মুসলিম নামধারী ব্যক্তিকে কাফির বলার সাথে সংশ্লিষ্ট আরেকটি বিষয়: বন্ধুত্ব ও শত্রুতা। কাফিরের কুফরের প্রতি ঘৃণা এবং মুমিনের ঈমানের প্রতি প্রেম ঈমানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্য ইসলামী আকীদার অন্যতম আলোচ্য বিষয় ‘আল-ওয়ালায়াতু ওয়াল বারাআত’ (الولاية والبراءة)। (الـوِلايَـة) বিলায়াত বা ওয়ালায়াত অর্থ নৈকট্য, বন্ধুত্ব বা অভিভাবকত্ব। বারাআত (البراءة) অর্থ বিমুক্তি, সম্পর্কচ্ছিন্নতা, নির্দোষিতা বা অস্বীকৃতি।
কুরআন-হাদীসে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে মুমিনকে ভালবাসতে, তাঁর সাথে বিলায়াত (বন্ধুত্ব) প্রতিষ্ঠা করতে, কাফিরকে অপছন্দ করতে ও তার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে। মহান আল্লাহ বলেন:
وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللَّهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللَّهُ إِنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ
‘‘এবং মুমিন পুরুষগণ ও মুমিন নারীগণ একে অপরের বন্ধু-নিকটবর্তী বা ওলী। তারা ভাল কাজের আদেশ দেয়, অন্যায় কাজ থেকে নিষেধ করে, সালাত কায়েম করে, যাকাত প্রদান করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এদেরকে আল্লাহ শীঘ্রই দয়া করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়।[1]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
إِنَّمَا وَلِيُّكُمُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ وَالَّذِينَ آَمَنُوا الَّذِينَ يُقِيمُونَ الصَّلاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَهُمْ رَاكِعُونَ
‘‘তোমাদের বন্ধু তো আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং যারা ঈমান গ্রহণ করেছে, যারা সালাত কায়েম করে এবং যাকাত প্রদান করে এবং তারা রুকু-রত।’’[2]
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন:
لا يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللَّهِ فِي شَيْءٍ إِلا أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً
‘‘মুমিনগণ যেন মুমিনগণ ব্যতীত কাফিরদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যে কেউ এরূপ করবে তার সাথে আল্লাহর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। তবে ব্যতিক্রম, যদি তোমরা তাদের নিকট হতে আত্মরক্ষার জন্য সতর্কতা অবলম্বন কর।’’[3]
এভাবে কুরআনে বারবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, মুমিনগণ পরস্পর ভাই, বন্ধু, অন্তরঙ্গ সঙ্গী বা হৃদয়ের প্রিয়জন। পক্ষান্তরে কাফির কখনো মুমিনের অন্তরঙ্গ বন্ধু বা হৃদয়ের প্রিয়জন হতে পারে না। অমুসলিমের সাথে মুসলিমের সামাজিক বা লৌকিক সুসম্পর্ক ও মানবিক সহযোগিতা থাকবে, তবে হৃদয়ের প্রেম থাকবে না।
এ বিষয়ে হাদীস শরীফেও বারংবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আনাস ইবন মালিক (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
ثَلاَثٌ مَنْ كُنَّ فِيهِ وَجَدَ بِهِنَّ حَلاَوَةَ الإِيمَانِ وَطَعْمَهُ أَنْ يَكُونَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ وَرَسُولُهُ أَحَبَّ إِلَيْهِ مِمَّا سِوَاهُمَا وَأَنْ يُحِبَّ فِى اللَّهِ وَأَنْ يُبْغِضَ فِى اللَّهِ وَأَنْ تُوقَدَ نَارٌ عَظِيمَةٌ فَيَقَعُ فِيهَا أَحَبَّ إِلَيْهِ مِنْ أَنْ يُشْرِكَ بِاللَّهِ شَيْئًا
‘‘তিনটি বিষয় যার মধ্যে থাকবে সে এগুলো দ্বারা ঈমানের মিষ্টত্ব ও স্বাদ লাভ করবে: (১) মহান আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) অন্য সকলের চেয়ে তার নিকট প্রিয়তর হবে, (২) সে আল্লাহর জন্যই ভালবাসবে এবং আল্লাহর জন্যই ঘৃণা বা অপছন্দ করবে এবং (৩) বিশাল অগ্নিকুন্ড প্রজ্জ্বলিত করা হলে সে অগ্নিকুন্ডে ঝাঁপিয়ে পড়াকে সে আল্লাহর সাথে শিরক করা অপেক্ষা অধিক পছন্দ করবে।’’[4]
অন্য হাদীসে আবূ উমামা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন:
مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدْ اسْتَكْمَلَ الإِيمَانَ
‘‘যে আল্লাহর জন্য ভালবাসে, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করে, আল্লাহর জন্য প্রদান করে এবং আল্লাহর জন্য প্রদান থেকে বিরত থাকে সে ঈমান পরিপূর্ণ করেছে।’’[5]
এ সকল আয়াত ও হাদীসের নির্দেশনা খুবই সুস্পষ্ট। মুমিন ঈমান ও ঈামনদারদেরকে ভালবাসবেন এবং কুফর ও কুফরে লিপ্ত মানুষদেরক ঘৃণা করবেন বা অপছন্দ করবেন। ঈমান ও ঈমানদারকে ভালবাসা এবং কুফর ও কাফিরকে ঘৃণা করা মূলত ‘‘ঈমান’’-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্য এ বিষয় ‘‘ঈমান’’ ও ‘‘আকীদা’’ প্রসঙ্গে আলোচনা করা হয়। তবে ‘‘তাকফীর’’-এর একটি প্রচ্ছন্ন ও ভয়াবহ রূপ কাফিরদের বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াত বা হাদীসকে মুমিনদের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা। এ ছিল খারিজী বিভ্রান্তির উৎস। তাদের বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবন উমার (রা) বলেন:
إِنَّهُمْ انْطَلَقُوا إِلَى آيَاتٍ نَزَلَتْ فِي الْكُفَّارِ فَجَعَلُوهَا عَلَى الْمُؤْمِنِينَ
‘‘কাফিরদের বিষয়ে অবতীর্ণ আয়াতগুলোর কাছে যেয়ে সেগুলোকে তারা মুমিনদের উপর প্রয়োগ করে।’’[6]
বন্ধুত্ব ও শত্রুতা বিষয়ক নির্দেশনাগুলোকে অনেক মুসলিম অন্য মুসলিমের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেন। তারা পাপের কারণে, কর্মগত বা আকীদাগত মতভেদের কারণে ‘‘মুমিনগণকে’’ ঘৃণা করেন, বিদ্বেষ করেন বা শত্রুতা করেন এবং এরূপ ঘৃণা-বিদ্বেষকে ‘‘দীন’’ ও ইবাদত বলে গণ্য করেন।
অনেক সময় মানবীয় দুর্বলতায় আমরা ভালবাসা বা ঘৃণায় আবেগ-তাড়িত হয়ে পড়ি। ফলে এক্ষেত্রে ঈমানের নির্দেশনা অনুসারে সমন্বয় করতে পারি না। পাপ ও অন্যায়ের প্রতি ঘৃণাও ঈমানের দাবি। তবে মুমিনের মধ্যে পাপের পাশাপাশি ‘‘ঈমান’’ ও অন্যান্য ‘‘পুণ্য’’ বিদ্যমান। এগুলির জন্য মুমিনকে ভালবাসা ঈমানের দাবি। যেহেতু ঈমান মুমিনের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্ম সেহেতু পাপে লিপ্ত মুমিনকে ঈমানের কারণে এ পরিমাণ ভালবাসতে হবে এবং অন্যান্য নেক আমলের মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি তার পাপের প্রতি আপত্তি ও দূরত্বও থাকতে হবে। পাপের জন্য ঘৃণার কারণে ঈমানের অবমূল্যায়ন করা ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক।
মুমিনের ঈমানের দাবি যে, তিনি ‘‘ঈমান’’-কে সর্বোচ্চ ভালবাসবেন ও মূল্যায়ন করবেন। এ ভালবাসা ও মূল্যায়নের দাবি এই যে, যে হৃদয়ে ঈমানের ন্যূনতম আভা বা ছোঁয়া বিদ্যমান সে হৃদয় ও হৃদয়ের অধিকারীর প্রতি তার অন্তরের প্রেম, গভীর ভালবাসা ও সর্বোচ্চ মূল্যায়ন থাকবে। এ ভালবাসার অর্থ মুমিনের অন্যায়কে সমর্থন করা নয়। ‘‘ঈমানদার’’ বা মুসলিম নামধারী ব্যক্তি যদি অন্যায়ে লিপ্ত হয় তবে তাকে অন্যায় থেকে নিষেধ করা ও ভাল কাজে আদেশ করা তার বন্ধুত্ব ও প্রেমেরই দাবি। তবে মুমিনের অন্যায়ের কারণে তার ‘‘ঈমান’’ মূল্যহীন হয়ে যায় না। কুরআনের নির্দেশনা এটিই।
পক্ষান্তরে ঈমানের ন্যূনতম দাবি যে, কুফরকে মুমিন সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করবে। যে হৃদয়ে ‘‘কুফর’’ বিদ্যমান সে হৃদয় ও হৃদয়ের অধিকারী ব্যক্তিকে মুমিন কখনোই হৃদয়ের গভীরে ভালবাসতে পারে না। তাকে হৃদয়ের গভীরে ভালবাসার অর্থ তার ‘‘কুফর’’-কে স্বীকৃতি দেওয়া বা ‘‘কুফর’’-কে গুরুত্বহীন বলে গণ্য করা এবং কুফর-এর প্রতি হৃদয়ের আপত্তি অপসারিত হওয়া।
পাপ বা মতভেদের কারণে মুমিনকে ঢালাওভাবে ঘৃণা করা বা তার প্রতি শত্রুতা পোষণ করা আর কোনো ভালকাজের কারণে কাফিরকে ভালবাসা ও তাকে হৃদয় দিয়ে প্রেম করা একই প্রকারের অপরাধ। উভয় ক্ষেত্রেই ‘‘ঈমান’’-এর অবমূল্যায়ন করা হয়। এরূপ ঘৃণা ও বিদ্বেষকে যতই আমরা ‘‘আল্লাহর জন্য ঘৃণা’’ বলে দাবি করি, মূলত তা আল্লাহর জন্য নয়, বরং নিজেদের মনমর্জি, দল, মত, নেতা, ইমাম, আমীর, পীর বা অন্য কিছুর জন্য। কারণ ভালবাসা ও শত্রুতা যদি আল্লাহর জন্য হয় তাহলে তা ঈমান, নেকআমল ও পাপের পরিমাণে সমন্বিত হবে।
মুমিনের অন্যতম পরিচয় ‘‘ঈমান’’-কে ভালবাসা ও ঈমানের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা। এজন্য সুনিশ্চিত পাপ বা মতভেদীয় ‘‘পাপ’’-এর কারণে মুমিনের প্রতি আপত্তি বা ঘৃণা থাকলেও সাথে সাথে তার মধ্যে বিদ্যমান ঈমান ও অন্যান্য নেক আমলের পরিমাণ ভালবাসা থাকতে হবে। এভাবে ‘‘বিলায়াত’’ ও ‘‘বারাআত’’ অর্থাৎ বন্ধুত্ব ও শত্রুতা বা সম্পর্ক ও সম্পর্কহীনতা একত্রিত হবে। এ বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) তাঁর ‘‘আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম’’ গ্রন্থে কিছু দিক নির্দেশনা দিয়েছেন:
قَالَ الْمُتَعَلِّمُ رَحِمَهُ اللهُ: ... أَخْبِرْنِيْ عَنْ تَفْسِيْرِ الْوَلاَيَةِ وَالْبَرَاءَةِ هَلْ تَجْتَمِعَانِ فِيْ إِنْسَانٍ وَاحِدٍ؟ قَالَ الْعَالِمُ رَحِمَهُ اللهُ: الْوَلاَيَةُ هِيَ الرِّضَا بِالْعَمَلِ الْحَسَنِ، وَالْبَرَاءَةُ هِيَ الْكَرَاهَةُ عَلَى الْعَمَلِ السَّيِّئْ، وَرُبَّمَا اجْتَمَعَا فِيْ إِنْسَانٍ وَاحِدٍ، وَرُبَّمَا لَمْ يَجْتَمِعَا فِيْهِ. فَهُوَ الْمُؤْمِنُ الَّذِيْ يَعْمَلُ صَالِحاً وَسَيِّئاً، وَأَنْتَ تُجَامِعُهُ وَتُوَافِقُهُ عَلَى الْعَمَلِ الصَّالِحِ وَتُحِبُّهُ عَلَيْهِ، وَتُخَالِفُهُ وَتُفَارِقُهُ عَلَى مَا يَعْمَلُ مِنَ السَّيِّءِ وَتَكْرَهُ لَهُ ذَلِكَ. فَهَذَا مَا سَأَلْتَ عَنِ الْوَلاَيَةِ وَالْبَرَاءَةِ تَجْتَمِعَانِ فِيْ إِنْسَانٍ وَاحِدٍ. وَالَّذِيْ فِيْهِ الْكُفْرُ لَيْسَ فِيْ شَيْءٍ مِنَ الصَّالِحَاتِ وَإِنَّكَ تُبْغِضُهُ وَتُفَارِقُهُ فِيْ جَمِيْعِ ذَلِكَ. وَالَّذِيْ تُحِبُّهُ وَلاَ تَكْرَهُ مِنْهُ شَيْئاً فَهُوَ الْمُؤْمِنُ الَّذِيْ قَدْ عَمِلَ بِجَمِيْعِ الصَّالِحَاتِ وَاجْتَنَبَ الْقَبِيْحَ، فَأَنْتَ تُحِبُّ كُلَّ شَيْءٍ مِنْهُ، وَلاَ تَكْرَهُ مِنْهُ شَيْئاً.
‘‘আবূ মুকাতিল বলেন: ওয়ালায়াত ও বারাআত: বন্ধুত্ব ও সম্পর্কছিন্নতার ব্যাখ্যা আমাকে বলুন। একই ব্যক্তির ক্ষেত্রে কি উভয় বিষয় একত্রিত হতে পারে? ইমাম আবূ হানীফা বলেন: ‘ওয়ালায়াত’ অর্থ ভাল কাজের প্রতি সন্তুষ্টি এবং ‘বারাআত’ অর্থ খারাপ কাজের প্রতি অসন্তুষ্টি বা অপছন্দ। অনেক সময় একই মানুষের ক্ষেত্রে দুটি বিষয় একত্রিত হয় এবং অনেক সময় একত্রিত হয় না। যে মুমিন ব্যক্তি পুণ্য ও পাপ উভয় কর্মই করছে তার পুণ্য কর্মের বিষয়ে তুমি তার সাথে একত্রিত হবে, ঐকমত্য পোষণ করবে এবং এজন্য তুমি তাকে ভালবাসবে। আর সে যে অন্যায় কর্ম করছে সে জন্য তুমি তার বিরোধিতা করবে, তার থেকে বিচ্ছিন্ন হবে এবং তা অপছন্দ করবে। এরূপ ব্যক্তির ক্ষেত্রে বন্ধুত্ব ও শত্রুতা বা সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি একত্রিত হবে, যে বিষয়ে তুমি প্রশ্ন করেছ। আর যার মধ্যে কুফর বিদ্যমান সে কোনো নেককর্মের মধ্যে নেই; তুমি তাকে ঘৃণা কর এবং সব বিষয়ে তার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে। আর যাকে তুমি ভালবাসবে এবং তার কিছুই অপছন্দ করবে না সে ঐ মুমিন যে সকল নেক কর্ম করে এবং পাপ-অন্যায় বর্জন করে। এরূপ মুমিনের সবই তুমি ভালবাসবে এবং তার কিছুই অপছন্দ করবে না।[7]
এ হলো ভালবাসা ও সম্পর্কছিন্নতার বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি। এজন্যই আলী (রা), সাহাবী, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী ইমামগণ খারিজীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু কখনোই তাদেরকে কাফিরের মত ঘৃণা করেন নি। যদিও খারিজীগণ তাঁদেরকে কাফির বলে ঘৃণা করেছে, কিন্তু তাঁরা তা করেন নি। বরং তাদের সাথে আত্মীয়তা করেছেন, তাদের মধ্যে যারা সৎ ও সত্যপরায়ণ ছিলেন তাদের বর্ণিত হাদীস গ্রহণ করেছেন এবং হাদীস, ফিকহ, তাফসীর ইত্যাদির বর্ণনায় তাদের উপর নির্ভর করেছেন।
বর্তমান মুসলিম বিশ্বে আমরা অনেকেই নিজেদেরকে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত বা সুন্নাত ও ঐক্যের অনুসারী বলে দাবি করলেও বিদ‘আত ও বিভক্তির প্রতিই আমাদের আকর্ষণ বেশি। ঈমান, সালাত, যাকাত, সিয়াম, ইলম, কুরআন, তাকওয়া, আমল ইত্যাদির ভিত্তিতে আমরা মুসলিমদেরকে ভালবাসি না। বরং দলীয় মতামত ও পরিচয়ের ভিত্তিতে তাদেরকে ভালবাসি। ধর্মীয় ক্ষুদ্রক্ষুদ্র গোষ্ঠীতে আমরা বিভক্ত। আমার দল, গোষ্ঠীর নেতা বা গুরুর ‘‘অনুসারী’’ ব্যক্তি যদি ঈমান, আমল ও তাকওয়ায় অনেক পিছনেও থাকে তাহলেও সে আমার অতি প্রিয়জন। আর ভিন্ন দল, মত, নেতা বা গুরুর অনুসারী যদি ঈমান ও তাকওয়ার বিচারে অনেক ভালও হন তবুও তিনি আমার শত্রু বা অপছন্দিত।
আবার এরূপ বিভক্তিকে দীনের রূপ দেওয়ার জন্য আমরা অনেক তথাকথিত ‘‘আকীদা’’ বা ‘‘ইবাদত-পদ্ধতি’’ উদ্ভাবন করেছি, যে সকল আকীদা বা পদ্ধতির কথা কুরআন-হাদীসে সরাসরি নেই, ইমাম আযমসহ চার ইমাম বা তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ীগণ লিখেন নি অথবা তা মুস্তাহাব পর্যায়ের কোনো কর্ম মাত্র। এ সকল বিষয়ের অজুহাতে আমরা মুত্তাকী ব্যক্তিকে ঘৃণা করি এবং ফাসিক ব্যক্তিকে ভালবাসি। সর্বাবস্থায় মুমিনের ঈমান, ফরয-ওয়াজিব দায়িত্ব পালন, হারাম-মাকরূহ বর্জন, ইলম, কুরআন ইত্যাদির চেয়ে ‘‘আমার মতের সাথে শতভাগ মিল থাকা’’ বা ‘‘আমার পদ্ধতিতে ইবাদত পালন করা’’-কেই আমার ভালবাসার মূলনীতি বানিয়েছি। এভাবে আমরা মূলত ‘‘আমার পছন্দের ভিত্তিতে ভালবাসছি’’ কিন্তু একে আবার ‘‘আল্লাহর জন্য ভালবাসা’’ বলে আখ্যায়িত করছি।
মুসলিম উম্মাহর সকল বিভক্তি, ফিতনা ও অবক্ষয়ের অন্যতম উৎস ‘তাকফীর’। ইমাম আযমের সময়ে যেমন বিষয়টি অন্যতম ফিতনা ছিল, বর্তমানেও তা একইরূপ ফিতনা। রাজনৈতিক মতবাদ, মতভেদ, ধর্মীয় মতপার্থক্য ইত্যাদি কারণে কখনো বা মুসলিমদেরকে সরাসরি ‘‘কাফির’’ বলে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ‘‘ইসলামের শত্রু’’, ‘‘কুরআনের শত্রু’, ‘‘নবীর (ﷺ) শত্রু’’, ‘‘সুন্নাতের শত্রু’’, ‘‘ওলী-আউলিয়ার শত্রু’’, ‘‘কাফিরের চেয়েও খারাপ’’, ‘‘কাফিরদের দালাল’’ ইত্যাদি বলে প্রচ্ছন্ন ও কৌশলী তাকফীর করা হচ্ছে। এভাবে আমরা মুমিনকে কাফির বলার পাপে, বিদ্বেষের পাপে, দলাদলি ও বিভক্তির পাপে লিপ্ত হচ্ছি। সর্বোপরি জেনে বা না জেনে ইহূদী, খৃস্টান ও কাফিরগণ, যারা ইসলামের প্রকৃত শত্রু ও প্রকৃত কাফির তাদের স্বার্থরক্ষা ও ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের ষড়যন্ত্র কার্যকর করার পরিবেশ তৈরি করছি। আমাদের উচিত, প্রত্যেকে নিজের মতে-পথে সুদৃঢ় থাকার পাশাপাশি প্রতিপক্ষ বা ভিন্নমতাবলম্বী মুসলিমকে কাফির বলা থেকে বিরত থাকি, মত বা কর্মের সমালোচনা করলেও ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর প্রতি তাকফীর বা বিদ্বেষ প্রচার থেকে বিরত থাকি এবং সকল মুসলিমের হেদায়াত ও নাজাতের জন্য দুআ করি। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন।
[2] সূরা (৫) মায়িদা: ৫৫ আয়াত।
[3] সূরা (৩) আল-ইমরান: ২৮ আয়াত।
[4] মুসলিম, আস-সহীহ ১/৪৮ (কিতাবুল ঈমান, বাবু খিসালিন মানিত্তাসাফা বিহিন্না ওয়াজাদা); নাসাঈ, আস-সুনান ৮/৯৪ (কিতাবুল ঈমান ও শারাইউহু, বাবু তা’মুল ঈমান)।
[5] আবূ দাউদ, আস-সুনান (শামিলা) ৪/৩৫৪ (কিতাবুস সুন্নাতি, বাবুদ দালীল আলা যিয়াদাতিল ঈমান..)। হাদীসটি সহীহ।
[6] বুখারী, আস-সহীহ ৬/২৫৩৯ (কিতাবু ইসতিতাবাতিল মুরতাদ্দীন, বাবু কাতলিল খাওয়ারিজ)
[7] ইমাম আবূ হানীফা, আল-আলিম ওয়াল মুতাআল্লিম, পৃ. ৩৮-৩৯।