পরিচ্ছেদঃ ৩৫. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - বিতরের সালাত
১২৭৩-[২০] হাসান ইবনু ’আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিতরের দু’আ কুনূত পাঠ করার জন্য আমাকে কিছু ক্বালিমাহ্ শিক্ষা দিয়েছেন। সে ক্বালিমাগুলো হলো,
’’আল্ল-হুম্মাহদিনী ফীমান হাদায়তা ওয়া ’আ-ফিনী ফীমান ’আ-ফায়তা, ওয়াতা ওয়াল্লানী ফীমান তাওয়াল্লায়তা, ওয়াবা-রিক লী ফীমা- আ’ত্বায়তা, ওয়াক্বিনী শাররা মা- ক্বযায়তা, ফাইন্নাকা তাক্বযী ওয়ালা- ইউক্বযা- ’আলায়কা, ওয়া ইন্নাহূ লা- ইয়াযিল্লু মাওঁ ওয়ালায়তা, তাবা-রাকতা রব্বানা- ওয়াতা’আ-লায়তা।’’
অর্থাৎ ’’হে আল্লাহ! তুমি আমাকে হিদায়াত দান করো সে সব মানুষের সঙ্গে যাদের তুমি হিদায়াত দান করেছ (নবী রসূলগণ)। তুমি আমাকে দুনিয়ার বিপদাপদ থেকে হিফাযাত করো ওসব লোকের সঙ্গে যাদেরকে তুমি হিফাযাত করেছ। যাদের তুমি অভিভাবক হয়েছো, তাদের মাঝে আমারও অভিভাবক হও। তুমি আমাকে যা দান করেছ (জীবন, জ্ঞান সম্পদ, ধন, নেক ’আমল), এতে বারাকাত দান করো। আর আমাকে তুমি রক্ষা করো ওসব অনিষ্ট হতে যা আমার তাকদীরে লিখা হয়ে গেছে। নিশ্চয় তুমি যা চাও তাই আদেশ করো। তোমাকে কেউ আদেশ করতে পারে না। তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে কেউ অপমানিত করতে পারে না। হে আমার রব! তুমি বারাকাতে পরিপূর্ণ। তুমি খুব উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন’’। (তিরমিযী, আবূ দাঊদ, নাসায়ী, ইবনু মাজাহ, দারিমী)[1]
وَعَنِ الْحَسَنِ بْنِ عَلِيٍّ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمَا قَالَ: عَلَّمَنِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَلِمَاتٍ أَقُولُهُنَّ فِي قُنُوتِ الْوَتْرِ: «اللَّهُمَّ اهدني فِيمَن هديت وَعَافنِي فِيمَن عافيت وتولني فِيمَن توليت وَبَارك لي فِيمَا أَعْطَيْت وقني شَرَّ مَا قَضَيْتَ فَإِنَّكَ تَقْضِي وَلَا يُقْضَى عَلَيْك أَنه لَا يذل من واليت تَبَارَكت رَبَّنَا وَتَعَالَيْتَ» . رَوَاهُ التِّرْمِذِيُّ وَأَبُو دَاوُدَ وَالنَّسَائِيُّ وَابْنُ مَاجَهْ والدارمي
ব্যাখ্যা: أَقُولُهُنَّ অর্থাৎ আমি রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শেখানো শব্দগুলো দ্বারা দু‘আ করতাম। فِي قُنُوتِ الْوَتْرِ বিতরের কুনূতে আর قُنُوْتِ শব্দটি কয়েকটি অর্থের উপর মুত্বলাক্ব অর্থাৎ কয়েকটি অর্থে ব্যবহার হয়। এখানে قُنُوتِ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো বিতর সালাতে দাঁড়ানো অবস্থায় নির্ধারিত স্থানে দু‘আ করা বা প্রার্থনা করা। আর এর সমর্থনে আহমাদে এবং নাসায়ীর বর্ণনায় রয়েছে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ কালিমাগুলো বিতরের ক্ষেত্রে শিক্ষা দিয়েছেন। এ হাদীস পূর্ণ বছরের জন্য প্রযোজ্য। যেমন হানাফী ও হাম্বালী মাযহাবের মত এবং এটি শাফি‘ঈদেরও মত, তবে তাদের নিকট প্রসিদ্ধ অপর একটি মত হলো বিতর রমাযান মাসের শেষ দশকের জন্য খাস। তবে আমাদের নিকট প্রাধান্য মত হলো, সারা বছরই বিতরে কুনূত পড়া মুস্তাহাব। কেননা তা একটি যিকর, বিতরে তা শারী‘আত সম্মত হলে তা পূর্ণ বছরের জন্য শারী‘আত সম্মত হবে অন্য সকল যিকিরের (জিকিরের) মতোই।
উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, এ দু‘আর মাধ্যমে কুনূত পড়া শারী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত এবং এটাই ইমাম শাফি‘ঈ ও হাম্বালী মাযহাব অবলম্বীদের নিকট উত্তম। তবে হানাফী মাযহাব অবলম্বীদের নিকট বিতরের কুনূত সূরাহ্ আল আনফাল ও সূরাহ্ আল হা-ক্বক্বাহ্ এর দ্বারা অর্থাৎ (اللهم إنا نستعينك..... بالكفار ملحق) পড়াই উত্তম। এটি আবূ দাঊদ বর্ণনা করেছেন মারাসিল নামক গ্রন্থে, বায়হাক্বী বর্ণনা করেছে সুনান গ্রন্থের ২য় খন্ডের ২১০ পৃষ্ঠায় মুরসাল সানাদে, আবী শায়বাহ্ বর্ণনা করেছেন মাওকূফভাবে।
ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রহঃ) বলেনঃ এটি ‘উবাইয়ের মাসহাফের কুরআনের ২টি সূরাহ্। অনুরূপ কথা বর্ণনা করেছেন আল্লামা সুয়ূতী দুররুল মানসূর নামক গ্রন্থে এবং ইবনু কুদামাহ্ বর্ণনা করেছেন মুগনী নামক গ্রন্থের ২য় খন্ডের ১৫৩ পৃষ্ঠায়। মির্‘আত প্রণেতা বলেনঃ আমার নিকট গ্রহণযোগ্য ও প্রসিদ্ধ মত হলো বিতরের কুনূতে হাসান ইবনু ‘আলী (রাঃ)-এর বর্ণিত দু‘আ (اَللّهُمَّ اهْدِنِيْ) পড়াই উত্তম, কারণ তা সহীহ কিংবা হাসান, মারফূ' ও মুত্তাসিল সানাদে বর্ণিত। এমনকি ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেনঃ বিতরের কুনূত সম্পর্কে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত এ দু‘আর চেয়ে উত্তম দু‘আ আমার জানা নেই।
(আবূ দাঊদ, আহমাদ- ১ম খন্ড, ১৯৯, ২০০ পৃঃ)
তবে যদি হানাফীদের পছন্দনীয় দু‘আ কেউ পড়ে তবে তা সন্দেহাতীতভাবে বৈধ হবে মর্মে মির‘আত প্রণেতা অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
বিতর সালাতের কুনূত রুকূ‘র পূর্বে হবে না পরে পড়তে হবে এ ব্যাপারে মতানৈক্য রয়েছে। হানাফীদের নিকট প্রথমটি উত্তম (অর্থাৎ রুকূ‘র আগে পড়া)।
ইমাম শাফি‘ঈ, আহমাদ ও ইসহাক ইবনু রাহিয়্যাহ্-এর নিকট দ্বিতীয়টি (রুকূ‘র পরে পড়া) উত্তম। তাদের পক্ষ হতে দলীল (যারা রুকূ‘র পরে কুনূত পড়ার পক্ষে) উপস্থাপন করা হয় আনাস (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত হাদীস। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকূ‘র পড়ে কুনূত পড়তেন এবং আবূ বাকর ও ‘উমার (রাঃ) এমনকি ‘উসমান (রাঃ) পর্যন্ত, আর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকূ‘র পূর্বে কুনূত পড়েছেন মুসলিম মিল্লাতকে (রুকূ‘র পূর্বে পড়া) বৈধতা জানানোর জন্য। ইরাক্বী (রহঃ) বলেছেন, এ হাদীসের সানাদ জাইয়্যিদ (‘আমলযোগ্য), এছাড়াও মুস্তাদরাকে হাকিমে হাসান ইবনু ‘আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত।
‘‘যখন রুকূ‘ হতে মাথা উঠাবে এবং সিজদা্ (সিজদা/সেজদা) ব্যতীত কিছু অবশিষ্ট থাকবে না তখন কুনূত পড়বে।’’ এছাড়াও তাদের জন্য সাহাবায়ে কিরামদের একাধিক আসার রয়েছে এবং ফাজ্র (ফজর) সালাতের উপর কিয়াস রয়েছে, (অর্থাৎ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফাজ্রের (ফজরের) সালাতে রুকূ‘র পরে কুনূত পড়েছেন) যা রুকূ‘র পরে কুনূত পড়ারই প্রমাণ বহন করে। আর হানাফীগণ দলীল গ্রহণ করেছেন বুখারীর বর্ণনানুযায়ী নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকূ‘র পূর্বে কুনূত পড়েছেন। (সহীহুল বুখারী- ১ম খন্ড, ১৩৬ পৃঃ)
হাফিয আসক্বালানী উক্ত হাদীস আত্ তালখীস-এর ৯৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-এর বর্ণনায় বায়হাক্বীতে (৩য় খন্ড, পৃঃ ৩৯, ৪০ পৃঃ) রয়েছে যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকূ‘র পূর্বে কুনূত পড়েছেন। এ প্রসঙ্গে মির‘আত প্রণেতা (রহঃ) বলেনঃ বিতর সালাতে রুকূ‘র পূর্বে এবং পরে কুনূত পড়া বৈধ। তবে রুকূ‘র পূর্বে কুনূত পড়াটাই উত্তম, কারণ এ ব্যাপারে সর্বাধিক বিশুদ্ধ হাদীস রয়েছে। আর এ ব্যাপারে বিতরের কুনূত ফাজ্রের (ফজরের) সালাতের কুনূতের উপর কিয়াস করার কোন প্রয়োজন নেই, কেননা বিতরের ব্যাপারে অধিক হাদীস রয়েছে যেগুলো নির্ভরযোগ্য সানাদে বর্ণিত এবং তা রুকূ‘র পূর্বে কুনূত পড়াই স্পষ্ট করে দেয়। আর বিতরের কুনূতকে ফাজ্রের (ফজরের) কুনূতের সাথে কিয়াস করা সম্ভব নয়, কারণ উভয়ের মাঝে অর্থগত কোন সামঞ্জস্যতা নেই (একটি বদদু‘আ অপরটি সাধারণ দু‘আ বা প্রার্থনা) যা উভয়ের মাঝে সমন্বয়ে সহায়ক হয়।