পরিচ্ছেদঃ ১৫. প্রথম অনুচ্ছেদ - মদীনার হারামকে আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক সংরক্ষণ প্রসঙ্গে
ইমাম যুরক্বানী (রহঃ) বলেন, মদীনাহ্ বলা হয় বড় শহরকে। অতঃপর শব্দটি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দারুল হিজরতকেই মদীনাহ্ নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে।
ইবনু হাজার ’ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বলেন, মদীনাহ্ একটি সুপরিচিত শহরের নাম যেখানে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করেছেন, (এবং মৃত্যুর পর) সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়েছে। এর প্রাচীন নাম ছিল ইয়াসরিব। বর্তমান এ মদীনাহ্ শহরটির নাম ’’মদীনাহ্’’ এবং ’’ইয়াসরিব’’ উভয়টি পবিত্র কুরআনুল কারীমে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- মহান আল্লাহর বাণীঃ
(ক) يَقُوْلُوْنَ لَئِنْ رَجَعْنَا إِلَى الْمَدِيْنَةِ
’’তারা বলে- আমরা যদি মদীনায় প্রত্যাবর্তন করি, তাহলে সম্মানীরা অবশ্য অবশ্যই হীনদেরকে সেখানে থেকে বহিষ্কার করবে।’’ (সূরা আল মুনা-ফিকূন ৬৩ : ৮)
(খ) وَإِذْ قَالَتْ طَائِفَةٌ مِنْهُمْ يَا أَهْلَ يَثْرِبَ
’’স্মরণ কর, যখন তাদের একদল বলেছিল- হে ইয়াসরিববাসী! তোমরা (শত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে) দাঁড়াতে পারবে না, কাজেই তোমরা ফিরে যাও।’’ (সূরা আল আহযা-ব ৩৩ : ১৩)
ইয়াসরিব (বর্তমানের মদীনাহ্ শহরের) একটি স্থানের নাম। অতঃপর পুরো শহরটিকেই ইয়াসরিব নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে। কেউ কেউ বলেছেন, নূহ (আঃ) এর পুত্র শাম, তদীয় পুত্র ইরাম, তদীয় পুত্র ক্বনিয়াহ্, তদীয় পুত্র ইয়াসরিব-এর নামানুসারে এ শহরের নাম রাখা হয় ইয়াসরিব।
অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাম রাখেন ত্ববাহ্ ও ত্বইয়্যিবাহ্। এখানে ’আমলীক্ব’গণ বসবাস করত। অতঃপর বনী ইসরাঈলের একটি সম্প্রদায় এখানে উপনীত হন ও বসবাস শুরু করেন।
যুবায়র ইবনু বাকর ’’আখবারে মদীনাহ্’’ নামক গ্রন্থে একটি দুর্বল সনদে উল্লেখ করেছেন, এদের (ইসরাঈলদের) মূসা (আঃ) এখানে প্রেরণ করেছিলেন। এরপর আওস এবং খাযরাজ গোত্র এখানে আসেন এবং বসতি স্থাপন করেন।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) মদীনাহ্ শহরের পাঁচটি নামের উল্লেখ করেছেন। যথা- মদীনাহ্, ত্ববাহ্, ত্বইয়্যিবাহ্, আদ্দার ও ইয়াসরিব।
সহীহ মুসলিমে জাবির (রাঃ) থেকে মারফূ’ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- ’’নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলাই মদীনার নাম রেখেছেন ’’ত্ববাহ্’’ বা পবিত্র। ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেন, ত্ববাহ্ এবং ত্বইয়্যিবাহ্ নাম রাখা হয়েছে এজন্য যে, এ শহর শির্ক থেকে মুক্ত ও পবিত্র।
গবেষকগণ মদীনাহ্ শহরের অনেকগুলো নাম বর্ণনা করেছেন, বিস্তারিত দেখতে চাইলে ’’ওয়াফাউল ওয়াফা’’ এবং ’’উম্দাতুল আখবার’’ নামক গ্রন্থ দেখুন।
জানা আবশ্যক যে, হানাফীদের নিকট মদীনার একটি মর্যাদা রয়েছে, তবে তা মক্কার মতো নয়। পক্ষান্তরে আয়িম্মায়ে সালাসা তথা তিন ইমাম এর বিরোধী তারা মনে করেন মদীনার হুরমত মক্কার মতই। এখানকার শিকার ধরা হারাম, বৃক্ষ কর্তন হারাম ইত্যাদি। (সামনে এর বিস্তারিত বিবরণ আসবে)
২৭২৮-[১] ’আলী হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, কুরআন ও এ সহীফায় (পুস্তকে) যা আছে তা ছাড়া অন্য কোন কিছু রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছ থেকে আমরা লিখে রাখিনি। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মদীনাহ্ হারাম (অর্থাৎ- সম্মানিত বা পবিত্র) ’আয়র হতে সওর পর্যন্ত। যে ব্যক্তি এতে কোন বিদ্’আত (অসৎ প্রথা) চালু করবে অথবা বিদ্’আত চালুকারীকে আশ্রয় দেবে তার ওপর আল্লাহ ও মালায়িকাহ্ (ফেরেশতাগণ) এবং সকল মানুষেরই অভিসম্পাত। তার ফরয বা নফল কিছুই কবূল (গ্রহণযোগ্য) হবে না। সকল মুসলিমের প্রতিশ্রুতি বা দায়িত্ব এক; তাদের ক্ষুদ্র ব্যক্তিও তার চেষ্টা করতে পারে। যে কোন মুসলিমের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তার ওপর আল্লাহ ও মালায়িকাহ্ এবং সকল মানুষেরই অভিসম্পাত। তার ফরয ও নফল কোনটিই গৃহীত হবে না। আর যে নিজের মালিকের অনুমতি ছাড়া অন্য সম্প্রদায়ের সাথে বন্ধুত্ব (সম্পর্ক) স্থাপন করে তার ওপর আল্লাহর ও মালায়িকাহ্’র এবং সকল মানুষেরই অভিসম্পাত। তার ফরয বা নফল কোনটিই গৃহীত হবে না। (বুখারী, মুসলিম)
বুখারী ও মুসলিমের আর এক বর্ণনায় আছে, যে ব্যক্তি নিজের পিতা ছাড়া অন্যকে পিতা বলে স্বীকার করেছে অথবা যে ক্রীতদাস নিজের মালিক ছাড়া অন্যকে মালিক বলে গ্রহণ করেছে তার ওপর আল্লাহর, মালায়িকাহ্’র এবং সকল মানুষেরই অভিসম্পাত। তার কোন ফরয বা নফল কোনটাই গৃহীত হবে না।[1]
بَابُ حَرَمِ الْمَدِيْنَةِ حَرَسَهَا اللّٰهُ تَعَالٰى
عَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: مَا كَتَبْنَا عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِلَّا الْقُرْآنَ وَمَا فِي هَذِهِ الصَّحِيفَةِ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسلم: «الْمَدِينَةُ حَرَامٌ مَا بَيْنَ عَيْرٍ إِلَى ثَوْرٍ فمنْ أحدَثَ فِيهَا حَدَثًا أَوْ آوَى مُحْدِثًا فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لَا يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلَا عَدْلٌ ذمَّةُ المسلمينَ واحدةٌ يَسْعَى بِهَا أَدْنَاهُمْ فَمَنْ أَخْفَرَ مُسْلِمًا فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لَا يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلَا عَدْلٌ وَمَنْ وَالَى قَوْمًا بِغَيْرِ إِذْنِ مَوَالِيهِ فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لَا يُقْبَلُ مِنْهُ صَرْفٌ وَلَا عدل» وَفِي رِوَايَةٍ لَهُمَا: «مَنِ ادَّعَى إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ أَوْ تَوَلَّى غَيْرَ مَوَالِيهِ فَعَلَيْهِ لَعْنَةُ اللَّهِ وَالْمَلَائِكَةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ لَا يُقْبَلُ مِنْهُ صرف وَلَا عدل»
ব্যাখ্যা: ‘আলী (রাঃ)-এর উক্তি- ‘‘আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরআন ছাড়া কিছুই লিখি না, আর যা এ সহীফায় রয়েছে।’’ উল্লেখিত বাক্যে হাদীসটি ইমাম বুখারীর সহীহ গ্রন্থে সুফিয়ান-এর সূত্রে তিনি আ‘মাশ হতে, তিনি ইব্রাহীম আত্ তায়মী হতে, তিনি তার পিতা হতে, তিনি ‘আলী হতে বর্ণনা করেছেন।
হাদীসটি ইমাম মুসলিম আবূ মু‘আবিয়াহ্-এর সূত্রে তিনি আ‘মাশ থেকে, তিনি ইব্রাহীম থেকে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি অর্থাৎ- ইয়াযীদ ইবনু শারীক আত্ তায়মী (ইব্রাহীম-এর পিতা) বলেছেন, ‘আলী ইবনু আবূ ত্বলিব আমাদের মাঝে খুৎবাহ্ দিতে গিয়ে বললেন, ‘‘যে ধারণা করে যে কুরআন ছাড়া এবং এ সহীফাহ্ ছাড়া আমাদের নিকট আরো কিছু আছে যা আমরা পাঠ করে থাকি সে মিথ্যা বলল।’’
ইমাম বুখারী আবূ জুহাফাহ্’র সূত্রে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমি ‘আলী -কে জিজ্ঞেস করলাম আপনাদের নিকট কি কোন কিতাব আছে? তিনি বললেন, না, তবে আল্লাহর কিতাব (আল কুরআন) এবং ঐ বুঝ বা জ্ঞান যা একজন মুসলিম মুসলিমকে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) দেয়া হয়েছে আর এ সহীফায় যা রয়েছে।
হাফিয ইবনু হাজার আল আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, প্রশ্নকারী ‘আলী (রাঃ)-কে বহুবচনে সম্বোধন করে প্রশ্ন করেছেন; এর দ্বারা হয়তো পুরো আহলে বায়ত উদ্দেশ্য অথবা তার সম্মান উদ্দেশ্য।
আবূ জুহায়ফাহ্ ‘আলী (রাঃ)-কে এ প্রশ্নের করার কারণ হলো শী‘আদের ধারণা- আহলে বাইত তথা নাবী পরিবার, বিশেষ করে ‘আলী (রাঃ)-এর নিকট ওয়াহীর এমন কতিপয় বিষয় ছিল যা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে খাসভাবে দান করেছিলেন, যে সম্পর্কে অন্যদের কোন অবহিত ছিল না।
ইমাম নাবাবী (রহঃ) বলেনঃ শী‘আ এবং রাফিযীরা বলে থাকে, ‘আলী (রাঃ)-এর প্রতি নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনেকগুলো ওয়াসিয়্যাত করে গেছেন এবং শারী‘আতের গুপ্ত ভান্ডার, দীনের কাওয়ায়িদ এবং আসরারুল ‘ইলম বা ‘ইলমের গুপ্ত রহস্য বা তত্ত্বজ্ঞান তাকে দিয়ে গেছেন। তিনি আহলে বাইতদের এমন কিছু দিয়ে গেছেন যার সম্পর্কে অন্যদের কোন জ্ঞান-ই নেই। তাদের এ দাবী সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, মিথ্যা এবং বাতিল। ‘আলী (রাঃ)-এর নিজের কথাই তার ব্যাখ্যা প্রদান করেছে, যা অন্য বর্ণনায় এসেছে। আবূ জুহায়ফাহ্ ‘আলী (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘‘আপনার এ সহীফায় কি আছে?’’ উত্তরে তিনি বলেছেন, বন্দীপণ, অর্থাৎ- বন্দীর মুক্তিপণ।
হাফিয ইবনু হাজার আল আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, বুখারী এবং মুসলিমে ইয়াযীদ আত্ তায়মীর সূত্রে ‘আলী (রাঃ) থেকে এভাবে বর্ণনা এসেছে, তিনি বলেছেন,
ما عندنا شيء نقرؤه إلا كتاب الله وهذه الصحيفة، فإذا فيها الجراحات وأسنان الإبل والمدينة حرم.
আমাদের নিকট রক্ষিত আল্লাহর কিতাব ছাড়া আর কিছুই পাঠ করি না, আর এ সহীফায় যা রয়েছে। এতে রয়েছে, যখমের বিধান, উটের দাঁতের বিধান এবং মদীনার সম্মানের বিধান।
সহীহ মুসলিমে আবূ তুফায়ল-এর সূত্রে রয়েছে- ‘আলী (রাঃ) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বসাধারণের নিকট থেকে আমাদের কোন কিছুতেই বিশেষ কোন কিছু দ্বারা খাস করেননি। তবে এ তরবারির খাপে যা সংরক্ষিত। এরপর তিনি সেটা হতে লিখিত সংকলন বের করে দেখেন সেখানে লেখা আছে- لعن الله من ذبح لغير الله... الحديث। আল্লাহ অভিসম্পাত করেছেন ঐ ব্যক্তির ওপর যে আল্লাহর নাম ছাড়া অন্যের নামে পশু যাবাহ করে......। মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে- সেটাতে ফারায়িযুস্ সাদাকা লিখা ছিল। এ সকল বিভিন্ন রকম অর্থ সম্বলিত বর্ণনা সত্ত্বেও এ সহীফাহ্ ছিল একটি মাত্র এবং সকল বর্ণনার কথাগুলোই সেটাতে লিখা ছিল। যে যে বাক্য স্মরণ রেখেছেন সে সেটুকুই বর্ণনা করেছেন।
সহীহুল বুখারীতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বর্ণনা ‘‘মদীনাহ্ সম্মানিত’’-এর মূলে ‘আরাবী حرام শব্দ ব্যবহার হয়েছে যার অর্থ নিষিদ্ধ।
আহমাদ, আবূ দাঊদ প্রভৃতি গ্রন্থেও অনুরূপ ‘আলিফ’সহ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু মুসলিমের বর্ণনায় المدينة حرم ‘আলিফ’ ছাড়া বর্ণিত হয়েছে। এমনকি বুখারী, আহমাদ, তিরমিযী, নাসায়ী প্রভৃতি গ্রন্থেও।
الحرام শব্দটি ‘আলিফ’ ছাড়া حَرَمٌ-এর অর্থ প্রদান করেছে। কেননা বিভিন্ন রকমের বর্ণনার একটি আরেকটির তাফসীর করে থাকে।
মুল্লা ‘আলী কারী (রহঃ) বলেন, حرام-এর অর্থ محترم ممنوع مما يقتضي إهانة الموضع المكرم অর্থ ‘‘সম্মানিত’’, যে সম্মানিত স্থানের অবমাননা নিষিদ্ধ। ইমাম শাফি‘ঈ (রহঃ) الحرام-এর অর্থ গ্রহণ করেছে الحرم নিষিদ্ধ ও সম্মানিত।
মদীনার এ নিষিদ্ধ এরিয়া হলো ‘আয়র এবং সাওর-এর মধ্যবর্তী স্থান। ‘আয়র হলো মদীনাহ্ থেকে কিবলার দিকে যুল্ হুলায়ফার (যা মদীনাবাসীদের মীকাত) সন্নিকটে প্রসিদ্ধ একটি পাহাড়। আর সাওর হলো উহুদ পাহাড়ের পিছনে ছোট্ট একটি পাহাড়, তাই বলে এটা মক্কার সে সাওর পাহাড় নয়।
(ثور) ‘সাওর’ শব্দটি ইমাম মুসলিমের একক বর্ণনা, বুখারীতে (إلى كذا) শব্দে বর্ণিত হয়েছে, যাতে ইব্হাম বা অস্পষ্টতা রয়েছে।
আবূ ‘উবায়দ আল কাসিম ইবনুস্ সালাম বলেন, (مَا بَيْنَ عَيْرِ إِلٰى ثَوْرٍ) এ শব্দ সম্বলিত বাক্যটি ইরাকবাসীদের বর্ণনা, মদীনাবাসীরা ‘সাওর’ নামক কোন পর্বত আছে বলে তারা জানে না। ‘সাওর’ হলো মক্কার পাহাড়ের নাম। আমরা মনে করি হাদীসের আসল কথা হলোঃ (مَا بَيْنَ عَيْرِ إِلٰى ثَوْرٍ)
হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, এটা ত্ববারানী এবং আহমাদ-এর বর্ণনা যা ‘আব্দুল্লাহ ইবনুস্ সালাম রিওয়ায়াত করেছেন, উভয় বর্ণনায় উহুদ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। মদীনার সম্মানিত বা নিষিদ্ধ এরিয়া হলো পূর্বে কঙ্করময় টিলা এবং পশ্চিমেও কঙ্করময় টিলা আর উত্তর দক্ষিণে সাওর এবং ‘আয়র।
ইমাম শাফি‘ঈ, মালিক, আহমাদ তথা জমহূর আহলে ‘ইলম মনে করেন মক্কার মতই মদীনারও একটি নিষিদ্ধতা রয়েছে, এখানকার শিকার হত্যা করা যাবে না, বৃক্ষ কর্তন করা যাবে না। তবে ইমাম শাফি‘ঈ এবং মালিক (রহঃ)-এর একটি মত কেউ যদি কোন শিকার হত্যা করেই ফেলে অথবা কোন বৃক্ষ কর্তন করেই ফেলে তবে তার ওপর কোন জরিমানা ধার্য হবে না। কিন্তু ইবনু আবিয্ যি’ব এবং আবূ লায়লা প্রমুখ মনীষী বলেন, মক্কার মতই এদের ওপর শান্তির বিধান বর্তাবে। ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) বলেন, মদীনার নিষিদ্ধতা মূলত মক্কার নিষিদ্ধতার মত নয়। মদীনার শিকার হত্যা, বৃক্ষ কর্তনের নিষিদ্ধতা মুস্তাহাব অর্থে, হারাম অর্থে নয় এবং এটা মদীনার বিশেষ সম্মানার্থে বলা হয়েছে।
[এ মতামতগুলো বিভিন্ন ইমাম ও মুহাদ্দিসদের ব্যক্তিগত চিন্তার কথা অন্যথায় হাদীসে সেটাকে মুত্বলাক্বভাবেই হারাম বলা হয়েছে] -অনুবাদক
‘‘যে মদীনায় ইহদাস করল’’, এর অর্থ হলো যে মদীনাহ্ শহরে কোন মুনকার কাজ, বিদ্‘আত কাজ অর্থাৎ- যা কিতাব ও সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ সম্পাদন করবে অথবা এ জাতীয় কার্য সম্পাদনকারীকে আশ্রয়দান করবে তার প্রতি আল্লাহর লা‘নাত, তার মালায়িকাহ্’রও লা‘নাত এবং সমগ্র মানবমণ্ডলীর লা‘নাত বর্ষিত হবে। আল্লাহর লা‘নাত অর্থ আল্লাহর রহমাত থেকে দূরে থাকা এবং বঞ্চিত থাকা। আর মালায়িকাহ্’র লা‘নাত মানে তার জন্য আল্লাহর রহমাত থেকে দূরে থাকার (বদ্দু‘আ) করা।
হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, এ বাক্য দ্বারা বুঝা যায় যে, কোন গুনাহগারের প্রতি লা‘নাত করা বৈধ। এতে আরো প্রমাণ পাওয়া যায় যে, বিদ্‘আতকারী এবং বিদ্‘আতীকে আশ্রয়দানকারী উভয়েই সমান গুনাহগার।
কাযী ‘ইয়ায (রহঃ) বলেন, এ হাদীস দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় যে, মদীনাহ্ শহরে কোন বিদ্‘আত কার্য বা কুরআন সুন্নাহ পরিপন্থী কার্য সম্পাদন করা কাবীরাহ্ গুনাহের অন্তর্ভুক্ত। কেননা কাবীরাহ্ গুনাহ ছাড়া লা‘নাত করা প্রযোজ্য নয়। মালায়িকাহ্’র লা‘নাত এবং সমগ্র মানবমণ্ডলীর লা‘নাত দ্বারা আল্লাহর রহমাত থেকে দূরে বা বঞ্চিত থাকার কথা মুবালাগাতান বলা হয়েছে (অর্থাৎ- অতিরিক্ততা বা জোর দেয়া)। কেননা লা‘নাত শব্দের আভিধানিক অর্থ (اَلطَّرْدُ وَالإِبْعَادُ) বিতারিত করা, দূরে রাখা।
কেউ বলেছেন, লা‘নাত দ্বারা এখানে উদ্দেশ্য হলো ঐ শাস্তি, যে শাস্তি তার গুনাহের কারণে প্রথমে ভোগ করে নিবে (পরে সে জান্নাতে যাবে)। কাফিরদের ঐ লা‘নাত উদ্দেশ্য নয় যা আল্লাহর রহমাত থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে ও বঞ্চিত করে রাখবে।
তাদের নিকট থেকে কোন বিনিময় অথবা দান গ্রহণ করা হবে না, এখানে عَدْلٌ এবং صَرْفٌ শব্দ দু’টি নিয়ে মনীষীগণ ইখতিলাফ করেছেন। জমহূরের মতে صَرْفٌ হলো ফরয দান এবং عَدْلٌ হলো নফল দান। ইমাম ইবনু খুযায়মাহ্ হাসান বাসরী (রহঃ)-এর সূত্রে ঠিক এর বিপরীত বর্ণনা করেছেন। ইমাম আসমা‘ঈ বলেন, الصرف অর্থ হলো التوبة, আর العدل হলো الفدية। এছাড়া আরো অনেকে অনেক কথা বলেছেন।
সমগ্র মু’মিন যেমন একটি দেহের ন্যায়, দেহের একটি অঙ্গ আক্রান্ত হলে সমস্ত দেহই তার ব্যথা অনুভব করে, ঠিক অনুরূপ সমগ্র মুসলিমের যিম্মাহ ও প্রতিশ্রুতি যা কেউই তা ভঙ্গ করতে পারবে না। হাফিয ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, একজন মুসলিমও যদি কোন কাফিরকে নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেয় তবে অন্য কোন মুসলিম তা ভঙ্গ করতে পারবে না।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, যে আপন পিতাকে বাদ দিয়ে অন্যকে পিতৃ-পরিচয় দিবে এবং যে কৃতদাস নিজ মনিবের পরিবর্তে অন্যকে মনিব পরিচয় দিবে তার প্রতিও লা‘নাত। অপরকে পিতৃ পরিচয় দেয়া বহু কারণেই হতে পারে তন্মধ্যে দু’টি কারণ প্রধান। যথা- (১) মীরাসী সম্পদ গ্রহণের জন্য এবং (২) বংশীয় মর্যাদা লাভের জন্য। যে কারণেই হোক এ কাজ সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নিষিদ্ধ।