উত্তর: এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অতিদীর্ঘ একটি প্রশ্ন। মুমিন ও অমুসলিমের মধ্যকার পার্থক্যই সত্য ও মিথ্যা, সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগা নির্ধারিত হয়। জেনে রাখুন, প্রকৃত মুমিন সেই যিনি আল্লাহ প্রতি ঈমান আনে, কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত তাঁর নাম ও সিফাতসমূহ জেনে বুঝে যথাযথভাবে ঈমান আনে এবং এগুলো স্বীকার করে ও যা কিছু আল্লাহর নাম ও সিফাতের বিপরীত সেগুলো থেকে তাঁকে পবিত্র রাখে। এতে তার অন্তর ঈমান, ইলম, ইয়াকীন, প্রশান্তি ও আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনে ভরে যায়। ফলে সে একমাত্র আল্লাহর দিকে ঝুঁকে, তাঁর অনুগত হয়, তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে ইবাদত শরী‘আতসম্মত করেছেন ঠিক সেভাবেই সে একনিষ্ঠার সাথে সাওয়াবের আশায় ও আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইবাদত-বন্দেগী করে। এতে সে অন্তরে, ভাষায় ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে আল্লাহর অশেষ নি‘আমত ও দয়ার শুকরিয়া আদায় করে, সে সার্বক্ষণিক আল্লাহর যিকিরে (স্মরণে) মশগুল থাকে। তখন সে আল্লাহর স্মরণের চেয়ে বড় কোন নি‘আমত দেখতে পায় না, এর চেয়ে বড় সম্মান সে অনুভব করে না। একমাত্র আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন ও তাঁর স্মরণের তুলনায় তার কাছে দুনিয়ার ভোগ-বিলাস অতি তুচ্ছ ও নগন্য ব্যাপার মনে হয়। এতদ্বসত্ত্বেও সে দুনিয়ার জীবনের যথার্থ অংশ ভোগ করে, কাফির, নাস্তিক ও অসচেতনের মতো ঢালাও ভাবে দুনিয়ার ভোগ-বিলাসে মত্ত থাকে না। বরং এগুলোকে আল্লাহর হক ও বান্দার হক আদায়ের উপকরণ ও সহযোগিতা হিসাবে ব্যবহার করে। এধরণের আত্মসমালোচনা ও আকাঙ্ক্ষা তার ভোগকে পূর্ণতা দান করে, অন্তর প্রশান্ত হয় ও সুখ-বোধ হয় এবং তার পছন্দনীয় কিছু না পেলে তাতে দু:খিত ও চিন্তিত হয় না। আর এভাবে আল্লাহ তার মাঝে দুনিয়া ও আখিরাতের সুখ-সৌভাগ্য একত্রিত করে দেন। অন্যদিকে কাফির ও নাস্তিকরা মুমিনের সম্পূর্ণ বিপরীত। সে মহান রব আল্লাহকেই অস্বীকার করে যিনি তার অস্তিত্বের ও পরিপূর্ণতার প্রমাণে বিবেকপ্রসূত দলীল, কুরআন হাদীসের দলীল, অত্যাবশ্যকীয় বিজ্ঞান ও ইন্দ্রিয় বিজ্ঞানসম্মত অসংখ্য দলীল-প্রমাণ পেশ করেছেন; কিন্তু এসব প্রমাণাদির প্রতি সে ভ্রুক্ষেপ করে না। ফলে সে যখন আল্লাহর বিশ্বাস, স্বীকৃতি ও ইবাদাত বিমুখ হয় তখন সে প্রকৃতির পূজারীতে পরিণত হয়। তখন তার অন্তর চতুষ্পদ প্রাণীর অন্তরে পরিণত হয়। পার্থিব ভোগ-বিলাস, আমোদ-ফুর্তি ছাড়া তার আর কোনো উদ্দেশ্য থাকে না। তার অন্তর সর্বদা অশান্তিতে থাকে; বরং নিজের প্রিয় ও পছন্দনীয় জিনিস হারানোর ভয়ে শঙ্কিত, অন্যের ষড়যন্ত্র ও ক্ষতির আশঙ্কায় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকে। তার আল্লাহর প্রতি ঈমান নেই যে, তিনি কেউ তার বিপদাপদ ও বালা-মুসিবত সহজকরণ ও দূরীকরণ করতে পারে। ফলে সে ঈমানের স্বাদ, আল্লাহর নৈকট্য মজা এবং ঈমানের দুনিয়া ও আখিরাতের ফলাফল থেকে বঞ্চিত থাকে। সে তার কর্মের সাওয়াব প্রত্যাশা করে না আবার অন্যায়েরও শাস্তির ভয় করে না; বরং তার ভয় ও প্রত্যাশা শুধু পার্থিব নগণ্য জিনিস অর্জন।
মুমিনের বৈশিষ্ট্য হলো সে জাতি বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে কথা-বার্তা, কাজে-কর্মে ও নিয়তে সত্যের অনুসন্ধানী, সৃষ্টিকুলের প্রতি বিনয়ী, আল্লাহর বান্দাদের প্রতি হিতাকাঙ্ক্ষী। পক্ষান্তরে কাফির ও নাস্তিকদের বৈশিষ্ট্য হলো সত্য ও সৃষ্টিকুলের ব্যাপারে অহংকারী, আত্মকেন্দ্রিক ও কাউকে কোনো সদুপদেশ দেয় না। মুমিনের অন্তর ধোঁকাবাজি, প্রতারণা ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত। সে নিজের জন্য যা পছন্দ করে অন্যান্য মুসলিমের জন্য তা-ই পছন্দ করে এবং নিজের জন্য যা অপছন্দ করে অন্য মুসলিমের জন্যও তা অপছন্দ করে। সে সাধ্যমত অন্যের কল্যাণ সাধন করে, সৃষ্টিকুলের দুঃখ-কষ্ট নিজে বহন করে, কোনো ভাবেই অন্যের ওপর যুলুম করে না। পক্ষান্তরে, কাফির ব্যক্তির অন্তর প্রতিহিংসা, শত্রুতায় ভরপুর, পার্থিব স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্যের জন্য কোনো উপকার ও কল্যাণ সাধন করে না, সুযোগ পেলেই সৃষ্টিকুলের ওপর যুলুম করতে দ্বিধাবোধ করে না, মানুষের বালা-মুসিবত সহ্য করার ক্ষেত্রে সে সবচেয়ে দুর্বলে পরিণত হয়। মুমিন সর্বদা সত্যবাদী ও উত্তম আচরণকারী। সহনশীলতা, শান্ত-শিষ্টতা, দয়া, ধৈর্যশীলতা, ওয়াদাপূরণ, সহজতা, নম্র স্বভাব ইত্যাদি মুমিনের গুণ। অন্যদিকে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা, কঠোরতা, অধৈর্যতা, ভীরুতা, উদ্বিগ্নতা, মিথ্যাচারীতা, ওয়াদা খেলাফ ও দুশ্চরিত্র ইত্যাদি কাফিরের গুণ।
মুসলিম আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে মাথা নত করে না। তার অন্তর ও মুখমণ্ডল তার রব ব্যতীত অন্যের কাছে অবনত হওয়া থেকে সর্বদা পবিত্র থাকে। তার বৈশিষ্ট্য হলো পবিত্রতা, শক্তিশালী, বীরত্ব, দানশীল ও পুরুষত্বতা। সে সবার জন্য শুধু উত্তম কিছুই পছন্দ করে। অন্যদিকে কাফির ও নাস্তিক এর বিপরীত। তার অন্তর সর্বদা সৃষ্টিকুলের ভয় ও প্রাপ্তির জন্য ব্যাকুল থাকে, সে নিজের স্বার্থেই তাদের জন্য ব্যয় করে, তার নেই কোনো পবিত্রতা, সচ্চরিত্রতা। শুধু গণগ্য উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তার রয়েছে শক্তি ও বীরত্ব। তার পুরুষত্ব ও মানবতা নেই। ভালো বা মন্দ যাই হোক তা অর্জনে সে পরোয়া করে না। মুসলিম ব্যক্তি কোন বস্তু অর্জনের জন্য সেটির উপকারী উপকরণ সংগ্রহ করে আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে এবং তারই উপর নির্ভর করে সকল কাজে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করে আর আল্লাহ বান্দার কাজে সাহায্য করেন। অন্যদিকে কাফিরের কোনো তাওয়াক্কুল নেই, তার নিজের দুর্বলতার দিকে দৃষ্টিপাত ছাড়া তার কোনো দূরদৃষ্টি নেই, কখনো কখনো আল্লাহ তাকে সাহায্য করেন আবার কখনো তার উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সাহায্য না করে লাঞ্ছিত করেন। ফলে তার উদ্দেশ্য সফল করা হলে সে এটিকে তার ক্রমান্বয়ে করা কাজের সফলতা মনে করে।
মুমিন কোনো নি‘আমত প্রাপ্ত হলে এর শুকরিয়া আদায় করে, সে উপকারী কাজে তা অন্যের জন্য ব্যয় করে। এতে তার কাছে আরো কল্যাণ ও বরকত ফিরে আসে। অন্যদিকে অমুসলিমরা নি‘আমতদাতার থেকে অত্যন্ত নিকৃষ্ট পদ্ধতিতে, দাম্ভিকভাবে নি‘আমত লাভ করে, সে উপকারীর শুকরিয়া আদায় থেকে বিরত থাকে, নিজের হীন উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তা ব্যয় করে, অথচ তার এ সম্পদ খুব দ্রুত নিঃশেষ হয়ে যায় এবং অচিরেই তার থেকে চলে যায়। মুমিনের বিপদাপদ ও বালা-মুসিবত আসলে ধৈর্য ও সহনশীলতা, এর বিনিময় সাওয়াবের প্রত্যাশা এবং এ বিপদ দ্রুত চলে যাওয়ার আশায় তা মোকাবিলা করে। ফলে তার পছন্দনীয় যা কিছু হারায় বা অপছন্দনীয় যা কিছু অর্জন করে এর বিনিময়ে এর চেয়ে উত্তম ও অধিক সাওয়াব লাভ করে। অপরদিকে কাফিরের কোনো প্রিয় বস্তু হারিয়ে গেলে সে এটিকে উদ্বিগ্ন উৎকণ্ঠার কারণ মনে করে, এতে তার মুসিবত আরও বেড়ে যায় এবং তার প্রকাশ্য কষ্টের সাথে মনের কষ্টও একত্রিত হয়। কখনও কখনও সে ধৈর্যহারা হয়ে পরে এবং তার এ বিপদের কোনো প্রতিদানের আশা নেই। ফলে তার হতাশা ও দুঃশ্চিন্তা বেড়েই চলে। মুমিন সমস্ত নবী ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনে, তাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা প্রদান করে, সমস্ত সৃষ্টির উপরে তাদেরকে ভালোবাসে, তারা স্বীকার করে যে, কিয়ামতের দিনে তারা যেসব নি‘আমত ও প্রতিদান লাভ করবে তা তাদের অনুসরণ ও উপদেশের কারণেই এবং সেদিন সৃষ্টিকুল যে অকল্যাণ ও ক্ষতির সম্মুখীন হবে তা তাদের বিরোধিতা ও অনুসরণ না করার কারণে। নবী-রাসূলগণ সর্বোত্তম সৃষ্টি, বিশেষ করে নবীদের সর্দার ও সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, আল্লাহ তাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ করেছেন এবং সব কল্যাণ, সংস্কার ও হিদায়াতের জন্য তাকে প্রেরণ করেছেন।
পক্ষান্তরে, কাফিররা মুমিনদের বিপরীত। তারা রাসূলদের শত্রুদেরকে সম্মান করে, তাদের মতামতকে সম্মান করে, তাদের পূর্বসূরিদের মতো তারাও নবীদের আনিত বিষয়গুলো নিয়ে উপহাস ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। তাদের নির্বুদ্ধিতা ও চারিত্রিক অধঃপতনের কারণে এসব কাজ করে থাকে। মুমিনগণ সাহাবী, মুসলিমদের ইমাম ও হিদায়াতের বাণী প্রচারক ইমামদেরকে ভালোবাসে; কিন্তু কাফির এর বিপরীত। মুমিন একমাত্র আল্লাহর ইখলাসের কারণে সে সব কাজ শুধু আল্লাহর জন্যই করে এবং উত্তমরূপে আল্লাহর ইবাদত পালন করে; অন্যদিকে কাফিরের তুচ্ছ উদ্দেশ্য ব্যতীত তার কাজের কোনো লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নেই। মুমিন ইলমে নাফে‘ তথা উপকারী ইলম ও সহীহ ঈমান, আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য এগিয়ে আসা, আল্লাহর স্মরণ ও সৃষ্টিকুলের উপকার সাধন ইত্যাদির ব্যাপারে প্রশস্ত হৃদয়ের, উদার মনের। সব ধরণের নিকৃষ্ট গুণাবলী ও পঙ্কিলতা থেকে তার অন্তর পবিত্র। আর গাফিল কাফিরের মধ্যে অন্তর প্রশস্ততার কারণগুলো না থাকায় তারা এসব গুণাবলীর বিপরীত।