৫. (ক) সর্বাবস্থায় ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ করার দলীল সমূহ-
(أدلة قراءة الفاتحة في الصلاة) :
ইমাম ও মুক্তাদী সকলের জন্য সকল প্রকার ছালাতে প্রতি রাক‘আতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা ফরয। প্রধান দলীল সমূহ :
(১) হযরত উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَّمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ، مُتَّفَقٌ عَلَيْهِ(‘লা ছালা-তা লিমান লাম ইয়াক্বরা’ বিফা-তিহাতিল কিতা-ব’) ‘ঐ ব্যক্তির ছালাত সিদ্ধ নয়, যে ব্যক্তি সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করে না’। [22]
(২) ছালাতে ভুলকারী (مسئ الصلاة) জনৈক ব্যক্তিকে প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ... ثُمَّ اقْرَأْ بِأُمِّ الْقُرْآنِ وَبِمَا شَآءَ اللهُ أَنْ تَقْرَأَ ‘অতঃপর তুমি ‘উম্মুল কুরআন’ অর্থাৎ সূরায়ে ফাতিহা পড়বে এবং যেটুকু আল্লাহ ইচ্ছা করেন কুরআন থেকে পাঠ করবে’...। [23]
(৩) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন,
أُمِرْنَا أَنْ نَقْرَأَ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ وَمَا تَيَسَّرَ
‘আমরা আদিষ্ট হয়েছিলাম যেন আমরা সূরায়ে ফাতিহা পড়ি এবং (কুরআন থেকে) যা সহজ মনে হয় (তা পড়ি)’।[24]
(৪) আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, أَمَرَنِيْ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ أُنَادِيَ أَنَّهُ لاَ صَلاَةَ إِلاَّ بِقِرَاءَةِ فَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَمَا زَادَ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে নির্দেশ দেন যেন আমি এই কথা ঘোষণা করে দেই যে, ছালাত সিদ্ধ নয় সূরায়ে ফাতিহা ব্যতীত। অতঃপর অতিরিক্ত কিছু’।[25] এখানে প্রথমে সূরায়ে ফাতিহা, অতঃপর কুরআন থেকে যা সহজ মনে হয়, সেখান থেকে অতিরিক্ত কিছু পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
(৫) আল্লাহ বলেন,
وَإِذَا قُرِئَ الْقُرْآنُ فَاسْتَمِعُوْا لَهُ وَأَنْصِتُوْا...
(‘ওয়া এযা কুরিয়াল কুরআ-নু ফাসতামি‘ঊ লাহূ ওয়া আনছিতূ’)। অর্থ : ‘যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর ও চুপ থাক’... (আ‘রাফ ৭/২০৪)।
আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে বলেন,
أَتَقْرَءُوْنَ فِيْ صَلاَتِكُمْ خَلْفَ الْإِمَامِ وَالْإِمَامُ يَقْرَأُ ؟ فَلاَ تَفْعَلُوْا وَلْيَقْرَأْ أَحَدُكُمْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فِيْ نَفْسِهِ، أَخْرَجَهُ ابْنُ حِبَّانَ-
‘তোমরা কি ইমামের ক্বিরাআত অবস্থায় পিছনে কিছু পাঠ করে থাক? এটা করবে না। বরং কেবলমাত্র সূরায়ে ফাতিহা চুপে চুপে পাঠ করবে’।[26]
(৬) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ صَلَّى صَلاَةً لَمْ يَقْرَأْ فِيْهَا بِأُمِّ الْقُرْآنِ فَهِيَ خِدَاجٌ، فَهِيَ خِدَاجٌ، فَهِيَ خِدَاجٌ، غَيْرُ تَمَامٍ ‘যে ব্যক্তি ছালাত আদায় করল, যার মধ্যে ‘কুরআনের সারবস্ত্ত’ অর্থাৎ সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করল না, তার ঐ ছালাত বিকলাঙ্গ, বিকলাঙ্গ, বিকলাঙ্গ, অপূর্ণাঙ্গ’...। রাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) -কে বলা হ’ল, আমরা যখন ইমামের পিছনে থাকি, তখন কিভাবে পড়ব? তিনি বললেন, إقْرَأْ بِهَا فِيْ نَفْسِكَ (ইক্বরা’ বিহা ফী নাফসিকা) ‘তুমি ওটা চুপে চুপে পড়’। তাছাড়া উক্ত হাদীছে সূরা ফাতিহাকে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে অর্ধেক করে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে وَلِعَبْدِيْ مَا سَأَلَ ‘আর আমার বান্দা যা চাইবে, তাই পাবে’।[27] ইমাম ও মুক্তাদী উভয়েই আল্লাহর বান্দা। অতএব উভয়ে সূরা ফাতিহা পাঠের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে ‘ছিরাতে মুস্তাক্বীম’-এর সর্বোত্তম হেদায়াত প্রার্থনা করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণ আমাদেরকে যেদিকে পথনির্দেশ দান করেছেন।
উল্লেখ্য যে, উক্ত হাদীছে সূরা ফাতিহাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়েছে। ১ম ভাগে আলহামদু... থেকে প্রথম তিনটি আয়াতে আল্লাহর প্রশংসা এবং ২য় ভাগে ইহ্দিনাছ... থেকে শেষের তিনটি আয়াতে বান্দার প্রার্থনা এবং ইইয়াকা না‘বুদু...-কে মধ্যবর্তী আয়াত হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। যা আল্লাহ ও বান্দার মাঝে বিভক্ত। এর মধ্যে বিসমিল্লাহ-কে শামিল করা হয়নি। ফলে অত্র হাদীছ অনুযায়ী বিসমিল্লাহ সূরা ফাতিহার অংশ নয়।
‘খিদাজ’ (خِدَاجٌ) অর্থ : সময় আসার পূর্বেই যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়, যদিও সে পূর্ণাংগ হয় (আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব)। খাত্ত্বাবী বলেন, ‘আরবরা ঐ বাচ্চাকে ‘খিদাজ’ বলে, যা রক্তপিন্ড আকারে অসময়ে গর্ভচ্যুত হয় ও যার আকৃতি চেনা যায় না’। আবু ওবায়েদ বলেন, ‘খিদাজ’ হ’ল গর্ভচ্যুত মৃত সন্তান, যা কাজে আসে না’। [28] অতএব সূরায়ে ফাতিহা বিহীন ছালাত প্রাণহীন অপূর্ণাংগ বাচ্চার ন্যায়, যা কোন কাজে লাগে না।
(৭) হযরত ওবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) বলেন, আমরা একদা ফজরের জামা‘আতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পিছনে ছালাত রত ছিলাম। এমন সময় মুক্তাদীদের কেউ সরবে কিছু পাঠ করলে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য ক্বিরাআত কঠিন হয়ে পড়ে। তখন সালাম ফিরানোর পরে তিনি বললেন, সম্ভবতঃ তোমরা তোমাদের ইমামের পিছনে কিছু পড়ে থাকবে? আমরা বললাম, হ্যাঁ। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, لاَ تَفْعَلُوْا إِلاَّ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَإِنَّهُ لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِهَا ‘এরূপ করো না কেবল সূরায়ে ফাতিহা ব্যতীত। কেননা ছালাত সিদ্ধ হয় না যে ব্যক্তি ওটা পাঠ করে না’।[29]
ঘটনা এই যে, প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সাথে অনেকে ইমামের পিছনে সরবে ক্বিরাআত করত। অনেকে প্রয়োজনীয় কথাও বলত। তাতে ইমামের ক্বিরাআতে বিঘ্ন ঘটতো। তাছাড়া মুশরিকরাও রাসূল (ছাঃ)-এর কুরআন পাঠের সময় ইচ্ছাকৃতভাবে শিস দিত ও হাততালি দিয়ে বিঘ্ন ঘটাতো। সেকারণ উপরোক্ত আয়াত (আ‘রাফ ৭/২০৪) নাযিলের মাধ্যমে সকলকে কুরআন পাঠের সময় চুপ থাকতে ও তা মনোযোগ দিয়ে শুনতে আদেশ করা হয়েছে।[30] এই নির্দেশ ছালাতের মধ্যে ও বাইরে সর্বাবস্থায় প্রযোজ্য। অতঃপর পূর্বোক্ত উবাদাহ, আবু হুরায়রা ও আনাস (রাঃ) প্রমুখ বর্ণিত হাদীছ সমূহের মাধ্যমে জেহরী ছালাতে ইমামের পিছনে কেবলমাত্র সূরায়ে ফাতিহা নীরবে পড়তে ‘খাছ’ ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, অন্য কোন সূরা নয়।
অতএব উক্ত ছহীহ হাদীছ সমূহ পূর্বোক্ত কুরআনী আয়াতের (আ‘রাফ ৭/২০৪) ব্যাখ্যা হিসাবে এসেছে, বিরোধী হিসাবে নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উক্ত ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে ‘অহি’ দ্বারা প্রত্যাদিষ্ট, তাঁর নিজের পক্ষ থেকে নয়। অতএব অহি-র বিধান অনুসরণে সর্বাবস্থায় ছালাতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য।
৫. (খ) বিরোধীদের দলীলসমূহ ও তার জওয়াব
(أدلة المخالفين للقراءة وجوابها) :
ইমামের পিছনে জেহরী বা সের্রী কোন প্রকার ছালাতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা যাবে না -এই মর্মে যাঁরা অভিমত পোষণ করেন, তাঁদের প্রধান দলীল সমূহ নিম্নরূপ :
(১) সূরা আ‘রাফ ২০৪ আয়াতে ক্বিরাআতের সময় চুপ থেকে মনোযোগ দিয়ে তা শুনতে বলা হয়েছে। সেখানে বিশেষ কোন সূরাকে ‘খাছ’ করা হয়নি। এক্ষণে হাদীছ দ্বারা সূরায়ে ফাতিহাকে খাছ করলে তা কুরআনী আয়াতকে ‘মনসূখ’ বা হুকুম রহিত করার শামিল হবে। অথচ ‘হাদীছ দ্বারা কুরআনী হুকুমকে মানসূখ করা যায় না’। [31]
জবাব : এখানে ‘মনসূখ’ হবার প্রশ্নই ওঠে না। বরং হাদীছে ব্যাখ্যাকারে বর্ণিত হয়েছে এবং কুরআনের মধ্য থেকে উম্মুল কুরআনকে ‘খাছ’ করা হয়েছে (হিজর ১৫/৮৭)। যেমন কুরআনে সকল উম্মতকে লক্ষ্য করে ‘মীরাছ’ বণ্টনের সাধারণ আদেশ দেওয়া হয়েছে (নিসা ৪/৭,১১)। কিন্তু হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সম্পত্তি তাঁর উত্তরাধিকারী সন্তানগণ পাবেন না বলে ‘খাছ’ ভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।[32]
মূলতঃ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আগমন ঘটেছিল কুরআনের ব্যাখ্যাকারী হিসাবে[33] এবং ঐ ব্যাখ্যাও ছিল সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট।[34] অতএব রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদত্ত ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করা ‘অহিয়ে গায়ের মাতলু’ বা আল্লাহর অনাবৃত্ত অহি-কে প্রত্যাখ্যান করার শামিল হবে।
(২) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, একদা এক জেহরী ছালাতে সালাম ফিরিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুছল্লীদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ কি এইমাত্র আমার সাথে কুরআন পাঠ করেছ? একজন বলল, জি-হাঁ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, তাই বলি, مَا لِيْ أُنَازِعُ القُرْآنَ ‘আমার ক্বিরাআতে কেন বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে’? রাবী বলেন,- فَانْتَهَى النَّاسُ عَنِ الْقِرَاءَةِ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِيْمَا جَهَرَ فِيْهِ ‘এরপর থেকে লোকেরা জেহরী ছালাতে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ক্বিরাআত করা থেকে বিরত হ’ল’।[35]
জবাব : হাদীছের বক্তব্যে বুঝা যায় যে, মুক্তাদীগণের মধ্যে কেউ রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে সাথে সরবে ক্বিরাআত করেছিলেন। যার জন্য ইমাম হিসাবে রাসূল (ছাঃ)-এর ক্বিরাআতে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছিল। ইতিপূর্বে আনাস ও আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ দু’টিতে নীরবে পড়ার কথা এসেছে, যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। শাহ অলিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) বলেন,فَإنْ قَرَأَ فَلْيَقْرَءِ الْفَاتِحَةَ قِرَاءَةً لاَ يُشَوِّشُ عَلَي الْإِمَامِ- ‘জেহরী ছালাতে মুক্তাদী এমনভাবে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করবে, যাতে ইমামের ক্বিরাআতে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়’।[36] অতএব নীরবে ইমামের পিছনে সূরায়ে ফাতিহা পড়লে ইমামের ক্বিরাআতে বিঘ্ন সৃষ্টির প্রশ্নই আসে না। উল্লেখ্য যে, হাদীছের শেষাংশে ‘অতঃপর লোকেরা ক্বিরাআত থেকে বিরত হ’ল’ কথাটি ‘মুদরাজ’ (مدرج), যা সনদভুক্ত অন্যতম বর্ণনাকারী ইবনু শিহাব যুহরী কর্তৃক সংযুক্ত। শিষ্য সুফিয়ান বিন ‘উয়ায়না বলেন, যুহরী (এ বিষয়ে) এমন কথা বলেছেন, যা আমি কখনো শুনিনি’। [37]
(৩) আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّمَا جُعِلَ الْإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوْا وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوْا- ‘ইমাম নিযুক্ত হন তাকে অনুসরণ করার জন্য। তিনি যখন তাকবীর বলেন, তখন তোমরা তাকবীর বল। তিনি যখন ক্বিরাআত করেন, তখন তোমরা চুপ থাক’। [38]
জবাব : উক্ত হাদীছে ‘আম’ ভাবে ক্বিরাআতের সময় চুপ থাকতে বলা হয়েছে। কুরআনেও অনুরূপ নির্দেশ এসেছে (আ‘রাফ ৭/২০৪)। একই রাবীর (আবু হুরায়রা) ইতিপূর্বেকার বর্ণনায় এবং আনাস (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে সূরায়ে ফাতিহাকে ‘খাছ’ ভাবে চুপে চুপে পড়তে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অতএব ইমামের পিছনে চুপে চুপে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করলে উভয় ছহীহ হাদীছের উপরে আমল করা সম্ভব হয়।
(৪) হযরত জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَقِرَاءَةُ الْإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةٌ ‘যার ইমাম রয়েছে, ইমামের ক্বিরাআত তার জন্য ক্বিরাআত হবে’।[39]
জবাব : (ক) ইবনু হাজার আসক্বালানী বলেন, যতগুলি সূত্র থেকে হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে সকল সূত্রই দোষযুক্ত। সেকারণ ‘হাদীছটি সকল বিদ্বানের নিকটে সর্বসম্মতভাবে যঈফ (إِنَّهُ ضَعِيْفٌ عِنْدَ جَمِيْعِ الْحُفَّاظِ)’।[40]
(খ) অত্র হাদীছে ‘ক্বিরাআত’ কথাটি ‘আম’। কিন্তু সূরায়ে ফাতিহা পাঠের নির্দেশটি ‘খাছ’। অতএব অন্য সব সূরা বাদ দিয়ে কেবল সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করতে হবে।
(৫) لاَ صَلاَةَ إِلاَّ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ (‘লা ছালা-তা ইল্লা বি ফা-তিহাতিল কিতাব’) বা ‘সূরায়ে ফাতিহা ব্যতীত ছালাত নয়’ [41] অর্থ ‘ছালাত পূর্ণাংগ নয়’ (لاَ صَلاَةَ بِالكَمَالِ) । যেমন অন্য হাদীছে রয়েছে, لاَ إِيْمَانَ لِمَنْ لاَ أَمَانَةَ لَهُ وَلاَ دِيْنَ لِمَنْ لاَ عَهْدَ لَهُ (‘লা ঈমা-না লিমান লা আমা-নাতা লাহূ, ওয়ালা দ্বীনা লিমান লা ‘আহ্দা লাহূ’) ‘ঐ ব্যক্তির ঈমান নেই, যার আমানত নেই এবং ঐ ব্যক্তির দ্বীন নেই যার ওয়াদা ঠিক নেই’[42] অর্থ ঐ ব্যক্তির ঈমান পূর্ণ নয়, বরং ত্রুটিপূর্ণ।
জবাব : (ক) কুতুবে সিত্তাহ সহ প্রায় সকল হাদীছ গ্রন্থে বর্ণিত উপরোক্ত মর্মের প্রসিদ্ধ হাদীছটি একই রাবী হযরত উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) হ’তে দারাকুৎনীতে ছহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে এভাবে, لاَ تُجْزِئُ صَلاَةٌ لاَ يَقْرَأُ الرَّجُلُ فِيْهَا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ- ‘ঐ ছালাত সিদ্ধ নয়, যার মধ্যে মুছল্লী সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করে না’।[43] অতএব উক্ত হাদীছে ‘ছালাত নয়’ অর্থ ‘ছালাত সিদ্ধ নয়’।
(খ) অনুরূপভাবে’ ‘খিদাজ’ বা ত্রুটিপূর্ণ- এর ব্যাখ্যায় ইবনু খুযায়মা স্বীয় ‘ছহীহ’ গ্রন্থে ‘ছালাত’ অধ্যায়ে ৯৫ নং দীর্ঘ অনুচ্ছেদ রচনা করেন এভাবে যে,
بَابُ ذِكْرِ الدَّلِيلِ عَلَى أَنَّ الْخِدَاجَ الَّذِي أَعْلَمَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي هَذَا الْخَبَرِ هُوَ النَّقْصُ الَّذِي لاَ تُجْزِئُ الصَّلاَةُ مَعَهُ، إِذِ النَّقْصُ فِي الصَّلاَةِ يَكُوْنُ نَقْصَيْنِ، أَحَدُهُمَا لاَ تُجْزِئُ الصَّلاَةُ مَعَ ذَلِكَ النَّقْصِ، وَالآخَرُ تَكُوْنُ الصَّلاَةُ جَائِزَةً مَعَ ذَلِكَ النَّقْصِ لاَ يَجِبُ إِعَادَتُهَا، وَلَيْسَ هَذَا النَّقْصُ مِمَّا يُوجِبُ سَجْدَتَيِ السَّهْوِ مَعَ جَوَازِ الصَّلاَةِ- (صحيح ابن خزيمة، كتاب الصلاة، باب ৯৫)-
‘ঐ ‘খিদাজ’-এর আলোচনা যে সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) অত্র হাদীছে হুঁশিয়ার করেছেন যে, ঐ ত্রুটি থাকলে ছালাত সিদ্ধ হবে না। কেননা ত্রুটি দু’প্রকারেরঃ এক- যা থাকলে ছালাত সিদ্ধ হয় না। দুই- যা থাকলেও ছালাত সিদ্ধ হয়। পুনরায় পড়তে হয় না। এই ত্রুটি হ’লে ‘সিজদায়ে সহো’ দিতে হয় না। অথচ ছালাত সিদ্ধ হয়ে যায়’।
অতঃপর তিনি আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) -এর হাদীছ উদ্ধৃত করেন যে, لاَ تُجْزِئُ صَلاَةٌ لاَ يُقْرَأُ ا فِيْهَا بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ ‘ঐ ছালাত সিদ্ধ নয়, যাতে সূরায়ে ফাতিহা পাঠ করা হয় না’.....। [44]
এক্ষণে ‘লা ছালা-তা বা ‘ছালাত নয়’-এর অর্থ যখন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘লা তুজযিউ’ অর্থাৎ ‘ছালাত সিদ্ধ নয়’ বলে ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন, তখন সেখানে আমাদের নিজস্ব ব্যাখ্যার কোন অবকাশ নেই। অতএব ‘খিদাজ’ অর্থ ‘অপূর্ণাঙ্গ’ করাটা অন্যায়। বরং এটি ‘ক্রটিপূর্ণ’। আর ত্রুটিপূর্ণ ছালাত প্রকৃত অর্থে কোন ছালাত নয়।
অতএব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ছহীহ হাদীছ, অধিকাংশ ছাহাবী ও তাবেঈন এবং ইমাম মালেক, শাফেঈ ও আহমাদ সহ অধিকাংশ মুজতাহিদ ইমামগণের সিদ্ধান্ত ও নিয়মিত আমলের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সর্বাবস্থায় সকল ছালাতে সূরায়ে ফাতেহা পাঠ করা অবশ্য কর্তব্য। নইলে অহেতুক যিদ কিংবা ব্যক্তি ও দলপূজার পরিণামে সারা জীবন ছালাত আদায় করেও ক্বিয়ামতের দিন স্রেফ আফসোস ব্যতীত কিছুই জুটবে না। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘যেদিন অনুসরণীয় ব্যক্তিগণ তাদের অনুসারীদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে ও সকলে আযাবকে প্রত্যক্ষ করবে এবং তাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক সমূহ ছিন্ন হবে’। ‘যেদিন অনুসারীগণ বলবে, যদি আমাদের আরেকবার ফিরে যাওয়ার সুযোগ হ’ত, তাহ’লে আমরা তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করতাম, যেমন আজ তারা আমাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। এমনিভাবে আল্লাহ সেদিন তাদের সকল আমলকে তাদের জন্য ‘আফসোস’ হিসাবে দেখাবেন। অথচ তারা কখনোই জাহান্নাম থেকে বের হবে না’ (বাক্বারাহ ২/১৬৬-৬৭)।
[23] . আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/৮০৪; আবুদাঊদ হা/৮৫৯ ‘ছালাত’ অধ্যায়-২, অনুচ্ছেদ-১৪৯।
[24] . আবুদাঊদ হা/৮১৮।
[25] . আবুদাঊদ হা/৮২০।
[26] . বুখারী, জুয্উল ক্বিরাআত; ত্বাবারাণী আওসাত্ব, বায়হাক্বী, ছহীহ ইবনু হিববান হা/১৮৪৪; হাদীছ ছহীহ- আরনাঊত্ব; তুহফাতুল আহওয়াযী, ‘ইমামের পিছনে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-২২৯, হা/৩১০-এর ভাষ্য (فالطريقان محفوظان) , ২/২২৮ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ২/৬৭ পৃঃ, ‘মুক্তাদীর ক্বিরাআত ও চুপ থাকা’ অনুচ্ছেদ।
[27] . মুসলিম, মিশকাত হা/৮২৩, ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; নায়ল ৩/৫১-৫২।
[28] . তিরমিযী (তুহফা সহ) হা/২৪৭-এর ভাষ্য ২/৬১ পৃঃ; আবুদাঊদ (আওন সহ) হা/৮০৬-এর ভাষ্য, ৩/৩৮ পৃঃ ।
[29] . তিরমিযী (তুহফা সহ) হা/৩১০; মিশকাত হা/৮৫৪, ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২; আহমাদ হা/২২৭৯৮, সনদ হাসান -আরনাঊত্ব; হাকেম ১/২৩৮, হা/৮৬৯। আলবানী অত্র হাদীছ দ্বারা জেহরী ছালাতে মুক্তাদীর জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করাকে ‘জায়েয’ বলেছেন, কিন্তু ‘ওয়াজিব’ বলেন নি (দ্র: মিশকাত হা/৮৫৪-এর টীকা) । পরবর্তীতে উক্ত হাদীছকে যঈফ বলেছেন (আবুদাঊদ হা/৮২৩)। এমনকি তিনি অন্যত্র জেহরী ছালাতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ ‘মনসূখ’ বলেছেন (ছিফাত ৭৯-৮১)। পক্ষান্তরে ইমাম বুখারী ‘জেহরী ও সের্রী সকল ছালাতে ইমাম ও মুক্তাদী উভয়ের জন্য সূরা ফাতিহা পাঠ করা ওয়াজিব’ বলে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন (বুখারী, ‘আযান’ অধ্যায়-১০, অনুচ্ছেদ-৯৫)।
[30] . কুরতুবী, উক্ত আয়াতের তাফসীর দ্রষ্টব্য, ৭/৩৫৪ পৃঃ।
[31] . নূরুল আনওয়ার ২১৩-১৪ পৃঃ; নায়লুল আওত্বার ৩/৬৭ পৃঃ।
[32] . যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ آتَيْنَاكَ سَبْعًا مِّنَ الْمَثَانِيْ وَالْقُرْآنَ الْعَظِيْمَ ‘আমরা আপনাকে দিয়েছি সাতটি আয়াত (সূরা ফাতিহা), যা পুন: পুন: পঠিত হয় এবং মহান কুরআন’ (হিজর ১৫/৮৭)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِيَاءِ لاَ نُورَثُ مَا تَرَكْنَاهُ صَدَقَةٌ ‘আমরা নবীগণ! কোন উত্তরাধিকারী রাখি না। যা কিছু আমরা রেখে যাই, সবই ছাদাক্বা’। =কানযুল উম্মাল হা/৩৫৬০০; নাসাঈ কুবরা হা/৬৩০৯; মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/৫৯৭৬ ‘ফাযায়েল ও শামায়েল’ অধ্যায়-২৯, অনুচ্ছেদ-১০।
[33] . নাহল ১৬/৪৪, ৬৪।
[34] . নাজম ৫৩/৩-৪ وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوحَى, ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৯ ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ ।
[35] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, তিরমিযী , মিশকাত হা/৮৫৫, ‘ছালাতে ক্বিরাআত’ অনুচ্ছেদ-১২।
[36] . হুজ্জাতুল্লা-হিল বা-লিগাহ (কায়রো : দারুত তুরাছ ১৩৫৫/১৯৩৬), ২/৯ পৃঃ।
[37] . আবুদাঊদ হা/৮২৭; আওনুল মা‘বূদ হা/৮১১-১২, অনুচ্ছেদ-১৩৫; নায়লুল আওত্বার ৩/৬৫।
[38] . আবুদাঊদ, নাসাঈ, ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৮৫৭।
[39] . ইবনু মাজাহ হা/৮৫০; দারাকুৎনী হা/১২২০; বায়হাক্বী ২/১৫৯-৬০ পৃঃ; হাদীছ যঈফ।
[40] . ফাৎহুল বারী ২/২৮৩ পৃঃ, হা/৭৫৬ -এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; নায়লুল আওত্বার ৩/৭০ পৃঃ। আলবানী হাদীছটিকে ‘হাসান’ বলেছেন। অতঃপর ব্যাখ্যায় বলেন যে, হাদীছটির কোন সূত্র দুর্বলতা (ضعف) হ’তে মুক্ত নয়। তবে দুর্বল সূত্র সমূহের সমষ্টি সাক্ষ্য দেয় যে, এর কিছু ভিত্তি আছে (أن للحديث أصلا) (ইরওয়া হা/৫০০, ২/২৭৭)। তাঁর উপরোক্ত মন্তব্যই ইঙ্গিত দেয় যে, হাদীছটি আসলেই যঈফ, যা অন্যান্য মুহাদ্দিছগণ সর্বসম্মত ভাবে বলেছেন।
[41] . ত্বাবারাণী, বায়হাক্বী, সৈয়ূত্বী, আল-জামে‘উল কাবীর হা/১১৯৪; আলবানী, তামামুল মিন্নাহ পৃঃ ৩২৯।
[42] . বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৩৫ ‘ঈমান’ অধ্যায়-১, সনদ জাইয়িদ।
[43] . দারাকুৎনী (বৈরূত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ ১৪১৭/১৯৯৬) হা/১২১২, ১/৩১৯ পৃঃ, সনদ ছহীহ।
[44] . ছহীহ ইবনু খুযায়মা হা/৪৯০, ১/২৪৭-৪৮ পৃঃ সনদ ছহীহ। أجزأ الشيئ فلانا اي كفاه অর্থাৎ ‘এটি তার জন্য যথেষ্ট হয়েছে’ ; আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব ১১৯-২০ পৃঃ।