আল-ফিকহুল আকবর ইমাম আবূ হানীফা ও আল-ফিকহুল আকবার ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
১৪. ফিকহ বিষয়ক অভিযোগ পর্যালোচনা

ফিকহী অভিযোগগুলোর ক্ষেত্রে নিম্নের কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়:

(১) ইমাম আবূ হানীফা তাঁর সকল মতই কোনো না কোনো তাবিয়ী বা সাহাবী থেকে গ্রহণ করেছেন। ইমাম আহমদ ইবন হাম্বাল বলেন:


إنما كان أبو حنيفة تابعة ما اخترع قولا ولا أنشر خلافه لان أهل الكوفة إبراهيم التيمى والشعبي والحكم وغيرهم


‘‘আবূ হানীফা তো একান্তই অনুসারী ছিলেন, তিনি কোনো মত উদ্ভাবন করেন নি এবং কোনো মতভেদও সৃষ্টি করেন নি। কারণ ইবরাহীম নাখয়ী, শা’বী, হাকাম ও কূফার অন্যান্য আলিমের তিনি অনুসারী ছিলেন।’’[1]

যে মত ইবরাহীম নাখয়ী, আলকামা, হাম্মাদ ইবন আবী সুলাইমান প্রমুখ তাবিয়ী আবূ হানীফার পূর্বেই গ্রহণ করেছেন, অথবা রাবীয়াহ, সুফইয়ান সাওরী, ইবনুল মুবারাক প্রমুখ ফকীহ গ্রহণ করেছেন সে মতের জন্য আবূ হানীফা নিন্দিত হলেন, কিন্তু অন্যরা হলেন না![2]

(২) ইমাম আবূ হানীফার বিরোধীগণ তাঁর নামে এমন কিছু মত উল্লেখ করেছেন যা তিনি কখনোই বলেন নি। তাঁর মত ভুল বুঝে বা ইচ্ছাকৃত ভুল ব্যাখ্যা করে তাঁর নামে এ সকল মত প্রচার করা হয়েছে।

(৩) ইমাম আবূ হানীফার যে সকল মত হাদীস বিরোধী বলে প্রচার করা হয়েছে এগুলির অধিকাংশের ক্ষেত্রে তাঁর মতের পক্ষে সহীহ হাদীস বিদ্যমান। কিছু মতের পক্ষে হাদীস না থাকলেও কোনো সাহাবী বা তাবিয়ীর মত বা কর্ম বিদ্যমান। প্রসিদ্ধ চার ইমাম ও অন্য সকল ফকীহের মাযহাব বা মতের মধ্যেই আমরা এরূপ কিছু মত দেখতে পাই, যার পক্ষে কোনো সহীহ হাদীস নেই বা তার বিরুদ্ধে সহীহ হাদীস রয়েছে। এ সকল ক্ষেত্রে ফকীহ মূলত সাহাবী বা তাবিয়ীগণের মতের উপর নির্ভর করেছেন।

(৪) ইমাম মালিক, ইমাম শাফিয়ী, ইমাম আহমদ, ইমাম আওযায়ী ও অন্য সকল ফকীহের ক্ষেত্রে অনেক সহীহ হাদীস পাওয়া যায় যেগুলি তাঁরা গ্রহণ করেন নি। বিভিন্ন অজুহাতে, যুক্তিতে বা কারণে তাঁরা তা বর্জন করেছেন। শুধু হাদীসগুলো উল্লেখ করে উক্ত ইমাম হাদীসটির বিরোধিতা করেছেন বলে লিখলে তা অজ্ঞতা বা বিদ্বেষের প্রকাশ বলে গণ্য হবে।

(৫) প্রসিদ্ধ মালিকী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবন আব্দুল বার্র (৪৬৩ হি) বলেন:


أفرط أصحاب الحديث في ذم أبي حنيفة وتجاوزوا الحد في ذلك والسبب والموجب لذلك عندهم إدخاله الرأي والقياس على الآثار واعتبارهما... وكان رده لما رد من أخبار الآحاد بتأويل محتمل، وكثير منه قد تقدمه إليه غيره، وتابعه عليه مثله ممن قال بالرأي وجل ما يوجد له من ذلك ما كان منه اتباعا لأهل بلده كإبراهيم النخعي وأصحاب ابن مسعود إلا أنه أغرق وأفرط في تنزيل النوازل هو وأصحابه والجواب فيها برأيهم واستحسانهم فأتى منه من ذلك خلاف كبير للسلف.. وما أعلم أحدا من أهل العلم إلا وله تأويل في آية أو مذهب في سنة رد من أجل ذلك المذهب سنة أخرى بتأويل سائغ أو ادعاء نسخ... عن الليث بن سعد أنه قال: أحصيت على مالك بن أنس سبعين مسألة كلها مخالفة لسنة النبي ﷺ مما قال مالك فيها برأيه.. ليس لأحد من علماء الأمة يثبت حديثا عن النبي ﷺ ثم يرده دون ادعاء نسخ عليه بأثر مثله أو بإجماع أو بعمل يجب على أصله الانقياد إليه أو طعن في سنده ولو فعل ذلك أحد سقطت عدالته فضلا عن أن يتخذ إماما ولزمه إثم الفسق.


মুহাদ্দিসগণ আবূ হানীফার নিন্দায় বাড়াবাড়ি করেছেন এবং এ বিষয়ে সীমালঙ্ঘন করেছেন। এর কারণ মুহাদ্দিসগণের দৃষ্টিতে তিনি কিয়াস ও ইজতিহাদকে হাদীসের মধ্যে ঢুকিয়েছিলেন এবং এদুটিকে গ্রহণ করেছিলেন। ... তিনি যে সকল হাদীস প্রত্যাখ্যান করেছেন তা গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যার ভিত্তিতেই করেছেন। তাঁর এ সকল মতের (যেগুলিকে হাদীস বিরোধী বলে প্রচার করা হয়) অধিকাংশই তাঁর পূর্বে অনেক আলিম গ্রহণ করেছেন এবং তাঁর পরেও যারা কিয়াস ও ফিকহ নিয়ে কথা বলেছেন তাদের অনেকেই এ সকল মত গ্রহণ করেছেন। তাঁর মাযহাবে হাদীস বিরোধী বলে কথিত যা কিছু রয়েছে তার প্রায় সবগুলিতেই তিনি ইবরাহীম নাখয়ী, আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদের ছাত্রগণ বা তাঁর দেশের (কূফার) অনুরূপ আলিমদের অনুসরণ করেছেন। তবে তিনি ও তাঁর সাথীরা এ সকল মতের ভিত্তিতে ইজতিহাদ করে সাম্ভাব্য ঘটনা ও শাখাপ্রশাখা বের করে সাম্ভাব্য সমস্যার সমাধান বলার গভীরে প্রবেশ করেছেন ও বেশি পরিমাণে করেছেন।... আমার জানা মতে প্রত্যেক আলিমেরই কুরআনের কোনো আয়াত বা কোনো হাদীসের ক্ষেত্রে নিজস্ব মাযহাব বা মত রয়েছে যার ভিত্তিতে তিনি অন্য একটি হাদীস গ্রহণযোগ্য একটি ব্যাখ্য করে বা নাসখ দাবী করে প্রত্যাখ্যান করেন। ... (মিসরের প্রসিদ্ধ ফকীহ) লাইস ইবন সাদ বলেন: আমি মালিক ইবন আনাসের ৭০টি মাসআলা বাছাই করেছি, যেগুলিতে তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর হাদীসের বিরুদ্ধে নিজের মত অনুসারে ফাতওয়া দিয়েছেন। .... উম্মাতের কোনো আলিমই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে একটি হাদীস তাঁর নিকট প্রমাণিত হওয়ার পরে তা কোনো কারণ ছাড়া প্রত্যাখ্যান করেন না। তিনি অন্য একটি হাদীসের কারণে এ হাদীস রহিত হয়েছে বলে দাবি করেন, অথবা ইজমার দাবিতে হাদীসটি প্রত্যাখ্যান করেন, অথবা এমন একটি কর্মের কারণে হাদীসটি পরিত্যাগ করেন, যে কর্মকে গ্রহণ করা তাঁর মূলনীতি অনুসারে জরুরী, অথবা তিনি হাদীসটির সনদ ত্রুটিযুক্ত বলে দাবি করেন। যদি কেউ কোনো কারণ ছাড়া কোনো সহীহ হাদীস প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে সে পাপী বলে গণ্য হবে। তার ন্যূনতম দীনদারীই বিনষ্ট হয়ে যাবে, ইমাম হিসেবে স্বীকৃত হওয়া তো অনেক দূরের কথা।’’[3]

প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ ইবন তাইমিয়া (৭২৮ হি) বলেন:


وَمَنْ ظَنَّ بِأَبِي حَنِيفَةَ أَوْ غَيْرِهِ مِنْ أَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ أَنَّهُمْ يَتَعَمَّدُونَ مُخَالَفَةَ الْحَدِيثِ الصَّحِيحِ لِقِيَاسِ أَوْ غَيْرِهِ فَقَدْ أَخْطَأَ عَلَيْهِمْ وَتَكَلَّمَ إمَّا بِظَنِّ وَإِمَّا بِهَوَى


‘‘যদি কেউ ধারণা করে যে, আবূ হানীফা অথবা মুসলিমদের অন্য কোনো ইমাম কিয়াস বা অন্য কোনো অজুহাতে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সহীহ হাদীসের বিরোধিতা করেছেন তবে তার ধারণাটি অন্যায় ও ভুল বলে গণ্য। ঐ ব্যক্তি হয় আন্দাজে, অথবা প্রবৃত্তির তাড়নায় এরূপ কথা বলেছে।’’[4]

প্রসিদ্ধ সৌদি মুহাদ্দিস শাইখ আলী ইবন নাইফ আশ-শাহ্হূদ বলেন:


ما اشتهر من أن أهل الرأي بضاعتهم في الحديث مزجاة كلام غير صحيح، ولا يدعمه الدليل ... فاتهامهم بأنهم أصحابُ رأي، وأنَّ بضاعتهم في الحديث مزجاةٌ فيه شططٌ كبيرٌ، وعصبيةٌ مقيتة. ... مثال ذلك : كان الإمام أبو بكر بن أبي شيبة من المخالفين لأهل الرأي، شديد التمسك بالأثر، ومن ثم فقد أحصى المسائل التي خالف فيها أبو حنيفة، رحمه الله السنَّة فبلغت- على حدِّ زعمه- مئة وأربعاً وعشرين مسألة لا غير... ومعنى هذا أن الإمام أبا حنيفة ... قد وافق السنَّة فيما سوى هذه المسائل القليلة وهي بعشرات الآلاف. ولو نظرنا في هذه المسائل التي ذكرها ابن أبي شيبة في ردِّه على الإمام أبي حنيفة رحمه الله لوجدنا ما يلي : أ - معظمها أمور مختلف فيها منذ عهد الصحابة لم ينفرد فيها الإمام أبو حنيفة . ب- أو أمور وجد ما هو أقوى منها فلم يعمل بها .


‘‘একটি কথা প্রসিদ্ধ যে, ‘আহলুর রায়’ (কিয়াসপন্থী বা হানাফীগণ) হাদীস কম জানেন। কথাটি সঠিক নয়। দলীল এ কথা সমর্থন করে না।... তাঁদেরকে কিয়াসপন্থী বলে অভিযোগ করা, হাদীস বিষয়ে তাঁদের জ্ঞান কম বলে দাবি করা বড় অন্যায়, সীমালঙ্ঘন ও ঘৃণ্য মাযহাবী কোন্দলের প্রকাশ। একটি উদাহরণ দেখুন। ইমাম আবূ বকর ইবন আবী শাইবা আহলুর রায় বা কিয়াসপন্থীদের ঘোর বিরোধী ছিলেন, হাদীস পালন করার বিষয়ে অত্যন্ত কঠোর ছিলেন। আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহ যে বিষয়গুলিতে হাদীসের বিরোধিতা করেছেন সে বিষয়গুলি তিনি গণনাকরে একত্রিত করেছেন। ইবন আবী শাইবার মতানুসারে আবূ হানীফা শুধুমাত্র ১২৪টি মাসআলাতে হাদীসের বিরোধিতা করেছেন। ... এর অর্থ ইমাম আবূ হানীফা মাত্র সামান্য এই কটি মাসআলা ছাড়া বাকি সকল মাসআলায়, হাজার হাজার মাসআলায় হাদীস অনুসরণ করেছেন। ইবন আবী শাইবা উল্লেখকৃত এ মাসআলাগুলি, যেগুলিতে তিনি ইমাম আবূ হানীফা রাহিমাহুল্লাহর মত খন্ডন করেছেন সেগুলি যাচাই করলে আমরা দেখি (১) এগুলির অধিকাংশই সাহাবীগণের যুগ থেকে মতভেদীয় মাসআলা, কোনোটিই ইমাম আবূ হানীফার একক মত নয়। অথবা (২) এগুলির মধ্যে এমন কিছু বিষয় রয়েছে যেগুলিতে ইমাম আবূ হানীফা ইবন আবী শাইবার উল্লেখ করা হাদীসের চেয়ে শক্তিশালী অন্য দলিল পেয়েছেন, যে কারণে তিনি এ হাদীস গ্রহণ করেন নি।’’

এরপর শাইখ শাহ্হূদ কয়েকটি উদাহরণ উল্লেখ করেছেন, যেগুলিতে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, ইমাম ইবন আবী শাইবা যে মাসআলার জন্য ইমাম আবূ হানীফাকে অভিযুক্ত করেছেন, তিনি নিজেই মুসান্নাফ গ্রন্থের অন্যত্র এ মত অনেক সাহাবী-তাবিয়ী থেকে উদ্ধৃত করেছেন এবং এ সকল মতের পক্ষে অন্য হাদীস রয়েছে।[5]

[1] ইবন আদী, আল-কামিল (শামিলা) ৭/৯; (মুদ্রিত) ৮/২৪০।

[2] ড. মুহাম্মাদ কাসিম আল-হারিসী, মাকানাতু আবী হানীফাহ, পৃ. ৩১৮-৫০৬।

[3] ইবন আব্দুল বার, জামিউ বায়ানিল ইলম ২/২৮৯।

[4] ইবন তাইমিয়া, মাজমূউল ফাতাওয়া ২০/৩০৪-৩০৫।

[5] আলী ইবন নাইফ আশ-শাহ্হূদ, আল-খুলাসাতু ফী আসবাবি ইখতিলাফিল ফুকাহা, পৃ. ১৯২-১৯৭।