ঘটনার পরে ঘটনা আসে এবং এক ঘটনার প্রেক্ষিত আরেক ঘটনার গুরুত্ব ও চাঞ্চল্য কমিয়ে দেয়। নারী যেদিন থেকে তার মর্যাদার ঘর ছেড়েছে, অনিশ্চিত জীবনের পথে পা বাড়িয়েছে সেদিন থেকে তার দুর্ভোগের পথে যাত্রা শুরু হয়েছে। এভাবে কখনও তার আত্মার মৃত্যু হচ্ছে, কখনও স্বামীর ঘর আস্ত জিন্দানখানায় পরিণত হয়েছে, আর কখনও বা রশির ফাঁসে মৃত্যু হচ্ছে। কোনো কোনো মৃত্যু হচ্ছে কলঙ্কময় আর কোনো কোনোটা চরম বিব্রতকর ও বেদনাদায়ক। কোনো কোনো মৃত্যু গোটা দেশের মানুষকে ভাবিত করে তুলছে। নিজের মৃত্যুর দায় চুকাতে হচ্ছে পরিবারের লোকদের। এক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রচিত হচ্ছে শত বিড়ম্বনা, বেদনা ও শোকাবহ হতাশা। কোনো কোনো ঘটনা পরবর্তীদের জন্য অনুসরণীয়-অনুকরণীয় হয়ে উঠছে। সেই সূত্রে পাপ হচ্ছে নিজের এবং তাদেরও, যারা পাপের পথ দেখিয়ে গেছে।
বেশ কয়েকবছর আগে খুলনা অঞ্চলে প্রেমিক-প্রেমিকাযুগল এক রশিতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছিল। সে সময় এই ঘটনা গোটা বাংলাদেশের মানুষকে নাড়া দিয়েছিল। ওই তো বলেছিলাম, এক ঘটনার প্রেক্ষিত আগের ঘটনার তীব্রতা ও ভীবৎসতা মুছে দেয়। সে কারণে আজকালের নানা ঘটনা খুলনার এই প্রেমিক-প্রেমিকাযুগলের স্মৃতি বিস্মৃতি করে দিচ্ছে। কারণ প্রেমিকযুগলের এক রশিতে মৃত্যু যেন এখন উৎসব ও প্রতিবাদের একমাত্র দাওয়াইতে পরিণত হয়েছে। কয়েকটি ঘটনা তো খুব কাছাকাছি সময়ে সংঘটিত হয়েছে। যেমন-
ঘটনা- ১ : অভিভাবকদের জব্দ করতে মৃত্যু মৃত্যু খেলা!
ছাতকের এক প্রেমিকযুগল একরশিতে আত্মহত্যা করেছে। কিছুদিন আগে ভোরের নির্জনতায় উপজেলার চরমহল্লা ইউনিয়নের টেটিয়ারচর গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। একরশিতে প্রেমিক যুগলের আত্মহত্যার ঘটনা এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। জানা যায়, গ্রামের আবদুস ছাত্তারের পুত্র আবদুল্লাহ (২৫) ও আফরুজ আলীর কন্যা কুলছুমা বেগম (১৯) সম্পর্কে তালতো ভাই-বোন। এ সুবাদে দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে গভীর প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের প্রেমের সম্পর্কটি উভয় পরিবার মেনে না নিয়ে প্রায় দু’সপ্তাহ আগে আবদুল্লাহর সঙ্গে কালিয়ারচর গ্রামের তার চাচাতো বোনের ও কুলছুমাকে ছাতক সদর ইউনিয়নের কাজিহাটা গ্রামে বিয়ে দেয়া হয়।
বিয়ে হলেও কুলছুমা-আব্দুল্লাহর প্রেমে নাকি এতটুকু ভাটা পড়েনি কিংবা তারা পরের ঘরে গিয়েও এবং পরের মেয়েকে ঘরে এনেও ভাটা পড়তে দেয়নি। বরং নতুন সংসারে, নতুন ভাটায় বৈধ ও পবিত্র জোয়ার আনার পরিবর্তে চালিয়ে গেছে পুরোনো ভাটায় জোয়ার আনার দাঁড়! ফলে যে কোনো উপায়ে চেষ্টা করেছে মা-বাবার স্থাপিত সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজেদের হাতে সম্পর্ক রচনার কসরত। এরই ধারাবাহিকতায় রমজান মাসে কুলছুমাকে পিত্রালয়ে নিয়ে আসা হলে প্রেমিক-প্রেমিকার যোগাযোগ আগের চেয়ে তীব্র হতে থাকে। উভয় পরিবারের সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করে কুলছুমা-আবদুল্লাহ রচিত করে নতুন এক প্রেম কাহিনী। ঘটনার দিন সকালে ছাতক-জাউয়া সড়কের আজাদ মিয়ার পুকুর পাড়ের একটি রেইন ন্ট্রি গাছে এক রশিতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করে প্রেমিকযুগল। ভোরে ঝুলন্ত লাশ দেখে পথচারীরা পুলিশে খবর দেয়। কান্নায় ভাসে দুটি পরিবার আর লজ্জায় ভাসে গোটা দেশ। নিমজ্জিত হয় সভ্যতা ও আমাদের মুসলিম তাহজিব-তামাদ্দুনবোধ!
ঘটনা- ২ : শেষ ঠিকানাও যেন হয় পাশাপাশি!
এ এক অন্যরকম প্রেম। একে অপরকে ভালোবেসেছেন ভীষণভাবে। এ ভালোবাসার স্বীকৃতি জীবনে পাবেন না বলে প্রেমিক-প্রেমিকা বেছে নিয়েছেন মৃত্যুর পথ। তাও আবার একসঙ্গেই। মৃত্যুর পরও তাদেরকে যেনো আলাদা করা না হয়, সে বার্তাও জানিয়ে গেছেন চিঠিতে!
ঘটনাটি ঘটেছে চট্টগ্রাম রাউজানের নোয়াপাড়া ইউনিয়নে হাজী মকবুল আহমদ সওদাগরের বাড়িতে। ঘটনার দিন রাত ২টার দিকে একসঙ্গে আত্মহত্যা করেছেন প্রেমিক রমজান আলী (২০) আর প্রেমিকা সুখী (১৬)। বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে আমগাছের ডালে শাড়িতে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন এ যুগল।
জানা যায়, আত্মহত্যার সময় দুজনের কোমর বাঁধা ছিল কাপড় দিয়ে। সেখান থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করে পুলিশ।
উদ্ধার করা চিরকুটে লেখা ছিল, ‘এই মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। সবার কাছে আমাদের অনুরোধ আমাদের দেহগুলো দয়া করে কাটতে দেবেন না। পাশাপাশিই আমাদের কবর দেবেন। সবাই আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। আমরা একজন আরেকজনকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না, তাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলাম। বেঁচে থাকতে তো আর কেউ আমাদের এই সর্ম্পক মেনে নেবে না। তাই এই পথ বেছে নিলাম।’
জানা গেছে, ‘রমজান আর সুখী সম্পর্কে বেয়াই-বেয়াইন ছিলেন। রমজান স্থানীয় নোয়াপাড়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আর সুখী নোয়াপাড়া মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। একই বাড়িতে পাশাপাশি ঘরের বাসিন্দা তারা। রমজানের বাবা সৌদী প্রবাসী আর সুখীর বাবা সিকিউরিটি গার্ড।
কয়েক বছর আগে রমজানের বড়ভাই আজগর প্রেম করে সুখীর বড়বোন লাকিকে পালিয়ে বিয়ে করেন। সুখীর পরিবার বিষয়টি মেনে নেয়নি। দুই পরিবারের সঙ্গে এখনও সর্ম্পক বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এরই মাঝে আছগরের ছোটভাই রমজানের সঙ্গে লাকি আকতারের ছোট বোন সুখীর সম্পর্ক গড়ে উঠে। বড়ভাই বোনের বিয়েকে দুই পরিবার মেনে নেয়নি বলে তাদের এ সম্পর্কও মেনে না নেয়ার ধারণা থেকে এই যুগল আত্মহত্যা করেছে বলে অনুমান করা হয়।
ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু মর্মান্তিকতার এই আখ্যান শেষ হবে কবে? শুধু চোখের পানি আর হাপিত্যেশ করেই কি অধপতন ঠেকানো যায়?
লক্ষ্য করে দেখবেন, উভয় ঘটনার সূত্র এক। তালতো ভাইবোন আর বেয়াই-বেয়াইনের প্রেমাখ্যান। হাদীসে কতভাবে যে এধরনের সম্পর্ক স্থাপনে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। বৈবাহিক সম্পর্কের এই আত্মীয়-স্বজনকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাক্ষাৎ মৃত্যু বলে আখ্যায়িত করেছেন। ‘উকবা ইবন আমের রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إِيَّاكُمْ وَالدُّخُولَ عَلَى النِّسَاءِ» فَقَالَ رَجُلٌ مِنَ الأَنْصَارِ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، أَفَرَأَيْتَ الحَمْوَ؟ قَالَ: «الحَمْوُ المَوْتُ»
‘পরনারীর কাছে প্রবেশ থেকে সাবধান থেকো। এক আনসারী সাহাবী বললেন, হে আল্লাহর রাসূল দেবর-ভাসুরের বিষয় কিভাবে দেখেন? তিনি বললেন, দেবর-ভাসুর তো সাক্ষাৎ মৃত্যু।’ [বুখারী : ৫২৩২]
কারণ চাচাতো, খালাতো, মামাতো ও ফুফাতো ভাইবোনের সম্পর্কের মধ্যে যে জবাবদিহিতা ও আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করার দায়বদ্ধতা আছে সেটা বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্রে স্থাপিত সম্পর্কে নেই। এমনিভাবে অনাত্মীয় নারীপুরুষে সংকোচ, পরিচয়হীনতার কারণে যে জড়তার সুযোগ থাকে সেটাও আত্মীয়তার সূত্রে স্থাপিত সম্পর্কে অনুপস্থিত। ফলে এই দুই সম্পর্কের মাঝামাঝি আত্মীয়তার সূত্রে স্থাপিত হয় এমন এক ভয়ানক সম্পর্ক, যেখানে না আছে জড়তা-সংকোচ, না আছে জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। ফলে এই সম্পর্কের লোকেরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে এবং সম্পর্কের ভিত্তিতে ঘটায় এমন অবস্থা, যা কোনো কোনো সময় বাস্তব মৃত্যুর চেয়ে ভয়ানক হয়ে দেখা দেয়।
হাদীসে একারণেই এধরনের সম্পর্ককে মৃত্যুকূপ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হাদীসবিশারদগণ এই হাদীসের অনেক রকম ব্যাখ্যা করেছেন। কেউ কেউ তাবিল ও ব্যাখ্যার ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে হাদীসের শাব্দিক অর্থ পরিহার করে এর অন্তর্নিহিত অর্থ গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন, ‘মৃত্যু যেমন ভয়ানক এই ধরনের সম্পর্কের পরনারী পুরুষও একে অপরের জন্য ভয়ানক। হাদীসে প্রকৃত মৃত্যু বোঝানো হয়নি।’ কেউ কেউ বলেন, এর দ্বারা ব্যক্তির দীনের মৃত্যু বোঝানো হয়েছে।
অন্যদিকে কোনো কোনো হাদীসবিশারদ কোনোরকম তাবিলের আশ্রয় না নিয়ে সোজাসুজি এর শাব্দিক অর্থ ও ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন, ‘বস্তুত বৈবাহিক সূত্রে স্থাপিত সম্পর্কের ভিত্তিতে অবাধ মেলামেশার কারণে অনেক সময় তা মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’ যেমন ইমাম কুরতুবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
خرج هذا مخرج قول العرب الأسد الموت، والحرب الموت، أي لقاؤه يفضي إلى الموت. وكذلك دخوله على المرأة قد يفضي إلى موت الدين أو إلى موتها بطلاقها عند غيرة الزوج أو إلى الرجم إن وقعت الفاحشة
‘বাক্যটি আরবরীতি অনুযায়ী বলা হয়েছে। যেমন বলা হয়, যুদ্ধ মৃত্যুর আরেক নাম তথা যুদ্ধই মৃত্যু, বাঘই মৃত্যু। অর্থাৎ যুদ্ধের মুখোমুখি হলে যেমন মৃত্যুর সম্ভাবনা দেখা দেয়, তেমনিভাবে গায়রে মাহরাম নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশায় মৃত্যুর কারণ সংঘটিত হয়। যেমন, অবাধ মেলামেশার কারণে স্ত্রীর প্রতি রুষ্ট হয়ে স্বামী কতৃর্ক তালাক প্রদান এবং তালাকের কারণে আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত লাগায় স্ত্রীর মৃত্যু কিংবা ব্যভিচার সংঘটিত হলে রজমের শাস্তিজনিত কারণে মৃত্যুবরণ।’
সত্যি এই হাদীসবিশারদগণ এই যুগের বাস্তবচিত্র তাদের দূরদর্শিতার আয়নায় প্রত্যক্ষ করেছিলেন। তাই আজ থেকে বহুবছর আগে তাঁরা যখন এই তাফসীর করেছেন তখন অনেকেই হাদীসের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ না করলেও আজ সেই অর্থই অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হচ্ছে!
এভাবে অবাধ মেলামেশার কারণে মৃত্যুর আশঙ্কাকে সুদূরপরাহত ভাবার কোনো কারণ নেই। অতীত ইতিহাসে এধরনের অনেক ঘটনার নজির পাওয়া যায়। মুনাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, ইমাম গাজালি রহিমাহুল্লাহ এক স্থানে উল্লেখ করেছেন- ‘বনী ইসরাঈলের জনৈক পাদ্রীর কাছে একবার এক যুবতী মেয়েকে আনা হলো এক রোগের চিকিৎসা করার জন্য। তিনি প্রথম অবস্থায় যুবতীর চিকিৎসা করতে অস্বীকার করলেন। কিন্তু তারা এতে পীড়াপীড়ি শুরু করে, যারফলে বাধ্য হয়ে ওই পাদ্রী তাকে নিজের কাছে রেখে দেন। পাদ্রীর সঙ্গে যুবতীর অবাধ মেলামেশার একপর্যায়ে শয়তান এসে তাকে কুমন্ত্রণা দিতে থাকে এবং পাদ্রীকে ব্যভিচারে লিপ্ত করায়। এতে যুবতী গর্ভবতী হয়ে পড়ে। শয়তান এবার নতুন ফাঁদ পাতে পাদ্রীর কাছে এসে কুমন্ত্রণা দেয়, এই ঘটনা প্রকাশ পেলে লাঞ্ছনার শিকার হতে হবে। তাই যুবতীকে হত্যা করে ফেলো। কুমন্ত্রণা অনুযায়ী পাদ্রী তাকে হত্যা করে। এরপর শয়তান যুবতীর পরিবারে যায় এবং তাদেরকে পাদ্রীর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে। ফলে তারা তাকে বন্দি করে এবং হুমকি-ধমকি দেয়া শুরু করে। শয়তান আবার আসে পাদ্রীর কাছে। তাকে বলে, আমাকে সিজদা করো, তোমার মুক্তির ব্যবস্থা হবে। দিশেহারা পাদ্রী জীবন বাঁচানোর জন্য শয়তানকে সিজদা করে।’
নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা কত ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে, এই ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তাই যদি আজই সতর্ক না হই তবে অহরহ ঘটতে থাকবে একরশিতে নারীপুরুষের ঝুলে পড়ার এই মৃত্যুখেলা। অভিভাবকরা আর কতদিন এভাবে সন্তানের মৃত্যুখেলার অসহায় দর্শক হয়ে অশ্রুপাত করবে?