قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا هذه أَسْمَاءُ رِجَالٍ صَالِحِينَ مِنْ قَوْمِ نُوحٍ فَلَمَّا هَلَكُوا أَوْحَى الشَّيْطَانُ إِلَى قَوْمِهِمْ أَنْ اَنْصِبُوا إِلَى مَجَالِسِهِمْ الَّتِي كَانُوا يَجْلِسُونَ أَنْصَابًا وَسَمُّوهَا بِأَسْمَائِهِمْ فَفَعَلُوا فَلَمْ تُعْبَدْ حَتَّى إِذَا هَلَكَ أُولَئِكَ وَتَنَسَّخَ الْعِلْمُ عُبِدَتْ
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এগুলি হচ্ছে নূহ (আঃ)-এর সম্প্রদায়ের কতিপয় নেককার ব্যক্তিদের নাম, তারা যখন মৃত্যুবরণ করল, তখন শয়তান তাদের সম্প্রদায়কে কুমন্ত্রণা দিয়ে বলল, যেসব জায়গায় তাদের মজলিস বসত সেসব জায়গায় তাদের মূর্তি স্থাপন কর এবং তাদের সম্মানার্থে তাদের নামেই মূর্তিগুলির নামকরণ কর। তখন তারা তাই করল। তবে তাদের জীবদ্দশায় ঐ সমস্ত মূর্তির পূজা করা হয়নি, কিন্তু মূর্তি স্থাপনকারীরা যখন মৃত্যুবরণ করল এবং মূর্তি স্থাপনের ইতিকথা ভুলে গেল তখনই এগুলির ইবাদত শুরু হল (বুখারী ২/৭৩২ পৃঃ, অত্র হাদীছে মূর্তিপূজার সূচনা প্রমাণিত হয়)।
নেককার, পীর, বুযুর্গ লোকদের ব্যাপারে সীমালঙ্ঘন করা মানুষের মুশরিক হওয়ার অন্যতম কারণ। একমাত্র আল্লাহর সাথে খাছ কোন হক্বের মধ্যে কোন নেককার ব্যক্তি বা পীর-বুযুর্গ কিংবা কোন নেতাকে হক্বদার বানানো। কেননা আল্লাহর হক্বের মধ্যে কোন অংশীদারই শরীক হতে পারে না। আর অন্যকে তাঁর সাথে হক্বদার মনে করায় সবচেয়ে বড় শির্ক। হক্ব বা অধিকার তিন প্রকার। এক. আল্লাহর হক্ব, তা হল চাওয়া-পাওয়া, ভয়-ভীতি ও আশা-আকাঙ্ক্ষার হক্বদার একমাত্র আল্লাহ। দুই. শ্রদ্ধা ও সম্মানের অধিকার একমাত্র আল্লাহর রাসূল। তিন. যৌথ অধিকার। আর তা হচ্ছে আল্লাহ ও রাসূলের যথাযথ আনুগত্য করা। যারা আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর হক্ব যথাযথ আনুগত্যের মাধ্যমে আদায় করতে পারে একমাত্র তারাই ওলী আউলিয়াদের যথাযথ সম্মান করতে পারে। নেককার লোকদেরকে মাত্রাতিরিক্ত ভালবাসায় হচ্ছে শির্কের উৎপত্তি। অবশ্য এ ভালবাসা এখন ভন্ড পীর ও নেতাদের দখলে চলে গেছে। ফলে শির্কের পরিধি আরও অনেক বেড়ে গেছে। যেমন ভালবাসার স্থান পেয়েছে শহীদ মিনার, কবরে পুষ্প প্রদান, নেতাদের মাযারে পুষ্প প্রদান, নেতাদের ছবি-মূর্তি, শ্রদ্ধাঞ্জলী, বিজয় দিবস ও তার পালন নীতি, জন্ম দিবস ও তার প্রস্তুতি, শিখা চিরন্তন ও শিখা অনির্বাণ ইত্যাদি। মৃত পীর-ওলীদের বাস্তব শ্রদ্ধা এসব শির্কের মূলকেন্দ্র।
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي مَرَضِهِ الَّذِي لَمْ يَقُمْ مِنْهُ لَعَنَ اللهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ
আয়েশাহ (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) তাঁর জীবনের শেষ অসুখে বলেছিলেন, ‘ইহুদী-খৃষ্টানদের উপর আল্লাহর অভিশাপ। তারা তাদের নবীদের ক্ববরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছিল’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৭১২ বঙ্গানুবাদ ২য় খন্ড হা/৬৫৯ ‘মসজিদসমূহ ও ছালাতের স্থান’ অনুচ্ছেদ)।
عَنْ جُنْدَب قَالَ سَمِعْتُ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ : أَلاَ وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ أَلاَ فَلاَ تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ إِنِّي أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ.
জুনদুব (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, ‘মনে রেখ নিশ্চয়ই তোমাদের পূর্ববর্তী লোকেরা তাদের নবী এবং নেককার লোকদের ক্ববরকে মসজিদ বানিয়েছিল। সাবধান! তোমরা ক্ববরকে মসজিদ বানাইওনা। আমি তোমাদেরকে ক্ববরকে মসজিদ বানাতে নিষেধ করছি’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৭১৩)।
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ رضى الله عنه قَالَ دَخَلَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم مَكَّةَ وَحَوْلَ الْبَيْتِ سِتُّونَ وَثَلاَثُمِائَةِ نُصُبٍ فَجَعَلَ يَطْعُنُهَا بِعُودٍ فِى يَدِهِ وَيَقُولُ (جَاءَ الْحَقُّ وَزَهَقَ الْبَاطِلُ إِنَّ الْبَاطِلَ كَانَ زَهُوقًا) (جَاءَ الْحَقُّ وَمَا يُبْدِئُ الْبَاطِلُ وَمَا يُعِيدُ).
আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, (মক্কা বিজয়ের দিন) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন কা‘বা ঘরের চারপাশে তিনশ’ ষাটটি মূর্তি ছিল। তখন তিনি তাঁর হাতের ছড়ি দিয়ে এগুলোকে ঠোকা দিতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, ‘সত্য এসেছে আর মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। মিথ্যা তো বিলুপ্ত হওয়ারই’ (সূরা ইসরাঈল ৮১)। ‘সত্য এসেছে আর অসত্য না পারে নতুন কিছু সৃষ্টি করতে এবং না পারে পুনরাবৃত্তি করতে’ (বুখারী হা/৪৭২০)।
عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ اللهُمَّ لاَ تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَنًا يُعْبَدُ اشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ.
আতা ইবনু ইয়াসার (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) প্রার্থনা করে বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার ক্ববরকে মূর্তিতে পরিণত করো না যার ইবাদত করা হবে। আল্লাহ ঐ জাতির উপর রাগান্বিত হয়েছেন যারা তাদের নবীগণের ক্ববরকে মসজিদে পরিণত করেছে (আবূদাঊদ, মিশকাত হা/৭৫০ সনদ ছহীহ, বঙ্গানুবাদ ২য় খন্ড হা/৬৯৪)।
ক্ববরের পার্শ্বে ইবাদত করার ব্যাপারে যেখানে এত কঠোরতা সেখানে কোন ব্যক্তির ইবাদত করা কিভাবে জায়েয হতে পারে? ক্ববরের পার্শ্বে যে সব কার্যকলাপ হয় তা দু’ধরনের- একটি বৈধ অপরটি নিষিদ্ধ। ক্ববরের ব্যাপারে বৈধ কাজ হচ্ছে- শরী‘আত সম্মত উপায়ে ক্ববর যিয়ারত করা। অপরটি হচ্ছে- ক্ববর স্পর্শ করা এবং ক্ববরবাসীকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের ওয়াসীলা হিসাবে গণ্য করা। ক্ববরের পার্শ্বে ছালাত আদায় করা, বাতি জ্বালানো, আগরবাতি লাগানো এবং ক্ববরের উপরে সৌধ নির্মাণ করা। ক্ববরবাসীর কাছে দো‘আ করা। সাহায্য চাওয়া, দুনিয়া ও আখেরাতের প্রয়োজন মিটানোর জন্য আবেদন করা। কোন ব্যক্তি যদি এ আক্বীদা পোষণ করে যে, উদ্দেশ্য হাছিলের ক্ষেত্রে ক্ববরবাসীরা স্বতন্ত্র ক্ষমতার অধিকারী, তাহলে সে মুসলমান থাকবে না। ক্ববর পূজা করা, ক্ববরের পার্শ্বে অনুষ্ঠান করা ও ক্ববরের পার্শ্বে মসজিদ নির্মাণ করা ইহুদী-খৃষ্টানদের কাজ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَلَكِنَّ الشَّيَاطِينَ كَفَرُوا يُعَلِّمُونَ النَّاسَ السِّحْرَ ‘কিন্তু শয়তানেরাই কুফুরী করেছিল, তারা মানুষকে যাদু শিক্ষা দিত’ (আল-বাক্বারাহ ১০২)।
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক জিনিস থেকে বেঁচে থাক; তার একটি হচ্ছে যাদু’ (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫২; বঙ্গানুবাদ ১ম খন্ড হা/৪৭ ‘ঈমান’ অধ্যায়)।
عَنْ بَجَالَةَ بْنَ عَبْدَةَ أَنَّهُ قَالَ أَتَانَا كِتَابُ عُمَرَ قَبْلَ مَوْتِهِ بِسَنَةٍ أَنْ اقْتُلُوا كُلَّ سَاحِرٍ وَسَاحِرَةٍ.
বাজালাহ ইবনু আবাদাহ থেকে বর্ণিত, ওমর (রাঃ) মুসলিম গভর্নরদের কাছে পাঠানো নির্দেশনামায় বলেছিলেন, ‘‘তোমরা প্রত্যেক যাদুকর পুরুষ এবং যাদুকর নারীকে হত্যা কর’’ (বুখারী, বায়হাক্বী, আল-কাবায়ির ২৬ পৃঃ)।
عَنْ أَبِي مُوْسَى الْاَشْعَرِي أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ ثَلاَثَةٌ لاَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ مُدْمِنُ خَمْرٍ وَقَاطِعُ رَحِمٍ وَمُصَدِّقٌ بِالسِّحْرِ.
আবূ মূসা আশ‘আরী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘তিন শ্রেণীর লোক জান্নাতে যাবে না। (১) সর্বদা মদপানকারী, (২) আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারী, (৩) যাদুর প্রতি বিশ্বাসকারী। (আহমাদ, মিশকাত হা/৩৬৫ বঙ্গানুবাদ ৭ম খন্ড হা/৩৪৮৯ ‘মদের বিবরণ ও মদ্যপায়ীর প্রতি ভীতিপ্রদগণ’ অনুচ্ছেদ)।
যাদুকে শির্কের মধ্যে শামিল করার কারণ হচ্ছে- যাদু শির্ক ব্যতীত কার্যকর করা সম্ভব নয়। আবার শয়তানী আত্মার ওয়াসীলা ব্যতীত যাদুকরের স্বার্থ অর্জিত হয় না। তাই যাদুবিদ্যা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা ব্যতীত মানুষের একত্ববাদ পরিপূর্ণ হতে পারে না। যাদু দু’টি কারণে শির্কের অন্তর্ভুক্ত। (১) যাদু বিদ্যায় শয়তানকে ব্যবহার করা হয় এবং তার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। (২) যাদু বিদ্যায় ইলমে গায়েবের দাবী করা হয়। যাদুকরের জ্ঞান ও যাদুবিদ্যা অর্জনের ক্ষেত্রে আল্লাহর অংশীদারিত্বের দাবী করা হয়, এটা নিঃসন্দেহে শির্ক। তাছাড়া যাদুকে কার্যকর করতে গেলে অনেক হারাম, নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য কার্যকলাপের আশ্রয় নিতে হয় যার শাস্তি মৃত্যুদন্ড বলে সাব্যস্ত করা হয়েছে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন, أَلاَ إِنَّمَا طَائِرُهُمْ عِنْدَ اللهِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ- ‘মনে রেখ, আল্লাহর কাছেই রয়েছে তাদের কুলক্ষণসমূহের চাবিকাঠি। কিন্তু তাদের অধিকাংশ লোকই তা বুঝে না’ (আ‘রাফ ১৩১)।
আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন, قَالُوا إِنَّا تَطَيَّرْنَا بِكُمْ لَئِنْ لَمْ تَنتَهُوا لَنَرْجُمَنَّكُمْ وَلَيَمَسَّنَّكُمْ مِنَّا عَذَابٌ أَلِيمٌ، قَالُوا طَائِرُكُمْ مَعَكُمْ- ‘জনগণ রাসূলগণকে বলল, আমরা তোমাদেরকে অশুভ কুলক্ষুণে মনে করছি। যদি তোমরা বিরত না হও, তবে অবশ্যই তোমাদের পাথর দ্বারা হত্যা করব এবং আমাদের পক্ষ থেকে তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে। তখন রাসূলগণ বললেন, তোমাদের অশুভ কুলক্ষণ তোমাদের সাথে রয়েছে’ (ইয়াসীন ১৮-১৯)।