তার কোনো ওযরই ছিলো না তা হলে তার সালাতই হবে না”।[17]
আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«لاَ صَلاَةَ لِجَارِ الْـمَسْجِدِ إِلاَّ فِـيْ الْـمَسْجِدِ، قِيْلَ : وَمَنْ جَارُ الـْمَسْجِدِ؟ قَالَ : مَنْ سَمِعَ الـْمُنَادِيَ».
“মসজিদের প্রতিবেশীর সালাত মসজিদ ছাড়া আর কোথাও হবে না। তাঁকে বলা হলো: মসজিদের প্রতিবেশী কে? তিনি বললেন: যে ব্যক্তি মুআয্যিনের আযান শুনে”।
তিনি আরো বলেন:
«مَنْ سَمِعَ النِّدَاءَ مِنْ جِيْرَانِ الْـمَسْجِدِ فَلَمْ يُجِبْ وَهُوَ صَحِيْحٌ مِنْ غَيْرِ عُذْرٍ فَلاَ صَلاَةَ لَهُ».
“মসজিদের কোনো প্রতিবেশী আযান শুনে মসজিদে উপস্থিত হয়ে জামা‘আতে সালাত আদায় না করলে অথচ সে সুস্থ-সবল এবং তার কোনো ওযর নেই তা হলে তার সালাতই হবে না”।
তিনি আরো বলেন:
«مَنْ سَمِعَ النِّدَاءَ فَلَمْ يَأْتِهِ لَمْ تُجَاوِزْ صَلاَتُهُ رَأْسَهُ إِلاَّ مِنْ عُذْرٍ».
“যে ব্যক্তি আযান শুনেও মসজিদে জামা‘আতে সালাত আদায় করতে আসেনি তার সালাতটুকু তার নিজ মাথাই অতিক্রম করবে না। আকাশ পর্যন্ত পৌঁছা তো অনেক দূরের কথা। তবে এ ব্যাপারে তার কোনো ওযর থাকলে তা ভিন্ন”।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন:
«لأَنْ تَمْتَلِئَ أُذُنا ابْنِ آدَمَ رَصَاصاً مُذَاباً خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَسْمَعَ الْـمُنَادِيَ ثُمَّ لاَ يُجِيْبُهُ».
“আদম সন্তানের উভয় কান গলানো সিসা দিয়ে ভর্তি থাকা তার জন্য অনেক ভালো মুআয্যিনের আযান শুনে মসজিদে উপস্থিত হয়ে জামা‘আতে সালাত না পড়ার চাইতে”।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَنْ سَمِعَ الـُمنَادِىَ فَلَمْ يُجِبْ مِنْ غَيْرِ عُذْرٍ، لَمْ يَجِدْ خَيْراً وَلَمْ يُرَدْ بِهِ».
“যে ব্যক্তি মুআয্যিনের আযান শুনেও মসজিদে উপস্থিত হয় নি অথচ তার কোনো ওযরই ছিলো না তা হলে সে কল্যাণপ্রাপ্ত নয় অথবা তার সাথে কোনো কল্যাণ করার ইচ্ছেই করা হয় নি”।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَنْ سَمِعَ الْـمُنَادِيَ فَلَمْ يُجِبْ مِنْ غَيْرِ عُذْرٍ فَلاَ صَلاَةَ لَهُ».
“যে ব্যক্তি মুআয্যিনের আযান শুনেও মসজিদে উপস্থিত হয় নি অথচ তার কোনো ওযরই ছিলো না তা হলে তার সালাতই হবে না”।[18]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিযুক্ত মক্কার গভর্ণর আত্তাব ইবন আসীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি একদা মক্কাবাসীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন:
«وَاللهِ لاَ يَبْلُغُنِيْ أَنَّ أَحَداً مِنْكُمْ تَخَلَّفَ عَنِ الصَّلاَةِ فِيْ الْـمَسْجِدِ مَعَ الْـجَمَاعَةِ إِلاَّ ضَرَبْتُ عُنُقَهُ».
“আল্লাহর কসম! কোনো ব্যক্তি জামা‘আতে সালাত পড়ছে না এমন খবর আমার কানে আসলে আমি তাকে হত্যা করবো”।[19]
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَتَخَلَّفُوْنَ عَنِ الصَّلاَةِ فَيَتَخَلَّفُ لِتَخَلُّفِهِمْ آخَرُوْنَ لأَنْ يَحْضُرُوْا الصَّلاَةَ أَوْ لأَبْعَثَنَّ عَلَيْهِمْ مَنْ يُجَافِيْ رِقَابَهُمْ».
“তাদের কী হলো! যারা জামা‘আতে সালাত পড়ছে না এবং তাদেরকে দেখে অন্যরাও জামা‘আতে উপস্থিত হচ্ছে না। তারা যেন জামা‘আতে সালাত আদায়ের জন্য উপস্থিত হয় তা না হলে আমি তাদের নিকট এমন লোক পাঠাবো যারা তাদের গর্দান উড়িয়ে দিবে”।[20]
এ ছাড়া অন্য কোনো সাহাবী এদের বিপরীত মত পোষণ করেন নি। অতএব, বুঝা গেলো এ ব্যাপারে তাদের সবার ঐকমত্য রয়েছে।
হাসান বাসরী রহ. বলেন:
«إِنْ مَنَعَتْهُ أُمُّهُ عَنِ الْعِشَاءِ فِيْ الْـجَمَاعَةِ شَفَقَةً لَمْ يُطِعْهَا».
“কারোর মা যদি সন্তানের ওপর দয়া করে তাকে ইশার সালাত জামা‘আতে পড়তে নিষেধ করে তা হলে সে তাঁর আনুগত্য করবে না। কারণ, গুনাহ’র কাজে মাতা-পিতার আনুগত্য করতে হয় না”।[21]
আরো যাঁরা জামা‘আতে সালাত পড়া ওয়াজিব বলেছেন তারা হলেন, আত্বা ইবন আবী রাবাহ, ইমাম আহমদ, ইমাম শাফেঈ, আওযাঈ, খাত্ত্বাবী, ইবন খুযাইমাহ, ইমাম বুখারী, ইবন হিব্বান, আবু সাউর, ইবন হাযম, ইমাম দাউদ আয-যাহেরী, ইবন ক্বুদামাহ, আল্লামা আলাউদ্দীন আস-সামারক্বান্দী, আবু বাকার আল-কাসানী, ইবনুল্-মুনযির, ইবরাহীম আন-নাখা‘য়ী ও ইমাম ইবন আব্দিল-বার প্রমুখ।
আর একটি ব্যাপার হচ্ছে, যে জামা‘আতে সালাত আদায় করা থেকে পিছিয়ে থাকে সে পরবর্তীতে সম্পূর্ণরূপে সালাতই ছেড়ে দেয়। তাই প্রতিটি মুসলিমের একান্ত কর্তব্য হবে, জামা‘আতে সালাত আদায়ের ব্যাপারে আরো বেশী যত্নবান হওয়া এবং নিজ ছেলে-সন্তান, পরিবারবর্গ, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী এমনকি সকল মুসলিম ভাইদেরকে এ ব্যাপারে উৎসাহিত করা। আর তখনই আমরা মুনাফিকী থেকে মুক্তি পাবো।
[12] আহমদ, হাদীস নং ৭৯১৩।
[13] ত্বাবারানী/কবীর, হাদীস নং ১৩০৮৫; ইবন আবী শাইবাহ: ১/৩৩২।
[14] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৮০১।
[15] আবু দাউদ, হাদীস নং ৫৫৪; নাসাঈ, হাদীস নং ৮৪৩।
[16] ইবন আবী শায়বাহ, হাদীস নং ৩৪৮৬।
[17] ইবন আবী শায়বাহ, হাদীস নং ৩৪৮২।
[18] ইবন আবী শায়বাহ, হাদীস নং ৩৪৮৩।
[19] কিতাবুস-সালাহ/ইবনুল-কাইয়্যেম ৫৯৫।
[20] মিফ্তাহুল-আফকারর/আব্দুল আযীয আল-সালমান ২/১০২।
[21] সহীহ বুখারী: অধ্যায় ১০, অনুচ্ছেদ: ২৯।