লগইন করুন
পরিচ্ছেদঃ ১২. প্রথম অনুচ্ছেদ - মুহরিম ব্যক্তির শিকার করা হতে বিরত থাকবে
২৬৯৭-[২] আবূ কাতাদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে (’উমরা করতে) বের হয়েছেন এবং পথিমধ্যে তিনি তাঁর কিছু সহযাত্রীসহ পিছনে পড়ে গেলেন। সাথীদের সকলেই মুহরিম ছিলেন, কিন্তু আবূ কাতাদা তখনও ইহরাম বাঁধেননি। আবূ কাতাদা’র দেখার পূর্বে তার সাথীরা একটি বন্যগাধা দেখলেন। তারা বন্যগাধাটি দেখার পর তাকে (আবূ কাতাদা-কে) এভাবেই থাকতে দিলেন। অবশেষে আবূ কাতাদাও ওটাকে দেখে ফেললেন। এরপর তিনি (আবূ কাতাদা) তার ঘোড়ায় চড়ে সাথীদেরকে তার চাবুকটা দিতে বললেন। কিন্তু সাথীরা তা তাকে দিতে অস্বীকৃতি জানালেন। অতঃপর তিনি নিজেই চাবুক উঠিয়ে নিলেন।
তারপর বন্যগাধাটির ওপর আক্রমণ করে আহত (দুর্বল) করলেন। অবশেষে (তা যাবাহ করার পর) আবূ কাতাদা তা খেলেন এবং তারাও (সাথীরাও) খেলেন কিন্তু এতে তারা অনুতপ্ত হলেন। অতঃপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পৌঁছে তাকে বিষয়টি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের সাথে বন্যগাধার কিছু আছে কি? তারা উত্তরে বললেন, আমাদের সাথে (রন্ধনকৃত) এর একটি পা আছে। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা গ্রহণ করলেন ও খেলেন। (বুখারী, মুসলিম)
বুখারী মুসলিমের আর এক বর্ণনায় আছে- তারা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আসলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের কেউ কি আবূ কাতাদা-কে বন্যগাধাকে আক্রমণ করার জন্য বলেছিলে? তারা বললেন, জ্বি না। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, তবে তোমরা এর অবশিষ্ট মাংস (গোসত/মাংস) খেতে পারো।[1]
بَابُ الْمُحْرِمِ يَجْتَنِبُ الصَّيْدَ
وَعَنْ أَبِي قَتَادَةَ أَنَّهُ خَرَجَ مَعَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَتَخَلَّفَ مَعَ بَعْضِ أَصْحَابِهِ وَهُمْ مُحْرِمُونَ وَهُوَ غَيْرُ مُحْرِمٍ فَرَأَوْا حِمَارًا وَحْشِيًّا قَبْلَ أَنْ يَرَاهُ فَلَمَّا رَأَوْهُ تَرَكُوهُ حَتَّى رَآهُ أَبُو قَتَادَةَ فَرَكِبَ فَرَسًا لَهُ فَسَأَلَهُمْ أَنْ يُنَاوِلُوهُ سَوْطَهُ فَأَبَوْا فَتَنَاوَلَهُ فَحَمَلَ عَلَيْهِ فَعَقَرَهُ ثُمَّ أَكَلَ فَأَكَلُوا فَنَدِمُوا فَلَمَّا أَدْرَكُوا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ سَأَلُوهُ. قَالَ: «هَلْ مَعَكُمْ مِنْهُ شَيْءٌ؟» قَالُوا: مَعَنَا رِجْلُهُ فَأَخَذَهَا النَّبِيُّ صَلَّى الله عَلَيْهِ وَسلم فَأكلهَا وَفِي رِوَايَةٍ لَهُمَا: فَلَمَّا أَتَوْا رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «أَمِنْكُمْ أَحَدٌ أَمَرَهُ أَنْ يَحْمِلَ عَلَيْهَا؟ أَوْ أَشَارَ إِلَيْهَا؟» قَالُوا: لَا قَالَ: «فَكُلُوا مَا بَقِيَ مِنْ لَحمهَا»
ব্যাখ্যা: (أَنَّه خَرَجَ مَعَ رَسُولِ اللّٰهِ ﷺ) ‘‘তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বের হলেন’’। অর্থাৎ- হুদায়বিয়ার বৎসর। জেনে রাখা ভাল যে, আবূ কাতাদা কর্তৃক বন্যগাধা শিকার করার বর্ণনার মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে।
হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ মোটকথা এই যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৬ষ্ঠ হিজরী সালে ‘উমরা করার উদ্দেশে মদীনাহ্ থেকে রওয়ানা হলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যুলহুলায়ফাহ্ হতে ৩৪ মাইল দূরে রওহা নামক স্থানে পৌঁছলে খবর পান যে, মুশরিক শত্রুরা গয়ক্বাহ্ নামক উপত্যকাতে অবস্থান করছে।
আশঙ্কা করা হয় যে, তারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসতর্কতার সুযোগে তাঁর ওপর তারা আক্রমণ করতে পারে। তাই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ শত্রুদলের অনিষ্ট থেকে নিরাপত্তা লাভের উদ্দেশে একদল লোক সেদিকে প্রেরণ করেন। তাদের মাঝে আবূ কাতাদা ছিলেন। অতঃপর যখন তারা নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হন তখন তারা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে এসে মিলিত হন। আবূ কাতাদা ব্যতীত অন্য সবাই ‘উমরা করার নিমিত্তে ইহরাম বাঁধে। আবূ কাতাদা (রাঃ) ইহরামবিহীন অবস্থায় তার ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন এজন্য যে, হয়তঃ তিনি তখনো তার মীকাতে পৌঁছেনি অথবা তার ‘উমরা করার ইচ্ছা ছিল না। মোটকথা, তিনি এ অবস্থায় ‘‘সুক্বইয়্যাহ্’’ নামক স্থানে এসে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাক্ষাৎ লাভ করেন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সাক্ষাৎ লাভের পূর্বে রওহা নামক স্থানে শিকারের ঘটনা ঘটে।
(حَتّٰى رَاٰهُ أَبُو قَتَادَةَ فَرَكِبَ فَرَسًا لَه) ‘‘আবূ কাতাদা শিকারী পশু দেখতে পেয়ে তিনি তার বাহনে আরোহণ করেন।’’
(فَسَأَلَهُمْ أَنْ يُنَاوِلُوهُ سَوْطَه فَأَبَوْا) ‘‘তিনি তার সঙ্গীদেরকে চাবুক তুলে দিতে বললে তারা তা তুলে দিতে অস্বীকার করে।’’ কেননা ইহরাম অবস্থায় যেরূপ কোন কিছু শিকার করা হারাম অনুরূপ শিকারীর সহযোগিতা করাও হারাম। তাই তারা আবূ ক্বাতাদার হাতে চাবুক তুলে দিয়ে পশু শিকার কাজে তাকে সহায়তা করতে অস্বীকার করেন।
(ثُمَّ أَكَلَ فَأَكَلُوا فَنَدِمُوْا) ‘‘এরপর আবূ কাতাদা শিকারী পশু রান্না করে তার গোশ্ত (গোসত/গোশত) খেলেন এবং তাঁর সঙ্গীরাও তা খাবার পর আফসোস করতে থাকল।’’ কেননা তারা ধারণা করেছিল যে, কোন অবস্থাতেই মুহরিম ব্যক্তির জন্য শিকারী পশুর গোশ্ত (গোসত/গোশত) খাওয়া বৈধ নয়।
মুসলিমের অন্য বর্ণনায় আছে যে, (فأكل بعض أصحاب رسول الله - ﷺ - وأبي بعضهم) ‘‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কিছু সহাবা তা খেলেন আর কিছু সহাবা তা খেতে অস্বীকার করেন।’’ হাফিয ইবনু হাজার বলেনঃ অনেক বর্ণনা দ্বারা সাব্যস্ত যে, তারা ঐ পশুর গোশ্ত (গোসত/গোশত) খেয়েছিল। পরবর্তীতে তাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল যে, ইহরাম অবস্থায় আমরা কি শিকারী পশুর গোশ্ত (গোসত/গোশত) খেতে পারি?
(فَلَمَّا أَدْرَكُوْا رَسُوْلَ اللّٰهِ ﷺ سَأَلُوْهُ) ‘‘তারা যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উপস্থিত হলেন তখন তারা তার নিকট এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলেন। অর্থাৎ- ইহরাম অবস্থায় শিকারকৃত পশুর গোশত খাওয়া বৈধ কি-না।
(فَأَخَذَهَا النَّبِىُّ ﷺ فَأَكَلَهَا) ‘‘নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিয়ে খেলেন।’’ এতে ইঙ্গিত রযেছে যে, কাজের মাধ্যমে প্রশ্নের উত্তর দেয়া কথার মাধ্যমে উত্তর দেয়ার চেয়ে বেশী মজবুত।
কাযী ‘আরায বলেনঃ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ক্বাতাদার নিকট হতে উক্ত শিকারী পশু চেয়ে নিয়ে খেলেন যাতে তাদের অন্তরে প্রশান্তি আসে যারা তা হতে খেয়েছিলেন। কেননা তাদের মধ্যে যে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল তা দূর করতে তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কথা ও কাজের মাধ্যমে তা বৈধ হওয়ার প্রমাণ দিলেন।
অত্র হাদীস প্রমাণ করে যে, বন্য গাধা খাওয়া হালাল এবং তা এক প্রকার শিকারী পশু।
এতে এ প্রমাণও পাওয়া যায় যে, মুহরিম ব্যক্তির পক্ষে শিকারকৃত পশুর গোশত (গোসত/গোশত) খাওয়া বৈধ যদি উক্ত পশু মুহরিমের খাবার উদ্দেশে শিকার করা না হয়।
মুসনাদ আহমাদ (৫ম খণ্ড, ৩০৪ পৃঃ) ইবনু মাজাহ্, মুসান্নাফ ‘আবদুর রাযযাক (৪র্থ খণ্ড, ৪৩০ পৃঃ) দারাকুত্বনী, ইসহাক ইবনু রহওয়াইহ্, ইবনু খুযায়মাহ্ ও বায়হাক্বী (৫ম খণ্ড, ১৯০ পৃঃ) মা‘মার (রহঃ)-এর বরাতে ইয়াহ্ইয়া ইবনু আবী কাসীর থেকে ‘আবদুল্লাহ ইবনু আবী কাতাদা সূত্রে তার পিতা আবূ কাতাদা হতে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি বলেনঃ হুদায়বিয়ার সময়ে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সফরসঙ্গী ছিলাম। আমার সঙ্গীগণ ইহরাম বেঁধেছিলেন কিন্তু আমি ইহরাম বাঁধিনি। আমি একটি বন্যগাধা দেখতে পেয়ে তা আক্রমণ করে শিকার করি। বিষয়টি আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট উল্লেখপূর্বক বললামঃ এটা কিন্তু আপনার জন্যই শিকার করেছি। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সঙ্গীদেরকে তা খেতে বললেন কিন্তু আমি তাঁর জন্য শিকার করেছি এ কথা বলাতে তিনি তা আর খেলেন না।
ইবনু খুযায়মাহ্ বলেনঃ এ হাদীসের এ অতিরিক্ত অংশটুকু যদি সহীহ বলে গণ্য হয় তাহলে এর মর্ম হলো যে, আবূ কাতাদা তাঁর উদ্দেশে পশুটি শিকার করেছেন এ কথা বলার আগে তিনি তা থেকে খেয়েছিলেন। অতঃপর তিনি যখন তাঁকে অবহিত করলেন যে, এটি তাঁর উদ্দেশেই শিকার করেছেন তখন তা খাওয়া থেকে বিরত থাকলেন।
(فَكُلُوْا مَا بَقِىَ مِنْ لَحْمِهَا) ‘‘এর অবশিষ্ট গোশত তোমরা খাও’’। এ আদেশসূচক শব্দ বৈধতা বুঝানোর জন্য, আবশ্যক বুঝানোর জন্য নয়। কেননা এ আদেশটি ছিল তাদের প্রশ্নের জবাব স্বরূপ। আর প্রশ্ন ছিল খাওয়া বৈধ কি-না, এ সম্পর্কে?
এ হাদীসের শিক্ষাঃ মুহরিম ব্যক্তির জন্য শিকার করা বৈধ নয় এবং এ সংক্রান্ত সাহায্য-সহযোগিতাও বৈধ নয়।
হালাল ব্যক্তি যে পশু শিকার করে তা থেকে মুহরিম ব্যক্তির খাওয়া বৈধ যদি না তার উদ্দেশে শিকার করা হয়। এ বিষয়ে সকলেই একমত। তবে যদি পশুটি মুহরিম ব্যক্তির উদ্দেশে শিকার করা হয় তাহলে জমহূর ‘উলামাগণের মতে তা মুহরিম ব্যক্তির পক্ষে খাওয়া বৈধ নয়। পক্ষান্তরে ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর মতে তা খাওয়া বৈধ যদিও তা মুহরিম ব্যক্তির জন্য শিকার করা হয়। আবূ কাতাদা বর্ণিত এ হাদীসটিই তাদের সপক্ষে দলীল।
জমহূর ‘উলামাগণ এ হাদীসের জবাবে বলেন যে, মা‘মার (রহঃ)-এর বরাতে বর্ণিত হাদীসে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে যে, আবূ কাতাদা যখন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে অবহিত করলেন যে, পশুটি তিনি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উদ্দেশেই শিকার করেছেন তখন তিনি তা থেকে খেতে বিরত থাকলেন।