এক রুশ কূটনীতিক বাংলাদেশে বেশ কিছুদিন অবস্থান করে নিজ দেশে ফিরে গিয়ে মুসলিম হয়েছিলেন। বাংলাদেশের কী দেখে মুসলিম হলেন এবং কীসে আপনাকে ইসলাম গ্রহণ করতে উৎসাহিত করলো এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বিস্ময়কর একটা তথ্য দিলেন। তিনি বললেন, বাংলাদেশের দুর্নীতি ও অনিয়ম! তার জবাবে হতবাক সবাই। অনিয়ম-দুর্নীতি দেখে কেউ মুসলিম হয়? প্রশ্নকারীর বিস্ময় দেখে বিষয়টা খুলে বললেন এই নবমুসলিম। তিনি বললেন, বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যেখানে অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষ-উৎকোচ এবং উপরি কামাই ছাড়া কোনো কাজ হয় না। একজন পিয়নও উৎকোচের নিশ্চয়তা ছাড়া চিঠি পৌঁছায় না। ক্ষমতার দাপটে থাকা লোকেরা সাধারণ গ্রাম্য বিচার করেও ঘুষ খায়। এত অনিয়ম-দুর্নীতির পরও দেশটি টিকে আছে, দেশের মানুষ বেঁচে আছে! তাই আমি ভাবিত হই, কী করে একটা দেশের মানুষ এত অন্ধকারের মধ্যে বেঁচে থাকে? আমার ভাবনায় আসে নিশ্চয় এর পেছনে এমন কোনো শক্তি আছে, যা তাদেরকে এই অন্ধকারের মধ্যে বাঁচিয়ে রেখেছে, দেশটিকে টিকিয়ে রেখেছে। আর সেই শক্তি হচ্ছে ইসলাম। তাই আমি ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছি।’

এই হচ্ছে একজন বিদেশীর দৃষ্টিতে বাংলাদেশের দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র। মাঝেমধ্যে ভাবি, বাংলাদেশের দুর্নীতিরও একটা কীর্তি আছে- বিধর্মীদেরকে আলোর দিশা দিতে পারে! অন্ধকার আছে বলেই তো আলো! অন্ধকার বলেই তো আলোর মাহাত্ম্য! একারণেই বিচক্ষণ লোকেরা অন্ধকার থেকে আলোর দিশা নেয়, অন্ধকারের অপর পিঠে আলো খুঁজে বেড়ায়। যেমন খুঁজেছিলেন এবং পেয়েছিলেন এই রুশ নাগরিক।

কিন্তু সবাই আঁধারে আলো খোঁজে? অন্ধকারে পায় আলোর দিশা? না, অনেকে বরং অন্ধকার থেকেই অন্ধকারের পথে যাত্রা করে। এক পাপ থেকে রচনা করে আরেক পাপ এবং বৃহৎ পাপ। সেই পাপের পথের এক পথিকের যাত্রা কত মানুষের জীবনকে যে তছনছ করে দেয় তার হিসেব করা ভার। এই পথের যাত্রা শুধু একজন মানুষের জীবনকে ধ্বংস গহ্বরে নিক্ষেপ করে না, গোটা সমাজকে ঠেলে দেয় ভয়াবহ পরিণতির দিকে। এমনি একটি ঘটনার জনক আবিদ (ছদ্মনাম)। মানুষ বললে ভুল হবে- সম্ভ্রমখেকো জলজ্যান্ত এক নরপশু। পশুরাও একটা সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু আমরা মানুষরাই তা পারি না। চেষ্টা করি মনুষ্যত্বের সংজ্ঞা ভেদ করে পশু-নরকীট সব কিছুর সংজ্ঞা ছাড়িয়ে যেতে। যেমন করেছে আবিদ। পাশের বাড়ির একটা মেয়ে তাকে পছন্দ করত। চেষ্টা ছিল তার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে। মেয়েটির পরিবারও বিষয়টি চাইত। সহজ পথে কাজ হবে না ভেবে মেয়েটা এক অপকৌশলের আশ্রয় নেয়। একদিন আবিদের ফাঁকা বাড়িতে ঢুকে পড়ে অপবাদের বাষ্প ছড়াতে থাকে। ঘটনার বায়ু এলাকা গরম করে তুললে বিচার সাজানো হয়। চেষ্টা করা হয় মেয়েটিকে আবিদের সঙ্গে বিয়ে দিতে। কিন্তু আবিদের বাবা কোনোমতেই তা মানতে চান না। শেষ পর্যন্ত পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা জরিমানা করে আবিদকে মুক্তি দেয়া হয়।

সন্দেহ নেই, এক্ষেত্রে আবিদ মজলুম, অন্যায়ের শিকার। বাংলাদেশে এধরনের জুলুমের শিকার হন অনেকেই। কিন্তু এই জুলুম থেকে আবিদ পাপের যে দরজা উন্মুক্ত করে তা মানবতার আকাশে বিরাট দাগ ও কালি বলেই জ্ঞান করতে হবে। সে প্রতিজ্ঞা করে, নারী জাতির ওপর দিয়ে সে এই জুলুমের ঝাল মেটাবে। একটা নারীর বদলে শত শত নারীকে নষ্ট করবে। ইজ্জত-আব্রু ধ্বংস করবে। কী জঘন্য মনোবৃত্তি, নিষ্ঠুর প্রতিজ্ঞা। ‘নিজের পাপের শাস্তি নিজেই ভোগ করতে হবে এবং একজনের পাপ অন্যজন বহন করবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ وَلَا تَكۡسِبُ كُلُّ نَفۡسٍ إِلَّا عَلَيۡهَاۚ وَلَا تَزِرُ وَازِرَةٞ وِزۡرَ أُخۡرَىٰۚ ثُمَّ إِلَىٰ رَبِّكُم مَّرۡجِعُكُمۡ فَيُنَبِّئُكُم بِمَا كُنتُمۡ فِيهِ تَخۡتَلِفُونَ ١٦٤ ﴾ [الانعام: ١٦٤]

‘আর প্রতিটি ব্যক্তি যা অর্জন করে, তা শুধু তারই ওপর বর্তায়। আর কোনো ভারবহনকারী অন্যের ভার বহন করবে না। অতঃপর তোমাদের সবাইকে প্রতিপালকের কাছে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অনন্তর তিনি তোমাদেরকে বলে দেবেন, যেসব বিষয়ে তোমরা বিরোধ।’ (সূরা আল-আন‘আম, আয়াত : ১৬৪)

তাহলে এক মেয়ের অপরাধের কারণে কেন হাজার নারীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার প্রতিজ্ঞা? কেন একজনের বোঝা অপরজনের ওপর চাপানো? নিষ্ঠুর এই মনোবৃত্তি কত ভয়ংকর হতে পারে তার সবচেয়ে দৃষ্টান্ত সম্ভবত আবিদ। প্রতিশোধের এই জিঘাংসা নিয়ে পড়াশোনার উদ্দেশ্যে রংপুরের এক কলেজে ভর্তি হয় সে। পড়াশোনার চেয়ে জিঘাংসা বাস্তবায়ন করা তার প্রধান লক্ষ্য হয়ে ওঠে। প্রথমে টার্গেট করে রংপুরের মিঠাপুকুরের মেয়ে নীলিমাকে (ছদ্মনাম)। উত্তরাঞ্চলের মেয়েরা সরলতার অভিধায় প্রসিদ্ধ। নীলিমাও তার বাইরে নন। অবশ্য প্রথম প্রথম নীলিমা অপরিচিত লোকটার কথার ফাঁদে পা দিতে সংকোচ করেন। কিন্তু এক বিধ্বংসী জিঘাংসা নিয়ে কলেজে এসেছিল আবিদ। তাই তার এই জিঘাংসা পূরণ করতে ফাঁদের পর ফাঁদ পাততে থাকে। বিছাতে থাকে জালের পর জাল। যে জাল ছিন্ন করা নারীদের জন্য বিশেষত উত্তরাঞ্চলের সরল মেয়েদের জন্য দুরূহই বটে। তাই আবিদের মুখে বোন সম্বোধন শুনে মোমের মতো গলে যান নীলিমা। কথিত ভাইকে নেন আপন করে। আপনত্বের ঘড়ির কাঁটা স্বস্থানে দ্বিতীয়বার ফিরে আসেনি, ক্যালেণ্ডারের পাতায় যোগ হয়নি নতুন আরেকটি দিন, কিন্তু এই নতুন ভাইবোনের জীবন-দিগন্তে যেন উদিত হয়েছে আপনত্বের অনেকগুলো সূর্যিমামা, যেন অকৃত্রিমতার ক্যালেণ্ডারে যোগ হয়েছে অনেকগুলো দিন। তাই ছোটো ভাই বড় বোনকে ফোন দিয়ে জানায়, সে তাকে নিয়ে মেলায় ঘুরতে যাবে!

নীলিমা নিজেকে বোনের পরিচয়ে অকৃত্রিম ও উজাড় দেখতে চেয়েছিলেন। প্রথমে কিছুটা আমতা আমতা করলেও আবিদ তাকে ভাইবোনের পরিচয়ের নিখাঁদতা স্মরণ করিয়ে দেয়। বলে, আপু! ভাইবোনের সম্পর্কে কোনো ঝামেলা আছে? কী চমৎকার! যুগের ঘূর্ণিচাকায় প্রবাদের গাত্র বুঝি পিষ্ট হয়। পুরাতন প্রবাদের জায়গা দখল করে নেয় নতুন প্রবাদ- ‘পাতানো ভাইবোন যেখানে আপদ নেই সেখানে!’

আপদ মুক্তির নিশ্চয়তা পেয়ে পথে নামে নীলিমা। রওয়ানা হয় ছোটো ভাইয়ের সঙ্গে মেলায়। নীলিমাকে দেখে একটু হকচকিয়ে যায় আবিদ। এক জিঘাংসু প্রতিজ্ঞার প্রথম শিকার! সে তার টার্গেট পূরণ করতে পারবে তো? এগিয়ে চলে আবিদ। বুকে তার কম্পন, মনে উত্তেজনা আর চরিত্রে জিঘাংসার তাজা রক্ত।

কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আবিদ হঠাৎ বলে ওঠে তার প্রকৃতির ডাক এসেছে। উসখুসে ভাব দেখায় সে। বিব্রত নীলিমা সংকুচিত হয়ে পড়ে। তার কারণে ছোটো ভাইটি এই অসময়ে বিপদে পড়েছে, ভাবতেই কষ্ট লাগে তার। রিক্সা চলতে চলতে আবিদের হোস্টেলের কাছে এসে পড়ে। সে নীলিমাকে বলে, চলো হোস্টেলের কাছে এসে পড়েছি এখানে প্রয়োজনটা সেরে যাই! নীলিমা প্রথমে একটু ইতস্তত করে। সে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে চায়। কিন্তু অবিদ বলে, ছি! এভাবে বড় বোনকে বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখা যায়? কথা বাড়ায় না নীলিমা। ইতস্তত বিক্ষিপ্তপদে আবিদের হোস্টেলকক্ষে প্রবেশ করে সে।

হোস্টেলে ঢুকে অবাক হয়ে যায় নীলিমা। গোটা হোস্টেল ভবনে সুনসান নিরবতা। যেন পিনপতনের শব্দও শোনা যায় বহু দূর থেকে। বোনকে নিজকক্ষে বসিয়ে তড়িঘড়ি করে বাথরুমে প্রবেশ করে আবিদ। বাথরুম থেকে বের হয়ে কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই একেবারে ব্যঘ্র-ক্ষিপ্রতায় ‘বড়বোন’ নীলিমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আবিদ। সে পকেট থেকে ছোরা ও ব্লেড বের করে বলে ‘চেঁচালে সোজা গলায় পাড় মারবো। গায়ের কাপড় ছিঁড়ে ফেলে দিবো।’

নীলিমা ঘটনার আকস্মিকতায় হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। প্রতিরোধ ক্ষমতা নিস্তেজ হতে থাকে। ছিন্নবস্ত্রে ঘরে ফেরার অসম্ভব্যতার শঙ্কায় মূলোৎপাটিত বৃক্ষের মতো বিছানায় ধপাস করে বসে পড়ে। পরের ইতিহাস যেমনি বেদনায়ক তেমনি মর্মান্তিক। আবিদ বড়বোনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার কথা বলে বাসে ওঠে। বাসের হেল্পারের সঙ্গে চুক্তি করে নেয় সুযোগ মতো তাকে নামিয়ে দিলে একশত টাকা বকশিস দেবে। এভাবে চুক্তি করে গাড়িতে ওঠে নীলিমা-আবিদ। সিটে নিস্তব্ধ নীলিমা দূর আকাশের নীলিমাপানে তাকিয়ে থাকে। কোনো কথা ফোটে না তার মুখে। ভেতরে তার ঝড় বইছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সমাজ-সংসারের প্রতি তার তীব্র ঘৃণাবোধ সৃষ্টি হয়েছে। বাস কিছুদূর যাওয়ার পর বমির উদ্রেক দেখায় আবিদ। হেল্পার দৌড়ে আসে তাকে সাহায্য করার জন্য এবং বমি করানোর জন্য বাসের দরজার কাছে নিয়ে যায়। বমির ভাব করে এক পর্যায়ে বাস থেকে নেমে পড়ে আবিদ। হেল্পার বলে, উস্তাদ গাড়ি টান দেন। নীলিমার চোখের সামনেই ঘটছিল সব। ‘ছোটোভাই’কে থামানোর নূন্যতম প্রচেষ্টা করে না নীলিমা। সে কাঠখণ্ডে পরিণত হয়েছে। তাই চোখের সামনে যা দেখছে তা এক নিষ্ঠুর খেলার মতো মনে হচ্ছে তার কাছে। খেলোয়াড়রা তো খেলবেই, বাঁশি বাজিয়ে তাকে মাঝপথে থামানোর দরকার কি? তাই আবিদের বমির ভাব, ভাব করে নেমে যাওয়া, নেমে যেতে হেল্পারের সহযোগিতা সবকিছুই ঠিকঠাক ধরতে পেরেছিলেন নীলিমা। কিন্তু প্রতারণার শিকার হয়ে নারীসত্তার সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু হারিয়ে এসে নতুন করে পাওয়ার কিছু না থাকায় কোনোকিছুতেই বাধা দেননি তিনি।

জিঘাংসার মোড়ক উন্মোচন করে ঘরে ফিরে এলো আবিদ। রাত তখন দশটা। হঠাৎ নীলিমার ছোটো বোনের নাম্বার থেকে একটা ফোন এলো, ভাইয়া! নীলিমা আপু তো এখনো বাড়ি আসলো না...

হ্যাঁ, এক অপার্থিব বিশ্বাসে চরম প্রতারিত হয়ে আর কোনো দিন ঘরে ফেরেননি নীলিমা। কোথায় হারিয়ে গেছে তারও খোঁজ রাখেনি কেউ। নীলিমার পরিবারের লোকেরাও তার সন্ধান জানতে পারেনি। আবিদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে তারা। কেননা আবিদ প্রতিটি নারীর জন্য একটা করে নতুন সিম বরাদ্দ করত। ওই নারীর সম্ভ্রম লুট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নাম্বারটাও বন্ধ হয়ে যেত চিরদিনের জন্য।

জিঘাংসা বাস্তবায়ন আর নিত্য নারীদেহের গন্ধ আবিদকে আরো বেয়াড়া করে তোলে। সে নতুন নতুন শিকারের পেছনে ছুটতে থাকে। ঘুণে ধরা এই সমাজে উঁইপোকার মতো আগুন দেখে ছুটে আসতে থাকে হতভাগা নারী। দ্বিতীয় শিকার হিসেবে পায় মা-বাবাহারা এক ইয়াতিম মেয়ে। মেয়েটি ভাইয়ের কাছে থাকে। আবিদ নূন্যতম পরিচয়ের সূত্রে তার কাছে মোবাইল নাম্বার চাইলে মেয়েটি বলে, আমিই কল দেবো আপনাকে। এরপর একদিন রাতে কল দিয়ে সে আবিদের বাসায় আসে। সাক্ষাৎ ও কথার প্রথম পর্বেই আবিদ তাকে ধর্ষণ করে। অনেক কান্নাকাটি করে মেয়েটি। সে বলে, ‘আমি তো তোমাকে ভালোবাসিই, তোমার কাছে এমনিতেই আসব, এই কাজটা না করলেও পারতে! এই পাপের কারণে তোমার মুখ দেখাও অপরাধ।’

আবিদ বলে ঠিক আছে, তাই হবে। হবে না, এতো ভালোবাসা নয়; নারী বধের তামাশা! আবিদ নিজেই স্বীকার করে, কুমারী মেয়েদের ছেড়ে এরপর মহিলাদের দিকে নজর দিই। এদিকে রংপুরের ভিসা অফিসে দালালের কাজ শুরু করে আবিদ। সেই সূত্রে গাজীপুরের এক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে বিদেশে পাঠানোর জন্য ভিসা করতে আসে এবং ওই দিন ভিসা প্রক্রিয়া শেষ না হওয়ায় আবিদকে ‘বিশ্বাস’ করে তার দায়িত্বে রেখে যায়। শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দেয়া বোঝেন তো? কবি নয়; আমি এখানে নিরব...। এভাবে চলতে থাকে আবিদের নারীবধ। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ....।

আবিদ জানায়, পনের ষোলোটা মেয়ের জীবন নষ্ট করার পর ফেসবুকে যশোরের মেয়ে আখির সঙ্গে পরিচয় হয়। তার সঙ্গে আরেক ছেলের বন্ধুত্ব ছিল। ওই ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছুটিয়ে আমি তার সঙ্গে সম্পর্ক করি। আখির কথায় আমি ভালো হয়ে যাই। অন্য নারীদের সঙ্গে যেনার আক্রোশ কমে যায়। দুলো ভাইয়ের মাধ্যমে ছবি সংগ্রহ করি। পরে খুলনায় তার সঙ্গে দেখা করতে যাই। হোটেলে তিন ঘণ্টা কাটাই।....করি, ...ধরে থাকি। এসময় তার ছবিগুলো তুলে রাখি। সে অস্বীকার করে, লাইট বন্ধ করে দেয়। রাতে কথা বলি। আসার সময় সে রাস্তাতেই আমাকে...ধরে। আমি তাকে বলি, আমি চলে যাচ্ছি বটে কিন্তু জীবনটা তোমার হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি। এখন এটা জীবন্ত রাখলে রাখতে পারো মারলে মারতে পারো। তবে এই সম্পর্কও স্থায়ী হয় না। আখির সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর সে ঢাকায় আবার আগের পাপে জড়িয়ে পড়ে।

ঢাকায় সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় বাসা ভাড়া নিয়ে প্রতিবেশি বিবাহিত মেয়েদের সম্ভ্রম লুটে নেয়ার জন্য অবলম্বন করত চরম জঘন্যপন্থা। আবিদ নিজেই বলেছে, ‘ঢাকার ভালো ও অভিজাত ফ্যামিলিতে হাত দিতাম। এতে ঘটনা ফাঁস হওয়ার ভয় থাকত না। খারাপ হলে ফাঁস হওয়ার ভয়ে সেসব ফ্যামিলির সঙ্গে সম্পর্ক করতাম না।’

যারা ঢাকায় থাকেন তারা বোঝেন ঢাকার জীবন কতটা সংগ্রামমুখর। কতটা লড়াই করে এখানে টিকে থাকতে হয়। চাকরির স্বল্পতা, নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী গতি, এক ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে চার ঘণ্টা হাতে নেয়ার অপরিহার্যতা এবং বলাকা, সুপ্রভাত, তুরাগ, ৮নং, ২৭ নং গাড়ির আটত্রিশ সিটের গাড়িতে ৭০ জন করে উঠে ঝাঁকুনি খান আর ঘামে জবুথবু হয়ে যারা গন্তব্যে পৌঁছান, মাসে মাসে বাড়িওয়ালাদের তাড়া খেয়ে ভাড়া বাড়াতে গিয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখেন, ত্রিশ দিনের ওপরের দিনওয়ালা মাসগুলো যাদের কাছে ভীমরুলের মতো হুল ফোটায়, তারা সমাজ-সংসারে যে কতটা করুণা পাওয়ার যোগ্য, তা একমাত্র বিবেকবান মানুষই বোঝেন। কিন্তু বোঝে না আবিদরা। তাই এরা হাত দেয় এসব সংগ্রামমুখর মানুষদের ঘরে, হাত দেয় তাদের সম্ভ্রমগাত্রে। উস্কে দেয় তাদের ঘরণীদেরকে, যাদের জন্যই এরা এই কঠিন জীবনযাপন করছে। সে এসব নারীদেরকে উত্তেজিত করে স্বামীরা তাদের সময় দিতে পারে না বলে! স্ত্রীদেরকে নিয়ে বিনোদন করে না বলে! বাচ্চাকেও সময় দিচ্ছে না বলে! স্ত্রীদেরকে সে এভাবে উত্তেজিত করত এবং শেষে টোপ ফেলে বলত, আসুন আমি সময় দিই, আপনাকে নিয়ে ঘুরি, পার্কে, বিনোদনকেন্দ্রে, চিড়িয়াখানায়...

হায়রে বেঈমান বধূ! তুই স্বামীর শুধু রোমান্টিকতারই কাঙাল থাকলি! ভাবলি না, স্বামী কেন ও কার জন্য হাড়ভাঙা খাটুনি করেন? রোমান্টিকতা কি শুধু বাক্যস্ফূরণেই! তোর জন্য অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থা না করে স্বামী যদি সারাদিন তোর পাশে বসে বসে রোমান্টিক কথার ঝুলি খুলে বসতেন তবে কি তাতে পেট ভরত? দেহের আবরণ হতো? ঢাকার অট্রালিকায় বসবাস ও গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির সহজলভ্য উপকরণে তোর সাংসারিক জীবন আনন্দঘন হতো? হতভাগ্য পথিক, প্রস্তরখণ্ডের পাষণ্ডতাকে ভাবে দুশমন, অথচ ভাবে না, প্রস্তরের পাষণ্ডতাতেই তার পথ কণ্টকাকীর্ণ মুক্ত! অন্যথায় নরম কাদার গর্তে আটকে যেত তার চলার পথ, হারিয়ে যেত অচেনা ঠিকানায়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিও এইচ ও) ও ইংল্যান্ডের বিখ্যাত জরিপ সংস্থা আরপিও ১৫০০০ মানুষের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, প্রযুক্তির কোপে তাদের দাম্পত্যজীবনে ছন্দপতন ঘটছে। দু’টি বিশ্বখ্যাত সংস্থার করা এই সমীক্ষার রিপোর্ট দেখে লন্ডন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক ক্যাথ মার্সার বলেছেন, ‘বর্তমান প্রতিযোগিতার বাজারে সাধারণ মানুষ এমনিতেই মানসিক চাপে থাকেন। চাকরি, রোজগার, সব মিলিয়ে চিন্তার শেষ নেই। মন সায় না-দিলে শরীর কাজ করবে কীভাবে?’

[টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য টেলিগ্রাফ ও বিবিসি অনলাইন]

জরিপ, রিপোর্ট, বিবেক সবকিছুই বলে কর্মক্লান্ত পুরুষ এখানে নিতান্তই অপরাগ। সারাদিনের এই খাটুনি খেটে ক্ষুধার্ত, ঘর্মাক্ত স্বামীর পক্ষে খুব সঙ্গত কারণেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এমনিভাবে কর্মক্ষেত্র বাদ দিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে ঘুরতে যাওয়াও কোনো যুক্তিতে বৈধ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সমাজের কতিপয় দুষ্ট, বেকার, লম্পট ও দুশ্চরিত্র লোক নারীদেরকে এই অসম্ভব কাজেই স্বামীদেরকে দোষারোপ করে তাদেরকে বিপথগামী করছে। প্রতিবেশি সূত্রে যখন তখন কর্মব্যস্ত পুরুষের খালি ঘরে ঢুকে নারীদেরকে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে।

স্বামী-অনুপস্থিত নারীর ঘরে প্রবেশ ও তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতার মর্মান্তিক শাস্তির কথা হাদীসে বলা হয়েছে। ইমাম তাবারানী রহিমাহুল্লাহ উল্লেখ করেন-

«مَنْ قَعَدَ عَلَى فِرَاشِ مُغِيبَةٍ بُعِثَ لَهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ثُعْبَانٌ»

‘যে ব্যক্তি স্বামী অনুপস্থিত রমণীর ঘরে উপবেশন করবে আল্লাহ তা‘আলা কেয়ামত দিবসে তাকে দংশন করার জন্য একটি বিষাক্ত সাপ নিযুক্ত করবেন।’ [মুসনাদ আহমদ : ২২৫৬২, যঈফ]

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহিমাহুল্লাহ প্রতিবেশি সূত্রের ভিত্তিতে কোনো নারীর দিকে অপদৃষ্টি দেয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে লিখেন-

والجيران يأمن بعضهم بعضًا، ففى هذا من الظلم أكثر مما فى غيره، وجاره يجب عليه أن يحفظ امرأته من غيره، فكيف يفسدها هو . الكتاب : تفسير ابن تيمية

‘প্রতিবেশিরা একজন আরেকজন থেকে নিরাপদ থাকবে। ফলে প্রতিবেশির প্রতি জুলুম করা হলে তা অন্যদের প্রতি কৃত জুলুমের চেয়ে গুরুতর অন্যায়। সেহেতু প্রতিবেশির কর্তব্য হচ্ছে প্রতিবেশি নারীকে বহিরাগত লোকদের যে কোনো ক্ষতি থেকে হেফাজত করা। সুতরাং প্রতিবেশি নিজেই যদি ওই মহিলার দিকে হাত বাড়ায় তবে তা কী পরিমাণ ভয়াবহ অপরাধ হতে পারে?’

বিশ্বখ্যাত মুফাসসির আল্লামা শিহাবুদ্দিন মাহমুদ আলুসী রহিমাহুল্লাহ বলেন, প্রতিবেশি নারীর সঙ্গে অপকর্মে লিপ্ত হওয়া শুধু প্রতিবেশির হক নষ্ট করাই নয়, বরং অন্য সাধারণ যেনার চেয়ে এটা অধিকতর গুরুতর। কেননা,

وزنا الثيب أقبح من زنا البكر

‘কুমারী মেয়ের চেয়ে বিবাহিত নারীর সঙ্গে অপকর্ম করার অপরাধ ভয়ানক।’ [তাফসীরে রুহুল মাআনী]

মুফাসসির আবু আবদুল্লাহ মুস্তাফা আদাবী মিসরী বলেন-

مع أن كل الزنا حرام، لكن لأنك انتهكت حرمتين: حرمة الفرج المحرم، وحرمة الجار فكان التغليظ أشد.

‘সকল প্রকার যেনাই ভয়াবহ পাপ। কিন্তু প্রতিবেশি নারীর সঙ্গে তা অত্যন্ত কঠিন। কেননা এখানে দুটি হারাম কাজ বিদ্যমান। হারাম উপায়ে জৈবিক চাহিদা পূরণ এবং প্রতিবেশির অধিকার ক্ষুণ্ন করা। তাই এটা অন্য ব্যভিচারের চেয়ে মারাত্মক। [সিলসিলাতুত তাফসীর]

মুফাসসির আবু ইউসুফ মুহাম্মাদ জায়েদ ‘আলজাওয়াহিরুল হারিরিয়া মিন কালামি খায়রিল বারিয়া’ তাফসীর গ্রন্থে বলেন-

والزنا بحليلة الجار وهو داخل في الزنا والنهبة والغلول

‘প্রতিবেশি নারীর সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ায় একই সঙ্গে তিনটি গুনাহ সম্মিলনের কারণ। যথা, যেনা, ডাকাতি ও প্রতারণা।’

প্রতিবেশি নারীর ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করার সংস্কৃতি আমাদের এই তথাকথিত আধুনিক সভ্য সমাজে নিদারুণভাবে ব্যাহত হলেও যে জাহেলী যুগকে আমরা ঘৃণা করি সেই জাহেলী যুগেও অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে তা রক্ষা করা হতো। বিশ্বখ্যাত মুফাসসির ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন-

والزِّنَى - وإنْ كان من الكبائرِ والفواحش - لكنَّه بحليلة الجارِ أفحشُ وأقبح؛ لما ينضمُّ إليه من خيانةِ الجار ، وهَتْكِ ما عظَّم الله تعالى ورسولُهُ مِنْ حرمته ، وشِدَّةِ قبح ذلك شرعًا وعادة ؛ فلقد كانتِ الجاهليةُ يتمدَّحون بصون حريمِ الجارْ ، ويَغُضُّون دونهم الأبصارْ ؛ كما قال عنترة :

‘যে কোনো যেনাই অত্যন্ত জঘন্য ও অমার্জনীয় অশ্লীলতার অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু প্রতিবেশি নারীর সঙ্গে তা করা অনেক কারণেই মারাত্মক। কেননা এতে প্রতিবেশির হকের খেয়ানত, আল্লাহ তা‘আলা ও তদীয় রাসূলের গুরুত্বপূর্ণ নিষেধ লঙ্ঘনের মতো ধৃষ্টতা বিদ্যমান। তাছাড়া এই পাপটি শরীয়ত ও সামাজিকবোধ- উভয় দৃষ্টিতেই অত্যন্ত নিন্দীয় ও জঘন্য। একারণেই জাহেলী যুগের লোকেরাও প্রতিবেশির ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করাকে নিজেদের গৌরবজনক কাজ বলে মনে করত। আনতারা কবি বলেন-

وَأَغُضُّ طَرْفِي مَا بَدَتْ لِي جَارَتِي

حَتَّى يُوَارِيْ جَارَتِي مَأْوَاهَا

‘যখনই আমার প্রতিবেশি নারী আমার দৃষ্টিতে উদয় হয় তখনই আমি দৃষ্টি সংযত করি এবং যতক্ষণ না সে তার আবাসস্থলে প্রত্যাগমন করে ততক্ষণ পর্যন্ত দৃষ্টি বন্ধ রাখি।’ [আল মুফহিম লিমা আশকালা মিন তালখীসি কিতাবি মুসলিম]

বড্ড আফসোস! জাহেলী যুগের লোকেরা সৌজন্যবোধ লালন করেও ‘জাহেল সভ্যতার’ অপবাদ ঘোচাতে পারেনি। কিন্তু আমরা সৌজন্যবোধ, শালীনতা, আত্মমর্যাদাবোধ সবকিছু জলাঞ্জলি দিয়েও ‘সভ্য যুগের সভ্য নাগরিক’ তকমা লাগিয়ে অতীতকালের গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগিয়ে ইতিহাসের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছি!

এই ছড়ি ঘুরিয়েই আবিদ কারো কন্যা, কারো বোন, কারো মা, কারো স্ত্রীর সম্ভ্রমহানী করে। একজন, দুইজন, তিনজন... তেতাল্লিশজন নারী হয় তার জিঘাংসা ও সম্ভ্রমহানীর শিকার।

আবিদ ফিরে এসেছে কিনা তা জানি না। তবে আল্লাহয়ী আজাবের ঝলক কিঞ্চিত হলেও তাকে তাড়া করেছে। মাত্র এক রাতের মধ্যেই তার দুই হাত সহ শরীরের প্রায় গোটা অংশ শ্বেত হয়ে যায়। চিকিৎসগণ বিস্মিত হয়ে বলেছেন এই শ্বেত রোগ এত দ্রুত এক রাতের মধ্যে হওয়া সত্যি বিস্ময়কর!