যারা সিফাতসমূহকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে তাবিল তথা দূর ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয় তাদের মধ্যে একদল আছে এমন যারা কুরআন-সুন্নাহয় সিফাত-বিষয়ক কিছু টেক্সট সম্পর্কে আহেল সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। তাদের দাবি এই যে আহলে সুন্নাত এই টেক্সটসমূহকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে অন্য অর্থে নিয়ে থাকেন। তাদের এ প্রশ্ন উত্থাপনের মূল লক্ষ্য আহলে সুন্নাতকে তাবিলপন্থীদের দলে শামিল করে নেওয়া এবং আহলে সুন্নাতের মধ্যে ও তাদের মধ্যে যে কোনো পার্থক্য নেই তা প্রমাণ করা।
যারা এরূপ প্রশ্ন করেন, দু পর্যায়ে তাদের উত্তর দিতে চাই। প্রথম পর্যায়ে সংক্ষিপ্তভাবে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে বিস্তারিতভাবে:
প্রথমত: সংক্ষিপ্ত জবাব আর তা দুভাবে:
এক. আমরা এটা মানি না যে আহলে সুন্নাতের ব্যাখ্যা সিফাত বিষয়ক কিছু টেক্সটকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দেয়; কারণ বাহ্যিক অর্থ বলতে বুঝায় কোনো কথা সামনে আসামাত্র যে অর্থটি মাথায় উঁকি দেয়। আর এ বাহ্যিক অর্থ কথার কনটেক্সট হিসেবে, কথাকে যার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে উল্লেখ করা হয় তার হিসেবে, ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। পাশাপাশি বাক্যের গাঁথুনি হিসেবেও শব্দার্থের পরিবর্তন হয়। আর একটি বাণী তো কিছু শব্দ ও বাক্যের সমন্বয়েই তৈরি হয়। অতএব একটিকে অন্যটির সঙ্গে মেলানোর পরই অর্থ উদ্ধার হয়।
দুই. যদি আমরা মেনেও নিই যে আহলে সুন্নাত যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা কিছু টেক্সটকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দেয়, তবে তারা এরূপ করেছেন কুরআন-সুন্নাহর দলিলের ভিত্তিতে। হয়তো টেক্সটের সঙ্গেই থাকা দলিল অথবা অন্য কোথাও থাকা দলিল। তারা নিছক কিছু সংশয়-সন্দেহকে দলিল হিসেবে সাব্যস্ত করেননি, অথচ এসব সংশয়-সন্দেহকেই আহলে তা‘তীল অকাট্য প্রমাণ হিসেবে মনে করে এবং আল্লাহর জন্য তা সাব্যস্ত করে যা তিনি নিজের জন্য সাব্যস্ত করেননি।
দ্বিতীয়ত: বিস্তারিত জবাব
এ পর্যায়ে ওইসব টেক্সট সম্পর্কে আলোচনা করব যেগুলোর ব্যাপারে বলা হয় যে আহলে সুন্নাত তা বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। নিম্নবর্ণিত উদাহরণগুলো থেকে তা বুঝা যাবে। তাহলে ইমাম গাযালীর একটি কথা উল্লেখের মাধ্যমে শুরু করি। ইমাম গাযালী হাম্বলী মাযহাবের কোনো ব্যক্তির বরাত দিয়ে উল্লেখ করেন যে, ‘ইমাম আহমদ তিন জায়গা ছাড়া অন্য কোথাও তাবিল করেননি। এ তিন জায়গা হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত তিনটি হাদীস:
الحجر الأسود يمين الله في الأرض
হজরে আসওয়াদ জমীনের বুকে আল্লাহর ডান হাত
قلوب العباد بين أصبعين من أصابع الرحمن
বান্দাদের অন্তরসমূহ দয়াময়ের আঙ্গুলসমূহের মধ্যে দু’আঙ্গুলের মাঝখানে।
إني أجد نفس الرحمن من قبل اليمن
নিশ্চয় আমি আল্লাহর (বান্দাদের) নাফস (বিপদমুক্তির বিষয়টি) ইয়েমেনবাসীদের দিকে পাই।
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া উক্ত হাদীসগুলো ইমাম গাযালী থেকে বর্ণনা করে মাজমুউল ফাতাওয়ায় উল্লেখ করেছেন। (খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ৩৯৮)
এরপর তিনি বলেছেন, ‘এ ঘটনাটি ইমাম আহমদের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার’।
প্রথম উদাহরণ: ‘হজরে আসওয়াদ পৃথিবীতে আল্লাহর ডান হাত’।
এর উত্তর: উক্ত হাদীসটি বাতিল হাদীস। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে উক্ত হাদীসটি প্রমাণিত হয়নি। ইমাম ইবনুল জাওযী ‘আল ইলাল আল মুতানাহিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন যে, ‘এ হাদীসটি সহীহ নয়’। ইবনুল আরাবী বলেন, ‘এটি একটি বাতিল হাদীস, যার প্রতি তাকানো হবে না।’ শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন, ‘এ হাদীসটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অপ্রমাণিত সনদে বর্ণিত হয়েছে।’ অতএব এ হাদীসের অর্থ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। তবু শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন: ‘এটা প্রসিদ্ধ যে উক্ত হাদীস ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত হয়েছে। আর পুরো হাদীসটি হলো এ রকম:
«الحجر الأسود يمين الله في الأرض، فمن صافحه وقبله، فكأنما صافح الله وقبل يمينه»
হজরে আসওয়াদ পৃথিবীতে আল্লাহ তা‘আলার ডান হাত। যে তার সঙ্গে হাত মেলাল এবং চুম্বন করল, সে যেন আল্লাহর সঙ্গে মুসাফাহা করল এবং তাঁর ডান হাত চুম্বন করল।
যে ব্যক্তি উক্ত হাদীসের শব্দমালায় গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করবে সে বুঝতে পারবে এর শব্দমালায় কোনো সমস্যা নেই; কেননা এতে বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীতে আল্লাহর ডান হাত’। অর্থাৎ এখানে শব্দকে বন্ধনযুক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে, উন্মুক্তভাবে বলা হয়নি যে, ‘আল্লাহর ডান হাত’ বরং বলা হয়েছে, ‘পৃথিবীতে আল্লাহর ডান হাত’। আর কোনো শব্দকে উন্মুক্তভাবে উল্লেখ করা ও বন্ধনযুক্ত করে উল্লেখ করার মধ্যে অর্থগতভাবে পার্থক্য রয়েছে। এরপর তিনি বলেন: ‘যে তার সঙ্গে হাত মেলাল ও মুসাফাহা করল সে যেন আল্লাহর সঙ্গেই মুসাফাহা করল। অতএব হাদীসটি শুরুর অংশ এবং শেষের অংশ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, হজরে আসওয়াদ আল্লাহ তা‘আলার সিফাতের মধ্যে শামিল নয়। প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তির জন্যই এ বিষয়টি পরিষ্কার। (মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৯৮)
এর উত্তর: এ হাদীসটি সহীহ। ইমাম মুসলিম উক্ত হাদীসটি তার গ্রন্থে আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবন আস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছেন:
«إن قلوب بني آدم كلها بين إصبعين من أصابع الرحمن كقلب واحد يصرفه حيث يشاء»
নিশ্চয় আদম সন্তানের সকল অন্তর দয়াময়ের আঙ্গুলসমূহের মধ্যে দু'আঙ্গুলের মাঝখানে, এক অন্তরের মতো যা তিনি তার ইচ্ছানুযায়ী নিয়ন্ত্রণ করেন।
এরপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«اللهم مصرف القلوب، صرف قلوبنا على طاعتك»
হে আল্লাহ, অন্তরসমূহের নিয়ন্ত্রণকারী! আপনি আমাদের অন্তরসমূহ আপনার আনুগত্যের ওপর স্থির করুন।
আহলে সুন্নাত এবং সালাফগণ হাদীসটিকে বাহ্যিক অর্থেই নিয়েছেন। তারা বলেছেন, প্রকৃত অর্থে আল্লাহ তা‘আলার আঙ্গুল আছে একথা আমরা আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করি, যেভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছেন। আর আল্লাহ তা‘আলার দু‘আঙ্গুলের মাঝখানে বান্দাদের অন্তর থাকে একথার দাবি এটা নয় যে আল্লাহ তা‘আলার আঙ্গুল বান্দাদের অন্তরসমূহ স্পর্শ করে আছে। হাদীসের শব্দমালা থেকে স্পর্শ করে থাকার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না। অতএব বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে অন্য অর্থ নেয়ার আদৌ কোনো প্রয়োজন নেই। এর উদাহরণ, যদি কেউ বলে যে মেঘমালা জমিন ও আসমানের মাঝখানে, তাহলে এ বক্তব্যের অর্থ এটা নয় যে মেঘমালা জমীন ও আসমানকে স্পর্শ করে আছে। অনুরূপভাবে যদি বলা হয় যে বদরপ্রান্তর মক্কা ও মদীনার মাঝখানে, তাহলে এর অর্থ এটা নয় যে বদরপ্রান্তর মক্কা ও মদীনাকে স্পর্শ করে আছে। অতএব বান্দাদের সকল অন্তর প্রকৃত অর্থেই আল্লাহ তা‘আলার আঙ্গুলসমূহের মধ্যে দু‘আঙ্গুলের মাঝখানে, তবে এ মাঝখানে থাকাটা স্পর্শকে আবশ্যক করে না। না আবশ্যক করে সত্তাগতভাবে বান্দাদের সঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা সংমিশ্রণকে যাকে আরবীতে ‘হুলুল’ বলা হয়।
এর উত্তর: এ হাদীসটি ইমাম আহমদ তার মুসনাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন (খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৪১)। হাদীসটি আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ‘ঈমান হলো ইয়েমেনি এবং প্রজ্ঞাও হলো ইয়েমেনি। আর নিশ্চয় আমি আল্লাহর (বান্দাদের) নাফস (বিপদমুক্তি) ইয়েমেনবাসীদের পক্ষ থেকে পাই।’ (হাইসামী) মাজমাউয যাওয়ায়িদ গ্রন্থে এসেছে, এ হাদীসটির বর্ণনাকারীগণ সহীহ হাদীস বর্ণনাকারীদের অন্তর্ভুক্ত। তবে শাবীব ছাড়া; তিনিও হলেন ছিকাহ অর্থাৎ বিশ্বস্ত। ‘তাকরীব’ গ্রন্থে এসেছে, শাবীব হলেন তৃতীয় তাবাকার বিশ্বস্ত বর্ণনাকরী। ইমাম বুখারী ‘আত-তারীখুল কাবীর’ গ্রন্থে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইমাম গাযালীর কথা অনুযায়ী ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল এ হাদীসটিকে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে এর অন্য অর্থ করেছেন। কিন্তু মূল বিষয় সে রকম নয়। কেননা হাদীসটিতে যে نفس শব্দটি এসেছে তার উচ্চারণ হবে ‘নাফাস’ ‘নাফ্স’ নয়। নাফ্স শব্দের অর্থ অন্তর। অতএব নাফ্স বললে হাদীসটির অর্থ দাঁড়াত: ‘আমি দয়াময়ের অন্তরকে ইয়েমেনের দিকে পাই’। কিন্তু এখানে নাফ্স উদ্দেশ্য নয় বরং উদ্দেশ্য হলো নাফাস। নির্ভরযোগ্য আরবী আভিধানগ্রন্থ ‘মাকাইসুল্লগাহ’ - তে নাফাস শব্দের অর্থ করা হয়েছে, ‘এমন জিনিস যার মাধ্যমে বিপদ থেকে মুক্তিলাভ করা যায়।’ সে হিসেবে হাদীসটি অর্থ দাঁড়াবে, ‘আল্লাহ তা‘আলা ইয়েমেনবাসীদের মাধ্যমে বান্দাদের বিপদমুক্ত করবেন।’
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেন: ‘এই ইয়েমেনবাসীরাই মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং বিভিন্ন শহর জয় করেছে। অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা তাদের মাধ্যমেই নানা সমস্যা থেকে মুমিনদের উদ্ধার করেছেন। (মাজমুউল ফাতাওয়া: খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৩৯৮)
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় আহলে সুন্নাতের দুটি বক্তব্য রয়েছে:
প্রথম বক্তব্য: এখানে ‘ইস্তাওয়া’ শব্দের অর্থ ঊর্ধ্বে উঠেছেন। অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা উপরের দিকে উঠেছেন। এ অর্থটিকেই ইমাম তাবারী তার তাফসীর গ্রন্থে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তিনি উক্ত আয়াতের তাফসীরে বলেছেন:
علا عليهن وارتفع، فدبرهن بقدرته، وخلقهن سبع سماوات
তিনি আকাশসমূহের ওপরে উঠলেন, ঊর্ধ্বে উঠলেন, তিনি তার কুদরত দ্বারা আকাশসমূহ নিয়ন্ত্রণ করলেন, এবং তা সাত আসমান হিসেবে সৃষ্টি করলেন।
ইমাম বাগাবী তার তাফসীরে অভিন্ন বক্তব্য উল্লেখ করেছেন যা তিনি ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা ও অধিকাংশ সালাফ তাফসীকারীদের উদ্বৃতি দিয়ে উল্লেখ করেছেন। ইস্তাওয়া শব্দের বাহ্যিক অর্থকে ধরে রাখতে গিয়েই তারা এরূপ তাফসীর করেছেন এবং ওপরে ওঠার আকার-প্রকৃতি-ধরণ কি তা তারা আল্লাহ তা‘আলার ইলমের কাছে সমর্পন করেছেন।
দ্বিতীয় বক্তব্য: ইস্তিওয়া শব্দের অর্থ এখানে পরিপূর্ণ মনোযোগ আরোপ করা। ইমাম ইবনে কাছীর সূরা আল বাকারার তাফসীরে এবং ইমাম বাগাবী সূরা ফুসসিলাত এর তাফসীরে এ ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। ইমাম ইবনে কাছীর বলেছেন: ‘অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা আকাশের প্রতি মনোযোগী হলেন। আর ইস্তিওয়া এখানে ইচ্ছা করা ও মনোযোগী হওয়ার অর্থকে শামিল করছে; কেননা এখানে ইস্তাওয়া ক্রিয়াপদেও পর إلى যুক্ত করা হয়েছে। ইমাম বাগাবী বলেছেন, ‘অর্থাৎ আল্লাহ তা‘আলা আকাশ সৃষ্টির দৃঢ় মনোযোগ পোষণ করলেন।’
বলার অপেক্ষা রাখে না যে উক্ত ব্যাখ্যায় বাণীকে তার বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়নি; কেননা ইস্তাওয়া ক্রিয়াপদটি এমন একটি অব্যয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যা শেষ প্রান্ত বা সীমানা বুঝায়। অতএব তা এমন অর্থ বুঝাচ্ছে যা উক্ত অব্যয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
উল্লিখিত দুই আয়াতে যে বাণী রয়েছে তা প্রকৃত ও বাহ্যিক অর্থেই। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, প্রকৃত ও বাহ্যিক অর্থটা এখানে কি?
এখানে কি বলা হবে যে, আল্লাহ তা‘আলা তার সৃষ্টিজীবের সঙ্গে থাকেন এই অর্থে যে তিনি তাদের সঙ্গে মিশে থাকেন অথবা তারা যেসব জায়গায় থাকে সেসব জায়গায় আল্লাহর তা‘আলার সত্তা অবস্থান করে।
না কি বলা হবে যে, এখানে বাহ্যিক ও প্রকৃত অর্থ বলতে বুঝায়, আল্লাহ তা‘আলা তার সৃষ্টিজীবের সঙ্গে এই অর্থে থাকেন যে তিনি তাঁর জ্ঞানে, কুদরতে, শ্রবণে, দর্শনে, নিয়ন্ত্রণে এবং রুবুবিয়াতের অন্যান্য অর্থে সকল মাখলুকের ঊর্ধ্বে আরশের ওপর থাকা সত্ত্বেও সকল সৃষ্টিকে পরিবেষ্টন করে আছেন?
এটা নিঃসন্দেহ যে প্রথম কথাটি এখানে প্রযোজ্য নয়, কেননা উল্লিখিত বাণীদ্বয়ের কনটেক্সট উক্ত কথাকে দাবি করে না। বরং কোনোভাবেই তা বুঝায় না; কেননা এখানে ‘সঙ্গে-থাকা’র বিষয়টি আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। আর আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিজীব কর্তৃক পরিবেষ্টিত হবেন তা হতে পারে না। অর্থাৎ যদি বলা হয় যে আল্লাহ তা‘আলা তার সৃষ্টিজীবের সঙ্গে থাকেন এই অর্থে যে তিনি তাদের সঙ্গে মিশে থাকেন অথবা তারা যেসব জায়গায় থাকে সেসব জায়গায় আল্লাহর তা‘আলার সত্তা অবস্থান করে, তাহলে একথার দাবি হলো যে আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টিবস্তু কর্তৃক পরিবেষ্টিত থাকেন। আল্লাহর ব্যাপারে এমন কথা কখনো বলা যাবে না। উপরন্তু مَعِيَّة (সঙ্গে থাকা) আরবী ভাষার অর্থনির্দেশ-নীতি অনুযায়ী মিশে থাকা অথবা একই স্থানে সঙ্গে থাকাকে দাবি করে না। বরং সাধারণভাবে সঙ্গে থাকাকে বুঝায়, এরপর স্থান অনুযায়ী সঙ্গে থাকার আকার-প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়।
আর আল্লাহ তা‘আলার সঙ্গে-থাকাকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা সম্পূর্ণ বাতিল যার অর্থ দাঁড়ায় মাখলুকের সঙ্গে মিশে থাকা অথবা মাখলুক যে জায়গায় থাকে সে জায়গায় অবস্থান করা। এ ধরনের ব্যাখ্যা কয়েকটি কারণে বাতিল:
প্রথম কারণ: এরূপ ব্যাখ্যা সালাফদের ইজমার উল্টো। সালাফদের কেউই এরূপ ব্যাখ্যা করেননি। বরং তারা এরূপ ব্যাখ্যা অস্বীকার করার ব্যাপারে একমত ছিলেন।
দ্বিতীয় কারণ: কুরআন, সুন্নাহ, যুক্তিবুদ্ধি, স্বচ্ছ মানবপ্রকৃতি ও সালাফদের ইজমার দ্বারা একথা প্রমাণিত যে আল্লাহ তা‘আলা সর্বোচ্চে ও সর্বোর্ধ্বে। আর উক্ত ব্যাখ্যা আল্লাহ তা‘আলার সর্বোচ্চতা ও সর্বোর্ধ্বতার বিপরীত। আর যা দলিল দ্বারা প্রমাণিত বিষয়ের বিপরীত হবে তা বাতিল। অতএব বান্দাদের সঙ্গে থাকার অর্থ যদি কেউ এভাবে করে যে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের সঙ্গে মিশে থাকেন অথবা বান্দাদের জায়গাতেই থাকেন তবে কুরআন, সুন্নাহ, যুক্তিবুদ্ধি, স্বচ্ছ মানবপ্রকৃতি ও সালাফদের ইজমা অনুযায়ী তা প্রত্যাখ্যাত হবে।
তৃতীয় কারণ: উক্ত কথার যুক্তিগত এমন অযাচিত ফলাফল বের হয় যা আল্লাহ তা‘আলার জন্য উপযোগী নয়।
আর যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলাকে জানে, তাঁকে যথার্থরূপে সম্মান করে এবং আরবী ভাষায় معية অর্থাৎ ‘সঙ্গে-থাকা’ কাকে বলে তা বোঝে সে কখনোই একথা বলতে পারে না যে: আল্লাহ তা‘আলা মাখলুকের সঙ্গে থাকার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের সঙ্গে মিশে থাকেন অথবা তারা যে জায়গায় অবস্থান করে তিনিও সে জায়গায় অবস্থান করেন। আরবী ভাষা সম্পর্কে যে অজ্ঞ, সেই কেবল এরূপ কথা বলতে পারে।
অতএব এতে আর কোনো সন্দেহ রইল না যে এ কথাটি বাতিল। যেহেতু এ কথাটি বাতিল তাই দ্বিতীয় কথাটিই সঠিক। আর তা হলো, আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের সঙ্গে এমনভাবে আছেন যে তিনি তাঁর ইলম, কুদরত, শ্রবণ, দর্শন, নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য ও রুবুবিয়াতের যা যা দাবি আছে সবকিছুর নিরিখে তিনি তাদের পরিবেষ্টন করে আছেন। এটাই হলো উল্লিখিত দুই আয়াতের নিঃসন্দেহ বাহ্যিক অর্থ; কেননা এ আয়াত দুটো হলো হক এবং হকের বাহ্যিক অর্থও হক। বাতিল কখনো আল কুরআনের বাহ্যিক অর্থ হতে পারে না।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ফতওয়ায়ে হামাবিয়াতে বলেছেন (মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১০৩): ‘আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক বান্দার সঙ্গে থাকার অর্থ জায়গা অনুযায়ী ভিন্ন-ভিন্ন হয়ে থাকে। অতএব আল্লাহ তা‘আলা যখন বলেন:
﴿يَعۡلَمُ مَا يَلِجُ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا يَخۡرُجُ مِنۡهَا﴾ [الحديد: ٤]
তিনি জানেন জমিনে যা কিছু প্রবেশ করে এবং তা থেকে যা কিছু বের হয়। (আল-হাদীদ: ৫৭: ৪)
এরপর বলেন:
﴿وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ ﴾ [الحديد: ٤]
‘আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন।’ (আল হাদীদ: ৫৭: ৪)
তখন আল্লাহ তা‘আলার এ ভাষণ বাহ্যিকভাবে যা বুঝায় তা হলো, আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক বান্দাদের সঙ্গে-থাকার অর্থ হলো- তিনি তাদের সকল বিষয় জানেন, তিনি তাদের ওপর সাক্ষী, তিনি সকল বিষয়ের ওপর আধিপত্যশীল ও সর্বজ্ঞানী। এটাই হলো সালাফদের কথার অর্থ যে, ‘তিনি তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আছেন।’[1] এটাই হলো আল্লাহ তা‘আলার বাণীর বাহ্যিক অর্থ ও হাকীকত। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত দুটি বাণীরও একই অর্থ। আর তা হলো:
﴿مَا يَكُونُ مِن نَّجۡوَىٰ ثَلَٰثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمۡ﴾ [المجادلة: ٧]
তিন জনের কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে চতুর্থজন হিসেবে আল্লাহ থাকেন না।
এরপর তিনি বলেছেন:
﴿هُوَ مَعَهُمۡ أَيۡنَ مَا كَانُواْۖ ﴾ [المجادلة: ٧]
তিনি তো তাদের সংগেই আছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। (সূরা আল মুজাদালা: ৫৮: ৭)
আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গারে ছাওরে তাঁর সাথীকে যে বলেছিলেন:
﴿لَا تَحۡزَنۡ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَنَاۖ ﴾ [التوبة: ٤٠]
তুমি পেরেশান হয়ো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন। (আত-তাওবা: ৯: ৪০)
এখানেও ‘আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন’ বাহ্যিক অর্থেই। আর সার্বিক অবস্থা থেকে বুঝা গেলো যে এখানে সাথে-থাকার অর্থ - জ্ঞান ও সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে সঙ্গে থাকা।
এরপর তিনি বলেন: “ معية (সঙ্গে-থাকা) শব্দটি কুরআন-সুন্নাহর বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছে। প্রতি জায়গার দাবি অনুযায়ী তার অর্থ নির্ণিত হবে। হয়তো ভিন্ন ভিন্ন জায়গা অনুযায়ী এ শব্দের অর্থ ভিন্ন ভিন্ন হয়েছে অথবা সকল স্থানে এক এক মাত্রার সম্মিলিত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যদিও প্রত্যেক জায়গায়ই শব্দটি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যযুক্ত। তবে যে অর্থেই হোক না কেন, কোনো স্থলেই অর্থ এটা নয় যে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সত্তাসহ মাখলুকের সঙ্গে মিশে আছেন। যদি মিশে থাকতেন তবে বলা শুদ্ধ হতো যে বাহ্যিক অর্থ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।”
সঙ্গে-থাকার দাবি এটা নয় যে, আল্লাহ তা‘আলার সত্তা মাখলুকের সঙ্গে মিশে থাকে, এর দলিল হলো আল্লাহ তা‘আলা সূরায়ে মুজাদালার আয়াতের শুরুতে এবং শেষে তাঁর সর্বব্যাপী ইলমের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন:
﴿ أَلَمۡ تَرَ أَنَّ ٱللَّهَ يَعۡلَمُ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَمَا فِي ٱلۡأَرۡضِۖ مَا يَكُونُ مِن نَّجۡوَىٰ ثَلَٰثَةٍ إِلَّا هُوَ رَابِعُهُمۡ وَلَا خَمۡسَةٍ إِلَّا هُوَ سَادِسُهُمۡ وَلَآ أَدۡنَىٰ مِن ذَٰلِكَ وَلَآ أَكۡثَرَ إِلَّا هُوَ مَعَهُمۡ أَيۡنَ مَا كَانُواْۖ ثُمَّ يُنَبِّئُهُم بِمَا عَمِلُواْ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِۚ إِنَّ ٱللَّهَ بِكُلِّ شَيۡءٍ عَلِيمٌ ٧ ﴾ [المجادلة: ٧]
তুমি কি লক্ষ্য করনি যে, আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে নিশ্চয় আল্লাহ তা জানেন? তিন জনের কোন গোপন পরামর্শ হয় না যাতে চতুর্থজন হিসেবে আল্লাহ থাকেন না, আর পাঁচ জনেরও হয় না, যাতে ষষ্ঠজন হিসেবে তিনি থাকেন না। এর চেয়ে কম হোক কিংবা বেশি হোক, তিনি তো তাদের সঙ্গেই আছেন, তারা যেখানেই থাকুক না কেন। তারপর কিয়ামতের দিনে তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে জানিয়ে দেবেন। নিশ্চয় আল্লাহ সব বিষয়ে সম্যক অবগত। (আল মুজাদালা: ৫৮: ৭)
উক্ত আয়াতের বাহ্যিক অর্থানুযায়ী, এখানে বান্দাদের ‘সঙ্গে-থাকা’র দাবি হলো- আল্লাহ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে পূর্ণ ইলম রাখেন এবং তাদের আমল ও কর্মের কোনো কিছুই তাঁর কাছে গোপন নয়। এখানে অর্থ এটা নয় যে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের সঙ্গে মিশে আছেন, অথবা তিনি তাদের সঙ্গে জমিনের ওপর আছেন।
অনুরূপভাবে সূরায়ে হাদীদের আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে আরশের ওপরে উঠার কথা, তাঁর ব্যাপক ইলমের কথা বলেছেন এরপর তিনি বান্দাদের সঙ্গে থাকার কথা উল্লেখ করেছেন এবং পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন যে বান্দারা যা আমল করে সে সম্পর্কে তিনি সর্বদ্রষ্টা। ইরশাদ হয়েছে:
﴿ هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ يَعۡلَمُ مَا يَلِجُ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا يَخۡرُجُ مِنۡهَا وَمَا يَنزِلُ مِنَ ٱلسَّمَآءِ وَمَا يَعۡرُجُ فِيهَاۖ وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٤ ﴾ [الحديد: ٤]
তিনিই আসমানসমূহ ও জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশে উঠেছেন। তিনি জানেন জমিনে যা কিছু প্রবেশ করে এবং তা থেকে যা কিছু বের হয়; আর আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা কিছু উত্থিত হয়। আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। (আল হাদীদ: ৫৭: ৪)
এ আয়াতের বাহ্যিক অর্থ এটা যে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের সঙ্গে আছেন। তবে এ সঙ্গে থাকার অর্থ বান্দাদের বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান রাখা, বান্দাদের সকল আমল দেখা যদি সর্বোচ্চতায় আরশের ওপরে আছেন। আয়াতের অর্থ এটা নয় যে আল্লাহ তা‘আলা বান্দাদের সঙ্গে মিশে আছেন, অথবা তাদের সঙ্গে জমিনে আছেন; কেননা এরূপ অর্থ হলে আয়াতের শুরুর অংশে আল্লাহ তা‘আলার সর্বোচ্চতা ও আরশের ওপরে থাকার যে কথা রয়েছে তার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে যাবে।
অতএব আমরা বুঝতে পারলাম যে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের সঙ্গে আছেন এর দাবি হলো যে আল্লাহ তা‘আলা তাদের অবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ জ্ঞাত, তিনি তাদের কথাবার্তার সর্বশ্রোতা, তিনি তাদের আমলসমূহের সর্বদ্রষ্টা, তিনি তাদের সকল বিষয় নিয়ন্ত্রণকারী। তিনি তাদের জীবনদানকারী, মৃত্যুদাতা, ধনাঢ্য দাতা ও দরিদ্রকারী। তিনি তাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা রাজত্ব দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা রাজত্ব থেকে বঞ্চিত করেন, তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মান দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন, ইত্যাদি ইত্যাদি যা আল্লাহ তা‘আলার রুবুবিয়াত ও তার পরিপূর্ণ ক্ষমতা দাবি করে। সৃষ্টিজগতে হস্তক্ষেপ থেকে কোনো কিছুই আল্লাহ তা‘আলাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে না। যার এই শান তিনি প্রকৃত অর্থেই তাঁর সৃষ্টির সাথে, যদিও তিনি তাদের ঊর্ধ্বে আরশের ওপরে প্রকৃত অর্থে।[2]
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া ‘আল আকীদা আল ওয়াসেতিয়া’য় আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক বান্দার সাথে থাকার ব্যাপারে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন- ‘আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপরে থাকা এবং একই মুহূর্তে আমাদের সঙ্গে থাকার ব্যাপারে যা কিছু বললেন, তা প্রকৃত অর্থেই। এ ক্ষেত্রে কোনো অর্থবিকৃতির প্রয়োজন নেই। তবে অবশ্যই মিথ্যা ধারণা থেকে আল্লাহ তা‘আলার প্রতি আমাদের বিশ্বাসকে বাঁচাতে হবে।’ (মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৪২)
তিনি আল ফাতওয়া আল হামাবিয়া (মাজমুউল ফাতাওয়া, পৃষ্ঠা ১০২, ১০৩)- তে বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে সার কথা হলো, যে ব্যক্তি আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাহ গভীরভাবে অধ্যায়ন করবে সে পরিপূর্ণ হিদায়েত ও আলো লাভ করতে সক্ষম হবে, যদি সে সত্যের অনুসরণকে উদ্দেশ্য বানায়, তাহরীফ ও বিকৃতি থেকে বেঁচে থাকে এবং আল্লাহ তা‘আলার নাম ও সিফাতের ক্ষেত্রে ইলহাদ ও বিকৃতির আশ্রয় নেওয়া থেকে বিরত থাকে।’
আর কোনো ধারণাকারী এ ধারণা করবে না যে, উল্লিখিত বিষয়ের একটি অন্যটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যেমন কেউ বলল যে, ‘আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপরে আছেন এ ব্যাপারে কুরআন-সুন্নায় যে বক্তব্য এসেছে তার বিপরীত বক্তব্য রয়েছে নিম্নবর্ণিত আয়াত ও হাদীসে। আয়াতটি হলো, (وَهُوَ مَعَكُمْ ) ‘আর তিনি তোমাদের সাথেই আছেন’, আর হাদীসটি হলো, إذا قام أحدكم إلى الصلاة فإن الله قبل وجهه ‘যখন তোমাদের কেউ সালাতে দাঁড়ায় তখন আল্লাহ তা‘আলা নিশ্চয় তাঁর সম্মুখেই থাকেন’।[3] এ জাতীয় ধারণা অর্থাৎ (আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আরশের উপর উঠা সংক্রান্ত) উল্লিখিত বক্তব্যের সঙ্গে উক্ত আয়াত ও হাদীসটি সাংঘর্ষিক, এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
আর তা এ জন্যে যে আল্লাহ তা‘আলা প্রকৃত অর্থেই আমাদের সঙ্গে আছেন, যেমন তিনি প্রকৃত অর্থেই আরশের ওপরে আছেন। এক আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা এ উভয় বিষয়কে একত্র করে বলেছেন:
﴿ هُوَ ٱلَّذِي خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٖ ثُمَّ ٱسۡتَوَىٰ عَلَى ٱلۡعَرۡشِۖ يَعۡلَمُ مَا يَلِجُ فِي ٱلۡأَرۡضِ وَمَا يَخۡرُجُ مِنۡهَا وَمَا يَنزِلُ مِنَ ٱلسَّمَآءِ وَمَا يَعۡرُجُ فِيهَاۖ وَهُوَ مَعَكُمۡ أَيۡنَ مَا كُنتُمۡۚ وَٱللَّهُ بِمَا تَعۡمَلُونَ بَصِيرٞ ٤ ﴾ [الحديد: ٤]
তিনিই আসমানসমূহ ও জমিন ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি আরশে উঠেছেন। তিনি জানেন জমিনে যা কিছু প্রবেশ করে এবং তা থেকে যা কিছু বের হয়; আর আসমান থেকে যা কিছু অবতীর্ণ হয় এবং তাতে যা কিছু উত্থিত হয়। আর তোমরা যেখানেই থাক না কেন, তিনি তোমাদের সাথেই আছেন। আর তোমরা যা কর, আল্লাহ তার সম্যক দ্রষ্টা। (সূরা আল হাদীদ: ৫৭: ৪)
আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াতে আমাদের এ সংবাদ দিয়েছেন যে তিনি আরশের ওপরে আছেন। তিনি সকল বিষয়ে সুপরিজ্ঞাত এবং আমরা যেখানেই থাকি না কেন তিনি আমাদের সঙ্গেই আছেন। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে বলেছেন:
والله فوق العرش، وهو يعلم ما أنتم عليه
(আর আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপরে, তোমরা যে অবস্থায় আছ, আল্লাহ তা‘আলা তা জানেন।) [4]
আল্লাহ তা‘আলার শানের জন্য যেভাবে উপযোগী সেভাবে তিনি বান্দার সঙ্গে থাকেন, এ কথার সঙ্গে, আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপরে আছেন, এর কোনো সংঘর্ষ নেই। বিষয়টি আমরা তিনভাবে বুঝতে পারি:
এক: আল্লাহ তা‘আলা এ উভয় বিষয়কে তাঁর কিতাবে একত্র করেছেন। যে কিতাব সকল বৈপরীত্ব থেকে মুক্ত। আর যে দুটি বিষয়কে আল্লাহ তা‘আলা একত্র করেছেন সে দুটির মাঝে কোনো বৈপরীত্ব থাকতে পারে না।
আর আল কুরআনের কোনো বিষয়ে বৈপরীত্য আছে বলে যদি ধারণা হয়, তাহলে আপনার উচিত হবে গভীরভাবে অধ্যয়ন করা যাতে প্রকৃত অবস্থা প্রকাশ পায় (অবৈপরীত্য বুঝা যায়)। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿ أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَۚ وَلَوۡ كَانَ مِنۡ عِندِ غَيۡرِ ٱللَّهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ ٱخۡتِلَٰفٗا كَثِيرٗا ٨٢ ﴾ [النساء: ٨٢]
তারা কি কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না? আর যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে হত, তবে অবশ্যই তারা এতে অনেক বৈপরীত্য দেখতে পেত। (সূরা আন-নিসা: ৪: ৮২)
যদি গভীরভাবে অধ্যয়নের পরও বিষয়টি স্পষ্ট না হয়, তাহলে যারা পাকাপোক্ত জ্ঞানের অধিকারী তাদের পথ অবলম্বন করতে হবে, যারা বলেন যে,
﴿ءَامَنَّا بِهِۦ كُلّٞ مِّنۡ عِندِ رَبِّنَاۗ وَمَا يَذَّكَّرُ إِلَّآ أُوْلُواْ ٱلۡأَلۡبَٰبِ ٧ ﴾ [ال عمران: ٧]
আমরা এগুলোর প্রতি ঈমান আনলাম, সবগুলো আমাদের রবের পক্ষ থেকে। (সূরা আলে ইমরান: ৩: ৭)
অতএব বিষয়টিকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করতে হবে যিনি এ ব্যাপারে সুপরিজ্ঞাত। জেনে রাখবেন, যদি কোনো ত্রুটি থাকে তবে তা আপনার জ্ঞান ও বুঝের মধ্যে রয়েছে। পক্ষান্তরে আল কুরআন সকল বৈপরীত্য থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।”
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া র. তার কথা (যেমন আল্লাহ তা‘আলা এ দুটিকে একত্র করেছেন) দ্বারা এ দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।
ইমাম ইবনুল কাইয়েম র. বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা অবশ্যই সংবাদ দিয়েছেন যে তিনি তাঁর সৃষ্টির সাথে আছেন যদিও তিনি আরশের ওপরে আছেন। আর আল্লাহ তা‘আলা এ দুটিকে একত্র করে উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন- এখানে তিনি সূরা আল-হাদীদের আয়াতটি উল্লেখ করেছেন- এরপর তিনি বলেছেন: অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা সংবাদ দিয়েছেন যে তিনি আসমানসমূহ ও জমিন সৃষ্টি করেছেন এবং তিনি তাঁর আরশের ওপরে উঠেছেন। তিনি তাঁর বান্দাদের সাথে আছেন এ অর্থে যে তিনি আরশের ওপর থেকেই তাদের আমল দেখছেন, যেমন হাদীসে এসেছে: (আর আল্লাহ তা‘আলা আরশের ওপরে, তোমরা যে অবস্থায় আছ তিনি তা দেখছেন।) অতএব আল্লাহ তা‘আলার ঊর্ধ্বতা এবং মাখলুকের সঙ্গে থাকা, এ দুটির মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। আর মাখলুকের সঙ্গে থাকা আল্লাহ তা‘আলার ঊর্ধ্বতাকে বাতিল করে দেয় না। বরং উভয়টিই সত্য।’[5]
দুই. ‘সঙ্গে থাকা’র প্রকৃত অর্থ উর্ধ্বতার সাথে সাংঘর্ষিক নয়। বরং এ উভয় বিষয় সৃষ্টিবস্তুর ক্ষেত্রেও একত্র হতে পারে। উদাহরণত যদি কেউ বলে যে ‘আমরা এখনও এ অবস্থায় চলছি যে চাঁদ আমাদের সাথে।’ তাহলে এ কথার দ্বারা কোনো বৈপরীত্য বুঝা যাবে না। কেউ এরূপ বুঝবে না যে, চাঁদ মাটিতে নেমে এসেছে এবং আমাদের সঙ্গে চলতে শুরু করেছে। যদি সৃষ্টিবস্তুর ক্ষেত্রে এরূপ সম্ভব হয়, তাহলে সৃষ্টিকর্তা, যিনি সকল বিষয়কে পরিবেষ্টিত করে আছে, তিনি উর্ধ্বে থাকা সত্ত্বেও মাখলুকের সঙ্গে অবশ্যই থাকতে পারেন। এটা এ কারণে যে ‘সঙ্গে থাকা’র প্রকৃত অর্থ এক জায়গায় একত্র হওয়াকে আবশ্যক করে না।
এ দিকে ইঙ্গিত করেই ইমাম ইবনে তাইমিয়া র. বলেছেন যে, আরবীতে مع (সঙ্গে) শব্দটি যখন ব্যবহৃত হয় তখন এর বাহ্যিক অর্থ হয় সাধারণভাবে তুলনা করা, যা আবশ্যিকভাবে পরস্পর পরস্পরকে স্পর্শ অথবা একে অন্যের ডানে বা বামে থাকাকে দাবি করে না। যদি ‘সঙ্গে থাকা’র অর্থকে বিশেষ কোনো বস্তু বা ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে উল্লিখিত হয়, তবে তা সে বিশেষ অর্থ-কেন্দ্রিক তুলনাকে বুঝাবে। বলা হয় যে, আমরা এখনও চলছি আর চাঁদ আমাদের সঙ্গে, অথবা তারকা আমাদের সঙ্গে। আরও বলা হয় যে ‘এ বস্তুটি আমার সঙ্গে’ যদিও তা আপনার মাথার ওপরে। কেননা আপনার উদ্দেশ্য হলো এ বস্তুর সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা বর্ণনা করা। অনুরূপভাবে আল্লাহ তা‘আলাও প্রকৃত অর্থেই তাঁর মাখলুকের সঙ্গে আছেন যদিও তিনি প্রকৃত অর্থেই তাঁর আরশের ওপরে আছেন।’[6]
তিন. যদি মেনেও নেই যে ‘সঙ্গে থাকা’ এবং ঊর্ধ্বতা এ দুটি বিষয় কোনো সৃষ্টিবস্তুর ক্ষেত্রে একত্র হতে পারে না, তবুও বলব যে আল্লাহ তা‘আলার ক্ষেত্রে এ দুটি বিষয় একত্র হওয়া নিষিদ্ধ নয়। কেননা তিনি নিজেই এ দুটি বিষয়কে একত্র করেছেন। কারণ আল্লাহ তা‘আলা অতুলনীয়, তাঁর সঙ্গে কোনো মাখলুকের তুলনা হয় না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١]
তাঁর মতো কোনো জিনিস নেই, আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা। (আশ-শুরা: ৪২: ১১)শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এ দিকে ইঙ্গিত করেই ‘আল আকীদা আল ওয়াসেতিয়া’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘কুরআন-সুন্নাহয় আল্লাহ তা‘আলার নিকটতা অথবা সঙ্গে থাকার যে কথা বলা হয়েছে তা আল্লাহ তা‘আলার ঊর্ধ্বতা ও সর্বোচ্চতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলার গুণসমগ্রের কোনোটির ক্ষেত্রেই তাঁর তুল্য কোনো বিষয় নেই। তিনি শীর্ষে থেকেও কাছে এবং নিকটে থেকেও ঊর্ধ্বে।’[7]
[2][2] - এটা পেছনে গিয়েছে যে আরবী ভাষায় معية (সঙ্গে থাকা) মিশে থাকা অথবা এক জায়গায় থাকাকে দাবি করে না। (লেখক)
[3] - সহীহ বুখারীতে হাদীসটি এভাবে এসেছে : ‘ إن أحدكم إذا كان في الصلاة فإن الله قبل وجهه ’ অর্থাৎ ‘ তোমাদের কেউ যখন সালাতে থাকে তখন আল্লাহ তাআলা নিশ্চয় তার চেহারার দিকে থাকেন।’ হাদীস নং (৭৫৩)। সহীহ মুসলিমে হাদীসটি এভাবে এসেছে : ‘ إذا كان أحدكم يصلي فلا يبصق قبل وجهه، فإن الله قبل وجهه إذا صلى অর্থাৎ ‘তোমাদের কেউ যখন সালতে থাকে সে যেন তার চেহারার দিকে থুথু না ফেলে, কেননা আল্লাহ তাআলা তার চেহারার দিকে থাকে যখন সে সালাত আদায় করে।’ হাদীস নং (৫৪৭)।
[4] - আদ্দুররুল মানছুর : ১/১০৯
[5] - ইবনুল মুসিলী, মুখতাসারুস্সাওয়াইক, পৃষ্ঠা ৪১০
[6] - ইবনে তাইমিয়া, আল ফাতওয়া আল হামুবিয়াহ, দ্রঃ মাজমুউল ফাতওয়া, খন্ড ৫, পৃষ্টা ১০৩
[7] - মাজমুউল ফাতাওয়া, খন্ড ৩, পৃষ্ঠা ১৪৩
প্রথম ভাগ:
এদের বক্তব্য হলো ‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে আছেন’, এখানে ‘সঙ্গে থাকা’র দ্বারা যদি সাধারণভাবে সঙ্গে থাকাকে বুঝায় তবে এর অর্থ হবে, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর জ্ঞানে ও সর্বব্যাপী ক্ষমতায় সৃষ্টির সঙ্গে রয়েছেন। আর যদি বিশেষভাবে সঙ্গে থাকাকে বুঝায় তবে এর অর্থ হবে, সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে তিনি থাকেন। যদিও আল্লাহ তা‘আলা সত্তাগতভাবে সর্বোর্ধ্বে এবং আরশের ওপরে।
এঁরাই হলেন সালাফ এবং এঁদের মাযহাবই হলো সত্য। যেমনটি ওপরে বর্ণিত হয়েছে।
দ্বিতীয় ভাগ:
এদের বক্তব্য হলো, ‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে আছেন’ এ কথার দাবি হলো, আল্লাহ তা‘আলা জমিনে তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে আছেন। তারা আল্লাহ তা‘আলার সর্বোর্ধ্বে থাকা এবং আরশের ওপরে থাকাকে নাকচ করে দেন। এরা হলেন প্রাচীন জাহমিয়া ফেরকার অন্তর্গত হুলুলিয়া গোষ্ঠী। এদের মাযহাব বাতিল ও অগ্রহণযোগ্য। সালাফগণ এদের মাযহাব বাতিল হওয়া এবং প্রত্যাখ্যান করার ব্যাপারে একমত। যেমনটি ওপরে বর্ণনা করা হয়েছে।
তৃতীয় ভাগ:
এদের বক্তব্য হলো, ‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে আছেন’, এর দাবি হলো আল্লাহ তা‘আলা তাদের সঙ্গে জমিনে আছেন এবং একই সঙ্গে সর্বোর্ধ্বে আরশের ওপরেও আছেন। শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া এদের বক্তব্যকে মাজমুউল ফাতাওয়ায় তুলে ধরেছেন।[1]এরা মনে করেছেন যে ‘সঙ্গে থাকা’ এবং ‘ঊর্ধ্বতা’ এ উভয় বিষয়ে যেসব টেক্সট রয়েছে তার বাহ্যিক অর্থকে তারা ধারণ করতে পেরেছেন। কিন্তু তারা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন এবং পথভ্রষ্ট হয়েছেন। কেননা ‘সঙ্গে থাকা’ বিষয়ে যেসব টেক্সট রয়েছে তা মাখলুকের সঙ্গে সত্তাগতভাবে আল্লাহ তা‘আলার মিশে থাকাকে দাবি করে না। এটা বরং বাতিল। আর আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর রাসূলের কথার বাহ্যিক অর্থ কোনো বাতিল বিষয় হতে পারে না।
>‘আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সৃষ্টির সঙ্গে আছেন’ আমাদের সালাফগণ যখন এর ব্যাখ্যা এভাবে দিয়েছেন যে তিনি তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমে তাদের সঙ্গে আছেন, তখন এ ব্যাখ্যার দাবি এটা নয় যে তিনি কেবল তাঁর জ্ঞানের মাধ্যমেই তাদের সঙ্গে আছেন। বরং এর দাবি এটাও যে তিনি তাঁর শ্রবণ, দর্শন, ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ এবং রুবুবিয়াতের এ জাতীয় আরও যে অর্থসমূহ রয়েছে এসব দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা তাদের পরিবেষ্টন করে আছেন।
বিগত পৃষ্ঠাগুলোয় এ ব্যাপারে ইঙ্গিত করেছি যে আল্লাহ তা‘আলার উর্ধ্বাবস্থান কুরআন, সুন্নাহ, যুক্তিবুদ্ধি, ফিতরত ও ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।
আল্লাহ তা‘আলার ঊর্ধ্বাবস্থান আল কুরআন দ্বারা বিভিন্নভাবে প্রমাণিত। কখনো ‘উলু’ (ঊর্ধ্বতা), কখনো ‘ফাওকিইয়া’ (ওপরে থাকা), কখনো ইস্তিওয়া ‘আলাল আরশ (আরশের ওপরে ওঠা), কখনো ‘আকাশে থাকা’ ইত্যাদি শব্দের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। যেমন নিম্নোক্ত আয়াতসমূহে:
﴿وَهُوَ ٱلۡعَلِيُّ ٱلۡعَظِيمُ ٢٥٥ ﴾ [البقرة: ٢٥٥]
আর তিনি সুউচ্চ, মহান। (আল বাকারা: ২: ২৫৫)
﴿ وَهُوَ ٱلۡقَاهِرُ فَوۡقَ عِبَادِهِۦۚ﴾ [الانعام: ١٨]
আর তিনিই তাঁর বান্দাদের উপর ক্ষমতাবান। (আল আনআম: ৬: ১৮)
﴿ ٱلرَّحۡمَٰنُ عَلَى ٱلۡعَرۡشِ ٱسۡتَوَىٰ ٥ ﴾ [طه: ٥]
পরম করুণাময় আরশের ওপর উঠেছেন। (তাহা: ২০: ৫)
﴿ ءَأَمِنتُم مَّن فِي ٱلسَّمَآءِ أَن يَخۡسِفَ بِكُمُ ٱلۡأَرۡضَ فَإِذَا هِيَ تَمُورُ ١٦ ﴾ [الملك: ١٦]
যিনি আসমানে আছেন, তিনি তোমাদেরসহ জমিন ধ্বসিয়ে দেওয়া থেকে কি তোমরা নিরাপদ হয়ে গেছ? (আল মুলক: ৩৭: ১৬)
আবার কখনো আল্লাহর পানে বিভিন্ন বিষয়ের ঊর্ধ্বগমন, ওপরের দিকে ওঠা এবং আল্লাহর দিকে উঠিয়ে নেওয়া এ জাতীয় শব্দ দ্বারা আল কুরআন আল্লাহ তা‘আলার ঊর্ধ্বাবস্থানকে নির্দেশ করেছে। যেমন নিম্নোক্ত উদাহরণসমূহে:
﴿إِلَيۡهِ يَصۡعَدُ ٱلۡكَلِمُ ٱلطَّيِّبُ﴾ [فاطر: ١٠]
তাঁরই পানে উত্থিত হয় ভাল কথা। (ফাতির: ৩৫: ১০)
﴿ تَعۡرُجُ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةُ وَٱلرُّوحُ إِلَيۡهِ﴾ [المعارج: ٤]
ফেরেশতাগণ ও রূহ এমন এক দিনে আল্লাহর পানে ঊর্ধ্বগামী হয়। (আল মাআরিজ: ৭০: ৪)
﴿ إِذۡ قَالَ ٱللَّهُ يَٰعِيسَىٰٓ إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ﴾ [ال عمران: ٥٥]
স্মরণ কর, যখন আল্লাহ বললেন, ‘হে ঈসা, নিশ্চয় আমি তোমাকে পরিগ্রহণ করব, তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নেব।’ (আলে ইমরান: ৩: ৫৫)
আবার কখনো বা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে কোনো কিছু ‘অবতরণ করা’ ও তৎসংলগ্ন শব্দ দিয়ে আল কুরআন আল্লাহ তা‘আলার ঊর্ধ্বাস্থানকে প্রমাণিত করেছে, যেমন নিম্নোক্ত আয়াতদ্বয়ে:
﴿ قُلۡ نَزَّلَهُۥ رُوحُ ٱلۡقُدُسِ مِن رَّبِّكَ ﴾ [النحل: ١٠٢]
বল, রুহুল কুদস (জীবরীল) একে (কুরআনকে) তোমার রবের পক্ষ হতে যথাযথভাবে নাযিল করেছেন। (সূরা আন-নাহল: ১৬: ১০২)
﴿ يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ إِلَى ٱلۡأَرۡضِ ثُمَّ يَعۡرُجُ إِلَيۡهِ﴾ [السجدة: ٥]
তিনি আসমান থেকে জমিন পর্যন্ত সকল কার্য পরিচালনা করেন। তারপর তা তাঁরই দিকে উত্থিত হয়। (আস-সাজদাহ: ৩২: ৫)
আল্লাহ তা‘আলার সুউচ্চ অবস্থান কথা, কর্ম ও অনুমোদন এ তিন প্রকার সুন্নত দ্বারাই প্রমাণিত এবং তা বহু হাদীসে নানাভাবে এসেছে এবং সবগুলো মিলে মুতাওয়াতিরের পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছে। নিম্নে এ জাতীয় কিছু হাদীস উল্লেখ করা হলো:
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিজদারত অবস্থায় বলেছেন:
«سبحان ربي الأعلى»
(পবিত্র মহান আমার রব, যিনি সর্বোচ্চ)[1]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে বলেছেন:
«إن الله لما قضى الخلق كتب عنده فوق عرشه: إن رحمتي سبقت غضبي»
আল্লাহ তা‘আলা যখন সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি তাঁর কাছে আরশের ওপর লিখলেন, নিশ্চয় আমার রহমত আমার রাগ থেকে অগ্রগামী হয়েছে[2]।
অন্য এক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
«ألا تأمنوني وأنا أمين من في السماء»
তোমরা কি বিশ্বাস করবে না; অথচ আমি হলাম যিনি আকাশে আছেন তাঁর বিশ্বাসের পাত্র।[3]
হাদীস দ্বারা আরো প্রমাণিত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুমার দিন মিম্বারে থাকা অবস্থায় দু’হাত উত্তোলন করেছেন এবং বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি আমাদের উদ্ধার করুন![4]’
আর তিনি আরাফার দিন খুতবা প্রদানকালে আকাশের দিকে হাত উত্তোলন করেছেন যখন মানুষেরা বলেছে, ‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি পৌঁছে দিয়েছেন, দায়িত্ব আদায় করেছেন এবং নসীহত করেছেন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, اللهم اشهد ( হে আল্লাহ! আপনি সাক্ষী থাকুন)[5]।একদা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক কৃতদাসীকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আল্লাহ কোথায়?’ উত্তরে সে বলল যে, ‘আসমানে’। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কথা মেনে নিলেন এবং তার মনিবকে বললেন, ‘তাকে আযাদ করে দাও, নিশ্চয় সে মুমিনা’[6]।
>[2] - বুখারী, হাদীস নং ৭৪২২; মুসলিম, হাদীস নং ২৭৫১।
[3] - বুখারী, হাদীস নং ৪৩৫১
[4] - বুখারী, হাদীস নং ১০১৪; মুসলিম, হাদীস নং ৮৯৭।
[5] - মুসলিম, হাদীস নং ১২১৮।
[6] - মুসলিম, হাদীস নং ৫৩৭।