নাস্তিক্যবাদের প্রভাব সম্ভবত সবচেয়ে বেশি দেখা যায় বিশ্ব রাজনীতি ও বিভিন্ন দেশের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে। কারণ যেই নাস্তিক্যবাদ ও বস্তুবাদী স্বভাব-চরিত্র একজন মানুষের হৃদয়কে কঠোরতা, রূঢ়তা আর আত্মপরায়ণতায় ভরপুর রাখে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও দ্বিপাক্ষিক রাষ্ট্রীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এটা তাকে কঠোরতা ও স্বার্থপরতার পথে ঠেলে দেয়। আর সে কারণেই আমরা পৃথিবীর বড় বড় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে সবসময়ই দেখি নিকৃষ্ট থেকে নিকৃষ্টতর কলা-কৌশল আর টাল-বাহানার আশ্রয় নিতে। উদ্দেশ্য থাকে, দুর্বল জাতিগুলোর গলায় গোলামির জিঞ্জির পরিয়ে দেওয়া, ছলে-বলে দুর্বল রাষ্ট্রগুলোর ধন-সম্পদ বাগিয়ে নেওয়া। এই নাস্তিক্যবাদ ও বস্তুবাদী রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়েছে আরব ও ইসলামী বিশ্ব। কারণ, যখনই কোনো আরব কিংবা মুসলিম রাষ্ট্র নিজেদের হৃত অধিকার ফেরত চায়, তখনই তাদের সামরিক আগ্রাসনের নগ্ন হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। বরং আরও আগে বেড়ে বলা যায়, যখন আমাদের কোনো রাষ্ট্র নিজের সীমানার ভেতরে পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহর আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে আলোর পথে হাঁটার পরিকল্পনা করে, তখনই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো বিভিন্ন খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে তার পথ আগলে দাঁড়ায়। পশ্চাৎপদ ও প্রগতিবিরোধী, অন্যায় ও বর্বর, জালেম ও অসহিষ্ণুসহ বিভিন্ন অপবাদ আর কলঙ্কের কালিমা লেপন করা হয় আমাদের পবিত্র ধর্মের সুশুভ্র অঙ্গে। ইসলামী বিশ্বের বিরুদ্ধে এই নাস্তিক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো তাদের মনে যে কতটা ঘৃণা ও বিদ্বেষ লালন করে এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ বোধহয় ‘তেল’। যখন ইসলামী বিশ্ব এই তেলের ন্যায্য দাম পাওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে আবেদন করেছিল, তখন তথাকথিত এসব আন্তর্জাতিক মোড়ল আমাদের ‘বিশ্ব অর্থনীতি ও সভ্যতা ধ্বংসের ষড়যন্ত্রকারী’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিল। কারণ শুধু একটিই, আমরা কেন আমাদের ন্যায্য অধিকার চাইতে গিয়েছিলাম? বরং এসব সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বারবার হাঁক-ডাক ছেড়েছে, যদি তাদের কাছে তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয় কিংবা তেলের মূল্য বৃদ্ধি পায়, তবে প্রয়োজনে তারা আমাদের তেলের খনি দখল করে আমাদেরই এর থেকে মাহরূম রাখবে।
এভাবেই আজ গোটা পৃথিবী সাম্রাজ্যবাদী বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর আন্তর্জাতিক বস্তুবাদ ও স্বার্থপরতার আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। একের পর এক তারা দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে দখল করে সেগুলোর ধন-সম্পদ লুট করছে। সেখানকার অধিবাসীদের গলায় গোলামির জিঞ্জির পরিয়েছে। আর সেগুলোকে ঠেলে দিয়েছে ভেদাভেদ, বিশৃঙ্খলা, অস্থিরতা আর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের দিকে।
বিশ্ব রাজনীতির কর্ণধারগণ যদি আল্লাহ তাআলার একত্ববাদে বিশ্বাসী হতেন, মহান স্রষ্টার ভয় যদি তাদের হৃদয়ে সদা-সর্বদা জাগরূক থাকতো, তবে এই পৃথিবীটা আজ এতটা অশান্ত থাকত না। জাতিতে জাতিতে থাকতো ভ্রাতৃত্ববোধ আর পরস্পরের সহমর্মিতা ও ভালোবাসার সুনিবিড় বন্ধন। দুর্বলদের সহায়তা, দরিদ্রদের অনুগ্রহ আর মজলুমের মমত্ববোধ- এসবই হতো বিশ্ব রাজনীতির মূল নীতিমালা।
কিন্তু এর চেয়েও বেশি ভয় আর আতঙ্কের বিষয় হলো আধুনিক যুদ্ধের হাতিয়ার ও সমরাস্ত্র আবিষ্কার। কারণ নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য কখন যে এই নাস্তিক্যবাদী ও স্বার্থপর রাষ্ট্রগুলো গোটা পৃথিবীটা ধ্বংস করে দেয়- সেটা সম্ভবত কেউ-ই বলতে পারবে না।
ছোট ও দুর্বল রাষ্ট্রগুলোকে ধ্বংস করার জন্য আজ বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো যেসব পন্থা-পদ্ধতি এখতিয়ার করছে, তাতে কেউ বিস্মিত না হয়ে পারবে না। সমরাস্ত্রের পরিবর্তে আজ তারা ব্যবহার করছে মাদক, মিথ্যা প্রচারণা, নারী ও বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াইয়ের হাতিয়ার। দেশ ও দেশের মানুষের জন্য হিতকর সবকিছুই তাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চক্ষুশূল।
এভাবেই নাস্তিক্যবাদ ও মহান আল্লাহ থেকে দূরাবস্থান একটি সুন্দর মানব সমাজকে পরিণত করে জুলুম-নির্যাতন, অন্যায়-অনাচার, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-হানাহানিপূর্ণ একটি ঘৃণ্য সমাজে। ফুল ও পাখির গান নয়; সর্বদা সে সমাজে বয়ে চলে ধ্বংস আর বিনাশের তুফান। সেখানে মাদকের ভেতরে মানুষ বুঁদ হয়ে থাকে। ফুলে ওঠা আরক্তিম কামার্ত চোখে কামের নেশা দেখতে পায় পৃথিবীর সবকিছুতে। এভাবে নাস্তিক্যবাদের ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠা বিশ্ব রাজনীতি একজন মানুষকে বানিয়ে ফেলে চরম স্বার্থপর ও আত্মপরায়ণ। সে কেবল এই দুনিয়ার জন্যই বেঁচে থাকে। তার সামনে উপস্থিত দিনটিকেই পূর্ণ ভোগ করতে ভালোবাসে। ফলে সে মেশিনের মতো অহর্নিশ ঘুরতে থাকে। তার জীবন ভরে ওঠে হতাশা, বিশৃঙ্খলা আর অপরাধের অভিশাপে।