নিজের কাজ বা সৃষ্টির কাজ আগে করা এবং স্রষ্টার কাজ পিছিয়ে দেয়া বৈধ হতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয় নামাযকে বিশ্বাসীদের জন্য নির্ধারিত সময়ে অবশ্য কর্তব্য করা হয়েছে। (নিসাঃ ১০৩)
যুদ্ধ চলাকালেও নামায পিছিয়ে না দিয়ে “সালাতুল খাওফ” পড়ার নির্দেশ আছে। সুতরাং কাজের ফাঁকেই নামায আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা রাখা জরুরী। কাজের কাপড় নোংরা হলেও পৃথক কাপড় রেখে নামায পড়তে হবে। মাঠে-ময়দানে ভিজে জায়গায় দাঁড়িয়েও নামায পরে নিতে হবে। একান্ত কেউ নিরুপায় হলে সে কথা ভিন্ন। যেমন রোগী ও মুসাফির জমা তাকদীম বা তা’খির করতে পারে। বৃষ্টির জন্যও জমা তাকদীম হতে পারে।
না, সময় পার করে নামায পড়া যথেষ্ট নয়। ইচ্ছাকৃত সময় পার করে নামায পড়লে তা নষ্ট করারই শামিল। বহু উলামার মতে এমন ব্যক্তি ‘কাফের’ হয়ে যাবে। ১৪২
যে নামাযীরা সময় পার করে নামায পড়ে, তাদের জন্য রয়েছে জাহান্নামের ‘গাই’ উপত্যকা। মহান আল্লাহ বলেন, “তাদের পর এল অপদার্থ পরবর্তীগণ তাঁরা নামায নষ্ট করলে ও প্রবৃত্তিপরায়ণ হল; সুতরাং তাঁরা অচিরেই ‘গাই’ প্রত্যক্ষ করবে।” (মারয়্যামঃ ৫৯)
নামায বিনষ্ট করার অর্থেঃ একেবারে নামায না পড়া; যা মূলতঃ কুফরী, অথবা নামাযের সময় বিনষ্ট করা; যার অর্থ সঠিক সময়ে নামায আদায় না করা, যখন ইচ্ছা পড়া বা বিনা ওযরে দুই বা ততোধিক নামাযকে একত্রে পড়া, অথবা কখনো দুই, কখনো চার, কখনো এক, কখনো পাঁচ অক্তের নামায পড়া। এ সমস্ত নামায বিনষ্ট করার অর্থে শামিল।
নামাযে শৈথিল্য বা ঢিলেমি করা অথবা নামাযকে ভারী মনে করা মুনাফিকদের কাজ। মহান আল্লাহ বলেন, “নিশ্চয় মুনাফিক (কপট) ব্যক্তিরা আল্লাহকে প্রতারিত করতে চায়। বস্তুতঃ তিনিও তাঁদেরকে প্রতারিত করে থাকেন এবং যখন তাঁরা নামাযে দাঁড়ায় তখন শৈথিল্যের সাথে নিছক লোক দেখানোর জন্য দাঁড়ায় এবং আল্লাহকে তাঁরা অল্পই স্মরণ করে থাকে।” (নিসাঃ ১৪২)
“আর তাদের দান খয়রাত গ্রহণযোগ্য না হওয়ার কারণ এ ছাড়া আর কিছুই নয় যে, তাঁরা আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে কুফরী করেছে, আর তাঁরা নামাযে শৈথিল্যের সাথেই উপস্থিত হয় এবং তাঁরা অনিচ্ছাকৃতভাবেই দান করে থাকে।” (তাওবাহঃ ৫৪)
আল্লাহ্র রাসুল (সঃ) বলেন, “মুনাফিকদের পক্ষে সবচেয়ে ভারী নামায হল এশা ও ফজরের নামায। ঐ দুই নামাযের কি মাহাত্ন্য আছে, তা যদি তাঁরা জানত, তাহলে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও অবশ্যই তাতে উপস্থিত হত। আমার ইচ্ছা ছিল যে, কাউকে নামাযের ইকামত দিতে আদেশ দিই, অতঃপর একজনকে নামায পড়তেও হুকুম করি, অতঃপর এমন একদল লোক সঙ্গে করে নিই; যাঁদের সাথে থাকবে কাঠের বোঝা। তাদের নিয়ে এমন সম্প্রদায়ের নিকট যাই, যারা নামাযে হাজির হয় না। অতঃপর তাদেরকে ঘরে রেখেই তাদের ঘরবাড়িকে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিই।” ১৪৩
না, বরং এ কাজ বিদআত। তবে যদি তা মুসাফাহাহ প্রথম সাক্ষাতের জন্য সালাম-সহ হয়, তাহলে তা সুন্নত। অর্থাৎ, নামায শুরু হওয়ার পর পাশে দাঁড়ানোর সময় সালাম-মুসাফাহাহ সুযোগ না হওয়ার ফলে নামায শেষ হওয়ার পরে তা করলে দূষণীয় নয়। ১৪৪
জামায়াতের সওয়াব নেওয়ার উদ্দেশ্যে তা বৈধ। তখন আপনার উচিৎ ইমামতি নিয়ত করে তাকবীরাদি সশব্দে পড়া। আপনি সুন্নত পড়ছেন এবং সে নিশ্চয় ফরয পড়ছে। আপনাদের এই নিয়তের ভিন্নতা নামাযের কোন ক্ষতি করবে না। সাহাবী মুআয বিন জাবাল (রঃ) আল্লাহ্র রাসুল (সঃ) এর সাথে নামায পড়তেন, তারপর নিজের গোত্রে ফিরে গিয়ে তাদের ইমামতি করে ঐ নামাযই পড়তেন। ১৪৫ তাঁর প্রথম নামায ফরয হতো এবং শেষেরটা নফল।
একদা তিনি সালাম ফিরে দেখলেন, মসজিদের এক প্রান্তে দুই ব্যক্তি জামাআতে নামায পড়েনি। কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁরা কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘আমরা আমাদের বাসায় নামায পড়ে নিয়েছি।’ তিনি বললেন, “এমনটি আর করো না। বরং যখন তোমাদের কেউ নিজ বাসায় নামায পড়ে নেয়, অতঃপর (মসজিদে এসে) দেখে যে, ইমাম নামায পড়েনি, তখন সে যেন (দ্বিতীয়বার) তাঁর সাথে নামায পড়ে। আর এ নামায তাঁর জন্য নফল হবে।” ১৪৬
মহানবী (সঃ) একদা এক ব্যক্তিকে একাকী নামায পড়তে দেখলে তিনি অন্যান্য সাহাবীদের উদ্দেশ্যে বললেন, “এমন কেউ কি নেই, যে এর সাথে নামায পড়ে একে (জামাআতের সওয়াব)দান করবে?” এ কথা শুনে এক ব্যক্তি উঠে তাঁর সাথে নামায পড়ল। ১৪৭ অথচ সে মহানবী (সঃ) এর সাথে ঐ নামায পূর্বে পড়েছিল। সুতরাং ইমামের ছিল ফরয এবং মুক্তাদীর নফল।
এ থেকে আরো বুঝা যায় যে, জামাআত শেষ হওয়ার পর দ্বিতীয় জামাআত কায়েম করা দোসাবহ নয়।
যদি সে নিশ্চিতভাবে জানে যে, পরবর্তী জামাআতের জন্য লোক আছে, তাহলে সে শেষ বৈঠকে শামিল না হয়ে অপেক্ষা করবে এবং জামাআতের সাথে নামায পড়বে। যেহেতু সঠিক মতে পূর্ণ এক রাকআত না পেলে জামাআত পাওয়া যায় না। কিন্তু যদি কোন লোক আসার আশা না থাকে, তাহলে উত্তম জামাআতে শামিল হয়ে নামায আদায় করা; যদিও তা শেষ বৈঠক। কারণ জামাআত সহকারে নামাযের কিছু অংশ পাওয়া, মোটেই কিছু না পাওয়া থেকে উত্তম। অতঃপর সে যদি জামাআতের শেষ বৈঠকে শামিল হওয়ার পর শুনতে পায় যে, দ্বিতীয় জামাআত খাড়া হয়েছে, তাহলে সে ঐ নামায (সালাম না ফিরে) বাতিল করে তাদের সাথে জামাআত সহকারে নামায আদায় করতে পারে। অথবা দু’রাকাআত হয়ে থাকলে তা নফলের নিয়ত করে সালাম ফিরে নামায শেষ করে ঐ জামাআতে শামিল হতে পারে। পরন্ত সে একাকী নামায শেষ করলেও তাতে কোন দোষ নেই। সে এই তিনটির মধ্যে একটিকে এখতিয়ার করতে পারে। ১৪৮
যেভাবে সম্ভব, সেভাবেই পড়ে নিতে হবে। কিবলা মুখে দাঁড়িয়ে, রুকু সিজদা যথা নিয়মে করা সম্ভব হলে, তা করতে হবে। নচেৎ বসে ইশারায় রুকু সিজদা করে নামায আদায় করতে হবে। মহান আল্লাহ বলেছেন, “আল্লাহকে যথাসাধ্য ভয় করে চল।” (তাগাবুনঃ ১৬)
তিনি ইমারান বিন হুসাইন (রঃ) কে বলেছিলেন, “তুমি দাঁড়িয়ে নামায পড়। না পারলে বসে পড়। তাও না পারলে পার্শ্বদেশে শুয়ে পড়।” ১৪৯
উত্তম হল প্রথম অক্তে নামায পড়ে নেওয়া। অবশ্য গন্তব্যস্থলে মাটিতে নেমে শেষে অক্তে নামায আদায় করার আশা থাকলে তাও করতে পারে। অনুরূপ মোটরগাড়ি, ট্রেন ও পানিজাহাজে নামাযের সময় হলে একই নিয়ম। ১৫০
যে মসজিদে কবর আছে, সে মসজিদে নামায শুদ্ধ নয়, চাহে সে কবর নামাযীদের পিছনে বা সামনে, ডানে বা বামে হোক। যেহেতু নবী (সঃ) বলেছেন, “ইয়াহুদী খ্রিস্টানদের উপর আল্লাহ্র অভিশাপ, কারণ তাঁরা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছে।” ১৫১
তিনি আরো বলেছেন, “সাবধান! তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের নবী ও নেক লোকেদের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিত। সাবধান! তোমরা কবরগুলোকে মসজিদ বানিয়ে নিয়ো না। এরূপ করতে আমি তোমাদেরকে নিষেধ করেছি।” ১৫২
আর যেহেতু কবরের ধারে পাশে নামায পড়া শিরকের অন্যতম অসীলা এবং তাতে থাকে কবরস্থ ব্যক্তিকে নিয়ে অতিরঞ্জন, সেহেতু উক্ত হাদীসদ্বয় এবং অনুরূপ আরো অন্যান্য হাদীসের উপর আমল করে শিরকের ছিদ্রপথ বন্ধ করার লক্ষ্যে কবরযুক্ত মসজিদে নামায নিষিদ্ধ হওয়া আবশ্যক। ১৫৩
তাদের জন্য বৈধ নয় ঘরে নামায পড়া। বরং তাদের জন্য ওয়াজেব হল, মসজিদে উপস্থিত হয়ে জামাআত সহকারে নামায আদায় করা। যেহেতু মহানবী (সঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি আযান শোনা সত্ত্বেও মসজিদে জামাআতে এসে নামায আদায় করে না, কোন ওজর না থাকলে সে ব্যক্তির নামায কবুল হয় না।” ১৫৪
একটি অন্ধ লোক নবী (সঃ)এর নিকট এসে নিবেদন করল, “হে আল্লাহ্র রাসুল! আমার কোন পরিচালক নেই, যে আমাকে মসজিদ পর্যন্ত নিয়ে যাবে।” সুতরাং সে নিজে বাড়িতে নামায পড়ার জন্য আল্লাহ্র রাসুল (সঃ) এর নিকট অনুমতি চাইল। তিনি তাকে অনুমতি দিলেন। কিন্তু যখন সে পিঠ ঘুরিয়ে রওনা দিল, তখন তিনি তাকে ডেকে বললেন, “তুমি কি আহবান (আযান)শুনতে পাও?” সে বলল, ‘জি হ্যাঁ।’ তিনি বললেন, “ তাহলে তুমি সাড়া দাও।” (অর্থাৎ মসজিদেই এসে নামায পড়।) ১৫৫
রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “সেই মহান সত্তার শপথ! যার হাতে আমার জীবন আছে। আমার ইচ্ছা হচ্ছে যে, জ্বালানী কাঠ জমা করার আদেশ দিই। তারপর নামাযের জন্য আযান দেওয়ার আদেশ দিই। তারপর কোন লোককে লোকেদের ইমামতি করতে আদেশ দিই। তারপর আমি স্বয়ং সেই সব (পুরুষ) লোকদের কাছে যাই (যারা মসজিদে নামায পড়তে আসেনি)এবং তাঁদেরকে সহ তাদের ঘর বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিই।”১৫৬
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রঃ) বলেন, “ যাকে এ কথা আনন্দ দেয় যে, সে কাল কিয়ামতের দিন আল্লাহ্র সঙ্গে মুসলিম হয়ে সাক্ষাৎ করবে, তাঁর উচিৎ, সে যেন এই নামাযসমূহ আদায়ের প্রতি যত্ন রাখে, যেখানে তাঁর জন্য আযান দেওয়া হয় (অর্থাৎ মসজিদে)। কেননা, মহান আল্লাহ তোমাদের নবী (সঃ) এর নিমিত্তে হিদায়াতের পন্থা নির্ধারণ করেছেন। আর নিশ্চয় এই নামাযসমূহ হিদায়েতের অন্যতম পন্থা ও উপায়। যদি তোমরা (ফরয) নামায নিজেদের ঘরেই পর, যেমন এই পিছিয়ে থাকা লোক নিজ ঘরে নামায পড়ে, তাহলে তোমরা তোমাদের নবীর তরীকা পরিহার করবে। আর (মনে রেখো) যদি তোমরা তোমাদের নবীর তরীকা পরিহার কর, তাহলে নিঃসন্দেহে তোমরা পথহারা হয়ে যাবে। আমি তোমাদের লোকেদের এই পরিস্থিতি দেখেছি যে, নামায (জামাতসহ পড়া) থেকে কেবল সেই মুনাফিক (কপট মুসলিম) পিছিয়ে থাকে, যে প্রকাশ্য মুনাফিক। আর (দেখেছি যে, পীড়িত)ব্যক্তিকে দুজনের (কাঁধের) উপর ভর দিয়ে নিয়ে এসে (নামাযের) সারিতে দাঁড় করানো হতো।” ১৫৭
যে কাপড় পড়া সত্ত্বেও পুরুষদের নাভির নিচে থেকে হাঁটু পর্যন্ত কোন অংশ খোলা থাকে অথবা আবছা দেখা যায়, সে কাপড়ে নামায শুদ্ধ হয় না। অনুরূপ যে শাড়ি বা ওড়নায় মহিলার মাথার চুল, ঘাড়, হাতের রলা, পেট বা পিঠের অংশ খোলা থাকে অথবা আবছা দেখা যায়, তাতে নামায হয় না। নামাযে সতর ঢাকা জরুরী। তা খোলা গেলে নামায ঘোলা হয়ে যাবে।