নাস্তিক্যবাদের তুফান বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার তৃতীয় উপকরণ ছিল নাস্তিক্যবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভাবন। আর এর মাঝে সবার আগে যে নামটি চলে আসে তা হলো ইয়াহূদী বংশোদ্ভূত জার্মান খ্রিস্টান (পরবর্তীতে নাস্তিক) কাল মার্কসের উদ্ভাবিত কম্যুনিজম। যদিও মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্যই কম্যুনিজমের উৎপত্তি হয়েছিল এবং পুঁজিবাদী দুনিয়া ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধন-সম্পত্তির ধারার বিলোপ সাধন করে সকল মানুষের সমতার ওপর ভিত্তি করে সাম্যবাদী সমাজ গড়ে তোলার শ্লোগান নিয়ে এটা অস্তিত্বে এসেছিল; কিন্তু এর হর্তাকর্তারা ধীরে ধীরে একে ধর্মীয় পোশাক পরাতে শুরু করেন। ফলে সেখানে আস্তে আস্তে অর্থনীতির সঙ্গে দূরতম সংশ্লিষ্টতা নেই এমন বহু বিষয়েরও অনুপ্রবেশ ঘটে। এক পর্যায়ে তারা ধারণা দিতে শুরু করেন- মানুষের জীবনটা কেবল পার্থিব জগতের জন্যই। প্রভু, পরকাল কিংবা আত্মা বলতে আসলে কিছু নেই। আর তাই সৃষ্টির শুরু থেকেই মানুষের আগ্রহ আর আকাঙক্ষার ক্ষেত্র কেবল পার্থিব দুনিয়ার উন্নতি-অগ্রগতি। পরবর্তীতে মানুষকে আরও জানানো হয় যে, জগতের ধর্মগুলো মূলত গরীবকে শোষণের জন্য ধনীদের আবিষ্কৃত হাতিয়ারমাত্র। আমানত, সচ্চরিত্র ইত্যাদি আখলাকগুলো পুঁজিবাদী স্বার্থকে রক্ষার জন্যই চতুর মস্তিষ্কের চিন্তার প্রসবমাত্র। আর এভাবেই সাম্যবাদীদের বিশ্বাসের ভিত্তি গড়ে ওঠে জগতের সকল নবী-রাসূলের দুশমনির ওপর। তারা বিশ্বাস করতে শুরু করে- সমাজের সাধারণ মানুষকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে জুলুম-নির্যাতনের পথ সুগম করার জন্যই আম্বিয়ায়ে কিরাম জগতে এসব ধর্মের প্রচার করেছিলেন। আর এভাবেই অর্থনৈতিক এই বিশ্বাসটি এক পর্যায়ে সব ধর্মের দুশমন হয়ে নাস্তিক্যবাদের এক নতুন তুফানরূপে আত্মপ্রকাশ করে। আরও আগে বেড়ে বলা যায়, কম্যুনিজমই ছিল সম্ভবত নাস্তিক্যবাদের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী তুফান। কারণ কম্যুনিজমের মূল শ্লোগান আর দর্শন ছিল সমাজের সাধারণ মানুষের স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করা। বাহ্যিকভাবে যা ছিল ইনসাফপূর্ণ ও মানবতার জন্য পরম উপকারী একটি দর্শন। আর যেহেতু সমাজের অধিকাংশ মানুষই ছিল দরিদ্র ও নিপীড়িত-নিষ্পেষিত সেহেতু নিজেদের মঙ্গল ও স্বার্থের কথা চিন্তা করে সাধারণ মানুষরা হৃদয়ের দুয়ার খুলে একে স্বাগত জানায়। এটা আসন গেড়ে বসে তাদের মনের মণিকোঠায়। বস্তুত কেবল অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়; একটি ধর্মবিশ্বাস হিসেবেও এটি স্থান পেয়ে যায় তাদের মস্তিষ্কের গভীরে।
আর এভাবেই নতুন একটি অর্থনৈতিক ধারার ছদ্মাবরণে নাস্তিক্যবাদ পৃথিবীতে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। পরবর্তীতে রাশিয়ায় সংঘটিত বলশেভিক বিপ্লবের সাফল্য ও তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাগ্রহণ ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তারা প্রকাশ্যে ধর্মের গলা কাটতে শুরু করে। নাস্তিক্যবাদ অলি-গলি ছেড়ে এবার রাজপথে নেমে হুক্কাহুয়া করতে থাকে। ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এই প্রলয়ংকরী তুফান।
কম্যুনিজমের বিশ্বাস ছিল, গোটা পৃথিবী একসময় তাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি আর বিশ্বাসের কাছে অবশ্যই আত্মসমর্পণ করবে। আর সেকারণে এটা শুধু দাওয়াতের ভেতরেই তার কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ রাখেনি; গোটা বিশ্বে এই আদর্শ ছড়িয়ে দিতে এক পর্যায়ে বিপ্লব আর রক্তাক্ত সহিংসতার পথ বেছে নেয়। ফলে দ্রুত গোটা বিশ্বে এই আদর্শিক বিপ্লব ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে বিভিন্ন জাতি নিজের অজান্তেই নাস্তিকতার পথে অগ্রসর হতে থাকে। ঠিক যেমনটা ঘটেছিল চীনে ও রাশিয়ার সীমানার ভেতরের বিভিন্ন ইসলামী প্রজাতন্ত্রে। আজও মার্কসীয় বিশ্বাসের প্রজ্জ্বলিত নাস্তিক্যবাদের এই আগুন গোটা বিশ্বে দ্রুদ্রুত থেকে দ্রুততর গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। এমনকি ইসলামের দুর্গ হিসেবে খ্যাত আরব দুনিয়ায়ও মার্কসীয় মতাদর্শ একের পর এক হানা দিয়ে যাচ্ছে।