নাস্তিক্যবাদ মানুষের সামাজিক জীবনে ধ্বংসের কুঠার হয়ে গোড়া কেটে দিয়েছে। কারণ আল্লাহ তা‘আলা থেকে দূরত্ব কেবলমাত্র মানুষের ব্যক্তিজীবনেই প্রভাব ফেলে না; বরং স্বাভাবিকভাবেই সেই প্রভাব বিস্তৃত হয় তার সামাজিক জীবনে এবং সেটাকে গুঁড়িয়ে দেয়। একটি সুন্দর মানব সমাজের অবকাঠামো তৈরি হওয়ার জন্য শর্ত হলো সেখানে লাগানো ইটগুলো হতে হবে সুন্দর ও ভালো। যদি ভিত্তিমূলই ভালো না হয়, ভবনের মূল উপকরণই যদি সুস্থিত ও মজবুত না হয় আর পরবর্তীতে সেই ভবন গড়ে উঠতে না উঠতেই কাত হয়ে পড়ে, তবে তাতে বিস্ময়ের কী থাকে?

মানবীয় সমাজ ব্যবস্থার প্রধান উপাদান হচ্ছে পরিবার। আর সেই কারণে যখন সুন্দর ও সুস্থ মানবতা নষ্ট হয়ে যায়, তখন পারিবারিক বন্ধনও অসুস্থ ও অসুন্দর হয়ে পড়ে। একটি পরিবারের প্রধান পুরুষ স্বামীর স্বভাব নষ্ট হলে সেই নষ্টামি স্ত্রী পর্যন্ত এবং সেখান থেকে সন্তানদের প্রতি গড়ানোই স্বাভাবিক। একইভাবে পরিবারের স্ত্রীর ভেতর যদি আল্লাহর ভয় না থাকে, নিজের কাজকর্মে তাকে মনে না রাখে, তবে এর প্রভাব অনিবার্যভাবেই স্বামী-সন্তানদের ওপর পড়ে। আর এভাবেই একজন মন্দ মানুষের কারণে একসময় গোটা পরিবার নষ্ট হয়ে পড়ে। নাস্তিক্যবাদ ঠিক সেই ধ্বংসের কাজটাই করেছে নিপুণভাবে। আর সে কারণেই বর্তমান নাস্তিক্যবাদী সমাজে আমরা এমন কোনো পরিবারের সন্ধান পাই না যার সবগুলো অঙ্গ সঠিক ও সুস্থভাবে কাজ করছে। যেই পরিবারের সকল সদস্যের মাঝে সুন্দর ও সুষম ভারসাম্য রয়েছে। আর যখন সুষম পরিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংস হয়, তখন স্বাভাবিকভাবে একটি অসুস্থ পরিবারে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের তাৎপর্যও হারিয়ে যায়। তাৎপর্যহীন সেই সম্পর্কের ভেতরে তখন থাকে কেবল স্বার্থসিদ্ধি আর ভোগ-সম্ভোগের গরজ। সেখানে পরস্পরের প্রতি নিষ্ঠা, নিখাঁদ ভালোবাসা কিংবা ত্যাগ ও কুরবানীর ছিঁটেফোঁটাও থাকে না। পরিবারের কল্যাণ্যের জন্য একজন স্বামী কিংবা বাবা যে নিজের সকল স্বার্থ ও সাধকে কুরবানী দিয়ে দিতে পারেন, একজন নিষ্ঠাবান স্ত্রী যে কখনো জীবনের চক্রাবর্তে কেবল ভালোবাসার তাগিদে একজন হতদরিদ্র, অসুস্থ ও সাধারণ স্বামীর ঘর করতে পারেন, সয়ে যেতে পারেন সন্তানদের প্রতিপালনসহ জীবন-যুদ্ধের সবধরনের সংগ্রাম ও সাধনা- এগুলো একটি নাস্তিক্যবাদী পরিবারে কল্পনাও করা যায় না। পরকালের হিসাব-নিকাশ আর ভালো-মন্দ পরিণতিতে অবিশ্বাসী একটি পরিবারের ভেতরে কখনো ত্যাগ-তিতিক্ষার মন-মানসিকতা সৃষ্টি হতে পারে না। কারণ তখন কুরবানী করে কী লাভ- এই প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যায় না। একইভাবে সন্তানদের কথাও ধরুন। আল্লাহ তা‘আলায় বিশ্বাসী একজন সন্তান জানে, তার পিতা-মাতার বার্ধক্য কিংবা দুরবস্থায় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে সে আদিষ্ট। কিন্তু সে যদি আল্লাহ তাআলার ওপরই বিশ্বাস না করে, তবে এত কষ্ট সে কোনো দিনও করতে যাবে না। ব্যক্তিস্বার্থ কাজ না করলে মাতা-পিতার দিকে ফিরেও তাকাবে না। এভাবেই নাস্তিক্যবাদের প্রাদুর্ভাবের মধ্য দিয়ে পরিবারিক বন্ধনে মূল যেই সুতোখানি থাকে সেটাই ছিঁড়ে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে।

নাস্তিক্যবাদ পারিবারিক বন্ধনের এতখানি ক্ষতি করেও নিরস্ত থাকেনি; বরং এটা আরও সামনে এগিয়ে গিয়ে সর্বনাশের এমন সবদিক উন্মোচিত করেছে যা ভাবতেও অবাক লাগে। জীবনের ভোগ-বিলাস পূর্ণ মাত্রায় আস্বাদন করতে গিয়ে, কামচরিত্র পূরণের পথে দৌড়াতে গিয়ে একজন অবিশ্বাসী মানুষের কাছে বৈবাহিক ও পারিবারিক বন্ধন ধরে রাখার বিষয়টিও বোকামি ও নির্বুদ্ধিতা বলে মনে হয়। কখনো কখনো তাই পুরুষরা ভাবতে থাকে যে, পরিবারের সবগুলো সন্তান তার ঔরসেই যে হয়েছে এমনটি নাও হতে পারে। একইভাবে পরিবারের সন্তানরা ভাবতে থাকে, তাদের সবাই একজন পিতার ঔরসে নাও হতে পারে। আর এভাবেই একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবারের সদস্যদের এক ও অভিন্নপ্রাণ হওয়ার নান্দনিক অনুভূতি সবার মাঝখান থেকে হারিয়ে যায়। শারীরিক ভোগ-সম্ভোগের সুযোগ পেলেও, দৈহিক সুখে শিহরিত হয়ে উঠলেও তারা চিরদিনের জন্য বঞ্চিত থাকে মনের সুখ আর হৃদয়ের প্রশান্তি থেকে। কারণ তাদের সম্পর্ক থাকে তখন কেবল পশুর সম্পর্কের মতোই। যার কারণে তালাক ও বিচ্ছেদ, ঘর ছেড়ে নিরুদ্দেশ হওয়া, এমনকি নিজের জীবন সঙ্গীর সঙ্গে খেয়ানতের মতো সর্বনাশা ঘটনাগুলোও অতি সহজেই প্রাত্যাহিক ঘটনার মতো সেখানে ঘটে থাকে। পিতা তার মেয়ের সঙ্গে ছেলেবন্ধুদের দেখে তাকে স্বাধীনতার প্রতি আরও উদ্বুদ্ধ করেন। ছেলের সঙ্গে তার মেয়েবন্ধুদের দেখেও না দেখার ভান করেন। কারণ নাস্তিক্যবাদ তাদের শিক্ষা দিয়েছে, প্রত্যেকে তার নিজের ইচ্ছানুযায়ী জীবন চালাবে। প্রত্যেকে তার নিজের ব্যাপারে দায়িত্বশীল। সুতরাং অপরে কী করছে- সেটা দেখার দায়িত্ব তার নয়। আর এভাবেই পরিবারিক ব্যবস্থাকে সে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছে।