দুই. চরিত্র গঠনের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ

মানবতাকে কেবল তাওহীদের শিক্ষা দিয়েই ইসলাম ক্ষান্ত থাকে নি; বরং পৃথিবীতে আদল ও ইনসাফের প্রতিষ্ঠা, গোটা বিশ্ব মানবতার পর্থিব জীবনের শান্তি ও সফলতা নিশ্চিত করার বিষয়টিও ইসলাম পরম গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। সে কারণে মুসলিমদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিজেরা কল্যাণ ও সফলতা লাভের সঙ্গে সঙ্গে তারা যেন অন্যান্য মানুষকেও এর প্রতি আহ্বান করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَلۡتَكُن مِّنكُمۡ أُمَّةٞ يَدۡعُونَ إِلَى ٱلۡخَيۡرِ وَيَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَيَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِۚ وَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلۡمُفۡلِحُونَ ١٠٤﴾ [ال عمران: ١٠٤]

“আর তোমাদের মাঝে এমন একটি দল থাকা চাই যারা আহ্বান করবে কল্যাণের প্রতি, নির্দেশ দিবে ন্যায়ের, আর নিষেধ করবে অন্যায় থেকে। আর তারাই হচ্ছে সফলকাম।” [সূরা আল-ইমরান: ১০৪]

অন্যত্র বলেন,

﴿كُنتُمۡ خَيۡرَ أُمَّةٍ أُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَأۡمُرُونَ بِٱلۡمَعۡرُوفِ وَتَنۡهَوۡنَ عَنِ ٱلۡمُنكَرِ وَتُؤۡمِنُونَ بِٱللَّهِۗ﴾ [ال عمران: ١١٠]

“তোমরাই মানবতার জন্য শ্রেষ্ঠ জাতিরূপে উত্থিত হয়েছো- তোমরা ন্যায়ের পথে নির্দেশ দাও ও অন্যায় থেকে নিষেধ করো, আর আল্লাহতে বিশ্বাস রাখো। [সূরা আল-ইমরান: ১১০]

অতঃপর দাওয়াতের এপথে চলতে গিয়ে ধেয়ে আসা সকল বিপদ-আপদের মুখে আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদের ধৈর্য ও সবরের নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে করে মানুষ তাদের প্রতি বিরক্ত হয়ে বিমুখতার পথ বেছে না নেয়। পাশাপাশি নির্দেশ দিয়েছেন বিতর্কের ক্ষেত্রে যেন তারা হিকমত ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সর্বোত্তম পন্থা অবলম্বন করে। এভাবে মুমিনদের হৃদয় মানুষের মুহাব্বত ও ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকবে, সর্বদা তাদের শির্ক ও অবিশ্বাসের অন্ধকার থেকে মুক্ত করে হিদায়াতের আলোর পথে নিয়ে আসার চিন্তায় বিভোর থাকবে।

ইসলাম নিজ অনুসারীদের কাফের ও মুশরিকসহ পৃথিবীর সকল মানুষের সঙ্গে আদল ও ইনসাফ, দয়া ও করুণা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে। দীন ও উম্মাহর কল্যাণ ও মঙ্গলের খাতিরে বিরুদ্ধবাদীদের পক্ষ থেকে আসা সকল যুলুম-নির্যাতনের ক্ষেত্রে সবর কিংবা বেশির থেকে বেশি হলে ইনসাফপূর্ণ প্রতিশোধ গ্রহণ করতে বলেছে। আল্লাহ বলেন,

﴿وَقَٰتِلُواْ فِي سَبِيلِ ٱللَّهِ ٱلَّذِينَ يُقَٰتِلُونَكُمۡ وَلَا تَعۡتَدُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُعۡتَدِينَ ١٩٠﴾ [البقرة: ١٩٠]

“আর আল্লাহর পথে তোমরা যুদ্ধ করো তাদের সঙ্গে যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে। আর সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সীমালঙ্ঘনকারীদের পছন্দ করেন না।” [সূরা আল-বাক্বারা: ১৯০]

একইভাবে কাফেরদের জুলুম-নির্যাতন সত্ত্বেও তাদের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা ন্যায় ও ইনসাফের নির্দেশ দিয়েছেন:

﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ كُونُواْ قَوَّٰمِينَ لِلَّهِ شُهَدَآءَ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَلَا يَجۡرِمَنَّكُمۡ شَنَ‍َٔانُ قَوۡمٍ عَلَىٰٓ أَلَّا تَعۡدِلُواْۚ ٱعۡدِلُواْ هُوَ أَقۡرَبُ لِلتَّقۡوَىٰۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ خَبِيرُۢ بِمَا تَعۡمَلُونَ ٨ ﴾ [المائ‍دة: ٨]

“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর জন্য দৃঢ় প্রতিষ্ঠাতা হও, ন্যায়-বিচারে সাক্ষ্যদাতা হও, আর কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ তোমাদের যেন ন্যায়াচরণ না করতে প্ররোচিত না করে। ন্যায়াচরণ করো, এটিই হচ্ছে তাকওয়ার সবচেয়ে নিকটতর। আর আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো। নিঃসন্দেহে তোমরা যা কিছু করছো, আল্লাহ সে সম্পর্কে পূর্ণ ওয়াকিক-হাল।” [সূরা আল-মায়িদাহ: ৮]

মূলত ইসলাম গোটা মানবতার জন্য হিদায়াত ও রহমতস্বরূপ পৃথিবীতে এসেছে। আল্লাহ তা‘আলা ইসলামের নবীকেও ‘রহমতের নবী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন,

﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَٰكَ إِلَّا رَحۡمَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ ١٠٧﴾ [الانبياء: ١٠٧]

“আর আমরা তো কেবল আপনাকে গোটা সৃষ্টিকুলের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।”[সূরা আল-আম্বিয়া: ১০৭]

এরপর ইসলাম মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম-মিসকীন ও অভাবী মানুষের প্রতি দয়া ও অনুগ্রহের নির্দেশ দিয়েছে। প্রতিবেশীদের পরস্পরের ওপর বিভিন্ন অধিকার নির্ধারণ করেছে। বন্ধুর ওপর বন্ধুর অধিকার দিয়েছে। নিজের আশ-পাশের মানুষের অধিকারের কথাও বাদ রাখে নি। আরও আগে বেড়ে বলা যায়, পৃথিবীর সকল মুসলিমের একে অপরের ওপর বিভিন্ন অধিকার সাব্যস্ত করেছে। সালামের জবাব, হাঁচির উত্তর কিংবা অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়ার মাধ্যমেও এসব অধিকার পূর্ণ হয়ে থাকে। এসবের পাশাপাশি ইসলাম একজন মুসলিমকে অপর মুসলিমের ওপর জুলুম করতে নিষেধ করছে। কাউকে ঘৃণা বা অপমান করতে বারণ করেছে। তিনদিন কারও সঙ্গে কথা না বলে থাকতে নিষেধ করেছে। কারও দরাদরির ওপর দরাদরি, বিয়ের প্রস্তাবের ওপর প্রস্তাব করতে বারণ করেছে। অপরের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ, শত্রুতা-সমালোচনা থেকে দূরে থাকতে বলেছে। এগুলো অমান্যকারীর জন্য ঘোষণা করেছে কঠোর শাস্তি। এভাবেই ইসলাম পরিণত হয়েছে একটি পরিপূর্ণ মানবতার পয়গামে। যা এর অনুসারীকে সর্বাবস্থায় ও সর্বস্থানে ন্যায় ও কল্যাণের বীজ বপনের নির্দেশ দেয়। জগতের প্রত্যেকটি মানুষের সঙ্গে দয়া ও করুণার দীক্ষা দেয়।

মানবতার প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শনের এসব দীক্ষা নিয়ে একজন সত্যিকার মুসলিম সহজাতভাবেই সম্পূর্ণ সুনির্মল ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের অধিকারী একজন সুন্দর মানুষে পরিণত হয়। আর এগুলো করতে গিয়ে যখন সে সবসময় স্বীয় রবের ধ্যান ও খেয়াল হৃদয়ে জাগ্রত রাখবে, সন্দেহ নেই কুফর, অবিশ্বাস আর নাস্তিক্যবাদ থেকে সে অনেক দূরে থাকবে। পরিণত হবে মহান প্রভুর নিতান্ত কাছের একজন মানুষে।

এভাবে ইসলামের সঠিক চর্চার মাধ্যমে একজন মুসলিম হয়ে ওঠে ভূপৃষ্ঠের ওপর চলমান সবার মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ وَعَمِلُواْ ٱلصَّٰلِحَٰتِ أُوْلَٰٓئِكَ هُمۡ خَيۡرُ ٱلۡبَرِيَّةِ ٧ ﴾ [البينة: ٧]

“নিঃসন্দেহে যারা ঈমান এনেছে ও সৎকর্ম করেছে, তারা গোটা সৃষ্টিজগতের মধ্যে সর্বোত্তম।” [সূরা আল-বাইয়্যিনাহ: ৭]

পরিশেষে আমরা এ সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হতে পারি যে, পৃথিবীতে ইসলামের আগমনের অন্যতম দু’টি মৌলিক উদ্দেশ্য হলো: নিষ্ঠা ও পূর্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্থাপনপূর্বক তাঁর ইবাদতে আত্মনিবেদন করা এবং গোটা মানবতার কল্যাণ ও মঙ্গলের জন্য কাজ করা। অথচ নাস্তিক্যবাদ এর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে গোটা পৃথিবীতে কেবল অশান্তি আর নৈরাজ্য সৃষ্টি করতেই অধিকতর সিদ্ধহস্ত।