২২ সূরাঃ আল-হজ্জ | Al-Hajj | سورة الحج - আয়াত নং - ২৯ মাদানী

২২ : ২৯ ثُمَّ لۡیَقۡضُوۡا تَفَثَهُمۡ وَ لۡیُوۡفُوۡا نُذُوۡرَهُمۡ وَ لۡیَطَّوَّفُوۡا بِالۡبَیۡتِ الۡعَتِیۡقِ ﴿۲۹﴾

‘তারপর তারা যেন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়, তাদের মানতসমূহ পূরণ করে এবং প্রাচীন ঘরের* তাওয়াফ করে’। আল-বায়ান

অতঃপর তারা যেন তাদের দৈহিক অপরিচ্ছন্নতা দূর করে, তাদের মানৎ পূর্ণ করে আর প্রাচীন গৃহের তাওয়াফ করে। তাইসিরুল

অতঃপর তারা যেন তাদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে এবং তাদের মানত পূর্ণ করে ও তাওয়াফ করে প্রাচীন গৃহের। মুজিবুর রহমান

Then let them end their untidiness and fulfill their vows and perform Tawaf around the ancient House." Sahih International

* البيت العتيق বা পুরাতন ঘর বলতে আল্লাহর ইবাদাতের জন্য তৈরীকৃত সবচাইতে পুরাতন ঘর তথা কা‘বা ঘরকে বুঝানো হয়েছে। কারণ ইবাদাতের জন্য নির্মিত এটাই যমীনের বুকে সর্বপ্রথম ঘর।

২৯. তারপর তারা যেন তাদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে(১) এবং তাদের মানত পূর্ণ করে(২) আর তাওয়াফ করে প্রাচীন ঘরের।(৩)

(১) تفث এর আভিধানিক অর্থ ময়লা, যা মানুষের দেহে জমা হয়। [ফাতহুল কাদীর] ইহরাম অবস্থায় চুল মুণ্ডানো, চুল কাটা, উপড়ানো, নখ কাটা, সুগন্ধি ব্যবহার করা ইত্যাদি হারাম। তাই এগুলোর নীচে ময়লা জমা হওয়া স্বাভাবিক ব্যাপার। এই আয়াতে বলা হয়েছে যে, হজ্জের কুরবানী সমাপ্ত হলে দেহের ময়লা দূর করে দাও। অর্থাৎ এহরাম খুলে ফেল, মাথা মুণ্ডাও এবং নখ কাট। নাভীর নীচের চুলও পরিস্কার কর। [কুরতুবী] আয়াতে প্রথমে হাদঈ জবাই ও পরে ইহরাম খোলার কথা বলা হয়েছে। এতে বোঝা যায় যে, এই ক্রম অনুযায়ী এসব কার্যাদি সম্পন্ন করা মুস্তাহাব। যদি এতে আগ-পিছ হয়, তবে কোন সমস্যা নেই। কারণ, হাদীসে এসেছে, “সেদিন (১০ই যিলহজ্জ তারিখে) হজ্জের কাজগুলোর মধ্যে কোনটা আগ-পিছ করার ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে যখনই কোন প্রশ্ন করা হয়েছে, তখনি তিনি বলেছেনঃ কর, কোন সমস্যা নেই।” [বুখারীঃ ৮১, ১২১, ১৬২১, ১৬২২, ৬১৭২, মুসলিমঃ ১৩০৬] এ প্রসংগে এ কথা জেনে নেয়া উচিত যে, পাথর নিক্ষেপ ও মাথামুণ্ডন এ দু'টির যে কোন একটি এবং হাদঈ জবাইয়ের কাজ শেষ করার পর অন্যান্য যাবতীয় নিষেধাজ্ঞা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু স্ত্রী সহবাস ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ হয় না যতক্ষণ না ‘তাওয়াফে ইফাদাহ’ শেষ করা হয়।

(২) نذور শব্দটি نذر এর বহুবচন। অর্থাৎ এ সময়ের জন্য যে ব্যক্তি কোন মানত করে সে যেন তা পূরণ করে। শরীআতে মানতের স্বরূপ এই যে, শরীআতের আইনে যে কাজ কোন ব্যক্তির উপর ওয়াজিব নয়, যদি সে মুখে মানত করে যে, আমি এ কাজ করব অথবা আল্লাহর ওয়াস্তে আমার জন্য এ কাজ করা জরুরী, একেই নযর বা মানত বলা হয়। একে পূর্ণ করা ওয়াজিব হয়ে যায়, যদিও মূলতঃ তা ওয়াজিব ছিল না। তবে এর ওয়াজিব হওয়ার জন্য কাজটা গোনাহ ও নাজায়েয না হওয়া সর্বসম্মতিক্রমে শর্ত। যদি কেউ কোন গোনাহর কাজের মানত করে, সেই গোনাহর কাজ করা তার উপর ওয়াজিব নয়; বরং বিপরীত করা ওয়াজিব। [কুরতুবী] তবে কসমের কাফফারা আদায় করা জরুরী হবে। মানত পূর্ণ করা ওয়াজিব; আলোচ্য আয়াত থেকে মূলতঃ তাই প্রমাণিত হয়। এতে মানত পূর্ণ করার আদেশ দেয়া হয়েছে। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন, এ আয়াতে উটি বা গৃহপালিত জন্তুর যা যবেহ করার জন্য মানত করেছে সেটাকে পূরণ করতে বলা হয়েছে। মুজাহিদ বলেন, এখানে উদ্দেশ্য, হজ ও হাদঈ সংক্রান্ত মানত এবং এমন মানত যা হজের সময় সম্প্রপন্ন করতে হয়। কারও কারও মতে হজের যাবতীয় কাজকে এখানে মানত হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। [ইবন কাসীর; ফাতহুল কাদীর]

(৩) এখানে তাওয়াফ বলে তাওয়াফে যিয়ারত বা তাওয়াফে ইফাদাহ বোঝানো হয়েছে, যা যিলহজ্জের দশ তারিখে কঙ্কর নিক্ষেপ ও হাদঈ যাবাই করার পর করা হয়। এটি হজ্জের রোকন তথা ফরযের অন্তর্ভুক্ত। যা কখনও বাদ দেয়ার সুযোগ নেই। [কুরতুবী] আর যেহেতু ধূলা-ময়লা দূর করার হুকুমের সাথে সাথেই এর উল্লেখ করা হয়েছে তাই এ বক্তব্য একথা প্ৰকাশ করে যে, হাদঈ যাবাই করার এবং ইহরাম খুলে গোসল করে নেবার পর এ তাওয়াফ করা উচিত। এখানে কাবাঘরের জন্য عَتِيق শব্দ অত্যন্ত অর্থবহ। “আতীক” শব্দটি আরবী ভাষায় তিনটি অৰ্থে ব্যবহৃত হয়। একটি অর্থ হচ্ছে প্রাচীন। দ্বিতীয় অর্থ স্বাধীন, যার উপর কারোর মালিকানা নেই। তৃতীয় অর্থ সম্মানিত ও মর্যাদাপূর্ণ। [কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর] এ তিনটি অর্থই এ পবিত্র ঘরটির বেলায় প্রযোজ্য। তাছাড়া লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আল্লাহর এ ঘরটি বহিঃশত্রুর আক্রমণ হতেও মুক্ত। মুজাহিদ রাহেমাহুল্লাহ বলেনঃ আল্লাহ তাঁর গৃহের নাম (بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ) রেখেছেন; কারণ, আল্লাহ একে কাফের ও অত্যাচারীদের আধিপত্য ও অধিকার থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। কোন কাফেরের সাধ্য নেই যে, একে অধিকারভুক্ত করে। আসহাবে-ফীল তথা হস্তী-বাহিনীর ঘটনা এর পক্ষে সাক্ষ্য দেয়।

তাফসীরে জাকারিয়া

(২৯) অতঃপর তারা যেন তাদের অপরিচ্ছন্নতা দূর করে, [1] তাদের মানত পূর্ণ করে[2] এবং তাওয়াফ করে প্রাচীন (কা’বা) গৃহের। [3]

[1] অর্থাৎ, ১০ম যুলহজ্জ তারিখে জামরাতুল কুবরা (বা আক্বাবার বড় জামরায়) পাথর মারার পর হাজীরা প্রাথমিকভাবে হালাল হয়ে যান। যার পর ইহরাম খুলে ফেলেন এবং এক কথায় স্ত্রী-মিলন ছাড়া ঐ সব কাজ যা ইহরাম অবস্থায় অবৈধ ছিল, বৈধ হয়ে যায়। আর অপরিচ্ছন্নতা দূর করার অর্থ হল, চুল ও নখ ইত্যাদি কেটে নিয়ে তেল ও সুগন্ধি ব্যবহার করা, সেলাই করা কাপড় পরিধান করা ইত্যাদি।

[2] যদি কেউ মানত করে থাকে; যেমন মানত করে থাকে যে, আল্লাহ যদি আমাকে তাঁর পবিত্র ঘর কা’বা দর্শন করার সৌভাগ্য দান করেন, তাহলে আমি অমুক নেকীর কাজ (যেমনঃ নামায, রোযা বা দান) করব।

[3] عَتِيق মানে প্রাচীন, উদ্দেশ্য কা’বাগৃহ। অর্থাৎ মাথা নেড়া করা বা চুল ছেঁটে ফেলার পর (হজ্জের তাওয়াফ) তাওয়াফে ইফাযাহ করে, যাকে তাওয়াফে যিয়ারাহও বলা হয়। এটি হজ্জের একটি রুকন; যা আরাফায় অবস্থান ও জামরাতুল কুবরায় পাথর মারার পর করা হয়। পক্ষান্তরে তাওয়াফে কুদূম কিছু লোকের নিকট ওয়াজিব, আবার কিছু লোকের কাছে সুন্নত। আর তাওয়াফে বিদা’ (বিদায়ী তাওয়াফ) সুন্নতে মুআক্কাদাহ (বা ওয়াজিব); যা বেশির ভাগ উলামাদের নিকট ওজর থাকলে ত্যাগ করা বৈধ। যেমন সর্বসম্মতিক্রমে ঋতুমতী মহিলাদের ক্ষেত্রে এ তাওয়াফ মাফ। (আইসারুত্ তাফাসীর)

তাফসীরে আহসানুল বায়ান