৩৫ সূরাঃ ফাতির | Fatir | سورة فاطر - আয়াত নং - ৩২ - মাক্কী
অতঃপর আমি এ কিতাবটির উত্তরাধীকারী করেছি আমার বান্দাদের মধ্যে তাদেরকে, যাদেরকে আমি মনোনীত করেছি। তারপর তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি যুলমকারী এবং কেউ কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী। আবার তাদের কেউ কেউ আল্লাহর অনুমতিসাপেক্ষে কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী। এটাই হলো মহা অনুগ্রহ। আল-বায়ান
অতঃপর সেই কিতাবটির উত্তরাধিকারী করেছি আমি আমার বান্দাহদের মধ্যে হতে যাদেরকে বেছে নিয়েছি। অতঃপর তাদের কতক নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছে, আর কতক মধ্যপন্থী। তাদের কতক আল্লাহর নির্দেশে সৎ কাজে অগ্রণী। এটাই (মানুষের প্রতি আল্লাহর) খুবই বড় দয়া। তাইসিরুল
অতঃপর আমি কিতাবের অধিকারী করলাম আমার বান্দাদের মধ্যে তাদেরকে যাদেরকে আমি মনোনীত করেছি; তবে তাদের কেহ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেহ মধ্য পন্থী এবং কেহ আল্লাহর ইচ্ছায় কল্যাণের কাজে অগ্রগামী। এটাই মহা অনুগ্রহ। মুজিবুর রহমান
Then we caused to inherit the Book those We have chosen of Our servants; and among them is he who wrongs himself, and among them is he who is moderate, and among them is he who is foremost in good deeds by permission of Allah. That [inheritance] is what is the great bounty. Sahih International
৩২. তারপর আমরা কিতাবের অধিকারী করলাম তাদেরকে, যাদেরকে আমাদের বান্দাদের মধ্য থেকে আমরা মনোনীত করেছি।(১); তবে তাদের কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যমপন্থী এবং কেউ আল্লাহর ইচ্ছায় কল্যাণের কাজে অগ্রগামী।(২) এটাই তো মহাঅনুগ্রহ—(৩)
(১) অর্থাৎ আমার বান্দাদের মধ্যে যাদেরকে আমি মনোনীত করেছি। অধিকাংশ তফসীরবিদ এর অর্থ নিয়েছেন উম্মতে মুহাম্মদী। [ইবন কাসীর] আলেমগণ প্রত্যক্ষভাবে এবং অন্যান্য মুসলিমগণ আলেমগণের মধ্যস্থতায় এর অন্তর্ভুক্ত।
(২) অর্থাৎ যাদেরকে মনোনীত করে কুরআনের অধিকারী করেছি, তারা তিন প্রকার। [ইবন কাসীর]
এক. যুলুমকারী মুসলিম। এরা হচ্ছে এমনসব লোক যারা আন্তরিকতা সহকারে কুরআনকে আল্লাহর কিতাব এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আল্লাহ্র রাসূল বলে মানে কিন্তু কার্যত আল্লাহ্র কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের অনুসরণের হক আদায় করে না। এরা মুমিন কিন্তু গোনাহগার। অপরাধী। কিন্তু বিদ্রোহী নয়। দূর্বল ঈমানদার, তবে মুনাফিক নয় এবং চিন্তা ও মননের দিক দিয়ে কাফেরও নয়। তাই এদেরকে আত্মনিপীড়ক হওয়া সত্বেও কিতাবের ওয়ারিসদের অন্তর্ভুক্ত এবং আল্লাহর নির্বাচিত বান্দাদের মধ্যে শামিল করা হয়েছে। নয়তো একথা সুস্পষ্ট, বিদ্রোহী, মুনাফিক এবং চিন্তা ও মননের দিক দিয়ে কাফেরদের প্রতি এ গুণাবলী আরোপিত হতে পারে না। তিন শ্রেণীর মধ্য থেকে এ শ্রেনীর ঈমানদারদের কথা সবার আগে বলার কারণ হচ্ছে এই যে, উম্মাতের মধ্যে এদের সংখ্যাই বেশী।
দুই. মাঝামাঝি অবস্থানকারী। এরা হচ্ছে এমন লোক যারা এ উত্তরাধিকারের হক কমবেশী আদায় করে কিন্তু পুরোপুরি করে না। হুকুম পালন করে এবং অমান্যও করে। নিজেদের প্রবৃত্তিকে পুরোপুরি লাগামহীন করে ছেড়ে দেয়নি। বরং তাকে আল্লাহর অনুগত করার জন্য নিজেদের যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালায় কিন্তু মাঝে মাঝে কোন কোন মোস্তাহাব কাজ ছেড়ে দেয় এবং কোন কোন মাকরূহ কাজে জড়িত হয়ে পড়ে। কখনো কখনো গোনাহে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এভাবে এদের জীবনে ভালো ও মন্দ উভয় ধরনের কাজের সমাবেশ ঘটে। এরা সংখ্যায় প্রথম দলের চেয়ে কম এবং তৃতীয় দলের চেয়ে বেশী হয়। তাই এদেরকে দু’নম্বরে রাখা হয়েছে।
তিনঃ ভালো কাজে যারা অগ্রবতী। এরা যাবতীয় ফরয, ওয়াজিব ও মোস্তাহাব কর্ম সম্পাদন করে এবং যাবতীয় হারাম ও মাকরূহ কর্ম থেকে বেঁচে থাকে; কিন্তু কোন কোন মোবাহ বিষয়, ইবাদতে ব্যাপৃত থাকার কারণে অথবা হারাম সন্দেহে ছেড়ে দেয়। এরা কিতাবের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রথম সারির লোক। এরাই আসলে এ উত্তরাধিকারের হক আদায়কারী। কুরআন ও সুন্নাতের অনুসরণের ক্ষেত্রেও এরা অগ্রগামী। [বিস্তারিত বর্ণনা দেখুন, কুরতুবী; ফাতহুল কাদীর]
আবুদ্দারদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে অনুরূপ একটি তাফসীর বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘তাদের কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী’ অর্থাৎ অত্যাচারীকে হাশরের মাঠে চিন্তা ও পেরেশানীর মাধ্যমে পাকড়াও করা হবে। আর ‘কেউ মধ্যমপন্থী’ যার হিসেব হবে সহজ এবং ‘কেউ আল্লাহর ইচ্ছায় কল্যাণের কাজে অগ্রগামী’ তারা বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে। [মুসনাদে আহমাদ: ৫/১৯৪] সে হিসেবে আমাদের নিকট স্পষ্ট যে, এ তিন প্রকার লোকই উম্মতে মুহাম্মদীর অন্তর্ভুক্ত এবং اصطفى বা ‘মনোনয়ন’ গুণের বাইরে নয়। এটি হল উম্মতে মুহাম্মদীর মুমিন বান্দাদের একান্ত বৈশিষ্ট্য ও শ্রেষ্ঠত্ব। তাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কার্যত: ক্ৰটিযুক্ত, সেও এই মর্যাদার অন্তর্ভুক্ত। উপরোক্ত তাফসীর ছাড়াও এ আয়াতের আরও একটি তাফসীর রয়েছে।
কোন কোন মুফাসসির এ আয়াতের তিন শ্ৰেণীকে সূরা আল-ওয়াকি’আর তিন শ্রেণী অর্থাৎ মুকাররাবীন, আসহাবুল ইয়ামীন এবং আসহাবুশ শিমাল বলে মত প্ৰকাশ করেছেন। সে অনুসারে আয়াতে ‘তাদের কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী’ বলে কাফের, মুনাফিকদের বোঝানো হয়েছে। আর ‘কেউ মধ্যমপন্থী’ বলে ডানপন্থী সাধারণ ঈমানদার এবং ‘কেউ আল্লাহর ইচ্ছায় কল্যাণের কাজে অগ্রগামী’ বলে আল্লাহর নৈকট্যপ্ৰাপ্ত লোকদের বোঝানো হয়েছে। এ তাফসীরটিও সহীহ সনদে কাতাদা, হাসান ও মুজাহিদ থেকে বর্ণিত হয়েছে। [ইবন কাসীর] কিন্তু প্রথম তাফসীরটিই এখানে অগ্রগণ্য। কারণ তা সহীহ হাদীস দ্বারা সমর্থিত। তাছাড়া পরবর্তী আয়াতসমূহ থেকেও তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।
(৩) “এটাই মহা অনুগ্রহ” বাক্যটির সম্পর্ক যদি নিকটতম বাক্যের সাথে ধরে নেয়া হয় তাহলে এর অর্থ হবে, ভালো কাজে অগ্রগামী হওয়াই হচ্ছে বড় অনুগ্রহ এবং যারা এমনটি করে মুসলিম উম্মাতের মধ্যে তারাই সবার সেরা। আর এ বাক্যটির সম্পর্ক পূর্ববর্তী বাক্যের সাথে করা হলে এর অর্থ হবে, আল্লাহর কিতাবের উত্তরাধিকারী হওয়া এবং এ উত্তরাধিকারের জন্য নির্বাচিত হওয়াই বড় অনুগ্রহ এবং আল্লাহর সকল বান্দাদের মধ্যে সেই বান্দাই সর্বশ্রেষ্ঠ যে কুরআন ও মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান এনে এ নির্বাচনে সফলকাম হয়েছে। [দেখুন: ফাতহুল কাদীর]
তাফসীরে জাকারিয়া(৩২) অতঃপর আমি আমার দাসদের মধ্যে তাদেরকে গ্রন্থের অধিকারী করলাম যাদেরকে আমি মনোনীত করেছি;[1] তবে তাদের কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, [2] কেউ মিতাচারী[3] এবং কেউ আল্লাহর নির্দেশে কল্যাণকর কাজে অগ্রগামী। [4] এটিই মহা অনুগ্রহ। [5]
[1] গ্রন্থ বলতে কুরআন এবং মনোনীত বান্দা বা দাস বলতে উম্মতে মুহাম্মাদীকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, আমি উম্মতে মুহাম্মাদীকে এই কুরআনের অধিকারী বানিয়েছি এবং তাদেরকে আমি অন্যান্য উম্মতসমূহ ব্যতিরেকে মনোনীত করেছি এবং তাদেরকে মর্যাদা ও অনুগ্রহ প্রদান করেছি। এ আয়াতটি (وَكَذَلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا لِتَكُونُوا شُهَدَاءَ عَلَى النَّاسِ) البقرة-১৪৩) এর যে বক্তব্য তার নিকটবর্তী বক্তব্য।
[2] এখানে উম্মতে মুহাম্মাদীর তিনটি শ্রেণী উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথমঃ এমন লোক, যারা কিছু ফরয পালনে শৈথিল্য করে এবং কিছু হারাম কর্মেও লিপ্ত হয়ে পড়ে অথবা অনেকের নিকট ঐ সকল ব্যক্তি যারা সাগীরা গুনাহ করে ফেলে। তাদেরকে নিজের প্রতি অত্যাচারী এই জন্য বলা হয়েছে যে, তারা সামান্য শৈথিল্যের কারণে নিজেদেরকে সেই উচ্চস্থান থেকে বঞ্চিত করে নেবে, যা বাকি অন্য দুই প্রকারের মুসলিমরা অর্জন করতে সক্ষম হবে।
[3] এটি দ্বিতীয় শ্রেণীর উম্মতঃ অর্থাৎ, মধ্যমপন্থী; যারা ভালো-মন্দের মিশ্র আমল করে। অনেকের নিকট এরা হল তারা, যারা ফরয কাজ যথাযথভাবে পালন এবং হারাম কাজ ত্যাগ তো করে; কিন্তু কখনো কখনো মুস্তাহাব কাজ ত্যাগ করে এবং হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। অথবা ঐ সকল ব্যক্তি তারা, যারা সৎলোক তো বটে; কিন্তু অগ্রণী নয়।
[4] এরা ঐ সকল ব্যক্তি যারা দ্বীনের ব্যাপারে ইতিপূর্বে উল্লিখিত দুই দল থেকে অগ্রগামী।
[5] অর্থাৎ, কিতাবের অধিকারী বানানো এবং মর্যাদা ও অনুগ্রহ দানে মনোনীত করাটাই মহা অনুগ্রহ।
তাফসীরে আহসানুল বায়ান