পরিচ্ছেদঃ ২. প্রথম অনুচ্ছেদ - বিদায় হজের বৃত্তান্তের বিবরণ
২৫৫৫-[১] জাবির ইবনু ’আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় নয় বছর অবস্থানকালে হজ্জ/হজ পালন করেননি। অতঃপর দশম বছরে মানুষের মধ্যে ঘোষণা করলেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ বছর হজে যাবেন। তাই মদীনায় বহু লোক আগমন করলো। অতঃপর আমরা তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাথে হজ্জ/হজ করতে রওয়ানা হলাম এবং যখন যুলহুলায়ফাহ্ নামক স্থানে পৌঁছলাম (আবূ বকর-এর স্ত্রী) আসমা বিনতু ’উমায়স মুহাম্মাদ ইবনু আবূ বকর-কে প্রসব করলেন। তাই আসমা (রাঃ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে জিজ্ঞেস করে পাঠালেন, ’’আমি এখন কি করবো?’’ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে পাঠালেন, ’’তুমি গোসল করবে এবং কাপড়ের টুকরা দিয়ে টাইট করে লেঙ্গুট (প্যান্ট) পরবে। এরপর ইহরাম বাঁধবে। তখন (বর্ণনাকারী জাবির) বলেন, এ সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে দু’ রাক্’আত সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করলেন। এরপর ক্বাস্ওয়া নামক উটনীর উপর আরোহণ করলেন।
অতঃপর যখন ’বায়দা’ নামক স্থানে তাঁকে নিয়ে উটনী সোজা হয়ে দাঁড়াল তিনি আল্লাহর তাওহীদ সম্বলিত এ তালবিয়াহ্ পাঠ করলেন, ’’লাব্বায়কা আল্লা-হুম্মা লাব্বায়কা, লাব্বায়কা লা- শারীকা লাকা লাব্বায়কা, ইন্নাল হাম্দা ওয়ান্নি’মাতা লাকা ওয়াল মুল্ক, লা শারীকা লাকা।’’ জাবির (রাঃ) বলেন, আমরা হজ্জ/হজ ব্যতীত আর অন্য কিছুর নিয়্যাত করিনি। আমরা ’উমরা বিষয়ে কিছু জানতাম না। অবশেষে আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বায়তুল্লাহয় আসলাম তখন তিনি ’হাজরে আসওয়াদ’ (কালো পাথর)-এ হাত লাগিয়ে চুমু খেলেন এবং সাতবার কা’বার (বায়তুল্লাহ) তাওয়াফ করলেন। তাতে তিনবার জোরে জোরে (রমল) ও চারবার স্বাভাবিকভাবে হেঁটে হেঁটে তাওয়াফ করলেন। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাকামে ইব্রাহীমের দিকে অগ্রসর হলেন এবং কুরআনের এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, وَاتَّخِذُوْا مِنْ مَقَامِ إِبرَاهِيْمَ مُصَلّٰى ’’এবং মাকামে ইব্রাহীমকে সালাতের স্থানে রূপান্তরিত করো’’- (সূরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ১২৫) (অর্থাৎ- এর কাছে সালাত আদায় করো)। এ সময় তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাকামে ইব্রাহীমকে তার ও বায়তুল্লাহর মাঝখানে রেখে দু’ রাক্’আত সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করলেন।
অপর এক বর্ণনায় আছে, এ দু’ রাক্’আত সালাতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ’কুল হুওয়াল্লা-হু আহাদ’ ও ’কুল ইয়া- আইয়্যুহাল কা-ফিরূন’ পড়েছিলেন। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হাজারে আস্ওয়াদের দিকে ফিরে গেলেন, একে স্পর্শ করে চুমু খেলেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দরজা দিয়ে সাফা পর্বতের দিকে বের হয়ে গেলেন। যখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাফার নিকটে পৌঁছলেন তখন কুরআনের এ আয়াত তিলাওয়াত করলেন, إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللّٰهِ অর্থাৎ- ’’নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়াহ্ আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত’’- (সূরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ১৫৮)। আর বললেন, আল্লাহ তা’আলা যেখান হতে শুরু করেছেন আমিও তা ধরে শুরু করবো। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাফা হতে শুরু করলেন এবং এর উপরে চড়লেন। এখান থেকে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর ঘর দেখতে পেলেন।
অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা দিলেন এবং তাঁর মহিমা বর্ণনা করলেন। আর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, ’’আল্লাহ ছাড়া প্রকৃতপক্ষে কোন ইলাহ নেই, তিনি অদ্বিতীয়, তাঁর কোন শারীক নেই, তাঁরই সার্বভৌমত্ব ও তাঁরই সব প্রশংসা, তিনি সব কিছুতেই ক্ষমতাবান।’ আল্লাহ ছাড়া কোন মা’বূদ নেই, তিনি অদ্বিতীয়, তিনি তাঁর ওয়া’দা পূর্ণ করেছেন, তিনি তাঁর বান্দাকে সাহায্য করেছেন, একাই তিনি সম্মিলিত কুফরী শক্তিকে পরাভূত করেছেন- এ কথা তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তিনবার বললেন। এর মাঝে কিছু দু’আ করলেন। অতঃপর সাফা হতে নামলেন এবং মারওয়াহ্ অভিমুখে হেঁটে চললেন, যে পর্যন্ত তাঁর পবিত্র পা উপত্যকার মধ্যমর্তী সমতলে গিয়ে ঠেকলো।
তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দ্রুতবেগে হেঁটে চললেন, মারওয়ায় না পৌঁছা পর্যন্ত। এখানেও তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাফায় যা করেছেন, মারওয়ার শেষ চলা পর্যন্ত তাই করলেন। এমনকি যখন মারওয়াতে শেষ তাওয়াফ শেষ হলো, তখন তিনি মারওয়ার উপর দাঁড়িয়ে লোকদেরকে সম্বোধন করলেন এবং লোকেরা তখন তাঁর নীচে (অপেক্ষমাণ) ছিল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, যদি আমি আমার ব্যাপারে আগে জানতে পারতাম যা পরে আমি জেনেছি, তবে আমি কখনো কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে আনতাম না এবং একে ’উমরার রূপ দান করতাম। তাই তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে আসেনি সে যেন ’ইহরাম’ খুলে ফেলে। একে ’উমরার রূপ দান করে। এ সময় সুরাক্বাহ্ বিন মালিক ইবনু জু’শুম দাঁড়িয়ে বললো, হে আল্লাহর রসূল! এটা কি আমাদের জন্য এ বছর, নাকি চিরকালের জন্য? তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ হাতের আঙুলগুলো পরস্পরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে দু’বার বললেন, ’উমরা হজের মধ্যে প্রবেশ করলো না। বরং চিরকালের জন্যে।
এ সময় ’আলী (রাঃ) ইয়ামান হতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরবানীর পশু নিয়ে আসলেন (তিনি সেখানে বিচারক পদে নিযুক্ত ছিলেন)। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি (ইহরাম বাঁধার সময় নিয়্যাতে) কি বলেছিলে? ’আলী(রাঃ) বললেন, আমি বলেছি- হে আল্লাহ! আমি ইহরাম বাঁধছি যেভাবে তোমার রসূল ইহরাম বেঁধেছেন!’’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার সাথে কুরবানীর পশু রয়েছে, তাই তুমি ইহরাম খুলো না। রাবী জাবির (রাঃ) বলেন, যেসব কুরবানীর পশুগুলো ’আলী(রাঃ) ইয়ামান হতে নিয়ে এসেছিলেন এবং যেগুলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের সাথে নিয়ে এসেছিলেন তাতে মোট একশ’ হয়ে গেলো। রাবী জাবির বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাথে যারা নবীর মতো পশু নিয়ে এসেছিলেন, তারা ছাড়া সকলে ইহরাম খুলে হালাল হয়ে গেলেন এবং চুল কাটলেন। অতঃপর (৮ যিলহাজ্জ) তারবিয়ার দিন তাঁরা সকলেই নতুন করে ইহরাম বাঁধলেন এবং মিনা অভিমুখে রওয়ানা হলেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-ও সওয়ার হয়ে গেলেন এবং সেখানে যুহর, ’আসর, মাগরিব, ’ইশা ও ফজরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করলেন। অতঃপর সূর্যোদয় পর্যন্ত স্বল্প সময় অবস্থান করলেন।
এ সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আদেশ করলেন যেন তাঁর জন্যে নামিরাহ্’য় একটি পশমের তাঁবু খাটানো হয়। এ কথা বলে তিনিও সেদিকে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তখন কুরায়শগণের এ বিষয়ে সন্দেহ ছিল না যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চয়ই মাশ্’আরুল হারাম-এর নিকটে অবস্থান করবেন, যেভাবে তারা জাহিলিয়্যাতের যুগে করতো (নিজের মর্যাদাহানির আশঙ্কায় সাধারণের সাথে ’আরাফাতে সহবস্থান করবেন না)। কিন্তু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ’আরাফাতে না পৌঁছা পর্যন্ত সামনে অগ্রসর হলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন, নামিরাহ্’য় তাঁর জন্য তাঁবু খাটানো হয়েছে। তাই তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেখানে নামলেন (অবস্থান নিলেন) সূর্য ঢলা পর্যন্ত। অতঃপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাঁর ক্বাস্ওয়া উষ্ট্রীর জন্য আদেশ করলেন।
ক্বাস্ওয়া সাজানো হলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ’বাত্বনি ওয়াদী’ বা ’আরানা’ উপত্যকায় পৌঁছলেন এবং লোকদের উদ্দেশে ভাষণ দিলেন, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন- ’’তোমাদের একজনের জীবন ও সম্পদ অপরের প্রতি (সকল দিন, কাল ও স্থানভেদে) হারাম যেভাবে এ দিনে, এ মাসে, এ শহরে হারাম। সাবধান! জাহিলিয়্যাতের যুগের সকল অপকর্ম আমার পদতলে প্রোথিত হলো, জাহিলিয়্যাত (মূর্খতার) যুগের রক্তের দাবীগুলো রহিত হলো। আর আমাদের রক্তের দাবীসমূহের যে দাবী আমি প্রথমে রহিত করলাম, তা হলো (আমার নিজ বংশের ’আয়াশ) ইবনু রবী’আহ্ ইবনু হারিস-এর রক্তের দাবী। যে বানী সা’দ গোত্রের দুধপানরত অবস্থায় ছিল তখন হুযায়ল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করে। এভাবে জাহিলিয়্যাত যুগের সূদ মাওকূফ (রহিত) হয়ে গেল। আর আমাদের (বংশের) যে সূদ আমি প্রথমে মাওকূফ করলাম তা (আমার চাচা) ’আব্বাস ইবনু ’আবদুল মুত্ত্বালিব-এর (পাওনা) সূদ, তা সবই মাওকূফ করা হলো।’’
’’তোমরা তোমাদের নারীদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করবে। কেননা তোমরা তাদেরকে গ্রহণ করেছো আল্লাহর আমানাত হিসেবে এবং আল্লাহর নামে তাদের গুপ্তাঙ্গকে হালাল করেছো। তাদের ওপর তোমাদের হাক্ব হলো তারা যেন তোমাদের বিছানায় এমন কাউকেও আসতে না দেয়, যাকে তোমরা অপছন্দ কর। যদি তারা তা করে, তবে তাদেরকে মৃদু প্রহার করবে। আর তোমাদের ওপর তাদের হাক্ব হলো, তোমরা ন্যায়সঙ্গতভাবে তাদের খাদ্য ও পোশাকের ব্যবস্থা করবে।’’
’’আমি তোমাদের মাঝে এমন একটি জিনিস রেখে যাচ্ছি যদি তোমরা তা আকড়ে ধরো, তবে তোমরা আমার মৃত্যুর পর কখনো বিপথগামী হবে না- তা হচ্ছে আল্লাহর কিতাব।’’
’’হে লোক সকল! তোমরা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে, তখন তোমরা কি বলবে? লোকেরা উত্তরে বললো, আমরা সাক্ষ্য দিবো যে, আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর বাণী আমাদের কাছে পৌঁছিয়েছেন। নিজের কর্তব্য সম্পূর্ণরূপে পালন করেছেন এবং আমাদের কল্যাণ কামনা করেছেন। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজের শাহাদাত অঙ্গুলি আকাশের দিকে উঠিয়ে এবং মানুষের দিকে তা ইঙ্গিত করে তিনবার বললেন, ’’হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থেকো।’’
অতঃপর বিলাল(রাঃ) আযান ও ইক্বামাত(ইকামত/একামত) দিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুহরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করলেন। বিলাল আবার ইক্বামাত(ইকামত/একামত) দিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ’আসরের সালাত আদায় করলেন। এর মাঝে কোন নফল সালাত আদায় করলেন না। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ক্বাস্ওয়া উষ্ট্রীতে আরোহণ করে (’আরাফাতে) নিজের অবস্থানস্থলে পৌঁছলেন। এখানে এর পিছন দিক (জাবালে রহমতের নীচে) পাথরসমূহের দিকে এবং হাবলুল মুশাত-কে নিজের সম্মুখে করে কিবলার দিকে ফিরলেন। সূর্য না ডুবা ও পিত রং কিছুটা না চলে যাওয়া পর্যন্ত এভাবে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এখানে দাঁড়িয়ে রইলেন।
এরপর সূর্যের গোলক পরিপূর্ণ নীচের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলো। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) উসামাকে নিজের সওয়ারীর পেছনে বসালেন এবং মুযদালিফায় পৌঁছা পর্যন্ত সওয়ারী চালাতে থাকলেন। এখানে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এক আযান ও দুই ইক্বামাত(ইকামত/একামত)ের সাথে মাগরিব ও ’ইশার সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করলেন। এর মধ্যে কোন নফল সালাত আদায় করলেন না। তারপর ভোর না হওয়া পর্যন্ত শুয়ে রইলেন। ভোর হয়ে গেলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আযান ও ইক্বামাত(ইকামত/একামত) দিয়ে ফজরের সালাত আদায় করলেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ক্বাস্ওয়া নামক উষ্ট্রীতে আরোহণ করে চলতে লাগলেন যতক্ষণ না মাশ্’আরাল হারামে এসে পৌঁছলেন। সেখানে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কিবলামুখী হয়ে আল্লাহর কাছে দু’আ করলেন। তাঁর মহিমা ঘোষণা করলেন, কালিমায়ে তাওহীদ (লা- ইলা-হা ইল্লালস্ন-হ) পড়লেন এবং তাঁর একত্ব ঘোষণা করলেন। এভাবে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেখানে আকাশ পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকলেন।
অতঃপর তিনি সূর্যোদয়ের পূর্বেই সওয়ারী চালিয়ে দিলেন এবং আপন (চাচাতো ভাই) ফযল ইবনু ’আব্বাস-কে সওয়ারীর পেছনে বসালেন। এভাবে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ’বাত্বনি মুহাস্সির’ নামক স্থানে পৌঁছলেন এবং সওয়ারীকে কিছুটা দৌড়ালেন। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মধ্যম পথে চললেন যা বড় জামারার দিকে গিয়েছে। সুতরাং তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওই জামারায় পৌঁছলেন যা গাছের নিকট অবস্থিত (অর্থাৎ- বড় জামারাহ্) এবং বাত্বনি ওয়াদী (অর্থাৎ- নীচের খালি জায়গা) হতে এর উপর বুটের মতো সাতটি কংকর মারলেন। আর প্রত্যেক কংকর মারার সময় ’’আল্লা-হু আকবার’’ বললেন। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সেখান থেকে কুরবানীর জায়গায় ফিরে আসলেন এবং তেষট্টিটি উট নিজ হাতে কুরবানী করলেন। অতঃপর যা বাকী রইলো তা ’আলীকে বাকী পশুগুলো দিলেন, তিনি তা কুরবানী করলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিজের পশুতে ’আলীকেও শারীক করলেন। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) প্রত্যেক পশু হতে এক টুকরা নিয়ে একই হাড়িতে পাকানোর নির্দেশ দেন। সুতরাং নির্দেশ অনুযায়ী একটি ডেকচিতে তা পাকানো হয়।
তারা উভয়ে এর মাংস (গোসত/মাংস) খেলেন ও ঝোল পান করলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সওয়ারীতে আরোহণ করলেন এবং বায়তুল্লাহর দিকে রওয়ানা হলেন। মক্কায় পৌঁছে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যুহরের সালাত আদায় করলেন। এরপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) (নিজ বংশ) বানী ’আবদুল মুত্ত্বালিব-এর নিকট পৌঁছলেন। তারা তখন যমযমের পাড়ে দাঁড়িয়ে লোকজনকে পানি পান করাচ্ছিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে বললেন, হে বানী আবদুল মুত্ত্বালিব! তোমরা টানো (দ্রুত কর), আমি যদি আশংকা না করতাম যে, পানি পান করানোর ব্যাপারে লোকেরা তোমাদের উপরে জয়লাভ করবে, তবে আমিও তোমাদের সাথে পানি টানতাম। তখন তারা তাঁকে এক বালতি পানি এনে দিলেন, তা হতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পানি পান করলেন। (মুসলিম)[1]
بَابُ قِصَّةِ حَجَّةِ الْوَدَاعِ
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَكَثَ بِالْمَدِينَةِ تِسْعَ سِنِينَ لَمْ يَحُجَّ ثُمَّ أَذَّنَ فِي النَّاسِ بالحجِّ فِي الْعَاشِرَةِ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَاجٌّ فَقَدِمَ الْمَدِينَةَ بَشَرٌ كَثِيرٌ فَخَرَجْنَا مَعَهُ حَتَّى إِذَا أَتَيْنَا ذَا الْحُلَيْفَةِ فَوَلَدَتْ أَسْمَاءُ بِنْتُ عُمَيْسٍ مُحَمَّدَ بْنَ أَبِي بَكْرٍ فَأَرْسَلَتْ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: كَيْفَ أصنعُ؟ قَالَ: «اغتسِلي واستثقري بِثَوْبٍ وَأَحْرِمِي» فَصَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي الْمَسْجِدِ ثُمَّ رَكِبَ الْقَصْوَاءَ حَتَّى إِذَا اسْتَوَتْ بِهِ نَاقَتُهُ عَلَى الْبَيْدَاءِ أَهَلَّ بِالتَّوْحِيدِ «لَبَّيْكَ اللَّهُمَّ لَبَّيْكَ لَبَّيْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ لَبَّيْكَ إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ لَا شَرِيكَ لَكَ» . قَالَ جَابِرٌ: لَسْنَا نَنْوِي إِلَّا الْحَجَّ لَسْنَا نَعْرِفُ الْعُمْرَةَ حَتَّى إِذَا أَتَيْنَا الْبَيْتَ مَعَهُ اسْتَلَمَ الرُّكْنَ فَطَافَ سَبْعًا فَرَمَلَ ثَلَاثًا وَمَشَى أَرْبَعًا ثُمَّ تَقَدَّمَ إِلَى مَقَامِ إِبْرَاهِيمَ فَقَرَأَ: (وَاتَّخِذُوا مِنْ مَقَامِ إِبراهيمَ مُصَلَّى)
فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ فَجَعَلَ الْمَقَامَ بَيْنَهُ وَبَيْنَ الْبَيْتِ وَفِي رِوَايَةٍ: أَنَّهُ قَرَأَ فِي الرَّكْعَتَيْنِ: (قُلْ هوَ اللَّهُ أَحَدٌ و (قُلْ يَا أيُّها الكافِرونَ)
ثُمَّ رَجَعَ إِلَى الرُّكْنِ فَاسْتَلَمَهُ ثُمَّ خَرَجَ مِنَ الْبَابِ إِلَى الصَّفَا فَلَمَّا دَنَا مِنَ الصَّفَا قَرَأَ: (إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شعائِرِ اللَّهِ)
أَبْدَأُ بِمَا بَدَأَ اللَّهُ بِهِ فَبَدَأَ بِالصَّفَا فَرَقِيَ عَلَيْهِ حَتَّى رَأَى الْبَيْتَ فَاسْتَقْبَلَ الْقِبْلَةَ فَوَحَّدَ اللَّهَ وَكَبَّرَهُ وَقَالَ: «لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَحْدَهُ أَنْجَزَ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ» . ثُمَّ دَعَا بَيْنَ ذَلِكَ قَالَ مِثْلَ هَذَا ثَلَاثَ مَرَّاتٍ ثُمَّ نَزَلَ وَمَشَى إِلَى الْمَرْوَةِ حَتَّى انْصَبَّتْ قَدَمَاهُ فِي بَطْنِ الْوَادِي ثُمَّ سَعَى حَتَّى إِذَا صَعِدْنَا مَشَى حَتَّى أَتَى الْمَرْوَةَ فَفَعَلَ عَلَى الْمَرْوَةِ كَمَا فَعَلَ عَلَى الصَّفَا حَتَّى إِذَا كَانَ آخِرُ طَوَافٍ عَلَى الْمَرْوَةِ نَادَى وَهُوَ عَلَى الْمَرْوَةِ وَالنَّاسُ تَحْتَهُ فَقَالَ: «لَوْ أَنِّي اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِي مَا اسْتَدْبَرْتُ لَمْ أسق الهَدْيَ وجعلتُها عُمْرةً فمنْ كانَ مِنْكُم لَيْسَ مَعَهُ هَدْيٌ فَلْيَحِلَّ وَلْيَجْعَلْهَا عُمْرَةً» . فَقَامَ سُرَاقَةُ بْنُ مَالِكِ بْنِ جُعْشُمٍ فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ أَلِعَامِنَا هَذَا أَمْ لِأَبَدٍ؟ فَشَبَّكَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَصَابِعَهُ وَاحِدَةً فِي الْأُخْرَى وَقَالَ: «دَخَلَتِ الْعُمْرَةُ فِي الْحَجِّ مَرَّتَيْنِ لَا بَلْ لِأَبَدِ أَبَدٍ» . وَقَدِمَ عَلِيٌّ مِنَ الْيَمَنِ بِبُدْنِ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ لَهُ: «مَاذَا قُلْتَ حِينَ فَرَضْتَ الْحَجَّ؟» قَالَ: قُلْتُ: اللهُمَّ إِنِّي أُهِلُّ بِمَا أهلَّ بهِ رسولُكَ قَالَ: «فَإِنَّ مَعِي الْهَدْيَ فَلَا تَحِلَّ» . قَالَ: فَكَانَ جَمَاعَةُ الْهَدْيِ الَّذِي قَدِمَ بِهِ عَلِيٌّ مِنَ الْيَمَنِ وَالَّذِي أَتَى بِهِ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مِائَةً قَالَ: فَحَلَّ النَّاسُ كُلُّهُمْ وَقَصَّرُوا إِلَّا النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم وَمن كَانَ مَعَه من هدي فَمَا كَانَ يَوْمُ التَّرْوِيَةِ تَوَجَّهُوا إِلَى مِنًى فَأَهَلُّوا بِالْحَجِّ وَرَكِبَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَصَلَّى بِهَا الظُّهْرَ وَالْعَصْرَ وَالْمَغْرِبَ وَالْعِشَاءَ وَالْفَجْرَ ثُمَّ مَكَثَ قَلِيلًا حَتَّى طَلَعَتِ الشَّمْسُ وَأَمَرَ بِقُبَّةٍ مِنْ شَعَرٍ تُضْرَبُ لَهُ بِنَمِرَةَ فَسَارَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَلَا تَشُكُّ قُرَيْشٌ إِلَّا أَنَّهُ وَاقِفٌ عِنْدَ الْمَشْعَرِ الْحَرَامِ كَمَا كَانَتْ قُرَيْشٌ تَصْنَعُ فِي الْجَاهِلِيَّةِ فَأجَاز رَسُول الله صلى حَتَّى أَتَى عَرَفَةَ فَوَجَدَ الْقُبَّةَ قَدْ ضُرِبَتْ لَهُ بِنَمِرَةَ فَنَزَلَ بِهَا حَتَّى إِذَا زَاغَتِ الشَّمْسُ أَمَرَ بِالْقَصْوَاءِ فَرُحِلَتْ لَهُ فَأَتَى بَطْنَ الْوَادِي فَخَطَبَ النَّاسَ وَقَالَ: «إِنَّ دِمَاءَكُمْ وَأَمْوَالَكُمْ حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هَذَا فِي شَهْرِكُمْ هَذَا فِي بَلَدِكُمْ هَذَا أَلَا كُلُّ شَيْءٍ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ تَحْتَ قَدَمَيَّ مَوْضُوعٌ وَدِمَاءُ الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوعَةٌ وَإِنَّ أَوَّلَ دَمٍ أَضَعُ مِنْ دِمَائِنَا دَمُ ابْنِ رَبِيعَةَ بْنِ الْحَارِثِ وَكَانَ مُسْتَرْضَعًا فِي بَنِي سَعْدٍ فَقَتَلَهُ هُذَيْلٌ وَرِبَا الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوعٌ وَأَوَّلُ رِبًا أَضَعُ مِنْ رِبَانَا رِبَا عَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَإِنَّهُ مَوْضُوعٌ كُلُّهُ فَاتَّقُوا اللَّهَ فِي النِّسَاءِ فَإِنَّكُمْ أَخَذْتُمُوهُنَّ بِأَمَانِ اللَّهِ وَاسْتَحْلَلْتُمْ فُرُوجَهُنَّ بِكَلِمَةِ اللَّهِ وَلَكُمْ عَلَيْهِنَّ أَنْ لَا يُوطِئْنَ فُرُشَكُمْ أَحَدًا تَكْرَهُونَهُ فَإِنْ فَعَلْنَ ذَلِكَ فَاضْرِبُوهُنَّ ضَرْبًا غَيْرَ مُبَرِّحٍ وَلَهُنَّ عَلَيْكُمْ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَقَدْ تَرَكْتُ فِيكُمْ مَا لَنْ تَضِلُّوا بَعْدَهُ إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ كِتَابَ اللَّهِ وَأَنْتُمْ [ص:786] تُسْأَلُونَ عَنِّي فَمَا أَنْتُمْ قَائِلُونَ؟» قَالُوا: نَشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ وَأَدَّيْتَ وَنَصَحْتَ. فَقَالَ بِإِصْبَعِهِ السَّبَّابَةِ يَرْفَعُهَا إِلَى السَّمَاءِ وَيَنْكُتُهَا إِلَى النَّاسِ: «اللَّهُمَّ اشْهَدْ اللَّهُمَّ اشْهَدْ» ثَلَاثَ مَرَّاتٍ ثُمَّ أَذَّنَ بِلَالٌ ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الظُّهْرَ ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الْعَصْرَ وَلَمْ يُصَلِّ بَيْنَهُمَا شَيْئًا ثُمَّ رَكِبَ حَتَّى أَتَى الْمَوْقِفَ فَجَعَلَ بَطْنَ نَاقَتِهِ الْقَصْوَاءِ إِلَى الصَّخَرَاتِ وَجَعَلَ حَبْلَ الْمُشَاةِ بَيْنَ يَدَيْهِ وَاسْتَقْبَلَ الْقِبْلَةَ فَلَمْ يَزَلْ وَاقِفًا حَتَّى غَرَبَتِ الشَّمْسُ وَذَهَبَتِ الصُّفْرَةُ قَلِيلًا حَتَّى غَابَ الْقُرْصُ وَأَرْدَفَ أُسَامَةَ وَدَفَعَ حَتَّى أَتَى الْمُزْدَلِفَةَ فَصَلَّى بِهَا الْمَغْرِبَ وَالْعَشَاءَ بِأَذَانٍ وَاحِدٍ وَإِقَامَتَيْنِ وَلَمْ يُسَبِّحْ بَيْنَهُمَا شَيْئًا ثُمَّ اضْطَجَعَ حَتَّى طَلَعَ الْفَجْرُ فَصَلَّى الْفَجْرَ حِينَ تَبَيَّنَ لَهُ الصُّبْحُ بِأَذَانٍ وَإِقَامَةٍ ثُمَّ رَكِبَ الْقَصْوَاءَ حَتَّى أَتَى الْمَشْعَرَ الْحَرَامَ فَاسْتَقْبَلَ الْقِبْلَةَ فَدَعَاهُ وَكَبَّرَهُ وَهَلَّلَهُ وَوَحَّدَهُ فَلَمْ يَزَلْ وَاقِفًا حَتَّى أَسْفَرَ جِدًّا فَدَفَعَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ وَأَرْدَفَ الْفَضْلَ بْنَ عَبَّاسٍ حَتَّى أَتَى بَطْنَ مُحَسِّرٍ فَحَرَّكَ قَلِيلًا ثُمَّ سَلَكَ الطَّرِيقَ الْوُسْطَى الَّتِي
تَخْرُجُ
عَلَى الْجَمْرَةِ الْكُبْرَى حَتَّى أَتَى الْجَمْرَةَ الَّتِي عِنْدَ الشَّجَرَةِ فَرَمَاهَا بِسَبْعِ حَصَيَاتٍ يُكَبِّرُ مَعَ كُلِّ حَصَاةٍ مِنْهَا مِثْلَ حَصَى الْخَذْفِ رَمَى مِنْ بَطْنِ الْوَادِي ثُمَّ انْصَرَفَ إِلَى الْمَنْحَرِ فَنَحَرَ ثَلَاثًا وَسِتِّينَ بَدَنَةً بِيَدِهِ ثُمَّ أَعْطَى عَلِيًّا فَنَحَرَ مَا غَبَرَ وَأَشْرَكَهُ فِي هَدْيِهِ ثُمَّ أَمَرَ مِنْ كُلِّ بَدَنَةٍ بِبَضْعَةٍ فَجُعِلَتْ فِي قِدْرٍ فَطُبِخَتْ فَأَكَلَا مِنْ لَحْمِهَا وَشَرِبَا مِنْ مَرَقِهَا ثُمَّ رَكِبَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَفَاضَ إِلَى الْبَيْتِ فَصَلَّى بِمَكَّةَ الظُّهْرَ فَأَتَى عَلَى بَنِي عَبْدِ الْمُطَّلِبِ يَسْقُونَ عَلَى زَمْزَمَ فَقَالَ: «انْزِعُوا بَنِي عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَلَوْلَا أَنْ يَغْلِبَكُمُ النَّاسُ عَلَى سِقَايَتِكُمْ لَنَزَعْتُ مَعَكُمْ» . فَنَاوَلُوهُ دَلْوًا فَشَرِبَ مِنْهُ. رَوَاهُ مُسْلِمٌ
ব্যাখ্যা: (اغْتَسِلِىْ) ‘‘তুমি গোসল করো’’। অত্র হাদীসের এ অংশটি প্রমাণ করে নিফাস অবস্থায় ইহরাম বাঁধার জন্য গোসল করা প্রয়োজন। যদিও সে তখনো নিফাস হতে পবিত্র হয়নি। ঋতুবতী মহিলার ক্ষেত্রেও এ বিধান প্রযোজ্য। আর এ গোসল পবিত্রতার গোসল নয় বরং তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও দুর্গন্ধ দূর করার নিমিত্তে। যাতে সমবেত লোকজন দুর্গন্ধজনিত কষ্ট হতে মুক্ত থাকতে পারে।
(اسْتَلَمَ الرُّكْنَ) ‘‘হাজারে আস্ওয়াদ স্পর্শ করলেন।’’ কোন প্রকার গুণ বর্ণনা করে শুধুমাত্র (الرُّكْنَ) শব্দটি উল্লেখ করলে তা দ্বারা হাজারে আস্ওয়াদই বুঝায়। অর্থাৎ- তিনি উক্ত পাথরটির উপর হাত রাখলেন এবং তাতে চুমু দিলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) রুকনে ইয়ামানীকেও স্পর্শ করেন তবে তাতে চুমু দেননি। সম্ভব হলে হাজারে আস্ওয়াদ স্পর্শ করে তাতে চুমু দেয়া সুন্নাত। যদি তা কষ্টকর হয় তবে শুধুমাত্র হাত দ্বারা স্পর্শ করে হাতে চুমু দিবে। তাও সম্ভব না হলে লাঠি দ্বারা পাথর স্পর্শ করে তাতে চুমু দিবে। তাও যদি সম্ভব না হয় তাহলে হাজারে আসওয়াদের দিকে কোন কিছু দিয়ে ইশারা করবে। তবে ইশারাকৃত বস্ত্ততে চুমু দিবে না। আর রুকনে ইয়ামানীতে শুধুমাত্র স্পর্শ করাই সুন্নাত। তাতে চুমু দেয়া সুন্নাত নয়। আর তা স্পর্শ করতে না পারলে অন্য কিছু করবে না। তাওয়াফের প্রতি চক্করেই হাজারে আসওয়াদের এসে তার দিকে ইশারা করা এবং ‘আল্লা-হু আকবার’ বলা মুস্তাহাব।
(فَرَمَلَ) ‘‘অতঃপর তিনি রমল করলেন।’’ অর্থাৎ- কাঁধ দুলিয়ে ছোট পদক্ষেপে দ্রুতগতিতে অগ্রসর হলেন। (ثَلَاثًا) ‘‘তিনবার’’ অর্থাৎ- সাত চক্করের তিন চক্করে তিনি রমল করে বাকী চার চক্কর স্বাভাবিক গতিতে হাঁটলেন। আর এ তাওয়াফের সকল চক্করেই তিনি ইযতিবা' করেন। ডান কাঁধ খালি চাদরের দু’প্রান্ত বাম কাঁধের উপর তুলে দিয়ে গায়ে চাদর জড়ানোকে ইযতিবা' বলা হয়। ইমাম নাববী বলেনঃ মুহরিম যদি ‘আরাফাতে অবস্থানের পূর্বে মক্কাতে প্রবেশ করে তার জন্য তাওয়াফ কুদূম করা সুন্নাত। আর তাওয়াফে কুদূমের প্রথম তিন চক্করে রমল করাও সুন্নাত।
(فَصَلّٰى رَكْعَتَيْنِ) ‘‘অতঃপর তিনি দু’ রাক্‘আত সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করলেন।’’ অত্র হাদীস প্রমাণ করে তাওয়াফ শেষে মাকামে ইব্রাহীমের পিছনে দু’ রাক্‘আত সালাত আদায় করা বিধিসম্মত। এ বিষয়ে সকলেই একমত। তবে এ সালাত সুন্নাত, না-কি ওয়াজিব এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
(ثُمَّ رَجَعَ إِلَى الرُّكْنِ فَاسْتَلَمَه) ‘‘এরপর তিনি হাজারে আস্ওয়াদের নিকটে ফিরে এসে তা স্পর্শ করলেন।’’ এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তাওয়াফ কুদূম সম্পাদনকারী তাওয়াফের পর সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) শেষে পুনরায় হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করার পর সাফা পাহাড়ের দিকের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাবে। তবে সকলেই একমত যে, এ স্পর্শ করা সুন্নাত, তা ওয়াজিব নয়। আর তা পরিত্যাগকারীর জন্য কোন কাফফারাহ দিতে হবে না।
(أَبْدَأُ بِمَا بَدَأَ اللّٰهُ بِه) ‘‘আমি সেখান থেকে (সা‘ঈ) শুরু করব যা দিয়ে আল্লাহ আয়াত শুরু করেছেন’’। অর্থাৎ- আমি সাফা পাহাড় থেকে সা‘ঈর কাজ শুরু করব। কেননা আল্লাহ বলেছেনঃ إِنَّ الصَّفَا وَالْمَرْوَةَ مِنْ شَعَائِرِ اللّٰهِ।
‘আল্লামা সিন্দী বলেনঃ রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বক্তব্য থেকে এ কথা বুঝায় যে, আল্লাহ তা‘আলা যে বিষয় প্রথমে উল্লেখ করেছেন কর্মক্ষেত্রেও তা প্রথমে হওয়া বাঞ্ছনীয়। তবে এ শুরুটা মুস্তাহাব, ওয়াজিব নয়।
(فَبَدَأَ بِالصَّفَا فَرَقِىَ عَلَيْهِ) ‘‘তিনি সা‘ঈ শুরু করার উদ্দেশে সাফা পাহাড়ে আরোহণ করলেন।’’
(ثُمَّ دَعَا بَيْنَ ذٰلِكَ قَالَ مِثْلَ هٰذَا ثَلَاثَ مَرَّاتٍ) অতঃপর তিনি এর মাঝে দু‘আ করলেন। আর উল্লিখিত যিকির তিনবার পাঠ করলেন। ‘আল্লামা সিন্দী বলেনঃ উল্লিখিত যিকির তিনবার পাঠ করবে এবং প্রত্যেকবার অত্র যিকির পাঠ শেষে দু‘আ করবে।
ইমাম নাবাবী বলেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বাণী- (أَبْدَأُ بِمَا بَدَأَ اللّٰهُ بِه)। অত্র হাদীসে হজ্জের বিভিন্ন বিষয় বর্ণিত হয়েছে।
(১) সা‘ঈর জন্য শর্ত হলো তা সাফা থেকে শুরু করতে হবে। এটা ইমাম শাফি‘ঈ, ইমাম মালিক ও জমহূর ‘উলামাগণের অভিমত। নাসায়ীতে বর্ণিত আছে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ (أَبْدَوْوا بِمَا بَدَأَ اللّٰهُ بِه) অর্থাৎ- ‘‘তোমরা সেখান থেকে শুরু করো যা দ্বারা আল্লাহ শুরু করেছেন।’’ এখানে (أَبْدَأوا) শব্দটি বহুবচন এবং তা আদেশসূচক।
(২) সা‘ঈর শুরুতে সাফা পাহাড়ে আরোহণ করা উচিত। তবে এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। জমহূর ‘উলামাগণের মতে তা সুন্নাত, ওয়াজিব নয়। তা পরিত্যাগ করলে সা‘ঈ বিশুদ্ধ হবে। কিন্তু ফাযীলাত থেকে বঞ্চিত হবে। আমাদের সাথীরা বলেন, তা মুস্তাহাব।
(৩) সাফা পাহাড়ে আরোহণ করে কিবলামুখী হয়ে উল্লেখিত যিকির পাঠ এবং দু‘আ করা সুন্নাত। আর তা তিনবার পাঠ করবে।
(حَتَّى انْصَبَّتْ قَدَمَاهُ فِىْ بَطْنِ الْوَادِىْ ثُمَّ سَعٰى) ‘‘তার পদদ্বয় নিম্নভূমিতে অবতরণের পর তিনি দৌড়ালেন।’’ অর্থাৎ- ছোট পদক্ষেপে দ্রুত পদচারণা করলেন।
(حَتّٰى اِذَا صَعِدَتَا) ‘‘এমনভাবে তার পদদ্বয় নিম্নভূমি হতে উঁচু ভূমিতে আরোহণের পর তিনি হেঁটে চললেন।’’ ইমাম নাবাবী বলেনঃ এতে এ প্রমাণ পাওয়া যায় যে, সা‘ঈ করাকালে নিম্নভূমিতে দ্রুত পদক্ষেপে দৌড়াতে হবে। অতঃপর উঁচু ভূমিতে আসার পর সাধারণ গতিতে মারওয়া পর্যন্ত হেঁটে চলবে। এ স্থানে সাত চক্করের প্রতি চক্করেই দ্রুত দৌড়িয়ে চলা মুস্তাহাব। আর নিম্নভূমির পূর্বে উঁচু ভূমিতে হেঁটে চলা মুস্তাহাব। যদি কোন ব্যক্তি সাফা ও মারওয়ার মাঝখানে সম্পূর্ণ স্থান হেঁটে চলে অথবা দৌড়িয়ে চলে তবে তার সা‘ঈ বিশুদ্ধ হবে। কিন্তু ফাযীলাত থেকে বঞ্চিত হবে।
(فَفَعَلَ عَلَى الْمَرْوَةِ كَمَا فَعَلَ عَلَى الصَّفَا) ‘‘মারওয়াতে তাই করলেন তিনি সাফাতে যা করেছিলেন। অর্থাৎ- মারওয়াতে আরোহণ করে কিবলামুখী হয়ে পূর্বোল্লিখিত যিকির পাঠ ও দু‘আ করলেন। এটিও পূর্বের মতই সুন্নাত।
(حَتّٰى اِذَا كَانَ اٰخِرُ طَوَافٍ عَلَى الْمَرْوَةِ) ‘‘তাওয়াফের শেষ চক্করে যখন তিনি মারওয়াতে এলেন।’’ হাদীসের এ অংশ প্রমাণ করে যে, সাফা হতে মারওয়াতে যাওয়া এক চক্কর গণনা করা হবে। আবার মারওয়াহ্ থেকে সাফাতে যাওয়া আরেক চক্কর। এভাবে সাফা থেকে সা‘ঈ শুরু করে মারওয়াতে যেয়ে সা‘ঈর সপ্তম চক্কর শেষ হবে। এটাই ইমাম শাফি‘ঈ ও জমহূর ‘উলামাগণের অভিমত। পক্ষান্তরে আবূ বাকর সায়রাফী-এর মতে সাফা থেকে মারওয়াতে গিয়ে পুনরায় সাফাতে ফিরে আসলে এক চক্কর হবে। এ মতানুযায়ী সাফা হতে সা‘ঈ শুরু হয়ে সাফাতেই তা শেষ হবে। কিন্তু এ সহীহ হাদীসটি তাদের এ অভিমত প্রত্যাখ্যান করে।
(لَوْ أَنِّى اسْتَقْبَلْتُ مِنْ أَمْرِىْ مَا اسْتَدْبَرْتُ) ‘‘যা আমি এখন বুঝতে পেরেছি তা যদি আমি আগে বুঝতে পারতাম।’’ অর্থাৎ- যখন আমি হজ্জের কাজ শুরু করেছি তখন যদি বুঝতে পারতাম।
(لَمْ أَسُقِ الْهَدْىَ) ‘‘তাহলে আমি কুরবানীর পশু নিয়ে আসতাম না’’। কেননা কোন ব্যক্তি যখন ইহরাম বাঁধার সময় থেকে কুরবানীর পশু সাথে নিয়ে আসে তাহলে তা যাবাহ করার আগে তার জন্য হালাল হওয়া বৈধ নয়। আর ইয়াওমুন্ নাহরের পূর্বে অর্থাৎ- ১০ই যিলহজ্জের পূর্বে কুরবানীর পশু যাবাহ করা বৈধ নয়। আর এমন ব্যক্তির জন্য হজ্জের উদ্দেশে বাঁধা ইহরামকে ‘উমরাতে রূপান্তর করতে পারে না। আর যে ব্যক্তি কুরবানীর পশু না নিয়ে আসবে তার জন্য হজ্জের ইহরামকে ‘উমরার ইহরামে রূপান্তর করা বৈধ।
হাদীসের এ অংশ প্রমাণ করে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তামাত্তু' হজ্জ/হজ করেননি, বরং তাঁর হজ্জ/হজ ছিল হজ্জে কিরান।
(وَجَعَلْتُهَا عُمْرَةً) ‘‘আমি তা ‘উমরাতে রূপান্তর করতাম।’’ অর্থাৎ- আমি আমার হজ্জের ইহরামকে ‘উমরাতে রূপান্তর করে ‘উমরার কাজ সমাপনান্তে হালাল হয়ে পুনরায় হজ্জ/হজ সম্পাদন করে তামাত্তু' হজ্জ/হজ সম্পাদন করতাম।
(أَلِعَامِنَا هٰذَا أَمْ لِأَبَدٍ؟) ‘‘এ বিধান কি শুধু এ বৎসরের জন্য না-কি চিরদিনের জন্য?’’ অর্থাৎ- হজ্জের নিয়্যাত পরিবর্তন করে তা ‘উমরাতে পরিণত করা কি শুধু এ বৎসরের জন্য? হাদীসের প্রকাশমান অর্থ এটিই, অথবা এর অর্থ হলো হজ্জের মাসসমূহে ‘উমরা পালন করা অথবা হজ্জের সাথে ‘উমরা পালন করার বিধান কি শুধু এ বৎসরের জন্য?
(دَخَلَتِ الْعُمْرَةُ فِى الْحَجِّ مَرَّتَيْنِ لَا بَلْ لِأَبَدِ أَبَدٍ) ‘‘হজ্জের সাথে ‘উমরা পালনের বিধান চিরদিনের জন্য। তা কোন বৎসরের জন্য খাস নয়।" সুরাকার প্রশ্নের উদ্দেশ্য কি? তা নিয়ে ‘উলামাগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে।
(১) এর উদ্দেশ্য হজ্জের মাসসমূহে ‘উমরা পালন করা।
(২) এর দ্বারা উদ্দেশ্য হজে কিবরান করা।
(৩) হজ্জের নিয়্যাত পরিবর্তন করে তা ‘উমরাতে পরিণত করা।
১ম মতানুযায়ী- (دَخَلَتِ الْعُمْرَةُ فِى الْحَجِّ)-এর অর্থ হলো হজ্জের মাসসমূহে ‘উমরা করা বৈধ। এর দ্বারা জাহিলী যুগের এ ধারণাকে বাতিল ঘোষণা করা যে, হজ্জের মাসসমূহে ‘উমরা বৈধ নয়।
২য় মতানুযায়ী- এর অর্থ হলো যে ব্যক্তি একই সাথে হজ্জ/হজ ও ‘উমরার নিয়্যাত করেছে তার ‘উমরা হজ্জের সাথে মিশে গেছে এবং ‘উমরার কাজসমূহ হজ্জের কাজের মধ্যে প্রবেশ করেছে, ফলে উভয় কাজ হতে একবারে হালাল হবে।
৩য় মতানুযায়ী- এর অর্থ হলো হজ্জের নিয়্যাতের মধ্যে ‘উমরা-এর নিয়্যাত প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ- যে ব্যক্তি হজ্জের নিয়্যাত করেছে তার পক্ষে ‘উমরা-এর কাজ সম্পাদন করে হালাল হওয়া বৈধ। হজ্জের নিয়্যাত পরিবর্তন করে তা ‘উমরাতে পরিণত করার অর্থ হলো যে ব্যক্তি হজ্জে ইফরাদ বা হজ্জে কিরানের নিয়্যাত করেছে এবং সাথে কুরবানীর পশু নিয়ে যায়নি এবং সে ‘আরাফাতে অবস্থান করার পূর্বে বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করার পর সাফা মারওয়াতে সা‘ঈ করেছে তার জন্য হজ্জের নিয়্যাত পরিবর্তন করে উপর্যুক্ত কাজসমূহকে শুধুমাত্র ‘উমরাতে পরিণত করার নিয়্যাত করা এবং উক্ত কাজসমূহ সমাপনান্তে মাথা মুণ্ডন করে ইহরাম থেকে হালাল হবে। পরবর্তীতে হজ্জের নিয়্যাত করে পৃথকভাবে হজ্জের কাজ সম্পাদন করে হজে তামাত্তু' সম্পাদনকারী হবে। আর পরিবর্তন করা কি শুধু সাহাবীগণের পক্ষে ঐ বৎসরের জন্য খাস ছিল না-কি তা চিরদিনের জন্য বৈধ- এ বিষয়ে ‘উলামাগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে।
(১) ইমাম আহমাদ, আহলুয্ যাহির ও আহলুল হাদীসদের মতে তা সাহাবীগণের জন্য খাস নয় বরং এ বিধান ক্বিয়ামাত পর্যন্ত বহাল আছে। অতএব যে কোন ব্যক্তি যদি হজ্জ/হজ ইফরাদ বা হজ্জ/হজ কিরানের জন্য ইহরাম বাঁধে এবং সাথে কুরবানীর পশু না থাকে তাহলে তার ঐ ইহরামকে ‘উমরাতে পরিণত করতে পারবে এবং ‘উমরা-এর কাজ সমাপনান্তে ইহরাম থেকে হালাল হয়ে যাবে।
(২) ইমাম মালিক, শাফি‘ঈ, আবূ হানীফা ও জমহূর ‘উলামাগণের মতে এটা শুধু সাহাবীগণের পক্ষে ঐ বৎসরের জন্য খাস। পরবর্তীতে কারো জন্য তা বৈধ নয়।
যারা বলেন তা সাহাবীগণের জন্য খাস তাদের দলীল নিম্নরূপঃ
(১) মুসলিমে আবূ যার হতে বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেনঃ হজ্জের মুত্‘আহ্, অর্থাৎ- হজ্জ/হজ্জকে ‘উমরাতে রূপান্তর করা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাহাবীগণের জন্য খাস।
(২) আহমাদ, আবূ দাঊদ, নাসায়ী ও ইবনু মাজাহতে বিলাল ইবনুল হারিস বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেনঃ আমি বললাম, হে আল্লাহর রসূল! হজ্জ/হজ্জকে ‘উমরাতে রূপান্তর করা এটা কি আমাদের জন্য খাস, না-কি তা সবার জন্যই? নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ বরং তা তোমাদের জন্য খাস।
বাহ্যিক দৃষ্টিতে মনে হয় যে, জাবির (রাঃ) বর্ণিত হাদীস ও আবূ যার এবং বিলাল ইবনুল হারিস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে আসলে তা নয় বরং হাদীস দু’টোর মধ্যে সমন্বয় করা সম্ভব। তা এভাবে যে, বিলাল ইবনুল হারিস (রাঃ) এবং আবূ যার (রাঃ) বর্ণিত হাদীস সাহাবীগণের জন্য খাস এ অর্থে যে, এ সফরে যারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে হজ্জের নিয়্যাত করেছিলেন। কিন্তু যাদের সাথে কুরবানীর পশু ছিল না রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশের কারণে তাদের জন্য ওয়াজিব ছিল হজ্জ/হজকে ‘উমরাতে রূপান্তর করা। আর তা সাহাবীগণের জন্যই খাস।
আর জাবির (রাঃ) বর্ণিত হাদীসে তা চিরদিনের জন্য, অর্থাৎ- হজ্জকে ‘উমরাতে রূপান্তর করা চিরদিনের জন্য বৈধ। তবে তা ওয়াজিব নয়। হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী এবং ‘আল্লামা শানক্বীত্বী উভয় প্রকারের হাদীসের মধ্যে এভাবে সমন্বয় করেছেন। আর এটাই সঠিক। আল্লাহই ভাল জানেন।
(اَللّٰهُمَّ إِنِّىْ أُهِلُّ بِمَا أهلَّ به رَسُوْلُكَ) ‘‘হে আল্লাহ! আমি সে ইহরাম বাঁধলাম যে ধরনের ইহরাম বেঁধেছে আপনার রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।’’
এতে এ প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কোন ব্যক্তি যদি বলে অমুক ব্যক্তি যে ধরনের ইহরাম বেঁধেছে আমিও সে ধরনের ইহরাম বাঁধলাম, তাহলে তা সহীহ ও সঠিক। এ ব্যক্তির ইহরাম ঐ ব্যক্তির ইহরামের মতই যার নাম তিনি উল্লেখ করেছেন। ইমাম শাফি‘ঈ এবং তার অনুসারীদের অভিমত এটিই।
ইমাম আবূ হানীফার মতে তার ইহরাম সঠিক। কিন্তু যার নাম তিনি উল্লেখ করেছেন এর ইহরাম উল্লিখিত ব্যক্তির ইহরামের মতো হওয়া আবশ্যক নয়।
(فَحَلَّ النَّاسُ كُلُّهُمْ) ‘‘অতঃপর সবাই হালাল হয়ে গেল।’’ অর্থাৎ- অধিকাংশ লোকই ‘উমরা সম্পাদন করে হালাল হয়ে গেল।
(وَقَصَّرُوْا) ‘‘এবং তারা তাদের মাথার চুল ছেঁটে খাটো করল।’’ ‘আল্লামা ত্বীবী বলেনঃ মাথা মুন্ডানো উত্তম হওয়া সত্ত্বেও তারা এজন্য খাটো করেছিল যাতে মাথাতে কিছু চুল অবশিষ্ট থাকে এবং হজ্জ/হজ সম্পাদনের পর মাথা মুন্ডাতে পারে যাতে তারা চুল খাটো করা এবং মাথা মুন্ডানোর উভয় প্রকারের সাওয়াবই অর্জনে সক্ষম হয়।
(يَوْمُ التَّرْوِيَةِ) ‘‘তারবিয়ার দিন’’। এটি যিলহজ্জ মাসের অষ্টম দিন। এ দিনকে (التَّرْوِيَةِ) এজন্য বলা হয় যে, হাজীগণ এ দিনে নিজেরা পানি পান করে যেমন তৃপ্ত হয় তেমনি তাদের বাহন উটকে পানি পান করিয়ে তৃপ্ত করায় এবং পরবর্তী দিনগুলোর জন্য পানির ব্যবস্থা করতো ‘আরাফাতে অবস্থানের প্রস্ত্ততি স্বরূপ। কেননা তৎকালীন সময়ে বর্তমানের ন্যায় ‘আরাফাতে পানির কোন ব্যবস্থা ছিল না।
এটাও বলা হয়ে থাকে যে, কুরায়শগণ হাজীদেরকে পান করানোর উদ্দেশে মক্কা থেকে পানি নিয়ে যেত ফলে হাজীগণ তা পান করে তৃপ্ত হত। অথবা ইব্রাহীম (আঃ) এ দিনে চিন্তা-ভাবনা করেছিলেন যে, তার পুত্র ইসমা‘ঈলকে কিভাবে কুরবানী করবেন। আর (التَّرْوِيَةِ) শব্দটি চিন্তা-ভাবনার অর্থেও ব্যবহার হয়, তাই এ দিনের নাম (يَوْمُ التَّرْوِيَةِ) ‘‘তারবিয়ার দিন’’ নামকরণ করা হয়েছে। আল্লাহ ভাল জানেন।
প্রকাশ থাকে যে, যিলহজ্জ মাসের পরস্পর ছয়টি দিনের পৃথক পৃথক নাম রয়েছে।
(১) অষ্টম দিন- ইয়াওমুত্ তারবিয়াহ্, (২) নবম দিন- ‘আরাফাহ্, (৩) দশম দিন- আন্ নাহর, (৪) একাদশ দিন- আল ক্বার। কেননা এ দিন তারা মিনাতে অবস্থান করে, (৫) দ্বাদশ দিন- আন্ নাফরুল আওয়াল, (৬) ত্রয়োদশ দিন- আন্ নাফরুস্ সানী।
(فَأَهَلُّوْا بِالْحَجِّ) ‘‘তারা হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধল।’’
আলমুহিববুত্ তাবারী বলেনঃ এতে এ ইঙ্গিত রয়েছে যে, মক্কাহ্বাসীগণ এবং তামাত্তু হজ্জ/হজ সম্পাদনকারীগণ এ দিনই হজ্জের জন্য ইহরাম বাঁধবেন। এতে এ ইঙ্গিতও পাওয়া যায় যে, মক্কাতে যারা ইহরাম বাঁধবে এ দিন তারা তাওয়াফ ও সাঈ' করবে না।
(ثُمَّ مَكَثَ قَلِيلًا حَتّٰى طَلَعَتِ الشَّمْسُ) ‘‘তিনি সূর্যোদয় পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন।’’ এতে প্রমাণিত হয় যে, সূর্যোদয়ের পর মিনা থেকে ‘আরাফার উদ্দেশে রওয়ানা হওয়া সুন্নাত। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মিনাতে অবস্থান এবং তথায় সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায়, রাত যাপন করা প্রমাণ করে যে, এসবগুলোই মুস্তাহাব। অষ্টম দিনের দিবাগত রাতে মিনাতে অবস্থান করা আর মিনার দিবসগুলোতে, অর্থাৎ- ইয়াওমুন্ নাহর থেকে পরবর্তী দিনগুলোতে মিনাতে রাত যাপনের বিধানের মধে পার্থক্য রয়েছে। এতে সবাই একমত।
ইমাম নাবাবী বলেনঃ এ রাতে (অষ্টম দিন দিবাগত রাতে) মিনাতে যাতায়াত করা সুন্নাত। তা হজ্জের রুকনও নয় এবং তা ওয়াজিবও নয়। এ রাতে কেউ মিনাতে রাত যাপন না করলে তার জন্য দম ওয়াজিব নয় এতে ঐকমত্য রয়েছে।
(وَأَمَرَ بِقُبَّةٍ مِنْ شَعَرٍ تُضْرَبُ لَه بِنَمِرَةَ) ‘‘নামিরাতে তার জন্য একটি তাঁবু খাটানোর নির্দেশ দিলেন।’’ ইমাম ত্বীবী বলেন, নামিরাহ্ ‘আরাফাহ্ পার্শ্বস্থ একটি জায়গার নাম, তা ‘আরাফাহ্ নয়। ইমাম নাবাবী বলেনঃ এ হাদীস প্রমাণ করে ইহরামধারী ব্যক্তি তাঁবু বা অন্য কিছুর দ্বারা ছায়া গ্রহণ করতে পারে। অবস্থানকারীর পক্ষে ছায়া গ্রহণ করার বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই। আরোহী ব্যক্তির পক্ষে তা বৈধ কি-না এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। অধিকাংশ ‘আলিমদের মতে তা বৈধ। ইমাম মালিক ও আহমাদের মতে মাকরূহ। ইমাম নাবাবী আরো বলেনঃ এতে এ প্রমাণ পাওয়া যায় যে, মিনা থেকে রওয়ানা হয়ে গিয়ে নামিরাতে অবস্থান করা মুস্তাহাব। কেননা সুন্নাত হলো যুহর ও ‘আসরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) যুহরের ওয়াক্তে একত্রে আদায় করার পর ‘আরাফাতে গিয়ে অবস্থান করা। অতএব সূর্য ঢলে পড়ার পূর্ব পর্যন্ত নামিরাতে অবস্থান করা সুন্নাত। সূর্য ঢলার পর ইমাম মুসল্লীদের নিয়ে মসজিদে ইব্রাহীমে (নামিরাতে অবস্থিত মাসজিদ) যেয়ে খুতবাহ্ দিবেন। অতঃপর তাদের নিয়ে যুহর ও ‘আসরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায়ান্তে ‘আরাফাতে যেয়ে অবস্থান করবেন।
(حَتّٰى اَتٰى عَرَفَةَ) ‘‘তিনি ‘আরাফাতে আগমন করলেন।’’ অর্থাৎ- ‘আরাফার নিকটবর্তী হলেন। ‘আরাফার নাম ‘আরাফাহ্ হওয়ার কারণ এই যে, জিবরীল (আঃ) এখানে ইব্রাহিম (আঃ)-কে হজ্জের নিয়মাবলী শিখিয়েছিলেন অথবা আদম (আঃ) ও হাওয়া (আঃ) দুনিয়াতে আগমনের পর এখানেই তাদের পুনর্মিলন ও পরিচয় ঘটে অথবা লোকজন পরস্পরের সাথে এখানে পরিচয় ঘটে, তাই এ স্থানের নাম ‘আরাফাহ্।
(فَخَطَبَ النَّاسَ) ‘‘অতঃপর লোকদের উদ্দেশে খুতবাহ্ দিলেন।’’ যুরক্বানী বলেনঃ অত্র হাদীসে প্রমাণ মিলে যে, ‘আরাফার দিনে অত্র স্থানে ইমামের জন্য খুতবাহ্ দেয়া মুস্তাহাব। জমহূর ‘উলামাগণের এটাই অভিমত। ইমাম শাফি‘ঈ-এর মতে হজ্জ/হজ মাওকূফে চার স্থানে খুতবাহ্ দেয়া ইমামের জন্য সুন্নাত।
(১) যিলহজ্জ মাসের সপ্তম দিনে মক্কাতে যুহরের সালাতের পর।
(২) নামিরাতে ‘আরাফার দিনে।
(৩) মিনাতে ইয়াও্মুন্ নাহরের দিন।
(৪) আইয়্যামে তাশরীক্বের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ- ইয়াওমুন্ নাফরিল আওয়াল।
ইমাম আবূ হানীফার মতে হজ্জে তিনটি খুতবাহ্ সুন্নাত।
প্রথম দু’টি ইমাম শাফি‘ঈ-এর মতই।
তৃতীয়টি মিনাতে যিলহজ্জের একাদশ দিনে। অর্থাৎ- ইয়াওমুল ক্বার।
(حَرَامٌ عَلَيْكُمْ كَحُرْمَةِ يَوْمِكُمْ هٰذَا فِىْ شَهْرِكُمْ هٰذَا) ‘‘তোমাদের পরস্পরের রক্ত প্রবাহিত করা হারাম। যেমন- আজকের দিনে তা হারাম।’’
অর্থাৎ- যিলহজ্জ মাসে ‘আরাফার দিনে মক্কাতে তা যে রকম হারাম তেমনি অন্যায়ভাবে তার রক্ত প্রবাহিত করা তথা হত্যা করা সম্পদ অন্যায়ভাবে জবর-দখল করা, তোমাদের কারো সম্মানহানি করা হারাম। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুসলিমদের জান, মাল ও সম্মানের মর্যাদাকে, মক্কা, ‘আরাফাহ্ ও যিলহজ্জ মাসের মর্যাদার সাথে তুলনা করার কারণ এই যে, ঐ মাসে ঐ স্থানে এগুলো করা কারো নিকটই বৈধ নয়। তাই জান-মাল ও সম্মানের মর্যাদার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য ঐ বস্ত্তগুলোর সাথে তুলনা করা হয়েছে।
(كُلُّ شَىْءٍ مِنْ أَمْرِ الْجَاهِلِيَّةِ تَحْتَ قَدَمَىَّ مَوْضُوعٌ) ‘‘জাহিলী যুগের সকল রীতিনীতি আমার পদতলে রাখা হলো।’’ অর্থাৎ- প্রত্যাখ্যাত ও বাতিল।
(وَدِمَاءُ الْجَاهِلِيَّةِ مَوْضُوعَةٌ) ‘‘জাহিলী যুগের রক্তের দাবী প্রত্যাখ্যাত’’। অর্থাৎ- তার ক্বিসাস, দিয়াত ও কাফফারাহ সব কিছুই বাতিল ও পরিত্যক্ত। কেউ তার দাবী করতে পারবে না। দাবী করলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। ক্বিসাসের বিধান তো জাহিলী যুগের লোকেরা উদ্ভাবন করেনি। তা সত্ত্বেও নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাতিল করার মাধ্যমে জাহিলী যুগের ঝগড়ার ধারাবাহিকতাকে বন্ধ করার উদ্দেশে এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
(وَإِنَّ أَوَّلَ دَمٍ أَضَعُ مِنْ دِمَائِنَا دَمُ ابْنِ رَبِيعَةَ بْنِ الْحَارِثِ) ‘‘আমাদের বংশের রক্তের দাবী যা আমি পরিত্যক্ত ঘোষণা করছি তা হলো রবী‘আর ছেলের রক্তের দাবী’’। ইমাম নাবাবী বলেনঃ যিনি মানুষকে ভাল কাজের আদেশ দান করেন এবং মন্দ কাজের নিষেধ করেন তার কর্তব্য হলো প্রথমে নিজের মধ্যে নিজ পরিবারের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা। তা করলেই বিষয়টি লোকজনের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা পাবে। এজন্যই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথমে নিজ বংশীয় রক্তের দাবী ছেড়ে দেন। উক্ত রবী‘আহ্ ছিলেন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাচাতো ভাই। ঐ ভাইয়ের ছেলের নাম ছিল (إياس) ইয়াস্।
(فَاتَّقُوا اللّٰهَ فِى النِّسَاءِ) ‘‘মহিলাদের ব্যাপারে তোমরা আল্লাহকে ভয় করো।’’ যেহেতু জাহিলী যুগের সকল রীতিনীতি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে তন্মধ্যে মহিলাদের অধিকার না দেয়া এবং তাদের প্রতি সুবিচার না করা জাহিলী যুগের একটি রীতি। তাই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের ব্যাপারে উম্মাতকে নির্দেশ দিয়েছেন ইসলামী শারী‘আতের নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে এবং এ বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করতে।
অত্র হাদীসে নারীদের অধিকার রক্ষা করা এবং তাদের সাথে সদাচরণের আদেশ দিয়েছেন।
(فَإِنَّكُمْ أَخَذْتُمُوهُنَّ بِأَمَانِ اللّٰهِ) ‘‘তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানাত হিসেবে গ্রহণ করেছো।’’ যুরক্বানী বলেনঃ আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের নিকট আমানাত রেখেছেন। অতএব সে আমানাত সংরক্ষণ করা এবং ইহকালীন ও পরকালীন সকল অধিকার ও তাদের কল্যাণের প্রতি খেয়াল রাখা তোমাদের একান্ত কর্তব্য।
(وَلَكُمْ عَلَيْهِنَّ أَنْ لَا يُوطِئْنَ فُرُشَكُمْ أَحَدًا تَكْرَهُونَه) ‘‘তাদের ওপর তোমাদের অধিকার হলো তারা এমন কাউকে তোমার বিছানায় আসতে দিবে না যাদেরকে তোমরা অপছন্দ করো।’’
ইমাম খাত্ত্বাবী বলেনঃ এর অর্থ হলো তারা কোন পর-পুরুষকে তাদের নিকট প্রবেশের অনুমতি দিবে না তাদের সাথে গল্প করার জন্য। ইসলাম পূর্বযুগে ‘আরব দেশে নারী-পুরুষদের মধ্যে পরস্পর গল্প করার প্রচলন ছিল। এটাকে তারা কোন প্রকার দোষণীয় মনে করত না। পর্দার আয়াত নাযিল হওয়ার পর নারীদেরকে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হলো এবং পর-পুরুষের সাথে বসে গল্প করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়া হলো।
(فَاضْرِبُوهُنَّ ضَرْبًا غَيْرَ مُبَرِّحٍ) ‘‘তাদেরকে কঠিন মার মারবে না।’’ অর্থাৎ- তারা যদি তোমাদের অনুমতি ব্যতীত কোন পুরুষকে বাড়ীতে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে ফেলে তাহলে তোমরা তাদের হালকা প্রহার করতে পারো। কিন্তু এমন প্রহার করা যাবে না যাতে তা কষ্টদায়ক হয়। অত্র হাদীসে পুরুষদেরকে তার অধীনস্থ কোন নারী অপরাধে জড়িত হওয়ার কারণে তাদেরকে প্রহার করার অনুমতি দেয়া হয়েছে যাতে তারা সাবধান হয়ে যায়।
(وَلَهُنَّ عَلَيْكُمْ رِزْقُهُنَّ وَكِسْوَتُهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ) ‘‘তারা তোমাদের নিকট ন্যায়সঙ্গত ভরণ-পোষণ পাওয়ার অধিকারী।’’ অর্থাৎ- তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য-পানীয়, বাসস্থান এবং পরিধেয় পোষাকাদি যথারীতি পাবে। এ ক্ষেত্রে যেমন অপব্যয় করা যাবে না তেমনিভাবে কৃপণতাও করা যাবে না। ধনী ব্যক্তি তার অবস্থানুযায়ী তা প্রদান করবে। আর দরিদ্র ব্যক্তি তার অবস্থানুযায়ী। আর তা কুরআন, হাদীস ও ইজমা দ্বারা সাব্যস্ত।
(كِتَابَ اللّٰهِ) ‘‘আল্লাহর কিতাব’’। অর্থাৎ- আমি তোমাদের নিকট কুরআন রেখে গেলাম তা আকড়িয়ে ধরে থাকলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। এখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু হাদীসের কথা উল্লেখ করেননি। অথচ কিছু কিছু বিধান হাদীস থেকেই জানা যায়। এর কারণ এই যে, কুরআনের উপর ‘আমল হাদীসের উপর ‘আমলও আবশ্যক করে। কেননা আল্লাহ তা‘আলা বলেছেনঃ أَطِيْعُوا اللَّهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُوْلَ ‘‘তোমরা আল্লাহর ও রসূল-এর আনুগত্য করো’’। অতএব কিতাব তথা কুরআনের উপর ‘আমলই হাদীসের উপর ‘আমল করা অপরিহার্য করে। এতে এ ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, কুরআনই আসল।
(اَللّٰهُمَّ اشْهَدْ) ‘‘হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাকো।’’ অর্থাৎ- তোমার বান্দাগণের স্বীকৃতি (نَشْهَدُ أَنَّكَ قَدْ بَلَّغْتَ) ‘‘আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি রিসালাতের দায়িত্ব উম্মাতের নিকট পৌঁছিয়েছেন।’’ তাদের এ স্বীকৃতির প্রতি তুমি সাক্ষী থাকো।
(ثُمَّ أَذَّنَ بِلَالٌ ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الظُّهْرَ ثُمَّ أَقَامَ فَصَلَّى الْعَصْرَ) ‘‘অতঃপর বিলাল আযান দেয়ার পর ইক্বামাত দিলে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যুহরের সালাত আদায় করলেন, অতঃপর ইক্বামাত দিলে তিনি ‘আসরের সালাত আদায় করলেন।’’ অর্থাৎ- নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুহরের ওয়াক্তে এক আযানে ও দু’ ইক্বামাতে যুহরের ও ‘আসরের সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) জমা করে আদায় করলেন।
অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, ‘আরাফাতে এক আযান ও দু’ ইক্বামাতে যুহর ও ‘আসরের সালাত জমা করে আদায় করতে হয়।
এ বিষয়ে ‘উলামাগণের মাঝে তিনটি মত পরিলক্ষিত হয়।
(১) এক আযান ও দু’ ইক্বামাতে তা আদায় করতে হবে। এ অভিমত পোষণ করেন ইমাম আবূ হানীফা, সাওরী, শাফি‘ঈ, আবূ সাওর, আহমাদ ও ইমাম মালিক থেকে এক বর্ণনা অনুযায়ী। মালিকী মাযহাবের ইবনুল কাসিম, ইবনু মাজিশূন এবং ইবনু মাওয়াযির অভিমতও তাই।
(২) আযান ব্যতীত দু’ ইক্বামাতে তা আদায় করতে হবে। ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে এমন একটি বর্ণনা পাওয়া যায়।
(৩) দু’ আযান ও দু’টি ইক্বামাত দিতে হবে। মালিকী মাযহাবের এটিই প্রসিদ্ধ মত। ইবনু কুদামাহ্ বলেনঃ হাদীসে যা বর্ণিত হয়েছে, তাই উত্তম।
জেনে রাখা ভাল যে, ‘আরাফাতে যুহর ও ‘আসরের সালাত একত্রে আদায় করার জন্য ইমাম আবূ হানীফার মতানুযায়ী তা জামা‘আত সহকারে বড় ইমাম তথা খলীফাহ্ অথবা তার প্রতিনিধির নেতৃত্বে আদায় করা শর্ত। মুযদালিফাতে মাগরিব ও ‘ইশার সালাত একত্রে আদায় করার ক্ষেত্রে এ শর্ত প্রযোজ্য নয়। সাওরী ও ইব্রাহীম নাখ্‘ঈর অভিমতও তাই।
ইমাম মালিক, শাফি‘ঈ ও আহমাদের মতানুযায়ী তা শর্ত নয়। আর এ মতটি প্রবল।
(ثُمَّ رَكِبَ حَتّٰى اَتَى الْمَوْقِفَ) ‘‘অতঃপর বাহনে আরোহণ করে মাওক্বিফে আসলেন।’’ অর্থাৎ- ‘আরাফার ময়দানে আসলেন। ‘আরাফার ময়দান পুরোটাই অবস্থানস্থল। আর এখানে অবস্থানের সময়সীমা ‘আরাফার দিনে সূর্য ঢলে যাওয়ার পর থেকে ইয়াওমুন্ নাহরের ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত। যে ব্যক্তি এ সময়ের মধ্যে এর কোন অংশে ‘আরাফায় অবস্থান করে তার হজ্জ/হজ বিশুদ্ধ। আর যে ব্যক্তি তা করতে ব্যর্থ তার হজ্জ/হজ হবে না। এটাই ইমাম শাফি‘ঈ ও জমহূর ‘উলামাগণের অভিমত। ইমাম মালিক-এর মতে শুধুমাত্র দিনের কোন এক ভাগে ‘আরাফায় অবস্থান করলে হজ্জ/হজ বিশুদ্ধ হবে না বরং দিনের সাথে রাতের কিছু অংশও ‘আরাফায় অবস্থান করতে হবে।
(وَاسْتَقْبَلَ الْقِبْلَةَ) ‘‘তিনি কিবলামুখী হলেন।’’ এতে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ‘আরাফায় অবস্থান কিবলামুখী হওয়া মুস্তাহাব।
(حَتّٰى اَتَى الْمُزْدَلِفَةَ فَصَلّٰى بِهَا الْمَغْرِبَ وَالْعَشَاءَ بِأَذَانٍ وَاحِدٍ وَإِقَامَتَيْنِ) ‘‘তিনি মুযদালিফাতে এসে এক আযান ও দু’ ইক্বামাতে (‘ইশার ওয়াক্তে) মাগরিব ও ‘ইশার সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করলেন।’’ ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেনঃ এ হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ‘আরাফাহ্ থেকে মুযদালিফাতে গমনকারী ব্যক্তির জন্য মাগরিবের সালাত বিলম্ব করে ‘ইশার সালাতের সাথে একত্রে আদায় করা সুন্নাত। তবে কেউ যদি মাগরিবের সময়ে ‘আরাফাতে অথবা রাস্তায় অথবা অন্য কোন স্থানে এ দু’ সালাত একত্রে আদায় করে অথবা পৃথক পৃথকভাবে নিজ নিজ ওয়াক্তে আদায় করে, তবে তা ইমাম শাফি‘ঈ, আওযা‘ঈ, আবূ ইউসুফ আশহাব এবং আহলুল হাদীসদের কূফাহাদের মতে বৈধ। কিন্তু তা উত্তমের বিপরীত। ইমাম আবূ হানীফা এবং ফুকাবাসীদের মতে তা মুযদালিফাতেই আদায় করতে হবে। ইমাম মালিক-এর মতানুযায়ী মুযদালিফাতে আগমনের পূর্বে তা আদায় করা বৈধ নয় তবে উযর থাকলে ভিন্ন কথা।
(وَلَمْ يُسَبِّحْ بَيْنَهُمَا شَيْئًا) ‘‘এ দু’ সালাতের মাঝে তিনি কোন নফল সালাত আদায় করেননি।’’ অর্থাৎ- মাগরিব ও ‘ইশার সালাতের মাঝখানে কোন নফল সালাত আদায় করেননি।
(فَصَلَّى الْفَجْرَ حِينَ تَبَيَّنَ لَهُ الصُّبْحُ) ‘‘ফজর সালাতের ওয়াক্ত হলে তিনি ফজরের সালাত আদায় করলেন।’’ ইমাম নাবাবী বলেনঃ মুযদালিফাতে ফজর সালাতের ওয়াক্ত শুরু হওয়া মাত্রই তা আদায় করা সুন্নাত। কেননা এ দিনে অনেক কাজ রয়েছে। এজন্য এ দিন ওয়াক্ত হওয়া মাত্রই এ সালাত (সালাত/নামাজ/নামায) আদায় করা জরুরী যাতে অন্যান্য কাজের জন্য সময় পাওয়া যায়।
(ثُمَّ اَتَى الْمَشْعَرَ الْحَرَامَ) ‘‘অতঃপর তিনি মাশ্‘আরে হারামে আসলেন।’’ মাশ্‘আরে হারাম মুযদালিফার একটি নির্দিষ্ট স্থানের নাম। (الْمَشْعَرَ) নামকরণের কারণ এই যে, তা ‘ইবাদাতের জন্য চিহ্নিত স্থান। হারাম এজন্য বলা হয় যে, তা হেরেম এলাকায় অবস্থিত অথবা এ স্থানের মর্যাদা অন্যান্য স্থানের তুলনায় বেশী। আর এর দ্বারা উদ্দেশ্য মুযদালিফাতে অবস্থিত কুবাহ নামক পাহাড়। তবে জমহূর মুফাসসিরীনদের মতে সমস্ত মুযদালিফা অঞ্চলই মাশ্‘আরে হারাম। ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম জাবির (রাঃ) থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি এখানে অবস্থান করলাম তবে সমগ্র মুযাদালিফাহ্ অবস্থান স্থল। ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সমগ্র মুযদালিফা মাশ্‘আরুল হারাম।
(فَاسْتَقْبَلَ الْقِبْلَةَ فَدَعَاهُ) ‘‘অতঃপর তিনি কিবলামুখী হয়ে দু‘আ করলেন।’’ মুহিববু ত্ববারী বলেনঃ হাজীদের জন্য মুস্তাহাব হলো তারা এখানে ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত দু‘আ পাঠ করবে। তা নিম্নরূপ-
اللهم اعصمني بدينك وطاعتك وطواعية رسولك، اللهم جنبني حدودك، اللهم اجعلني ممن يحبك، ويحب ملائكتك، ويحب رسلك، ويحب عبادك الصالحين. اللهم حببني إليك وإلى ملائكتك وإلى رسلك وإلى عبادك الصالحين. اللهم يسرني لليسرى، وجنبني العسرى، واغفر لي في الآخرة والأولى. اللهم اجعلني أوف بعهدك الذي عاهدت عليه واجعلني من أئمة المتقين ومن ورثة جنة النعيم، واغفر لي خطيئتي يوم الدين.
(فَلَمْ يَزَلْ وَاقِفًا) ‘‘তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন।’’ এ হাদীস প্রমাণ করে কুবাহ পাহাড়ে অবস্থান করা হজ্জের কার্য্যাবলীর অন্তর্গত এ বিষয়ে বিরোধ নেই।
(حَتّٰى اَسْفَرَ جِدًّا) ‘‘দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে খুব বেশী ফর্সা হয়ে গেল।’’ অর্থাৎ- ফজরের পর ভোরের আলো পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ পেল। ত্ববারী বলেন, মুযদালিফাতে রাত যাপনের পরিপূর্ণ সুন্নাত হলো ভোরের আলো পূর্ণভাবে প্রকাশ পাওয়া পর্যন্ত তথায় অবস্থান করা। ইমাম আবূ হানীফার মতে কেউ যদি মুযদালিফাতে ফজরের পর অবস্থান না করে তার জন্য দম ওয়াজিব। তবে ওজর থাকে তাহলে ভিন্ন কথা। ইবনু আবিদীন বলেনঃ মাশ্‘আরে হারামে অবস্থান করা ওয়াজিব তা সুন্নাত নয়। আর মুযদালিফাতে ফজর পর্যন্ত রাত যাপন করা সুন্নাত তা ওয়াজিব নয়।
(فَدَفَعَ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ) ‘‘সূর্যোদয় হওয়ার পূর্বেই তিনি মাশ্‘আরে হারাম ত্যাগ করেন।’’ এতে সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্যোদয়ের পূর্বে মিনার দিকে রওয়ানা হয়েছেন। জমহূর ‘উলামাগণের নিকট এটাই সুন্নাত। ইমাম মালিক-এর মতে পূর্বাকাশে লালিমা প্রকাশের আগেই মিনার দিকে রওয়ানা হবে।
(حَتّٰى اَتَى الْجَمْرَةَ الَّتِىْ عِنْدَ الشَّجَرَةِ فَرَمَاهَا) ‘‘অতঃপর তিনি বৃক্ষের নিকট জামারাতে এসে পাথর নিক্ষেপ করলেন।’’ এ হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, তৎকালীন সময়ে জামারায়ে ‘আক্বাবার নিকট বৃক্ষ ছিল। শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী বলেনঃ জামারাতে পাথর নিক্ষেপের উদ্দেশ্য আল্লাহর যিকির প্রতিষ্ঠা করা।
আল্লাহর যিকির দু’ ধরনেরঃ
(১) এক প্রকার যিকির দ্বারা আল্লাহর দীনের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা করা। এর জন্য লোকজনের সমাবেসস্থলকে বাছাই করা হয় (সেখানে আধিক্য উদ্দেশ্য নয়)। জামারাতে পাথর নিক্ষেপ তারই অন্তর্ভুক্ত।
(২) এ প্রকার যিকির দ্বারা মহান আল্লাহর মর্যাদাকে অন্তরে প্রতিষ্ঠা করা আর এজন্য তাতে অধিক্য প্রয়োজন।
(يُكَبِّرُ مَعَ كُلِّ حَصَاةٍ مِنْهَا) ‘‘প্রতিটি পাথর নিক্ষেপকালে তাকবীর (আল্লাহু আকবার) বলতেন। ইমাম নাবাবী বলেনঃ এতে প্রমাণ পাওয়া যায়, প্রতিটি পাথর নিক্ষেপের সময় তাকবীর বলা সুন্নাত এবং প্রতিটি পাথর পৃথকভাবে নিক্ষেপ করতে হবে। যদি সাতটি পাথর একসাথে নিক্ষেপ করে তাহলে তা এক নিক্ষেপ বলে গণ্য করা হবে।
(فَنَحَرَ ثَلَاثًا وَسِتِّينَ بَدَنَةً بِيَدِه) ‘‘অতঃপর তিনি স্বীয় হস্তে তেষট্টিটি উট যাবাহ করলেন।’’ এতে জানা যায় যে, কুরবানীর পশু স্বীয় হস্তে যাবাহ করা মুস্তাহাব।
(ثُمَّ أَعْطٰى عَلِيًّا فَنَحَرَ مَا غَبَرَ) ‘‘অতঃপর বাকী পশু যাবাহ করার জন্য ‘আলী -কে দায়িত্ব দিলেন।’’ এতে জানা গেল যে, কুরবানীর পশু স্বয়ং যাবাহ না করে কাউকে যাবাহ করার দায়িত্ব দেয়া বৈধ। এতে এ প্রমাণও পাওয়া যায় যে, কুরবানীর পশুর সংখ্যা যদি বেশীও হয় তবুও তা ১০ই যিলহজ্জ তারিখে যাবাহ করাই উত্তম বিলম্ব না করে। যদিও এর পরবর্তী তিনদিনও কুরবানী করা বৈধ।
(ثُمَّ رَكِبَ رَسُوْلُ اللّٰهِ ﷺ فَأَفَاضَ إِلَى الْبَيْتِ) ‘‘অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাহনে আরোহণ করেন এবং দ্রুত বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করতে যান।’’
এ তাওয়াফকে তাওয়াফে ইফাযাহ্ ও তাওয়াফে যিয়ারহ্ বলা হয়। এটি হজ্জের রুকন। আর এ তাওয়াফ ‘আরাফাতে অবস্থানের পর মিনাতে এসে অবস্থান করে মক্কাতে গিয়ে তাওয়াফ করতে হয়। এ তাওয়াফের ওয়াক্ত শুরু হয় ইয়াওমুন্ নাহরের অর্ধরাত্রি অতিক্রান্ত হওয়ার পর। তবে উত্তম হলো ইয়াওমুন্ নাহরে অপরাহ্নে জামারায়ে ‘আক্বাবাতে পাথর নিক্ষেপের পর মিনাতে কুরবানীর পশু যাবাহ করে মাথা মুন্ডানোর পরে তাওয়াফ করা। তবে ইয়াওমুন্ নাহরের যে কোন সময়ে এ তাওয়াফ করা সমানভাবে বৈধ। কোন ওজর ব্যতীত তা ইয়াওমুন্ নাহরের পরে পিছিয়ে নেয়া মাকরূহ। আর আইয়্যামে তাশরীক্বের পর পর্যন্ত বিলম্ব আরো অধিক মাকরূহ। এ তাওয়াফ অবশ্যই ‘আরাফাতে অবস্থানের পর করতে হবে। কেউ যদি ইয়াওমুন্ নাহরের অর্ধ রাত্রির পরে তাওয়াফ করার পর ঐ রাতেই ফজরের পূর্বে ‘আরাফায় গিয়ে অবস্থান করে তাহলে এ তাওয়াফ বিশুদ্ধ হবে না। এ তাওয়াফ বিলম্বে করলে দম ওয়াজিব হবে কিনা তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ইমাম শাফি‘ঈ ও আহমাদ-এর মতানুসারে তা আইয়্যামে তাশরীক্বের পর পর্যন্ত বিলম্ব করলে দম ওয়াজিব নয়। ইমাম মালিক-এর মতে খুব বেশী বিলম্ব করলে দম ওয়াজিব। ইমাম আবূ হানীফার মতে আইয়্যামে তাশরীক্বের তৃতীয় দিন পর্যন্ত বিলম্ব করলে দম ওয়াজিব হবে।
(فَصَلّٰى بِمَكَّةَ الظُّهْرَ) ‘‘অতঃপর তিনি মক্কাতে যুহরের সালাত আদায় করেন।’’ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াওমুন্ নাহরে যুহরের সালাত কোথায় আদায় করেছেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। জাবির (রাঃ)-এর অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, তিনি যুহরের সালাত মক্কাতেই আদায় করেছেন।
অনুরূপ আবূ দাঊদে বর্ণিত হয়েছে, ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইয়াওমুন নাহরে যুহরের সালাত আদায় করেন ও তাওয়াফ ইফাযাহ্ করেন। অতঃপর মিনাতে ফিরে এসে আইয়্যামে তাশরীক্বের রাতগুলোতে তিনি মিনাতেই অবস্থান করেন। তবে মুসলিমে ইবনু ‘উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওয়াফে ইফাযাহ্ সমাপনান্তে মিনাতে ফিরে যুহরের সালাত আদায় করেন।
ইবনু হাযম (রহঃ) ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) ও জাবির (রাঃ) বর্ণিত হাদীসকে প্রাধান্য দিয়ে বলেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদিনে মক্কাতেই যুহরের সালাত আদায় করেছেন।
ইমাম নাবাবী ইবনু ‘উমারের এ হাদীস ও জাবির (রাঃ) এবং ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বর্ণিত হাদীসের মধ্যে এভাবে সমন্বয় করেছেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য ঢলার পূর্বেই তাওয়াফে ইফাযাহ্ সম্পাদন করার পর মক্কাতে যুহরের সালাত আদায় করেন। অতঃপর মিনাতে এসে সাহাবীগণের অনুরোধক্রমে তিনি তাদের নিয়ে পুনরায় যুহরের সালাত আদায় করেন যা ছিল নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য নফল।
(فَنَاوَلُوهُ دَلْوًا فَشَرِبَ مِنْهُ) ‘‘তারা তাঁকে (যমযমের) পানির বালতি দিলে তিনি তা থেকে পান করলেন।’’ এতে প্রমাণ মিলে যে, হজ্জ/হজ সম্পাদনকারীর জন্য যমযমের পানি পান করা মুস্তাহাব।
বলা হয়ে থাকে যে, যমযমের পানি দাঁড়িয়ে পান করা মুস্তাহাব। এর স্বপক্ষে বুখারীতে ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসটিকে দলীল হিসেবে উপস্থাপন করা হয় যাতে আছে- ‘‘আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে যমযমের পানি পান করিয়েছি। তিনি তা দাঁড়িয়ে পান করেছেন।
‘আসিম (রহঃ) বলেনঃ ‘ইকরিমাহ্ শপথ করে বলেছেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সে সময় উটের উপর ছিলেন। অতএব অত্র হাদীস দ্বারা যমযমের পানি দাঁড়িয়ে পান করার দলীল গ্রহণ করা সমালোচনামুক্ত নয়। কেননা বিষয়টি এমনই যা ‘ইকরিমাহ্ শপথ করে বলেছেন তা হলো যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন বাহনের উপর ছিলেন। আর এ অবস্থাকে قائم তথা দাঁড়ানোই বলা হয়। ইবনু ‘আব্বাস-এর বক্তব্য দ্বারা উদ্দেশ্য তাই। অতএব নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এ অবস্থা এবং দাঁড়িয়ে পান করা হাদীসের মধ্যে কোন বৈপরীত্য নেই। অথবা ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীস থেকে তার প্রকাশমান অর্থ গ্রহণ করলেও এ প্রমাণ পাওয়া যায় যে, দাঁড়িয়ে পান করা বৈধ। অর্থাৎ- নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাঁড়িয়ে পান করেছিলেন তা বৈধতা বুঝানোর জন্য। এটাও বলা হয়ে থাকে যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওজর থাকার কারণে দাঁড়িয়ে পান করেছিলেন। অতএব বসে পান করা মুস্তাহাব, দাঁড়িয়ে পান করা মাকরূহ তবে প্রয়োজনে দাঁড়িয়ে পান করা বৈধ।