পরিচ্ছেদঃ ৬৭/৪. বহুবিবাহ
৫০৬৭. ’আত্বা (রহ.) বলেন, আমরা ইবনু ’আব্বাস (রাঃ)-এর সঙ্গে ’সারিফ’ নামক স্থানেমাইমূনাহ (রাঃ)-এর জানাযায় হাজির ছিলাম। ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) বলেন, ইনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সহধর্মিণী। কাজেই যখন তোমরা তাঁর জানাযাহ উঠাবে তখন ধাক্কা-ধাক্কি এবং তা জোরে নাড়া-চাড়া করো না; বরং ধীরে ধীরে নিয়ে চলবে। কেননা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নয়জন সহধর্মিণী ছিলেন। [1] আট জনের সঙ্গেতিনি পালাক্রমে রাত্রি যাপন করতেন। আর একজনের সঙ্গে রাত্রি যাপনের কোন পালা ছিল না। [2] [মুসলিম ১৭/১১৪, হাঃ ১৪৬৫] (আধুনিক প্রকাশনীঃ ৪৬৯৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ৪৬৯৭)
[1] ইসলামে একাধিক বিবাহের অনুমতিঃ ইসলাম হচ্ছে সকল জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ তা‘আলার দেয়া ভারসাম্যপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। এতে দু’টি শর্তাধীনে পুরুষ কর্তৃক একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বিধান দেয়া হয়েছে। (১) সর্বাধিক চার জন স্ত্রী সে একসঙ্গে রাখতে পারবে, (২) স্ত্রীদের সঙ্গে জীবন যাপনের ক্ষেত্রে ইনসাফ বজায় রাখতে হবে। যে সব জাতি একাধিক স্ত্রী গ্রহণের কঠিন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেছে, তারা সামাজিক ক্ষেত্রে নানাবিধ দুঃখ, বেদনা, গঞ্জনার শিকার হয়েছে, তাদের নৈতিক চরিত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই বিশেষ কারণে ইসলাম একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি দিয়ে মানুষের জীবনে শান্তির অমিয় ধারা প্রবাহিত করার ব্যবস্থা করেছে।
১। কোন পুরুষ যখন দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবনে স্ত্রীর কারণে সন্তানাদি থেকে বঞ্চিত থাকে, তখন এ সীমাহীন বঞ্চনার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে অন্য নারীকে বিবাহ করা।
২। স্ত্রী যদি চিররুগ্না হয়ে পড়ে কিংবা পাগল হয়ে যায় কিংবা বয়সের কারণে যৌনকর্মে আসক্তিহীন হয়ে যায় সেক্ষেত্রে সবল সুঠাম দেহের অধিকারী কোন পুরুষ কি আরেকটি বিবাহ না করে যৌন উত্তেজনার আগুনে আজীবন জ্বলতে থাকবে? নাকি গার্লফ্রেন্ড ও প্রণয়িনী জোগাড় করে অশ্লীলতার বিস্তার ঘটিয়ে সমাজকে অনৈতিকতায় ভরে তুলবে?
উল্লেখ্য অনুরূপভাবে স্বামী যদি চিররুগ্ন হয়ে পড়ে কিংবা পাগল হয়ে যায় কিংবা বয়সের কারণে যৌনকর্মে আসক্তিহীন হয়ে যায় সেক্ষেত্রে তার ঘর সংসার করা কিংবা না করার ব্যাপারে স্ত্রীরও স্বাধীনতা রয়েছে। সে ইচ্ছে করলে খুলা ত্বলাক করিয়ে নিতে পারবে। অতএব একাধিক বিয়ের বিষয়টি শুধুমাত্র সেই স্বামীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য যার শারীরিক ও আর্থিক সহ সার্বিক দিক দিয়ে সামর্থ্য রয়েছে।
৩। যুদ্ধের ফলে- যেমনটি প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ইউরোপে ঘটেছিল- পুরুষের সংখ্যা কমে গেলে বহু নারী অবিবাহিতা থেকে যাবে যদি একাধিক স্ত্রী গ্রহণের অনুমতি না থাকে। সেক্ষেত্রে ঐ সকল নারীরা অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হয়ে গোটা সমাজকে কলূষিত করে তুলবে।
৪। কোন কোন পুরুষ অন্যান্য পুরুষদের চেয়ে অধিক দৈহিক শক্তির অধিকারী। এরূপ পুরুষদের জন্য একজন স্ত্রী নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। কেননা, ইচ্ছে করেও সে তার জৈবিক শক্তিকে চেপে রাখতে পারে না। এমন পুরুষদের জন্য আইনগতভাবেই দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি থাকা বাঞ্ছনীয়। নতুবা এসব পুরুষের দ্বারা সমাজে কলূষতার বিস্তার ঘটবে।
৫। কোন শ্রমজীবী মনে করতে পারে যে, তার আরেকজন স্ত্রী হলে শ্রমের কাজে তাকে সাহায্য করতে পারবে, এমতাবস্থায় দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণ করা তার অর্থনৈতিক প্রয়োজন। এভাবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে আরো অনেক প্রয়োজন দেখা দিতে পারে যার কারণে এক ব্যক্তি এক স্ত্রী বর্তমান থাকতে আরো স্ত্রী গ্রহণে বাধ্য হতে পারে।
ইসলাম একাধিক বিবাহের অনুমতি দিয়েছে যা বহুবিধ কারণে ন্যায়সঙ্গত ও যুক্তিযুক্ত। কোন নারী যদি এ বিধানকে অবজ্ঞা করে তবে তার ঈমানের ব্যাপারে আশংকা রয়েছে।
চারের অধিক স্ত্রী গ্রহণের নিষেধাজ্ঞা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য প্রযোজ্য ছিল না। এ সম্পর্কে সূরা আহযাবের ৫০ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন- হে নাবী! আমি তোমার জন্য বৈধ করেছি তোমার স্ত্রীগণকে যাদের মাহর তুমি প্রদান করেছ, আর বৈধ করেছি সে সব মহিলাদেরকেও যারা আল্লাহর দেয়া দাসীদের মধ্য হতে তোমার মালিকানাভুক্ত হবে, তোমার সে সব চাচাতো, ফুফাতো, মামাতো, খালাতো বোনদেরকেও (বিবাহ বৈধ করেছি) যারা তোমার সাথে হিজরত করে এসেছে এবং কোন মু’মিন নারী নাবীর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নিকট নিজেকে পেশ করলে এবং নাবী তাকে বিয়ে করতে চাইলে সেও বৈধ- এটা বিশেষ করে তোমার জন্য, অন্য মু’মিনদের জন্য নয়। মু’মিনদের স্ত্রী আর তাদের দাসীদের ব্যাপারে কী সব বিধি-বিধান দিয়েছি তা আমি জানি, (আমি তোমাকে সে সব বিধি বিধানের ঊর্ধ্বে রেখেছি) যাতে তোমার পক্ষে কোন প্রকার সংকীর্ণতার অসুবিধা না থাকে; আর আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়াবান।
স্ত্রী গ্রহণের ব্যাপারে আল্লাহ যে নাবীর জন্য বিশেষ বিধানের ব্যবস্থা করলেন এখানে আমরা তার তাৎপর্য ও কারণ বিশ্লেষণের চেষ্টা করব। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ২৫ বছর বয়সে ৪০ বছর বয়স্কা এক পৌঢ়াকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে একাদিক্রমে ২৫টি বছর তাঁর সঙ্গে অত্যন্ত পরিতৃপ্তিময় দাম্পত্য জীবন অতিবাহিত করেন। এ পৌঢ়ার ইন্তেকাল হলে সাওদা (রাঃ) নাম্নী এক বয়োবৃদ্ধাকে বিয়ে করেন। পূর্ণ ৪টি বছর এই বয়োবৃদ্ধাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একমাত্র স্ত্রী হয়েছিলেন। অপরদিকে নাবীর উপর অর্পিত হয়েছিল একটি সম্পূর্ণ আনাড়ি ও সেকেলে জাতিকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এক উচ্চ, উন্নত, পবিত্র ও সুসভ্য জাতি হিসেবে গড়ে তোলার বিরাট ও বিশাল দায়িত্ব। এজন্য শুধু পুরুষদেরকে গড়ে তোলাই যথেষ্ট ছিল না। নারীদেরকে তৈরিরও প্রয়োজন ছিল। অথচ ইসলামী সমাজে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এমতাবস্থায় নারী সমাজের মাঝে দ্বীনী দা‘ওয়াতের কাজ ব্যাপকভাবে পরিচালনার জন্য প্রথমত কিছু সংখ্যক নারীকে শিক্ষা-প্রশিক্ষণের মাধ্যমে গড়ে তোলার একান্ত প্রয়োজন ছিল। আর বিভিন্ন বয়সের কিছু সংখ্যক নারীকে স্ত্রী হিসেবে একান্তে প্রশিক্ষিত করা ছাড়া অন্য কোন উপায়ে এ কাজ সঠিকভাবে সফল করা সম্ভব ছিল না। আর তা একজন নারীর পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল, ফলে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-র জন্য একাধিক নারীকে বিবাহের প্রয়োজন দ্বীনী প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তদুপরি জাহিলী জীবন ব্যবস্থা খতম করে তদস্থলে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্যে বিভিন্ন গোত্র-পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন করে সম্পর্ক পাকাকরণ ও শত্রুতার অবসান ঘটানোর প্রয়োজন ছিল খুব বেশি। এ দৃষ্টিতে বিচার করলে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেসব বিয়ে করেছিলেন সেসব বিবাহ ইসলামের সমাজ সংগঠন ও প্রসারে খুবই কল্যাণকর প্রমাণিত হয়েছিল। ‘আয়িশাহ ও হাফসাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বিয়ে করে তিনি আবূ বাক্র ও ‘উমার (রাঃ)-এর সঙ্গে সম্পর্ক অধিক দৃঢ় ও স্থায়ী করে নিয়েছিলেন। উম্মু সালামাহ (রাঃ)-ও ছিলেন এমন পরিবারের কন্যা যার সাথে আবূ জাহ্ল ও খালিদ বিন ওয়ালীদের নিকটতর সম্পর্ক ছিল। আর উম্মু হাবীবাহ (রাঃ) ছিলেন আবূ সুফ্ইয়ানের কন্যা। এসব বিবাহ সম্পর্কিত গোত্র-পরিবারগুলোর তাঁর সাথে শত্রুতা-বিদ্বেষের তীব্রতা অনেকাংশে কমে গিয়েছিল। উম্মে হাবীবা (রাঃ)-কে বিয়ে করার পর আবূ সুফ্ইয়ান আর কোনদিনই রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়নি। সাফিয়া, জুয়াইরিয়া ও রায়হানা (রাযি.) ইয়াহূদী পরিবারের মেয়ে ছিলেন। তাদেরকে মুক্তি দিয়ে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাদেরকে বিয়ে করলেন তখন ইয়াহূদীদের শত্রুতাপূর্ণ আচরণ স্তিমিত হয়ে গেল। এর কারণ ছিল এই যে, এ সময় আরব ঐতিহ্য অনুযায়ী জামাতা কেবল কনের পরিবারের নয়, গোটা গোত্রেরই জামাতা হত এবং জামাতার সঙ্গে লড়াই সংঘর্ষ করা ছিল অত্যন্ত লজ্জাকর ব্যাপার। আর পোষ্যপুত্রের তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীকে কেউ বিয়ে করতে পারবে না- এ জাহিলী রসম রেওয়াজকে চূর্ণ করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা যায়দ বিন হারিসাহ (রাঃ)-এর তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর সঙ্গে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন যা কুরআনের সূরা আহযাবে বর্ণিত হয়েছে। নাবী পত্নীগণ কর্তৃক নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত ইসলামী বিধি-বিধান এক অক্ষয় সম্পদ হিসেবে হাদীসের কিতাবগুলোতে বিদ্যমান আছে। এ ক্ষেত্রে বিশেষতঃ ‘আয়িশাহ (রাঃ)-এর অবদান শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী মানুষের মাঝে ইসলামের আলো বিকীরণ করে চলেছে। উল্লেখ্য নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এতোগুলি বিয়ে আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ীই করেছিলেন এবং চারাধিক বিয়ে তাঁর জন্যই খাস ছিল। এছাড়া তিনি যদি কামুক [না‘ঊযুবিল্লাহ্] হতেন তাহলে একজন অর্ধ বয়সী নারীকে বিয়ে করতেন না এবং শুধুমাত্র তাকে নিয়েই দীর্ঘ দিন সন্তুষ্ট থাকতেন না। এরূপ হলে তিনি জাহেলী যুগের মক্কার কাফিরদের থেকে তাঁর ন্যায় পরায়ণতা ও চারিত্রিক গুণাবলীর কারণে আল-আমীন উপাধিও পেতেন না।
[2] যার সঙ্গে রাত্রি যাপনের পালা ছিল না তিনি হলেন সাউদা বিনতে যাম‘আ (রাঃ), বার্ধক্যজনিত কারণে তিনি নিজের পালায় ছাড় দিয়ে তা ‘আয়িশাহ (রাঃ)-কে দান করেছিলেন।
بَاب كَثْرَةِ النِّسَاءِ
إِبْرَاهِيمُ بْنُ مُوْسٰى أَخْبَرَنَا هِشَامُ بْنُ يُوْسُفَ أَنَّ ابْنَ جُرَيْجٍ أَخْبَرَهُمْ قَالَ أَخْبَرَنِي عَطَاءٌ قَالَ حَضَرْنَا مَعَ ابْنِ عَبَّاسٍ جِنَازَةَ مَيْمُوْنَةَ بِسَرِفَ فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ هٰذِه„ زَوْجَةُ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَإِذَا رَفَعْتُمْ نَعْشَهَا فَلاَ تُزَعْزِعُوْهَا وَلاَ تُزَلْزِلُوْهَا وَارْفُقُوْا فَإِنَّه“ كَانَ عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم تِسْعٌ كَانَ يَقْسِمُ لِثَمَانٍ وَلاَ يَقْسِمُ لِوَاحِدَةٍ.