অন্য কোনো রাত্রিতে না আদায় করে শুধু মাত্র লাইলাতুল ক্বাদ্‌রের রাত্রিতে তাহাজ্জুদ এর সালাত আদায়ের ব্যাপারে বিধান কি?

ফাত্‌ওয়া নং - 50693

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য।

প্রথমত : লাইলাতুল ক্বাদ্‌রের রাত্রিতে ‘ইবাদাত করার মহান ফযীলাত এর ব্যাপারে দলীল রয়েছে। আমাদের রাব্ব (সৃষ্টিকর্তা, মালিক, লালন-পালন ও পরিচালনাকারী) তাবারাকা ওয়া তা‘আলা বলেছেন :

﴿ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ٣ ﴾ [القدر: ٣]

“এই রাতের ‘ইবাদাত হাজার রাতের চেয়ে উত্তম” [আল-ক্বাদ্‌র:৩]

এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

«مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ»

رواه البخاري (1901) ومسلم (760 )

“যে ঈমান সহকারে ও প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল ক্বাদ্‌রের রাত্রিতে ক্বিয়াম করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” (বুখারী, ১৯০১; মুসলিম: ৭৬০)

আল্লাহ-তা‘আলা বলেছেন :

﴿ إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ ٢ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ ٣ تَنَزَّلُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ فِيهَا بِإِذۡنِ رَبِّهِم مِّن كُلِّ أَمۡرٖ ٤ سَلَٰمٌ هِيَ حَتَّىٰ مَطۡلَعِ ٱلۡفَجۡرِ ٥ ﴾ [القدر: ١- ٥]

১. নিশ্চয়ই আমি একে লাইলাতুল ক্বাদ্‌রে নাযিল করেছি।
২. এবং আপনি কি জানেন লাইলাতুল ক্বাদ্‌র কি?
৩. লাইলাতুল ক্বাদ্‌র হাজার মাস অপেক্ষা অধিক উত্তম।
৪. এতে ফেরেশতাগণ এবং রূহ (জিবরীল-’আলাইহি স সালাম) তাঁদের রাব্বের অনুমতিক্রমে অবতরণ করেন সকল সিদ্ধান্ত নিয়ে।
৫. শান্তিময় (বা নিরাপত্তাপূর্ণ) সেই রাত, ফাজ্‌রের সূচনা পর্যন্ত।”

[৯৭ আল-ক্বাদ্‌র : ১-৫]

আবূ হুরাইরাহ -রাদিয়াল্লাহু আনহু- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন যে তিনি বলেছেন :

«مَنْ قَامَ لَيْلَةَ الْقَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ»

رواه البخاري (1901) ومسلم (760 )

“যে ঈমান সহকারে ও প্রতিদানের আশায় লাইলাতুল ক্বাদ্‌রের রাত্রিতে ক্বিয়াম করবে তার অতীতের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।” (বুখারী, ১৯০১; মুসলিম: ৭৬০)

এখানে “ঈমান সহকারে” এর অর্থ: এই রাতের মর্যাদা ও তাতে আমল করা, শারী‘আতসম্মত হওয়ার ব্যাপারে বিশ্বাস স্থাপন করা।

আর “প্রতিদানের আশায়” এর অর্থ: আল্লাহ তা‘আলার জন্য নিয়্যাতের ব্যাপারে ইখলাস (একনিষ্ঠতা) পোষণ করা।

দ্বিতীয়ত : লাইলাতুল ক্বাদ্‌র নির্দিষ্ট কোন্‌ রাত তা নিয়ে ‘আলিমদের মাঝে এত ভিন্নমত রয়েছে যে তা ৪০-এরও বেশি মতামত পর্যন্ত পৌঁছেছে যেমনটি ‘ফাতহ আল-বারী’ তে উল্লেখিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সঠিক মতটি হল তা রমযান-এর শেষ দশকের বিজোড় রাতের কোন একটি।

‘‘আয়েশাহ্‌ -রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা- থেকে বর্ণিত হয়েছে যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

«تَحَرَّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنْ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ» .

رواه البخاري ( 2017 ) – واللفظ له - ومسلم ( 1169 )

“লাইলাতুল ক্বাদ্‌র রমযান-এর শেষ দশকের বিজোড় রাতে অনুসন্ধান কর।”

[এটি বর্ণনা করেছেন আল-বুখারী (২০১৭) শব্দচয়ন তাঁর। আরও বর্ণনা করেছেন মুসলিম (১১৬৯)]

আল-বুখারী এই হাদীসটিকে (রমযান এর) ‘শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বাদ্‌র অনুসন্ধান’ নামক অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

এই রাতটি নির্দিষ্ট কোন দিনে তা অপ্রকাশিত রাখার পেছনে হিক্‌মাহ (রহস্য) হল মুসলিমদেরকে রমযান এর শেষ দশকের সবগুলো রাতেই ‘ইবাদাত, দো‘আ ও যিক্‌র করার ব্যাপারে তৎপর হতে সক্রিয় করানো। একই হিক্‌মাহ এর কারণে জুমু‘আহ এর দিনে ঠিক কোন সময়টিতে দো‘আ কবুল করা হয় তাও নির্দিষ্ট করে বলা হয় নি এবং আল্লাহ তা‘আলার সেই ৯৯ টি নামও নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি যে সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :

( مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ ) رواه البخاري (2736) ومسلم (2677)

“যে তা (৯৯ টি নাম) গণনা করবে, [অর্থাৎ (১) মুখস্ত করবে, (২) এর অর্থ বুঝবে, (৩) সে অনুযায়ী আমল করবে] সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।” [এটি বর্ণনা করেছেন আল-বুখারী (২৭৩৬) ও মুসলিম (২৬৭৭)]

আল-হাফিয ইবনু হাজার -রাহিমাহুল্লাহ- বলেছেন : “তাঁর - অর্থাৎ ইমাম বুখারীর- বক্তব্য ‘অধ্যায় (বাব): রমযান এর শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বাদ্‌র অনুসন্ধান’ এই পাঠ থেকে রমযান মাসেই যে লাইলাতুল ক্বাদ্‌র হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল এই ইঙ্গিত পাওয়া যায়; এরপর এর (রমযানের) শেষ দশকে এবং এরপর এর (শেষ দশকের) বিজোড় রাতগুলোর যে কোনো একটিতে। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো রাতে নয়। এই সংক্রান্ত একাধিক বর্ণনা থেকে আমরা অনুরূপ ইঙ্গিত পাই।” [ফাত্‌হ আল-বারী (৪/২৬০)]

তিনি আরও বলেছেন : “আলিমগণ বলেন, এই রাতটির নির্দিষ্ট তারিখ গোপন রাখার পেছনে হিক্‌মাহ হল মানুষ এটি পাওয়ার জন্য চেষ্টা সাধনা করবে। তবে নির্দিষ্ট তারিখ জানা থাকলে মানুষ শুধু সেই রাতেই ‘ইবাদাত সীমাবদ্ধ রাখত যেমনটি এর আগে ব্যাখ্যা করা হয়েছে জুমু‘আহ-র দিনের (দো‘আ কবুলের) সুনির্দিষ্ট সময়ের (অজানা থাকার) ব্যাপারে।” [ফাত্‌হ আল-বারী (৪/২৬৬)]

তৃতীয়ত : এই মতের ভিত্তিতে কারো পক্ষে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয় কোন নির্দিষ্ট রাতটি ‘লাইলাতুল ক্বাদ্‌র’। বিশেষ করে যখন আমরা জানি যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটি কোন রাত তা সুনির্দিষ্টভাবে উম্মাতকে জানাতে চেয়েছিলেন কিন্তু পরে তিনি জানিয়েছেন যে, আল্লাহ –তা‘আলা-এই জ্ঞান উঠিয়ে নিয়েছেন।

‘উবাদাহ ইবনুস সামিত -রাদিয়াল্লাহু আনহু- থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘লাইলাতুল ক্বাদ্‌র’ এর ব্যাপারে খবর দিতে বের হলেন, (এ সময়) মুসলিমদের মধ্যে দু ব্যক্তি বিবাদে লিপ্ত হল। তিনি বললেন :

«إِنِّي خَرَجْتُ لأُخْبِرَكُمْ بِلَيْلَةِ الْقَدْرِ، وَإِنَّهُ تَلاحَى فُلانٌ وَفُلانٌ فَرُفِعَتْ، وَعَسَى أَنْ يَكُونَ خَيْرًا لَكُمْ، الْتَمِسُوهَا فِي السَّبْعِ وَالتِّسْعِ وَالْخَمْسِ». رواه البخاري ( 49 )

“আমি আপনাদেরকে ‘লাইলাতুল ক্বাদ্‌র’ এর ব্যাপারে খবর দিতে বের হয়েছিলাম কিন্তু অমুক এবং অমুক ব্যক্তি বিবাদে লিপ্ত হল, এরপর তা (সেই জ্ঞান) উঠিয়ে নেয়া হল, আশা করি তা আপনাদের জন্য বেশি ভাল হয়েছে, আপনারা তা সপ্তম (২৭ তম), নবম (২৯ম) এবং পঞ্চমে (২৫ম তারিখে) অনুসন্ধান করুন।”

[এটি বর্ণনা করেছেন আল-বুখারী (৪৯)]

ফাতওয়া বিষয়ক স্থায়ী কমিটির ‘আলিমগণ বলেন,

“রমযান মাসে নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল ক্বাদ্‌র হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য সুস্পষ্ট দালীলের প্রয়োজন। তবে অন্যান্য রাতের চেয়ে শেষ দশকের বিজোড় রাতগুলোর কোনো একটিতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি আর (এর মধ্যে) সাতাশ তম রাতে হওয়ার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশি; যার ইঙ্গিত পাওয়া যায় বিভিন্ন হাদীসসমূহে যা আমরা পূর্বে উল্লেখ করেছি।”

[ফাত্‌ওয়া আল-লাজ্‌নাহ আদ-দা’ইমাহ লিল বুহূস আল-‘‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা’ (১০/৪১৩)]

তাই নির্দিষ্ট কোনো রাতকে লাইলাতুল ক্বাদ্‌র হিসেবে চিহ্নিত করা একজন মুসলিমের জন্য উচিৎ নয়, কারণ এতে এমন ব্যাপারে দৃঢ় নিশ্চয়তা পোষণ করা হয়, যে ব্যাপারে দৃঢ় নিশ্চয়তা পোষণ করা সম্ভব নয়। আর এতে অনেক কল্যাণ ছুটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। হতে পারে এটি ২১তম রাতে অথবা ২৩তম রাতে অথবা ২৯তম রাতে। তাই সে যদি শুধু ২৭তম রাতে ক্বিয়াম করে তবে তার থেকে অফুরন্ত কল্যাণ ছুটে যেতে পারে, আবার হতে পারে সে এই মুবারাক (বরকতময়) রাত হারিয়ে ফেলতে পারে।

সুতরাং একজন মুসলিমের উচিৎ গোটা রমযান জুড়েই আনুগত্য ও ‘ইবাদাতের কাজে সর্বোচ্চ সাধনা চালানো, আর শেষ দশকে সে ব্যাপারে বেশি তৎপর হওয়া। এটিই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ।

‘আয়েশাহ্‌ -রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা- থেকে বর্ণিত যে তিনি বলেছেন :

«كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا دَخَلَ الْعَشْرُ شَدَّ مِئْزَرَهُ ، وَأَحْيَا لَيْلَهُ ، وَأَيْقَظَ أَهْلَهُ» .

رواه البخاري ( 2024 ) ومسلم ( 1174 )

“(রমযানের শেষ) দশ রাত্রি শুরু হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোমর বেঁধে নামতেন, তিনি নিজে তাঁর রাত জাগতেন (‘ইবাদাত এর মাধ্যমে) এবং তাঁর পরিবারবর্গকে জাগাতেন (‘ইবাদাতের জন্য)।”

[এটি বর্ণনা করেছেন আল-বুখারী (২০২৪) ও মুসলিম (১১৭৪)]

এবং আল্লাহই সবচেয়ে ভাল জানেন।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে