হে মুসলিম ভাই, তোমার নিকট এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি স্পষ্ট হওয়ার পর, মনে রেখো, যে ব্যক্তি আল্লাহর দীনে নতুন কোনো শরী‘আত ভালো উদ্দেশ্যে হলেও আবিষ্কার করে, তার আবিষ্কৃত বিদ‘আতটি গোমরাহী বা ভ্রষ্টতা হওয়ার সাথে সাথে আল্লাহর দীনের ব্যাপারে অনাস্থা, প্রশ্ন তোলা হিসেবেই গণ্য হবে। আর আল্লাহকে তার স্বীয় বাণী- ٱلۡيَوۡمَ أَكۡمَلۡتُ لَكُمۡ دِينَكُمۡ তে মিথ্যুক সাব্যস্ত করা হবে। কারণ, যে ব্যক্তি আল্লাহর দীনে কোনো শরী‘আত বা বিধান আবিষ্কার করল, যা দীনের অন্তর্ভুক্ত নয়, তার অবস্থা দাবী করছে যে সে যেন বললো, দীন পূর্ণাঙ্গ নয়, দীন এখনো পরিপূর্ণতা লাভ করে নি। কারণ সে মনে করছে দীনের যে বিধানটি সে আবিষ্কার করল, যদ্বারা সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে চায় তা এখনো অবশিষ্ট রয়ে গেছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, মানুষ এমন এমন বিদ‘আত আবিষ্কার করে যা আল্লাহ তা‘আলার সত্ত্বা, নামসমূহ ও সিফাতসমূহের সাথে সম্পর্ক রাখে। তারপর সে দাবি করে যে, সে এ দ্বারা তার রবের মহত্ব সাব্যস্তকারী, তার রবের পবিত্রতা বর্ণনাকারী এবং এ দ্বারা সে আল্লাহ তা‘আলার এ বাণীর﴿فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢﴾ [البقرة: ٢٢] “তোমরা আল্লাহর জন্য শরীক সাব্যস্ত করো না অথচ তোমরা জান” এর নির্দেশনা বাস্তবায়নকারী। তুমি এর চেয়ে আরও বেশি আশ্চর্য হবে, যখন দেখবে, আল্লাহ তা‘লার সত্ত্বার সাথে সম্পৃক্ত এমন একটি বিদ‘আত আবিষ্কার করল, যার ওপর উম্মতের পূর্বসূরী বা ইমামগণের কোনো সমর্থন নেই, অথচ সে দাবি করে, সে আল্লাহর বড়ত্ব ও পবিত্রতা বর্ণনাকারী এবং আল্লাহ তা‘আলা বাণী-
﴿فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٢٢﴾ [البقرة: ٢٢]
“তোমরা আল্লাহর জন্য শরীক সাব্যস্ত করো না অথচ তোমরা জান” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২২] এর যথাযথ বাস্তবায়নকারী। আর যে তার আবিষ্কৃত বিদ‘আতের বিরোধিতা করবে, তাকে সে সাদৃশ্য সাব্যস্তকারী বা দৃষ্টান্তস্থাপনকারী ইত্যাদি জঘন্য খারাপ উপাধি দ্বারা ভূষিত করে। অনুরূপভাবে তুমি আশ্চর্য হবে এমন সম্প্রদায়ের বিষয়ে যারা আল্লাহর দীনে নেই এমন কিছু বিদ‘আত আবিষ্কার করে যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সম্পৃক্ত। এ দ্বারা তারা দাবি করে যে, তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রেমিক, রাসূলের সম্মান রক্ষাকারী। আর যে তাদের আবিষ্কৃত সেসব বিদ‘আতের সাথে ঐক্যমত পোষণ করে না, তাকে রাসূলের শত্রু ও অসম্মানকারী ইত্যাদি খারাপ উপাধিতে আখ্যায়িত করে গালি দেয়।
আরও আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এ ধরনের লোকেরা বলে, আমরাই আল্লাহ ও তার রাসূলের যথাযথ সম্মান প্রদর্শনকারী। অথচ তারা যখন আল্লাহর দীন বা তার দেওয়া শরী‘আত -যা নিয়ে দুনিয়াতে আল্লাহর রাসূল আগমন করেছেন, তাতে এমন কিছু আবিষ্কার করে, যা তার দীনের অংশ নয়, তখন তারা অবশ্যই আল্লাহ ও তার রাসূলের সামনে অগ্রগামী হলো। অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تُقَدِّمُواْ بَيۡنَ يَدَيِ ٱللَّهِ وَرَسُولِهِۦۖ وَٱتَّقُواْ ٱللَّهَۚ إِنَّ ٱللَّهَ سَمِيعٌ عَلِيمٞ ١﴾ [الحجرات: ١]
“হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সামনে অগ্রবর্তী হয়ো না এবং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর, নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ”। [সূরা আল-হুজরাত, আয়াত: ১]
হে মুসলিম ভাইয়েরা! আমি তোমাদের প্রশ্ন করি এবং আল্লাহর শপথ দিয়ে বলছি, আমি চাই তোমরা আমার প্রশ্নের উত্তর তোমাদের অন্তর থেকে দিবে শুধু আবেগে মুখ দিয়ে নয়, তোমাদের দীনের দাবী অনুযায়ী উত্তর দিবে কারো অন্ধ অনুসরণে নয়, যে ব্যক্তি দীনের মধ্যে এমন কোনো বিধান আবিষ্কার করল, যা দীনের বিষয় নয়, চাই তা আল্লাহর সত্ত্বার সাথে সম্পৃক্ত হোক বা তার সিফাত তথা গুণাগুণের সাথে বা নামের সাথে অথবা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে সম্পৃক্ত হোক। তারপর তারা বলে, আমরাই আল্লাহ ও তার রাসূলের সম্মান রক্ষাকারী। এসব লোক কি সত্যিকার অর্থে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের সম্মান রক্ষা বিষয়ে অধিক হকদার? নাকি ঐ সব লোক বেশি হকদার, যারা এক চুল পরিমাণ আল্লাহর দেওয়া শরী‘আত থেকে বিচ্যুত হয় না, শরী‘আতের যে সব বিধান তাদের নিকট এসেছে সে সম্পর্কে তারা বলে, আমরা ঈমান এনেছি এবং মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছি সে সব বিষয়ের ওপর, যার ব্যাপারে আমাদেরকে সংবাদ দেওয়া হয়েছে। আরও বলে, যে সব বিষয়ে আমাদেরকে আদেশ দেওয়া বা নিষেধ করা হয়েছে তা আমরা শুনলাম ও মানলাম। আর যেসব বিষয়ে শরী‘আত নিয়ে আসে নি সেসব বিষয়সমূহ সম্পর্কে তারা বলে, আমরা বিরত থাকলাম, আমাদের জন্য উচিৎ হবে না যে, আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ওপর অগ্রগামী হই। আর আমাদের জন্য উচিৎ নয় যে, আমরা আল্লাহর দীনে এমন কিছু আবিষ্কার করি যা তার দীনের অংশ নয়। এ উভয় দলের কোন দলটি আল্লাহ ও তার রাসূলের মহব্বতকারী হিসেবে পরিগণিত হওয়ার হকদার এবং সম্মানরক্ষাকারী হওয়ার হকদার? নিঃসন্দেহে বলা যায়, সে দলটি উত্তম যারা বলে আমরা ঈমান এনেছি, বিশ্বাস করেছি, আমাদের নিকট যে সংবাদ এসেছে, তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছি, আমাদের যা নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তা আমরা শুনেছি ও অনুসরণ করেছি এবং যা আমাদের আদেশ করা হয় নি তা থেকে আমরা আমাদের হাত গুটিয়ে নিলাম এবং তা হতে আমরা বিরত থাকলাম। আর তারা বলে, আমরা আল্লাহর শরী‘আতের মধ্যে এমন কিছু আবিষ্কার করতে অক্ষম যা শরী‘আত নয় এবং এমন কোনো বিদ‘আত করতে অক্ষম যা দীনের মধ্যে নেই। সন্দেহ নেই যে, এ ধরনের লোকেরাই তাদের নিজেদের মর্যাদা কি তা জানতে পেরেছে এবং স্রষ্টার মর্যাদা কি তা জানতে পেরেছে। প্রকৃতপক্ষে তারাই আল্লাহ ও তার রাসূলকে যথাযথ সম্মান দেখিয়েছে এবং তারাই আল্লাহ ও তার রাসূলের সত্যিকার মহব্বত ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। তারা নয়, যারা আল্লাহর দীনে নতুন কিছু আবিষ্কার করেছে, যা দীনের মধ্যে বিশ্বাসে, কথায় ও আমলে কোথাও নেই।
তুমি আরও আশ্চর্য হবে, ঐ সম্প্রদায়ের লোকদের বিষয়ে যারা আল্লাহর রাসূলের কথা—«إياكم ومحدثات الأمور فإن كل محدثة بدعة، وكل بدعة ضلالة، وكل ضلالة في النار». “সাবধান! তোমরা নতুন আবিষ্কৃত বিষয়গুলো হতে বেঁচে থাকো; কারণ, প্রতিটি নতুন আবিষ্কৃত বিষয় বিদ‘আত। আর প্রত্যেক বিদ‘আত গোমরাহী, আর প্রত্যেক গোমরাহীর গন্তব্য জাহান্নাম”।[1] -এ মহান বাণীটি তারা ভালোভাবেই জানে। আর তারা এ কথাও জানে আল্লাহর রাসূলের বাণীতে «كل بدعة»“প্রত্যেক বিদ‘আত” কথাটি ব্যাপক, মৌলিক। এখানে ব্যাপকতার সবচেয়ে শক্তিশালী শব্দ«كل» কে ব্যবহার করা হয়েছে। আর এ শব্দটি যিনি উচ্চারণ করেছেন তিনি অবশ্যই এ শব্দের মর্মার্থ সম্পর্কে অবগত আছেন। কারণ, তিনি সমস্ত মাখলুকের তুলনায় অধিক ভাষাবিদ, মাখলুকের জন্য সবচেয়ে বেশি হিতাকাংখি মাখলুক। তিনি কখনোই এমন কথা উদ্দেশ্য ছাড়া বলতে পারেন না। ফলে তিনি যখন এ কথা «كل بدعة ضلالة» “প্রত্যেক বিদ‘আত গোমরাহী” বলেছেন, তখন তিনি অবশ্যই জানতেন তিনি কি বলছেন এবং তিনি যা বলছেন তার অর্থ কি। ফলে সার্বিক দিক দিয়ে উম্মতের পরিপূর্ণ কল্যাণের দিক বিবেচনা রেখেই তার থেকে এ কথাটি উচ্চারিত হয়েছে।
আর যখন কোনো বাণীতে উপরোক্ত তিনটি বিষয় অর্থাৎ পরিপূর্ণ কল্যাণকামিতা ও তার ইচ্ছা, পুর্ণাঙ্গ বর্ণনা ও তার সুস্পষ্টতা এবং পূর্ণাঙ্গ ইলম ও জ্ঞান, এ তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত হওয়া স্পষ্ট হলো, তখন তা থেকে প্রমাণিত হলো যে, সে কথার যে স্বাভাবিক অর্থ বুঝা যায় তা অবশ্যই বক্তার উদ্দেশ্য। আর সেটাই তার মূল অর্থ। সুতরাং হাদীসে এমন একটি ব্যাপক ও সামগ্রিক কথা (সকল প্রকার বিদ‘আত) এটা বলার পরও বিদ‘আতকে তিন প্রকার বা পাঁচ প্রকার ভাগ করা কীভাবে শুদ্ধ হতে পারে? না কখনই না, এভাবে ভাগ করা কোনো ক্রমেই শুদ্ধ নয়। যে সব আলেম এ কথা দাবি করে যে বিদ‘আতে হাসানাহ নামে এক প্রকার বিদ‘আত রয়েছে, তা দুই অবস্থার কোনো একটি থেকে মুক্ত নয়:
এক- মূলতঃ তা বিদ‘আত নয়, সে সেটাকে বিদ‘আত ধারণা করেছে।
দুই- অথবা তা বিদ‘আত। নিন্দনীয় বা খারাপ। তবে তার খারাবী সম্পর্কে তারা অবহিত নয়। সুতরাং যে কোনো ব্যক্তিই এ কথা বলে, ‘এক প্রকার বিদ‘আত আছে বিদ‘আতে হাসানা’ তার উত্তর উপরের কথাই। এ কথার ভিত্তিতেই বলা যায় যে, যারা বিদ‘আতী, তাদের জন্য বিদ‘আতকে হাসানা বলে চালিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের হাতে রয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণী- «كل بدعة ضلالة» “প্রত্যেক বিদ‘আত গোমরাহী” নামক ধারালো তলোয়ার বা উন্মুক্ত অসি। এটি এমন একটি তলোয়ার যা নবুওয়াত ও রিসালাতের কারখানায় নির্মাণ করা হয়েছে। কোনো সাধারণ কারখানায় তৈরি করা হয় নি। নবুওয়াতের কারখানায় তৈরি করা এ সুন্দর ও অভিনব তলোয়ার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতে তৈরি করেছেন। যার হাতে এ ধরনের ধারালো তলোয়ার থাকবে, বিদ‘আতীদের দ্বারা- কোনো বিদ‘আতকে ‘তা বিদ‘আতে হাসানা’ এটা বলে তার মুকাবিলা করা সম্ভম হবে না। কারণ সে তখনই বলতে সক্ষম হবে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বলেছেন, «كل بدعة ضلالة»“প্রত্যেক বিদ‘আতই গোমরাহী”।