ফিকহ শব্দের আভিধানিক অর্থ, বুঝা। ইসলামী পরিভাষায় আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নতে যে সব শরী‘আতের বিধান বর্ণিত, তা জানা ও বুঝাকে ফিকহ বলা হয়। আল্লাহ তা‘আলা মানব জাতির হিদায়াতের জন্য কুরআন নাযিল করেন। তাতে রয়েছে মানব জাতির জন্য হিদায়াত, দুনিয়ার জীবনে চলার জন্য যা দরকার তার সব কিছুর সমাধান ও বর্ণনা। একজন বান্দা তার দীনের বিষয়ে যত কিছুর মুখাপেক্ষী হয় এবং দুনিয়া ও আখিরাতে যা কিছু তার সাহায্যকারী, তার সব কিছুই রয়েছে এ কিতাব তথা কুরআনে। আল্লাহ তা‘আলা এ কিতাবকে মানব জাতির হিদায়াতের গ্যারান্টিস্বরূপ নাযিল করেছেন। মানবজাতির হিদায়াতের জন্য এটিই যথেষ্ট। পবিত্র কুরআনের সাথে সাথে রয়েছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস, যা কুরআনের ব্যাখ্যা বা তাফসীর। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ إِلَّا رِجَالٗا نُّوحِيٓ إِلَيۡهِمۡۖ فَسۡ‍َٔلُوٓاْ أَهۡلَ ٱلذِّكۡرِ إِن كُنتُمۡ لَا تَعۡلَمُونَ ٤٣﴾ [النحل: ٤٣]

“আর আমরা তোমার পূর্বে কেবল পুরুষদেরকেই রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছি, যাদের প্রতি আমরা অহী পাঠিয়েছি। সুতরাং জ্ঞানীদের জিজ্ঞাসা কর, যদি তোমরা না জানো”। [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৪৩]

আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হচ্ছেন আল্লাহর পক্ষ থেকে মানুষের নিকট প্রেরিত দূত, বর্ণনাকারী, মুবাল্লিগ ও এ মহা গ্রন্থ আল-কুরআ- কিতাবের ব্যাখ্যাদানকারী। আল্লাহর কিতাব ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস একটি অপরটির সম্পূরক। এ দু’টির মধ্যেই রয়েছে মানবজাতির জন্য হিদায়াত, ভালো ও মন্দের সঠিক দিক নির্দেশনা, হিদায়াত ও গোমরাহীর পরিচয়।

দীনের বুঝ বা ফিকহ ফিদ-দীন হলো, আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নত থেকে আমাদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান জানা ও বুঝা। যাতে আমরা বাস্তব জীবনে যে সব ফিতনা ফ্যাসাদের সম্মুখীন হই, তা হতে বাঁচতে পারি এবং নাজাত বা মুক্তির পথ অবলম্বন করতে পারি। একেই বলা হয় ফিকহ ফিদ-দীন। আল্লাহ তা‘আলা আমাদের ফিকহ ফিদ-দীন হাসিল করার নির্দেশ দিয়েছেন। আর যাদের মধ্যে ফিকহ ফিদ-দীন নেই তাদের নিন্দা করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَمَا كَانَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لِيَنفِرُواْ كَآفَّةٗۚ فَلَوۡلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرۡقَةٖ مِّنۡهُمۡ طَآئِفَةٞ لِّيَتَفَقَّهُواْ فِي ٱلدِّينِ وَلِيُنذِرُواْ قَوۡمَهُمۡ إِذَا رَجَعُوٓاْ إِلَيۡهِمۡ لَعَلَّهُمۡ يَحۡذَرُونَ ١٢٢﴾ [التَّوۡبَةِ:٢٢ ١]

“আর মুমিনদের জন্য সংগত নয় যে, তারা সকলে একসঙ্গে অভিযানে বের হবে। অতঃপর তাদের প্রতিটি দল থেকে কিছু লোক কেন বের হয় না, যাতে তারা দীনের গভীর জ্ঞান আহরণ করতে পারে এবং আপন সম্প্রদায় যখন তাদের নিকট প্রত্যাবর্তন করবে, তখন তাদেরকে সতর্ক করতে পারে, যাতে তারা (গুনাহ থেকে) বেঁচে থাকে”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ১২২]

মুনাফিকদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তারা বুঝে না। অর্থাৎ তারা আল্লাহর আহকাম সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখে না। কারণ, তারা আল্লাহর কিতাবকে গুরুত্ব দেয় না, আল্লাহর কিতাবের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করে না এবং আল্লাহর কিতাবের দিক ফিরে তাকায় না। ফলে তারা আল্লাহর কিতাব সম্পর্কে অন্ধকারে থাকে।

মনে রাখবে, শেষ জামানায় দুনিয়াতে অনেক বড় বড় ফিতনা প্রকাশ পাবে এবং নতুন নতুন ফিতনার আবির্ভাব ঘটবে। তখন মানুষ ফিতনার মধ্যেই জীবন যাপন করবে -ফিতনার বাইরে কেউ থাকতে পারবে না। কেউ হয়তো কম ফিতনার সম্মুখীন হবে আবার কেউ অধিক ফিতনার সম্মুখীন হবে; কিন্তু ফিতনা থেকে কেউ নিরাপদ থাকতে পারবে না।

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে করীমে বিভিন্ন ফিতনা সম্পর্কে আমাদের জানিয়েছেন এবং সতর্ক করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা ধন-সম্পদ ও সন্তান- সন্ততিকে ফিতনা বলে আখ্যায়িত করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿إِنَّمَآ أَمۡوَٰلُكُمۡ وَأَوۡلَٰدُكُمۡ فِتۡنَةٞۚ وَٱللَّهُ عِندَهُۥٓ أَجۡرٌ عَظِيمٞ ١٥﴾ [التغابن: ١٥]

“তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি তো কেবল পরীক্ষা বিশেষ। আর আল্লাহর নিকটই মহান প্রতিদান”। [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৫]

ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি ফিতনা বা পরীক্ষা। যে ব্যক্তি ধন-সম্পদ, সন্তান-সন্ততি, ব্যবসা-বাণিজ্য, ঘর-বাড়ি, গোত্র ও মাতৃভূমির মহব্বতকে আল্লাহ ও তার রাসূলের মহব্বতের তুলনায় অধিক বেশি প্রাধান্য দেয়, সে আল্লাহর এ পরীক্ষায় ফেল করল। সে যেন তার পরিণতির প্রতীক্ষায় থাকে। অপর আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَتَّخِذُوٓاْ ءَابَآءَكُمۡ وَإِخۡوَٰنَكُمۡ أَوۡلِيَآءَ إِنِ ٱسۡتَحَبُّواْ ٱلۡكُفۡرَ عَلَى ٱلۡإِيمَٰنِۚ وَمَن يَتَوَلَّهُم مِّنكُمۡ فَأُوْلَٰٓئِكَ هُمُ ٱلظَّٰلِمُونَ ٢٣﴾ [التَّوۡبَةِ: ٤ ٢]

“হে ঈমানদারগণ, তোমরা নিজদের পিতা ও ভাইদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, যদি তারা ঈমান অপেক্ষা কুফরিকে প্রিয় মনে করে। তোমাদের মধ্য থেকে যারা তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করে তারাই যালিম”। [সূরা আত-তাওবাহ, আয়াত: ২৪]

আল্লাহ তা‘আলা স্ত্রীকেও ফিতনা বলে আখ্যায়িত করেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّ مِنۡ أَزۡوَٰجِكُمۡ وَأَوۡلَٰدِكُمۡ عَدُوّٗا لَّكُمۡ فَٱحۡذَرُوهُمۡۚ وَإِن تَعۡفُواْ وَتَصۡفَحُواْ وَتَغۡفِرُواْ فَإِنَّ ٱللَّهَ غَفُورٞ رَّحِيمٌ ١٤﴾ [التغابن : ١٤]

“হে মুমিনগণ, তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের কেউ কেউ তোমাদের দুশমন।[1] অতএব, তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর যদি তোমরা মার্জনা কর, এড়িয়ে যাও এবং মাফ করে দাও তবে নিশ্চয় আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু”। [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ৪]

তোমরা স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের মহব্বতকে আল্লাহ ও তার রাসূলের মহব্বতের ওপর প্রাধান্য দেবে না। আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্যর ওপর কারও আনুগত্য করাকে অগ্রাধিকার দেবে না। আল্লাহর নৈকট্য লাভের বিপরীতে তাদের কোনো কর্মের পাবন্দী করবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُوٓاْ إِنَّ مِنۡ أَزۡوَٰجِكُمۡ وَأَوۡلَٰدِكُمۡ عَدُوّٗا لَّكُمۡ فَٱحۡذَرُوهُمۡۚ﴾ [التغابن: ١٤]

“হে মুমিনগণ, তোমাদের স্বামী-স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের কেউ কেউ তোমাদের দুশমন। অতএব তোমরা তাদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর”। [সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৪]

আল্লাহ তা‘আলার বাণী احذروهم কথার অর্থ এ নয়, তোমরা তাদের সাহায্য সহযোগিতা করো না, তাদের থেকে তোমরা দূরে থাক, তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন কর এবং তাদের সাথে উঠ-বস থেকে বিরত থাক; বরং এর অর্থ, যখন আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বতের সাথে তাদের মহব্বতের টক্কর লাগে, তখন আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের মহব্বতকে স্ত্রী-সন্তান, ধন-দৌলত ইত্যাদির মহব্বতের ওপর প্রাধান্য দেবে। তখন আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের সন্তান-সন্ততি ইত্যাদিকে সঠিক পথে পরিচালনা করবেন এবং তোমাদের আমলকে সংশোধন করে দেবেন। এ ক্ষেত্রে একজন মুসলিমর জন্য ওয়াজিব হলো, সে যথাসাধ্য আল্লাহকে ভয় করবে। যখন আল্লাহর মহব্বতের সাথে ছেলে-সন্তান, স্ত্রী ও ধন-সম্পদের মহব্বতের সাথে সংঘর্ষ হয়, তখন আল্লাহর মহব্বতের ওপর কারও মহব্বতকে প্রাধান্য দেবে না। আল্লাহর মহব্বতকেই প্রাধান্য দেবে।

কল্যাণ ও অকল্যাণ উভয়টিই আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ পরীক্ষা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

كُلُّ نَفۡسٖ ذَآئِقَةُ ٱلۡمَوۡتِۗ وَنَبۡلُوكُم بِٱلشَّرِّ وَٱلۡخَيۡرِ فِتۡنَةٗۖ وَإِلَيۡنَا تُرۡجَعُونَ [الانبياء: ٣٥]

“প্রতিটি প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে, আর ভালো-মন্দ দ্বারা আমরা তোমাদেরকে পরীক্ষা করে থাকি এবং আমাদের কাছেই তোমাদেরকে ফিরে আসতে হবে”। [সূরা আল-আম্বিয়া আয়াত: ৩৫]

আয়াতে কল্যাণ বলতে ধন-সম্পদ, বৃষ্টি, ফসল ও যাবতীয় নি‘আমত বুঝানো হয়েছে। আর অকল্যাণ বলতে অভাব-অনটন, দুর্ভিক্ষ, অসুস্থতা ইত্যাদি বিপদ-আপদকে বুঝানো হয়েছে। উল্লিখিত কল্যাণ ও অকল্যাণ উভয়টিই মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে পরীক্ষাস্বরূপ। মানুষ একদিন আল্লাহ কাছেই ফিরে যাবেন। তাদের কাউকে স্বাধীনভাবে ছাড় দেওয়া হবে না। অনুরূপভাবে আল্লাহর আনুগত্য করা, নাফরমানী করা উভয়টিই মানুষের জন্য ফিতনা-পরীক্ষা। মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য করার আদেশ দেওয়া ও নাফরমানি করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহর আনুগত্য করা পরীক্ষা হওয়ার কারণ, যখন মসজিদে সালাতের আযান হয়, তখন একজন মানুষের সামনে বিভিন্ন ব্যস্ততা দেখা দেয়। যেমন, ভালো ভালো খাবার সামনে থাকে, খেলা-ধুলায় মগ্ন থাকে ও বিভিন্ন উপভোগ্য বিষয়াবলী তার সামনে উপস্থিত হয়, তখন সে কোনটিকে প্রাধান্য দেয়, সালাত নাকি সালাতের প্রতিবন্ধক বিষয়াবলী? এটি মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে একটি কঠিন পরীক্ষা। (যদি আল্লাহর আহ্বানে সাড়া দেয়, তবে সে পরীক্ষায় পাশ। আর যদি সাড়া না দেয় তবে সে পরীক্ষায় ফেল।)

[1] অর্থাৎ তারা কখনো কখনো আল্লাহর পথে চলা, তাঁর আনুগত্য করা অথবা আল্লাহর যিকির ও আখিরাতের স্মরণ থেকে তোমাদের বিরত রাখতে পারে। এ আয়াতে শত্রুতা ও দুশমনি বলতে এর প্রতিই ইঙ্গিত করা হয়েছে।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১ পর্যন্ত, সর্বমোট ১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে