পরিচ্ছেদঃ ২২. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - ভালো কাজের আদেশ
৫১৪৫-[৯] আবূ সা’ঈদ আল খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ’আসরের সালাতের পর আমাদের মাঝে দাঁড়ালেন। কিয়ামত পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটবে, সেগুলো বর্ণনা করলেন। সেসব কথা যে স্মরণ রাখল তো রাখল, আর যে ভুলে গেল তো ভুলে গেল। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) যা কিছু বললেন, এতে এ কথাও ছিল যে, দুনিয়াটা একটা মিষ্টি ও সুস্বাদু বস্তু। আল্লাহ তা’আলা এতে তোমাদেরকে তাঁর প্রতিনিধি বানিয়ে দিলেন। তারপর দেখবেন, তোমরা কিভাবে ’আমল করো। সাবধান! দুনিয়ার মোহ থেকে বাঁচো এবং বাঁচো রমণীদের থেকে। অতঃপর বললেনঃ নিশ্চয় কিয়ামতের দিন প্রতিটি ওয়া’দা ভঙ্গকারীর জন্য একটি ঝাণ্ডা হবে, যা দুনিয়ার ওয়া’দা অনুসারে উঁচু-নিচু হবে। কোন ওয়া’দা ভঙ্গকারী জনপ্রতিনিধি বা জনসাধারণের শাসকদের ওয়া’দা ভঙ্গের চেয়ে বড় হবে না। তার ঝাণ্ডা তার বসার স্থানের কাছে দণ্ডায়মান করা হবে। তারপর তিনি বললেনঃ মানুষের ভীতি যেন তোমাদের কাউকে ন্যায় কথা বলা থেকে বিরত না রাখে, যখন সে সেটাকে ন্যায় বলে জানে।
অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোন অন্যায় কাজ করতে দেখে, লোকভীতি যেন সেটাকে উৎপাটন করা থেকে তাকে বিরত না করে। এ বলে আবূ সা’ঈদ আল খুদরী(রাঃ) কেঁদে ফেললেন এবং বললেনঃ আমি অবশ্য অন্যায় কাজ সংঘটিত হতে দেখেছি; কিন্তু মানুষের ভয়ে আমি সেটা নিষেধ করতে পারিনি। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ স্মরণ রেখ, আদম সন্তানকে বিভিন্ন স্তরে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন আছে, মু’মিন হিসেবে জন্মগ্রহণ করে, মু’মিন হিসেবে জীবন-যাপন করে এবং মু’মিন হিসেবে মৃত্যুবরণ করে এবং তাদের কেউ কেউ এমনও রয়েছে যে, জন্মগ্রহণ করে কাফির হিসেবে, জীবন-যাপন করে কাফির হিসেবে এবং মৃত্যুবরণ করে কাফির হিসেবে। আর তাদের থেকে কেউ কেউ এমন রয়েছে যে, জন্মগ্রহণ করে মু’মিন হিসেবে, জীবন-যাপন করে মু’মিন হিসেবে; কিন্তু মৃত্যুবরণ করে কাফির হিসেবে। আবার কেউ কেউ এমন আছে যে, কাফির হিসেবে জন্মগ্রহণ করে, কাফির হিসেবে জীবন-যাপন করে; কিন্তু মৃত্যুবরণ করে মু’মিন হিসেবে।
আবূ সা’ঈদ আল খুদরী(রাঃ) বলেন, তারপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাগ সম্পর্কে বললেনঃ কেউ কেউ এমন আছে, যারা খুব তাড়াতাড়ি রাগে এবং তাড়াতাড়ি ঠাণ্ডা হয়। একটি অপরটির ক্ষতিপূরণকারী। আবার কেউ কেউ এমন আছে, যারা খুব দেরিতে রাগে এবং তাদের রাগ নিবারিত হতেও দেরি হয়। এ দু’টো অবস্থাও একটি অপরটির ক্ষতিপূরক। তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই সর্বোত্তম, যার রাগ দেরিতে আসে এবং তাড়াতাড়ি রাগ প্রশমিত হয়ে যায় এবং সে ব্যক্তি নিকৃষ্ট, যে তাড়াতাড়ি রাগে এবং দেরিতে ঠাণ্ডা হয়। তারপর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেনঃ তোমরা রাগ থেকে বাঁচো। কেননা সেটা আদম সন্তানের হৃদয়ে একটি জ্বলন্ত অঙ্গার। তোমরা কি দেখনি, মানুষ যখন রাগে, তখন শাহ-রগ ফুলে ওঠে এবং চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে যায়। অতএব, তোমাদের কেউ যখন রাগ উপলব্ধি করবে, সে যেন চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে এবং ভূমির সাথে মিশে থাকে।
আবূ সা’ঈদ আল খুদরী(রাঃ) বলেনঃ অতঃপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঋণ সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এমন আছে, যে ঋণ পরিশোধ যথাসময়ে করে; কিন্তু সে যদি কাউকে ঋণ দিয়ে থাকে, তাহলে সেটা আদায়ের ব্যাপারে খুব কঠিন হয়ে পড়ে এবং খুব খারাপ ব্যবহার করে। এগুলোর মধ্যে একটি অভ্যাস অপর অভ্যাসটির ক্ষতিপূরক। আবার কোন লোক এমন আছে, যে ঋণ পরিশোধ করার ব্যাপারে খুবই খারাপ; কিন্তু সে যদি কাউকে ঋণ দিয়ে থাকে, তাহলে নরম কথা বলে ঋণ আদায় করে। এসব অভ্যাস একটি অপরটির ক্ষতিপূরক। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে কারো নিকট থেকে ঋণ গ্রহণ করলে ঠিক সময় মতো পরিশোধ করে; আর সে যদি কারো নিকট পাওনা থাকে, তাহলে নরম কথা বলে তার ঐ পাওনা আদায় করে। তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সর্বনিকৃষ্ট, যে ঋণ পরিশোধ করার ব্যাপারে খারাপ এবং নিজের পাওনা আদায়ের ব্যাপারে কঠিন ও কটুভাষী হয়। ততক্ষণে সূর্য খেজুরের ডাল এবং দেয়ালের কিনারায় পৌঁছল। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেনঃ সাবধান! সময় চলে গিয়েছে। তার মোকাবিলায় এতটুকু পরিমাণ দুনিয়াবী জীবন বাকি আছে, যতটুকু এ দিনের ক্ষুদ্রাংশ বাকি আছে। (তিরমিযী)[1]
وَعَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ: قَامَ فِينَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَطِيبًا بَعْدَ الْعَصْرِ فَلَمْ يَدَعْ شَيْئًا يَكُونُ إِلَى قِيَامِ السَّاعَةِ إِلَّا ذَكَرَهُ حَفِظَهُ مَنْ حَفِظَهُ وَنَسِيَهُ مَنْ نَسِيَهُ وَكَانَ فِيمَا قَالَ: «إِنَّ الدُّنْيَا حُلْوَةٌ خَضِرَةٌ وَإِنَّ اللَّهَ مُسْتَخْلِفُكُمْ فِيهَا فَنَاظِرٌ كَيْفَ تَعْمَلُونَ أَلَا فَاتَّقُوا الدُّنْيَا وَاتَّقُوا النِّسَاءَ» وَذَكَرَ: «إِنَّ لِكُلِّ غَادِرٍ لِوَاءً يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِقَدْرِ غَدْرَتِهِ فِي الدُّنْيَا وَلَا غَدْرَ أَكْبَرُ مِنْ غَدْرِ أَمِيرِ الْعَامَّةِ يُغْرَزُ لِوَاؤُهُ عِنْدَ اسْتِهِ» . قَالَ: «وَلَا يَمْنَعْنَّ أَحَدًا مِنْكُمْ هَيْبَةُ النَّاسِ أَنْ يَقُولَ بِحَقٍّ إِذَا عَلِمَهُ» وَفِي رِوَايَةٍ: «إِنْ رَأَى مُنْكَرًا أَنْ يُغَيِّرَهُ» فَبَكَى أَبُو سَعِيدٍ وَقَالَ: قَدْ رَأَيْنَاهُ فَمَنَعَتْنَا هَيْبَةُ النَّاسِ أَنْ نَتَكَلَّمَ فِيهِ. ثُمَّ قَالَ: «أَلَا إِنَّ بَنِي آدَمَ خُلِقُوا عَلَى طَبَقَاتٍ شَتَّى فَمنهمْ مَن يولَدُ مُؤمنا وَيحيى مُؤْمِنًا وَيَمُوتُ مُؤْمِنًا وَمِنْهُمْ مَنْ يُولَدُ كَافِرًا وَيحيى كَافِرًا وَيَمُوتُ كَافِرًا وَمِنْهُمْ مَنْ يُولَدُ مُؤْمِنًا وَيحيى مُؤْمِنًا وَيَمُوتُ كَافِرًا وَمِنْهُمْ مَنْ يُولَدُ كَافِرًا وَيحيى كَافِرًا وَيَمُوتُ مُؤْمِنًا» قَالَ: وَذَكَرَ الْغَضَبَ «فَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ سَرِيعَ الْغَضَبِ سَرِيعَ الْفَيْءِ فَإِحْدَاهُمَا بِالْأُخْرَى وَمِنْهُمْ مَنْ يَكُونُ بَطِيءَ الْغَضَبِ بَطِيءَ الْفَيْءِ فَإِحْدَاهُمَا بِالْأُخْرَى وَخِيَارُكُمْ مَنْ يَكُونُ بَطِيءَ الْغَضَبِ سَرِيعَ الْفَيْءِ وَشِرَارُكُمْ مَنْ يَكُونُ سَرِيعَ الْغَضَبِ بَطِيءَ الْفَيْءِ» . قَالَ: «اتَّقُوا الْغَضَبَ فَإِنَّهُ جَمْرَةٌ عَلَى قَلْبِ ابْنِ آدَمَ أَلَا تَرَوْنَ إِلَى انْتِفَاخِ أَوْدَاجِهِ؟ وَحُمْرَةِ عَيْنَيْهِ؟ فَمَنْ أَحَسَّ بِشَيْءٍ مِنْ ذَلِكَ فَلْيَضْطَجِعْ وَلْيَتَلَبَّدْ بِالْأَرْضِ» قَالَ: وَذَكَرَ الدَّيْنَ فَقَالَ: «مِنْكُمْ مَنْ يَكُونُ حَسَنَ الْقَضَاءِ وَإِذَا كَانَ لَهُ أَفْحَشَ فِي الطَّلَبِ فإحداهُما بِالْأُخْرَى وَمِنْهُم مَن يكونُ سيِّءَ الْقَضَاءِ وَإِنْ كَانَ لَهُ أَجْمَلَ فِي الطَّلَبِ فَإِحْدَاهُمَا بِالْأُخْرَى وَخِيَارُكُمْ مَنْ إِذَا كَانَ عَلَيْهِ الدَّيْنُ أَحْسَنَ الْقَضَاءِ وَإِنْ كَانَ لَهُ أَجْمَلَ فِي الطَّلَبِ وَشِرَارُكُمْ مَنْ إِذَا كَانَ عَلَيْهِ الدَّيْنُ أَسَاءَ الْقَضَاءَ وَإِنْ كَانَ لَهُ أَفْحَشَ فِي الطَّلَبِ» . حَتَّى إِذَا كَانَتِ الشَّمْسُ عَلَى رؤوسِ النَّخْلِ وَأَطْرَافِ الْحِيطَانِ فَقَالَ: «أَمَا إِنَّهُ لَمْ يَبْقَ مِنَ الدُّنْيَا فِيمَا مَضَى مِنْهَا إِلَّا كَمَا بَقِيَ مِنْ يَوْمِكُمْ هَذَا فِيمَا مَضَى مِنْهُ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيّ
ব্যাখ্যাঃ (إِنَّ الدُّنْيَا خَضِرَةٌ) অর্থাৎ- দুনিয়া অনেক চাকচিক্যময় আর প্রমোদের জায়গা। এর ভোগ্য বস্তুগুলো অত্যন্ত মজাদার ও চমৎকার।
হাদীসে الدُّنْيَا শব্দের বিশেষণ হিসেবে خَضِرَةٌ আর حُلْوَةٌ ব্যবহার করার কারণ হলো ‘আরবের লোকেরা সুখকর ও পছন্দনীয় বস্তুর ক্ষেত্রে উক্ত শব্দদ্বয় ব্যবহার করে তার মাধুর্যতা প্রকাশ করে থাকেন। সে দিক থেকে এখানেও তার প্রয়োগ ঘটেছে।
(فَاتَّقُوا الدُّنْيَا) অর্থাৎ- জীবন ধারণের তাগিদে আর ধর্মীয় কারণে যতটুকু প্রয়োজন তাতেই সীমাবদ্ধ থাকা। অতিরিক্ততা বর্জনই হলো আসল উদ্দেশ্য।
(وَاتَّقُوا النِّسَاءَ) অর্থাৎ- নারীদের চক্রান্ত, ছলনা আর কুটবুদ্ধি থেকে সতর্ক থাক।
وَلَا غَدْرَةَ أَعْظَمَ مِنْ غَدْرَةِ إِمَامٍ عَامَّةٍ ‘আল্লামা তূরিবিশতী (রহিমাহুল্লাহ) এ ধরনের ইমামের ব্যাপারে বলেনঃ এখানে উদ্দেশ্য হলো ঐ ব্যক্তি যিনি কোনরূপ চক্রান্ত বা ছলচাতুরীর মদদ ছাড়াই মুসলিম অধ্যূষিত এলাকায় জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং জনগণের একান্ত আন্তরিকতায় বিভিন্ন সময়ে সাহায্যপ্রাপ্ত হন। এমন ব্যক্তি যখন জনগণের সাথে প্রতারণা করেন তখন এর চাইতে জঘন্যতম ও ক্ষতিকর প্রতারণা আর কিছুই হতে পারে না। (তুহফাতুল আহ্ওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২১৯১; মিরক্বাতুল মাফাতীহ)