রমযানের শেষ দশকের ফযীলত - ২

ই‘তিকাফ করা: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রমযানের শেষ দশকে ইবাদতের মধ্যে অন্যতম ছিল ই‘তিকাফ করা। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، كَانَ يَعْتَكِفُ العَشْرَ الأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ حَتَّى تَوَفَّاهُ اللَّهُ».

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত রমযানের শেষ দশক ই‘তিকাফ করতেন”।[1] রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লাইলাতুল কদরের তালাশে রমযানের শেষ দশ দিন সমস্ত কাজ-কর্ম ছেড়ে, অন্যান্য চিন্তা-ভাবনা মুক্ত হয়ে তার রবের মুনাজাত, যিকির ও দো‘আয় মগ্ন হওয়ার জন্য ই‘তিকাফ করতেন।

ইমাম আহমাদ রহ. বলেন, ই‘তিকাফকারীর জন্য মানুষের সাথে বেশি মেলা-মেশা না হওয়াই মুস্তাহাব; এমনকি ইলম ও কুরআন শিক্ষার জন্যও নয়, বরং তার জন্য উত্তম হলো একাকী থাকা, তার রবের মুনাজাত, যিকির ও দো‘আয় একাগ্র থাকা।

এ ধরণের ই‘তিকাফ হলো শর‘ঈ নির্জনবাস যা মসজিদে করতে হয়, এতে মানুষের সাথে একত্রিত হওয়া বাদ পড়ে না আবার জামা‘আতে সালাত আদায়ও বাদ পড়ে না। অন্যদিকে মানুষের থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে নির্জনবাস করা শরী‘আতে নিষেধ। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে একলোক সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলো যে রাত জেগে সালাত আদায় করে আর দিনে সাওম পালন করে, তবে সে জুমু‘আর সালাত ও জামা‘আতে উপস্থিত হয় না। তিনি বললেন, লোকটি জাহান্নামী।

অতএব, এ উম্মাতের জন্য শরী‘আতসম্মত নির্জনবাস হলো মসজিদে ই‘তিকাফ পালন করা, বিশেষ করে রমযান মাসে, আরও নির্দিষ্ট করে রমযানের শেষ দশ দিন, যেমনিভাবে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন। ই‘তিকাফকারী আল্লাহর ইবাদত, আনুগত্য ও যিকিরে নিজেকে মসজিদে আবদ্ধ করে রাখে, দুনিয়ার সমস্ত ঝামেলামুক্ত হয়ে অন্তরকে একমাত্র রবের দিকে ঝুঁকিয়ে দেয় এবং তাঁর নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা করে। অতএব, আল্লাহর সন্তুষ্টি অন্বেষণ ব্যতীত তার কোনো কাজ থাকে না।

ই‘তিকাফের হাকীকী অর্থ হলো, সৃষ্টির সাথে সব ধরণের সম্পর্ক ছিন্ন করে স্রষ্টার সাথে সম্পর্কযুক্ত হওয়া। তার রবের পরিচিতি, তাঁর ভালোবাসা ও তাঁর মমত্ববোধ যত বেশি শক্তিশালী হবে ব্যক্তি তত বেশি দুনিয়ার সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে তাঁর প্রতি সম্পূর্ণ সম্পর্কযুক্ত হবে। কোনো একলোক গৃহে সম্পূর্ণ একাকী থেকে তার রবের জন্য নিজেকে মুক্ত করল। তাকে একজন জিজ্ঞাসা করল, তুমি কি একাকীত্ব অনুভব করো না? সে বলল, কীভাবে আমি একাকীত্ব অনুভব করব অথচ তিনি তো বলেছেন: যে ব্যক্তি আমাকে স্মরণ করে আমি তার মজলিশের সাথী।

হে মানুষ! যে নিজের জীবনকে নিঃশেষ করে দিয়েছ, উঠ। তোমার জীবনে যা কিছু ছুটে গেছে সেগুলো লাইলাতুল কদরে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করো। কেননা একটি লাইলাতুল কদরই তোমার জীবনে ছুটে যাওয়া দিনগুলোর জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ ٢ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ٣﴾ [القدر: ١، 3]

“নিশ্চয় আমরা এটি (কুরআন) নাযিল করেছি ‘লাইলাতুল কদরে।’ তোমাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল কদর’ কী? ‘লাইলাতুল কদর’ হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।” [সূরা আল-কাদর, আয়াত: ১-৩]

«إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أُرِيَ أَعْمَارَ النَّاسِ قَبْلَهُ. أَوْ مَا شَاءَ اللهُ مِنْ ذلِكَ. فَكَأَنَّهُ تَقَاصَرَ أَعْمَارَ أُمَّتِهِ أَنْ لاَ يَبْلُغُوا مِنَ الْعَمَلِ، مِثْلَ الَّذِي بَلَغَ غَيْرُهُمْ فِي طُولِ الْعُمْرِ، فَأَعْطَاهُ اللهُ لَيْلَةَ الْقَدْرِ، خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ».

“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তার পূর্বের মানুষের হায়াত দেখানো হলো অথবা আল্লাহ যতটুকু চেয়েছেন ততটুকু দেখানো হয়েছে। এতে তিনি তার উম্মতের হায়াত নিতান্তই কম মনে করলেন। যেহেতু অন্যান্য উম্মাতের দীর্ঘ হায়াতের কারণে তাদের বেশি আমল তার উম্মাতের কম হায়াতের কারণে অল্প আমল তাদের সমকক্ষ হতে পারবে না। অতঃপর আল্লাহ তাকে লাইলাতুল কদর দান করেছেন যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।”[2]

মুজাহিদ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,

«أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَكَرَ رَجُلًا مِنْ بَنِي إِسْرَائِيلَ لَبِسَ السِّلَاحَ فِي سَبِيلِ اللهِ أَلْفَ شَهْرٍ قَالَ: فَعَجِبَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ ذَلِكَ قَالَ: فَأَنْزَلَ اللهُ عَزَّ وَجَلَّ ﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ ٢ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ٣﴾ [القدر: ١، 3] الَّتِي لَبِسَ فِيهَا ذَلِكَ الرَّجُلُ السِّلَاحَ فِي سَبِيلِ اللهِ أَلْفَ شَهْرٍ».

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী ইসরাঈলের একলোকের কথা উল্লেখ করেন যিনি আল্লাহর পথে এক হাজার মাস অস্ত্র পরিহিত ছিল (অর্থাৎ হাজার মাস জিহাদ করেছেন)। এতে মুসলিমগণ আশ্চর্যন্বিত হলেন। তখন আল্লাহ তা‘আলা এ আয়াত নাযিল করেন,

﴿إِنَّآ أَنزَلۡنَٰهُ فِي لَيۡلَةِ ٱلۡقَدۡرِ ١ وَمَآ أَدۡرَىٰكَ مَا لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ ٢ لَيۡلَةُ ٱلۡقَدۡرِ خَيۡرٞ مِّنۡ أَلۡفِ شَهۡرٖ٣﴾ [القدر: ١، 3]

“নিশ্চয় আমরা এটি (কুরআন) নাযিল করেছি ‘লাইলাতুল কদরে।’ তোমাকে কিসে জানাবে ‘লাইলাতুল কদর’ কী? ‘লাইলাতুল কদর’ হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।” [সূরা আল-কাদর, আয়াত: ১-৩] অর্থাৎ বর্ম পরিহিত সে ব্যক্তি এক হাজার মাসের জিহাদের চেয়েও লাইলাতুল কদর উত্তম।”[3]

নাখা‘ঈ রহ. বলেন, কদরের রাতে আমল করা অন্য সময়ের এক হাজার মাস আমল করা অপেক্ষা উত্তম। সহীহাইনে আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:

«مَنْ قَامَ لَيْلَةَ القَدْرِ إِيمَانًا وَاحْتِسَابًا، غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ».

“যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করে, তাঁর পিছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে”।[4]

মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে,

«فَمَنْ قَامَهَا ابْتِغَاءَهَا إِيمَانًا، وَاحْتِسَابًا، ثُمَّ وُفِّقَتْ لَهُ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ».

“যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদরে ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রাত জেগে ইবাদাত করবে, অতঃপর সে রাত লাভ করার তাওফীকপ্রাপ্ত হবে, তার পিছনের ও পরের সমস্ত গুনাহ মাফ করা হবে।”[5]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«فِيهِ لَيْلَةٌ خَيْرٌ مِنْ أَلْفِ شَهْرٍ، مَنْ حُرِمَ خَيْرَهَا فَقَدْ حُرِمَ».

“এ মাসে একটি রাত রয়েছে যা এক হাজার মাস অপেক্ষাও উত্তম। যে ব্যক্তি সে রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেল সে প্রকৃতই বঞ্চিত রয়ে গেল।”[6] জুওয়াইবার রহ. বলেন, আমি দাহহাক রহ.-কে জিজ্ঞসে করলাম, হায়েয ও নিফাসবতী, মুসাফির ও ঘুমন্ত ব্যক্তির ব্যাপারে আপনি কী মনে করেন? তারা কি লাইলাতুল কদরের মর্যাদা পাবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। যাদের আমলই আল্লাহ কবুল করেন তাদেরকেই লাইলাতুল কদরের মর্যাদা দান করবেন। সুতরাং কবুল হওয়াই এখানে মূল বিষয়, বেশি পরিমাণ ইবাদত মূখ্য উদ্দেশ্য নয়। উদ্দেশ্য হলো অন্তরের সৎকাজ ও এর পবিত্রতা। এখানে শারীরিক বেশি আমল উদ্দেশ্য নয়। কেননা কতিপয় রাত জাগরণকারী সালাত আদায়কারী কষ্ট আর রাত জাগা ব্যতীত কিছুই পায় না, কত সালাতে দণ্ডায়মান লোক সাওয়াব থেকে বঞ্চিত অথচ ঘুমন্ত ব্যক্তি আল্লাহর দয়াপ্রাপ্ত হয়। এ ঘুমন্ত ব্যক্তি যদিও ঘুমাচ্ছে কিন্তু তার অন্তর আল্লাহর যিকিরে জাগ্রত থাকে, আর সালাতে দণ্ডায়মান সে ব্যক্তি যদিও সালাত আদায় করছে কিন্তু তার অন্তর পাপী। বান্দা কল্যাণকর কাজের প্রচেষ্টা করতে, সৎকাজে কঠোর পরিশ্রম, অসৎ ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে আদিষ্ট। প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার কাজের ধরণ অনুযায়ী তার কাজ সহজ করা হয়। সৌভাগ্যবানদেরকে সৌভাগ্যবানদের আমল করতে সহজ করে দেওয়া হয় আর দুর্ভাগাকে দুর্ভাগাদের কাজ করতে সহজ করে দেওয়া হয়। সুতরাং এ মাসে আমলের মাধ্যমে গনীমত গ্রহণে দ্রুত এগিয়ে আসো। তোমার জীবনে যা হারিয়ে গেছে তা হয়ত ফিরে পাবে।

>
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ২০২৬, সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১১৭২।

[2] মুয়াত্তা মালিক, হাদীস নং ১১৪৫, মুহাক্কিক আইমান শা‘বান সালিহ বলেন, ইমাম মালিক আহলে ইলমের সিকাহদের থেকে এ হাদীস শুনেছেন। এ হাদীসের মুরসাল শাওয়াহেদ আছে। দেখুন, জামে‘উল উসূল, ৯/২৪১। আলবানী রহ. হাদীসটিকে দ‘ঈফ মু‘দাল বলেছেন।

[3] আস-সুনান আল-কুবরা, বাইহাকী, হাদীস নং ৮৫২২, তিনি হাদীসটিকে মুরসাল বলেছেন; তাখরীজ আহাদীস আল-কাশশাফ, ৪/২৫৩, মুহাক্কিক হাদীসটিকে মুরসাল বলেছেন।

[4] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৯০১।

[5] মুসনাদ আহমাদ, হাদীস নং ২২৭১৩, শু‘আইব আরনাঊত হাদীসটিকে হাসান বলেছেন; তবে দুটি ইবারত ব্যতীত। সে দুটি ইবারত হলো (أَوْ فِي آخِرِ لَيْلَةٍ) এবং (وَمَا تَأَخَّرَ)।

[6] নাসাঈ, হাদীস নং ২১০৬, আলবানী রহ. বলেছেন, হাদীসটি সহীহ। মুসনাদে আহমদ, ৭১৪৮, শু‘আইব আরনাঊত বলেছেন, হাদীসটি সহীহ।